মায়াডোর-২৯,৩০

0
342

মায়াডোর-২৯,৩০

(২৯ পর্ব)
.
কল্পকে মুনা খবরটা দেয় সন্ধ্যায়। কিন্তু কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না। ইতি হুট করে নানাবাড়ি চলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ কল্প কিছু একটা ভেবে মুনাকে তার নাম্বার দিয়ে বলেছে রুমকিকেও দিতে। ইতি কোনোভাবে খবর পাঠাতে পারে তাদের কাছে। মুনা নাম্বার নিয়ে চলে গেছে। কল্প আজও টিউশনিতে গেল না। খুবই চিন্তা হচ্ছে তার। ইতিকে এরা বন্দি করে রাখেনি তো? এখন আসলে সে কি করবে? কি করা উচিত? সুপ্তিকে কল দেয় কল্প। অনেক্ষণ কথা হয় তাদের। সুপ্তি পরামর্শ দেয় আপাতত বিয়ের প্রস্তাব দিতে৷ জোর করে তো আর বিয়ে দিয়ে দেবে না। কল্প পায়চারি করতে করতে বেলকনিতে গিয়ে তার মা’কে কল দেয়। মা বলেন এসব ঝামেলায় কেন জড়িয়েছে সে। কথায় কথায় রাগারাগি হয় তাদের। সে কল কেটে দেয়। পরেরদিন ভোরে হঠাৎ মনে হলো তাহিদকে সবকিছু খুলে বলবে সে। হয়তো সে ব্যাপারটা বুঝবে। বিয়ে ভেঙে দেবে। তখন আর ইতিকে আঁটকে রাখবে না ওরা। কিন্তু তাহিদের নাম্বার তার কাছে নেই। কল দেয় মা’কে। তিনি রিসিভ করলেন,

– ‘হ্যাঁ বল।’

– ‘মা তোমার সঙ্গে দেখা করেছিলাম না ইতির এক ফুপুর বাসায়। ওদের কারও নাম্বার কি আছে?’

– ‘হ্যাঁ আছে, কেন?’

– ‘তাহিদ ভাইয়ের নাম্বারটা দাও আমাকে।’

– ‘কেন, ওর নাম্বার দিয়ে কি করবি? কেন পাগলামি করছিস বাবা? এতদিনে ইংল্যান্ড…। ‘

কল্প থামিয়ে দেয়,

– ‘এসব আলাপ এখন রাখো মা, নাম্বারের দরকার আছে, তুমি পারলে দাও।’

– ‘এনে দিতে হবে। ওর মায়ের নাম্বার আছে।’

– ‘আচ্ছা এনে দাও। এখন রাখছি।’

সে গোসলে ঢুকে। গোসল শেষে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেইটের কাছে আসতেই মেসেজ টিউন বাজে। মনিরা বেগম তাকে নাম্বার দিয়েছেন। কল্প রিকশা ডেকে উঠে কল দেয় তাহিদকে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হয় ওপাশ থেকে।

– ‘হ্যালো তাহিদ ভাই বলছেন?’

– ‘হ্যাঁ আপনি কে?’

– ‘ভাই আমি কল্প। ইতিকে নিয়ে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। মনিরা যে উনার ছেলে।’

– ‘হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। কি খবর তোমার?’

– ‘ভাইয়া ভালো না। আপনাকে কিছু দরকারি কথা বলার জন্য কল দিয়েছি। বুঝতে পারছি না কিভাবে নিবেন।’

– ‘কি কথা, বলো কি বলতে চাও।’

– ‘ভাই কথাগুলো ভেবে দেখবেন। কারণ তাতে আপনারও ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।’

– ‘কি ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না৷ ভূমিকা ছাড়া স্পষ্ট বলো।’

– ‘আপনি এখন ফ্রি আছেন তো?’

– ‘হ্যাঁ আছি।’

– ‘ভাই ইতির সঙ্গে আপনার শুনলাম বিয়ের কথা হচ্ছে?’

– ‘হ্যাঁ, মা তো এমনিতেই বিয়ের জন্য পিছু লেগে আছেন৷ কিছুদিন আগে ইতির কথা বলায় রাজি হয়ে গেলাম।’

– ‘ভাই এই বিয়েটা প্লিজ আপনি ভেঙে দিন।’

– ‘আশ্চর্য কি বলো এসব!’

– ‘হ্যাঁ ভাই, আমার আর ইতির অনেক দিনের সম্পর্ক। এবং আমি জব করছি। সবকিছু গুছিয়ে বিয়ের আলাপ দিতে চাইছিলাম তার আগেই ঝামেলা হয়ে গেল।’

– ‘কি ঝামেলা? আর ইতিও তোমাকে ভালোবাসে তার প্রমাণ কি?’

– ‘ভাই আপনি ইতির সঙ্গে কথা বলে নিন। তাতেই হবে। আমিই বলতাম ইতিকে আপনার কাছে কল দিতে। কিন্তু ওরা মোবাইল কেড়ে নিয়ে ওরা বন্দি করে রেখেছে।’

– ‘কি বলো এসব। বন্দি করে রাখবে কেন?’

– ‘জানি না ভাই। হয়তো জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে।’

– ‘পাগল না-কি, জোর করে বিয়ে দিলে শেষে সমস্যা তো হবে আমার।’

– ‘এটুকু বলার ছিল ভাই। আমি আপনাকে স্ক্রিনশট কিছু পাঠাবো। আপনার কাছে বিয়ে না বসার জন্য ইতি শনিবার রাতে বাবাকে বলতে গিয়েছিল। এরপর থেকে সে অফলাইনে। কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারছি না। একবার ভাবুন এভাবে বিয়ে হলে আমরা তিনজনেরই জীবন নষ্ট হবে।’

– ‘তুমি এখন ফোন রাখো কল্প। আমি দেখছি ব্যাপারটা।

কল্প ফোন রেখে রোজকার মতো অফিসে চলে যায়।

হুস্না বেগমের মোবাইল বেজে উঠে দুপুর দুইটার সময়। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাহিদ সালাম দিয়ে বলে, ‘মামী ইতি কোথায়?’

– ‘কেন বাবা?’

– ‘ওর সাথে কথা বলবো আমি।’

– ‘ও তো ঘুমে এখন।’

– ‘তাহলে ওর মোবাইল বন্ধ কেন?’

– ‘কি হয়েছে বলো তো বাবা।’

– ‘মামী আমি মা’কে দিয়ে কল দেওয়াতে পারতাম। নিজেই দিয়েছি। কারণ আমি ইতির মুখ থেকে স্পষ্ট জানতে চাই সে আমার কাছে বিয়ে বসতে রাজি কি-না।’

– ‘কি যে বলো তুমি তাহিদ। আমরা রাজি আছি যেখানে। ওর আবার দ্বিমত কি হবে?’

– ‘ওর দ্বিমত হলে বিয়ের পর ঝামেলা হবে না?’

– ‘বিয়ের পর ওসব ঠিক হয়ে যায় বাবা। এগুলো তুমি ভেবো না।’

– ‘জোর করে বিয়ে দিলে ঠিক হয় না। উল্টো আমার জন্য যন্ত্রণা হবে। আমি জেনেছি ইতির কল্পের সাথে রিলেশন ছিল।’

হুস্না বেগম খানিক থমকে যান। তারপর নিজেকে সামলে হেঁসে বলেন, ‘আরে এগুলো কিছু না। ওই ছেলে তাবিজ-কবচ কিছু করছিল। আর মেয়েটার বয়স কম তো, তাই পাগলামি করেছে। এখন এসব ভুলে গেছে।’

– ‘মামী ধামাচাপা দেন, আর যাই করেন। মেয়েকে আগে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করান। জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে দিলে আমি এসবে নাই। ওর রিলেশন ছিল বা আছে তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সে এখন আমার কাছে বিয়েতে রাজি কি-না এটা শুধু আমি দেখবো।’

– ‘হ্যাঁ রাজি তো বাবা। এগুলো ভেবো না।’

– ‘মামী বুঝতে পারছো না৷ শেষপর্যন্ত বিয়ে কিন্তু করবো না আমি। এখন তোমরা জোরাজুরি করছো আমি জানি। তাই সময় নিয়ে বুঝাও। বিয়ের আগে আমি ওকে ঠিকই জিজ্ঞেস করবো রাজি কি-না। তাই ধামাচাপা না করে বুঝানোর চেষ্টা করো। আর না পারলে আমার সঙ্গে বিয়ে ভে*ঙে দাও। রাখলাম এখন৷’

হুস্না বেগম মোবাইল রেখে বিছানায় বসে পড়েন। মাথা দপদপ করছে। মুজিব উদ্দিন বাজারে চলে গেছেন৷ কাকে বলবেন এই বিপদের কথা? তিনি চাবি নিয়ে দরজা খুলে ইতির রুমে যান৷ অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে আছে ইতি। রুমে আলো দেখে উঠে বসে সে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ চুলগুলো জট-পাকানো। হুস্না বেগম বিছানায় এসে বসে ওর গাল টিপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘যে নাগরের জন্য মরে যাচ্ছিস সে কি করেছে জানিস? বে*জন্মাটা তাহিদকে সব বলে দিছে৷ এখন দেখ কার জন্য মরে যাচ্ছিস? সে কি তোর ভালো চায়? ভালো চাইলে এই কাজ করতো? যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছি তার কাছে ব*দনাম করে বিয়ে ভে*ঙে দিতে চাইছে। সে তো শ*ত্রু। তোর ব*দনাম বলে ভে*ঙে দেওয়ার পায়তারা করে। কেমন শ*য়তানের ঘরের শ*য়তান। এমনিতে মনে হতো একেবারে ফেরেশতা। যাকে যত ফেরেশতা লাগে৷ সে হয় আরও বড়ো শয়*তানের বাচ্চা। আর তাতে হয়েছে কি? বিয়ে কি ভে*ঙে দিতে পারছে? তাহিদ কি ওর মতো ছেলে? তাহিদ উল্টো বলেছে অতীতে যাইই করুক ইতি। যদি সে এখন আমার কাছে বিয়ে বসতে চায় তাহলে আমি বিয়ে করবো। দেখেছিস কেমন সুবোধ ছেলে তাহিদ? টাকা-পয়সা, বংশ সবদিক থেকেই তাহিদ যোগ্য পাত্র। তাই বলছি এসব ঘ্যা*ড়ত্যা*ড়ামো বাদ দিয়ে রাজি হয়ে যা৷ তাহিদের সঙ্গে কথা বল। দেখবি ভালো লাগবে৷ কল্প আর তাহিদের মাঝে আলাদা কি আছে? তাহিদও ছেলে কল্পও ছেলে। উল্টো তাহিদ ডাক্তার। টাকা-পয়সার অভাব নেই।’

– ‘মা কেন ব্যর্থ চেষ্টা করছো? আমি মরে গেলেও কল্পকে ছাড়া বিয়ে করবো না। এই যে এই রুমে আমাকে রেখেছো। জানো? এই রুমে আমি মরে গেলেও শান্তি পাব? এই রুমটায় কল্প থাকতো। আমার কাছে এই রুমের সবকিছু বড়ো আপন। তোমরা যত যাইই করো, আমার উল্টো ভালো লাগছে। গর্ব হচ্ছে। আমি কল্পের জন্য কষ্ট করছি..।’

কথা শেষ করার আগেই হুস্না বেগম চুলের মুঠি ধরে গালে ‘ঠাস’ করে চ*ড় দিয়ে বললেন, ‘তুই ওই বে*জন্মা, রাস্তার ছেলেকে কখনও পাবি না। বিয়ে করলে তাহিদকেই করা লাগবে। নির্লজ্জ মেয়ে। এসব যে বলিস লজ্জা করে না?’

ইতি চুল থেকে হাত টেনে সরিয়ে বলে, ‘অকারণ ওকে কেন গালি দাও? আমি জানি কল্প কেমন মানুষ। আর আমি নির্লজ্জ হতে যাব কেন? ও আমার স্বামী। বিয়ে না করলেও আমি স্বামী মনে করি। শুধু সময়-সুযোগের অভাবে আমরা কাগজপত্রে বিয়েটা করিনি। আমাদের দু’টি মনের সেই পবিত্র বন্ধন বহু আগে থেকে হয়ে গেছে। ওর কথা বলতে আমার কোনো লজ্জা করে না মা।’

হুস্না বেগম আর রাগ ধরে রাখতে পারেন না। গলা চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, ‘মনটা তো চায় গলা টিপে মে*রে ফেলিরে ন*টি। সিনেমা দেখে দেখে এগুলো শিখেছিস তাই না? জীবনটাকে সিনেমা পেয়েছিস?’

– ‘নাটক-সিনেমা তো মানুষকে দেখেই বানায় মা। এগুলো আমার মনের কথা। আমার সকল সুখ শান্তি ওই কল্পের বুকে…।’

– ‘কি পেয়েছিস এই খা*নকির ছেলের কাছে? লজ্জা করে না বাপ এসে রাতে অন্ধকার রুমে পেয়েছিল? আমার পেটে তোর মতো খা*নকি কিভাবে জন্ম নিল কিভাবে? বল আমারে?’

– ‘বাজে কথা বলো না মা। আমি নির্লজ্জের মতো হতে চাইনি। শুধু বিয়ে করতে চাই না বলতে গিয়েছিলাম। তোমরাই বাড়াবাড়ি করছো।’

– ‘বিয়ে করবি না কেন? তাহিদের সঙ্গে বিয়ে হলে ভেবে দেখ তোর জীবন কেমন হবে? ঢাকা শহরে থাকবি, নিজের বাসা। ডাক্তার ছেলে। টাকা-পয়সার অভাব নেই। দেশ-বিদেশ ঘুরবি। দামি জামা-কাপড় গহনা পরবি।’

ইতি ফ্যাকাসে মুখে হাসে৷ তারপর দূর্বল গলায় বলে, ‘আর শান্তি? তুমি যা কিছু বললে এগুলো তো নীচু মনের মানুষদের কাজ। যারা অন্যকে দেখানোতে ব্যস্ত। আমি চাই নিজের সুখ-শান্তি। একটা গহনা গায়ে দিলে কি হয়? আরেকজন দেখে বলে বাহ বড়োলোক? তাতে আমার কি? আমার গহনা, দামি পোশাক থেকেও শান্তি কল্পের সঙ্গে থাকতে পারা।’

হুস্ন বেগমের রাগে গা আরও জ্বলে উঠে। চুলের মুঠি ধরে আবার টেনে ধরে পিঠে একের পর এক ঘু*সি মারতে মারতে বলেন,

– ‘তোরে আমার মে*রে ফেললেও মেজাজ ঠাণ্ডা হবে না। এই খা*নকি তোর লজ্জা-শরম কি নাই? এগুলো মুখে আনিস কিভাবে? ওই বে*জন্মার ঘরের বে*জন্মা জাদু-টোনা করছে না-কি? বল আমারে বল?’

ইতির হঠাৎ কি যে হলো। বারবার কল্পকে গালি দেওয়া সে সহ্য করতে পারছে না। আচমকা জোরে ধাক্কা মা*রে মা’কে। হুস্না বেগম ছিটকে গিয়ে পড়েন মেঝেতে। ইতির মাথায় হঠাৎ কিছু একটা আসে। পলকে বিছানা থেকে পা বাড়িয়ে চলে যায় টেবিলে। সেখান থেকে এক লাফে রুমের বাইরে আসে। হুস্না বেগম তাড়াতাড়ি উঠে ‘এই দাঁড়া’ বলে তেড়ে আসার আগেই সে বাইরে থেকে দরজা তালা মেরে দেয়। তারপর আর পিছু ফিরে তাকায় না ইতি। ছুটে যেতে চায়। কিন্তু বারান্দা পেরিয়ে এসেই করিডরের সামনে থমকে দাঁড়ায়।
(আজ রাতেই আরেক পর্ব আসতে পারে। রাতে ঘুমানোর আগে একবার পেইজে উঁকি মে*রে যাবেন)
_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

মায়াডোর (৩০ পর্ব)
.
করিডরে নীলা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই সে মুখ ফিরিয়ে তাড়াতাড়ি রুমে চলে যায়। ইতি খানিক থামে। চারদিকে তাকায়। বারান্দার দড়িতে শুকোতে দেয়া একটা ওড়না টেনে এনে মাথায় দেয়। তাড়াতাড়ি গ্রিলের দরজা খুলে উঠানে নামে। আর পিছু ফিরে তাকায় না সে। দ্রুতপদে উঠান পেরিয়ে গেইট খুলে রাস্তায় আসে৷ একটা খালি রিকশা যাচ্ছিল, হাত তুলে থামায় ইতি। রিকশায় উঠে বসে বলে, ‘মেইন রাস্তার মোড়ে যান।’

মুনাদের বাসার সামনে নেমে বলে, ‘ভাই একটু দাঁড়ান, আমি ভাড়াটা ভেতর থেকে এনে দিতে হবে।’

রিকশাওয়ালা প্যাডেল চেপে বললো, ‘না থাকলে বাদ দেন আফা।’

ইতি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তবুও চলে গেল রিকশা। তাড়াতাড়ি সে গেইট খুলে ভেতরে গিয়ে বেল চাপে। দরজা খুলে এসে কাজের মেয়ে। ইতি ভেতরে গিয়ে বললো, ‘মুনা কোথায়?’

– ‘বসেন ডেকে দিতাসি।’

মেয়েটি গিয়ে মুনাকে আনে। অবাক হয় মুনা।

– ‘আরে তুই! তুই না-কি নানাবাড়ি চলে গেছিস। তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।’

ইতি কাজের মেয়ের দিকে তাকায়। তারপর ইতস্তত করে বলে, ‘তোর সঙ্গে কথা আছে মুনা।’

– ‘আয় আমার রুমে আয়। তোর এই অবস্থা কি?’

ইতি জবাব না দিয়ে ওর পিছু পিছু রুমে যায়। তারপর দরজা ভেজিয়ে বলে, ‘তাড়াতাড়ি কল্পকে কল দে মুনা, আমি পালিয়ে এসেছি।’

– ‘বলিস কিরে? আর তোর মুখে মা*রের দাগ না-কি এগুলো।’

– ‘হ্যাঁ আমি বন্দি ছিলাম এই কয়দিন। তুই আগে কল্পকে কল দে।’

মুনা তাড়াতাড়ি কল দেয় কল্পকে। একবার কল হতেই রিসিভ হয়।

– ‘কল্প ভাইয়া আপনি কোথায়?’

– ‘আমি তো অফিসে। কেন কোনো সমস্যা?’

– ‘ভাইয়া ইতি তো আমার বাসায়। ও পালিয়ে চলে এসেছে। এই কয়দিন বন্দি ছিল সে।’

– ‘বলো কি? আচ্ছা আমি আসছি।’

– ‘কিন্তু ভাইয়া আমার মা জানলে তো রাগ করবে। ওকে এখানে বেশি সময় রাখা যাবে না৷ পালিয়ে এসেছে শুনলে মা রাগারাগি করবে।’

– ‘উনি বুঝবে কিভাবে?’

– ‘ওকে দেখলেই বুঝা যাবে। ওর মুখে মা*রের দাগ। চোখের নিচে কালি। চুল-টুলের অবস্থা নাই। দেখেই বুঝা যায় সমস্যা কিছু আছে।’

– ‘মুনা তুমি এখনই ওকে গোসল করাও। আমি ড্রেস আনব আসার সময়। চেঞ্জ করলে খুব একটা বুঝবে না৷ তুমি বলবা অসুস্থ ছিল সে। প্লিজ এই হেল্পটুকু করো।’

– ‘আচ্ছা আপনি আসুন আগে ভাই।’

কল্প কল রেখে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়। একটা রিকশায় বসে মা’কে কল দিয়ে পুরো ঘটনা বলে। ইতি পালিয়ে এসেছে শুনে তিনি বললেন। বাসায় ফিরিয়ে দিতে। এভাবে ঝামেলা হবে। মামলা-মোকদ্দমা হবে। অনেক্ষণ কথা বলে কল্প কল রেখে দেয়। রিকশায় বসে মুখ আঁজলা করে মুখ ঢেকে দ্রুত চিন্তা করে কি করবে এখন। এই মুহূর্তে ইতিকে নিয়ে সরা দরকার। পুলিশকে টাকা খাইয়ে নিয়ে এলে প্রাপ্ত-বয়স না খুঁজেই ঝামেলা করবে। নিপাকে সে একটা রেকর্ড দিতে হবে বিস্তারিত বলে। চাচাকে ম্যানেজ করে ফেললে বাড়িতে আপাতত নিয়ে চলে যেতে পারবে সে। এরপর যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নিতে পারবে৷ না-কি এখনই কাজি অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে? কল্প মুনা মঞ্জিলের সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে প্রথমেই নিজের রুমে আসে। এসেই মনে পড়ে যায় ড্রেস আনতে ভুলে গেছে সে। মুনাকে মেসেজ দিয়ে জানায়। রিপ্লাইয়ে সে বলে তার একটা ড্রেস পরিয়ে দিয়েছে। কল্প নিপাকে একটা দীর্ঘ রেকর্ড পাঠায়। কখন সিন করবে কে জানে। তবুও রেকর্ড আগেই দিয়ে রাখা ভালো। কিছু ছবিও দিয়েছে ইতির। এতদিন দেয়নি নিপাকে। তাড়াতাড়ি তার একটা ব্যাগে কাপড় ভরে নেয়। আগে ইতিকে নিয়ে শহর ছাড়তে হবে৷ এরপর বাকি ভাবনা। আজ বৃহস্পতিবার। হাতে এমনিতেই দু’দিন ছুটি আছে। ব্যাগ-প্যাক নিয়ে রাস্তায় এসে একটা সিএনজি ডাকে। গেইটের সামনে সিএনজি রেখে মুনাকে কল দিয়ে বলে ওকে বাইরে পাঠাতে। মুনা ইতিকে বের করে দেয়। কল্প সিএনজিতে উঠে বসে আছে৷ ইতিকে দেখে সে অবাক হয়। এই কয়দিনে মেয়েটার চেহারা-ছবি একদম পালটে গেছে।

– ‘আসো ইতি।’

ইতি এসে উঠে বসে। সিএনজি চলতে শুরু করে। কল্প পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে ব্যগ্র গলায় বলে, ‘এ কি অবস্থা হয়েছে ইতি? ওরা এরকম করলো কেন?’

ইতি কোনো কথা বলতে পারে না৷ মুখ গুঁজে দেয় তার বুকে। কেঁপে কেঁপে উঠে কান্নায়। কল্প চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘কিন্তু আমি তো তাহিদ ভাইকে সব বলেছি। পালিয়ে না এলেও হয়তো সমাধান হতো।’

ইতি চোখ মুছে বললো, ‘না ওরা আপনার কাছে বিয়ে দিবে না। তাহিদ ভাইয়ের কাছেই দিবে।’

– ‘কিন্তু তাহিদ ভাই তো বিয়ে করবে না।’

– ‘কে বলছে করবে না। সে মা’কে বলেছে আমাকে রাজি করাতে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তো এখন চলে এসেছো। আমি তাদের কল দিয়ে বলি পালিয়ে যেহেতু এসেছে এখন তো চাইলেই বিয়ে করতে পারি। এরচেয়ে মেনে নিক। দুই পরিবার ভালোভাবে মিলেমিশে বিয়ে হবে।’

– ‘এই কাজ জীবনেও করবেন না। আপনি কি আমাকে বোঝা মনে করছেন? করলে নামিয়ে দিন। আমি যেদিকে ইচ্ছা চলে যাব। ওরা নিয়ে ঠিকই আর বিয়ে দেবে না।’

কল্প ওর গালে হাতে রেখে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কপালে চুমু খায়।

– ‘এসব বলো না ইতি। আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি একদম চিন্তা করো না।’

কল্প দ্রুত ভাবছে এখন কোথায় যাবে। বিয়ে ছাড়া তাদেরকে এই মুহূর্তে কেউ বাসা ভাড়াও দেবে না। আর আজই বিয়ে করলে চারদিক থেকে সমস্যায় পড়বে। নানাবাড়িতে গেলে রিস্ক হয়ে যাবে। মামার সঙ্গে ওরা যোগাযোগ করে চলে যেতে পারে। তবে নিপা যদি চাচাকে ম্যানেজ করে ফেলে তাহলে বাড়িতে নিয়ে চলে যাবে সে। ছোটচাচা তখন এমনিতেই বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। আপাতত ঘর-দোর ঠিক করে নেয়া দরকার। সে চাচিকে কল দিয়ে বললো বাড়িতে যাবে। সঙ্গে একজন মেহমান আছে৷ তার ঘর-দোর যেন একটু পরিষ্কার করে রাখেন। সিএনজি শহরের অনেক অলিগলি পেরিয়ে অন্যপ্রান্তে চলে এসেছে দেখে কল্প বললো, ‘ভাই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে রাখবেন। কিছু খাওয়া দরকার।’

ইতি চুপচাপ বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। কল্প মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘ইতি কিছু বলছো না যে। এখন কি করবে?’

– ‘আপনার যা ইচ্ছা করেন।’

– ‘এই কয়দিন খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?’

– ‘আপনার বুকে মাথা রেখে আছি। আমার সব কষ্ট এই প্রশান্তির কাছে কিছুই না। ওসব ভাববেন না।’

– ‘ওইদিন যে ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম কিছু। সেগুলো আজ একটা রেকর্ডের সঙ্গে নিপাকে পাঠিয়েছি। চাচা-চাচিকে দেখাতে বলেছি।’

– ‘এগুলো ছাড়া আমার কোনো ছবি আপনার কাছে নেই তাই না?’

– ‘না।’

– ‘আপনি আমার কাছে কখনও ছবিও চাননি।’

– ‘হ্যাঁ, তাইতো, চাইনি কখনও কেন যেন।’

– ‘মিস করলে তো চাইবেন।’

কল্প মুচকি হেঁসে চুমু খেয়ে বললো, ‘মিস ঠিকই করি ম্যাডাম। তবুও কেন যেন ফোনে চুমু কিংবা রোমান্টিক কথা, ছবি চাওয়া এসব আমার আসে না।’

ইতি আরেকটু নিবিড় হয়ে জড়িয়ে ধরে ‘ওম-ওম’ গলায় বলে, ‘আমার ভাবের দোকানদার যে তাই।’

– ‘তোমার জন্য কাপড়-চোপড় কিছু কিনা দরকার ইতি। আমি মুনাকে বলেছিলাম তোমাকে গোসল করাতে, আমি ড্রেস নিয়ে যাব। কিন্তু শেষে ভুলে গিয়েছিলাম।’

– ‘পরে এসব ভাববেন। যেখানে নিয়ে যাবেন কাপড়ের দোকান নিশ্চয় মিলবে।’

– ‘তা মিলবে।’

সিএনজি চালক একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামিয়ে বললো, ‘এখানে দেখেন হবে কি-না, না হলে সামনে আরও রেস্টুরেন্ট আছে।’

– ‘এটাতেই হবে। ইতি নামো। আর আপনিও আসেন ভাই।’

তিনজন নেমে খাবার-দাবার খেয়ে এলো।
সিএনজি ড্রাইভার সিটে বসে আমতা-আমতা করে বললো, ‘ভাই সিএনজি তো মহাসড়কে গেলে প্রব্লেম। পুলিশ ঝামেলা করে। তাছাড়া আপনাদের ব্যাপারটাও বুঝতে পারছি, তাই রিস্ক নিয়ে না যাওয়াই ভালো।’

কল্প খানিক ভেবে বললো, ‘তাহলে আর কি করার, বাস স্টেশনেই নিয়ে যান।’

_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here