মায়াবন_বিহারিণী?,০৪,০৫

0
711

#মায়াবন_বিহারিণী?,০৪,০৫
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্থ_পর্ব

১০.
মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে একদিন। গত পরশুদিনের মতো গতদিনও বেশ অস্বস্তিতে কেটেছে উপমার। আমেনা বেগম আর ইফতেখার সাহেবকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে সে। ইফতেখার সাহেব ও কেমন যেন চুপচাপ নির্বাক ভঙ্গিমায় বাড়িতে আসা যাওয়া করছেন। আমেনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে কথা শোনালেও কানে নেয়না সে। আজ বেশ সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত জমিলা খাতুনের বাড়ির দিকে পা বাড়ায় উপমা। দূর সম্পর্কের চাচি হলেও নিজ সন্তানের মতো বেশ স্নেহ করে তাকে। জমিলা খাতুনের বাড়ির সামনে গেলেও কেন যেন ভেতরে আর প্রবেশ করতে মন চাইলো না উপমার। চাচি যদি ঘটে যাওয়া কোনো প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে কি জবাব দিবে সে?
তাই একরাশ মন খারাপ নিয়ে তার পাশে থাকা পুকুর ঘাটের কাছে পা বাড়ায় উপমা। এই পুকুরপাড়ের আশেপাশে সচরাচর কারো আনাগোনা হয়না তেমন। পুকুর ধারে থাকা থাকা বিশালাকার বকুল গাছটার নিচে বকুল ফুলের স্তুপ জমা হয়েছে। হয়তো কোন এক দমকা হাওয়ায় গাছের বেশিরভাগ ফুল মাটিতে ঝড়ে পড়েছে। অন্যান্য দিন হলে খুশিমনে গিয়ে বকুল ফুল গুলো কুড়িয়ে শাড়ির আঁচলে পুড়ে নিত উপমা কিন্তু আজকে তার ঠিক উল্টো ঘটল। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে পুকুরপাড়ের ঘাটলার সিঁড়ি ডিঙিয়ে খানিকটা নিচের দিকে চলে যায় সে। অতঃপর পায়ের একাংশ পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ে উপমা। পুকুরের হালকা ঘোলাটে পানিতে স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে তার। আশপাশে জমা শ্যাওলার মাঝে বেশ কয়েকটা লাল পদ্ম ও ফুটেছে। হুট হাট কোনো কারণে মন খারাপ হলেই এখানে ছুটে আসে উপমা।
পানিতে থাকা প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উপমা। চোখে মুখে মলিনতার‌ রেখা, উদাসী ভাব। আন‌মোনা হয়ে চারপাশে পড়ে থাকা ছোট ছোট নুড়ি পাথর গুলো হাতে নিয়ে সামনে থাকা পানিতে ছুড়ে দিতেই পানির তরঙ্গে প্রতিবিম্ব সামান্য এঁকেবেঁকে যায়।

– “উপমা? এই উপমা? কই তুই?”
হঠাৎ কারো পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সামান্য পরিমাণ হকচকিয়ে যায় উপমা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই হৈমন্তীর হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ে তার‌। একপ্রকার দৌড়ে হাঁপিয়ে এসে পুকুরঘাটে থামে হৈমন্তী। অনেকদূর দৌড়ে আসায় শ্বাস প্রশ্বাসের গতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে তার। হৈমন্তীকে এভাবে হাঁপিয়ে উঠতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। নির্বিকার ভঙ্গিমায় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “কি হইছে? এভাবে হাঁক ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করতেছিস ক্যান? কিছু হইছে?”

উপমার প্রশ্ন শুনে হৈমন্তী হাতের ইশারায় পেছনের দিকে তাক করে।
– “কি হইছে? পেছনে কি? কেউ আসতেছে?”
– “ক্যাম্প! ক্যাম্পে কাইল শহর থাইকা ডাক্তার আইছে। বেশ বড়সড় ডাক্তার।”
হৈমন্তীর কথায় মুহূর্তেই নড়েচড়ে বসে উপমা। কিন্তু এখান থেকে উঠে ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা তার মোটেও জাগ্রত হলো না। উল্টো সেখানে ঠায় বসে থেকেই বলে ওঠে,
– “হুম তো? তারা আইছে গ্রামে সেবা করার জন্য। মাসের নির্দিষ্ট দিন শেষ হইলে আবার শহরে চইলা যাবে।”

উপমার এমন ভাবলেশহীন জবাবে অবাক হয় হৈমন্তী। কেননা বরাবরের মতোই এই ডাক্তারি বিষয়টার প্রতি উপমার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। ক্যাম্পে প্রতিবার ডাক্তার আসার খোঁজ পেলে উপমাই সবার আগে ছুটে যায় সেখানে। তবে আজ কি হলো? আজ তার জবাব এমন রূঢ় আর অদ্ভুত কেন?
– “তুই কি ঠিক আছিস উপমা? তোর চেহারা সুরত এমন শুকাইয়া আছে ক্যান? বাড়িত কি চাচি চাচায় কিছু কইছে?”
হৈমন্তীর কথায় মৃদু হাসে উপমা। সে হাসি বড়ই রহস্যময়ী। তবে কাউকে এখনিই কিছু মুখ ফুটে বলতে চায় না সে। শুধু শুধু নিজের সাথে অন্যের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে কি লাভ? হৈমন্তী হচ্ছে উপমার সমবয়সী। একই সাথে পড়াশোনা করলেও হৈমন্তী হচ্ছে সবচেয়ে ভালো বন্ধু যাকে অনায়াসেই মনের সব কথা বলে উপমা। কিন্তু আজ মনে জমা সব কথা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায় সে। প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্য বলে উঠে,
– “আজকাল তোর চোখ একটু বেশিই গোয়েন্দাগিরি শুরু করছে হৈমন্তী। আমার আবার কি হইব? আমার চোখ মুখ সবই ঠিক আছে। এখন কথা না বাড়াইয়া চল ক্যাম্পে যামু। অনেকদিন ধরে যাওয়া হয় না।”
উপমাকে কিয়ৎক্ষণের মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে দেখে আবারও অবাক হয় হৈমন্তী। তবে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না। কেননা সে ভালো করেই জানে উপমা ঠিক সময় এলে নিজ থেকেই সবটা বলবে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায় উপমা। তারপর হাঁটা শুরু করে ক্যাম্পের পথে।

১১.
সকাল থেকে শুরু করে একটানা ডিউটি করে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিল আবেগ। ডাক্তারি লাইফে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু আগেই দুজন রোগীকে দেখে ঔষধপত্র দিয়ে বিদেয় দিয়েছে সে। ডক্টর সায়ান ও অন্যপাশে রোগী দেখছে হয়তো। পুরো রুমে ভীড়ভাট্টা‌ বেশ কমে যাওয়ায় চেয়ার টেনে একপাশে বসে পড়ে আবেগ। বাইরে একপলক তাকাতেই সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি চোখে এসে পড়ে তার।
হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে খেয়াল করতেই দেখে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে অনেক আগেই। শরীর বেশ ক্লান্ত হওয়ায় চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিতেই চোখ প্রায় লেগে আসে আবেগের। টেবিলের উপর এককোণে পড়ে থাকা ফোনের ভাইব্রেশনে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় আবেগ। ফোনটা তার নিজস্ব শব্দে পুনরায় বেজে উঠতেই একপ্রকার বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে তুলে নেয় আবেগ। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ দিয়ে কারো থমথমে, গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে,
– “কেমন আছো আবেগ?”
পরিচিত সেই কন্ঠস্বর! দীর্ঘ তিন মাস পর ফের সেই কন্ঠ শুনতে পেয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ চমকে ওঠে আবেগ। সে তো মানুষটার সাথে স্পষ্ট ভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তবে আজকে আবার কি প্রয়োজনে ফোন দিয়েছে সে?
– “আবেগ?”
পুনরায় অপর পাশ দিয়ে কথা ভেসে আসতেই গলা খাঁকারি দেয় আবেগ। অতঃপর বেশ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “মিস্টার আহিল শাহরিয়ার, আপনি? আপনার আমাকে ফোন করার বিশেষ কোনো কারণ?”
– “আবেগ! নিজের বাবার সাথে এভাবে কথা বলার মানে কি? ভুলে যেও না সম্পর্কে আমি তোমার বাবা হই।”
– “ভুলিনি মিস্টার শাহরিয়ার, কিছুই ভুলিনি আমি। শুধু আপনিই ভুলে গিয়েছিলেন আপনার দায়িত্ব, আপনার সম্পর্ক। সেসব প্রসঙ্গ না টেনে সরাসরি বলুন কি প্রয়োজনে ফোন দিয়েছেন আপনি?”
আবেগের এমন কথায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ উঠলেও নিজেকে দমিয়ে নেন শাহরিয়ার সাহেব। পরবর্তীতে অপর পাশ থেকে শাহরিয়ার সাহেবের কথা কর্ণপাত হতেই রাগে কান গরম হয়ে আসে আবেগের।

ক্যাম্প থেকে সারি সারি মানুষ বের হচ্ছে। আর সেটা দেখে উপমা আর হৈমন্তীও পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করে ক্যাম্পের দিকে। দু পাশে দুটো ক্যাম্প রয়েছে; হয়তো রোগীর সংখ্যা খুব বেশি তাই। অন্যান্য গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত থাকলেও ত্রিমোহিনী তা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও তা গ্রামের শেষ মাথায় এবং জনমানবশূন্য। তাই প্রতিবছর মাসের নির্দিষ্ট কিছু সময় শহর থেকে বেশ বড় বড় ডাক্তার রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। আর এবারও তাই করা হয়েছে।
প্রথমে পা টিপে টিপে বাম পাশের ক্যাম্পে যায় উপমা। দুজন মধ্যবয়স্ক ডাক্তার ঘুরঘুর করে প্রতি রোগীদের চেকআপ করছে। একজন বসে রোগীর ব্লাড প্রেসার মাপছে হয়ত।
– “এই হৈমন্তী! এইখানে তো যাওয়া সম্ভব না এখন। ভেতরে গেলে নিশ্চিত রোগী ভাইবা প্রশ্ন করা শুরু কইরা দিব। রোগী মানুষ দিয়া গমগম করতেছে।”
ভেতরের দিকে সামান্য উঁকি মেরে হৈমন্তীকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে উপমা। হৈমন্তীও কথায় সায় দেয় তার।
– “এক কাজ কর, ওপাশের কামরায় গিয়ে দেখে আসি কেউ আছে কিনা?”
যেমন ভাবা তেমন কাজ। এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে ক্যাম্পের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় উপমা। দরজাটা হাল্কা চাপানো। ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরের দিকে উঁকি দিতেই খেয়াল করে পুরো রুমে কোথাও কেউ নেই।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাবধানতার সহিত ভেতরে প্রবেশ করে উপমা। মাঝারি কামরাটায় দু চারটে বেড, চেয়ার আর টেবিল রয়েছে। টেবিলের উপর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী রাখা হয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা নেমপ্লেট হাতে তুলে নেয়। সেটাতে ইংরেজিতে গুটি গুটি অক্ষরে লিখা রয়েছে “Dr. ‌ Shahriyar Abeg‌”। তার মানে এখানে আসা নতুন ডাক্তারের নাম কি আবেগ? নামটা পড়তেই মৃদু হাসে উপমা। আবেগ! নামটা বেশ মোহনীয় তো!

– “কে ওখানে? কে আপনি? কোনো কিছু প্রয়োজন ছিল?”
পেছন থেকে কারো গম্ভীর শীতল পুরুষালি কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় উপমা। থাকে থাকা নেমপ্লেট টাও মৃদু শব্দে টেবিলের উপর পড়ে যায়।…………..

#চলবে ?

#মায়াবন_বিহারিণী?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চম_পর্ব

১২.
রুক্ষসুক্ষ গম্ভীর মুখশ্রী। চোখ দুটোও বেশ গভীর। সাদা অ্যাপ্রন‌ পরিহিত, গলায়ও একটা স্টেথোস্কোপ ঝোলানো। আবেগের শীতল কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে উপমা। একরাশ ভয় নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই আবেগের মুখ দর্শন হয় তার। ২৫-২৬ বছর বয়সী উজ্জ্বল বর্ণের মানব; যার মুখশ্রী জুড়ে গম্ভীরতার‌ ছাপ।
এদিকে সামনে থাকা সদ্য কিশোরীর দিকে চোখ যেতেই চিন্তায় বিলীন হয়ে যায় আবেগ। এই মেয়ে কে? কোনো প্রয়োজনে এসেছে নাকি?

– “এই মেয়ে? কে তুমি? ওখানে কি করছো টেবিলের কাছে? দেখ নি ওপাশের ক্যাম্পে রোগী দেখা হচ্ছে?”
শীতল পুরুষালি কন্ঠে প্রশ্ন শুনে বেশ থতমত খেয়ে যায় উপমা। কি বলবে সে? সে কোনো রোগী নয় কিংবা এখানে চিকিৎসা করাতেও আসে নি? সামনে থাকা কিশোরীর এমন নীরবতা পালন করা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। মেয়েটা কি তার কথা শুনতে পায়নি; নাকি ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি?
– “কি হলো? তুমি কি শুনতে পাওনি? এখানে কি করছো?”

পুনরায় আবেগের প্রশ্ন শুনে কিছুটা ঘাবড়ে যায় উপমা। তার পেছন পেছন তো হৈমন্তী ও এসেছিল; তার মানে তো হৈমন্তীরও এখানে থাকার কথা। কিন্তু হৈমন্তী কোথায়? নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে।
– “আব,আস,আসলে আমি এইখানে ইচ্ছা কইরা আসি নাই। আমারে এইখানে নিয়ে আসা হইছে।”
কোনো মতে ভয়ে ভয়ে বলে উঠে উপমা। উপমার প্রশ্নোত্তর শুনে আবেগ স্বাভাবিক ভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অতঃপর স্টেথোস্কোপ টা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে উঠে,
– “তা রোগী কে? তুমি? নাকি তোমার পরিবারের অন্য কেউ?”
পেছন থেকে কোনো সাড়াশব্দ পায় না আবেগ। নিশ্চয়ই এই মেয়ের শ্রবণ সমস্যা রয়েছে নাহলে অন্যমনস্ক হয়ে থাকার সমস্যা রয়েছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে পেছনে তাকাতেই আশ্চর্য হয় আবেগ। সে কি ব্যাপার! মেয়েটা কোথায় গেল? এখনই তো এখানে ছিল। এটুকু সময়ের মধ্যে কিভাবে গায়েব হয়ে গেল? মেয়েটার কি কোনোভাবে অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে? নিজের অজান্তেই উদ্ভট সব ভাবনায় মত্ত হয়ে পড়ে আবেগ।

এদিকে ক্যাম্প থেকে বাইরে বেরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে উপমা। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে সে। কোথায় ভেবেছিল ক্যাম্পে এসে শহর থেকে আসা ডাক্তারদের চিকিৎসা সম্পর্কে লুকিয়ে লুকিয়ে টুকটাক কিছু শিখে নিবে কিন্তু এখানে তো তার উল্টোটাই হলো। প্রতিবার এই উদ্দেশ্যেই দু একদিন পর পর ক্যাম্পে এসে উঁকি দেয় উপমা। আশপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কাজল কালো চোখ জোড়া হৈমন্তীকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও যায়।
হুট করে মাথায় কেউ চাট্টি মারতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় হৈমন্তী। ভ্রু জোড়া কুঁচকে পেছনে তাকাতেই উপমার রাগান্বিত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের কথা মনে পড়তেই শুষ্ক অধর দুটি জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে সে। উপমার রাগান্বিত হয়ে যাওয়ার কারণ তার বোঝা হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে।
– “উ,উপ,উপমা তুই? আমি জানি তুই রাইগা আছিস। রাগ করিস না; আমি তো ভুল করে,,,,”

হৈমন্তী তার মুখ নিঃসৃত বাক্য পূর্ণ করতে পারে না। তার পূর্বেই উপমা চাপা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
– “চুপ কর ফাজিল মাইয়া। ভুল করে এখানে চলে আসছিস‌ নাকি ইচ্ছা কইরা চলে আসছিস? আরেকটু হইলেই আইজ ধরা খাইতে হইত ঐ শহুরে ডাক্তারের কাছে। আর ঐ শহুরে ডাক্তারের ঐ ঠান্ডা গলার স্বর শুইনাই‌ তো সব হযবরল হইতে চলছিল। কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাবখানা তার! আইচ্ছা ডাক্তার মানুষ ও এমন গম্ভীর হয় নাকি? তাগো তো হইতে হয় হাসিখুশি; উদার মনের। ডাক্তার ই যদি এমন হয় তাইলে রোগীদের ই বা কি হইব?”

দূর আকাশের পানে তাকিয়ে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে উপমা।

১৩.
আবেগ। পুরো নাম হচ্ছে আরশান শাহরিয়ার আবেগ। আহিল শাহরিয়ার এবং ইশিতা শাহরিয়ারের একমাত্র ছোট ছেলে। মোটামুটি ২৫-২৬ বছর বয়সী একজন সুদর্শন পুরুষ। পেশায় একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সদ্য ডাক্তার।
উপমা চলে যাওয়ার পর থেকেই কোনো এক গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে আবেগ। মিনিট বিশেক পর আবারো রোগীদের হালকা ভীড় পড়ে যাওয়ায় ওপাশের ক্যাম্প থেকে ছুটে আসে সায়ান‌। সায়ান হচ্ছে ইপিআই হসপিটালের সিনিয়র ডক্টর যাকে আবেগের সাথে পাঠানো হয়েছে। কলেজ লাইফ শেষে যদি কোনো ভালো বন্ধু হিসেবে কাউকে আবেগ পেয়েছে তা হলো সায়ান। দুজনের মাঝেই বন্ধুত্ব বেশ গভীর। রোগীদের চাপে একটা সময় দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে আসে। ঘড়ির কাঁটায় ৫:০০ টা বাজলেই ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়া হবে। তাই নিজেদের জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্যাম্পে থাকা ডাক্তাররা। সায়ান আর আবেগ দুজন একসাথেই বেরিয়ে পড়বে। এখান থেকে কিছু দূরেই থাকার জন্য হসপিটাল কর্তৃক ব্যবস্থা করা হয়েছে। হঠাৎ করে সায়ানের ফোনে কল আসতেই খেয়াল করে শ্রেয়ার নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। মুচকি হেসে কল রিসিভ করে একপ্রান্তে গিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে মগ্ন হয়ে পড়ে সায়ান।
এদিকে আবেগ তার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী গোছানোর শেষে খেয়াল করে ফোনটা তার টেবিলের উপরেই পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিতেই চোখ পড়ে কর্ণারে থাকা একটা ঝুমকার উপর। এটা এখানে কি করছে? ভ্রু কুঁচকে ঝুমকা অন্য হাতে তুলে নেয় আবেগ। এটা কার হতে পারে? কোনো রোগীর? চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতেই চঞ্চল কিশোরীর মুখশ্রী ভেসে ওঠে। কাজল কালো চোখ, মুখশ্রী তার চঞ্চলতা আর কৌতূহল দিয়ে ঘেরা। হ্যাঁ, হতেই পারে! দুপুরের দিকে ঐ অল্প বয়সী মেয়েটাই তো ঘুরঘুর করছিল টেবিলের কাছে; তখনই হয়তো ভুল করে ছুটে গিয়েছিল। আর কিছু ভাবতে পারে না আবেগ; তার পূর্বেই পেছন থেকে ডাক পড়ে সায়ানের‌। ডাক শুনে দ্রুত ঝুমকাটা শার্টের পকেটে ভরে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করে বাইরের দিকে।

সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে গ্রামের মেঠো পথে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে উপমা। বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে। লাল সূর্য অস্তমিত হয়ে আরেকটু বাদেই চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। রাস্তার পাশে দু সারি জুড়ে ধান গাছের শীষ। বাড়ির অনেকটা কাছে আসতেই পা দুটো থমকে দাঁড়ায় উপমার। সামনে থেকে এগিয়ে আসা মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির লোলুপ দৃষ্টি চোখ এড়ায় না তার। লোকটির চোখে লোলুপ দৃষ্টি আর মুখে বিশ্রী হাসির রেখা। এমন বিকৃত ভঙ্গিমা দেখে রাগে ক্ষোভে গা জ্বলে উঠে উপমার; তবে মুখ ফুটে কিছু বলে না। এই লোকটা বরাবরের মতই অপছন্দের তালিকায়। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই পথ রুখে দাঁড়ায় সেই লোকটি। অগত্যা থেমে যেতে হয় উপমাকে।

১৪.
– “সমস্যা কি সজল ভাই? এইভাবে আমার পথ রুখে দাঁড়াইছেন কেন? আমারে যাইতে দেন!”
উপমার রাগান্বিত কন্ঠস্বর শুনে হাসে সজল।

– “উফফ, উপমা তোরে কতবার কইছি যে আমারে ভাই ডাকবি‌ না! আমি তোর মায়ের পেটের ভাই লাগি?
আর এইভাবে দিনদুপুরে শাড়ি পইড়া গ্রামগঞ্জে ঘুইরা বেরানোর‌ কি প্রয়োজন? শুনলাম আইজ নাকি ক্যাম্পেও গেছিলি; তা কয়জন‌রে নিজের রূপ দিয়া ঘায়েল করলি? তোরে তো বেশ কয়বার ই কইলাম‌ যদি তুই চাস তাইলে তোরে আর তোর এই রূপ আমার কাছেই রাইখা দিমু। আর নাইলে এক রাইতের জন্য হলেও,,, চিন্তা করিস না কেউ জানব না। শুধু তুই আর আমি বাদে‌।”

আর কিছু শুনতে পারে না উপমা। সজলের এই নোংরা প্রস্তাবের কথা শুনতেই শরীর ঘিন ঘিন করে ওঠে তার। এতক্ষণ কিছু না বললেও শেষোক্ত‌ কথায় রাগ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায় উপমার।
– “খবরদার সজল ভাই! আপনার মন মানসিকতা নিচু ছিল জানতাম কিন্তু চিন্তা ভাবনা ও এত যে নোংরা হইয়া যাইব তা কল্পনাও করতে পারি নাই। আপনারে কতবার বলছি আমার সামনে আসবেন না তারপরও কেন আসেন। আজকে শেষ বারের মত কইতেছি‌ এরপর আপনারে আমার আশপাশে দেখলেও ছাইড়া দেব না। আর আপনি নিশ্চয়ই ভালো কইরাই জানেন এই উপমা এক কথায় ই বিশ্বাসী।”

কর্কশ কন্ঠস্বরে সজলকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায় না উপমা। সজলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাশ দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেশক্তি নেই তার মাঝে। অপরদিকে সজলের মাঝে কোনো প্রকার হেলদোল নেই। সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্রী ভাবে হাসে। মুখে তার অতৃপ্তি আর লোলুপ হাসি। কিছু একটা ভেবে হাঁটা শুরু করে তার নিজ গন্তব্যে।

গুটি গুটি পায়ে সন্তর্পণে বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করতেই গোয়ালঘর থেকে আমেনা বেগমের কর্কশ কন্ঠস্বর কর্ণপাত হয় উপমার।
– “কি রে নবাবের বেটি; সারাদিন বাড়ির বাইরে থাইকতেই যহন হইব তহন আর বাড়িত আসার দরকার কি? পুকুরপাড়ে কিংবা গোয়ালঘরে ঘুমালেই তো পারিস। সকাল হইতে রাইত পর্যন্ত বাইরে ঘুইরা বের হবে আর এদিকে খেটে মরব আমি! অপয়া, অলক্ষ্মী কোথাকার।”
হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপমা। এটা নতুন কিছু নয়; প্রতিদিন ই এমন কটুক্তি শুনতে হয় তার। আমেনা বেগম ও একগাদা খড় গোয়ালঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লেন দ্রুত। সন্ধ্যা নামার একটু আগেই মশার উপদ্রব শুরু হয় এখানে। উপমাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘরে চলে গেল। ঘরে গিয়ে পৌঁছাতেই চোখ পড়ে টেবিলের উপর বসে থাকা পূর্ণার উপর। মেয়েটা খুব মনোযোগ দিয়ে পাঠ্যবই অধ্যয়ন করছে। এবার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সে। বয়সে কাঁচা হলেও চিন্তাশক্তি তার বিশাল।

খুব সন্তর্পণে পেছনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল থেকে কয়েকটা কাঁচা তেঁতুল, বরই বের করে নেয় উপমা। সকালে হৈমন্তীর সাথে ক্যাম্পে যাওয়ার পথে থাকা তেঁতুল গাছ থেকে নিয়েছিল সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেগুলো পূর্ণার সামনে তুলে ধরতেই প্রথমে সামান্য পরিমাণ হকচকিয়ে যায় পূর্ণা; কিন্তু পরমুহূর্তেই সেগুলো দেখে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উপমাকে জড়িয়ে ধরে। উপমাও সযত্নে আগলে নেয় পূর্ণাকে।……………….

#চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here