মায়াবন_বিহারিণী ?,বিংশ_পর্ব,একবিংশ_পর্ব ( অন্তিম খন্ডাংশ-১)

0
730

#মায়াবন_বিহারিণী ?,বিংশ_পর্ব,একবিংশ_পর্ব ( অন্তিম খন্ডাংশ-১)
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#বিংশ_পর্ব

৫০.
ঘন্টা খানেক পরেই বড় বড় পায়ে উপমার রুমে প্রবেশ করলেন আমেনা বেগম। উপমা তখন খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে আনমনে বসে ছিল। চেহারা খানিকটা ফ্যাকাশে; ঠোঁটের কোণটাও‌ কেটে ফুলে আছে। তাতে রক্ত ও জমে আছে কিছুটা। আমেনা বেগম ঘরে প্রবেশ করতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
বিছানায় একটু আগেই যে শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে গিয়েছেন সেই শাড়িটা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে। আর বাদবাকি কিছু সাজ সামগ্রী ছিল তাও এলোমেলো হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। উপমার এমন গা ছাড়া ভাব দেখে মুহূর্তেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হুট করে উপমার খোলা চুলের মুঠি চেপে ধরতেই হকচকিয়ে যায় উপমা। সাথে ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে সে।

– “মুখপুড়ী ন্যাকামি করিস? গতবার ও একই নাটক সাজাইয়া বিয়ে ভাইঙা দিছিলি‌। মুখে বড় বড় কথা; পড়াশোনা করুম, ডাক্তার হমু! অ্যাহ্, ন্যাকামি কইরা বিয়ে ভাইঙা শহুরে পোলার লগে ঘুইরা ঘুইরা প্রেম করতেছিলি!
একখান কথা কান খুইলা শুইনা রাখ‌, এইবারের বিয়েতে যদি মত না দিস তাইলে তোদের দুই বোনের এই বাড়ির অন্ন বন্ধ কইরা দিমু আমি।”
চুলের মুঠি ধরা অবস্থাতেই জোর গলায় শাসিয়ে বলে উঠেন আমেনা বেগম। অন্যদিকে অতিরিক্ত টান খাওয়াতে ব্যাথায় চোখের কার্নিশ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে উপমার; কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না সে।‌ বেশ কিছুক্ষণ পরেই আমেনা বেগম উপমার চুল ছেড়ে দেন। অতঃপর কর্কশ কন্ঠে গর্জে উঠেন,
– “আর মাত্র আধঘন্টা সময় দিলাম তোরে; সুন্দর কইরা শাড়ি পইড়া তৈরি হইয়া নে। তোর আব্বা কাজী সাহেব আর সজল আইলেই তোগো বিয়া পড়ানো হইব। গতবারের মতোন ভুল করার চিন্তাও করিস না, উপমা।”

বলেই তিনি গটগট করে রুমের বাইরে বেরিয়ে পড়েন। অন্যদিকে উপমা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছে একপ্রকার। কিন্তু যত যাই হোক; কোনোমতেই এই বিয়েতে মত দেয়া যাবে না। কিন্তু উপমা জানে না এর পরিণতি কি। তার একটা সিদ্ধান্তে কতকিছু পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

অপরদিকে ত্রিমোহিনীর সাথে সংযুক্ত মেঘনা নদীর শাখা যেখানে যোগাযোগের মাধ্যম হয়। ইফতেখার সাহেব ও বর্তমানে সেখানেই উপস্থিত হয়েছেন। পাশে সজল ও উপস্থিত আছে। কিছুক্ষণ বাদেই দূর হতে ধেয়ে আসা মোটর বোটে করে একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে নামে নদীর পাড়ে। ইফতেখার সাহেবকে চোখে পড়তেই মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে ইফতেখার সাহেবের দিকে এগিয়ে যান তিনি। ইফতেখার সাহেব বসে বসে তামাক চিবোচ্ছিলেন আর পাশেই বসে থাকা সজলকে বাহবার সাথে বলে উঠেন,

– “বুঝলা সজল তোমার মধ্যে দিন দিন আমি নিজেরেই দেখবার পারতাছি। তোমার যা কুটনৈতিক বুদ্ধি তাতে এমনিতেই যেকোনো বাজি চোখ বন্ধ কইরাই জিতন‌ যায়। তাছাড়াও শেষ সময়ে যদি এই কৌশল কইরা ভালোই হইছে; সাপও মরব লাঠিও ভাঙব না। খুন খারাবি ছাড়াই যে উপমারে সহজে হাতের মুঠোয় আনোন যাইব তুমি না থাকলে বুঝতাম ই না।”

ইফতেখার সাহেবের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে শয়তানি হাসি দেয় সজল। বিড়বিড় করে ধীর গলায় বলে উঠে,
– “ঠিকই কইছেন চেয়ারম্যান সাহেব। সবতো আপনার কাছ থেইকাই‌ শিখা। আর উপমা যে এত সহজেই পাওন যাইব তা আমিও ভাবি নাই।”
– “কিছু কইলা সজল?”
জিজ্ঞেস করেন ইফতেখার সাহেব। সজল কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হয় সেই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। লোকটিকে দেখে ইফতেখার সাহেব হেসে উঠে দাঁড়ান। অতঃপর কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করে নিজের হাতে থাকা একটা কালো ব্যাগ সেই লোকটিকে ধরিয়ে দেন। লোকটিও ব্যাগ খুলে ভালোমতো দেখে নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা। গুনে গুনে ২৫ টা ড্রাগস এর প্যাকেট পেতেই তিনি মুচকি হেসে নিজের পকেট হতে দুটো মোটা বান্ডিল টাকা এগিয়ে দেয় ইফতেখার সাহেবের দিকে। ইফতেখার সাহেব ও বিনিময়ে মৃদু হেসে সেই টাকাটা নিয়ে নেন আর লোকটিও বিদায় নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন।

৫১.
নববধূর গায়ে বিয়ের কোনো সাজ সামগ্রী নেই বললেই চলে। উদাসীন মুখশ্রীতে চড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে। হ্যাঁ, একটু আগেই ইফতেখার সাহেব দ্বিতীয় দফায় হাত তুলেছেন উপমার গালে। আর সেটার কারণ হলো উপমা বিয়েতে রাজি হয়নি বলে। উপমার নিস্তেজ শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই যে এখন এতকিছুর প্রতিবাদ একা করতে‌ পারবে। নিজের প্রাণ ও যদি উৎসর্গ করে দিতে হয় তাও সে করবে কিন্তু এ বিয়ে কোনোমতে করবে না বলে ঠিক করেছে সে। আর এজন্যই তাকে এসব অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। উপমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইফতেখার সাহেব ক্রুদ্ধ মেজাজ নিয়ে উপমার দিকে তেড়ে যান।
– “এই, কানে কি কথা যায় নাই? মূর্তির মতোন এইখানে দাঁড়াইয়া আছিস কেন? আমি যহন একবার কইছি সজলের লগে তোর বিয়া হইব তার মানে হইবই‌। আর যদি না হয় আজ এই বাড়িত থেইকা তোর লাশ ও খুঁইজা পাইব না কেউ!”

ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে মুহুর্তেই সেই পুরনো উপমা জেগে ওঠে। চুপচাপ সহ্য করছে বলে এতটাই দুর্বল ভেবে তার উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে ইফতেখার সাহেব। না এভাবে চুপ থাকা আর সম্ভব না।
– “হ্যাঁ, যেইভাবে‌ আমার অয়ন্তিকা মা’কে খুন করছিলেন তাই তো? কি এমন অপরাধ করছিল আমার মা যার জন্য আমার মা’কে খু’ন‌ কইরা ফেলছেন আপনে। আর আমি এমন কোনো ভুল করিনাই যে তার মাশুল দেয়ার লাইগা আমার সজল ভাইরে বিয়া করতে হইব।”

শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করা উপমার প্রশ্ন ইফতেখার সাহেবকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিব্রত করে দেয়। মেয়েটা মোটেও ভয় পাচ্ছে না তাকে বরং তাকে উল্টো প্রশ্ন করছে। বাকি কথা এড়িয়ে যেতে চাইলেই উপমা ফের দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “কি হইলো বলেন, কেন খু*ন করছিলেন আমার মাকে? এই কারণে যে সে আপনার অপকর্মে বাঁধা দিছিল বইলা? তাইলে শুইনা রাখেন অয়ন্তিকা মায়ের মতোন আমারেও যদি খুন কইরা ফালান তবুও আমি সজল ভাইরে বিয়া করব না!”

উপমার প্রশ্নে ইফতেখার সাহেবের রগচটা মেজাজ আরো একধাপ বিগড়ে যায়। মেয়েটা আসলেই হয়েছে অয়ন্তিকার মতো। কথায় কথায় অযথা প্রশ্ন করে বসে থাকে।

– “হ্যাঁ, হ্যাঁ; আমিই খু*ন করছি অয়ন্তিকারে। আমিই খু*ন করছি। আর যদি দরকার পরে আইজকা তোরেও খু*ন করমু।”
উপমার প্রশ্নোত্তরে‌ ইফতেখার সাহেব প্রায় চেঁচি‌য়েই বলে উঠেন উক্ত বাক্য। তার কথা শুনে উপমা‌ও স্থির হয়ে যায়। যেন এই মুহূর্তে আরো কোনো কথা তার শ্রবণ হচ্ছে না। এরই মাঝে পুনরায় ইফতেখার সাহেব তার মুখ খুলেন,

– “অয়ন্তিকারে যখন প্রথম বিয়া কইরা আনলাম তখন এত জমি, ভিটা কিছুই ছিল না। ফাঁকা গোরস্থা‌নের মতো জায়গায় একখান ছনের ঘর ছিল যেইখানে খুব অভাবের সংসার চলতাছিল‌। আর যার ভিটায় কাজ করতাম সেও তেমন একখান পয়সা কড়ি দিত না। এইভাবেই যখন দিন যাইতেছিল‌ তখন হরিবাবুর‌ সঙ্গে দেখা হয় আমার। সদরে নাকি তার বিরাট ব্যবসা আছে; এই কথা কইয়া আমারেও তার ব্যাবসায় যোগ দিতে কইল। আর এইটাও কইলো যে ব্যবসায় লাভ হইলে মেলা টাকা দিব। সংসারের কথা ভাইবা তখন হাত মিলাই হরিবাবুর‌ লগে। মেলা দিন যাওয়ার পর যখন সে আমারে সদরে নিয়া গেল প্রথমবারের লাইগা তখন তার ব্যাবসাখানা‌ দেইখা ভয় পাইয়া যাই আমি। বিভিন্ন ছুরি, বন্দুক থাকে প্রতি লোকজনের কাছে। আমি গেলে আমারেও তা ধরাইয়া দেয়; সাথে কইরা হরেক রকমের নেশাপানির জিনিস। এইসব এক জায়গা থেইকা অন্য জায়গায় পারাপারের কাজে নাকি কখনও কখনও খু*ন খারাবিও করতে হয়।”

এইটুকু বলেই থামলেন ইফতেখার সাহেব আর উপমা সবকিছু অবিশ্বাস্য হয়ে কর্ণপাত করছে। তার মায়ের হত্যাকারীর এমন বর্ণনা তার পুরো শরীরে কাঁটা ধরিয়ে দেয়।

অন্যদিকে ভরা প্লাটফর্মে বহুকষ্টে ভীড়ভাট্টা ঠেলে সায়ান আর আবেগ ট্রেনে প্রবেশ করেছে। বের হতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। অবশ্য ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে আধঘন্টা আগেই। সায়ান আর আবেগ নিজ নিজ সিট খুঁজে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করেছে। আরেকটু পরেই হয়তো ট্রেন সিলেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলেও আবেগের দৃষ্টি সম্পূর্ণ বাইরের দিকে। ধীরে ধীরে এক জায়গার প্রতি দূরত্ব বেড়েই চলেছে তার। এইতো কিছুদিন আগেই তো কাজের জন্য এসেছিল সে ত্রিমোহিনীতে‌। কিন্তু এখানে এসে যে সে বাজেভাবে মায়ায় আটকে যাবে তা কে জানতো? বিশদিন‌ যেন চোখের নিমিষেই কেটে গিয়েছে। মহৎ লোকেরা একটা কথা ঠিকই বলে যে ভালো লাগার, ভালোবাসার সময়গুলো খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যায়। আবেগ যখন বাইরে তাকিয়ে এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে এসব ভাবছিল তখনই তার পকেটে থাকা মুঠোফোন বেজে উঠে নিজস্ব রিংটোনে।
পকেট হতে ফোনটা বের করতেই ইশিতা মা নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকে। কল রিসিভ করতেই অপরপাশ‌ থেকে স্নেহের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “কেমন আছিস আবেগ?”
মায়ের কন্ঠ শুনে সেকেন্ড কয়েক চুপ থাকে আবেগ। অতঃপর মৃদু হেসে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “আমি আসছি মা। আমি তোমার কাছে ফিরে আসছি।”…………………

#চলবে

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#একবিংশ_পর্ব ( অন্তিম খন্ডাংশ-১)

৫৩.
মধ্যাহ্নের প্রহর গড়িয়ে অপরাহ্নে পড়েছে। সাথে করে সূর্যের তেজস্ক্রিয়তাও পশ্চিমে খানিকটা হেলে পড়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। ইফতেখার সাহেব সহ সকলেই গম্ভীর মুখে বিশেষ করে উপমা ইফতেখার সাহেবের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু আগে থেকে ইফতেখার সাহেবের মুখ থেকে যা যা শুনেছে তাতে ক্রমাগত অবাকই হচ্ছে সে। তাকে আরো একধাপ অবাক করে দিয়ে ইফতেখার সাহেব পুনরায় বলে উঠলেন,

– “তখন অয়ন্তিকা পোয়াতি। আস্তে আস্তে কইরা ছনের ঘর থেইকা টিনের ঘর হইলো। এই আশপাশের ভিটা জমিও তিন চারখান‌ নিজ আয়ত্তে আইলো। এইসব উন্নতি দেইখা তোর মা অয়ন্তিকা মনে করা শুরু করলো এইসব বুঝি তোর আগমনের কারণেই ঘটতাছে অথচ ঐ সময়ে আমি এইসব ব্যবসায় বহুত গভীরে জড়াইয়া গেছি। ব্যবসায় খালি লাভ ই হইতে শুরু করলো। হরিবাবুও ততদিনে এক দুর্ঘটনায় গত হইয়া গিয়াছেন। তয় সব ঠিকঠাক ই চলতাছিল‌; বিপত্তি ঘটলো তখনই যখন তোর বয়স এক বছর। চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনয়ন পত্রে যখন আমার নাম‌ উঠলো তখন এই গ্রামের সেই সময়ের মোড়ল নজরুল মোহাম্মদ আমার পেছনে লোক লাগায়। লোকখান‌ একটু বেশিই নাক গলাইয়া ফেলছিল আমারে নিয়া তাই সেই সমস্যা একদম গোড়া সহই উইপড়া‌ ফেলেছিলাম যাতে কইরা এই ক্ষমতার পথে কেউ বাধা না দিবার পারে। তয় ঐ যে কইলাম‌ অয়ন্তিকা বরাবরের মতো একটু বেশিই উৎসুক ছিল আমার ব্যাপারে। এই জন্যেই মাইয়া মাইনষের অত পড়ালেখা করান লাগে না। এরা অল্পতেই বেশি উড়ে। আর এই সামান্য পড়ালেখার জোরে অয়ন্তিকা ও তার চালাকি দিয়া আমার এইসব কাজের ব্যাপারে সব জাইনা যায় তখনই সেইটা তার জন্যে কাল হইয়া দাঁড়ায়।
মাইয়াডার‌ একটু বোকামির লাইগাই অল্প বয়সে প্রাণ হারাইতে হইলো। কি দরকার ছিল এইসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কইরা তা পুলিশের কাছে জানানোর? অয়ন্তিকা যদি এইডা না করত তাইলে আইজ তোর মা আর পুলিশ দুইজনেই বাইচা থাকত। কষ্ট লাগে মাঝেমধ্যে কিন্তু কি করমু বল? আমার কাছে আবার জানের আগে ঐ ক্ষমতাটাই একটু বেশি প্রিয়। ঐটারে আর চাইলেই কি হাতছাড়া করোন যায়?”

এবার যেন সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা উপমাই খায়। সজল আর আমেনা বেগমের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই যেন তারা সব আগে থেকেই জানে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে চিনতে আজ একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে উপমার। জন্মদাতা পরিচয় ছাড়াও যে তার পেছনে এত বড় ভয়ংকর, অমানবিক চরিত্র লুকিয়ে আছে‌ তা কল্পনাও করতে পারে নি সে।
– “তার মানে‌ সত্যি সত্যিই সেইদিন অয়ন্তিকা মাকে আপনে ঐভাবে‌ খুন করছিলেন?”

ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে উপমা। আখি যুগল অশ্রুসিক্ত তার। উপমার প্রশ্ন শুনে ইফতেখার সাহেব মোটেও অবাক হন নি কিংবা হকচকিয়ে যান নি। বরং নির্দ্বিধায় বলে উঠেন,

– “হয়, ঠিকই কই‌ছিস তুই! সেইদিন ঐভাবে‌ অয়ন্তিকার লাশটা আমিই ফেলেছিলাম ঐ নর্দমায়। সেইদিন রাইতেও‌ যখন তোর মা অয়ন্তিকা এইসব বিষয় নিয়া আমারে হুমকি ধামকি দিতাছিল‌ তখনও আমি তারে বুঝাইয়া গেছি যে না এইসব বললে লাভ হইব না। আর আমি যদি জেলেই চইলা যাই তাহলে দুই মা মাইয়ার‌ কি হবে। কিন্তু উড়ন্ত পাখি যখন হাতছাড়া হইয়া যায় তখন কি আর তারে খাঁচায় ফেরান যায়?
পানি বেশিদূর গড়াই‌য়া গেছিল। তাই ভাবলাম গোড়া শুদ্ধ সেই আগাছা উপড়ে ফেলা দরকার। তাইতো তোর মা যখন রাইত দুইটায় গভীর ঘুমে তলা‌ইয়া ছিল তখন আমার জমির ধান কাটার দা টাই কামে আইলো। অনেকদিন ধইরা ঘষামাজা হয়না দেইখা বেচা‌রির গলায় সেইটা চালানোর পর মুরগির মতো ছটফটাইতেছিল‌। তয় চিন্তা করিস না তোর মার কষ্ট দেইখা আমিও নিজেরে আর সামলাইতে‌ পারি নাই। তাই দ্বিতীয়বার সেইটা গলায় চালানোর মিনিট কয়েক বাদেই চাতক পাখি শান্ত হইয়া গিয়াছে। রাত গভীর হইতে শুরু করল, সাথে কইরা একজনের খু*ন হওয়ার কাহিনী, রহস্য ও! অবশ্য সকাল হওয়ার আগেই সবকিছু এমন ভাবে সাজানো হইছিল যে তাতে যে দেখব সেই বলব এ কোন সন্ত্রাসীর কাম। তয় আমার এই কামে অবশ্য সাহায্য করছিল সজলের বাপ হারুন। যাক মেলাখান কইয়া ফেলছি; এই আমেনা এক মগ ঠান্ডা পানি নিয়া আহো তো। গলাটা ভারী শুকাইয়া গেছে আমার!”

ইফতেখার সাহেবের বলতে দেরি আমেনা বেগমের ছুটতে দেরি নাই। অন্যদিকে উপমার পায়ের তলা দিয়ে যেন মাটি সরে গিয়েছে। অসাড় শরীরে প্রাণের সঞ্চার নেই বললেই চলে। একজন কি করে পারে ক্ষমতার লোভে পড়ে এত নৃশংসভাবে হত্যা করতে কাউকে। এসব ভাবতে ভাবতেই উপমার শরীর হিম হতে শুরু করছে। বাবা নামক শব্দটার প্রতি এখন আর বিশ্বাস নেই তার। এভাবে এক পর্যায়ে তার শরীর আর তার সায় দেয় না। মুহূর্তেই হাঁটু গেড়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে উপমা।

৫৪.
মিনিট পাঁচেক পরেই আমেনা বেগম পানি ভর্তি মগ নিয়ে এসে ইফতেখার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতেই ইফতেখার সাহেব সেটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটুকু পানিই খেয়ে নেন। উপমার এমন করুণ শোচনীয় পরিস্থিতি আমেনা বেগম আড়চোখে তাকিয়ে পৈশাচিক হাসি দেন যেন ঘটনাটি তার কাছে বেশ মুখরোচক।

– “কিন্তু ক্ষমতার জোরে আর কতদিন এভাবে মানুষ খুন করতে থাকবেন চেয়ারম্যান সাহেব? আপনার কি মনে হয় না যে আপনার এবার সেই সব রহস্য হাঁটে হাঁড়ি ভাঙতে চলেছে?”
হঠাৎ করেই পরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বেশ নড়েচড়ে উঠেন ইফতেখার সাহেব। সাথে উপমাও। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করেন সেদিনের মত আজও কন্সটেবল আলী সহযোগে দাঁড়িয়ে আছেন অফিসার আমান। কই আজ তো তাকে কোন খবর দেয়া হয়নি তাহলে সে এখানে কি করছে? তবে কি উপমাই কোনোভাবে অফিসার আমানকে খবরটা দিয়েছে? মনে মনে এসব ভাবলেও মুখশ্রীতে কোনো চিন্তার ছাপ নেই ইফতেখার সাহেবের। তিনি যথেষ্ট স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠেন,

– “আরে অফিসার সাহেব আপনে? তো হঠাৎ কইরা আমার বাড়িতে? আর কি সব বলতেছেন খু*ন খারাবি‌ নিয়া? এই আমেনা বড় সাহেব গো লাইগা দুই কাপ চা আনো কড়া লিকার দিয়া!”
ইফতেখার সাহেবের কথানুযায়ী চুপচাপ ভেতরে চলে যান আমেনা বেগম। সব ঠিকঠাক থাকলেও সজলের মুখশ্রীতে হালকা চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে যা ওতটা‌ স্পষ্ট নয়। অফিসার আমান ও মুচকি হাসলেন। অতঃপর ভেতরে প্রবেশ করে একবার উপমার দিকে তাকালেন। মেয়েটার উপর যে একটু আগেই বেশ খানিক অত্যাচার হয়ে গিয়েছে তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমান সাহেব সামান্য গলা খাঁকারি দিলেন।

– “অতিথি আপ্যায়ন আপনার করতে হবে না চেয়ারম্যান সাহেব। দেখুন না আমরাই আপনার অতিথি আপ্যায়ন করতে চলে এসেছি। তো এখন কি আপনি আমাদের সাথে সোজাসুজি চলবেন নাকি,,?”
অফিসার আমানের পুরো কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ইফতেখার সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।

– “কি কইতে চাইতাছেন‌ অফিসার সাহেব? যা কইবেন তা সরাসরি বইলা ফেলেন।”

– “এটাই যে একটু আগেই আপনার সব অপরাধের স্বীকারোক্তি এই রেকর্ডারে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আজকে সকালে নদীর পাড়ে আপনার আর সজলের মাদকদ্রব্য মালামাল পরিবহনের ভিডিও ফুটেজ ও রয়েছে। এত এত প্রমাণ থাকতেও আপনার আপ্যায়ন কিভাবে না করি চেয়ারম্যান সাহেব? তাইতো আর বিলম্ব না করে চলে আসলাম আপনার কাছে। কন্সটেবল‌ আলী, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন যান গিয়ে আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবকে অতিথি আপ্যায়নের জন্য নিয়ে চলুন।”

অফিসার আমানের কথা শুনে উপমা চমকালেও‌ ইফতেখার সাহেব বোধহয় একটুও চমকাননি‌। তার ভাবমূর্তি দেখে মনে হচ্ছে তিনি এমন কিছু হওয়ারই আশা করেছিলেন। অন্যদিকে উপমা গোল গোল চোখে অফিসার আমানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক সেদিন পথিমধ্যে তার দোয়া কবুল হয়ে গিয়েছিল আর অফিসার আমানের সঙ্গে ও তার দেখা হয়েছিল। আর সেদিনই অফিসার আমানকে তার দেখা ও শোনা সবটুকুই খুলে বলে উপমা। এটাই যেন ইফতেখার সাহেবের প্রতি সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল অফিসার আমানের নিকট।

৫৫.
এ পর্যন্ত বলা অফিসার আমানের কথাগুলো শুনে তাচ্ছিল্য হাসলেন ইফতেখার সাহেব যা কিছুক্ষণ পরেই অট্টহাসিতে রূপান্তরিত হলো। আমান সাহেব তার এ উদ্ভট আচরণের কারণ খুঁজে পাননি।
– “আমারে আপনার কি মনে হয় অফিসার সাহেব? আমারে কি এতটাই বলদ মনে হয় যে আমি এত সহজেই আপনের কাছে ধরা দিমু? ইশ্, আপনে তো দেখি মস্ত বড় ভুলে ডুইবা আছেন।
আপনে কি কইরা ভাবলেন যে আমি আমার ক্ষমতার খেলায় এত সহজেই সবকিছু হাতছাড়া কইরা দিমু? এইসব খেলায় মাথা খাটাইতে হয় বুঝলেন; এইসব ছবি, ক্লিপ, শব্দ আমার কিছু করতে পারব না। আর ধরলাম পারলো ও। কিন্তু আমার খেলায় যে একটা গুটির আয়ু একদমই শেষ, তাইনা উপমা?”
শেষো‌ক্ত কথাটির ভাবার্থ বুঝে উঠলো না উপস্থিত কেউই। বাহিত হলো মিনিট কয়েক। উপমার চঞ্চল চোখ খুঁজল চারদিকে কাউকে। হ্যাঁ, মুহুর্তেই তার মস্তিষ্কের সব নিউরনগুলো‌ জাগ্রত হয়ে উঠলো। পূর্ণা, মেয়েটা কোথায়? আশেপাশে তো তাকে দেখাই যাচ্ছে না।

– “পূর্ণা কোথায় আব্বা?”
ধাতস্থ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে উপমা।
– “এইজন্যই তো তোরে বুদ্ধিমতি বলি উপমা একদম অয়ন্তিকার মতন। দেখ কেউ না বুঝলেও তুই ঠিক বুইঝা ফেললি।”

– “কথারে ঘুরায় প্যাচায়েন না, আব্বা! পূর্ণা কই? ওরে কই লুকায় রাখছেন?”
– “আমি যদি বইলাই দেই তাহলে খেলা জমব কি কইরা? পারলে খুঁইজা নে পূর্ণারে। সময় মাত্র পনেরো মিনিট।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে ভয়ে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে উপমার। ভয়ঙ্কর কিছু হতে চলেছে আজ। অফিসার আমান মুহূর্তেই তার গান বের ইফতেখার সাহেবের দিকে তাক করেন,
– “চেয়ারম্যান সাহেব, ভুল করেও কিছু করার চেষ্টা করবেন না। চুপচাপ বলুন পূ‌র্ণা কোথায়? কি করেছেন আপনি তার সাথে?”

– “আহা অফিসার শান্ত হও। এত চিন্তা শরীরের জন্য ভালা না। আর ঐসব দেখাইয়া লাভ নাই। তার চেয়ে বরং তুমি এইটা দেখ।”
বলেই সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট আয়তকার রিমোট বের করলেন ইফতেখার সাহেব। অফিসার আমানের দেখে আর বেগ পেতে হয় না ইফতেখার সাহেব কি করতে চলেছেন।

– “এইযে এইটা কি দেখতাছ? একটা পুরো জান আমার হাতে। যদি এখানের লাল বাটনে আমি একবার ভুল কইরা চাপ দেই তাহলে ঐ পনেরো মিনিট ও থাকব না পূর্ণার জীবনে। সব বুমম হইয়া যাইব।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় উপমার। কোনো বিলম্ব না করেই যে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে অফিসার আমানের কথা ভেসে আসে,

– “উপমা ভেতরে যেও না, ভেতরে বোমা আছে। সেগুলো যেকোনো সময় ফেটে যেতে পারে।”
কিন্তু সেগুলো আর উপমার কর্ণগোচর হলো না উপমার। সেসব না শুনেই সে ছুট লাগালো ভেতরের দিকে। প্রথমেই নিজের ঘরটাতে ভালোভাবে পরখ করে নিল সে। পুরো আনাচে কানাচে খুঁজেও পূর্ণার হদিস পেল না। একে একে ইফতেখার সাহেবের রুম থেকে শুরু করে সবটাই খোঁজা শেষ প্রায়। কিন্তু পূর্ণা কোথায়? তাকে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা এমন কোথাও কি আছে যেখানে পূর্ণাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে? একেতো সময় নেই তার উপর মাথা কাজ করছে না উপমার। এভাবে ভাবতে ভাবতেই তার চোখ পড়ে বেশ কয়েক বছর পুরনো একটা ছোট পকেট রুমে। অয়ন্তিকা মাঝেমধ্যে এখানেই সময় কাটাত। তবে তার মৃত্যুর পর সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাতপাঁচ না ভেবেই সে এগিয়ে রুমের দিকে।……………..

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here