মায়াবন_বিহারিণী ?,০৮,০৯

0
634

#মায়াবন_বিহারিণী ?,০৮,০৯
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টম_পর্ব

২০.
কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না। তেমনই মাঝ দিয়ে আরো তিনটে দিন চলে গিয়েছে। সবাই যার যার নিজ ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময়‌ ব্যাতীত করছে। আবেগের সময় কেটেছে বিভিন্ন মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে গবেষণা করার মধ্য দিয়ে। এই তিন দিনের মাঝে খুব একটা বাইরে যাওয়ার অবসর হয়ে উঠেনি তার। ডাক্তারি পেশার এই একটাই বৈশিষ্ট্য নিজের জন্য অবসর সময়টাকে নিজেদের লাইফ ডিকশনারি থেকে বাদ দিয়ে দিতে হয়। আবেগের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হচ্ছে। অন্যদিকে উপমা দুইদিন বিকেলে বাড়ির বাইরে টুকটাক বের হলেও ব্যস্ততায় হৈমন্তীর সাথেও দেখা করেনি। এদিকে পূর্ণারও গা পুড়িয়ে জ্বর এসেছে। বিকেলের দিকে পানি ভর্তি কলস নিয়ে বাড়িতে ফেরার সময় উপমার চোখ পড়ে উঠোনে বসে থাকা ইফতেখার সাহেবের উপর। ইফতেখার সাহেব মোড়ায় বসে নিজ আনন্দে তামাক চিবোচ্ছেন‌। উপমার দিকে একপলক তাকালেও পুনরায় তামাক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরই মাঝে সদর দরজা দিয়ে হেলেদুলে প্রবেশ করে সজল। সজলকে এমন অসময়‌ বাড়িতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। এই সভ্যতা বিহীন মানুষটাকে বাড়িতে কি প্রবেশ করতে দেয় ইফতেখার সাহেব তা ভেবে কুল কিনারা খুঁজে পায় না সে। বহুবার আকার ইঙ্গিতে ইফতেখার সাহেবকে সজলের অপকর্ম সম্পর্কে ধারণা জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করলেও তা বরাবরের মতই উপেক্ষা করে গিয়েছেন ইফতেখার সাহেব; যেন এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই নেই।
সজল উপস্থিত হতেই ইফতেখার সাহেব এবার বেশ নড়েচড়ে বসলেন। তামাকের বাটি টা সরিয়ে একবার উপমার দিকে তাকিয়ে সজলকে আড়ালে ইশারা দিতেই সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে ইফতেখার সাহেবের পেছন পেছন হেঁটে ভেতরের দিকে চলে যায় সজল। তবে যাওয়ার পূর্বে উপমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে যায় যা উপমার চোখ এড়ায় না।

প্রায় একঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। বাড়ির বড় কামরাতে‌ সেই কখন ইফতেখার সাহেব আর সজল প্রবেশ করেছে; কিন্তু এখনো তাদের বের হওয়ার নামগন্ধ নেই। পাশের রুমেই বসে টেবিলের উপর পড়তে বসেছিল উপমা। বেশ কিছুদিন হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার জন্য হৈমন্তীকে দিয়ে আগ থেকেই কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়েছিল সে। অপরপাশে খাটের মধ্যে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে পূর্ণা। সকালের দিকেই জ্বর কমে এসেছে। তন্মধ্যে হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কর্ণগোচর হতেই নড়েচড়ে উঠে উপমা। টেবিল থেকে উঠে দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখে সজল বেরিয়ে পড়েছে কক্ষ থেকে। হাতে একটা ব্যাগ রয়েছে। ইফতেখার সাহেব চারপাশে একবার ভালো করে দৃষ্টিপাত করে নেন এই উদ্দেশ্যে যে কেউ আছে কিনা।
ইফতেখার সাহেব আর সজল বেরিয়ে যেতেই উপমাও পিছু পিছু বের হয়। বারান্দার পাশ ঘেঁষে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পায়ে কিছু অনুভব হতেই থমকে দাঁড়ায় সে। নিচে মেঝেতে তাকিয়ে দেখে সাদা রঙের গুঁড়ো বস্তু সারি দিয়ে পড়ে আছে। কই একটু আগেই তো এ জায়গাটা পরিস্কার ছিল এমনকি সে নিজেই করেছে। তৎক্ষণাৎ নিচে বসে হাতের সাহায্যে সেই গুঁড়ো বস্তু নাকের কাছে নিতেই নাক সিঁটকায় উপমা। কেমন ঝাঁঝালো বিদঘুটে গন্ধ। মাথাও ঝিমঝিম করছে। কিন্তু এই বিদঘুটে গন্ধযুক্ত বস্তু বাস্তবে কি? সিনেমা, নাটকের কথা মনে পড়তেই আতকে উঠে সে। এগুলো কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নাকি আসলেই কোনো নেশা দ্রব্য? আর সেটা হলেও এ বাড়িতে কি করছে? এসবের মধ্যে ইফতেখার সাহেব আর সজলের কোনো যোগসূত্র নেই তো আবার? ব্যাপারটা নিয়ে সেখানেই গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে উপমা।

২১.
সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশের বিশালতা লালিমায়‌ ছেয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। একটু আগেই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছে আবেগ আর সায়ান। ঘরে প্রবেশ করতেই সায়ান চলে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। আর আবেগ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার টাই খুলতে ব্যস্ত। হাতে থাকা ঘড়িটা খুলে টেবিলের উপর রাখতেই চোখ পড়ে টেবিলের উপর অযত্নে এককোণে পড়ে থাকা একটা ঝুমকার উপর। ঝুমকাটার‌ কথা তো মনেই পড়েনি এ দুদিনে। ঝুমকাটা আলতো হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হাসে আবেগ। মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই চঞ্চল কিশোরীর ডাকনাম,
– “ভ্যাবলা কান্ত মশাই? স্ট্রেঞ্জ‌ বাট ফানি।”
তার ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে ফোনের রিংটোনে। ফোনের স্ক্রিনে মা নামটা ভেসে উঠতেই স্মিত হাসে আবেগ। অতঃপর ফোন রিসিভ করে ভাব বিনিময় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দু’পাশে থাকা দুজন ব্যক্তি।

রাত ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এসেছে। গ্রাম এলাকায় রাত আটটা বলতেই প্রায় অনেকখানি রাত। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত সাড়ে নটা বেজেছে। আশপাশের বাড়ির মানুষজন অনেকক্ষণ হয়েছে ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা জানালা ভেদ করে চাঁদের আলো ঘরে প্রবেশ করছে। চোখে ঘুম নেই উপমার। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে এসে দাড়াতেই বাইরের দৃশ্য দর্শন হয় তার। মন কেমন যেন ছটফট করছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বাইরে একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অতঃপর বাড়ির সবার আড়ালে অতি সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে উপমা। এভাবে রাত বিরাতে বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারটা নতুন কিছু নয় তার নিকট। বাইরে বের হয়ে সোজা উত্তর পার্শ্বের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করে উপমা। বিষন্নতা কাটাতে এর চেয়ে ভালো উপায় আর কি হতে পারে? দেখতে দেখতে প্রায় অনেকটাই গন্তব্যে এসে পৌঁছায় সে। চারপাশে স্বচ্ছ পানি চিকচিক করছে চাঁদের আলোয়। নিস্তব্ধ কোলাহলহীন পরিবেশে এগিয়ে গিয়ে নদীর ধারে বসে পড়ে উপমা। চোখ জুড়ে নেমে আসে ক্লান্তির ছায়া।

অন্যদিকে গ্রামের রাস্তায় অন্ধকারে টর্চের আলোতে হেঁটে চলেছে আবেগ। সাথে সায়ান ও ছিল তবে একটু আগেই জরুরি ফোন আসায় অগত্যা বাড়ি যেতে হয়েছে তাকে। রাতের সোডিয়াম আলোতে ঢাকার রাস্তায় হাঁটার অভ্যাসটা বোধহয় এখনো যায়নি আবেগের। তাইতো গ্রামে এসেও সেই একই অভ্যাস রয়ে গিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকদূর ই এসে পড়েছে সে। আশপাশে দূর দূরান্তে কোনো বাড়ির চিহ্ন ও নেই। চারপাশে শুধু সারি সারি ধান ক্ষেত। সামনে যাওয়া টা কি ঠিক হবে? কিয়ৎক্ষ‌ণ চিন্তা ভাবনা করে পুনরায় হাঁটা ধরে সামনের দিকে। মিনিট পাঁচেকের পথ পেরোতেই সেই নদীটা চোখে পড়ে আবেগের যেখানে তার আর সেই চঞ্চল কিশোরীর সাথে দেখা হয়েছিল। কিন্তু নামটাই তো জানা নেই তার? যদি দ্বিতীয়বার দেখা হতো তাহলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে নিত তার এই আশায়‌ সেখানেই পা বাড়ায় আবেগ।

২২.
– “তয় আইজ ও কি কারো গানের সুর শুইনা আইসা পড়ছেন নাকি ডাক্তার মশাই?”
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে কারো শীতল কন্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে পিলে চমকায় আবেগ। যে ব্যক্তি অন্যের হার্টের চিকিৎসা করবে আজ তারই হার্ট ধড়ফড় করছে। ভাবা যায়? মেয়েলি কন্ঠের অনুসরণ করে সামনের দিকে এগোতেই চোখ পড়ে বাঁধা নৌকার উপর বসে থাকা কিশোরীর উপর। তবে কি সেদিনের সেই চঞ্চল কিশোরী আসলেই এখানে উপস্থিত রয়েছে নাকি এটা শুধুই তার কল্পনা? তার মাঝেই দ্বিতীয়বার মতো কন্ঠস্বর শুনতেই টনক নড়ে আবেগের।
– “এই যে মশাই! ওমন কইরা ড্যাবড্যাব কইরা কি দেখেন?”
উপমার প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আবেগ। তবুও নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়,
– “তোমাকে!”
এবার যেন কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম আবেগের‌। একটু আগে কি বললো সে? মেয়েটা কি ভাববে? যদি তাকে ভুল বুঝে কিছু বলে বসে? কিন্তু তাকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে উপমা সশব্দে হেসে ওঠে।
– “বিড়ালচোখী মাইনষের এই একটাই সমস্যা জানেন? যারে একবার দেখে তার প্রতি আলাদা একখান মায়া জন্মায় যায়। তাই বারবার দেখে।”

উপমার কথার ভাবার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না আবেগ। এমন কোথাও লিখা আছে নাকি? না নিশ্চয়ই এসব মেয়েটার বানোয়াট কথা। পরক্ষনেই হাসি থামিয়ে চুপচাপ হয়ে পড়ে উপমা।
– “এইভাবে না দাঁড়াইয়া থাইকা সামনে গিয়ে নৌকায় বসেন।”
আবেগ ও আর কথা বাড়ায়না। চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ে; এমনিতেই শরীর বেশ ক্লান্ত। উপমাও যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পাশে বসে পড়ে আবেগের। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। মিনিট দশেক এভাবে থাকার পর নীরবতা ভেঙে আবেগ মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “নাম কি?”
উপমা নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়েই বলে উঠে,
– “উপমা!”
বিনিময়ে মুচকি হাসে আবেগ। চঞ্চল কিশোরীর চরিত্রে নামটা বেশ মানিয়েছে।…………….

#চলবে ?

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#নবম_পর্ব

২৩.
– “শুনলাম শহর থাইকা আইছেন আর এগারো দিন পরেই নাকি চইলা যাইবেন?”
নিচু কন্ঠে বলে উঠা উপমার কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই উপমার বিক্ষিপ্ত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। চাঁদের মৃদু আলোয় যেন উপমার মুখশ্রী আরো আলোকিত হয়ে উঠেছে। ভাসা ভাসা চোখ, ঘন নেত্রপল্লব‌ বিশিষ্ট চোখ জোড়ায় এক অসীম মায়া লুকিয়ে রয়েছে।

– “এই যে বিড়াল‌চোখী মানব! ডাক্তার মানুষদের এমন আনমোনা‌ হয়ে থাকা মানায় না বুঝেছেন? তাদের তো হইতে হয় সবসময় প্রখর শ্রোতা!”
উপমার এমন কথায় কিয়ৎক্ষণ সময়ের জন্য ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। এ আবার কেমন প্রসঙ্গ? নিজেদের তৈরি কোনো নিজস্ব কল্পনার জগত থাকতে পারে না নাকি? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে সত্যিই তো! দিন দিন আবেগ মেয়েটার ভাবনার প্রতি একটু বেশিই অন্যমনস্ক হয়ে চলেছে। কিন্তু এমনটা হলে তো চলবে না। সে তো একজন ডাক্তার। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,

– “হুম কিন্তু এই খবর তুমি পেলে কি করে? আমার অগোচরে আবার কাউকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাখো নি তো?”
আবেগের প্রশ্নে উপমা ফিক করে হেসে দেয়।

– “আপনি তো দেখি বড়ই রসিক মানুষ। শুনেন এই গ্রাম এলাকায় কোনো গুপ্তচর নিয়োগ করতে হয় না। খবর সবার আগেই বাতাসে বাতাসে সবার কানে পৌঁছায় যায়। আর রইলো আপনার শহরে যাওয়ার কথা? সে তো পরশুদিন ই আব্বার মুখে শুনছিলাম। আইজ হঠাৎ দেখা হইলো তা জিজ্ঞেস করলাম।”

আবেগ উত্তরে আর কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ নদীর ধারে বসে নীরবতা পালন করে। রাত গভীর হচ্ছে ক্রমশ। চারপাশে মৃদু বাতাসের শব্দের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কর্ণপাত হচ্ছে। রাতের শীতলতা বাড়তেই নীরবতা কাটিয়ে উপমা বলে উঠে,
– “রাইত গভীর হইতাছে ডাক্তার মশাই। আপনার এইখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হইবো না। পরে পথ ভুইলা গেলে সে আরেক বিপদ। তাই বলি পুরো রাত এইখানে না কাটাইয়া নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ান।”

– “কেন রাতটা তো বেশ ভালোই; এখানেই তো হাজার বছর কাটিয়ে দেয়া যাবে কবির ভাবনায়। তবে হ্যাঁ ঠিক; গভীর রাত্রি। আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত।”

আবেগের প্রস্তাবে উপমাও উঠে দাঁড়ায়। আবেগ বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। তখনই পেছন থেকে উপমার আগ্রাসী কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে,
– “কাল যদি কেউ ক্যাম্পে যায় তাহলে কি তারে সেদিনের মতো আবারও তাড়াইয়া দেয়া হবে?”
থমকে দাঁড়ায় আবেগ। উপমার বাচ্চামো প্রশ্নে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
– “না অবশ্যই না। তবে রোগী ব্যাতীত অন্য কাউকে চিকিৎসা করা কিন্তু মোটেও এলাউ না মিস উপমা।”
বলেই ইশারায় বিদায় জানিয়ে সোজা রাস্তায় পা বাড়ায় আবেগ। আবেগের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসে উপমা। আজকের রাতটা একটু বেশিই অদ্ভুত ও সুন্দর!

২৪.
সূর্যের কিরণ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তৃত ভাবে। চৈত্র মাসের প্রথম দিন। তাতেই কেমন যেন ভ্যাপসা গরম ছুটেছে চারপাশে। আমেনা বেগম পাশের বাড়ির রুমা বেগমের সাথে মিলে উঠোনে বসে আয়োজন বসিয়েছে। বাড়ি থেকে একটু দূরে অবস্থিত ধানক্ষেত থেকে আজ পরিপক্ক ধান আনা হবে। সেগুলো মাড়াই থেকে শুরু করে চাল বানানো অবধি পুরোটাই ব্যস্ততার কাজে কাটবে। উপমাও সকাল থেকেই বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে সবার নজরের আড়ালেই আবার ঘরে প্রবেশ করেছিল সে। ইফতেখার সাহেব সূর্যের আলো ফোটার পূর্বেই দুজন লোকের সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। এভাবে চুপিচুপি হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে এমন অদ্ভুত ভাবে গা ঢাকা দেয়ার বিষয়টির মর্মার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না উপমা। কেন যেন মনে হয় ইফতেখার চরিত্রটা বেশ জটিল এবং রহস্যময়।
বাদ খানিকটা সময় পরই উৎফুল্ল মন নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে হৈমন্তী। খুশিতে বেশ উৎফুল্ল হয়ে আমেনা বেগমকে সালাম দিতেই তিনি সামান্য ভ্রু কুঁচকে সালামের উত্তর নেন এবং পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমেনা বেগমকে টপকিয়ে‌ হৈমন্তী চলে যায় বাড়ির ভেতরে। ভেতরে গিয়ে দেখে উপমা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি হচ্ছে। লম্বা এলোকেশী‌ চুলগুলো গিট দিয়ে বেনী পাকাতেই পেছনে এসে হাজির হয় হৈমন্তী। আয়নার পিঠে হৈমন্তীর মুখশ্রী চোখে পড়তেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উপমা। প্রত্যুত্তরে হৈমন্তী পেছন থেকে একটা সাদা খাম সামনে তুলে ধরতেই অবাক হয় সে। কেননা এমন ধরনের খাম খুব একটা বিশেষ দিন ছাড়া হৈমন্তী নিয়ে আসে না।
খাম সম্পর্কে জানতে সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ঘুরে হৈমন্তীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় উপমা। প্রত্যুত্তরে যা আসে তাতে চোখ হতে দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে।

বিগত কয়েকদিন বেশ ভালোই কেটেছে আবেগের। নির্মল পরিবেশে থেকে নিজের স্বপ্নের দিকে প্রতিদিন একধাপ এগিয়ে যাওয়াটা বেশ আনন্দের তার কাছে। এখান থেকে যেতে পারলে নিশ্চয়ই বড় কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। চেয়ারের উপর বসে রোগীকে চেকআপ করে প্রেসক্রিপশন লিখতে ব্যস্ত ছিল সে। তখনই রোগীদের সারি ডিঙিয়ে চুপিচুপি প্রবেশ করে হৈমন্তী আর উপমা। আজ সকাল থেকেই ডক্টর সায়ানের ডিউটি অপর পাশের ক্যাম্পে পড়েছে। তাই আর এপাশে বেশ খানিক রোগীকে আবেগের একাই সামাল দিতে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পর সারি ধীরে ধীরে কমে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। দুপুরের দিকে বেশিরভাগ সময়ই কেউ আসে না আর। তখনই সামনে থাকা চেয়ারে একজন এসে বসে পড়ে। কলমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিচু কন্ঠে সামনে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আবেগ বলে উঠে,

– “জি বলুন? রোগীর নাম আর কি সমস্যা?”

– “অনিন্দিতা নওরিন উপমা। রোগ তো অনেকই আছে তয় ঠিক কোনটা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারতেছি না।”
চঞ্চল কন্ঠস্বর। সামনে থাকা কিশোরী রমণীর কথায় নিচ থেকে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। এতক্ষণ শরীরে জমে থাকা ক্লান্তি যেন কিশোরীর মুখশ্রী দর্শন হতেই উধাও হয়ে যায়। অপরদিকে আবেগকে এভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে খিলখিলিয়ে হেসে দেয় উপমা।

২৫.
– “এখানে রোগী ব্যাতীত অন্য কাউকে চিকিৎসা প্রদান করা হয় না মিস উপমা।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতে দেখতে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে আবেগ।
– “হইতেও তো পারে ডাক্তার মশাই। হইতেও তো পারে যে আমার বিশাল বড় রোগ হইছে; মনের রোগ।
খাইতে ভাল্লাগে না, ঘুমাইতে ভাল্লাগে না। চারিপাশ জুইরা খালি তারে আর তারেই দেখি। বলেন এইটা কি কোন রোগ না?”

উপমার এমন উদ্ভট সব কথাবার্তা শুনে হকচকিয়ে যায় আবেগ। কি সব বলছে মেয়েটা?
– “মনের রোগ মানে? কি সব বলছো উপমা? এসব মনের রোগ না বরং তোমায় অরুচিতে ধরেছে। তাই বলছি নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দাও আর যাওয়ার সময় ওপাশের ক্যাম্প থেকে কয়েকটা ভিটামিন ট্যাবলেট নিয়ে যেও।”
আবেগের কাটকাট গলায় জবাব।

– “যে মনের রোগই চিনবার‌ পারে না; সে আবার কিসের ডাক্তার?”
সামনে থাকা কিশোরীর কথা কর্ণপাত হতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোকা বনে গেল আবেগ।
মনের রোগ? সেটা আবার কি? হার্ট বিষয়ক কোনো রোগ? ডাক্তারি পড়াশোনায় তো এটা সম্পর্কেই শুনেছে সে। কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে তো মোটেও তা মনে হচ্ছে না। নিষ্পলক চাহনিতে মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবেগ। মায়াবি ডাগর ডাগর চোখে কাজল লেপ্টে রয়েছে, বৈশিষ্ট্যেও যেন তার চঞ্চলতা!
আবেগকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উপমা হাসি থামিয়ে দেয় পলকেই। অতঃপর বেশ ঠাট্টার ছলেই বিড়বিড় করে বলে উঠে,
– “কি ভ্যাবলা কান্ত মশাই? ভাবনার জগতে পইরা গিয়েছেন মনে হয়! তা সেই ভাবনার জগত কি আমারে কেন্দ্র কইরাই?”

পিলে চমকায় আবেগ। মেয়েটা তো বেশ ভয়ংকর কথা বলতে জানে। আর তার মনের কথাই বা জানল কি করে? মেয়েটা কি তবে কোনোভাবে তার মাইন্ড পড়ে নিতে পারে? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গলা খাঁকারি দেয় আবেগ। তারপর অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,
– “এসব কিছুই না; সবকিছুই তোমার কিশোরী মনের ভ্রান্তি!”……………..

#চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here