মায়াবন_বিহারিণী ?,১২,১৩

0
589

#মায়াবন_বিহারিণী ?,১২,১৩
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বাদশ_পর্ব

৩০.
– “কি লিখতে‌ছিস তুই বুবু? আর তোর হাতে ঐটা কি?”
পেছন থেকে হঠাৎ পূর্ণার কন্ঠ শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে যায় উপমা। দ্রুত লেখা থামিয়ে দিয়ে ডা‌য়েরি বন্ধ করে নিয়ে কোনোমতে বলে উঠে,
– “ক,কই কিছু না তো। আর এইটাতো পায়েল; অনেকদিন আগের।”
উপমার জবাবে সন্দিহান চোখে উপমার দিকে তাকায় পূর্ণা; ঠিক যেন তার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।
– “আচ্ছা ঠিক আছে, তয় রাইত হইয়া গেছে বুবু। কয়টা খাওয়াইয়া দে; মেলা ঘুম পাইতাছে।”
পূর্ণার আবদার শুনে অগত্যা উঠে যেতে হয় উপমাকে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পূর্ণা‌কে খাইয়ে দেয়ার পর নিজেও কিছুটা খেয়ে নেয়। আসলেই অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে। পূর্ণাও ঘুমিয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। সেও গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে‌ বিছানায়। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় গরম বেশ ভালোই পড়েছে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উপমা। চোখে কেন যেন ঘুম নেই। বিছানায় কয়েকবার এপাশ ওপাশ করলেও চোখে ঘুম নামে না তার।

– “মনে হয় না এখানে আর কখনো আসা হবে।”
মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু আবেগের বলা শেষোক্ত কথাটুকুই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে উপমার। মন জুড়ে শুধু একপ্রকার অস্থিরতার বসবাস। শেষমেষ আর না পেরে লাফ দিয়ে উঠে বসে উপমা। আজ তার এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? সবকিছুই তো ঠিকঠাক রয়েছে। দ্রুত খাট থেকে নেমে টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস থেকে সবটুকু পানি ঢকঢক করে খেয়ে নেয় সে। আয়নায় চোখ পড়তেই খেয়াল করে শরীর ঘেমে রীতিমতো জুবুথুবু‌ হয়ে গিয়েছে। আবেগের চলে যাওয়ায় এমন লাগছে কেন? কই আগে তো কখনো হয়নি এমন। কখনো কারো প্রতি এত শূন্য লাগেনি তার? কয়েকদিনেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে বলে এমন লাগছে নাকি এর পেছনেও কোনো বিশাল ব্যাখ্যা লুকায়িত? আচ্ছা সেদিন হৈমন্তীর বলা কথার সাথে সত্যিই এর কোনো যোগসূত্র নেই তো! হৈমন্তী তো বলেছিল উপমা নিজের অজান্তেই কোনো একদিন তার ডাক্তার মশাইয়ের প্রেমে পড়বে। তবে কি সেই একদিন তার জীবনে আসলেই চলে এলো? পরক্ষণেই পিলে চমকায় উপমা। না এটা কি করে সম্ভব? কি সব চিন্তা ধারণায় মগ্ন হয়ে গিয়েছে ভেবেই নিজেকে নিজেই দু গাল বকা দেয় উপমা।

ইজি চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে আবেগ। ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়াতে শুধু জানালা ভেদ করে বাইরের প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত হয়েছে ব্যালকনি। চোখে ঘুম নেই আবেগের। বিকেলের কথা মনে পড়তেই বিষন্ন লাগে তার। তবে কি সে আগ বাড়িয়ে একটু বেশিই ভেবে নিয়েছিল? কিন্তু কি আর করার। সে তো না চাইতেও সেই চঞ্চল কিশোরীর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কি এমন আছে মেয়েটার মাঝে? অসীম মায়া? থাকতেই পারে। মেয়েটা তো আপাদমস্তক ই মায়াময়।
– “কি ব্যাপার ডক্টর আবেগ? এখন ও রাত জেগে কি করছেন? আজকে তো ফাইলপত্র ও তেমন নেই।”
– “এমনিতেই ডক্টর সায়ান। ঘুম আসছিল না তাই ভাবলাম ব্যালকনিতে বসেই রাত কাটানো যাক। আর এটা ঢাকা শহর ও না সোডিয়াম লাইটের আলোয় অন্ধকার রাতেও রাস্তায় ঘুরে আসা যাবে।”
আবেগের কথায় মৃদু হাসে সায়ান। সায়ান প্রায়শই অবাক হয় আবেগকে দেখে। লোকটা অন্যান্যদের চেয়ে বড়ই অদ্ভুত। এগিয়ে গিয়ে সে ও পাশের ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে। অতঃপর উৎসুক কন্ঠে আবেগের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

– “তারপর সেই চঞ্চল কিশোরীর কি হলো? বলতে পেরেছেন তাকে যে তার ডাক্তার সাহেব যে কি না আগে কোনো মেয়ের দিকে তাকায় পর্যন্ত নি সে শেষমেশ একটা ছোট্ট মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে?”
সায়ানের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলেও মুখশ্রীতে তার বেদনার ছাপ।

– “উহু! আমাকে দিয়ে একটা ভুল হয়ে গিয়েছে ডক্টর সায়ান। অনেক বড় একটা ভুল। উপমা চঞ্চল কিশোরী বটে। তবে তার সময়টা আবেগে ভেসে বেড়ানোর। মেয়েটার সেসব ইম্যাচুউরিটি কথাবার্তা আমি একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম; যেটা আমার একদম ই উচিত হয়নি।”
সায়ান আবেগের বলা কথাগুলোর ভাবার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
– “কিন্তু ডক্টর আবেগ? আপনি তো‌ উপমাকে ভালোবাসেন; তাই না? তাহলে এখানে ভুল বোঝাবুঝির কি আছে?”
– “হ্যাঁ, হয়তো আমি সত্যিই উপমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু উপমা? উপমা কি এসব স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে? আর এই কথারই বা কি গ্যারান্টি যে উপমা আমাকে ভালোবাসে? আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারছি না ডক্টর সায়ান। আই নিড এ টাইম।”

সায়ান কোনো জবাব দেয় না। আসলেই তো। আবেগ তো ঠিকই বলছে। আবেগ না হয় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাচিউর। কিন্তু উপমা? সে কি আদৌ ভালোবাসে আবেগকে। রাত ধীরে ধীরে গভীর হতে শুরু করেছে। সাথে করে আবেগের মনে জাগ্রত হওয়া প্রশ্নগুলো ও।

৩১.
আজ খুব বেলা করেই ঘুম ভাঙে উপমার। শরীরটাও‌ খুব একটা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে শরীর থেকে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। জ্বর টর আসেনি তো আবার? শেষ রাতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল তা খেয়াল নেই। বহুকষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে উঠতে আজ। আমেনা বেগমের কতই না কটুক্তি শুনতে হবে আজ কে জানে?
একরাশ ভীতি নিয়ে বারান্দার দরজার আড়ালে লুকিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অবাক হয় উপমা। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর অফিসার আমান, সাথে করে দারোগা আলী। আর তাদের দুজনের সামনেই ভয়ে জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমেনা বেগম। তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি কোনো বিষয় নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে আছেন। কিন্তু অফিসার আমান এই অসময়ে এখানে কি করছে? আর কাকেই বা খুঁজছে এখানে? আমেনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে আমান সাহেবের চোখ পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের চুপিচুপি পর্যবেক্ষণ করা উপমার উপর।
আমান সাহেব বারান্দায় তাকাতেই দ্রুত আড়ালে সরে আসে উপমা। বাইরে উঠানে কি যাওয়া উচিত নাকি ফের ঘরে চলে যাওয়া উচিত এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতেই আমেনা বেগমের চড়া গলা কর্ণকুহরে পৌঁছায় তার। কিঞ্চিৎ পরিমাণ হকচকিয়ে গেলেও পা টিপে টিপে অতি ধীর গতিতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে উপমা। অফিসার আমান একবার উপমার দিকে সরু দৃষ্টে তাকিয়ে আমেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন,,

– “আপনি এখন আসতে পারেন। আমার এখন উপমার সাথে কিছু কথা আছে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা জরুরি।”
এতেই যেন কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে আমেনা বেগমের। অস্থিরতার পরিমাণ আগের চেয়ে একটু বেশিই বেড়ে গিয়েছে। আমান সাহেব পুনরায় তাড়া দিতেই তিনি একপলক উপমার দিকে তাকিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ান। এদিকে উপমা পড়েছে বেশ অস্বস্তিতে। কি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন অফিসার আমান যার জন্য আমেনা বেগমকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এখান থেকে?

– “ইফতেখার সাহেব কোথায় উপমা?”
আমান সাহেবের হঠাৎ প্রশ্নে প্রথমে খানিকটা ইতস্তত বোধ করে উপমা।
– “আব্বা সজল ভাইয়ের সাথে সদরে গেছেন।”
– “কখন গিয়েছে বলতে পারবে?”
– “না, তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। তয় পূর্ণার কাছ থেইকা শুনছি ৪:৫০ টা নাগাদ বের হইয়া গিয়েছেন আব্বা।”
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে আমান সাহেব। দারোগা আলী ও তার নোটপ্যাডে কি যেন লিখছেন। কিছু একটা গভীরভাবে চিন্তা করে আমান সাহেব পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠেন,
– “আচ্ছা এটা বলতে পারবে যে যার কাছে চেয়ারম্যান সাহেব তোমাকে বিক্রি করে দিতে চলেছিল তার সাথে চেয়ারম্যান সাহেবের সম্পর্ক কেমন?
চেয়ারম্যান সাহেবের কি আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কারো সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রয়েছে; কিংবা সহজ কথায় কোনো মাদকদ্রব্য মালামাল ও হত্যার সাথে জড়িত আছেন কি না?”
আমান সাহেবের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় উপমা। কি সব জিজ্ঞেস করছেন সে? হত্যা মামলা? এ ও কি সম্ভব নাকি! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে হতেও তো পারে। যে মানুষটাকে উপমা এত বছরেও ঠিকঠাক করে চিনতে পারে নি তার সম্পর্কে এত তথ্য বের হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর বাকি রইল মাদকদ্রব্য? হ্যাঁ, সেদিনই তো সজলের হাতে ইফতেখার সাহেব একটা ব্যাগ দিয়েছিলেন যা দেখে উপমা নিজেই এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছিল। তবে কি এ ব্যাপারে আমান সাহেবকে বলে দেয়া উচিত হবে?
– “কি হয়েছে উপমা? কিছু বলছো না যে? ভয় পেয়ো না কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নির্ভয়ে বলতে পারো সব।”

উপমাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই ভেতর থেকে আমেনা বেগমের কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসে। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা আমান সাহেবের দিকে একপ্রকার তেড়ে আসেন তিনি।
– “কি ব্যাপার সাহেব? আপনে উপমারে কি কানপট্টি পড়াইতাছেন? আমি তো কইলামই চেয়ারম্যান সাহেব এখন বাড়িতে নাই। নির্বাচনের কাজে সদরে গেছে। উপমারে কি জিগাইতাছেন আপনে হ্যাঁ?
আমেনা বেগমের কথায় কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায় উপমা। এখন কিছু বললে তা হিতের বিপরীতেও হতে পারে। তাই এখন কিছু না বলাটাই শ্রেয়। অফিসার আমান একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টে আমেনা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি বেশ চুপসে যান। অতঃপর শান্ত গলায় বলে উঠেন,
– “ঠিক আছে। আজ আসছি। ইফতেখার সাহেবের সঙ্গে আমার জরুরি কথা রয়েছে। আর যদি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় তাহলে আমি পুনরায় আসব। ঐ যে বলেছিলাম আমার বিশেষ নজরদারি আপনাদের উপর।”

বলেই সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে আমান সাহেব। তিনি চলে যেতেই আমেনা বেগম দ্রুত উপমার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠেন,
– “এই অপয়া, ঐ পুলিশ তোরে কি জিগাইতেছিল হ্যাঁ! তোর আব্বারে নিয়ে কি কইছে, তাড়াতাড়ি বল।”
উপমা জবাব দেয় না। উল্টো দিকে ঘুরে চলে যেতে নিলেই আমেনা বেগম পুনরায় চেঁচিয়ে উঠেন,
– “কি হইলো কথা কানে যায় নাই? কথা বলতেছি‌স না কেন? আর তুই যদি কিছু না বলিস তাইলে কিন্তু অনেক খারাপ হইবো উপমা।”
মৃদু হাসে উপমা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠে,
– “যা জিজ্ঞেস করার তাই করছে! আর কি করবা? বড়জোর মাইরা‌ই ফেলবা; তয় মনে রাইখো‌ আমি চুপ কইরা আছি বইলা এইটা মনে কইরো না যে উপমা সব অন্যায় সহ্য করে নিবে। পাপের ঘড়া‌ একবার পূর্ণ হইয়া গেলে তা সবার সামনে আসতে বেশি দেরি লাগে না। যার যার কর্মফল সেই ভোগ করব।”
এ যেন হিংস্র আহত বাঘিনী। যার চোখে প্রতিবাদী মনোভাব। আমেনা বেগম রাগে গজগজ করলেও মুখ ফুটে কিছু বলেন না; কেননা মস্তিষ্ক জুড়ে তার অন্য কোনো পরিকল্পনা।……………….

#চলবে ?

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োদশ_পর্ব

৩২.
ক্লান্ত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। প্রাণহীন আকাশে আবার একটু একটু পাখিদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। হৈমন্তী‌দের বাড়ির পাশে থাকা বড় কাঁঠালগাছের শক্ত ডালে বাঁধা দোলনায় বসে পা দুলিয়ে চলেছে উপমা। পাশেই হৈমন্তীও কাঁঠাল গাছের ডালে বসে রয়েছে। হাতে থাকা শিউলি ফুলগুলোর দিকে একদৃষ্টে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে সেগুলো মুক্ত বাতাসে উড়িয়ে দেয় উপমা। কয়েকটা উপর থেকে পুনরায় এসে খোলা চুলের ভাঁজে আটকে গেলেও বাকিগুলো মাটিতে পতিত হয় অগোছালো ভাবে। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা।
– “তয় সত্যিই কি শহুরে ডাক্তার আর আসবে না? তুই কি একবারও খোঁজ নিছিলি তার?”

হৈমন্তীর হঠাৎ প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায়‌ উপমা। ভ্রু যুগল সামান্য কুঁচকে নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “কি জানি? আর আমিই বা খোঁজ নিব ক্যান তার? সে তো আমার হাতে সেইদিন পায়েল টা ধরাই‌য়া দিয়া কি যেন বিড়বিড় কইরা বলতে বলতে চইলা গেছিল। বলছিল যে তার চইলা যাওয়ার দিন সে আমারে ঐটা দিয়া যাবে। কিন্তু এমনও তো হইতে পারে যে সে তার কাজের ব্যস্ততায় আর আসতে পারব না”

উপমার কথায় ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে হৈমন্তী। অতঃপর হতাশা জড়ানো গলায় বলে উঠে,
– “তোর মতো বলদ মাইয়া আমার কপা‌লেই জুটতে হইল? একটা সামান্য বিষয়টারে জগাখিচুড়ী পাকা‌ইয়া ফেল‌ছিস।”
হৈমন্তীর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে হৈমন্তীর দিকে গোল গোল চোখে তাকায় উপমা। কি সব বলছে হৈমন্তী? কি এমন ভুল করেছে সে।

– “প্রেমিক মানুষ তার প্রেয়সীর লগে একটু অভিমান করতেই পারে। তার উপর সবচেয়ে বড় কথা হইলো সে একজন পুরুষ মানুষ। তারা সচরাচর তাদের প্রেয়সীর লগে অভিমান কইরা থাকতে একটু বেশিই ভালোবাসে।
আর তুই কি না শহুরে ডাক্তারের অভিমান না ভাঙাইয়া এইখানে বইসা বাতাস খাইতেছিস। বলি কি মাথায় কি শুধু অন্য বুদ্ধি থাকলেই হইব, প্রেমিক মাইনষের মন বোঝার লাইগাও একটু বুদ্ধি থাকতে হইব।”
বিরক্তির দৃষ্টে তাকিয়ে একনাগাড়ে বলে ওঠে হৈমন্তী। অপরদিকে হৈমন্তীর কথার আগা গোড়া বুঝতে না পেরে ঠোঁট উল্টে ফেলে উপমা। একের পর এক হৈমন্তী এসব কি বলে যাচ্ছে তাকে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে।
– “আহা কি শুরু করছিস হৈমন্তী! সেই কখন থেইকা একই কথা ঘুরাইয়া পেচাইয়া বইলা যাইতেছিস। একটু পরিষ্কার কইরা বলবি যে কি বলতে চাইতে‌ছিস তুই? আর কিসের অভিমান? কিসের প্রেমিক পুরুষ? ডাক্তার মশাই যদি আমার প্রেমিক পুরুষই হইতো তাইলে সে তো আমারে বইলাই দিত যে সে আমারে ভালোবাসে। সে তো আমারে কিছুই বলে নাই।”

ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উপমা।
– “এইটাই তো বুইঝা নিতে হবে তোরে। তোর গা ছাড়া ভাবের কারণেই হয়তো ডাক্তার মশাইয়ের মনে অভিমান জমছে। তা বলি কি এইভাবে অবহেলা না কইরা আগলায় নিলেই তো পারিস।
আমি নিশ্চিত শহুরে ডাক্তারের রাগ ভাঙালেই সব জলের মতন পরিষ্কার হইয়া যাইব। সে নিজেই তোরে তার ভালোবাসার কথা বইলা দিব। আর এইটাও শতভাগ নিশ্চিত যে তুই নিজেও কোনো না কোনোভাবে শহুরে ডাক্তারের প্রেমে পইড়া গেছিস।”
হৈমন্তীর কথা শুনে চক্ষু দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম উপমার। কি বলছে এসব হৈমন্তী! তবে কি আসলেই?

৩৩.
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। ক্যাম্পে তেমন কোনো রোগীর আনাগোনা নেই বললেই চলে। সবাই তাদের প্রতিদিনের নিয়মমাফিক অনুযায়ী ব্যাগপত্র গুছিয়ে যার যার বাসায় ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবেগ ও তার ব্যাতিক্রম নয়। আজকের দিনটা একটু বেশিই ব্যস্ততায় কেটেছে তার। টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে উঠতেই সায়ান তাকে ইশারায় বাইরে যেতে বললে সেও চুপচাপ বাইরের দিকে পা বাড়ায়। আজ সেই পুরনো জায়গায় ছুটে যেতে ইচ্ছে করলেও কোনো উপায়ান্তর নেই। নিজের মনকে যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সে।
বাইরে দাঁড়িয়ে এককোণে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে আবেগ। এখনো সায়ানের‌ ফেরত আসার কোনো নাম গন্ধ ও নেই। হয়তো ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পুনরায়।

– “এই যে ডাক্তার মশাই?”
চঞ্চল কন্ঠস্বর! পেছন থেকে পরিচিত সেই ক্ষীণ কন্ঠ কর্ণগোচর‌ হতেই হকচকিয়ে উঠে আবেগ। হৃৎস্পন্দন আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তার এই অস্থিরতার মাঝেই পেছন থেকে পুনরায় কারো ডাক পড়ে। এবার বেশ খানিকটা আশা নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই মুখটা চুপসে যায় তার। পেছনে কেউ তো দূরের কথা কারো অবয়বটুকু ও নেই। বিষাদ মাখা মুখশ্রী নিয়ে ঘুরে পুনরায় পেছন ফিরে তাকাতেই পিলে চমকে উঠে আবেগ। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
– “উ,উপমা?”
– “এই যে ভ্যাবলা কান্ত মশাই; কোথায় হারাইয়া গেলেন শুনি?”
উপমার উপস্থিতি টের পেতেই মুখের রং পরিবর্তন হতে শুরু করে আবেগের। মনে মনে বেশ খুশি হলেও চেহারা দেখে তা বোঝা মুশকিল। মুখে বেশ গম্ভীর ভাব এনে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “তুমি এখানে? এখানে কি করছো তুমি?”
– “কেন আমার কি এইখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হইছে নাকি? আমি তো আসছিলাম এইখানে আপনার জন্য; না মানে আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

উপমার নির্লিপ্ত উত্তর। আরেক দফা অবাক হয় আবেগ। কি কথা বলতে এসেছে উপমা? তবে কি সে কোনোভাবে আবেগের মনের কথা জানতে পেরেছে, আর সেটারই কি উত্তর দিতে এসেছে? না, না এ সম্ভব না। কেননা এখনও তো আবেগ নিজের মনের কথা উপমাকে মুখ ফুটে বলতেই পারে নি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কাঠ কাঠ গলায় জবাব দেয়,

– “তোমার কথা শোনার মতো পর্যাপ্ত সময় আমার কাছে নেই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ততক্ষণে সায়ানের ডাক ও পড়ে গিয়েছে। উপমাকে একপ্রকার উপেক্ষা করেই পাশ কাটিয়ে চলে যায় আবেগ। আবেগের এমন ব্যবহার দেখে কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেয়ে যায় উপমা। দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে যে আবেগ রেগে রয়েছে। আর এর জন্যেই তাকে উপেক্ষা করে চলেছে। ভাবা যায়? কিন্তু কেন? তবে কি কোনোভাবে হৈমন্তীর বলা বাণীই সত্যি হতে চলেছে? ভাবতেই চম‌কায় সে।

– “মেয়েটাকে এভাবে এভোয়েড‌ না করলেও পারতেন ডক্টর আবেগ।”
সায়ানের মৃদু কন্ঠ শুনতে পেয়ে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। সায়ানের‌ দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সে। অতঃপর প্রত্যুত্তরে এক ভয়ানক কথা বলে উঠে,
– “না পারলেও করতে হবে আমাকে ডক্টর সায়ান। উপমা একটা বাড়ন্ত চঞ্চল কিশোরী। তার সামনে যদি আমি আমার প্রেম প্রস্তাব নিয়ে যাই মেয়েটা হয় আমাকে ভুল বুঝবে, আর না হয় আমার প্রেমকে তুচ্ছ করে ছুঁড়ে মারবে সেই অদূরে।
তাছাড়া তাই প্রেম বিরহ থেকে তাকে প্রেম আবেদন না করাটাই শ্রেয় বলে মনে হয় আমার। আর তাই যে কদিন এই ত্রিমোহিনীতে‌ আছি সে কদিন উপমার থেকে যথাসম্ভব দূরেই থাকতে হবে আমাকে।”

আবেগের কথায় চুপ হয়ে যায় সায়ান। বলার মতো আর তেমন কিছু খুঁজে পায় না। শুধু মনে মনে সবটা ঠিক হয়ে যাওয়ার প্রার্থনা করে। মেঠো পথের রাস্তা ধরে ধরে হেঁটে চলে যায় দুটো অবয়ব।

বাড়ি এসে সেই কখন থেকেই চুপচাপ বসে রয়েছে উপমা। পূ‌র্ণা কয়েকবার এসে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেও তার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। তার মস্তিষ্ক জুড়ে অন্যসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কেমন গোলযোগে ফেঁসে গিয়েছে যে তা থেকে কোনোভাবেই বেরোতে পারছে না সে? শুনেছে ইফতেখার সাহেব ও নাকি আজ রাতেই সদর থেকে ফেরত আসবেন।
– “প্রেমিক মাইনষেরে নিজের আঁচলে বাইন্ধা রাখতে হয় সবসময়। নাইলে একবার গিঁট ছুই‌টা গেলে সেই গিঁট আর চাইলেও বান্ধন যায় না।
তাই বলি বেশি দেরি না কইরা শহুরে ডাক্তারের অভিমান ভাই‌ঙে ফেল। নাইলে নিজের মনের কথা জানাইয়া দে। অন্তত মানুষটারে তো আর চিরদিনের জন্য হারাইয়া ফেলবি না!”
বাড়ি ফেরত আসার সময় বলা হৈমন্তীর কথাগুলো মনে পড়তেই ভয়ে আঁতকে উঠে উপমা। সত্যিই কি সে আবেগকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে? না। এ সম্ভব না। আবেগকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললে সে বাঁচবে কি করে?
গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় উপমা। আবেগকে মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার। তবে কি শেষ মেষ আবেগের প্রেমে সত্যিই পড়ে গেল উপমা?………………….

#চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here