#মায়াবন_বিহারিণী ?,১৮,১৯
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টাদশ_পর্ব
৪৬.
চৈত্রের প্রায় শেষ সময়। রাতের আকাশে পুনরায় এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। বোধহয় নতুন চাঁদের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ এককথায় বলা যায় শুক্লা দ্বাদশীর রাত্রি। তার মৃদু আলোতে চারপাশ খানিকটা আলোকিত হয়ে আছে। ঘরের জানালা ঘেঁষে সেগুলোই পরখ করে যাচ্ছে উপমা। ঘুমের রেশ টুকু নেই দুটো নেত্রপল্লবে। মনটা বেশ বিষন্ন আর অবসাদ অনুভব হচ্ছে। বাড়ির সামনের পলাশ গাছটায় বসে থাকা ডাহুক পাখিটাও যেন ডেকে ডেকে তার দুঃখে নিজের দুঃখ প্রকাশ করছে। তার সুপ্ত হৃদয়ের বেদনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আবেগ। আজ তার প্রিয়তমকে একটু বেশিই মনে পড়ছে। পাশেই বিছানায় এক কোণে ডায়েরিটা অগোছালো ভাবে পড়ে রয়েছে। তবে এর মাঝে আজকে আরো একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
এইতো ঘন্টা কয়েক আগের কথা,,
সন্ধ্যার পর বাড়িতে বেশ কয়েক মিষ্টি, সন্দেশের হাঁড়ি, নিয়ে হাসি সহযোগে প্রবেশ করেন ইফতেখার সাহেব। উপমা সবেমাত্র হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে কলপাড় থেকে বেরিয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই ইফতেখার সাহেবের সঙ্গে চোখাচোখি হয় তার। একপ্রকার পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে পুনরায় ঘরে চলে আসে উপমা। অবশ্য ততক্ষণে আমেনা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। ঘরে প্রবেশ করতেই পূর্ণা বেশ উৎসুক হয়ে এগিয়ে গিয়ে উপমাকে জড়িয়ে ধরে।
– “বুবু, বুবু জানো? আব্বায় আমার আর তোমার জন্য সদর থেইকা মেলা সুন্দর সুন্দর জামা আনছে। তোমার পছন্দের নতুন শাড়িও আনছে। আবার দেখো চুড়িগুলাও কি সুন্দর! ঝিলমিল করতেছে।”
পূর্ণার আনন্দিত ও উৎসুক কন্ঠস্বর। অন্যদিকে পূর্ণার বলা কথা, ইফতেখার সাহেব ও আমেনা বেগমের চালচলন সবকিছুই প্রায় মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে উপমার। কি শুরু হয়েছে আজকে এসব? ইফতেখার সাহেব এবং আমেনা বেগমের মূল উদ্দেশ্যটাই বা কি? যার কারণে তিনি আজ এসব অদ্ভুত আচরণ করে যাচ্ছেন! উপমা যখন এসব নিয়ে হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ছিল তখনই তার সূক্ষ্ম ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে ইফতেখার সাহেবের ডাক শুনে।
– “উপমা, ও উপমা! এদিকে আয় মা!”
পিলে চমকে উঠে উপমা। এখন আবার তাকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। কাহিনীর মধ্যে আসল ঘাপলা টা কোথায়? এরই মাঝে দ্বিতীয় ডাক পড়তেই সেও কিছু একটা ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের রুমের দরজায় দাড়াতেই ইফতেখার সাহেব খুশি হয়ে দ্রুত বসা থেকে উঠে আসেন।
– “আহা বাইরে দাঁড়ায় আছিস কেন? ভেতরে আয়। এই যে দেখ তোর পছন্দের গুড়ের সন্দেশ আর রসগোল্লা আনছি। নে দেখ খাইয়া দেখ তো কেমন। আর তোর শাড়ি চুড়ি পছন্দ হইছে তো মা?”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে উপমার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। এ তো আজ ইফতেখার সাহেবের এক অন্যরকম রূপই দেখা যাচ্ছে। উপমা তার কথা মতোন ভেতরে প্রবেশ করে ঠিকই কিন্তু আর বসে না। আমেনা বেগম বাটিতে বেশ কয়েকটা মিষ্টি তুলে উপমার দিকে এগিয়ে দিলে হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় উপমা। অতঃপর ভ্রু সামান্য কুঁচকে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “এসব বাহানা না দিয়া আসল কাজের কথায় আসো! এইসব করার মানে কি চেয়ারম্যান সাহেব? আমি খুব ভালো কইরাই জানি এসবের পেছনে আপনার বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে। তাই ঘটনার মারপ্যাঁচ না কইরা সরাসরি বইলা ফেলেন।”
উপমার কথায় মুহূর্তে রং উড়ে যায় ইফতেখার সাহেবের। তিনি যে বেশ থতমত খেয়ে গিয়েছেন তা তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উপমার কথা শুনে ইফতেখার সাহেব হাতে থাকা ব্যাগটা পাশে রেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,
– “আচ্ছা তুই আগে এইখানে বস, তারপর তোরে সব কইতাছি।”
উপমাও আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ পাশে রাখা মোড়াটাতে বসে পড়লো।
– “আমি জানি উপমা মা, তুই আমার উপর রাইগা আছিস। রাইগা থাকার ই কারণ। এরকম একখান খারাপ মানুষের কুকর্ম সম্বন্ধে জানলে রাইগা থাকার ই কথা। তাছাড়া তোর মা অয়ন্তিকা,, থাক সেই প্রসঙ্গে না যাই। তয় মা একটু ভালো কইরা দেখ তোর এই বুড়া বাপটার বয়স হইতাছে। আর কইদিন ই বাচুম মা, তুই বল!
পারলে তোর এই বুড়া বাপ টারে মাফ কইরা দিস। আমি আজ থেইকা তোর কোনো কাজে বাঁধা দিমু না। তোরে অনেক পড়ামু। অনেক বড় ডাক্তার বানামু।”
শেষোক্ত কথাগুলো বেশ কান্না মিশ্রিত কন্ঠেই বলে উঠেন ইফতেখার সাহেব। আমেনা বেগম ও আঁচলে মুখ গুঁজে আছেন। এবার উপমা একটু নড়েচড়ে উঠে। তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর কার্যক্ষমতাও সজাগ হয়ে উঠে ক্রমশ। কি বলছেন এসব ইফতেখার সাহেব? সে কি আসলেই ঠিক শুনছে? কিন্তু হঠাৎ করে ক্ষমা চাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ? নাকি এও কোনো সাজানো নাটক?
– “কি হইলো, উপমা মা? কিছু বলতেছিস না কেন? তুই কি তোর বাপরে মাফ করতে পারবি না?”
প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলে না উপমা। মাথা নিচু করে উঠে বেরিয়ে পড়ে ইফতেখার সাহেবের কক্ষ হতে।
৪৭.
এতক্ষণ গভীর ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল উপমা উক্ত ঘটনা নিয়ে। তার হঠাৎ করেই চোখ পড়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে। ঘড়ির কাঁটায় ৪:০০ টা বাজে। ভোর হতে চললো প্রায়। পরক্ষণেই তার সমস্ত ইন্দ্রিয় জুড়ে আবেগের ভাবনা বিরাজমান হতে শুরু করে। তার প্রিয় মানুষ তো একটু পরেই প্রস্থান করবে এই ত্রিমোহিনী থেকে। তার সঙ্গে কি শেষবারের মতন দেখা করা প্রয়োজন না? পূর্ণা নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটার দিকে পুনরায় একবার তাকিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা রুমাল বের করে নেয় উপমা। বেশ কয়েকদিন আগেই অতি সযত্নে নিজ হাতে বিভিন্ন কারুকাজ আর নকশা করে রুমালটি তৈরি করে সে। আবেগকে দিবে দিবে বলে আর দেয়া হয় নি কোনো এক কারণে। আজ দিবে ঠিক করে সেটা নিয়েই রুম খুলে ছুট লাগায় বাইরের দিকে। ইফতেখার সাহেব আর আমেনা বেগম নিশ্চয়ই এতক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছেন।
বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে উপমা বের হয় উত্তরের রাস্তায়। নিশ্চয়ই এখনো আবেগ বাসা থেকে বের হয় নি। তাই সরাসরি সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনাই করে উপমা।
– “কি ব্যাপার এত আয়োজন কিসের লাইগা? আর ঐ অপয়ারে ঐসব দামী দামী জিনিসপত্র আইনা দেয়ার কি দরকার ছিল? দিনশেষে দেখবা কালসাপের মতোন ছোবল দিয়া বসব ঐ মুখপুড়ী!”
বিছানার এককোণ গোছাতে গোছাতে ইফতেখার সাহেবকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠেন আমেনা বেগম। স্বামীর অর্থসম্পদ সতীনের মেয়ের পেছনে ব্যয় হচ্ছে বলেই রাগে শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার। ইফতেখার সাহেব তখন সিন্দুক হতে সাদা কাপড়ে পেঁচানো একটা বোচকায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখছিলেন। গতকালই এসব সজলকে দিয়ে আনিয়েছেন তিনি। কোনো প্রকার বিপদ নেমে আসলে এগুলোই কাজে লাগাতে হবে। আমেনা বেগমের কথা কর্ণগোচর হতেই তিনি আড়চোখে আমেনা বেগমের দিকে তাকান। মাঝেমধ্যে আমেনা বেগমকেও তার অসহ্য লাগে চোখের সামনে। প্রথম স্ত্রীর মতোন করুণ দশা করে ছেড়ে দিতে মন চায় কিন্তু পারেন না। তার কারণ হচ্ছে আমেনা বেগমের কুটনৈতিক বুদ্ধি। এ কারণেই মাছের কাঁটা গলায় আটকে থাকার মতোন সয়ে যেতে হয় তাকে।
– “মাইয়া মাইনষের মতোন মাথামোটা হইলে এই পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকা থাকবার পারতাম না বুঝলা আমেনা? সবকিছুর জন্যই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হয়। খুব গভীর কইরা পরিকল্পনা করতে হয়।
তয় আরেকটা কথা কি জানো, বলির পাঁঠা, গরুরে বলি দেওয়ার আগে পরম যত্ন করতে হয় ক্যান? যাতে কইরা বলি দেওয়ার সময় সেই বলির পাঁঠা তার যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ভুইলা তার জীবন নিজ ইচ্ছায় উৎসর্গ কইরা দেয়। তেমনি মাইনষের জীবনের শেষ সময়টুকুতে একটু খাতির আপ্যায়ন করলে মন্দ হয় না।”
ইফতেখার সাহেবের কথার মর্মার্থ বুঝতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয় আমেনা বেগমকে। কিন্তু বুঝে ওঠার পরক্ষণেই তার মুখশ্রীতে পৈশাচিক আনন্দ তৃপ্তি ফুটে ওঠে।
বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে উপমা। একে তো চারপাশে অন্ধকার তার উপর উঁচু নিচু রাস্তা। আবেগের বাসার সামনে এসে দাড়াতেই হৃদস্পন্দন আগের তুলনায় অতি বেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ তার। আচ্ছা আবেগ আছে তো? চলে যায় নি তো তার সাথে দেখা না করে? সামনে যতই এগোচ্ছে ততোই অসাড় হয়ে আসছে শরীর। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার কড়া রেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় উপমা। আবেগ তার উপর অভিমান করে বসেনি তো আবার? ভাবতেই দরজায় কড়া নাড়ে সে।
নাহ্, কারো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে কি বাড়িতে কেউ নেই? না, কেউ না থাকলে তো তালা ঝোলানো থাকত। পুনরায় কড়া নাড়তে যাবে তার পূর্বেই দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে বেশ হকচকিয়ে যায় উপমা। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আপনি?”
ঘুম ঘুম চোখে ছিল সায়ান। কোনো মেয়েলি কন্ঠ শুনে প্রথমে চমকে গেলেও পরমুহূর্তে উপমাকে দেখে স্বাভাবিক হয় সে।
– “উপমা তুমি এখানে?”
বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় উপমা। কিভাবে আবেগের কথা জিজ্ঞেস করবে সে ভাবতেই অস্বস্তি হয় তার।
– “আচ্ছা ডাক্তার মশাই কোথায়? তিনি কি ঘুমাচ্ছেন?”
ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে উপমা। সায়ান উপমার ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। তারপর প্রত্যুত্তরে যা বলে তাতে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় উপমার।…………..
#চলবে
#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#উনবিংশ_পর্ব
৪৮.
খানিকটা অন্ধকার হলেও নদীর স্বচ্ছ পানি চিকচিক করছে। নদীর পাশে আসতে অনেকটাই বেগ পেতে হয়েছে উপমাকে। আবেগের বাসা থেকে একটু দূরেই বলা চলে নদীটাকে। এত পরিশ্রম তখনই পূর্ণতা পাবে যখন সে তার কাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষটিকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে। আর হলোও তাই। ঘাটে বাঁধানো নৌকার পাশেই পুরুষালী দেহের অবয়ব চোখে পড়ে তার এবং তাকে চিনতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না উপমার।
একটু আগেই যখন সায়ানকে আবেগের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার পর প্রত্যুত্তরে যখন সায়ান বলেছিল যে আবেগ বেরিয়ে পড়েছে তখন একটুর জন্য মাথা ঘুরে উঠে নি উপমার। তাকে এমন বিচলিত হতে দেখে সায়ান সশব্দে হেসে দিয়ে বলে দেয় আবেগ এই মুহূর্তে কোথায় আছে। নিজের স্বভাবে কিছুটা লজ্জা পেয়ে সায়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে উপমা।
আবেগকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই মুচকি হাসে উপমা। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আবেগের দিকে। অন্যদিকে বেশ খানিকক্ষণ হতে চললো আবেগ নদীর পাশেই বসে আছে এই ভেবে কখন উপমা আসবে। একটু পরেই তো চলে যেতে হবে তাকে। তাকে নিয়ে উপমার এমন বেখেয়ালীপনা ঠিক মেনে নিতে পারলো না আবেগ। হঠাৎ করেই তার মনে একঝাঁক অভিমান হানা দিল। সেই সুবাদে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বসা থেকে উঠে পড়ে। অতঃপর পেছনে ঘুরে তাকাতেই ভুত দেখার মতন চমকে উঠে কয়েক পা ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায় সে। আর সেটা পরিলক্ষিত হতেই না চাইতেও খিলখিল করে হেসে দেয় উপমা।
মৃদু আলোর ছিটেফোঁটা উপমার মুখশ্রী জুড়ে পড়তেই মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আবেগ। মনে মনে সময় থেমে যাওয়ার মতো অদ্ভুত ইচ্ছে পোষণ করে বসে সে। অপরদিকে আবেগকে নিজের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে দেয় উপমা। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে রসিকতার সুরেই বলে উঠে সে,
– “কি ব্যাপার ভ্যাবলা কান্ত মশাই; ভয় পেয়ে গিয়েছেন মনে হয়! কই আগে তো জানতাম না ডাক্তার মশাইয়েরাও ভীতু হয়।”
উপমার কথায় মাথা হালকা চুলকে নেয় আবেগ। প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে না সে। মিনিট কয়েকের নিস্তব্ধতা। কারো ঠোঁটেই কোনোরূপ কথা নেই; যা হচ্ছে তা শুধু চোখের ভাষার বিনিময়। দুজনের চোখই দুজনের চোখে আবদ্ধ। এ নিশ্চুপতাই কত কথা বলে যাচ্ছে একে অপরের সাথে, আবার অভিযোগ ও শুনিয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। মিনিট পাঁচেক বাদেই সেই নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেয়ে বসতে বলে উপমা। আবেগ ও তাই করে।
– “আচ্ছা আপনে ফের কবে আসবেন?”
উপমার বলা এ ছোট বাক্যেও যে রাজ্যের বিশাল কষ্ট লুকিয়ে আছে তা মুহূর্তেই বুঝে নেয় আবেগ এবং তা শুনে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে।
– “খুব শীঘ্রই আসব শ্যামবতী! আর তোমাকেও তোমার ডাক্তার মশাইয়ের কাছে চিরদিনের জন্য নিয়ে যাব; যাতে করে ডাক্তার মশাইয়ের বদ্ধ কুটির হতে আর ছুটে না যাও।”
বিনিময়ে মুচকি হাসে উপমা। এভাবেই কেটে যায় কিছুক্ষণ সময়। এ বিদায়ে হৃদয় ব্যাথিত হলেও এ সময়টা স্বরণীয় করে রাখার মতো। ভোরের আবছা আলোতে চারপাশ হালকা হালকা আলোকিত হতে শুরু করেছে। উপমা আর আবেগ দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। বিদায় পালা ক্রমশ যে ঘনিয়ে আসছে। উপমা তার বিষন্ন হৃদয় নিয়েই হাতে থাকা রুমাল টা আবেগের দিকে এগিয়ে দেয়। প্রথমে ভ্রু কুঁচকে নিলেও পরবর্তীতে উপমার দেয়া সেই রুমাল টা হাতে নিয়েই আবেগ খেয়াল করে কেউ একজন খুব যত্ন করে তাতে কারুকাজ ফুটিয়ে তুলেছে। রঙিন সুতোয় গাঁথা আবেগের নাম ক্ষুদ্রাক্ষরে।
আবেগও খুব সযত্নে সেটা তার শার্টের পকেটে পুরে নেয়। চোখের ইশারায় উপমাকে তার চলে যাওয়ার কথা জানাতেই গুটি গুটি পায়ে আবেগের সামনে এসে দাঁড়ায় উপমা।
– “সাবধানে থাইকেন। আর জলদিই ফিরা আইসেন। এই ত্রিমোহিনী আর এই উপমা দুইজনই আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”
মৃদু কন্ঠে উপমার আবেদন। আবেগ ও মৃদু হাসে তার প্রেয়সীর কথায়। হাত দুটো প্রসারিত করে উপমার চিবুক ছুঁয়ে দিতেই পিলে চমকে উঠে উপমা। পুরো শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। মাথা তুলে তাকাতেই আবেগের চোখে চোখ পড়ে তার। সে চোখের ভাষা কি যে গভীর তা অনুভব করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। অন্যদিকে উপমার কাজল রাঙা কৃষ্ণ চোখ দুটোর অতলে এক মুহূর্তের জন্য ডুবে যায় আবেগ।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু কিছু ভুল বলেন নি,
‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!’
এই কথার ভাবার্থ আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”
আবেগের কথায় লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা উপমার। চোখ দুটোও তড়িৎ গতিতে নিচে নামিয়ে ফেলে সে। লজ্জা পেলেও যে কোনো রমণীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগতে পারে তা আগে জানত না আবেগ। ঠোঁট দুটো কিঞ্চিত প্রসারিত করে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উপমার কপালে নিজের ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।
– “ভালোবাসি শ্যামবতী!”
উপমাও প্রত্যুত্তরে মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
– “আমিও ভালোবাসি ডাক্তার মশাই।”
৪৯.
প্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে যাওয়া বরাবরের মতই যথেষ্ট কষ্টকর। আর সেখানে যদি কেউ কারো প্রতি প্রবলভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে তো কোনো কথাই নেই। উপমা আর আবেগের ক্ষেত্রে ও ঠিক একই ঘটনা ঘটছে। উপমা দু পায়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর আবেগের অবয়বটাও ক্রমশ তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এইতো আরেকটু হলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে তার অবয়ব। আর হলোও সেটাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবেগ আর তার মাঝে বিশাল এক দূরত্ব তৈরি হলো। উপমাও সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অতঃপর নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
– “আপনি আইবেন তো ডাক্তার মশাই? আপনার প্রেয়সীরে সত্যিই কি নিজের করে নিয়ে যাইতে পারবেন; নাকি তার আগেই সবটা কর্পূরের ন্যায় বাতাসে মিলাইয়া যাইব!”
এ কন্ঠে যেন অজানা এক আশংকা লুকায়িত। যা উপমার সুপ্ত হৃদয়ের সব রঙকে মুহুর্তেই ফ্যাকাশে করে ছেড়ে দিয়েছে।
ভোরের আলো ফোটার একটু পরেই চুপিচুপি সবার নজর এড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে উপমা। এখনও সবাই ঘুমিয়েই আছে। সেই ধারণা নিয়েই বারান্দায় প্রবেশ করতেই কোনো পুরুষালি হাতের চড় তুমুল গতিতে এসে পড়ে উপমার কোমল গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায় উপমা। সাথে সাথেই মুখ থেকে মৃদু কন্ঠে বেরিয়ে আসে, ‘আহ্!’
মাথাটা পুরো ঝিমঝিম করছে। করারই কথা; এত শক্তিশালী চড় খেলে যে কারোরই মাথা ঘুরে যাবার কথা। ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে তাকাতেই খেয়াল করে ইফতেখার সাহেব তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চেহারায় তার রাগ ও ক্ষোভের মিশ্রণ। আমেনা বেগম ও পেছনে দাঁড়িয়ে সরু দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছেন। হঠাৎ করে যে কি হলো তা বুঝতে পারে না উপমা।
– “আব্বা, তুমি আমার গায়ে হাত তুললা? কি করছি আমি?”
ইফতেখার সাহেবের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে ওঠে উপমা। উপমার কথা শুনে অনেকটাই মুখ বাঁকিয়ে কটাক্ষের জবাবে আমেনা বেগম বলে উঠেন,
– “ন্যাকা সাজা হইতাছে মুখপুড়ী? অ্যাহ্, সারা গ্রামগঞ্জে ঘুইরা ঘুইরা নাগরের সাথে প্রেম করবি আবার উল্টো জিজ্ঞেস করিস কি হইছে!”
আমেনা বেগমের কথার ভাবার্থ খুঁজে পায় না উপমা। কার কথা বলছে সে?
– “কি সব বলতেছ তোমরা? কার সাথে ঘুরছি আমি?”
– “চুপ একদম চুপ! মুখপুড়ী, অপয়া একটা! আবার মুখে মুখে তর্ক করিস। সজল সব দেখছে। কি কইরা তুই ঐ ডাক্তার বেটারে জড়াইয়া ধইরা আছিলি। ছিঃ ছিঃ! গ্রামে কুকাম কইরা বেরাইয়া মুখে তার বড় বড় কথা। বলি কি লজ্জা করে না? ঐ নদীর ঘাটেই তো ডুইবা মরলে পারিস।”
আমেনা বেগমের কথায় এবার সবকিছু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে উপমার কাছে। সজল যে তার চরিত্রে এভাবে নর্দমার কাদা ছুড়ে মারবে তা কে জানতো? সে প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইফতেখার সাহেব কাট কাট গলায় বলে উঠেন,
– “আইজকাই এইসবের মিটমাট কইরা দিতে হইব। আর কান খুইলা শুইনা রাখ; আইজকাই তোর বিয়া হইব তাও আমার পছন্দের পোলার লগে। সজলের লগেই তোর বিয়া হইব। তোর কারণে আমি আমার মানসম্মান হারাইতে পারুম না।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে মুহুর্তেই পুরো চেহারার রং উড়ে যায় উপমার। কি করে সম্ভব এ? সজলের মতো একজন চরিত্রহীন মানুষকে বিয়ে করার চেয়ে তো ঐ নদীতে ডুবে মরাই উত্তম মনে হলো উপমার কাছে। কিন্তু না, এই বিয়ে করা সম্ভব নয়। এই বিয়ে হয়ে গেলে আবেগের কি হবে। এই ভাবতে ভাবতেই উপমা প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠে,
– “আব্বা!”
কিন্তু ইফতেখার সাহেব উপমাকে পাত্তা না দিয়েই বারান্দা থেকে বেরিয়ে যান। তবে যাওয়ার পূর্বে বলে যান,
– “আমি যাইতাছি গঞ্জে। আইসা যাতে দেখি এই বাড়ির বড় মাইয়া বিয়ার জন্য তৈরি।”
আমেনা বেগম ও মুখ বাঁকিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ান। ইফতেখার সাহেব ও চলে যেতেই সেখানে উপস্থিত হয় সজল। আর সজলের দিকে চোখ যেতেই উপমার রাগ উঠে যায়। একপ্রকার তেড়ে গিয়ে সজলকে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বে সজলই বলে উঠে,
– “কইছিলাম না তোরে আমার কাছে আসতে হইব; এক রাতের জন্য হোক আর নাইলে সারাজীবনের জন্য হোক। দেখ ঘুইরা ফিরা তুই আমার জালেই আটকা পড়লি উপমা। তৈরি থাকিস, দেখা হইব।”
– “ভালো হইব না কিন্তু সজল ভাই। আপনের ভালো মানুষির পর্দা আমি খুইলা দিমু। আর একটা কথা ভালো কইরা শুইনা রাইখেন; এই বিয়া দুঃস্বপ্নেও কোনোদিন হইব না।”
বলেই সজলকে পাশ কাটিয়ে ভেতরের দিকে চলে যায় উপমা। ছোট পূর্ণা সবটা দেখলেও ভয়ে জড়সড় হয়ে আর মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পায় নি।………………..
#চলবে ?