#মায়ারণ্যে
#পর্ব-৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★ সকালের ঝলমলে রোদটা চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে এলো অরণ্যের। কপাল কুঁচকে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো ও এখনো ছাঁদেই আছে। রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। রুমে ওর যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই এখানেই বসে থাকতে থাকতে একসময় হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ কিছু পানির ছিটা এসে লাগলো অরণ্যের মুখে। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকালো। আর তাকাতেই ওর আঁখি যুগল আটকে গেল। সামনে মায়া বালতী থেকে ধোয়া কাপড়চোপড় নেড়ে দিচ্ছে। ভেজা কাপড় গুলো ঝাড়ি দিয়ে নাড়ছে। সেই কাপড়ের পানির ছিটাই লেগেছে অরণ্যের মুখে। পানির ছিটা মায়ার মুখেও লাগছে। পানির ছিটা মায়ার মুখে বিন্দুর কণা হয়ে জমে আছে। সামনের চুলগুলোও ভিজে উঠেছে পানির ছিটাই।অসম্ভব স্নিগ্ধ আর মায়াবী লাগছে মেয়েটিকে। যেন কোন সদ্য ফোটা ফুলের ওপর ভোরের শিশির কণা জমে আছে। সকাল সকাল এমন দৃশ্য দেখে ঘোর লেগে যাচ্ছে অরণ্যের। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। বুকের মাঝে আবারও সেই অজানা অনুভূতির মেলা জমছে।
হঠাৎই অরণ্য মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? কি করছি আমি এসব? অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে এসব অনুচিত ভাবনা মনে আসে কিভাবে? না না এসব ঠিক না। একদম ঠিক না।
মায়া এতক্ষণেও অরণ্য কে খেয়াল করেনি।ও ওর মতো কাজ করে যাচ্ছে। কাপড়চোপড় নেড়ে দেওয়া শেষে মায়া চলে যেতে নিলে তখনই অরণ্যেকে দেখতে পেল। এই সময় অরণ্যকে এখানে দক মায়া অনেক টা অবাক হলো। উনি এখানে কি করছেন? উনি কি এখানেই ছিলেন রাতে? মায়া অরণ্যের দিকে এগিয়ে যেতে নিয়েও আবার গেলনা। উনার থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। কথাটা ভেবে মায়া আবারও বালতী নিয়ে চলে গেল।
মায়া ট্রেতে করে দুই কাপ গরম চা নিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো। ট্রে টা টেবিলে রেখে বেডের কাছে এগিয়ে গেল। সারা আর রাইসা এখনো ঘুমে কাদা। মেয়েগুলো সত্যিই ভারি মিষ্টি। কতো রাত পর্যন্ত ওর সাথে গল্প করলো। যেন নিজের বোনের মতো। মায়া মুচকি হেসে সারা আর রাইসাকে ডাক দিল। কতক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে ওরা দুজন উঠে বসলো। মায়া ওদের বেড টি এনে দিলে ওরা হাসিমুখে বললো।
–ওয়াও আপু তুমি কত্তো মিষ্টি। সকাল সকাল আমাদের ওঠার আগেই বেড টি নিয়ে এসেছ। তোমাকে এত্তো গুলো থ্যাংক ইউ।
মায়া মুচকি হেসে বললো।
–ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। এখন বলো তোমরা নাস্তায় কি খাবে? আমি এখুনি তোমাদের নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।
রাইসা বলে উঠলো।
–আরে আপু তোমার এতো কষ্ট করতে হবে না। একটা কিছু হলেই হবে।
মায়া বলে উঠলো।
–বললেই হলো নাকি। তোমরা আমাদের মেহমান। এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছ আর একটু মেহমান নওয়াজি না করলে কি হয়?
সারা মিছে অভিমান দেখিয়ে বললো।
–ওও তারমানে আমরা তোমার শুধুই মেহমান। আমরা তো কোথায় তোমাকে আমাদের বোন ভাবছিলাম। আর তুমিতো এখনো আমাদের মেহমানই ভেবে যাচ্ছো। যাও খেলবই না।
মায়া হালকা হেঁসে সারার দুই গাল টেনে বললো।
–আলে লে আমার বোনুটা রাগ করেছে বুঝি। আচ্ছা ঠিক আছে। কান ধরছি আর কখনো এই ভুল হবে না এবার ঠিক আছে তো?
সারা এবার একগাল হেঁসে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক আছে। আর হ্যাঁ তোমার যা ভালো লাগে তাই বানাও। আমরা সবই খেয়ে নেব।
–আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো। আমি তোমাদের জন্য নাস্তা রেডি করছি।
–ওক্কে আপু।
মায়া মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে।
____
অরণ্য ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে। তবে তার অবাধ্য বেহায়া চোখের দৃষ্টি বারবার শুধু রান্নাঘরে দিকেই যাচ্ছে। রান্না ঘরে মায়া রান্না করছে। সোফা থেকে সরাসরি মায়াকে দেখা যাচ্ছে। মায়া ওড়না কোমড়ে বেঁধে চুলে খোঁপা করে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। দেখতে যেন অনন্যা লাগছে। অরণ্য চেষ্টা করেও নিজের দৃষ্টি সরাতে পারছে না। বারবার ঘুরেফিরে চোখ দুটো শুধু সেদিকেই যাচ্ছে। সামনের কিছু চুল বারবার মায়ার মুখের এসে পড়ছে। আর মায়া বিরক্ত হয়ে সেগুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। অরণ্যের ইচ্ছে করছে নিজের হাতে পরম যত্নে ওই চুলগুলো মায়ার কানের পিঠে গুজে দিতে।
নিজের এমন অবাধ্য ভাবনায় নিজেই চমকে যায় অরণ্য। সাথে সাথে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় সে। কি হচ্ছে আমার সাথে? কি ভাবছি আমি এসব? এমন অনৈতিক চিন্তা ভাবনা আমার মাথায় কেন আসছে? না না এসব ঠিক না। এটা পাপ। আমি এসব অযাচিত কাজ করতে পারি না। কিছুতেই না। আমাকে যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। নাহলে অনেক খারাপ কিছু হয়ে যাবে।
____
ড্রয়িং রুমে তনিমা বেগম আর এলিসা বসে নানান কথা বার্তা বলছে। তখনই ওখানে এক প্রতিবেশী মহিলা এসে হাজির হলো। তাকে দেখে তনিমা বেগম হাসিমুখে বললো।
–আরে লাবনী ভাবি কেমন আছেন?
মহিলাটি সোফায় বসতে বসতে বললো।
–এইতো ভাবি ভালো আছি। আপনাদের কি অবস্থা? নতুন বউ আসলো। তা কেমন নতুন বউ কেমন?
–জ্বি ভালোই আছে।
মহিলাটি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–ভালো হলেই ভালো। একটু খেয়াল রাইখেন। আবার যেন মেয়ের মতো হয়না। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো কোনো ভরসা নেই। কখন কি হয়ে যায় কে যানে।
মহিলার খোঁচা মারা কথায় তনিমা বেগমের মুখটা ছোট হয়ে গেল। মেয়েটার জন্য তাকে কতজনের কত কথাই না শুনতে হয়। এলিসা বেগম তখন কথা ঘোরানোর জন্য বলে উঠলো।
–আরে ভাবি এসব ছাড়ুন। আপনি পাদ (ভাত) খেয়ে যান। আজ আমাদের সাথে ইদুর (ইলিশ) দিয়ে পাদ খেয়ে যান। অনেক গাঁজা (মজা) হয়েছে।
এলিসার খাবারের বর্ননা শুনে মহিলাটির বমি হওয়ার উপক্রম। তনিমা বেগম তখন বলে উঠলো।
–আরে ভাবি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আসলে ও বাংলা ঠিকমতো বলতে পারেনা তো তাই ভুলভাল বলে ফেলে।
মহিলাটি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো।
–আচ্ছা যাইহোক আমি যে কথা বলতে এসেছিলাম তাই বলি। আপনারা তো জানেনই আমার আবার সবার ভালো করার অভ্যাস। তাই আজও আপনাদের একটা ভালো কাজ করতেই এসেছি। আসলে ইরিনের জন্য আমার হাতে একটা ভালো ছেলে আছে। আপনারা বললে কথা বলতে পারি।
তনিমা বেগম একটু খুশি হয়ে বললেন।
–তাই নাকি? তা ছেলে কোথাকার? আর কি করে?
–ছেলে সব দিক দিয়েই সেরা। সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার। নিজের বাড়ি গাড়ি সবই আছে। দেখতেও মাশাল্লাহ। শুধু হালকা একটু সমস্যা আছে।
তনিমা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন।
–কি সমস্যা?
–ছেলেটার আগে বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরের দুটো ছেলে মেয়ে আছে। ব্যাস এতটুকুই। এটুকু তো মানিয়ে নিতেই হবে। আফটার অল আপনাদের মেয়েরও ডিফেক্ট আছে তাইনা? ওমন মেয়ের জন্য তো আর কোন অবিবাহিত তরুণ ছেলে পাবেন না তাইনা?
মহিলাটির কথায় এলিসা বেগম রাগে কিড়মিড় করছে। তনিমা বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। তিনি অসহায় কন্ঠে বললেন।
–তাই বলে দুই বাচ্চার বাবার সাথে বিয়ে দেব? মা হয়ে এটা কিভাবে করতে পারি বলুন?
–আরে দুই বাচ্চা হয়েছে তো কি হয়েছে? ছেলে মানুষের আবার বয়স দেখে নাকি কেও? আরে আপনার সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলে পাচ্ছেন এটাই তো আপনাদের সৌভাগ্যের ব্যাপার।
–তাহলে সেই সৌভাগ্য টা আপনি কেন লুফে নিচ্ছেন না?
সবাই সামনে তাকিয়ে দেখলো ইহান দাঁড়িয়ে আছে। ইহান সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বললো।
–হ্যাঁ আন্টি ব্যাপার টা যদি এতোই সৌভাগ্যের, তাহলে আপনি কেন সেই মহামূল্যবান সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবেন। আপনি নিজেই সেটা লুফে নিন। আপনারও তো মেয়ে আছে তাইনা?
ইহানের কথায় মহিলাটি ঝাঝালো কন্ঠে বললো। –কি আবোল তাবোল বলছ তুমি? আমার মেয়ের সাথে ইরিনের তুলনা করছ তুমি?
ইহান বাকা হেসে বললো।
–না না আন্টি কিযে বলেন না,ইরাবতীর সাথে কি আর আপনার মেয়ের তুলনা হয়? কোথায় চুপচাপ গাইয়ের মতো থাকা ইরাবতী। আর কোথায় আপনার আল্ট্রামডার্ন মেয়ে। বায়দা ওয়ে আপনার মেয়ের যে এতগুলো বডিগার্ড আছে তা আমি জানতামই না।
মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–বডিগার্ড?
–হ্যাঁ বডিগার্ড। সবসময়ই দেখি আপনার মেয়ের বডির সাথে তিন চারজন ঘেঁষে থাকে। তাই ভাবলাম বডিগার্ড হবে হয়তো।যাই বলুন আন্টি বডিগার্ড গুলো কিন্তু অনেক কেয়ারিং। সেদিন তো পাবে নেশায় ধুত আপনার মেয়েকে কি সুন্দর কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিল। আজকাল এমন কেয়ার কে করে বলুন।
ইহানের তীর মারা কথায় মহিলাটি ক্ষেপে গিয়ে বললেন।
–ব্যাস ব্যাস অনেক হয়েছে। কোথায় আমি আপনাদের ভালোর কথা ভাবছিলাম। আর আপনারা কিনা উল্টো আমাকেই অপমান করছেন? আরে আপনার ওই মেয়েকে কোন বুড়োও বিয়ে করবে না। হুহ ভালোর কাল নেই।
ইহান রাগে চোয়াল শক্ত করে আরও কিছু বলতে গেলেই তনিমা বেগম ওকে চোখের ইশারায় মানা করলো।
আর কথাগুলো বলতে বলতে মহিলাটি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ওখান থেকে।
ইরিন সিড়ির ওপর থেকে এতক্ষণ সব কথাই শুনছিল। নিজেকে এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে তুচ্ছ প্রাণী মনে হচ্ছে। যেন ও দুনিয়ার ওপর একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে ওর মা বাবার কথা ভেবে। ওর জন্য আজ ওর পরিবারকে সবার এতো কটু কথা শুনতে হচ্ছে। আজ ওর ভুলের জন্য মা বাবাকে এতো ছোট হতে হচ্ছে। এর থেকে মৃত্যুও হয়তো ভালো ছিল। তবে মরাটাও যে এতো সহজ না। নিজের ইচ্ছায় মৃত্যু গ্রহণ করাটা মহাপাপ না হলে,হয়তো কবেই সে এ কাজটা করে ফেলতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইরিন অশ্রু ভরা চোখে ওখান থেকে চলে গেল।
ইরিনের সেই করুন দৃশ্য ইহানের চোখ এড়ালো না। ইরিনকে এভাবে দেখলে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে তখন। কেন সে তার ইরাবতীর কষ্ট দূর করতে পারে না?এতো ভালোবেসেও কেন সে তাকে আগলে নিতে পারে না? এই কেনোর উত্তর কখনো কি পাবে সে?
ছাঁদে এসে বিষন্ন মনে বসে আছে ইরিন। একটু পরেই ইহান এলো ওখানে। এসেই এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি দিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো। ইরিন সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিছু খুঁজছ ইহান?
–হ্যাঁ একটা দামী জিনিস হারিয়ে গেছে সেটাই খুঁজছি।
–কি জিনিস?
ইহান এবার ইরিনের সামনে বসে বললো।
–ইরাবতীর হাসিটা। অনেকক্ষণ হলো খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি দেখেছ কোথাও?
ইহানের কথায় ইরিন মলিন হেঁসে বললো।
–আমি জানি তুমি আমার মুড ঠিক করার জন্য এসব বলছ। তবে এসবের কোনো দরকার নেই। আমি ঠিক আছি। এসব তো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর তেমন গায়ে লাগে না। তবে তোমার ওই আন্টির সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। উনি অনুচিত তো আর কিছু বলেন নি। আমার মতো মেয়েকে কেই বা বিয়ে করতে চাইবে বলো?
ইহাব ফট করে বলে উঠলো।
–আমি করবো। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আজ এক্ষুনি আমি তোমাকে বিয়ে করবো ইরাবতী।
ইরিন কতক্ষণ ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর হঠাৎ হো হো করে হেঁসে উঠলো ইরিন। প্রতিবারের মতোই এবারো ইহানের সত্য টাকে মজা ভেবে হেঁসে উড়িয়ে দিল ইরিন। ইহান সেটা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। যাক মজা ভেবেই হোক তবুও তো হাসি ফুটলো তার মুখে। এটাই বা কম কিসে।
________
সকালের নাস্তাটা কোনরকমে করে নিয়ে রুমে এসে অরণ্য তড়িঘড়ি করে রেডি হচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে ও সত্যি পাগল হয়ে যাবে। মায়াকে দেখলেই ওর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে প্রস্থান করতে চাইছে। নাহলে যে অযাচিত কিছু হয়ে যাবে। যেটা অরণ্য চাইছে না।
অরণ্য রিয়াকে বলেছে সে চাইলে কিছুদিন এখানে থাকতে পারে। তবে রিয়া বলেছে সে আজই অরণ্যের সাথেই যাবে। তাই রিয়া আর অরণ্যের বোনেরা সবাই একসাথেই যাবে।
মায়াও নিজের রুমে এসে রেডি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। মায়া আলমারি খুলে নতুন বোরখা টা বের করলো। সেদিন হঠাৎই মায়ার মামি ওকে এই নতুন বোরখা টা এনে দিয়ে বললো, এখন থেকে যেন এই বোরখাই পরি। পুরানো বোরখা পরার আর দরকার নেই। মায়া সেদিন প্রচুর অবাক হয়েছিল। আজ পর্যন্ত ওর মামি ওর জন্য কখনও কোন জিনিস আনেনি। আর হঠাৎ করে ওমন নতুন বোরখা দেওয়ায় অবাক হওয়াটাও যেন কম ছিল ওর কাছে। তবে যাইহোক নতুন বোরখা পেয়ে মায়া খুশিই ছিল। আগের বোরখা টা এমনিতেও অনেক পূরানো হয়ে গিয়েছিল। মায়ার টিউশনির টাকা দিয়ে রাস্তার পাশের খোলা দোকান থেকে কিনেছিল বোরখা টা। অনেক বছর হয়ে গেছে। তাই অনেক পুরানো আর রঙটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
তাই মায়া ওর মামির কথামতো সেদিন থেকে এই নতুন বোরখা টাই পরে।
মায়া রেডি হচ্ছে, তখনই সারা আর রাইসা এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–আমরা চলে যাচ্ছি আপু। তোমাকে অনেক মিস করবো মায়া আপু।
ওদের জন্য মায়ারও একটু খারাপ লাগছে। মায়া মুচকি হেসে বললো।
–আরে মন খারাপ করোনা। তোমাদের যখনই মন চাইবে আমার সাথে দেখা করে যেও কেমন?
সারা বলে উঠলো।
–ইশশ আপু তোমাকেও যদি আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারতাম তাহলে অনেক মজা হতো। তুমিও আমাদের সাথে চলনা?
সারার কথায় মায়ার বুকের ভেতর হঠাৎ ধুক করে উঠলো। আজ যদি সব ঠিক থাকতো তাহলে এমনটা হয়তো সত্যি সত্যিই হতো। কথাটা ভেবে বুক চিঁড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মায়ার। ওসব ভাবনাও যে বোকামি। তাই জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–এটা হয়না সারা। আমি কি আর তোমাদের সাথে যেতে পারি? তবে তোমাদের যখন ইচ্ছে আমার সাথে এসে দেখা করে যেতে পারো। আমারও ভালো লাগবে। আফটার অল তোমাদের মতো এতো কিউট কিউট বোন আমি কোথায় পাবো বলো। আমিও তোমাদের অনেক মিস করবো।
সারা আর রাইসা মায়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে চলে গেল। মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের কাজে মননিবেশ করলো। বোরখা পরে রেডি হয়ে বের হতে যাবে তখনই হঠাৎ রাদিব ওর দিকে দৌড়ে এলো। আচমকা এমন হওয়ায় মায়া আর রাদিব একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা খেল। রাদিবের হাতে ছিল জুসের বোতল। ধাক্কা লাগায় জুসের বোতল থেকে অনেক টা জুস মায়ার বোরখার ওপর পড়ে গেল। ফলে মায়ার বোরখায় জুসের দাগ লেগে গেল। সেটা দেখে রাদিব অপরাধী সুরে বললো।
–সরি আপু আমি বুঝতে পারিনি।
মায়া বলে উঠলো।
–ইটস ওকে কোনো ব্যাপার না। আমি এখুনি চেঞ্জ করে নিচ্ছি।
নতুন বোরখা নষ্ট হওয়ায় মায়া আবারও সেই পুরানো বোরখা টাই বের করে পড়ে নিল।
এদিকে অরণ্যরাও চলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। বের হওয়ার সময় অরণ্যের অবাধ্য চোখ দুটো আরচোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়াকেই খুঁজছিল। হয়তো চলে যাওয়ার আগে একনজর দেখার আশা জেগেছিল। তবে মায়াকে কোথাও না দেখতে পেয়ে আশাটাকে নিজের মাঝেই দমিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল অরণ্য। বাইরে গাড়ির কাছে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্যও সেখানে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ অরণ্যের মনে পড়লো ও ওর ওয়ালেট রুমের ভেতরেই ভুলে এসেছে। অরণ্য ওর ওয়ালেট টা আনার জন্য আবারও বাসার ভেতর ঢুকলো।
বাসার ভেতর ঢুকে আনমনেই সামনে তাকালো অরণ্য। আর সামনে তাকাতেই থমকে গেল সে। পুরো পৃথিবী টা যেন মুহূর্তেই ঘুরে উঠলো অরণ্যের। ও যা দেখছে তাকি সত্যি দেখছে নাকি ভ্রম? ওর চোখের সামনে ওর সেই সন্ধ্যামালতীকে দেখতে পাচ্ছে অরণ্য। হ্যাঁ সন্ধ্যামালতী। সেই একই বোরখা,সেই একই চোখ, একই রকম চাহুনি। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? সন্ধ্যামালতী তো রিয়া। তাহলে এই মেয়ে কে? তবে কি আমি সত্যি সত্যিই ভুল কাওকে বিয়ে করলাম?
কথাটা ভাবতেই অরণ্যের চোখের সামনে সবকিছু গোল গোল ঘুরতে লাগলো। না না এটা হতে পারে না। কিছুতেই না। আমার বিশ্বাস এভাবে হেরে যেতে পারে না।
চলবে…..