#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-২৬
★ড্রয়িং রুমে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।মায়ার মাঝে আপাতত কোন অনুভূতি কাজ করছে না। কেমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্যের রাগের মাত্রা সর্ব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রিয়ার এমন নির্লজ্জকর সম্পূর্ণ মিথ্যে একটা আরোপ শুনে অরণ্যের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত করে রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–শাস্ট শাট আপ ইউ চিপ গার্ল। তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। একেতো আমার বাড়িতে পা রাখার দুঃসাহস করেছিস। তারওপর নির্লজ্জের মতো এতবড় একটা মিথ্যে কথা বলছিস? জানের মায়া বুঝি ফুরিয়ে গেছে তোর। তাইতো নিজ হাতে মরতে এসেছিস।
রিয়া অতি কনফিডেন্স দেখিয়ে বললো।
–আমি মোটেও মিথ্যা বলছিনা। যা সত্যি তাই বলছি।আমি প্রেগন্যান্ট। আর এই বাচ্চা আপনার। সবাই জানে আমি এতোদিন আপনার সাথে এক রুমে ছিলাম। এখন আমার আর আমার বাচ্চার দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে।
অরণ্যের যেন রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। অরণ্য চোয়াল শক্ত করে বললো।
–আচ্ছা তাই? তা বাচ্চা বুঝি হাওয়ায় ভেসে এসেছে? যেখানে আমি তোকে টাচও করিনি। একটা দিনও এক বেডে ঘুমাইনি পর্যন্ত। সেখানে বাচ্চা কিভাবে এলো শুনি?
রিয়া বললো।
–হ্যাঁ জানি। কিন্তু সেদিন আপনি নেশা করে এসেছিলেন। আর নেশার ঘোরেই আপনি আমার কাছে এসেছিলেন। আপনার মনে নেই কারণ নেশায় মাতাল ছিলেন। আপনার কোন হুঁশ ছিল না।
–ব্যাস অনেক হয়েছে। অনেক মিথ্যে বলেছিস। আমি যতো মাতালই থাকি না কেন আমি তোর মতো মেয়ের সামনে কখনোই দূর্বল হবো না। এতটুকু সেন্স আমার আছে। তাই আরেক টা বাজে কথা বললে আমি সত্যিই খুন করে ফেলবো তোকে।
এবার অরণ্যের সাথে বাকি সবাইও সায় দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ অরণ্য ঠিকই বলেছে। আমাদের ওর ওপর বিশ্বাস আছে। তাই এসব ফালতু কথা না বলে বেড়িয়ে যাও এখান থেকে। কার না কার পাপ এনে আমাদের মাথায় ফেলার ধান্দা তাইনা?
রিয়া এবার বলে উঠলো।
–আমি জানতাম আপনারা বিশ্বাস করবেন না। তাই আমি প্রুফ নিয়েই এসেছি।
কথাটা বলে রিয়া ওর ফোন বের করে কিছু ছবি দেখালো। যেখানে অরণ্য খালি গায়ে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁধের ওপর শুয়ে আছে।
অরণ্যের বাবা আর চাচা রিয়ার কার্যকলাপে লজ্জায় মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। প্রচুর অস্বস্তিতে পড়ে গেল তারা। মেয়েটা যে এতো নির্লজ্জ তা জানায় ছিল না ওদের। সবার সামনে এসব দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। অরণ্য রাগী কন্ঠে বললো।
–এসব ফালতু ফটোল্যাব এর ছবি দেখিয়ে তুই সবাইকে বোকা বানাতে চাস? এসব ছবি রোজ হাজার বানানো যায়। তাই এসব নাটক বন্ধ করে এক্ষুনি বেড়িয়ে যা এখান থেকে।
রিয়া বললো।
–দেখুন আপনারা যদি আমার বাচ্চাকে মেনে না নেন। তাহলে কিন্তু আমি পুলিশের কাছে যাবো। নারী কল্যাণ সংস্থার কাছে গিয়ে এর দাবী করবো। তখন কিন্তু আপনাদের পরিবারেরই মানসম্মান যাবে। তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেন না।
–আরে তুই কি জানাবি। আমি এক্ষুনি পুলিশ কে ফোন করছি। তোদের সেদিনই পুলিশে না দিয়ে ভুল করেছি। তবে আজ আর সেই ভুল করবো না। তোকে এখুনি জেলে পাঠিয়ে ছাড়বো।
কথাটা বলেই অরণ্য ফোন বের করে পুলিশ কে ফোন করতে নেয়।মায়া এতক্ষণ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কিছু একটা মায়া বলে উঠলো।
–পুলিশ কে ফোন করবেন না প্লিজ। আ আমাদের রিয়াকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। ওর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে?
মায়ার কথায় অরণ্য আহত দৃষ্টিতে তাকালো মায়ার দিকে। তাহলে কি মায়া ওকে বিশ্বাস করছে না? সে ওই নির্লজ্জ মেয়েটার কথায় বিশ্বাস করছে? এই ছিল তার আমার ওপর বিশ্বাস?
অরণ্যের এই চাহুনির অর্থ মায়া বুঝতে পারছে। তবে মায়া সেটা উপেক্ষা করে সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
–দে দেখুন তাড়াহুড়োয় কোন ডিসিশন নেওয়া ঠিক হবে না। এতে আমাদের পরিবারের বদনামি হবে। তারচেয়ে ভালো আমরা নিজেরা নিজেরাই এটা সামলে নেই। আর তাছাড়া হতে পারে রিয়ার কথায় সত্যি আছে। আমি বলছিনা অরণ্য ভুল করেছে। কারণ অরণ্য তো আর জানতো না যে রিয়া তার বউ না। আর রিয়ার মতে অরণ্য সেদিন নেশায় বুদ ছিল। তাই হয়তো এমন কিছু হতেও পারে। সেক্ষেত্রে রিয়াকে একটা সুযোগ দেওয়া তো উচিত।
মায়ার কথায় অরণ্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না এসব কথা মায়া বলছে। অরণ্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়ার দিকে। ব্যাস এতটুকুই বিশ্বাস ছিল আমার ওপর তোমার?
অরণ্যের মা বলে উঠলো।
–তো এখন তুমি কি করতে চাও মায়া? এই মেয়েটার কথায় আমরা সব মেনে নেব? আর ওকে আমাদের বাড়িতে রেখে দিবো?
মায়া বললো।
–দেখুন এটা প্রমাণ করার একটা উপায় আছে। ডিএনএ টেস্ট। যদি রিয়া সত্যিই প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকে। তাহলে ডিএনএ টেস্টে জানা যাবে বাচ্চা কার। তবে সেটা এখন সম্ভব না। বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই না চাইতেও ততদিন রিয়াকে আমাদের এখানে রাখতে হবে।
অরণ্য এখনো চুপচাপ শুধু বিস্মিত চোখে মায়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।নাহ আজ আর সে কিছু বলবে না। মায়ার সামনে নিজেকো সঠিক প্রমাণ চেষ্টাও করবে না। মায়ার যদি ওর ওপর বিশ্বাসই না থাকে। তাহলে আর নিজেও কিছু বলবে না। যেখানে বিশ্বাসই নেই সেখানে কোন কিছু বলে কি লাভ?
অরণ্যের বাবা একটু ভেবে বললো।
–আমার মনে হয় মায়া ঠিকই বলছে। এসব ব্যাপার বাইরে জানাজানি হলে পরিবারের বদনামি হবে। একবার বাচ্চা হয়ে গেলে তখন সত্যি টা সামনে এসে যাবে। তখন দেখা যাবে এই মেয়ের সাথে কি করা উচিত। ততদিন এই মেয়েটাকে সহ্য করতে হবে। আর কিছু করার নেই।
অরণ্যের বাবার কথার ওপর আর কেউ কিছু বলতে পারলো না। তাই অগত্যা সবাই একমত হলো।
রিয়া মনে মনে একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিল। তার প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে।
আর অরণ্য রাগে দুঃখে কোন কিছু না বলে ওখান থেকে হনহন করে চলে গেল।
___
ডিনার টেবিলে বসে আছে ইহান আর ওর মা বাবা। একটু পরে ইরিন কিচেন থেকে খাবার নিয়ে এলো। আজ ইরিন ওর নতুন পরিবারের জন্য নিজে হাতে সবকিছু রান্না করেছে। নিজেকে এই পরিবারের সাথে মিশে যাওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করছে ইরিন। ইহানের মা বাবাও খুব খুশী হচ্ছে ইরিনের ব্যাবহারে।
ইরিন সবাইকে খাবার সার্ভ করতে লাগলো। ইহান শুধু মুগ্ধ হয়ে ওর ইরাবতীকে দেখছে। আজ ওর ইরাবতী ওর বউ।শুধুই ওর। কি সুন্দর বউয়ের মতো শাড়ী পড়ে ওর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ওদের জন্য নিজের হাতে রান্না করেছে। ইরাবতীর পদচারণে সারা বাড়ি যেন নতুন রঙে রেঙে উঠেছে।
ইরিন ইহানের প্লেটে খাবার সার্ভ করছে। আর ইহান গালে হাত দিয়ে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে ইরিনের দিকে। সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে থাকায় ইরিন প্রচুর লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে। ইহানের মা বাবাও মুখ টিপে হাসছে ইহানের কান্ড দেখে। ইহানের মা দুষ্টুমি করে বললো।
–বাবা ইহান, আজকে কি খাবার পেটে ঢুকাবি, নাকি বউয়ের মুখ দর্শন করেই পেট ভরবি?
ইহান ঘোরের মাঝেই বলে উঠলো।
–হ্যাঁ মা, একদম ঠিক বলেছ। এতো সুন্দর বউ হলে আর খাবারের কি দরকার। বউ দেখেই পেট ভরে যায়।
ইহানের কথায় ওর মা বাবা এবার উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। বেচারা ইহানের এবার ঘোর কাটলো। সবার সামনে একটু লজ্জায় পড়ে গেল সে। আর ইরিন তো পারছে না মাটির নিচে ঢুকে যেতে। এই ইহান টাও না, একদম বেশরম।
রাতে ইরিন শোবার জন্য তৈয়ারি করছে। তখনই ইহান ওর বালিশ টা হাতে নিয়ে চলে যেতে নিলেই ইরিন ইহানের হাত ধরে আটকে দিল। ইহান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ইরিন বলে উঠলো।
–সোফায় শোবার কোন দরকার নেই। তুমি চাইলে বেডেই শুতে পাড়ো। আমার কোন সমস্যা নেই। এতটুকু তো ভরসা আছে আমার।
ইহান অবাক চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো।
–আর ইউ শিওর?
ইরিন মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। ইহানের মনে যেন খুশীর এক উত্তাল ঢেউ উপচে পড়লো। ওর ইরাবতী ওর ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করছে। আর কি চাই ওর। ইহান মুচকি হেসে মাথা ঝাকালো। তারপর বেডের একপাশে গিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। ইরিনও লাইট বন্ধ করে শুধু ডিম লইট জ্বালিয়ে দিয়ে ইহানের পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। ইহান একটু সাহস করে বললো।
–ইরাবতী তুমি কিছু মনে না করলে তোমার হাতটা একটু ধরে ঘুমাতে দিবে?
ইরিন কিছু না বলে ওর হাতটা এগিয়ে দিল। ইহান মুচকি হেসে ইরিনের হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো। আর ইরিন তাকিয়ে আছে ইহানের ঘুমন্ত মুখটার দিকে। পাগল টা ওকে কতো ভালোবাসে। ওকি ইহানের এতো ভালোবাসার যোগ্য? যোগ্য নাহলেও হওয়ার চেষ্টা করবো। নিজেকে ইহান আর ওর পরিবারের আদর্শ বউ হয়ে ওঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। ইহান আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। এবার ওকে একটু সুখ দেওয়ার চেষ্টা তো করতেই পারি। এখন যে এই পাগল টা আমার স্বামী।
___
মায়া বেডে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ওর ভেতর কি চলছে তা শুধু ওই জানে।যা সে আপাতত না কাওকে বলতে পারবে, আর না কারও কাঁধে মাথা রেখে মন খুলে কাঁদতে পারবে। ও যা করতে চাইছে সেটা যে ওর জন্য কতটা কঠিন তা শুধু ওই জানে। ও জানে সামনের পথ হয়তো ওর জন্য আরও কঠিন হবে। তবে ওকে যে এটা করতেই হবে। এতেই যে সবার ভালো।
মায়ার ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার শব্দ পেল। মায়া জানে এখন অরণ্য এসেছে। তাই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করে পড়ে রইলো। এখন যে অরণ্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই ওর।
অরণ্য মায়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো। নিচে ওমন মহান কাজ করে এসে উনি কি সুন্দর আরামে শুয়ে আছে। যেন কোন কিছুই হয়নি। ইচ্ছে তো করছে এখুনি উঠিয়ে জিজ্ঞেস করি ক,কেন করলে এমনটা? একবারও আমার কথা ভাবলেনা তুমি? অরণ্য ধপধপ করে এসে বেডের ওপর শুয়ে পড়লো। মায়ার থেকে দুরত্ব রেখে কাত হয়ে শুয়ে রইলো। মায়ার ওপর প্রচুর রাগ আর অভিমান হচ্ছে। মায়া কিভাবে পারলো ওকে অবিশ্বাস করতে? আমার চেয়ে আজ ওই মেয়েটাকেই ওর বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো? ঠিক আছে তাহলে থাকো। আমিও এবার আর এগিয়ে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করবো না।
অনেকক্ষণ হলো এভাবে শুয়ে আছে। তবুও একবারও মায়া কিছু বলছে না। অরণ্য জানে মায়া এখনো ঘুমাইনি। আমি এভাবে রেগে আছি তবুও মায়া কিছু বলছে না। একবার আমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করছে না। হঠাৎ করে এতো নিঠুর হয়ে গেলে কেন তুমি? ওই মেয়েটার কথায় আমার থেকে দূরত্ব করে নিলে? এবার যদি তুমি আমার থেকে দূরে যাওয়ার চিন্তা করে থাকো তাহলে আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না। কখনও না।
___
অরণ্য অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। মায়া ওর জন্য কফি নিয়ে এসে অরণ্যেই দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–আপনার কফি।
তবে অরণ্য মায়ার দিকে একবারও তাকালো না। রেডি হয়ে মায়ার পাশ কেটে বেড়িয়ে গেল। মায়া অশ্রুসিক্ত চোখে অরণ্যের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। এটাতো হবারই কথা ছিল। হয়তো এটাই ওর নিয়তি।
অরণ্য ড্রয়িং রুমে আসলে ওর মা নাস্তা করে যেতে বললো। অরণ্য পাশে তাকিয়ে দেখলো রিয়া সোফায় বসে আপেল চিবুচ্ছে আর টিভি দেখছে। এটা দেখে অরণ্যের মাথা আরও গরম হয়ে গেল। অরণ্য চোয়াল শক্ত করে বললো।
–আমার ক্ষিদে নেই।
কথাটা বলেই অরণ্য হনহন করে বেড়িয়ে গেল।
চলবে….