#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-১৮
(ধামাকা পর্ব)
★সকাল বেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভেঙে এলো অরণ্যের। কপাল কুঁচকে চোখ খুলে তাকালো অরণ্য। হাসিমুখে চোখ মেলে তাকালো তার সন্ধ্যামালতীকে দেখার আশায়। কিন্তু বিছানায় মায়াকে দেখতে না পেয়ে মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল অরণ্যের। চমকে গিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো সে। রুমের ভেতরেও কোথাও মায়াকে দেখতে পেল না অরণ্য। বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। কোথায় গেল মায়া?
অরণ্য দ্রুত উঠে দড়িতে ঝুলানো ওর জামাকাপড় গুলো পড়ে নিল। শার্ট টা পড়তে গেলেই হঠাৎ পকেট থেকে একটা কাগজ পড়ে গেল। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে কাগজ উঠিয়ে মেলে ধরলো। কাগজের লেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোন কালি দিয়ে ঘষে ঘষে লিখেছে। চিঠিতে লেখা আছে,
“আমি চলে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করবেন না। আমাদের জন্য এটাই ভালো হবে। আমি কখনো আপনার কাছে কোন দাবি নিয়ে আসবোনা। আপনি আমাকে ভুলে নিজের জীবনে সুখী হোন। আমি জানি আমি আপনার অনেক বড়ো অপরাধী। হয়তো মাফ করবেন না আমায়। তবুও পারলে মাফ করে দিয়েন। কালকের রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর রাত ছিল। ওই স্মৃতিটুকু নিয়েই আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। আপনার কাছে একটাই অনুরোধ। প্লিজ কালকে রাতের সুন্দর মুহূর্ত টাকে কোনো অপরাধ ভাববেন না। আর ওটা নিয়ে নিজের মনে কোন অপরাধ বোধ রাখবেন না।
ভালো থাকবেন সবসময়। ইতি আপনার সন্ধ্যামালতী ”
অরণ্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হাত থেকে চিঠিটা পড়ে গেল। না না এটা হতে পারে না। তুমি আমার সাথে এটা করতে পারোনা। আমাকে ছেড়ে এভাবে যেতে পারোনা তুমি। কিছুতেই না। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবনা। কোথাও না।
অরণ্য পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। বাইরে এসে বৃদ্ধ স্বামী স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তারাও কিছু বলতে পারলোনা। অরণ্য ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো।
অরণ্য সবার প্রথমে মায়ার মামার বাড়ি এলো ওর খোঁজ নিতে। দরজায় এসে বেল দিলে মায়ার মামা এসে দরজা খুলে দিল। সকাল সকাল অরণ্যকে দেখে মায়ার মামা একটু অবাক হলেন। তিনি বললেন।
–আরে জামাই বাবাজি? তুমি হঠাৎ করে? এসো এসো ভেতরে এসো।
অরণ্য ভেতরে এসে বসলো। মায়ার মামাকে একটা বাহানা দিয়ে বললো।
–আসলে এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম তো, তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা করে যাই।
— ওও আচ্ছা ভালো করেছ। বসো আমি তোমার শাশুড়ীকে ডাকছি।
অরণ্য এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়াকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু মায়াকে কোথাও দেখতে পাচ্ছ না সে। ওর ভেতরের অশান্তি যেন আরও বেড়েই চলেছে। অরণ্য মায়ার মামার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–বাসায় সবকিছু ঠিক আছে তো? না মানে রিয়ার কাছে শুনলাম মায়া নাকি কাল বাসায় ফেরেনি। তো পরে কি এসেছে?
মায়ার মামা বলে উঠলো।
–হ্যাঁ বাবা কাল সারারাত নাজানি কোথায় ছিল মেয়েটা। আমরা এদিক ওদিক অনেক খোঁজ খবর নিলাম কিন্তু পেলাম না। হঠাৎ ভোরবেলা দেখি কোথাথেকে বাসায় এসেছে। জিজ্ঞেস করলে বললো ওর কোন বান্ধবীর বাসায় নাকি ছিল।
–ওও তারমানে ও এখন বাসায়ই আছে?
–না বাসায় তো নেই। আসলে এসেই হঠাৎ সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে বললো, ও নাকি এখন থেকে ভার্সিটির হোস্টেলে থাকবে। হোস্টেলে নাকি সিট পেয়েছে। আমাদেরকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও চলে গেল। তারপর কয়েকবার ফোন দিলাম কিন্তু ফোনও বন্ধ।
অরণ্য ওখানে আর দেরি না করে কোন বাহানা দিয়ে বেড়িয়ে এলো। তারপর সোজা মায়ার ভার্সিটির হোস্টেলে এসে মায়ার খোঁজ করলো। কিন্তু কোথাও মায়াকে পেলনা। হোস্টেলর কর্মকর্তার কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলো। মায়া নামের কোন মেয়েই এখানে আসেনি। তারমানে মায়া ওর মামাদের মিথ্যে বলেছে। ও হোস্টেলে আসেনি। তাহলে কোথায় গেল ও? আমার সন্ধ্যামালতী কি সত্যি সত্যিই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। অরণ্য দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে ওর। কোথায় খুঁজবে এখন ওর মায়াকে? মায়াকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে ও? কিভাবে?
____
পেরিয়ে গেছে তিন তিনটা দিন। এই তিনদিনে পাগলের মতো সবজায়গায় খুঁজে বেরিয়েছে মায়াকে। কোথাও পায়নি অরণ্য। রিয়ার কাছেও অনেকবার অনেক বাহানয় জানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মায়ার কোন খোঁজই পায়নি অরণ্য । ধীরে ধীরে সব আশা ফুরিয়ে যাচ্ছে অরণ্যের। চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে ও। মায়া বিহীন জীবন যে ওর কাছে মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। এই অসহনীয় যন্ত্রণা যে আর সহ্য করতে পারছে না। নাওয়া খাওয়া সব ভুলে গেছে। বাড়ির সবাই অরণ্যের এই হঠাৎ পরিবর্তনে চিন্তিত। সবাই জানার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু অরণ্য কাওকে কিছু বলছে না। সাহিল আর ইহান অরণ্যের ব্যাপার টা জানলেও তারাও কাওকে কিছু বলতে পারছে না।
এই যন্ত্রণা ভোলানোর জন্য অরণ্য আজ জীবনের প্রথম নেশা করেছে। নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে বারে। বার বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তবুও অরণ্য অ্যালকোহল পান করেই যাচ্ছে। সাহিল আর ইহান বারবার ফোন করে যাচ্ছে। কিন্তু অরণ্যের সেদিকে কোন হুঁশ নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে বারের ছেলেটা অরণ্যের ফোন রিসিভ করে ইহানকে বললো যে,অরণ্য বারে রয়েছে। ইহান আর সাহিল সাথে সাথে দ্রুত বারে চলে গেল। অরণ্যের এই অবস্থা দেখে ওদের দুজনেরও প্রচুর খারাপ লাগছে। ওরা এসে অরণ্যকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অরণ্য ওদের দেখে নেশায় মাতাল কন্ঠে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
–আরে তোরা এসেছিস? দেখনা অনেক মজা হচ্ছে। তোরাও আয় একসাথে আড্ডা দেবো।
ইহান বলে উঠলো।
–এসব কি করছিস অরণ্য? তুই জানিস বাসার সবাই কত চিন্তা করছে তোর জন্য? এভাবে নেশায় মাতাল হলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?
অরণ্য করুন সুরে বললো।
–তাহলে কি করলে ঠিক হবে বলনা? বলনা কি করলে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো? বলনা কি করে? কি করে আমি আমার মায়াকে পাবো বলনা? তোরা এনে দিবি? এনে দেনা আমার মায়াকে। প্লিজ এনে দেনা।
সাহিল আর ইহানের প্রচুর কষ্ট হচ্ছে অরণ্যের এই অবস্থা দেখে। প্রখর আত্মসম্মান বোধ সম্পূর্ণ ছেলেটার এমন করুণ অবস্থা দেখতে পারছে না ওরা। কিছু একটা করতেই হবে। অরণ্যকে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দিবে না। ওরা কোনরকমে অরণ্যকে ধরে নিয়ে বাসায় নিয়ে আসলো।
__
পরদিন বেলা ১১টা
তনিমা বেগম, এলিসা আর রাবেয়া বেগম ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে। সারাও ওখানে বসে টিভি দেখছে আর তাদের কথোপকথন শুনছে। তনিমা বেগম দুঃখী কন্ঠে বললেন।
–ছেলেটার কি হয়েছে কে জানে? কেমন বেহাল দশা হয়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না। বাসায়ও ঠিকমতো আসে না। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেও না। রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম সেও কিছু বলতে পারে না। ছেলেটার জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছে আমার।
এলিসা বেগম বলে উঠলেন।
–হ্যাঁ আমরাও বোয়াল(খেয়াল) কেটেছি(করেছি)। অরণ্য কেমন বলদে(বদলে) গেছে।
এলিসা বেগমের মহান বাণীতে ওরা তেমন অবাক হলো না। তারা এসব শুনে অভ্যস্ত।রাবেয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–হ্যাঁ ভাবি ঠিকই বলেছেন। শুধু অরণ্য না। আমার ছেলেটারও কি জানি হয়েছে। গত তিনদিন ধরে সাহিল কেমন পাল্টে গেছে। বেশিরভাগ সময় বাসার বাইরেই থাকে। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে না। মনমেজাজ কেমন খিটখিটে হয়ে থাকে ওর। কিছু বললে এরিয়ে যায়। আজ হঠাৎ বলছে ও নাকি আবার নিউইয়র্ক চলে যাবে। ওখানেই নাকি থাকবে। বলতো ভাবি আমার একটাই ছেলে। ওকে ছাড়া কিভাবে থাকবো আমরা?
রাবেয়া বেগমের কথা শুনে সারার বুকের ভেতর কেমন ধুক করে উঠলো। কেন যেন অদ্ভুত পঁচা পঁচা ফিলিং হচ্ছে। উনি চলে যাবেন? কিন্তু কেন? হুহ্ নিশ্চয় ওই বিদেশি মেয়েগুলোর জন্যই আবার যাচ্ছে। কিন্তু উনার যাওয়ার কথা শুনে আমার এমন লাগছে কেন? ধ্যাৎ ভালো লাগে না।
ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ বাসার কলিং বেল টা বেজে উঠলো। কাজের বুয়া গিয়ে দরজা খুলে দিলে একজন লোক ভেতরে ঢুকলো। লোকটা তনিমা বেগম দের সামনে এসে সালাম দিয়ে বললো।
–আসসালামু আলাইকুম। জ্বি আমি কাজি সাহেবের এসিস্ট্যান্ট। যিনি আপনার ছেলের বিয়ের কাবিন করিয়েছিলেন। আমি কি একটু অরণ্য সাহেবের সাথে দেখা করতে পারি।
তনিমা বেগম বললেন।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আপনি বসুন আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।
তনিমা বেগম সারাকে বললেন।
–সারা মা যাতো তোর অরণ্য ভাইয়াকে ডেকে আনতো।
সারা মাথা ঝাকিয়ে উপরে উঠে গেল অরণ্যকে ডাকতে। একটু পরে অরণ্য চোখ ডলে হাত দিয়ে নিজের চুলে ব্রাশ করতে করতে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে বললো।
–কি হয়েছে মা ডাকছিলে আমাকে?
— হ্যাঁ বাবা আসলে উনি কাজি সাহেবের এসিস্ট্যান্ট। তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।
অরণ্য লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো।
–জ্বি বলুন কি বললেন?
লোকটা একটা পেপারের খাম এগিয়ে দিয়ে বললো।
–জ্বি এটা আপনার বিয়ের কাবিননামা। রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেছে। তাই এক কপি আপনাকে দিতে বলেছে স্যার। আপনার যেকোনো কাগজপত্রের কাজে লাগতে পারে। আপনি একটু ভালো করে চেক করে দেখে বলেন কোন সমস্যা আছে কিনা।
অরণ্যের এসব দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নাই। কিন্তু সবার সামনে তো মানা করা যাচ্ছে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অরণ্য পেপার টা হাতে নিয়ে আনমনা হয়ে পেপারে চোখ বুলাতে লাগলো। কোনরকম চোখ বুলিয়ে যেই পৃষ্ঠা উল্টাতে যাবে তখনই একটা জায়গায় হঠাৎ চোখ আটকে গেল ওর। কনের স্বাক্ষরের জায়াগায় মায়ার নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। অরণ্য ভাবছে এটা হয়তো ওর ভ্রম হবে। অরণ্য চোখ ডলে ভালোভাবে পরিস্কার করে আবারও তাকালো সেদিকে। নাহ এখনো মায়াই দেখতে পাচ্ছে। অরণ্যের হাত কেমন কাঁপতে শুরু করছে। হৃদস্পদনের গতিবেগ অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। গলা শুঁকিয়ে আসছে ওর। অরণ্য সারার দিকে তাকিয়ে বললো।
–সারা একটু পানি আনতো।
সারা মাথা ঝাকিয়ে রান্নাঘর থেকে গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলো। অরণ্য পানি নিয়ে নিজের চোখে ছিটালো। চোখ পরিস্কার করে আবারও তাকালো সেদিকে। হ্যাঁ এখনো সে মায়ার নামটাই দেখতে পাচ্ছে। এবার সারা শরীরই কেমন কাঁপছে অরণ্যের। অরণ্য সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললো।
–আ আপনার এটা কি আসল পেপার?
লোকটা বলে উঠলো।
–জ্বি স্যার এটা আসল পেপারের কপি।
–তাহলে এখানে কনের নামের স্বাক্ষর ভুল আসলো কিভাবে?
–জ্বি না স্যার ভুল আসার প্রশ্নই আসে না। বিয়ের সময় যে স্বাক্ষর দেওয়া আছে ওইটাই আসবে।
অরণ্য পেপার টা লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–আচ্ছা তাহলে এটা কি? নামটা একটু জোরে পড়ে শুনান তো?
লোকটা তখন পেপারে থাকা মায়ার নামটা পড়ে শুনালো। যা শুনে অরণ্য সহ বাকি সবাইও স্তব্ধ হয়ে গেল। অরণ্যের সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। অরণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো।
–তাহলে এই নামটা কোথাথেকে আসলো।
–স্যার এটাতো কনের স্বাক্ষর। আর প্রথম থেকে এই নামটাই আছে।
কথাটা যেন অরণ্যের কানে বারবার বাজতে লাগলো। অরণ্য আবারও পেপার টা নিয়ে মায়ার নামটা ভালো করে দেখতে লাগলো। স্বাক্ষরের জায়গায় জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা মায়ার নামটা দেখে অরণ্যের আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই যেন সবকিছু থমকে গেল। তা তারমানে কি মায়ার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে? ভাবতেই যেন হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। অরণ্যের তখন মনে পড়লো বিয়ের দিন কেমন দুবার করে ওর বিয়ে পড়ানো হয়েছিল। তাহলে কি এইজন্যই? তাহলে কি সত্যি সত্যিই মায়াই আমার স্ত্রী?
অরণ্যের সামনে পুরো দুনিয়া গোলগোল ঘুরতে লাগলো। এখন ওর কি রিয়্যাকশন দেওয়া উচিত তা বুঝতে পারছে না ও। মায়া ওর স্ত্রী এটা জেনে খুশী হবে, নাকি ওর সাথে এতবড় ধোঁকার জন্য রাগ দেখাবে? তবে আপাতত খুশীর জায়গায় রাগটাই ভারী হয়ে যাচ্ছে। অরণ্য পেপারের দিকে তাকিয়ে থেকেই রাগী কন্ঠে উচ্চস্বরে রিয়ার নাম ধরে ডেকে উঠলো। দুই তিনবার ডাকার পর রিয়া দৌড়ে এলো। রিয়া দ্রুত নিচে এসে বললো।
–কি হয়েছে এভাবে ডাকছ কেন?
অরণ্যের চিল্লানিতে বাসার বাকি সদস্য রাও এসে জড়ো হয়ে গেল। তারা সবাই বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। অরণ্য হাতের পেপার টা রিয়ার মুখের ওপর ছুড়ে মেরে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–এসব কি?
রিয়া বেচারি ভয়ে ভয়ে পেপার টা হাতে নিয়ে নিল। কাবিননামায় মায়ার নাম দেখে ওর ভয়ে গলা শুঁকিয়ে এলো। এইরে ধরা পড়ে গেলাম বুঝি। এখন কি করবো? এরা সত্যি টা জানলে আমার কি অবস্থা করবে কে জানে? রিয়াকে চুপ থাকতে দেখে অরণ্যে আবারও রাগী কন্ঠে উচ্চস্বরে বললো।
–চুপ করে আছ কেন? বলো এসব কি? টেল মি ড্যাম ইট।
রিয়া ভয়ে কেঁপে উঠল। কোনরকমে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–আ আমি কিছু জানি না। সত্যিই বলছি।
–ও তুমি কিছু জানো না তাইনা? ওকে ফাইন তোমার বাবা মা তো নিশ্চয় জানবে তাইনা?
অরণ্য এবার রিয়ার মা বাবাকে ফোন করে দ্রুত এই বাসায় আসতে বললো।
আধাঘন্টার মাঝেই রিয়ার মা বাবা এসে হাজির হলো। অরণ্য তাদের দিকে পেপার টা এগিয়ে দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ তো বলুন এই ব্যাপারে আপনাদের কি বলার আছে?
রিয়ার মা বাবারও ভয়ে কন্ঠ নালী বন্ধ হয়ে গেল। ওরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রিয়ার মামী বলে উঠলো।
–আ আমার মনে হয় পেপারেই কোন ভুল এসেছে। তাছাড়া আর কিছুই না। সত্যি বলছি।
অরণ্যের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অরণ্য এবার ফোন বের করে বললো।
–বুঝতে পেরেছি আপনারা এভাবে মুখ খুলবেন না। ব্যাপার না। এখন আপনাদের মুখ আমি না পুলিশ এসেই খুলবে।
কথাটা বলে অরণ্য পুলিশ কে ফোন করতে নিল।
রিয়াদের এবার ভয়ে আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম। রিয়ার বাবা হাত জোর করে অনুনয়ের সুরে বললেন।
–না না বাবা পুলিশকে ডেকনা। আ আমি বলছি তোমাকে সবটা। হ্যাঁ মায়াই তোমার স্ত্রী। আর এবাড়ির বউ।
তারপর রিয়ার বাবা প্রথম থেকে সবটা খুলে বললো।
সব শুনে অরণ্য সহ বাকি সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। এতবড় একটা ধোঁকা হয়েছে ওদের সাথে আর ওরা কিনা জানেই না। অরণ্য ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। কিছু সময়ের জন্য সবকিছু থমকে গেল ওর। ওর সন্ধ্যামালতী ওর নিজের স্ত্রী। এটা ভেবে খুশী হওয়ার চেয়ে, মায়ার দেওয়া ধোকাটাই ওকে বেশি আঘাত করছে।
বাসার বাকি সবারও প্রচুর রাগ হচ্ছে। তনিমা বেগম রিয়ার সামনে এসে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিল। চড় খেয়ে রিয়া ছিটকে নিচে পড়ে গেল। তনিমা বেগম রাগী কন্ঠে বললেন।
–কেমন মেয়ে তুমি? বিয়ে বিহীন একটা পরপুরুষের সাথে দিনের পর দিন থাকছ? লজ্জা শরমের কিছুই তোমার মাঝে নেই? তোমার মতো বেহায়া মেয়ে আমি দেখিনি। ছিহ্হ। তোমার চেহারা দেখতেও ঘৃণা করছে আমার।
তনিমা বেগম এবার রিয়ার মা বাবার উদ্দেশ্যে বললেন।
— আপনাদের লজ্জা করলো না আমাদের সাথে এতবড় বেইমানি করতে? আপনাদের মতো নির্লজ্জ মানুষ আমরা দুনিয়াতে দ্বিতীয় টা দেখিনি। নিজের মেয়েকে কিভাবে একটা পরপুরুষের সাথে পাঠিয়ে দিলেন? একবারও বিবেকে বাঁধল না আপনাদের? ছিহ্হ!!
অরণ্যের হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই উঠে দাঁড়িয়ে রিয়ার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো।
–এক মিনিট! আপনি প্রথম থেকেই জানতেন আমি রিয়াকে না মায়াকে বিয়ে করতে চাই তাইনা? আর আপুকেও সেদিন আপনি মিথ্যে বলেছিলেন তাইনা?
রিয়ার মা থতমত খেয়ে গেল। সে কি বলবে? চুরি ধরা পড়ে যাওয়ায় মুখ থেকে আর কথা বের হচ্ছে না তার। অরণ্য ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
–কি হলো বলুন..
রিয়ার মা ভীতু স্বরে বললো।
–হ হ্যাঁ..
অরণ্য দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–সত্যি বলছি আপনি যদি মহিলা না হয়ে কোন পুরুষ হতেন তাহলে আমার হাতে আজ আপনার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। ডিজগাস্টিং ওম্যান।
এদিকে বাকি সবাই অরণ্যের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। অরণ্যের বাবা বলে উঠলো।
–কি বলছিস এসব অরণ্য? মায়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি মানে?
অরণ্য তখন সবাইকে সবটা খুলে বললো। সবাই আরও একবার ঝটকা খেল। সাথে রিয়াদের ওপর আরও বেশিকরে রেগে গেল। অরণ্যের ফুপি রাবেয়া বেগম এগিয়ে এসে বললো।
–অরণ্য তুই পারবি নাতো কি হয়েছে, আমিতো পারবো।
কথাটা বলেই রাবেয়া বেগম রিয়ার মায়ের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে দিল। তারপর বলে উঠলো।
–অসভ্য মহিলা। ভালো টাকা পয়সা ওয়ালা ছেলে দেখে লোভ সামলাতে পারিস নি তাইনা? তাইতো নির্লজ্জের মতো মায়ার জায়গায় নিজের মেয়েকে দিতে চেয়েছিলি। কিন্তু উপর ওয়ালার লিলা দেখ। সে ঠিকই ঠিক মানুষের সাথেই জুটি মিলিয়ে দিয়েছে। আর তোরা কিনা সেটা নিয়েও জঘন্য খেলা খেলেছিস? তোদের মতো মহিলাদের তো মুখে চুনকালি মাখিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা উচিত।
এবার ইরিন এসে রিয়ার গালে আরেকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়ে বললো।
–আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। তোর মতো চিপ মেন্টালিটির মেয়ে কখনো আমাদের অরণ্যের পছন্দ হতেই পারে না। আরে তোর মতো মেয়ে অরণ্যের পায়ের নখের যোগ্যও না।
বেচারি রিয়ার থাপ্পড় খেতে খেতে অবস্থা কাহিল। অরণ্যের চাচা বলে উঠলো।
–আমি এখুনি পুলিশ কে ফোন করছি। সবগুলো কে জেল হাজোতের ভাত খাওয়ালে তবেই এদের শিক্ষা হবে।
রিয়ারা এবার সবগুলো হাত জোর করে কাকুতি মিনতি করে বলতে লাগলো।
–না না দয়া করে এমন করবেন না। প্লিজ আমাদের কে পুলিশের হাতে দিবেন না। আমাদের কে মাফ করে দিন প্লিজ।
অরণ্যের বাবা ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন।
–থাক পুলিশ কে ইনভলভ করার দরকার নেই। এতে আমাদের পরিবারেরও নাম উছলাবে।
অরণ্য রিয়ার বাবার উদ্দেশ্যে বললো।
–এক শর্তে ছাড়তে পারি আপনাদের। যদি আমাকে মায়ার ঠিকানা বলেন। আমি জানি আপনি ভালো করে জানেন মায়া কোথায় আছে। তাই ফটাফট মুখ খুলুন।
রিয়ার বাবা বলে উঠলেন।
–সত্যি বলছি আমি জানি না। মায়া আমাদের কিছুই বলেনি। তবে গ্রামে মায়ার বাবার ছোট একটা ভিটে আছে। হয়তো সেখানে যেতে পারে। তাছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ওর।
–ঠিক আছে। আপনারা এখন আপনার মেয়েকে নিয়ে বিদায় হন। আর জীবনে কখনো আপনাদের এই কুৎসিত মুখ আমাদের দেখাবেন না। যান বিদায় হন এখান থেকে।
রিয়ার মা বাবা ভয়ে ভয়ে দ্রুত রিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার আগে রাবেয়া বেগম রিয়ার কানে গলার গহনা সব খুলো নিয়ে রিয়াকে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিলো।
অরণ্যের বাবা কিছু একটা ভেবে বললেন।
–আচ্ছা বিয়েটা যেভাবে হয়েছে। তাতে মায়ার সাথে বিয়েটাও কি জায়েজ হয়েছে?
অরণ্য বলে উঠলো।
–হয়েছে বাবা। তোমার মনে নেই, কিভাবে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ে পড়ানো হয়েছিল? অ্যাম শিওর তখন সহি ভাবে বিয়েটা পাকাপোক্ত করার জন্যই ওমনটা করেছিল।
–আরে হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ। আমার তো সেটা মনেই ছিল না।
–আর বাকিটা তো সে নিজেই ক্লিয়ার করবে।
কথাটা বলে অরণ্য দ্রুত বেরিয়ে যেতে লাগলো। তনিমা বেগম তখন বললেন।
–কিরে বাবা তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস?
–আমার এখনো আরেজনের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাদ আছে মা। তাকে আমার সবকিছুর বোঝাপড়া দিতেই হবে। এতো সহজে সে পার পেয়ে যাবে না। সেই যে আমার সবচেয়ে বড় অপরাধী।
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে বাইরে চলে গেল অরণ্য। তনিমা বেগমের অনেক চিন্তা হচ্ছে। অরণ্য যে এখন মায়ার কাছে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে সে। কিন্তু অরণ্য এখন প্রচুর রেগে আছে। অরণ্যের রাগ অনেক ভয়ংকর। সে এমনিতে সহজে রাগে না। তবে একবার রেগে গেলে সে অতিরিক্ত ভয়ংকর হয়ে যায়। তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। নাজানি মেয়েটার সাথে কি করে বসে।
____
আজ চারদিন হলো গ্রামের বাড়িতে এসেছে মায়া। পিতার এই ভিটেটাই এখন তার একমাত্র সম্বল। অরণ্যের জীবন থেকে সরে আসতে যে এই কদম নিতেই হয়েছে। নাহলে হয়তো সে মামা মামীর কথা রাখতে পারতো না। মামা মামী যেমনই হোক তারা ওকে এতদিন খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছে।তাদের কাছে ঋণী মায়া। মায়ার পরিবার বলতে তো ওরাই। তাই তো তাদের কথার মান রাখতে তাকে এমন শক্ত কদম নিতেই হয়েছে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য দূর্বল হয়ে পড়েছিল সে। তবে পরে তার হুঁশ আসে। তাইতো সবার ভালোর জন্য সে এখানে চলে এসেছে। কারোর জীবনে সে মুসিবত আনতে চায়না।
মায়া পাশের বাড়ি গিয়েছিল দিয়াশলাই এর জন্য। ওর বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ঘরটাও অনেক বছরের অযত্নে জির্ণসীর্ণ হয়ে গেছে। তবুও কোনরকমে দিন চালাচ্ছে মায়া। যেমনই হোক তাওতো নিজের। কমছে কম কারো বাড়ির আশ্রিতা হয়ে তো আর নেই। সন্ধ্যার আযান দিয়েছে অনেক আগেই। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিদিক। মায়া রুমের ভেতর ঢুকে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হারিকেন টায় আগুন জ্বালালো। হারিকেনের আলোয় ঘরটা একটু আলোকিত হলো। দিয়াশলাই এর কাঠিটা ঝাকি দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে সামনে তাকালো মায়া। আর সামনে তাকাতেই চমকে গেল মায়া। অরণ্যকে চৌকির ওপর বসে থাকতে দেখে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল মায়ার। অরণ্যের অগ্নি চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের জন্য অপরিসীম রাগের আভাস পাচ্ছে সে। তবে কি অরণ্য সব জেনে গেছে?
চলবে……