#মাশুল (চতুর্থ পর্ব)।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সাথে দেশে রিইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আগ পযর্ন্ত, মাঝের দুটো মাস কাটলো ভীষণ উত্তেজনায়। কিছুতেই যেন আমার সময় কাটে না, একেকটা দিন মনে হয় যেন একেকটা বছর। কেন জানি বাংলাদেশকে আবারো খুব আপন বলেই ভাবতে শুরু করলাম। আমার ভালোবাসার মানুষটি যে ওখানেই থাকে, এই ভাবনায় দেশে আসার তাড়া অনুভব করি সারাক্ষণ।
আমার নিজ ভাইবোনদের সাথে ততোদিনে যোগাযোগ ফিকে হয়ে এসেছে। তারপরও দেশে আসছি খবরটা ওদেরকে জানাতেই সবাই খুব খুশী, মন থেকেই। বড় ভাইতো বলেই ফেললেন তার ধারণা ছিল, আমি আর কখনো দেশেই আসবো না! আত্মীয় স্বজনেরাও আমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল।
হঠাৎ করে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বড় এ পরিবর্তনটায় লিমেরিকে আমার বিদেশী কলিগ বা স্টুডেন্টদের চোখ এড়ায়নি। অনেক দিন পর আমার হাসিমুখ আর উৎফুল্লতা, আমি যেন তাদের কাছে ভিন্ন একজন। তাইতো ইতিবাচক এই পরিবর্তনটায় প্রত্যেকেই খুব এনজয় করলো। কেউ কেউতো জিজ্ঞেসই করে ফেললো “ইউ আর সো চ্যান্জেড।”
এরপর ভাইবোনদের জন্য কিছু কেনাকাটা করার পাশাপাশি, শিলা আর ওর মেয়ে আরিয়ানার জন্যও কিছু গিফট নিলাম। ঢাকায় আমার কাছের পরিচিত তেমন কেউ নেই যে যার ওখানে গিয়ে উঠতে পারবো। হোটেলেও থাকতে ইচ্ছে হল না। অগত্যা আশফাকের সাথে যোগাযোগ করলাম। আমার থাকার ব্যবস্হা করে দিতে। আশফাক আমাদের ব্যাচের, ডিপার্টমেন্টের সতীর্থ। এখন জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির শিক্ষক, ও ক্যাম্প্যাসেই থাকে।
প্রথমে এক সপ্তাহ ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা থাকলেও পরে শিলার সাথে সময় কাটানোর সুযোগ হতে পারে, এ ভাবনা থেকে ছুটিটাকে একমাস করে নিলাম। আর থাকা খাওয়ারও সমস্যা হল না। বন্ধু আশফাক ভার্সিটির শিক্ষকদের ব্যাচেলর ডর্মেটরিতে একটা রুমের ব্যবস্হা করে দেয়।
এরপর লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার ফ্লাইটটা যখন ঢাকায় ল্যান্ড করলো, জানালায় উকি দিয়ে অনেকদিন পর প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখে ভীষণ উদ্বেলিত হলাম। অচেনা অনুভূতিতে ভাসছি, বারবারই শিলার মুখ ভেসে উঠছে। ভালোবাসার মানুষের সাথে শীঘ্রই দেখা হতে যাচ্ছে, এটা ভেবেই সারাক্ষণ শিহরিত থাকলাম। শিলাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার ঝাপসা স্বপ্নটা ততদিনে আমার কাছে অনেক বেশিই স্পষ্ট!
দশ বছর পর ঢাকা এয়ারপোর্টে নামতেই আমার জন্য একটার পর একটা চমক রইলো! বন্ধু আশফাক কিছু ব্যাচমেট বন্ধুদের নিয়ে হাজির হয়, আগে থেকে না জানিয়েই ওদের আসায় অবাক হলাম! ভীষণ আপ্লুত হই এখনো বন্ধুদের আনকন্ডিশনাল ভালোবাসাটা রয়ে গেছে বলে। চাঁদপুর থেকে এয়ারপোর্টে আমার বড় দুই ভাইও এসেছেন। দেখা মাত্রই ভাইদের জড়িয়ে ধরে কান্না, আশেপাশের অনেক লোকজন বেশ আনন্দ নিয়ে উপভোগ করলো।
এয়ারপোর্ট থেকে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির ক্যাম্পাসে আসার পথটুকুতো চিনতেই পারিনি। অবাক চোখে দেখছি দশ বছরে ভিন্ন রূপ নেওয়া একসময়ের প্রিয় এই শহরটাকে। বড় বড় অট্রালিকা, ট্রাফিক জ্যাম আর মানুষের ব্যস্ততা খুব সহজেই চোখে পড়লো।
আশুলিয়ার চেনা সেই পথটা দেখে স্মৃতিকাতর হলাম। আমি আর শিলা যে কতবার এখানে এসেছি তার কোন হিসাব নেই। একসময় বর্ষায় রাস্তার দুপাশে শুধু পানি আর পানি। সে এক অপরূপ সুন্দর এক ভিউ! অনেক লোকজন সময় কাটাতে এখানে আসতো। তবে এবার মনটা খারাপ হলো রাস্তার দুপাশটা আর আগের মতো দেখতে নয় বলে।
আমার সবচাইতে প্রিয় জায়গা, দ্বিতীয় আঁতুরঘর এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসটাতে এসে বড় ধরনের হোচট খেলাম। দশ বছর আগে ফেলে যাওয়া সেই ক্যাম্পাস, এখনো প্রতিদিন শিলাকে নিয়ে যেখানে আমার স্বপ্ন বিচরণ। সেটা আর আগের মতো নেই, দালান কোঠা আর দোকানপাটের সারি। ক্যাম্পাস তার নৈসর্গিকতা হারিয়েছে অনেকখানিই!
লাগেজ আর হ্যান্ড ব্যাগটা ডর্মে রেখেই, আশফাককে সাথে নিয়ে পরিমরি করে বেরিয়ে গেলাম। প্রিয় ক্যাম্পাসের পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়াতে। শিলার সাথে কাটানো স্মৃতি বিজরিত জায়গা গুলো নতুন করে দেখতে থাকলাম রিকশায় করে। আশফাক অবশ্য আমার এসব কাজকর্মে ব্যাপক মজা নিচ্ছে, নিঃশব্দে!
এতো পরিবর্তনের মাঝেও ডিপার্টমেন্টের সামনের পাম গাছটা ঠিক আগের মতো আছে বলে ভালো লাগলো। মনে পড়ে গেল, ক্লাস ক্যান্সেল বা গ্যাপ থাকলে এই গাছের নীচে গল্পে মেতে উঠতাম শিলা সহ অন্য বন্ধুদের সাথে। চমৎকার সেই সময়গুলো। ডিপার্টমেন্টের ল্যাবগুলো আগের চেয়ে অনেক আধুনিক বলেই মনে হল। এতদিন পর দেখা, ল্যাব এসিসটেন্ট সেলিম ভাই একমুহূর্ত সময়ও নেয়নি বুকে জড়িয়ে নিতে। ডিপার্টমেন্টের জাঁদরেল শিক্ষকদের রুমগুলোও ক্রস করলাম সন্তর্পনে, আগের মতো ভয় নিয়েই। ক্লাসরুমে ঢুকেই আমার বসার জায়গাটা খুব যত্ন নিয়ে দেখলাম, কতো স্মৃতিময় এই বেঞ্চটা! আমি আর শিলা পাশাপাশি বসতাম কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বেঞ্চে, প্রতিদিন নিয়ম করেই। এক যুগ আগে ছেলেমেয়ে এক বেঞ্চে না বসার অলিখিত নিয়ম মেনে, কায়দা করে পাশাপাশি বসার চেস্টাটা চলতো। ক্লাস চলাকালে আমাদের চোখাচোখি বা খুনসুটিও চলতো সবার অলক্ষ্যে।
হাজারো স্মৃতি বিজরিত নিজ ডিপার্টমেন্ট ঘুরে চলে এলাম, শিলার সেই প্রীতিলতা হলের সামনে। হল গেটের কাছাকাছি শিলার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো সেই জায়গাটায় এসে স্মৃতি হাতরাচ্ছিলাম। সময় বেশি নিতেই রিকশায় বসা আশফাকের জোর ধমক খেলাম। ব্যাটা এখন শিক্ষক, ছাত্রীরা এ অবস্থায় দেখলে নাকি ওর ইজ্জতে টানাটানি পরবে! তাইতো আমাকে দেওয়া ওর জোর তাড়ায় অনিচ্ছাসত্বেও রিকশায় উঠা।
অগত্যা আশফাকের সাথে স্মৃতিচারণ করতে করতে চলে এলাম ভাসানী হলে। পুরো পাঁচ বছর কাটানো আমার সেই রুমটায় ঢুকতেই ভীষণ আবেগ তাড়িত হলাম। আমি যে বেডটায় থাকতাম, এখন সেটা শফিক নামের এক কারেন্ট স্টুডেন্টের বেড। ছেলেটা হিস্ট্রিতে পড়ে। মনে হল রেন নিজের আপন ভাইকেই দেখছি।
যতক্ষণ হলে ছিলাম, শফিক আমাকে সঙ্গ দিয়ে গেল আন্তরিকতার সাথেই। এমনকি ছেলেটা হেটে বটতলার রাজ্জাকের দোকান পযর্ন্ত আমাকে এগিয়েও গেল। দশ বছরে ক্যাম্পাসের এতো পরিবর্তনের মাঝেও জাবিয়ান বন্ধনটায় যে কোন পরিবর্তন হয়নি, এটা দেখে ভীষণ আপ্লুত হলাম! হলের গার্ড মামাদের থেকে শুরু করে ক্যান্টিন বয় সবার মুখেই প্রাক্তন ছাত্রকে দেখে তৃপ্তির হাসি, অনেকদিন পর দেখায় কত জনের কত প্রশ্ন।
আমার জীবনে বটতলার রাজ্জাকের খাবারের হোটেল অনেক স্মৃতিময়। এখানে শিলার সাথে নিয়মকরে দুপুর বা রাতের খাবার খাওয়া জীবনের অন্যতম সুখ স্মৃতি। টাকা পয়সার টানাটানির দিনগুলোতেও রাজ্জাক আমাকে বাকিতে খাবার দিতো দ্বিধাহীনভাবে, হাসিমুখেই। সেই রাজ্জাক আমাকে দেখেই দৌড়ে ছুটে আসে। হাসি আর কান্নার মিশ্র একটা অনুভূতি নিয়ে আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আয়ারল্যান্ডের লিমেরিকে গত দশ বছর যতোই সুখে থাকি না কেন, এরকম স্বর্গীয় ফিলিংস ওখানে কখনো যে পাইনি এটা আমি নিশ্চিত। আগের মতো করেই রাজ্জাককে মজাচ্ছলে ধমক দিয়ে খাবারের অর্ডার করলাম, আশফাকের শত বারন সত্বেও। ওর বউ আমাদের জন্য অনেক রান্না বান্না করে রেখেছে। তাতে কি? বটতলার খাবারের সুযোগ মিস করিনি।
পরদিনই আমাদের রিইউনিয়ন। উত্তেজনা না জেট লেগ, কারণটা ঠিক জানিনা। সারারাত এক ফোঁটাও ঘুম হল না। সারাক্ষণ অস্হিরতায়, এতো বছর পর ভালোবাসার মানুষটাকে আবারো দেখবো বলে। আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সকাল নয়টায়, উত্তেজিত ই আমি সকাল আটটাতেই ক্যাফেটেরিয়ার সামনে হাজির। ফাঁকা ক্যাফেটারিয়াতে হৃদকম্পন নিয়ে শিলার অপেক্ষায়।
সহপাঠীদের সাথে অনেকদিন পর দেখা, ভীষণ আপ্লুত হলাম। বন্ধুদের ভালোবাসার চাপযুক্ত শক্ত কোলাকুলিতে বুকে কিঞ্চিৎ ব্যথাও অনুভব করলাম। মনে হল মধুর এই ব্যথাটাকে সারাজীবন লালন করে যাই। সন্ধিৎসু চোখ কিন্তু তখনো শিলাকেই খুঁজছে। ভীষণ অস্বস্তিকর এক অপেক্ষায়! উপস্থিত বন্ধুরা অনেকদিন পর একত্রিত হয়ে নানান স্মৃতি আর গল্পে। আমাদের ব্যাচের জোকার বন্ধু শিমুল, সবাইকে ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষকের হাটার অঙ্গভঙ্গি অনুকরন করে দেখাচ্ছে। ভীষণ মজা পেয়ে খুব উচ্চস্বরে সবাই হাসা হাসি করতে লাগলাম।
হঠাৎই আমার এক সহপাঠী বন্ধু আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে “দোস্ত দেখো তোমার বান্ধবী আসছে!” ঘাড় ঘুরে তাকাতেই চোখ পড়লো ক্যাফেটেরিয়ার ঢালু রাস্তাটা ধরে শিলার ধীরে ধীরে আসা। গায়ে আমার প্রিয় নীল রঙের একটা শাড়ি। দূর থেকে মনে হল, এতোদিনেও মেয়েটা একটুও বদলায়নি! মুহূর্তেই অতীতে ফিরে গেলাম যেন আমরা সম্পর্কে আছি, ও আগের মতো করেই সেজে গুজে আজ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। ভীষণ রোমাঞ্চকর এক অনুভূতিতে ভাসতে লাগলাম, বর্ণনাতীত।
(দশ পর্বে সমাপ্ত। পঞ্চম পর্ব আগামীকাল। ধন্যবাদ।)