#মাশুল (সপ্তম পর্ব)।
“শিলা একটানা বলে সম্ভবত টায়ার্ড, সেই সাথে উত্তেজনাতেও কাঁপছে। সম্ভবত ওর জীবনের সবচাইতে খারাপ ও অপ্রিয় স্মৃতি রোমান্থন করতে গিয়েই। খানিকক্ষণ বিরতিতে, নীরব থাকলাম দুজনেই।
আমি উদাস দৃষ্টিতে দশ বছর আগের স্মৃতি হাতড়িয়ে যেতে লাগলাম। হ্যাঁ, কথাটা সত্য যে আমি ওর সাথে ফোন বা যোগাযোগ করার চেষ্টা ইচ্ছে করেই করিনি। হঠাৎই তৈরী হওয়া জটিল একটা পরিস্থিতি থেকে পালাতেই আমার গুটিয়ে নেওয়া। এ জন্য আমার ম্যাচুইরটির পাশাপাশি আমার পারিবারিক বা সামাজিক অবস্থানটাও কিন্তু দায়ী। আমি চাইলেও নাটক সিনেমার নায়কদের মতো বোল্ড হতে পারিনি। আবার কারো কাছ থেকে সেই সময়ে সঠিক পরামর্শ বা সাহসটাও পাইনি। একটা অসহায় যুবকের তখন পালানো ছাড়া হাতে অন্য কোন অপশন নেই। তবে এখন মনে করি যে ওটা আমার জীবনের চরম ভুল সিদ্ধান্ত, যার মাশুল দিয়ে যাচ্ছি এখনো বেশ চড়াদরে।
তবে আমি শিলাকে ভালোবাসতাম বা এখনো ভালবাসি। আর ওর শুভাকাংখীতো চিরকালেরই। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওর হলমেট সামিনা সেদিন আমাকে ফোনে না পেয়ে, আমার হলে চলে আসে। হল গেষ্ট রুমে বসে ও যখন শিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবরটা দেয়। অবিশ্বাস্য চোখে সামিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম, দীর্ঘক্ষণ। কোনভাবেই খবরটাকে মেনে নিতে পারিনি। বারবার ওর কাছে কনফার্ম হতে চাইলাম, বিয়েটা সত্যি সত্যি হয়ে গিয়েছে কিনা! “বিয়েটা কনফার্মতো!”
সাথে সাথে সামিনার ফোন দিয়েই আরিফ ভাইকে ফোন দেই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র, শিলার ভাইয়ের বন্ধু। আরিফ ভাইও ব্যথাতুর মনে শিলার বিয়ের খবরটা কনফার্ম করলো। তখনই নিশ্চিত হলাম, আমার ভালোবাসার মানুষ এখন বিবাহিতা। আমার সাথে ওর আর কোনো সম্পর্ক নেই, এখন অন্যের ঘরনী!
আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, সামিনা তখনো বার বার করে বলছিল শিলা আমার সাথে কথা বলতে চায়। খুবই জরুরী কিছু একটা বলবে বলেই। ভীষণ কষ্ট পাওয়া এই আমি নেহাল জীবনটাকে আর কমপ্লিকেটেড করতে চাইলাম না। শিলার সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছাটা মরে গেল, মেয়েটা বিবাহিতা জানার পরপরই।
“বিয়ের চতুর্থ দিনেই বুঝতে পারলাম, সৃষ্টি কর্তা তোমার আমার মিলনটা কোনভাবেই চায় না। আমার শত চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে, এটা বুঝেও শিহাব কিন্তু তখনো আমাকে সাপোর্ট দিয়েই যাচ্ছে। আসলে শিহাব অনেক ম্যাচিউরড ছেলে। প্রথম থেকেই জানতো তুমি নেহাল কখনোই এই পরিস্হিতিতে আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে না। এখান থেকে উদ্ধার করার মতো সাহস অন্ততপক্ষে তোমার মতো ছেলের নেই এটা আমার জামাই বুঝে যায়।
হঠাৎ করেই তোমার প্রতি তীব্র ঘৃনাতে। আর একই সাথে শিহাবের প্রতি ভালোলাগা তৈরী হতে থাকে, খুব দ্রুতই। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এত সব সিনেমার কাহিনী, পুরো ঘটনাগুলোকে কিন্তু ও পরিবার বা বাইরের মানুষের কাছে সবসময়ই গোপন রেখেছে, মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত। একদিনের জন্যও অপ্রীতিকর এইসব প্রসঙ্গ তুলে আনেনি। শিহাব কিন্তু চাইলেই বিয়ের পর এইসব ঘটনাগুলোকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো। কিন্তু কখনোই এটা করেনি।
হ্যাঁ, আমার আর শিহাবের বাসর হল, আর সেটা বিয়ের পঞ্চম রাতে! দ্বিধাহীনভাবে শক্ত সুপুরুষ সৈনিক জামাইয়ের কাছে দেহ মন সবই দিয়ে দিলাম, সুখ স্মৃতিময় সেই রাতটাতে।” শিলার সুখের অনুভূতির প্রকাশ এখন ওর চোখে মুখে। আর আমার বুকে শুধুই শূন্যতা আর হাহাকার।
“আরিয়ানার জন্ম আমাদের বিয়ের ঠিক বছর খানেক পর, পৃথিবীর সবচাইতে সুখী বাবা মায়ের অনুভূতি দিয়ে। রাজকন্যা আরিয়ানা সংসারে বরপুত্র হয়ে এলো, চারিদিক থেকে সাফল্যের সংবাদ জানান দিতে দিতে। মেয়েটার জন্মের মাস দুয়েক আগে শিহাবের পদোন্নতি হল। মেজর হিসাবে জয়েন করলো আটাশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সাভার ক্যান্টন্টম্যান্টে। অফিসার্স কোয়ার্টারে মনের মতো একটা বাসাও পেলাম। আমার মা চলে এলেন খুলনা থেকে, বাড়তি সাপোর্ট দিতে।
আমার আরিয়ানা ভাগ্য আগাগোড়াই সুপ্রসন্ন। সাভারে আসার আগ পযর্ন্ত মাস্টার্স করার কোন সুযোগই ছিল না। ক্যাম্পাস লাগোয়া বাসা, স্যারদের আন্তরিক সহায়তায় আবারো ক্লাস শুরু করে দেই জুনিয়র ব্যাচের সাথে।” শিলার চোখেমুখে আত্মতৃপ্তি, গল্পে আছে খুব আগ্রহ নিয়ে। তবে ততোক্ষণে ওর গল্পে “আমি” নেই, শুধুই ওর পরিবারের কথা। ধরেই নিলাম শিলার স্মৃতিতে আমি আর নেই।
“আরিয়ানার জন্মের সময়ের স্মৃতিটা সারাজীবন মনে রাখার মতোই ঘটনা। ডেলিভারির আগের রাত ছিল বৃষ্টি আর ঝড় ঝঞ্জাময়। শিহাব প্যারট্রুপিং ট্রেইনিংয়ে সিলেটে। বাসায় শুধু আমি আর মা। সঙ্গে খুলনা থেকে আনা গৃহকর্মী। সবমিলিয়ে রাতটায় নিজেকে বেশ অসহায় বলে মনে হল। লেবার পেইন অনুভব করতেই শিহাবকে ফোন দেই। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাসার সামনে আর্মির এম্বুলেন্স। তুমুল ঝড় বৃষ্টির সেই রাতে সাভার ক্যান্টনম্যান্ট থেকে সিএমএইচে আসার পথটা সত্যই ভীতিকর ছিল। মা তো ভয়ে দোয়া দরূদ পড়ে আমাকে ক্রমাগত ফু দিয়ে যাচ্ছেন। আমি কষ্ট লাঘবে শিহাবের মুখটা কল্পনায়।” কাহিনীর এই অংশে আমি খানিকটা খেই হারিয়ে ফেলেছি। ওর কষ্টের গল্প শোনার চাইতে সুখের কথা শোনাতেই আমার আগ্রহ। তারপরও মনোযোগী শ্রোতা হয়েই ওর গল্পে।
“সিএমএইচে পৌঁছুতেই শিহাবের ব্যাচম্যাট কিছু বন্ধু অফিসার সহ উপস্থিত সবাই আমার সার্বক্ষণিক তদারকিতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এরপরই ওটিতে যাওয়া। সকালে হন্তদন্ত হয়ে শিহাব হাসপাতালে এসে আমার পাশে ফুটফুটে একটা শিশুকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না। বাচ্চাটা আর আমাকে জড়িয়ে ওর খুশির কান্নাটায় নিজেকে ভীষণ সুখী একজন বলেই মনে হল। এরপর ছোট্ট আরিয়ানাকে নিয়ে শিহাবের কান্ড কারখানায় হাসতে লাগলাম। বাচ্চা ধরতে অনভ্যস্ত এক দক্ষ সৈনিকের কাঁপাকাঁপি, সংসারে আসা উপচে পড়া সুখটাকেই দেখলাম।” শিলা এবার একটু থামলো, সম্ভবত স্মৃতি গুলোকে ঝালিয়ে নিতেই। এরপরই ওর কন্ঠটা একটু ভারী হয়ে উঠলো।
“আরিয়ানা হুবহু দেখতে ওর বাবার মতো। উপস্থিত সবাই এটা নিশ্চিত করতেই শিহাবের বিজয়ী হাসি। খুব কায়দা করে আরিয়ানার সাথে আমার আর শিহাবের ফটোসেশন হল। শিহাবের ব্যাচম্যাট বন্ধু নাইম ভাই খুব যত্ন নিয়ে ছবি গুলো তুললেন। আমাদের পারিবারিক ঐ ছবিগুলো এখনো বাসার দেওয়ালে ঝুলছে। আচ্ছা বলতো আল্লাহ্ কেন মাঝে মধ্যে মানুষের সাথে এতোটা নির্দয় হয়। প্রতিদিন আমাদের পারিবারিক ঐ ছবিটাকে যত্ন নিয়ে মুছি, জীবনে শিহাবের উপস্হিতি অনুভব করি। ওর অকাল মৃত্যুটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। কোনভাবেই না।” একটা ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর কথা বলেই শিলার জোর একটানা কান্নায় আমি নিজেও ভীষণ কষ্ট অনুভবে। নিজের ভালোবাসার মানুষের অকাল বৈধব্য, স্বান্তনা দেওয়ার ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেললাম। মাথা নীচু করে কান্নাটাই শুনে গেলাম।
(দশ পর্বে সমাপ্ত। অষ্টম পর্ব আগামীকাল। ধন্যবাদ।)