মাস্টারমশাই,পর্ব ১
শুভজিৎ জানা
১।
২০১৭ সাল। পৌষ মাস, অল্প সময়ের ব্যবধানে ময়ূরগঞ্জ উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে দেবে। তীব্র শীত মানুষের কোলাহল থামাতে পারেনি। এখনো কুয়াশায় আকাশ ঢাকা রয়েছে। বাসস্ট্যান্ডে কুলি এবং দোকানদারদের হৈ-হুল্লোড় বেশ চোখে পড়ার মতো। বাস ছাড়তে কিছুটা দেরি হচ্ছে তাতেই যাত্রীদের ক্ষোভের শেষ নেই। সকাল সকাল মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়ার মজাই আলাদা। একজন উনত্রিশ-তিরিশ বছরের ভদ্রমহিলা মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়া শেষ করলো। দোকানদারের প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে সে ভিড়ে ঠাসা বাসের মধ্যে উঠলো। পরনে গোলাপি রঙের শাড়ি,তার ওপর একটি সাদা রঙের শাল জড়িয়ে রেখেছে। মাথায় রয়েছে উলের টুপি। তবুও শীতে থর থর করে কাঁপছে। সম্ভবত শীতের সকালে জার্নি করার অভ্যাস নেই।তাই একটু অসুবিধায় পড়েছে। নিজের সিটের কাছে গিয়ে হতাশ হলো। সিট জানালার পাশে পড়েছে। এত শীতের মধ্যে জানালার পাশে বসে জার্নি করা কতটা দুষ্কর, তা সে কল্পনা করতেও পারছে না। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তবে ওর পাশের সিটটি খালি। অপেক্ষা করতে লাগলো আগন্তুক লোকটির জন্য। হয়তো,ওই লোকটিকে বলে সে নিজের সিট চেঞ্জ করতে পারবে। মিনিট দশেকের মধ্যে লোকটি এসে উপস্থিত হলেন। লোকটিকে দেখে কাবেরী সমস্ত আশা ত্যাগ করলো। লোকটির বয়স সত্তরের কাছাকাছি। লোক বলাও ভুল তিনি সম্পূর্ণ বৃদ্ধ। এত ঠান্ডার মধ্যে সে নিজেই জানালার পাশে বসতে পারছে না, সেখানে সত্তর বছরের বৃদ্ধকে কি করে বসতে বলতে পারেন! নিজের বিবেকে লাগলো। নিজের প্রস্ফুটিত আবেগকে সুপ্ত করে রাখলো।
ধীরগতিতে বাস চলতে শুরু করলো। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই কাবেরীর। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। কখন বেলা গড়িয়ে গেল বুঝতে পারল না। একটা ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। আকাশ বেশ পরিষ্কার। বেলা প্রায় দশটার কাছাকাছি। রোদ ঝলমল করছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঠিক মনে করতে পারলো না। তবে অনুমান করতে পারলো বেশ অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল।বাস শহর ছেড়ে সম্পূর্ণ গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে গেছে। পাশ ফিরে দেখলো সেই বৃদ্ধটিকে,তিনি আপন-মনে খবর কাগজ পড়ে যাচ্ছেন, আর বিড় বিড় করে কাকে যেন বকে যাচ্ছেন। সেগুলো কে পাত্তা না দিয়ে কাবেরী বাইরের খোলা আকাশের দিকে তাকালো। আজ প্রায় পনেরো বছর পর ময়ূরগঞ্জ ফিরছে। নিজের গ্রামের বাড়ি। ছোটবেলা কাটিয়েছে এই গ্রামে। কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। নীল সীমাহীন সমুদ্রের মতো ভালোবাসা,আবেগ জড়িয়ে রয়েছে এই গ্রামকে কেন্দ্র করে। তার গ্রাম। তার জন্মভূমি। ব্যস্ততার কারণে কিংবা বিভিন্ন অজুহাতের কারণে গ্রামে আর ফেরা হয়নি পনেরোটি বছর। তার আবেগ ভালোবাসা যেন হারিয়ে গেছিল। শহরের কোলাহল ক্লান্তি থেকে এক টুকরো ভালোবাসার পাওয়ার আশায় ছুটে চলে এসেছে এই গ্রামে। কয়েকটা দিন গ্রামে কাটানোর পর সে আবার ফিরে যাবে তার শহরে। তবে এখন গ্রামের রাস্তা অনেক উন্নত হয়ে গেছে। আগে ময়ূরগঞ্জ থেকে শহরে যাওয়ার জন্য সপ্তাহে দুদিন বাস চলতো। তাও নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কখনো আবার আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হতো। তবে এখন তা নেই। রাস্তা বেশ চকচকে এবং প্রায় তিরিশ মিনিট অন্তর বাস বেরিয়ে যাচ্ছে। এখনো বাসভর্তি মানুষ রয়েছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীত অনেকটাই কমে গেছে। মাথায় উলের টুপি খুলে ফেললো। টুপি খুলে ফেলতেই তার রূপ প্রকাশ পেল। রোগা ছিপছিপে ভদ্র মহিলা। মেঘবর্ণ গায়ের রং। চুল বেশ লম্বা এবং খোপা করে বাঁধা।
আরও কিছুক্ষণ বাস চলল। তারপর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থামল। বাস থামতেই কাবেরী এ-দিক ও-দিক চোখ ঘোরাতে লাগলো। জায়গাটা খুব চেনা। ময়ূরগঞ্জ এর আগের বাস স্ট্যান্ড। এখানে একটি বড় বটগাছ আছে। তাই বেশিরভাগ মানুষ এই জায়গাটিকে বটতলা বলে। কাবেরী চোখ ঘুরিয়ে বট গাছটি খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও পেল না। সম্ভবত গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে। বাসের প্রায় অধিকাংশ মানুষ এই জায়গায় নেমে গেল। এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ পরিচিত কাউকে দেখে কাবেরীর চোখ স্থির হয়ে গেল। স্থির চোখে একটি চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকলো।দোকানের বাইরে একটা বেঞ্চের ওপর বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। হাতে দুটো বই আর খবরের কাগজ। মাথায় সবগুলো চুল সাদা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। মুখে করুন বার্ধক্যের ছাপ। হঠাৎ করে যেন উনার বয়স বেড়ে গেছে। চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে বার্ধক্য। বার্ধক্যের করুন যন্ত্রণায় তিনি কম্পিত। তিনি যেন খাঁচায় বন্দি এক পাখি। সেখান থেকে মুক্তি পেতে ছটফট করছেন। কিন্তু পারছেন না। দোকানের পাশে কয়েকটি ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে।আর তারা বারবার বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে হাসাহাসি করছে। অজান্তেই কাবেরীর চোখে জলের রেখা বয়ে গেল। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এই মানুষটিকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। মানুষটি তানভীর স্যার। পুরো নাম শেখ তানভীর আলম।তার ছোটবেলার মাস্টারমশাই।এক অজানা কারণে অন্যান্য স্যারের তুলনায় এই স্যার তার কাছে অনন্য।এই মানুষটিকে ঘিরে বেঁধে রয়েছে হাজারো স্মৃতি। যা কখনো ভোলা সম্ভব নয়। কিন্তু মাস্টারমশায়ের সেই উজ্জ্বল শরীর, চোখেমুখে গাম্ভীর্য, তীব্র রাগ, কঠোরতা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। যে মানুষটাকে একসময় সারা স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ভয় করতো। সামনে যেতে হাত-পা কেঁপে উঠতো।আজ সেই মানুষটিকে দেখে হাসাহাসি করছে সবাই। বড্ড আজব এই সময়। সময় কখনো কোনো মানুষের দিকে অনুকূল থাকে না। আজ সময় আপনার দিকে অনুকূল আছে তো কাল আপনার দিকে প্রতিকূল থাকবে। এটাই পৃথীবির নিয়ম।
কাবেরী বিন্দুমাত্র দেরি করলো না।সে ছুটে মাস্টার মশাইয়ের কাছে গেল। পাশের বৃদ্ধ তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দেবে। কোনো বাধা মানল না কাবেরী। ছুটে বাস থেকে বেরিয়ে গেল। মাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছে। দু চোখ স্থির হয়ে রয়েছে মাস্টারমশায়ের পাংশু মুখখানির দিকে চেয়ে। মাস্টারমশাই সেদিকে খেয়াল করেননি। তিনি আপন-মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। চোখে ঠিকমতো দেখতেও পান না। মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলো কাবেরী। কিন্তু পারল না। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’মাস্টারমশাই! ও মাস্টারমশাই! আমায় চিনতে পারছেন?’
এই একটা শব্দই মাস্টারমশাইয়ের শরীর চঞ্চল করে তুলল। বহু বছর চাপা পড়ে যাওয়া পুরনো স্মৃতি জেগে উঠতে শুরু করলো। কতদিন হয়ে গেছে এই শব্দ তিনি শোনেননি। এখন কেউ মাস্টারমশাই বলে তাঁকে সম্বোধন করে না। সবাই হাসাহাসি করে। গালাগালি দেয়। মাস্টারমশাই মুখ তুলে তাকালো। কাবেরীর মুখটি আবছা আবছা মনে পড়ছে। তবে চিনতে পারলেন না। তিনি করুণ স্বরে বললেন,’কে তুই,মা?’ কাবেরী আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মাস্টারমশাইয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। তার মাস্টারমশাই তাকে চিনতে পারছে না। এ কি করে সম্ভব? খানিকক্ষণ চুপ থাকল কাবেরী। তারপর ভাবল, এটাতো স্বাভাবিক! প্রত্যেক বছর কত স্টুডেন্ট আসছে যাচ্ছে। সেখানে কতজনের মুখ মনে থাকবে মাস্টারমশাইয়ের?বয়স হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে ভুলে গেছেন। কাবেরী মুখ তুলে বলল,’আমি কাবেরী, মাস্টারমশাই! আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?আমি আপনার স্কুলের স্টুডেন্ট ছিলাম।’
মাস্টারমশাই তখনো চুপ রইলেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,’ও কাবেরী….’
‘হ্যাঁ মাস্টারমশাই। আমি কাবেরী। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?’
‘বয়স হয়েছে। ঠিকমতো দেখতে পারি না। কি করে চিনবো, বল? তবে নামটা বেশ মনে আছে?’
কাবেরী নিজের চোখের জল মুছে ফেলল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। তার মাস্টারমশাই তাকে চিনতে পেরেছে। এর চাইতে সুখ মনে হয় আর কোনো কিছুতে নেই। এত বছর পরও মাস্টারমশাই তার নামটা মনে রেখেছে। কাবেরী মাস্টারমশাইয়ের হাত স্পর্শ করল। ঠিক তখনই মাস্টারমশাই এক অদ্ভুত আচরণ করলেন। তিনি তার হাত ছুঁড়ে ফেললেন। বেশ রাগান্বিত স্বরে বললেন,’স্পর্শ করবে না আমাকে। আমি একটা পাপি মানুষ। ছুঁবে না আমায়।’
মাস্টারমশাইয়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসলো। পাশে বসে থাকা ছেলেরা হো হো করে হাসতে লাগলো। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। কাবেরী দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে বলল,’মাস্টারমশাই, আপনি এমন করছেন কেন? চলুন আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। কতদিন আপনার সঙ্গে গল্প করিনি। আপনাকে দেখিনি। চলুন না একবার আমার সঙ্গে।’
‘থাক দয়া দেখাতে হবে না। এই মাস্টারমশাই নিজের কাজ নিজে করতে পারে। কারোর দয়ায় বড় হয়নি।’ কর্কশ স্বরে কথাগুলো বললেন মাস্টারমশাই। হতভম্ব হয়ে বসে রইল কাবেরী। তার মাস্টারমশাই তার সঙ্গে এমন আচরণ কেন করছে? সে জানে না। কাবেরী আবার একবার মাস্টারমশাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। মাস্টারমশাই বেঞ্চ থেকে উঠে পড়লেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন,’দয়া দেখাতে এসেছে, দয়া! চাই না আমি কারোর দয়া। আরে আমি মাস্টারমশাই,আমি কোনো সেলিব্রেটি নই। মাস্টারমশাই আর সেলিব্রেটির মধ্যে অনেক পার্থক্য। আগে তা বোঝার চেষ্টা কর। তারপর দয়া দেখাবে।’ কাবেরী এবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। মাস্টারমশাইয়ের যেন আগের রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু কাবেরী তো এমন কোনো আচরণ করেনি। যেখানে মাস্টারমশাই মনঃক্ষুন্ন হবে। কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না। হাতে দুখানা বই আর খবর কাগজ নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর বিড় বিড় করে বলে গেলেন,’আমি ফেমাস মানুষ। আমি সেলিব্রেটি। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে সেলিব্রিটি বানিয়ে দিয়েছে। আমার নামে বই বের করেছে। আমার নামে ইউটিউবে ভিডিও বানিয়েছে। আমার নামে আবার ফ্যান ক্লাব রয়েছে। আমি সেলিব্রেটি। কোনো ছাত্রছাত্রীকে আমি মানুষ করতে পারিনি। সবকটা গাধা তৈরি হয়েছে।সবকটা গাধা…সবকটা গাধা..।’
কাবেরী বাসে ফিরে আসলো। মাস্টারমশাইয়ের জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। কিছু একটা আঘাত মাস্টারমশাইকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। কাবেরী ভাবতে লাগলো। গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। মাস্টারমশাইয়ের শেষের কথাগুলো বারবার ভাবতে লাগলো। উনার নামে বই বেরিয়েছে। উনার নামে ইউটিউবে ভিডিও বেরিয়েছে। সেখানে তো মাস্টারমশায়ের খুশি হওয়ার কথা। উনার জীবনী নিয়ে কেউ গল্প লিখেছেন।এর চাইতে খুশির খবর, আর কি হতে পারে! কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের চোখের জল বলছে,উনি আদৌ খুশিতে নেই। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কঠিন অসুখ তাঁকে শেষ করে দিচ্ছি। তার নামে কি বই বেরিয়েছে? যেখানে মাস্টারমশাই এতটাই রেগে রয়েছেন? তিনি ভেঙে পড়েছেন। তিনি কখনোই ভেঙ্গে পড়ার মানুষ ছিলেন না। কঠিন একটা আঘাত পেয়েছেন। সেই আঘাতের কারণ জানতেই হবে।
অনেক বছর পর নিজের গ্রামে ফিরল কাবেরী। তবুও নিজের মনকে স্থির রাখতে পারল না। বারবার বিচলিত হয়ে উঠছে। এক অজানা আশঙ্কা মনকে উত্তেজিত করে তুলছে। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ জিনিসই পরিবর্তন হয়ে গেছে।সেই পরিবর্তন তার চোখে লাগলো না। তার চোখে বারবার ভেসে উঠছে মাস্টারমশাইয়ের করুন দুখানা চোখ। মাস্টারমশাইয়ের বলা শেষ কথাগুলো।সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। গ্রামের বাড়িতে ব্যাগপত্র রেখে সোজা বেরিয়ে গেল মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেল। এর আগে অনেকবার মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে গেছে। আগের মতো সবকিছু ঠিকঠাক আছে, শুধু হারিয়ে গেছে হই হুল্লোড়। গ্রামের এক পাশে তাঁর বাড়ি।বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করার আগে লক্ষ্য করলো বাগানে কেউ গাছে জল দিচ্ছে। কাবেরী প্রথমে ওই লোকটির কাছে গেল। লোকটিকে খুব চেনা চেনা লাগছে। এই গ্রামে তার বাড়ি। লোকটি কাবেরীকে দেখে হেসে ফেলল। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে আসলো। গামছায় হাত মুছতে মুছতে লোকটি বলল,’ম্যাডাম আপনি?’
‘হ্যাঁ, তুমি রঘু তাই না!’
লোকটি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তারপর বলল,’জি ম্যাডাম।’
‘তুমি এখানে কি করছ?’
‘আমি আজ অনেকগুলো বছর ধরে এখানে রয়েছি। মাস্টারমশাইয়ের দেখাশোনা করি। বাড়িতে উনি একা থাকেন। উনার সেবা সুস্থতার সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর।’ রঘুর কথা শুনে কাবেরী ইতঃস্তত বোধ করতে লাগল। মাস্টারমশাইয়ের একটি সুখের সংসার ছিল। ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী সবাই ছিলেন। তারা এখন কোথায়? তবুও কাবেরী অন্যমনস্ক থাকলো।মনের মধ্যে আলাদা একটি আশঙ্কা দেখা দিল। একটু গম্ভীর স্বরে বলল,’আমি যতটুকু জানি তুমি ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে। ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করছো?’
রঘু খিল খিল করে হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,’যখন বৃদ্ধ বাবা-মা চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, পেটের খিদায় ছটফট করে, তখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ সবকিছু হারিয়ে যায়।’ কথা শেষ হতেই মাটির দিকে তাকালো রঘু। ক্ষণিকের মধ্যে নীরবতা নেমে এল। কাবেরী কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। এমন প্রশ্ন করা হয়তো উচিত হয়নি। আর কথা বাড়ালো না। মাস্টারমশাই এখন কোথায় আছে তা জেনে নিল। তারপর সে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। ভেতরে মাস্টারমশাই একটা কাঠের চেয়ারের উপর বসে রয়েছেন। ফোনে কার সঙ্গে বেশ হাসি খুশিতে কথা বলছেন। কাবেরী ভেতরে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মাস্টারমশাই ফোন রেখে দিলেন। তারপর তাকে চেয়ারে বসতে বললেন। কাবেরী বসলো। মাস্টারমশাই এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছেন। চোখে মুখে হাসি ফুটে রয়েছে। এখন অনেক সরল সহজ লাগছে। কাবেরী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে স্বাভাবিক ভাবে বলল,’আপনি কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?’ তিনি একটা জোরে হাই তুললেন। তারপর বললেন,’আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলছিলাম। জানিস, ছেলেটা বড্ড মিষ্টি হয়েছে। এখন আগের মত আর নেই। অনেক বদলে গেছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। আমার প্রচুর খেয়াল রাখে।’ মাস্টারমশাই থেমে গেল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল। এ টুকু কথাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। কাবেরী আবার বলল,’আপনার ছেলে কোথায় থাকেন?’
‘বিদেশে। বড় কোম্পানির মালিক। দেশে আসতে সময় পায় না। কিন্তু রোজ সময় করে ফোন করে। আমাকে ফোন করে বারবার বলে আমি যেন সেখানে চলে যাই। কিন্তু আমি এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারি না। বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল, চেয়ার, টেবিল, বই,খাতা,পেন সবকিছু ঘিরে অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এই স্মৃতি ছেড়ে আমি যেতে পারি না। সবাই চলে গেছে কিন্তু আমি থেকে গেছি।’ তিনি থামলেন। জল খেতে চাইলেন। কাবেরী উঠে গিয়ে মাস্টারমশাইকে এক গ্লাস জল এনে দিল। জল পান করে আবার বলতে শুরু করলেন।
‘জানিস তো মা,বড্ড ইচ্ছে করে এই বয়সে সবার সঙ্গে মন খুলে কথা বলি। কিন্তু কেউ এই বৃদ্ধ মানুষের কথা শোনে না। সবাই বলে বৃদ্ধ মানুষ। আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি। মুখে যা আসে তাই বলে যাই। আমার কথার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু আমার ছেলে আমার গর্ব। সে আমার সব কথা মন দিয়ে শোনে। দূর থেকে হলেও আমার খেয়াল রাখে।’
মাস্টারমশাই চোখ ছল ছল করে উঠল। তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। কাবেরী মাস্টারমশাইয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগল। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,’আপনি তো আপনার ছেলের কাছে চলে যেতে পারেন। সেখানে অনেক সুখে থাকবেন।’ মাস্টারমশাই মৃদু হাসলো।
‘বিদেশে এত মানুষ কই?যে আমার দেখাশোনা করবে!সেখানে সবাই ব্যস্ত। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।দিনের শেষে প্রিয় মানুষটিকে এক মুহূর্ত সময় দেওয়ার মতো সময়ও তাদের কাছে থাকে না।’ কাবেরী কিছু বলল না। চুপচাপ বসে থাকলো। সে ভাবছে…। গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে। যে বয়সে বাবা-মা সন্তানদের মানুষ করার জন্য নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করেছিল,যে বয়সে তাঁদের দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা ছিল, একে অপরকে প্রেম নিবেদন করার কথা ছিল, ওই বয়সে তাঁরা ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছে। তাঁরা এখন চায়, তাদের ছেলে মেয়ে তাদেরকে সময় দিক। কিন্তু দিনের শেষে ছেলে মেয়েরাই তাদেরকে পর করে দিয়েছে।
চলবে…..