মাস্টারমশাই,পর্ব ২

0
725

মাস্টারমশাই,পর্ব ২
শুভজিৎ জানা

ময়ূরগঞ্জ, শহর থেকে প্রায় শত কিলোমিটার দূরে এক নিরিবিলি জায়গায় অবস্থিত। গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা সবুজ গ্রাম। বেশিরভাগ মানুষ চাষের উপর নির্ভরশীল। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকজন মানুষ শহরে গিয়ে থাকেন। দিনশেষে কিংবা সপ্তাহের শেষে তারা আবার গ্রামে ফিরে আসেন।পারস্পারিক সমন্বয় এবং ঐক্যের মধ্যে তাঁরা জীবন-যাপন করেন। গ্রামের মানুষের মধ্যে হিংসা কিংবা পারস্পারিক রেষারেষি নেই তা বলা সম্পূর্ণ ভুল,রয়েছে,তবে অনেক কম। গ্রামে হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের মানুষ বসবাস করে। হাতে গোনা মাত্র তিনটে খ্রিস্টানদের বাড়িও রয়েছে। গ্রামের একেবারে পশ্চিমে কিছুটা দূরত্ব বরাবর রয়েছে মন্দির আর মসজিদ। পাশে রয়েছে বড় একটি দিঘি। বিকেল বেলায় গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে। দেখা যায় এক অপূর্ব মেলবন্ধন। কিন্তু রাতের বেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অপূর্ব মেলবন্ধন কোথায় হারিয়ে যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিঘির পাড়ে জুয়ার আড্ডা কিংবা তাসের আড্ডা জমে ওঠে। মাঝরাতে মানুষের চিল্লাচিল্লিও শোনা যায়।নিজেদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিজেরা পালন করে। আবার কিছু মানুষ দুটো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে উদারতার পরিচয় দেন। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবন….।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ঝগড়া,মারামারি।এক আদ্ভুত কারনে এই গ্রামের ধর্মের কারণে কখনো মারামারি হয়নি। প্রত্যেক মানুষই একে অপরের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে। অন্যের ধর্মের প্রতি ঘৃণা কখনো দেখা যায়নি। হয়তো এটাই এই গ্রামের ঐক্য।এই জিনিসটাই গ্রামের সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।

২।
২০০২ সাল, বৈশাখ মাস। বেশ অনেকদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। প্রখর রোদ গাছের পাতাগুলোকে শুকিয়ে দিয়েছে। পাতা গুলো দু-ফোঁটা বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভ্যাপসা গরমে মানুষ গুলো বড্ড ক্লান্ত।তীব্র গরম সহ্য করেও স্কুলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে কাবেরী।ক্লাস এইটের ছাত্রী সে।বয়স চৌদ্দ থেকে পনেরো মধ্যে হবে। খুব সরল এবং শান্তশিষ্ট মেয়ে। তার প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সঙ্গী শুভজিৎ। কাবেরী থেকে শুভজিৎ প্রায় দেড় বছরের ছোট। তবে এই শুভজিৎ এর আসল পরিচয় এখনো জানা যায়নি। তার বাবা-মা কে? আগে কোথায় থাকতো? জানা সম্ভব হয়নি। নিলেশ বাবু মানে কাবেরীর বাবা, উনিই প্রথম শুভজিৎ কে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। উনার মুখ থেকেই শুভজিৎ এর সম্বন্ধে সামান্য কিছুই তথ্য জানা যায়। নিলেশ বাবু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই শহরে কাটান। বাড়িতে স্ত্রী এবং মেয়ে থাকে।নিলেশ বাবুর স্ত্রী মানে পায়েল দেবী ছোটবেলা থেকে শহরে বড় হয়েছেন। গ্রামের মানিয়ে নিতে কিছুতেই পারছিলেন না। এত কাজ একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। একটা কাজের মানুষ চাই। কিন্তু গ্রামের কাজের মানুষ পাওয়াই দুষ্কর।গ্রামের মানুষগুলো অন্যের বাড়িতে চাকর গিরি করতে একদম পছন্দ করে না। শহর থেকে কেউ গ্রামে কাজ করতে আসতে রাজিও ছিল না।বড্ড মুশকিলে পড়েছিলেন নিলেশ বাবু। তার চালাক চতুর মন কিছুতেই কাজে লাগাতে পারছিলেন না।এমন সময় তার সাথে দেখা হয় ছোট্ট শিশু শুভজিৎ এর।সে একটা চায়ের দোকানে কাজ করতো। দোকানে আসা মানুষদের চা দিত,আবার কেউ ঘুগনি-মুড়ি কিংবা রুটি-ঘুগনি খেতে চাইলে তা দিতে হতো।তারপর থালা বাসন ধুয়ে পরিষ্কার করতো। এর বিনিময়ে শুভজিৎ কোনো টাকা পেত না। শুধুমাত্র তিন বেলা খেতে পারতো। আবার রাতে দোকানেই ঘুমোতে হতো, ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে। এই সুযোগ ছাড়তে চাইলেন না নিলেশ বাবু। তিনি এখানে এক অমানবিকতার পরিচয় দিলেন। নিজের চরিতার্থকে বিসর্জন দিলেন।বাচ্চা ছেলেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। কিন্তু অর্ধেকের বেশি প্রতিশ্রুতি রাখলেন না। চাকর চাকরই থেকে গেল।
রোজ সকালে উঠে শুভজিৎ প্রথমে পুজোর জন্য বাগান থেকে ফুল তুলে আনে। তারপর বাগানে গাছে জল দেয়।পায়েল দেবীর সমস্ত কাজে সাহায্য করে। রান্না করার সময় শুভজিৎ কে পায়েল দেবীর কাছে থাকতে হয়। উনার সঙ্গে বাজারে যেতে হয়, জল আনতে যেতে হয়,এবং কাবেরীকে স্কুলে,টিউশনে ছাড়তে এবং আনতে যেতে হয়। এবং সর্বশেষে বিকালে শুকনো জামা কাপড় গুছিয়ে আনতে হয়। এটাই শুভজিৎ এর সারাদিনের রুটিন। এর জন্য শুভজিৎ কোনো টাকা পায় না। তিনবেলা খাবার পায়। এবং বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের যখন নতুন জামা কাপড় কিংবা নতুন জুতো আনা হয়, তখন শুভজিৎ ও নতুন জামা-কাপড় উপহার পায়।প্রত্যেক মাসের শেষে যখন পুরো পরিবার এক সঙ্গে বেড়াতে যায় তখন শুভজিৎ ও তাদের সঙ্গী হয়। তার জন্য আলাদা রুম এবং বিছানার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন নিলেশ বাবু। শুধুমাত্র এটাই উপরি পাওনা ছিল তার। তবে পায়েল দেবী শুভজিৎ কে খুব ভালোবাসেন। উনার ভালোবাসার অনেক কারণ রয়েছে। শুভজিৎ খুব শান্তশিষ্ট এবং সাধাসিধে ছেলে। কোনো কাজে না বলে না। তার অভিধানে যেন ‘না’ শব্দটি নেই। সে সব সময় চেষ্টা করে তার মালিকের মন তুষ্ট করার। শুভজিৎ এর এই স্বভাব পায়েল দেবীর কাছে খুব তাড়াতাড়ি প্রিয় হয়ে ওঠে। নিজের ছেলের মতো না হলেও খুব ভালোবাসেন তিনি। তবে শুভজিৎ এর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি।তাকে তিন বেলা খাবার দিচ্ছেন, জামা কাপড় এনে দিচ্ছেন, -তার ওপর পড়াশোনা! না তা কখনো করবেন না নিলেশ বাবু। তিনি এমনিতেই ভীষণ কৃপণ। তার ওপরে এত কিছু কখনোই করবেন না। ইতিমধ্যে নিলেশ বাবু সাত গ্রামের মানুষকে জানিয়ে রেখেছেন, তিনি নাকি একটা অনাথ আশ্রম থেকে ছেলে আনিয়ে নিজের টাকায় বড়ো করছেন। তার সমস্ত দেখভাল খরচ উনার। এতে নিজের বেশ সুনাম ছড়িয়েছে। অনেকেই বুকভরা প্রশংসা করছেন। কিন্তু তিনি কতটা প্রশংসার যোগ্য তা একমাত্র ভগবানই জানেন।

শুভজিৎ, গায়ে ঢিলেঢালা পোশাক তবে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পায়ে চটি জুতো হাঁটার শব্দ বজায় রেখেছে।মাথাভর্তি উস্কোখুস্কো চুলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক পবিত্র মুখ। মুখে প্রফুল্ল হাসি বজায় রেখে কাবেরীর সাথে খোশ গল্প করছে। তার কাঁধে রয়েছে কাবেরীর স্কুল ব্যাগ। মালিক বলে দিয়েছেন, স্কুল ব্যাগ যেন সে নিয়ে যায়। তার ছোট মেয়ে ব্যাগ নিতে পারে না। মালিকের আদেশ অমান্য করার সাধ্য তার নেই। অন্যদিকে কাবেরী বেশ পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। চুলগুলো বেণি করে বাঁধা। শরীর বেশ চকচক করছে। কানে দুটো ছোট ছোট রিং পরে আছে। বিকালে কোথায় যাবে? কি করবে? কি কি খেলবে? এই নিয়ে দুজন কথা বলছে। স্কুলের কাছে এসে হঠাৎ কাবেরী থমকে দাঁড়িয়ে গেল। খুব তাড়াতাড়ি শুভজিৎ কে নিজের কাছে টেনে নিয়ে কোনো এক মানুষের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করল। মুহুর্তের মধ্যে কি ঘটলো, শুভজিৎ তা অনুমান করতে পারলো না।কাবেরী তাড়াতাড়ি শুভজিৎ এর কাছ থেকে স্কুল ব্যাগ নিয়ে নিল। তারপর তাকে বিদায় জানিয়ে স্কুলের মধ্যে প্রবেশ করল।অন্যদিকে, শুভজিৎ একটা ছোট্ট লাঠি দিয়ে রাস্তার আশেপাশে ছোট ছোট গাছগুলোকে পিটতে পিটতে বাড়ি ফিরতে লাগলো…..।

কিছুক্ষণ আগে কাবেরী যাকে দেখে থমকে গিয়েছিল, তিনি হলেন তানভীর স্যার। বেশ লম্বা এবং ছিপছিপে শরীর।উনাকে দেখলে কেউ বলতে পারবেন না -উনি পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। সব-সময় সুট-বুট লাগিয়ে বেশ পরিপাটি হয়ে থাকেন।প্রায় সময় গম্ভীর এবং রাগান্বিত থাকেন। কাউকে ভয় পায় না। কারোর সঙ্গে তেমন কথাও বলেন না। স্কুলের এমন কোনো ছাত্রছাত্রী নেই, তাঁকে ভয় পায় না। তাঁকে দেখলে ছাত্রছাত্রীরা দশ হাত দূরে সরে দাঁড়ায়। স্কুলে উনার অনুপস্থিতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঈদ কিংবা পুজোর আনন্দ দেয়।ছাত্র-ছাত্রীরা তানভীর স্যারকে ভয় পাওয়ার অনেক কারণও রয়েছে।বেশ রোমাঞ্চকর এক মানুষ।উনার সঙ্গে উনার সহকর্মীদের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। উনার সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকার জন্যও রয়েছে হাজারো কারণ। তিনি স্কুলের অর্ধেকের বেশি গাইডলাইনস পালন করেন না। তিনি নিজের জন্য নিজের আইন বানিয়েছেন। এর জন্য অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়।ঝামেলা পোহাতে রাজি কিন্তু গাইডলাইনস কিছুতেই পালন করবেন না। স্কুলের সমস্ত শিক্ষক মনে করেন ছাত্র-ছাত্রীদের শাসনের পাশাপাশি ভালোবাসা থাকাটাও জরুরি। কিন্তু তিনি তা মনে করেন না। তার কাছে শাসনই সবকিছু। শাসন ছাড়া তার অন্য কোনো অস্ত্র জানা নেই। তিনি স্কুলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তীব্র বিরোধিতা করেন। স্কুল হলো একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ সুগঠিত হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে স্কুলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানানসই নয়। তাঁর মতে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদেরকে কুসংস্কারের অতল গভীরে নিয়ে যায়। অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা স্কুলের প্রার্থনার পরে আসেন। বিষয়টি একদমই পছন্দ করেন না। বড়দের দেখে ছোট শিশুরা শিখবে। প্রার্থনার পর ছাত্রছাত্রীরা এলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু শিক্ষকদের নেই।অনেক শিক্ষক বই দেখিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান। তাও মানতে পারেন না। একজন শিক্ষকের পক্ষে এক জীবনে সবকিছু জানা কখনোই সম্ভব নয়। তাঁর অনেক কিছুই অজানা থাকতে পারে। স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বই খুলবেন,তা পছন্দ করেন না।প্রয়োজন হলে শিক্ষক বাড়ি থেকে প্রস্তুত হয়ে আসবেন।তিনি মনে করেন,শিক্ষক শিক্ষিকারা বই খোলার জন্য, আজকাল বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরাও চুরি করে লিখতে শুরু করেছে। শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে ছাত্র ছাত্রীদের এই বদ অভ্যাস জন্মেছে। শিশুরা কখনো বড়দের কথা শোনে না। বড়দের করা কাজগুলো অনুসরণ করে। তাই বড়দের করা কাজ গুলোর প্রতি শিশুদের ঝোঁক বেশি থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা স্কুলের চাইতে প্রাইভেট টিউশনিতে বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি তা পছন্দ করেন না। দেশের অনেক যুবক-যুবতী পড়াশোনা করে বেকার বসে রয়েছে।টিউশনের ক্ষেত্রে তাদেরকে বেশি ছাড় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। তানভীর স্যারের এই হিজিবিজি ভাবনা সহকর্মীদের সঙ্গে বিরোধের মূল কারণ। উনার সঙ্গে কেউ ঠিকমতো মিশতেও চায় না। উনার ভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা।

ক্লাস এইটের প্রথম ক্লাস তানভীর স্যারের। স্যার প্রবেশ করার অনেক আগেই পিনপতন নিরবতা নেমে এসেছে।উনি কতটা ভয়ানক হতে পারেন, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জানা। উনি সবসময় রুটিন ফলো করে চলেন। উনি ক্লাস রুমে প্রবেশ করার পর,কোনো ছাত্রছাত্রীকে উনার ক্লাসে কিছুতেই প্রবেশ করতে দেবেন না। সারা ক্লাস বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীরাও এখন যথেষ্ট সচেতন হয়ে গেছে।উনি নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশ করলেন। ‘গুড মর্নিং’ জানিয়ে সবাইকে বসতে বললেন। কেউ বেঞ্চে হেলান দিয়ে কিংবা অন্যের কাঁধে নিজের মাথা রেখে বসার সুযোগ নেই। সম্পূর্ণ স্ট্রং হয়ে বসতে হবে। একটু বেয়াদবি করলেই পিঠে পড়বে ডাস্টারের ঘা। এদিকে কাবেরীর গোটা শরীর কাঁপুনি দিচ্ছে। এই বুঝি তাকে ডাকল। আর একের পর এক লাঠির ঘা পিঠে পড়ল। স্যারের সমস্ত পড়া কমপ্লিট করে এসেছে। তবুও এক অজানা আতঙ্কে ভয় পাচ্ছে।তার স্কুলের ব্যাগ শুভজিৎ নিয়ে এসেছিল।তানভীর স্যার তা একদম পছন্দ করবেন না ভালোভাবে জানে -তাই স্যারের চোখের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কতটা পেরেছে তা জানে না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। স্যার কাবেরীকে দাঁড়াতে বলল। তাৎক্ষণিক কাবেরী উঠে দাঁড়ালো। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখ থেকে জল বেরিয়ে এসেছে। তানভীর স্যারের হাসি পেল কিন্তু জোর করে চেপে রাখলেন। তিনি কিছুতেই তার দুর্বলতা ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে প্রকাশ করবেন না। তিনি কাবেরীকে ধমক দিয়ে বললেন,’নিজের ব্যাগ নিজে নিয়ে আনতে পারিস না? একটা ছোট্ট শিশুকে নিজের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিস! নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করবি। দ্বিতীয়বার যেন এমন ঘটনা আমার চোখে না পড়ে।’ বেশি কথা বাড়ালেন না। কাবেরীকে বসতে বললেন। নিজের পড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তানভীর স্যার। এত সহজে কাবেরী মুক্ত পাবে কখনো ভাবতে পারেনি। বেশ খুশি অনুভব করলো।পুরো ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তানভীর স্যার ইংরেজির শিক্ষক। তিনি হিজিবিজি কি সব পড়িয়ে যাচ্ছেন। সবাই বোঝার চেষ্টা করছে। না বুঝেও রক্ষা নেই।একবার বুঝতে পেরে গেছি বললে তিনি দ্বিতীয় বার আর বোঝাবেন না। ওইখান থেকে কোশ্চেন জিজ্ঞেস করবেন। উত্তর দিতে না পারলে………।
রোজ ক্লাসের শেষে তানভীর স্যার মিনিট দশেক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। নিজের কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবার বা সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। বেশ অনেকক্ষণ ধরে স্যার কিশলয়ের সঙ্গে কথা বললেন। কিশলয় ক্লাসে ফার্স্ট বয়। কিশলয় শান্তশিষ্ট এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ছেলে। প্রত্যেক বছর স্কুলে প্রথম হয়। কিন্তু সবার মতো সেও তানভীর স্যার কে ভীষন ভয় পায়। তবে স্যারের সঙ্গে তার সম্পর্ক একটু আলাদা। স্যারকে নানা ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকে। স্যারও খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকে উত্তর দেন। সেই উত্তর যেন কিশলয়ের জীবনের লক্ষ্য তরি। স্যারের প্রতিটি বাক্য শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগে। কিশলয় একটু থেমে থেমে স্যারকে বলল,’স্যার একটা প্রশ্ন করব?’
‘হ্যাঁ কর। এত ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি বাঘ না ভাল্লুক,যে তোকে খেয়ে ফেলব!’
কিশলয় স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,’স্যার, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?’
‘আমি।’
স্যারের উত্তর শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। অনেকের ভীষণ হাসি পাচ্ছে, কিন্তু স্যারের সামনে কিছুতেই হাসতে পারছে না।তানভীর স্যার ঠিক বুঝতে পেরে গেলেন ছাত্র-ছাত্রীদের মনের সংকোচন। তিনি কিশলয়কে বসতে বললেন। তারপর হাসিমুখে বললেন,’আমি ভাবি পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি নিজেই। তাই আমি সুখী মানুষ। তোরা ভাবিস পৃথিবীতে সব চাইতে দুঃখী মানুষ তোরা নিজেরাই। তাই তোরা দুঃখী মানুষ। যে মানুষের ভাবনা যেমন, সে মানুষ তেমন ভাবে গড়ে উঠবে। এই পৃথিবীতে এক কোটি টাকার মালিকও সুখী নেই, এই পৃথিবীতে এক টাকার মালিকও সুখী নেই। এই পৃথিবীতে সুখী আছে সেই মানুষ,যে মানুষ কখনো নিজের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কিছু চায়নি।’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here