মাস্টারমশাই,পর্ব ৩
শুভজিৎ জানা
_______________
আমিনা দ্রুত রান্নার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। উনার স্বামী রাত দশটার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রান্না দেরি হলেই খিটখিট করবেন।খুব ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলেন তানভীর আলম। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন এবং খুব ভোরে উঠে পড়েন। সারাদিন নিয়মমাফিক নামাজ পড়েন। নিজের একই রুটিন জোর করে চাপিয়ে দিয়েছেন ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীর উপর। তারা কেউই এই নিত্য রুটিন মানতে চায় না। কিন্তু তানভীর স্যারের উপর কথা বলার সাহসও কারোর নেই। তাই বাধ্য হয়ে সমস্ত আদেশ পালন করতে হয়। আমিনা রান্নার কাজে ব্যস্ত। অন্যদিকে ছেলে মাহবুব সকাল থেকে বিরক্ত করে চলেছে। মাহবুব, পুরো নাম শেখ মাহবুব আলম। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই বড় কলেজে ভর্তি হতে পারছে না।বড়ো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য যথেষ্ট নাম্বার প্রয়োজন। সেই নাম্বারের ধারে কাছেও নেই মাহবুব। নাম্বার না থাকলেও তার বড়ো কলেজ চাই। গ্রামের কলেজে কিছুতেই পড়বে না।সে একজন মাস্টারমশাইয়ের ছেলে। যথেষ্ট অভিজাত পরিবার। সে কিনা গ্রামের স্কুলে পড়বে! বন্ধুদের কাছে তার মান সম্মান বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু আব্বুর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসও নেই।তাই সকাল থেকে সে আম্মুকে বিরক্ত করে চলেছে। যে কোনোভাবেই হোক আম্মুকে রাজি করাতে হবে। আম্মু রাজি হয়ে গেলে আব্বু রাজি হতে আর কতক্ষন!মাহবুব একটু কান্নার ভান করল। তারপর বলল,’ও আম্মু, আব্বুকে বল না টাকা দিতে।’ আমিনা কিছু বললেন না। ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মাহবুব ভীষণ বিরক্ত বোধ করছে। তার পাশে যেন কেউ নেই। সে বড় একা।এই বিপদের দিনে তার বাবা-মাও নেই। ভীষণ রেগে গেল সে। গম্ভীর স্বরে আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলল,’তোমরা আমার জন্য সামান্য টাকা দিতে পারছো না।সামান্য টাকার উপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আছে। তোমরা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো সিরিয়াস হয়নি, আর মনে হয় না হবে বলে!’
আমিনা আর চুপ থাকতে পারলো না। সকাল থেকেই ছেলে ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছে। তিনি কড়া স্বরে জবাব দিলেন,’আমাকে বলে কি হবে শুনি! সাহস থাকলে তোমার বাবাকে গিয়ে বল।’
‘আব্বু, আমার কথা কখনো শুনেছে বুঝি! তিনি কখনো আমার কথা শুনবেন না। উল্টে সমস্ত দোষ আমার উপর চাপিয়ে দেবেন। কড়া মেজাজে কথা বলবেন।’
‘তাহলে আমি কি করবো, বল? তোর আব্বু আমার কথা কখনো শুনেনি। তিনি যা বলেন, তিনি মনে করেন তা-ই ঠিক।”
গম্ভীর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মাহবুব। তার আব্বু সমস্ত মানুষের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কখনো কারোর কথা শোনেননি। আজও শুনবেন না। বড্ড বিপদে পড়ল মাহবুব। যে কোনোভাবেই হোক আব্বুকে রাজি করাতেই হবে। টাকা তার চাই। টাকা না হলে কিছুতে বড় কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। হোস্টেলে থাকাও হবে না। গ্রামের বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে। সারাদিন বাবার আদেশ পালন করতে হবে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। দিন দিন একই কথা শুনতে শুনতে মাহবুবের কান প্রায় পচে গেছে। তার পক্ষে এই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। বন্ধুদের কথাও দিয়ে দিয়েছে এরপর তারা একসঙ্গে শহরে গিয়ে থাকবে। বন্ধুদের কথা দিলে মাহবুব কথা রাখে। তার কথা কখনো নড়চড় হয় না। আজও হতে দেবে না।সে আবার একবার চেষ্টা করল। পেছন থেকে আম্মুকে জড়িয়ে ধরল। ছেলের প্রতি ভীষণ দুর্বল আমিনা। ছেলে একটু ভালোবাসা দেখালে তাঁর মন দ্রুত গলে যায়। খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। তিনি নরম গলায় বললেন,’ছাড় বলছি, আমায় রান্না শেষ করতে দে। রান্না শেষ না হলে তোর বাবা এখনি চিল্লাচিল্লি শুরু করবে।’
আম্মুকে সরল গলায় কথা বলতে দেখে মাহবুব ভীষণ খুশি হলো। সে একটা জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’আগে কথা দাও আব্বুকে রাজি করাবে। দিলেই ছাড়বো, না হলে ছাড়বো না। সারারাত এমনভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো।’
ছেলের বোকা বোকা কথা শুনে আমিনা মৃদু হাসলেন। তারপর তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করলেন, ডিনারের সময় স্বামীর সঙ্গে টাকার ব্যাপার নিয়ে কথা বলবেন।এবং যেকোনো মূল্যে রাজি করাবেন। ছেলে ভীষণ খুশি। তার আম্মু কেবল তাকে বোঝে আর কেউ বোঝে না। খুশিতে সে মায়ের দুগালে চুমু খেলো। তারপর নাচতে নাচতে নিজের রুমে চলে গেল।
নির্দিষ্ট সময়ে খেতে বসলেন তানভীর স্যার। খাওয়ার ক্ষেত্রেও ধরাবাঁধা নিয়ম। পরিবারে যখন সকল সদস্য উপস্থিত থাকে,তখন সকল সদস্যকে একসাথে খেতে হবে। কেউ আগে পরে খাওয়া চলবে না। খিদে না থাকলেও খেতে হবে। না হলে সবাই পরে খাবে। এককথায় সবাইকে একসঙ্গে খেতে হবে। তাতে নাকি পরিবারের মঙ্গল হয়। গোল হয়ে চারজন খেতে বসলেন। আমিনা সবাইকে খাবার পরিবেশন করলেন। ছেলে-মেয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু তানভীর স্যার খেলেন না।উনার স্ত্রী যতক্ষণ না মুখে ভাত তুলছেন ততক্ষণ তিনি কিছুতেই মুখে ভাত তুলবেন না। আগে স্ত্রী খাবেন তারপর তিনি নিজে খাবেন। এটাই তার প্রতি দিনকার রুটিন।যতই ঝগড়াঝাঁটি হোক না কেন আগে নিজের স্ত্রীকে খাওয়াবেন। তারপর নিজে খাবেন। আমিনাকে ভীষণ ভালোবাসেন তানভীর স্যার। বাবা-মার দেখা মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তানভীর আলম। খুব অল্প দিনে আমিনার প্রেমে পড়ে যান। উনার সুখ দুঃখের সাথী হন আমিনা। মাত্র দুটো বছর ব্যবধানে বাবা মা চলে যায়। সেখান থেকেই আমিনা উনার পাশে রয়েছেন। উনার সমস্ত কাজে সাহায্য করেছেন। জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে। কিন্তু কখনোই আমিনা উনাকে ছেড়ে যাননি। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তানভীর স্যার। ব্যর্থতার সময় একমাত্র উৎসাহের মানুষ ছিলেন আমিনা। তাই একটু বেশি ভালোবাসেন স্ত্রীকে। উনার রাগ,গাম্ভীর্য কখনো আমিনাকে দেখাতে পারেননি।এই একটা মানুষের প্রতি ভীষণ দুর্বল। মেয়েটির ভালোবাসার কাছে নিজের রাগ, অহংকার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দিয়েছেন। চারজন খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। তানভীর স্যার ভীষণ অবাক হলেন। প্রতিদিন খাবার সময় বেশ হই হুল্লোর করে পরিবারের সকলেই গল্প করে। কিন্তু আজ কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই চুপচাপ। এই চুপচাপের কারণ তিনি জানেন না। একই আশঙ্কায় ভুগছে ইয়াসমিন। তানভীর স্যারের ছোট মেয়ে ইয়াসমিন। সে বারবার তার আব্বু আর আম্মু মুখের দিকে তাকাছে। আবার আপন-মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে, কোনো কথা বলছে না। তানভীর স্যার বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন। তিনিও খেতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর আমিনা বললেন,’তোমাকে একটা কথা বলার ছিল, বলবো?’
তানভীর স্যার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। আমিনা সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। তানভীর স্যার যতই উনার স্বামী হোক না কেন, মানুষটিকে ভীষণ ভয় পান। কেন ভয় পান? তা তিনি নিজেও জানেন না।উনার চোখ দুটো দেখে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছেন। তানভীর স্যার খুব ভালোভাবে জানেন স্ত্রী তাকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু তিনি নিজেও জানেন না, তার স্ত্রী তাকে কেন ভয় পায়? উনি কখনো স্ত্রীকে একটা কটু কথা পর্যন্ত বলেনিন। উনার উপর রাগ দেখিয়ে কখনো কথাও বলেননি। সেই প্রথম দিন থেকেই আমিনা তানভীর স্যারকে ভয় পান। প্রথম প্রথম মজা পেত, কিন্তু পরে তা বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেন স্ত্রীর চোখ থেকে ভয় দূর করে দিতে। স্ত্রীর চোখ থেকে ভয় দূর করে দেওয়ার জন্য, তিনি স্ত্রীর কাছে দুর্বল হয়ে গেছেন। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে স্ত্রীর কাজে সঙ্গ দিয়েছেন। কিন্তু তাও স্ত্রীর মন থেকে নিজের প্রতি ভয় দূর করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটাই হয়তো মাস্টারমশাইয়ের একমাত্র ব্যর্থতা। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে আমিনাকে বললেন,’বল? কি বলতে চাও!’
‘না,মানে….।’আমতা আমতা করতে লাগলেন আমিনা। মাহবুব মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে করে হেসে যাচ্ছে ইয়াসমিন। তার আম্মু, আব্বুকে এত ভয় পায় কেন সেও জানে না। কই সে তো তার আব্বুকে কখনো ভয় পায় না। যা মুখে আসে তাই বলে যায়। আব্বু কখনো তাকে বকে নি। বরং তার সাদা সরল-সিদে মনোভাব দেখে প্রশংসা করেন। তানভীর স্যার আবার বললেন,’বলবে তো! কি হয়েছে?’
‘আসলে, মাহবুব শহরের কলেজে পড়তে চায়। নাম্বার কম থাকার জন্য….….।’ আমিনার কথা আটকে দিলেন তানভীর স্যার। তিনি বুঝতে পেরে গেলেন আমিনা ঠিক কি বলতে চাইছেন। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,’আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলেকে কখনো ঘুষ দিয়ে কলেজে ভর্তি করাবো না। সে যদি মনে করে শহরের কলেজ ছাড়া তার পক্ষে পড়া অসম্ভব, তাহলে পড়া বন্ধ করে দিক। আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি কখনোই আমার ছেলেকে ঘুষ দিয়ে পড়াবো না। কেউ যদি লুকিয়ে তাকে টাকা দেয়, তাহলে তার সেদিনই হবে এই বাড়িতে শেষ দিন।’
আব্বুর কথা শুনে মাহবুবের স্নিগ্ধ উজ্জ্বল মুখশ্রী সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে গেল। তার আব্বু তাকে নিরাশ করেছে। গম্ভীর কণ্ঠে খাবার থালার দিকে তাকিয়ে বলল,’টাকা দেবে না মানে! আমাদের তো টাকার কোন অভাব নেই। এলআইসি রয়েছে,সমিতিতে হাজার হাজার টাকা রয়েছে। ওইখান থেকে সামান্য টাকা ছেলের জন্য খরচ করতে পারবে না!’
তানভীর স্যার কিছু বললেন না। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছেন। নিজের গলা আর রোদন করতে পারলেন না। জোর গলায় জবাব দিলেন,’ওই টাকা আমাকে কেউ দান করেনি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করেছি। সেই টাকা কাউকে ঘুষ দেওয়ার জন্য নয়। এক্সামের আগে মনে ছিল না, ভালো নাম্বার না থাকলে ভালো কলেজে সুযোগ হবে না। সারাদিন গ্রামে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো হয়েছে। সকালে দশ বার না ডাকলে বিছানা থেকে ওঠা হতো না। যেমন কর্ম করেছ তেমন ফল পেতে হবে। এটাই তোমার শাস্তি।’
মাহবুব আর খেলো না। চুপচাপ বসে রইল। রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে দুনিয়ার সবচাইতে খারাপ তার বাবা। বাবা ছেলের দুঃখ বোঝেন না। তিনি খুব খারাপ। খুব নিষ্ঠুর। মাহবুব খাওয়ার থালা ছেড়ে উঠে গেল। আমিনা ছেলেকে আটকানোর চেষ্টা করলো,কিন্তু পারল না। তিনিও স্বামীর উপর খানিকটা রেগে গেলেন। কর্কশ স্বরে বললেন,’দিলে তো ছেলের খাওয়া ঘুচিয়ে। সামান্য কিছু টাকা দিলে এমন কি হয়ে যেতো? আমাদের তো টাকার অভাব নেই!’
ইয়াসমিন কিছু বলছে না। চুপচাপ বসে খেয়ে যাচ্ছে। তানভীর স্যার ইয়াসমিনের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। উনাকে কিছু বলতে না দেখে আমিনা আবার একই প্রশ্ন করল। তানভীর স্যার খুব স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলেন,’দেখো আমিনা, তুমি খুব ভালো করে জানো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এই পৃথিবীতে আমি একটা মানুষের প্রতি দুর্বল। তার মানে এই নয় যে আমি তোমার সমস্ত কথা শুনবো। তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ বুঝতে শিখেছো। তুমি তোমার ছেলের কথা ভাবছো,বড় কলেজে ভর্তি হতে না পারলে তার বন্ধুদের কাছে সে মুখ দেখাতে পারবে না।কই একবার তো আমার কথা ভাবোনি। রেজাল্টের দিন যখন সমস্ত শিক্ষক আমার কাছে এসে ছেলের রেজাল্ট জানতে চাইছিল। তখন আমার মাথা কতটা নিচু হয়েছিল। বড় কলেজে পড়লে বড় জায়গায় যেতে পারবে ছোট কলেজে পড়লে বড় জায়গায় যেতে পারবে না,সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কত মানুষ রয়েছে যারা কোনো কলেজে না পড়ে অনেক বড় জায়গায় পৌঁছেছে। তোমার কি মনে হয়, তাকে টাকা দিয়ে দিলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?কখনোই হবে না। আজ তুমি তাকে টাকা দিয়ে দাও। কদিন পর সে আবার ল্যাপটপ কেনার জন্য টাকা চাইবে। আবার কয়দিন যাবে আবার বাইক কেনার জন্য টাকা চাইবে।তারপর একদিন দেখা যাবে, তোমার সামনে এসে বলছে ‘আম্মু মদ খাবো টাকা দাও’। তখনো কি তুমি টাকা দেবে?তখন তুমি নিজে এসে আমার কাছে বলবে,’ছেলেটা উচ্ছন্নে চলে গেছে’। ওকে আটকায়। তখন আর আটকানো সম্ভব হবে না। আমাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে। তুমি টাকা না দিলেও সে যেখান থেকে হোক টাকা জোগাড় করবে। মানুষের চাহিদা কখনো কমে না। দিনের-পর-দিন চাহিদা বাড়তে থাকে।’
তানভীর স্যার বকবক করে গেলেন। বাবার কথা বেশ মন দিয়ে শুনলো ইয়াসমিন সঙ্গে আমিনাও। স্বামীর কথা শুনে আমিনা অনুশোচনা করতে লাগলেন।
রাত পৌনে এগারোটা। বাড়ির সকলে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তানভীর স্যার প্রতিদিনের মতো আজও ছেলেমেয়ে রুমের গিয়ে দেখতে লাগলেন, তারা ঠিকঠাকভাবে ঘুমিয়েছে কিনা! ছেলের রুমে দরজা বন্ধ। তিনি আর জোর করে দরজা খুললেন না। ছেলে কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পেতে দাও। অনুতাপ না হলে কখনো শিক্ষা পাবে না। তাকে একা থাকতে দেওয়াই ভালো। তিনি মেয়ের রুমে গেলেন। ইয়াসমিন তখনও খাতায় কিছু একটা লিখছে। এত রাত পর্যন্ত মেয়েকে জাগতে দেখে অবাক হলেন। তিনি মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাবাকে রুমের মধ্যে দেখে ইয়াসমিন কাঁপতে লাগলো।প্রতিদিন রাতে বাবা আসেন, কিন্তু কখনো রুমের মধ্যে প্রবেশ করেন না। আড়ালে দেখে চলে যান। আজ কিছু হয়নি তো? ইয়াসমিন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’আব্বু কিছু হয়েছে?’
‘না, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন?’
‘আসলে, অনেক হোমওয়ার্ক বাকি। ওই গুলো কমপ্লিট করছি।’
‘আচ্ছা,তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। একদম রাত জাগবি না।’
তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই পেছন থেকে ইয়াসমিন ডাকলো। তানভীর স্যার পেছন ঘুরলেন। ইয়াসমিন প্রফুল্ল হাসি দিল। তানভীর স্যার অনেকবার লক্ষ করেছেন সবার চোখের তার প্রতি ভয় থাকে। কিন্তু ইয়াসমিনের চোখে কখনো ভয় দেখেননি। এই জিনিসটা বেশ ভালো লাগে তাঁর। হয়তো, এর জন্যই তিনি একটু বেশি ভালোবাসেন ইয়াসমিনকে। মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,’কিছু সমস্যা হয়েছে?’
‘না, আসলে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল?’
হাসিমুখে বললেন,’বাবাকে সমস্যা বলবি -তাতে সমস্যার কি আছে? তাড়াতাড়ি বলে ফেল তো কি বলতে চাইছিস?’ ইয়াসমিন একটা জোরে ঢোক গিলল। কি করে সব কিছু বলবে বুঝতে পারছে না। আব্বু যে সম্পূর্ণ উত্তর দেবে না, ভালোভাবে জানে। তবুও একটা চেষ্টা। আর সাত- পাঁচ না ভেবে বলল,’আচ্ছা আব্বু, আমাদের ইংলিশে হায়েস্ট নাম্বার কে পেয়েছে?’
‘ও তো একমাত্র তোদের ইংরেজির স্যার বলতে পারবেন। আমি কি করে জানব?’ প্রসন্ন হাসি বিনিময় করে বললেন। ইয়াসমিন এবছর মাধ্যমিক দেবে। কয়েক সপ্তাহ আগে তাদের প্রথম ইন্টারনাল শেষ হয়েছে। এখনো ইংলিশ খাতা বের হয়নি। তার বাবা ইংরেজির খাতা দেখছেন। তাই সে জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু বাবার উত্তরে মোটেও খুশি হলো না। হতাশ মুখে আবার বলল,’ইংলিশ টিচার তো অন্য কেউ নয়,তুমি নিজেই!’
‘আমি ইংলিস টিচার তোর স্কুলে। বাড়িতে আমি তোর আব্বু। স্কুলে আর বাড়ির মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমি কিছুতেই বলতে পারবো না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে,ইংরেজিতে হায়েস্ট নাম্বার কত হয়েছে? অন্তত এইটুকু বলো।’
‘তা-ও তোদের ইংরেজির স্যার বলতে পারবেন।’ বাবার কথা শুনে আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না ইয়াসমিন। মেয়ের হাসি দেখাদেখি তিনিও হাসতে লাগলেন।
চলবে