মাস্টারমশাই
পর্ব ১০
শুভজিৎ জানা
______________
বছর ঘুরে শীতকাল চলে এল। যদিও এখনো তেমন শীতের দেখা নেই। মৃদু শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে। গ্রামের মানুষ মাঠ থেকে সোনালী ফসল তুলতে ব্যস্ত। তার মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বিদ্যালয়গুলোতে ফাইনাল এক্সাম। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী সারা বছর পড়াশোনা না করলেও এই সময় ঠিক পড়তে বসবে। আর ভীষণ রকমের বিরক্ত হবে। একদিকে ঠান্ডা তটস্থ অন্যদিকে সারাবছরের জমে থাকা পড়া। নিজেকে দিশেহারার মতো লাগে। এমন অবস্থা কাবেরীও। সেই বিকেল থেকে পড়তে বসেছে,এখন রাত আটটা হয়ে গেছে তবুও পায়েল দেবী তাকে পড়া ছেড়ে উঠতে দেননি। পরীক্ষার কয়টা দিন মন দিয়ে পড়তে হবে। কাবেরীও গুনগুন করে সারা বিকাল পড়ে গেলো। রাতে আর পড়াশোনা করতে ইচ্ছে নেই।কতদিন হয়ে গেল সে শুভজিৎ এর সঙ্গে খেলতে বাইরে বের হয়নি ,একইসঙ্গে বসে গল্প করেনি। তার আর ভালো লাগছে না পড়াশোনা করতে। কবে যে পড়াশোনা থেকে মুক্তি পাবে এই নিয়ে চিন্তিত সে। স্কুল যেতে,পড়াশোনা করতে,তার ভালো লাগছে না। তার মতে শুভজিৎ সবচেয়ে সুখী মানুষ।তাকে পড়াশোনা করতে হয় না, স্কুল যেতে হয় না, হোমওয়ার্ক করতে হয় না,স্যারদের কাছ থেকে মার খেতে হয় না, সারাদিন বাড়িতে থাকে। কত ভালো। তারও যদি এমন হতো তাহলে মন্দ হতো না। সারাদিন খেলতো আর ঘুরতো। আগামীকাল ইংরেজি পরীক্ষা। ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। কম নম্বর পেলে রক্ষে নেই। রেজাল্ট বেরোনোর পর তানভীর স্যার ধরবে। তার খুব ভালোভাবে মনে আছে।একবার তার এক সিনিয়র দাদা ফাইনাল এক্সামে ইংলিশে কম নাম্বার পেয়ে ফেল করে। ফেল করে যাওয়ার জন্য সে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তানভীর স্যারের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। স্যার ওর বাড়িতে গিয়ে উঠে এবং কম নাম্বার পাওয়ার কারণ জানতে চায়। পুরো গ্রামবাসী সেদিন অবাক হয়ে ছিল।ছেলেটি পড়া বন্ধ করে দিয়েছে অথচ সে কম নাম্বার কেন পেয়েছে তার কৈফিয়ত নিতে স্যার বাড়িতে এসেছে! অনেকে স্যারকে দেখে হাসাহাসি করেছিল। আবার অনেকে স্যারের তারিফ করেছিল। তানভীর স্যার যে নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের সন্তানদের মতো ভাববেন, সেদিন তারই প্রমাণ দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি অনেকের চোখে খারাপও হয়ে যান। অতিরিক্ত কোনো জিনিস ভালো নয়,আর সেই অতিরিক্ত জিনিসই পছন্দ করেন তানভীর স্যার। ওই ছেলের বাবাকে অনেক বুঝিয়ে ছেলেকে আবার স্কুলে পাঠায়। ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করে। যদিও ছেলেটি বেশি দিন স্কুলে যায়নি।অর্ধেক দিন যেতেই পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়।আবার সহকর্মীদের কাছে হাসির শিকার হয় তানভীর স্যার। তানভীর স্যার নাকি সবার কাছে ভালো মানুষ হতে চান। তিনি সবার সিমপ্যাথি পেতে চান। সেজন্য ছেলেটিকে স্কুলে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়েছিলেন। ছেলের পরিবারসহ গ্রামবাসীর প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিলেন।কিন্তু শেষপর্যন্ত পারলেন না। যদিও এগুলোকে কোনটাই পাত্তা দেননি তিনি। তিনি সব সময় নিজের মতো করে থেকেছেন।উনার ভালো কাজ,খারাপ কাজ একমাত্র আল্লাহ বিচার করবেন। তিনি সবসময় নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন। কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতে ছাড়েননি। তিনি যেমন নিজের ধর্মকে বিশ্বাস করেন তেমনি অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করেন। এক কথায় তিনি মনে করেন,ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস থাকা উচিত কিন্তু গোঁড়ামি নয়।
বিভিন্ন কারণে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রতিদিন উপস্থিত হতে পারেন না।আবার প্রত্যেকদিন পড়াতে মনও চায় না। ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দেন। কিন্তু এর পুরো ব্যতিক্রম তানভীর স্যার। তিনি বিশেষ কোনো কারন ছাড়া স্কুল বন্ধ করেন না এবং নিয়মিত পড়ান। তবুও উনার সিলেবাস কখনও কমপ্লিট হয় না। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা যেখানে পরীক্ষার অনেক আগে সিলেবাস কমপ্লিট করে ফেলেছেন। সেখানেও তিনি ব্যতিক্রম। তিনি সবজায়গায় ব্যতিক্রম থাকেন। তিনি মনে করেন, তিনি যেটুকু পড়িয়েছেন সেটাই অনেক। সিলেবাস কমপ্লিট না হওয়া, কিশলয় একবার প্রশ্ন করেছিল, তিনি কেন প্রত্যেক বছর পুরো সিলেবাস কমপ্লিট করতে পারেন না? এতে তো ছাত্র-ছাত্রীদের ভীষণ অসুবিধা হয়। তানভীর স্যার হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, কোনো একটা নির্দিষ্ট রাস্তা না চেনা মানুষকে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত গাড়ি চালাতে শুরু করলাম, এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম।তারপর পেছনে বসে থাকা মানুষটিকে যদি আবার ওই রাস্তায় একা ফিরে আসতে বলা হয়। তাহলে সে কি একা ফিরে আসতে পারবে? তা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ তাকে দ্রুত রাস্তা পার করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু রাস্তা চেনানো হয়নি। কিন্তু গাড়ি খুব হালকা চালিয়ে যদি মানুষটিকে রাস্তা চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে মানুষটি অনায়াসে একা ফিরে আসতে পারবে। পড়াশোনাও ঠিক একই রকম। দ্রুত পড়ালে বই দ্রুত শেষ হয়ে যাবে,কিন্তু বইয়ের মধ্যে কি আছে তা কখনো ছাত্র-ছাত্রীরা জানতে পারবে না।
গ্রামের বেশিরভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি থাকে না। আজকে আবার সন্ধ্যে থেকে নেই। সেই কখন গেছে এখনো আসার নাম নেই। কাবেরী হ্যারিকেনের আলো জ্বালিয়ে পড়াশোনা করছে। শুভজিৎ কে সেখানে আসতে দেয়নি পায়েল দেবী। শুভজিৎ ওখানে থাকলে কাবেরী কিছুতেই পড়বে না। বৃহস্পতিবার,হিন্দু ধর্মে বহুকাল ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে অগ্রহায়ন আর পৌষ মাসে বৃহস্পতিবার রাতে নাকি ভাত রান্না করতে নেই। ওই দিন পিঠা বানাতে হয়। শহরাঞ্চলে তেমনটা না মানলেও, গ্রামাঞ্চলে বেশ প্রচলিত আছে। তারা বেশ আনন্দের সাথে এই রীতি পালন করেন। তাই পায়েল দেবী আজ পিঠে বানাচ্ছেন। শুভজিৎ পাশে বসে পিঠে বানানো দেখছে। মাঝে মাঝে সাহায্য করছে। পিঠে হতেই, তিনি প্রথমে বাটি নিয়ে শুভজিৎ কে খেতে দিলেন। শুভজিৎ একটা পিঠে খেতেই মনে পড়ল কাবেরীর কথা। কাবেরী কতক্ষণ থেকে পড়তে বসেছে, কিছু খায়নি। তার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেলে। নিজের রুমে যাবে বলে শুভজিৎ কাবেরী রুমে আসলো। হ্যারিকেনের আলো জ্বালিয়ে পড়ছে কাবেরী। শুভজিৎ কে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। খুব তাড়াতাড়ি বলল,’মা কি বলল যে আর আমাকে আর পড়তে হবে না?’
শুভজিৎ মুচকি হাসলো। তারপর কাবেরীর কাছে গিয়ে চুপ করে বসলো।তাকে কথা বলতে বারণ করল। কোনোভাবে মা জানতে পারলে দু’জনকেই মারবে।সে লুকিয়ে লুকিয়ে তার জন্য পিঠে নিয়ে এনেছে। কাবেরীর আনন্দে চোখে জল চলে আসলো। ছোট্ট ছেলেটি পড়াশোনা না করেও কত কিছু বোঝে, অথচ সে পড়াশোনা করেও অনেক কিছু বোঝে না। সে আরাম করে দুটো পিঠে খেলো। পিঠে শেষ হতেই শুভজিৎ আবার পিঠে আনতে গেল। কাবেরী বলল, মা যেন কিছুতেই জানতে না পারে সে পিঠে চাইছে। শুভজিৎ একটা মুচকি হেসে তাকে আশ্বস্ত করল। শুভজিৎ আবার গিয়ে পিঠে নিয়ে আসলো। আবার দুজন মিলে খেলো। এমনটা বেশ কয়েকবার হওয়ার পর পায়েল দেবী একটু ভাবতে লাগলেন। এতগুলো পিঠে শুভজিৎ একা খাচ্ছে? তা কি করে সম্ভব হতে পারে? আবার একবার শুভজিৎ পিঠে আনতে আসতেই,পায়েল দেবী বললেন,’সত্যি করে বলতো এতগুলো পিঠে কি করছিস?’
শুভজিৎ একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর শান্ত মাথায় বলল,’পিঠে তো আমি একা খাচ্ছি। এখন যে পিঠে নিয়ে যাচ্ছি এগুলো রেখে দেব, রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে খাবো। ঘুমানোর সময় একা একা পিঠে খেতে খুব মজা লাগে।’
‘সত্যি তো।’
‘হ্যাঁ সত্যি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, নিয়ে রেখে দে।’
শুভজিৎ পিঠে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখনই পায়েল দেবী আবার বললেন,’আর পিঠে নিবি?’
‘আর দুটো নেব।’ তিনি হাসিমুখে আরও দুটো পিঠে শুভজিৎ এর বাটিতে দিলেন। শুভজিৎ আনন্দে গদগদ করতে থাকলো। মাঝেমধ্যে এই মানুষটির উপর রাগ হয়। আবার মাঝে মাঝে এই মানুষটির উপর ভালোবাসা ফুটে ওঠে। কেন এমন হয় সে জানে না।শুভজিৎ অনুভব করে পায়েল দেবী তাকে ভীষন ভালবাসেন। আগলে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সবার সামনে তা দেখাতে চান না। মনে মনে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসেন। এমনটা তিনি কেন করে তা সত্যি জানা নেই শুভজিৎ এর। সে এক ছুটে কাবেরী রুমে চলে এলো। তারপর দুইজন মিলে পিঠে খেতে থাকলো। দুজন মাকে বোকা বানিয়ে খুব হাসছে। এইভাবে মাকে যে কতবার বোকা বানিয়েছে তার হিসাব নেই।
কিছুক্ষণ আগে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। স্কুলের বাইরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শুভজিৎ। রোদ শরীরকে বেশ আরাম দিচ্ছে। মাঝে মাঝে উত্তরা হওয়া কানে আঘাত আনছে। তবে তার পরিমাণ নিতান্তই কম। পায়েল দেবী বলে দিয়েছেন পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বাইরে থাকতে। আজ বাড়ি আসার দরকার নেই। পরীক্ষা শেষ হলে দুজন একই সঙ্গে বাড়ি ফিরবে। প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শুভজিৎ এ-দিক ও-দিক বারবার চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। কোথায় কে কি বলছে সব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। দূর দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখছে। কেউ স্কুলের মধ্যে প্রবেশ করছে আবার কেউ বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় শুভজিৎ লক্ষ করল একজন বেশ লম্বা-চওড়া মানুষ স্কুল থেকে বেরিয়ে আসছে। তাকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। এর আগে দু’বার ওই মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মানুষটি নাকি ভীষণ রাগী। তানভীর স্যারের কথা কাবেরীর মুখ থেকে অনেক শুনেছে। অন্যান্য স্টুডেন্টের মতো শুভজিৎ উনাকে ভয় পেলো না। স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তানভীর স্যার বেরিয়ে যাবেন,আর পাসে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে অথচ ভয় পাবে না,তা কি হতে পারে?তিনি তার সঙ্গে ঠিক কথা বলবেন।শুভজিৎ কে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গেলেন। খুব নরম গলায় বললেন,’এখানে কি করছিস?’শুভজিৎ প্রসন্ন একটা হাসি দিয়ে বলল,’আমি কাবেরীর জন্য অপেক্ষা করে আছি। তার পরীক্ষা শেষ হলে একই সঙ্গে বাড়ি ফিরব।’
‘কিন্তু এ তো ব্যাড হ্যাবিট,বাবু! সে তিন ঘণ্টা ধরে এক্সাম দেবে আর তুই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি! বাড়ি ফিরে যা, পরীক্ষা শেষ হলে আসবি।’
‘তা হতে পারে না। মালিক আমাকে ভীষণ বকবেন। উনার কথা অমান্য করার ক্ষমতা আমার নেই।’ তানভীর স্যার নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটির সাহস আছে মানতে হবে। প্রথম কথা বলছে আবার চোখে চোখ রেখে। বেশ ভালো লাগলো। ছেলেটির কথা শুনে খুশি হলেন তানভীর স্যার। কিন্তু ভাবতে থাকলেন, ছেলেটি তাকে ভয় পাচ্ছে না কেন? আবার অন্যভাবে ভাবলেন তাকে ভয় পাওয়ার কি আছে? উনাকে ছাত্রছাত্রীরা এত ভয় কেন পায়, তিনি জানেন না। প্রথম কোনো ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে ভর্তি হলে, তাকে প্রথমে তার সিনিয়ররা জানিয়ে দেয় স্কুলে তানভীর স্যার বলে একজন ভয়ানক শিক্ষক রয়েছেন।সেখান থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে ভয়ের জন্ম হয়। একবারের জন্যও কেউ খোঁজ নেয় না, আসলে কি তানভীর স্যার ভয়ানক মানুষ? না তিনিও আর চারজন শিক্ষকের মতো একজন! এতে উনার তো কোনো দোষ নেই। তিনি খুশি হয়ে বললেন,’তুই আমার বাড়িতে চল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এক্সাম শেষ হলে আবার চলে আসবি।’
‘আপনার বাড়ি তো অনেক দূর। সেখান থেকে আমি একা কী করে আসবো?’
‘সেকেন্ড হাফে আমার মেয়ের পরীক্ষা রয়েছে। তার সঙ্গে চলে আসবি।’
শুভজিৎ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তারপর স্যারের হাত ধরে এগোতে লাগলো। তিনি সাইকেলের লক খুলে সাইকেলে চেপে বসলেন আর পেছনে শুভজিৎ বসলো। পুরনো সাইকেলের একটা বিকট শব্দ ছাড়া আর তেমন কোনো শব্দ হলো না। বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা। নীরবতা কাটানোর জন্য শুভজিৎ বলল,’আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনি স্কুল থেকে চলে যাচ্ছেন কেন? স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা অন্যায়। আর স্কুল থেকে পালিয়ে যাওয়া বুঝি অন্যায় নয়?’ তিনি ঝাটকা খেলেন। সাইকেল থামালেন। শুভজিৎ এর প্রথম কথাটি বারবার মনে আঘাত আনলো। ‘মাস্টারমশাই!’ ‘মাস্টারমশাই!’ এতদিন শিক্ষকতা করলেন কিন্তু কখনো কোনো ছাত্র ছাত্রী উনাকে মাস্টারমশাই বলে সম্বোধন করেনি। সবাই আধুনিক জীবনে আধুনিক ভাষা প্রয়োগ করে। সবাই উনাকে ‘স্যার’ বলে ডাকে। এতে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও প্রকাশ করতে পারেন না।অন্যান্য শিক্ষক কি চায় তা তানভীর স্যার জানেন না। তবে তানভীর স্যার মনে করে, একজন শিক্ষকের সর্বোচ্চ সম্মান হলো, উনাকে ‘মাস্টারমশাই’ বলে সম্বোধন করা।একজন শিক্ষকের সারা জীবনের পরিশ্রম এই একটি শব্দের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায়। উনি চাইছেন তাঁর পরিচয় তানভীর আলম নয়,কিংবা গ্রামের শিক্ষক নয়, তার পরিচয় হোক ‘মাস্টারমশাই’ বলে। তাঁকে সবাই ‘মাস্টারমশাই’ বলে সম্বোধন করুক। ‘মাস্টারমশাই’ এই একটা শব্দের মধ্যে কত শাসন,কত অজানা অনুভূতি, কত ভালোবাসা, কত পুরনো স্মৃতি জড়িয়ে থাকে তা কল্পনায়ও শেষ করা যাবে না। কিন্তু আজকাল ছেলে মেয়েদের এই শব্দটি তাদের কাছে বিরক্তিকর। আধুনিক যুগে আধুনিক শব্দ প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত। তাইতো তানভীর স্যার এক সময় এই ডাকটি কারোর কাছে থেকে শুনবেন বলে প্রত্যাশা করতে পারেননি। চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠল। শুভজিৎ লক্ষ্য করল স্যারের চোখে জল। সে কি কিছু ভুল করল? সবকিছু তো ঠিকঠাক ছিল। শুভজিৎ আর পূর্বের কথা স্যারের কাছে তুললো না। সে স্যারের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,’মাস্টারমশাই আপনি কাঁদছেন?’
তিনি কি বলবে কিছু বুঝতে পারলেন না। শুভজিৎ কে জড়িয়ে ধরলেন। পিঠে হাত চাপড়িয়ে দুফোঁটা চোখের জল ফেললেন। আদরে ভরিয়ে দিলেন। গালে কপালে বারবার চুম্বন করতে থাকলেন। হঠাৎ করে স্যারের এমন আচরনে অবাক হল শুভজিৎ। ভীষণ ভালো লাগছে তার। তিনি যেন তাঁর বাবা, ছেলেকে স্নেহ আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন। স্যারের আসল রূপ শুভজিৎ ধরে ফেললো। আসলে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা যেমন শাসন করে তেমনিই ভালোবাসেন। তানভীর স্যার কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। তিনিও ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন ভালোবাসেন তেমন শাসনও করেন। কিন্তু ভালবাসাটা সব সময় আড়ালে রাখেন। কখনো প্রকাশ করেননি। নিজের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী কেউই এই আড়ালে থাকা ভালোবাসাকে ধরতে পারেনি। কিন্তু আজ শুভজিৎ সেই ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়ে গেছে। সে বুঝতে পেরে গেছে, স্যার যতটা শাসন করতে পারেন, ঠিক ততটা ভালবাসতেও পারেন। আসলে তিনি নারকেলের মতো। নারকেলের বাইরে শক্ত আবরণ থাকলেও ভেতরে তৃষ্ণার্ত জল থাকে। যে জল একজন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে নতুন প্রাণ দেয়। তানভীর স্যারের বাইরে শক্ত আবরণ থাকলেও, ভেতরে একটি শান্ত উজ্জ্বল মখমলে আবেগ আছে। সেই আবেগকে কেউ কোনোদিন খুঁজে বার করতে পারেনি। আজ শুভজিৎ পেরেছে। তাইতো তিনি আজ আনন্দে কেঁদে উঠেছেন। এত শক্ত মানুষটি ভেঙ্গে পড়েছেন। এই বিশ্বে মানুষ জাতি বড্ড অদ্ভুত! কোনো মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর কাটিয়ে ফেলার পরেও সেই মানুষটিকে চিনতে পারে না। আবার কোনো মানুষ কোনো মানুষের সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিট থেকে ওই মানুষটির অনেক কিছু জানতে পেরে যায়।
অনেকক্ষণ পর তারা আবার সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে লাগলো। ভীষন খুশী হয়েছেন তিনি। তিনি শুভজিৎ এর সঙ্গে বেশ খোলা মনে কথা বললেন।
‘মাস্টারমশাই, আপনি কখনো শহরে গেছেন?’
‘অনেকবার।’
‘আচ্ছা মাস্টারমশাই, শহরে গেলে সমস্ত স্বপ্ন সত্যি হয়, তাই না!’
‘কে বলেছে এসব কথা? গ্রামে থেকেও সমস্ত স্বপ্ন সত্যি করা যায়?’
‘কিভাবে?’
‘স্বপ্ন পূরণ করার জন্য দুটো জিনিস খুবই প্রয়োজন। একটা হচ্ছে প্রচুর পরিশ্রম আর অন্যটি হচ্ছে মনের জোর।’
‘প্রচুর পরিশ্রম করলে এবং মনের জোর থাকলেই কি স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়?’
‘ না, অনেক সময় প্রচুর পরিশ্রম করলেও স্বপ্ন পূরণ হয় না, কিন্তু মনের তৃপ্তি পাওয়া যায়। এই তৃপ্তিও স্বপ্নপূরণের মতো। এক কথায় বলতে গেলে নগদ স্বপ্ন পূরণ।’
আসলে, মানুষের জীবনে সমস্ত পরিশ্রম সাফল্য এনে দেয় না। কিছু কিছু পরিশ্রম মনের তৃপ্তি এনে দেয়। এটাও এক প্রকার সাফল্য। যাকে বলে নগদ পাওনা।
তানভীর স্যার শুভজিৎ কে বাড়ি নিয়ে গিয়ে, মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইয়াসমিন শুভজিৎ কে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। বাড়িতে থাকা বিভিন্ন রকমের খাবার নিয়ে এসে তাকে দিল। শুভজিৎ এর চোখ যায়, ইয়াসমিনের ড্রইং খাতা আর রং পেন্সিলের উপর।সে সেগুলো নেবে বলে আবদার করতে থাকে ইয়াসমিনের কাছে। ইয়াসমিন ভীষণ অবাক হয়। প্রথম দিন পরিচয়ে অন্যের কাছে কিছু চাওয়া ব্যাড হ্যাবিট। আর শুভজিৎ কোনো দ্বিধা ছাড়াই চাইল। প্রথমে খারাপ ভাবলেও পরের স্বাভাবিক নিল। বাচ্চা ছেলে এগুলো কখনো দেখেনি। দেখলেও হাতে নেওয়ার ভাগ্য হয়নি।তাই এইসব জিনিসের প্রতি তার আগ্রহ ভীষণ। সে শুভজিৎ এর কথাগুলোকে স্বাভাবিক নিল। তাই প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ছাড়া, যা চাইলো তা দিয়ে দিল। পরীক্ষার কথা ভুলে সে তার সঙ্গে খেলতে শুরু করলো। খুব মিষ্টি একটা ছেলে। আব্বুর কাছে আবদার করতে থাকে, শুভজিৎ কে তাদের বাড়িতে রাখলে অসুবিধা কোথায়? বরং সে আরও অনেক সুখে থাকবে। পড়াশোনা করতে পারবে। সমাজের চারটা মানুষের মতো একটা মানুষ হয়ে বাঁচতে পারবে। কল্পনা করা তো সহজ। কিন্তু তাকে বাস্তবায়িত করা মোটেও সহজ নয়। ইয়াসমিন অনেক ছোট। সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু স্যার জানেন বাস্তবতা কতটা কঠিন!
চলবে