মাস্টারমশাই পর্ব ১৪

0
285

মাস্টারমশাই
পর্ব ১৪
শুভজিৎ জানা
_____________
কাবেরী আর মাস্টারমশাই অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের মধ্যে কথা চালিয়ে গেল। কাবেরীর পনেরো বছরের শহরের অভিজ্ঞতা আর মাস্টারমশাইয়ের বিধাতার করুন পরিনতির গল্প একে অপরকে শোনালো। কাবেরী কথার ফাঁকে ফাঁকে জানতে পারে, মাস্টারমশাই আজ থেকে দশ বছর আগে স্কুল থেকে রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন। কিন্তু কেন হয়েছেন তা জানতে পারল না। মাস্টারমশাই তার সম্বন্ধে কিছুই বললেন না। বারবার কথা এড়িয়ে গেলেন। কাবেরী জোর করল না। ভাবতে থাকলো। তার খুব স্পষ্ট ভাবে মনে আছে সে যখন গ্রাম থেকে চলে যায়, তখন মাস্টারমশাইয়ের বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে ছিল। এখন মাষ্টারমশাইয়ের বয়স নিশ্চয়ই ষাটের মধ্যে থাকবে। তাহলে তিনি কি করে দশ বছরের আগে রিটায়ার্ড হলেন?সে-ই হিসাব অনুযায়ী মাস্টারমশাইয়ের এখনো চাকরি করার কথা।কাবেরীর সবকিছু গুলিয়ে যেতে লাগলো। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। একের পর এক প্রশ্ন তার সামনে দাঁড় হচ্ছে। অথচ কোনো উত্তর নেই। গ্রামে এসেছিল বাড়ি বিক্রি করতে। এখন সে প্রশ্নের জালে জড়িয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে এত কিছুর মধ্যে সে-ও যেন কোথাও জড়িয়ে আছে। কাবেরী আরও ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীর কথা। আমিনা কোথায়? দুপুর থেকে তাদের বাড়িতে আছে। অথচ একবারও আমিনাকে দেখতে পায়নি। দুপুরের খাবারও খেলেন না। কাবেরী আর দেরি না করে প্রশ্ন করল মাস্টারমশাইকে। মাস্টারমশাই টুকটাক কথা বলছিলেন। আমিনার কথা উঠতেই তিনি পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলেন। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। চোখের রং গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তিনি অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি আরও কিছু হারাতে চলেছেন। শেষ বয়সে এসেও একের পর এক দামি জিনিস হারিয়ে ফেলেছেন। এক সময় তিনি নিজের জন্য নিজেই আইন তৈরি করেছিলেন। আজ সেই আইন তাঁকেই প্রশ্ন করে, আইন সঠিক ছিল তো? নিজের আইন দিয়ে তিনি সকলের বিচার করেছেন। এবার সে-ই আইন দিয়ে নিজেকে বিচার করতে হবে। তিনি পারবেন তো নিজের আইন দিয়ে নিজের বিচার করতে?মাস্টারমশাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর আস্তে আস্তে করে বলতে শুরু করলেন কাবেরীর চলে যাওয়ার পরের ঘটনা……।

২।
গ্রামে কত মানুষ আসে,কত মানুষ চলে যায়। তার খবর আদৌ কি কেউ রাখে? রাখলেও খুব অল্প দিনের জন্য।নিলেশ বাবুদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। তাদের চলে যাওয়ার পর পুরুষদের চায়ের আড্ডা আর মহিলাদের কলের গোড়ায় কয়েকদিনের জন্য আলোচনা চলল। অনেকেই কানাঘুষো করতে রইল, শুভজিৎ কে খুন করা হয়েছে।সেই‌ খুন মন্ডল বাড়িরই কেউ করেছে। হত্যা চাপা দেওয়ার জন্য তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলো। কিন্তু কেউ সাহস করে সবার সামনে প্রকাশ করতে পারেনি।তাই গ্রামবাসীদের মনেও শুভজিৎ এর মৃত্যু চাপা পড়ে যায়। তারপর সময় যত গড়তে থাকে তাদের নিয়ে আলোচনাও তত অল্প হয়ে ওঠে।
শুভজিৎ এর মৃত্যুর খবর শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন আমিনা। ছেলেটাকে কখনো দেখেননি। পরে জানতে পারেন তাদের বাড়িতে একদিন এসেছিল সে। রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় সেদিন তাকে দেখা হয়নি। তবুও অজান্তেই কেঁদে ফেলেছিলেন। বিধাতা এত নিষ্ঠুর কেন তিনি তা জানেন না।ছোট্ট ছেলেটির প্রাণ নেওয়া কি ভীষণ দরকার ছিল? ইয়াসমিনও কষ্ট পেয়েছিল ভীষণ। সে বারবার বিধাতাকে প্রশ্ন করেছিল, যদি তাকে কেড়ে নেওয়ার কথা ছিল, তাহলে তাকে কেন পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল? কেনই বা মাত্র একদিনের জন্য তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে ছিল? তার বুক হাহাকার করে উঠে। সামান্য কয়েক ঘন্টায় আপন করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল শুভজিৎ এর মধ্যে। সে তা করে দেখিয়েও ছিল।ছেলেটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল ইয়াসমিন। তাকে তাদের বাড়িতে রাখার কথা ভেবেছিল।কিন্তু এমন ভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে তা জানতো না। কিন্তু কি করা যায়? ভাগ্যের কাছে সবাই অসহায়।সে যখন জানতে পারলো শুভজিৎ আত্মহত্যা করেছে। সে আরও বেশি ভেঙে পড়ে। মন খারাপ হয়ে যায়। আবার তার মনে শুভজিৎ এর প্রতি একটা ঘৃণা চলে আসে। আত্মহত্যার মতো একটা পাপ কাজ সে কি করে করলো?যে নিজেকে কখনো ভালবাসতে পারেনি, তাকে তো অন্য কেউ ভালবাসতে পারবে না,স্বাভাবিক! তাই ইয়াসমিন খুব তাড়াতাড়ি তার মন থেকে শুভজিৎ কে মুছে ফেলে।
সামান্য বেলা হতেই তানভীর স্যার মাহবুবকে তৈরি হতে বলেন। হঠাৎ করে তাকে তৈরি হতে বলল কেন বুঝতে পারল না। তবে মনে মনে ভীষণ আনন্দ অনুভব করল। আব্বু নিশ্চয়ই কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবেন। মাঝেমধ্যে আব্বু এমন করেন। হঠাৎ করেই সারপ্রাইজ দেন। এই জিনিষটা বেশ ভালো লাগে তার। সে দ্রুত নতুন জামা পরে তৈরি হয়ে নিল।বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় লক্ষ্য করলো, ইয়াসমিন দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ইয়াসমিনকে হাসতে দেখে মাহবুব তার মাথায় আলতো করে চড় মারল।
‘হাসছিস কেন?’
‘এমনি।’
‘এমনি এমনি কেউ হাসে? পাগল না কি?বুঝেছি, আব্বু আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে তোকে নিয়ে যাচ্ছে না ওই জন্য হাসছিস?’
‘তুই যা দিলে বুঝতে পারবি। আব্বু তোকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে….’ইয়াসমিন মুখে ভেংচি কেটে বলল।
ইয়াসমিনের মাথায় আবার একটা চড় মেরে মাহবুব নাচতে নাচতে বাড়ির বাইরে আসলো। বাড়ির উঠোনে তানভীর স্যার তার সে-ই পুরনো ভাঙ্গা সাইকেলের উপর চড়ে বসলেন। ছেলেকে সাইকেলের পেছনে বসতে বললেন। মাহবুব নিজের সাইকেল আনতে চাইল। তানভীর স্যার বারণ করায় মাহবুব আর নিজের সাইকেল নিল না, সে আব্বুর পেছনে বসলো। তানভীর স্যার আস্তে আস্তে করে সাইকেল চালানো শুরু করলো। মহাবুব পেছনে বসে আছে। কিছুদুর যাওয়ার পর সে পেছনে ঘুরে দেখল, বাড়ির উঠোনে ইয়াসমিন দাঁড়িয়ে হাসছে। বোনের হাসির কারণ বুঝতে পারলো না। তবে অনুমান করতে পারলো আব্বু তাকে কোনো ভালো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে না। তার অপছন্দের কোনো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তানভীর স্যার আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলেন। পেছনে মাহবুব বারবার টলমল করছে। সে এ-দিক ও-দিক দেখার চেষ্টা করছে। তানভীর স্যার হাসিমুখে বললেন,’কি হলো, ভালো করে বস। এভাবে টলমল করলে পড়ে যাবি তো।’
‘আব্বু, আমি ঠিক আছি।’
‘আমাকে ধরে বস। তুই পড়লে তোর আম্মু আমার রক্ষে রাখবে না।’
‘আব্বু, আমি কলেজে পড়ি। আমি বড় হয়েছি…’
মাহবুবের কথা শেষ হতে দিল না,তার আগেই বললেন,’আমি জানি তুই কলেজে পড়িস। কিন্তু বাবার কাছে ছেলে মেয়েরা সব সময় ছোট। বাবার কাছে তারা কখনোই বড়ো হতে পারে না।তোরা একটু আঘাত পেলে তোদের যতটা না ক্ষত সৃষ্টি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষত সৃষ্টি হয় আমাদের বুকে।’
‘আচ্ছা, এবার আমাকে সাইকেল দাও আমি কিছুটা চালাই। তোমার তো কষ্ট হচ্ছে!’
‘এতদিন থেকে আমার কষ্টের দায়িত্ব নিতে হবে না। বৃদ্ধ হলে আমার আর তোর আম্মুর একটু দায়িত্ব নিলেই হবে। তখন তো বুড়ো হয়ে যাব। বাইরে ঘুরতে যেতে পারবো না। তখন আমাদের দায়িত্ব নিবি।এখন নেওয়ার দরকার নেই। সন্তানের কাছে বাবা মা শুধু এটুকুই আশা করে। তারা সন্তানদের কাছ থেকে আর কিছু চায় না।’
‘আমি কথা দিচ্ছি আব্বু, আমি কখনো তোমাদের ছেড়ে যাবো না। তুমি আমাদের যেভাবে ভালোবাসা আর শাসন দিয়ে বড় করেছো, আমিও তোমাদেরকে বৃদ্ধ অবস্থায় শাসন করবো আর ভালোবাসবো। তখন কিন্তু শাসন করলে বাধা দিলে চলবে না।’
বাবা আর ছেলে দুজন মিলে খুব হাসলো। কিন্তু মাহবুব বুঝতে পারলো না আব্বু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদূর আসার পর মাহবুব জানতে চায়, তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? তানভীর স্যার হাসিখুশিতে উত্তর দিলেন। মাহাবুব সকালে চুল কাটার জন্য টাকা চাইছিল। তাই তিনি নিজেই ছেলেকে সেলুনে নিয়ে যাচ্ছেন। একসঙ্গে দুই জন চুল কেটে বাড়ি ফিরবেন। মাহাবুব ভীষণ রেগে গেল। সে বড় হয়েছে। এখনো আব্বুর সঙ্গে সেলুনে আসবে। যখন ছোট ছিল তখন না হয় ঠিক ছিল এখন…..। বন্ধুদের সঙ্গে আসবে ভেবেছিল। বন্ধুরা দেখলে কি যে ভাববে….এত বড় ছেলে নিজের দায়িত্ব এখনো নিতে পারে না। আব্বুর সঙ্গে চুল কাটতে যায়। তিনি আবার বাচ্চা ছেলেদের মতো চুল কাটতে বলবেন। উনার আধুনিক চুলের ছাঁট একদমই পছন্দ নয়।তার মান সম্মান সব মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে আব্বু। কিন্তু তানভীর স্যার ছেলেকে সব বুঝিয়ে বলেন। বন্ধুদের ওপর সব সময় নির্ভর হতে নেই। তারা আজ আছে কাল নেই। বন্ধুরা কি বলল, তাতে কি আসে যায়।নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচবো। অন্যের জন্য কেন পরিবর্তন হব? এক জীবনে শত শত বন্ধু থাকে, কিন্তু একটা কঠিন পরিস্থিতিতে একটা বন্ধুও পাওয়া যায় না। কঠিন পরিস্থিতিতে দুচোখ মেলে দেখলে, কেবল একজন পুরুষ আর একজন মহিলাকে দেখতে পাওয়া যায়। তাদের যতই ঘৃণা করো, তাদের যতই অবহেলা করো। তারা কিন্তু কঠিন পরিস্থিতির সময় ঠিক থাকবে। তাদেরকে না চাইলেও থাকবে,আর তারাই হলো প্রকৃত বন্ধু। তারাই হলো বাবা-মা। আব্বুর কথা শুনে মাহবুব আশ্বস্ত হল। আব্বুর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। দুটো হাত মুঠো করে আব্বুর পেট জড়িয়ে ধরল। আরও কাছে যেতে চাইলো আব্বুর।

‘বাবা আজ মাংস আনবে? কতদিন হল মাংস আনোনি।কয়েকদিন আগেই পঁচিশে ডিসেম্বর, পয়লা জানুয়ারি গেল। গ্রামে সবার বাড়িতে মাংস হলো। আর আমরা পেঁপে সেদ্ধ আলু সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেলাম।’
কমলাকান্ত বাবু ব্যাগ নিয়ে বাজারে বের হচ্ছিলেন। হঠাৎ-ই কিশলয়ের মুখে এমন কথা শুনে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তিনি ঘুরে দেখলেন ছেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে এমন আবদার করে কিশলয়। কিন্তু কমলাকান্ত বাবু নিজের দারিদ্রতা কাটিয়ে ছেলের অর্ধেক আবদারও পূরণ করতে পারেন না। ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলেন।কিশলয় আস্তে করে চোখ তুলে বাবাকে দেখলো। বাবার চোখে রাগ নেই কিন্তু নিজেকে অপরাধী মনে করছেন। নিজের বিবেকে আঘাত পেয়েছেন। কিশলয়ের খুব খারাপ লাগলো। সে নিজেও জানে তাদের দারিদ্রতার কথা।বাবা কোথা থেকে টাকা পাবেন? তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বোঝা উচিত ছিল। সে বাবার কাছে এগিয়ে গেল। তারপর হাসিমুখে বলল,’আমার চাই না মাংস। তুমি তোমার টাকার মতো সবজি আনলেই হবে।’ ছেলের কান্ড কারখানা দেখে কমলাকান্ত বাবুর হাসি পেল। কিন্তু মুখ ফুটে হাসি বের হলো না। তিনি খুব কষ্টে চোখের জল লুকিয়ে ফেললেন। ছেলের মাথায় হাত বোলিয়ে বললেন,’আজ আমার কাছে বেশ কয়েকটা টাকা আছে। আমি মাংসই আনব।’
কিশলয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। প্রফুল্ল চোখে বাবাকে বারবার দেখতে লাগলো। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষ। একগাল হেসে বলল,’আমি দিদিকে বলে আসি, তুমি আজ মাংস আনবে। রান্না করতে সময় লাগবে তো।’
কমলাকান্ত বাবু মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন। কিশলয় ছুটে দিদির কাছে গেল,আর কমলাকান্ত বাবু হাসতে হাসতে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
কমলাকান্ত পুরো নাম কমলাকান্ত দাস। খুব দরিদ্র পরিবারে জন্ম। ধনসম্পত্তি বলতে এক বিঘে জমি রয়েছে। সেই জমির উপরে চাষবাস করে দিন যাপন করে। উপরি কাজ বলতে তিনি ঘটকালী করেন। ঘটকালী করে যেটুকু টাকা রোজগার করেন তাতেই সংসার চলে।জমি থেকে উপার্জন করা টাকা লোন শোধ করতেই চলে যায়। বাজারে তার ধার দেনা প্রচুর আছে। এত ধারদেনা প্রথম থেকে ছিল না। কিশলয়ের জন্মের পর থেকে হয়েছে। কিশলয়কে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা চলে যায় পৃথিবীর ছেড়ে। ডাক্তার প্রথম থেকেই বলে দিয়েছিল মা-ছেলে দু’জনকেই বাঁচানো যাবে না। কমলাকান্ত বাবু অনেক চেষ্টা করেছিলেন দুজনকে বাঁচানোর জন্য। অনেক ধারদেনা করে টাকা জমিয়েছিলেন চিকিৎসা করার জন্য। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। ছেলেকে বাঁচাতে পারলেও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। সেদিন থেকেই তাদের বাজারে লোন বেড়েই চলেছে। কিশলয় যখন জন্মায় তখন শিউলির বয়স ছিল এগারো বছর। তখন সে ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট। জন্ম-মৃত্যু এ সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। ছোট ভাইকে দেখে বড্ড খুশি হয়।কিন্তু মাতৃহারা শিশু কিছুতেই দিদির কাছে থাকতে চাইলো না। সব সময় কান্না করতো। কান্না থামানোর কোনো উপায় জানা ছিল না শিউলির।প্রথম কয়েক বছর কমলাকান্ত বাবু ছেলেকে বড্ড আদর যত্ন করেন। কিন্তু পরে তা কমতে থাকে।কিছুতেই কমলাকান্ত বাবু নিজের লোন শোধ করে উঠতে পারেন না। পাওনাদাররা তাদের প্রাপ্য টাকা পাওয়ার জন্য বারবার বাড়িতে আসতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে থাকা বন্ধ করে দেন। সারাদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন আর রাতে ফিরতেন। বাড়িতে শিউলি একা থাকতো। পাওনাদাররা মেয়েকে কিছু বলার সুযোগ পেত না। তবুও অনেকে অনেক কটু কথা শুনিয়ে যেত। শিউলির এ সব অভ্যাস হতে শুরু করে। তাদের কথা গায়ে ঘেঁষতে দিতো না। একসময় শিউলি নিজের পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। স্টুডেন্ট হিসেবেও সে তেমনটা ভালো ছিল না। বাড়িতে দুটো গরু ছিল। তাদেরও দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে শিউলির ওপর। বাবা রাতে বাজার করে দিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় পেঁপে সেদ্ধ,আলু সেদ্ধ, শাকসবজি সেদ্ধ খেয়ে বড় হয়। নিজের সুখ শান্তি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দেয় শিউলি। আস্তে আস্তে করে নিজের ভাইকেও বড় করে তোলে। দুটো গরু থেকে হয় পাঁচটা। বলতে গেলে, পরিবারের পুরো হাল নিজেই ধরে নেয়। ভাইয়ের মাতৃত্ব পূরণ করে। কিন্তু শিউলির পুরো বিপরীত কিশলয়। দারুন মেধাবী ছেলে। খুব অল্প সময়ে কঠিন কঠিন বিষয় আয়ত্ত করার ক্ষমতা তার মধ্যে জন্ম নেয়। ছেলের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয় বাবা। সে-ই ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে কিশলয়। লেখালেখি তার ভীষণ প্রিয়। দিদির সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কাটায়। দিদি কাজ করতে থাকলে তার পাশে গিয়ে বসে। কিন্তু শিউলি ভাইকে কোনো কাজ করতে দেয় না।মাঝেমধ্যে কিশলয় কাজ করলে কমলাকান্ত বাবু অদ্ভুতভাবে মেয়ের উপর রাগ করেন। ছেলে কোনো কাজ করুক, -তিনি চান না। তাঁর ছেলে পড়াশোনা করবে। বড় অফিসার হবে।ছেলের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কাজে লাগাতে চান কমলাকান্ত বাবু। যথাসাধ্য চেষ্টা করেন ছেলের সব আবদার পূরণ করার। ছেলের জন্য নতুন নতুন বই খাতা আনতে শুরু করেন। ছেলেও বাবার যোগ্য পরিশ্রমের মর্যাদা দেয়।সব সময় স্কুলে প্রথম হতে শুরু করে।গ্রামের মানুষের প্রশংসা অর্জন করে।কমলাকান্তবাবু গর্ববোধ করেন নিজের ছেলের জন্য। তিনি আরও বেশি পরিশ্রম করতে শুরু করেন। কিশলয়ের বড় হয়ে ওঠা, ছোট থেকে মেধাবী হওয়ার কারণে যে মানুষটি রয়েছে,তার প্রশংসা স্বীকার করতে রাজি নয় কমলাকান্ত বাবু। তিনি সবসময়ই ছেলের প্রশংসা করেন।ছেলের পাশাপাশি তাঁর যে একটা মেয়ে রয়েছে, তা যেন তিনি ভুলে গেলেন। শিউলিও এক অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী। কখনও মুখ ফুটে নিজের অধিকার চায়নি।আজীবন অন্যের সেবা করে নিজের জীবন কাটাতে লাগলো। অন্যের খুশিতে নিজে খুশি অনুভব করল। পরিস্থিতির কাছে নিজের ভালোলাগা বিসর্জন দিল। সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে শিউলি। প্রথমে পাঁচটা গরু বের করে দুধ দোয়া শেষ করে, তারপর তাদের মাঠে নিয়ে যায়। তাদের বাঁধার পর গোয়াল পরিষ্কার করে। ততক্ষণে বাবা আর ভাই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তাদের জন্য কখনো শরবত কখনো বা মসলা মুড়ি বানিয়ে দেয়। তাদের খেতে দিয়ে, নিজে দাঁত মেজে স্নান শেষ করে। দুধ নিয়ে মিঠাই এর দোকানে যায়।তারপর ভাই কে স্নান করিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করিয়ে দেয়। সময় করে নিজে কখনো পান্তা খায় আবার কখনো ভুলে যায়। তারপর উনুনে রান্না বসায়। রান্না শেষ হলে আবার মাঠে যায় গরু আনতে।দুপুরে বাবাকে খেতে দেয় আর নিজে খায়। বিকালে ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করে আর ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে খেলা করে। আবার সন্ধ্যে হলেই রান্না বসায় উনুনে। কখনো কখনো ভাইয়ের পড়াশোনায় সাহায্যও করে। তারপর ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে বাবার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর বাবা মেয়ে বসে ভাত খায়। এ হচ্ছে শিউলির প্রত্যেকদিনের রুটিন। রুটিনের কোনো চেঞ্জ নেই। কমলাকান্ত বাবু কখনো মেয়ের কষ্টের কথা শুনতে চায়নি, শিউলিও নিজের কষ্টের কথা কখনো বলতে চায়নি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here