মাস্টারমশাই
পর্ব ১৬
______________
বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল। সরকার শিক্ষা নীতির সাথে সাথে সিলেবাসও পরিবর্তন করে ফেলল। সরকারের এই পরিবর্তনকে কেউ স্বাগত জানালো আবার কেউ সমালোচনা করল। তবে সমালোচনা বেশিদিন টিকলো না। সবাই সরকারের নতুন আইন মেনে নিলো। সরকার নতুন শিক্ষানীতির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর শাসন পুরোপুরিভাবে তুলে দিল। ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনা না করলেও তাদের কোনো ভাবে গায়ে আঘাত করা যাবে না। তাদের শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এক কথায়, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এর জন্য সরকার যথেষ্ট কারণও দাঁড় করিয়েছিল। তাদের যুক্তিকে অনেকেই সমর্থন করেছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের শাস্তি দেওয়া বেমানান। একজন শিক্ষকের কর্তব্য ছাত্রছাত্রীদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া। তাদের ভালো মন্দের দিকে গুরুত্ব দেওয়া। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শাসন করার ফলে তাদের স্কুলের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তাদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে স্কুল। স্কুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের শাস্তি দেওয়া ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে তুলে নেওয়া হয়। আসলে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সাক্ষরতার হার বাড়ানো। সরকারের এই নিয়ম মানতে পারেননি তানভীর স্যার। তিনি সরকারের তীব্র বিরোধিতা করলেন। কিন্তু একজন মানুষের বিরোধিতা কেউ শুনল না। তিনি শিক্ষানীতির সাথে সাথে সিলেবাসের পরিবর্তন মেনে নিলেও, ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা না করলে শাস্তি দেওয়া যাবে না এই আইন মেনে নিতে পারেননি। আরও সময় গড়ালো। কিন্তু স্কুল থেকে পুরনো আইন সম্পূর্ণভাবে তুলে দিতে ব্যর্থ হয় সরকার। বিশেষ করে গ্রামের স্কুল গুলোতে। যদিও, শিক্ষক শিক্ষিকারা আগের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করলো না। নিজেদের চাকরির ভয় রয়েছে। তারা সরকারের আইন মানতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেমন একটা উদাসীনতা চলে আসলো। কিন্তু তানভীর স্যার নিজের আইন থেকে সরে দাঁড়াননি। তিনি তখনো ছাত্র-ছাত্রীদের প্রহার করে যেতে থাকলেন। মনে করলেন নিজের আইন সঠিক। একজন আদর্শ শিক্ষকের যা যা কর্তব্য তিনি তাই করলেন। তারপর আরও বাড়তে রইল সহকর্মীদের সাথে ঝামেলা। এমনিতেই তিনি সকল সহকর্মীদের সঙ্গে অজস্র ঝামেলায় জড়িয়ে ছিলেন। যতই দিন বাড়তে রইল ততই উনাদের মধ্যে ঝামেলা দ্বিগুণ হল। ছাত্র-ছাত্রীরাও তানভীর স্যারকে পছন্দ করলো না। উঁচু ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীরা উনার বদলির দাবি জানালো। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি ওই স্কুলেই থাকলেন। তবে সমস্যা কমলো না। উনার নামে মিথ্যা অপবাদ দিনের পর দিন বাড়তে শুরু করলো। ছাত্র-ছাত্রীরা দাবি করলো, উনি নিজের মেয়েকে ইচ্ছে করে বেশি নাম্বার দেন। বাড়িতে উনি মেয়েকে প্রশ্ন কাগজ ধরিয়ে দেন। তাই তো প্রত্যেক বছর ইয়াসমিন স্কুলে প্রথম হয়। প্র্যাকটিক্যালে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় নিজের মেয়েকে বেশি নাম্বার দেন। নিজের মেয়ের খাতা দেখার সময় অন্যান্য ছেলে মেয়েদের খাতা সঙ্গে অবমাননা করেন।দিনের-পর-দিন তানভীর স্যারের সম্বন্ধে গুঞ্জন বাড়তে থাকলো। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনেকবার তানভীর স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বসে কথা বললেন। কারণ,উনার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু খারাপ স্টুডেন্টরা নয়,স্কুলে টপ স্টুডেন্টরাও অভিযোগ করতে শুরু করেছে।কিন্তু কোনো সমাধান হলো না। নিজের আইন থেকে একচুলও সরে আসতে রাজি হলেন না। প্রধান শিক্ষক পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি যা করেছেন তার জন্য তাঁকে চাকরি খোয়াতে হতে পারে। তানভীর স্যারও খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন, তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। একজন শিক্ষকের যা যা করণীয় তিনি তাই করছেন। একজন আদর্শ শিক্ষক কখনো চাকরিকে ভয় পায় না। শুধুমাত্র স্কুলে চাকরি করলে শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষক হওয়ার জন্য অন্তরের শ্রদ্ধা আর ভক্তির প্রয়োজন। আর উনার মধ্যে তা খুব ভালোভাবে রয়েছে।
তবে তানভীর স্যারের একজন সহকর্মী অনিমেষ বাবু তিনি তানভীর স্যারের অনেক প্রশংসা করতেন। যদিও কখনো সামনে তা প্রকাশ করেননি। তানভীর স্যারের সঙ্গে তার ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। নিজের সহকর্মী বলতে তিনি একজনকে সবসময় পাশে পিয়েছেন। উনার অনেক ভালো বন্ধু। যদিও তিনি তানভীর স্যারের বয়সের তুলনায় অনেক বড়।দুজনের মধ্যে অনেক কথাই আলোচনা হতো, রাজনৈতিক থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সবই। বৃদ্ধা অনিমেষ বাবু অনেক সময় ভালো ভালো কথা শোনাতেন তানভীর স্যারকে। তিনিও খুব মন দিয়ে উনার কথা শোনতেন। উনার প্রতি দিন দিন শ্রদ্ধা বাড়ছিলো।একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য কি কি করনীয়? তানভীর স্যার উনার কাছ অনেক কিছু জেনে ছিলেন। তবে অনিমেষ বাবু বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতেন।
অনিমেষ বাবু পুরো নাম অনিমেষ ভট্টাচার্য। তিনি একজন ব্রাহ্মণ। ইতিমধ্যে ষাট বছর পূরণ করে ফেলেছেন।আজ উনার স্কুলের লাস্ট দিন। চারিদিকে একটা নীরবতা বিরাজ করছে। অনেকেই মানুষটিকে ঠিক মতো চিনে না। তবুও সবাই চুপচাপ বসে আছে। কোনো কথা নেই।মাত্র তিন বছর হলো এই স্কুলে চাকরি করেছেন। হঠাৎ করেই মানুষটির এই স্কুলে বদলি হয়। তারপর, দিন গুনতে গুনতে কাটিয়ে ফেলেন তিন বছর। স্টেজের ওপর সামান্য বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেললেন। স্কুল জীবনে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা সবার মাঝে তুলে ধরলেন। তিনি অনেক ঘটনার সাক্ষী আছেন। সেসব কথা তিনি সংক্ষেপে বললেন।ছাত্র-ছাত্রীরাও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনল। তেমন কাউকে ধৈর্য হারা হতে দেখা গেল না। স্কুল ছুটি হতেই সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তানভীর স্যার শেষবারের মতো অনিমেষ বাবুর সঙ্গে দেখা করলেন। অনিমেষ বাবু তাঁকে বুকে আগলে নিয়ে চোখের জল ফেললেন। তিনি কান্না মাখা গলায় বললেন,’ভালো থেকো তানভীর।’
‘আপনিও ভালো থাকবেন।’
‘জানো তানভীর, আমার যখন হঠাৎ করে বদলি হয়ে যায় তখন আমি খুব বিরক্ত হয়ে ছিলাম। হাতে মাত্র তিন বছর চাকরি আছে। আর তাতেই বদলি করে দিল। ভেবেছিলাম চাকরিটা ছেড়ে দেবো। পারলাম কই চাকরি ছাড়তে।গ্রামে চলে আসলাম। কিন্তু কখনো ভাবিনি এই স্কুলে এসে তোমার মতো একজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। এখন ওই বদলি আমার কাছে আশীর্বাদ মনে হয়। সেদিন যদি বদলি না হতো তাহলে তোমার মতো একজন মানুষের সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ হতো না। তোমাকে লোকে কি বলে আমি জানি না। কিন্তু তুমি আমার চোখে একজন আদর্শ শিক্ষক। আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর আর তুমি বিশ্বাস করো আল্লাহ। আমাদের ধর্মে একটা প্রবাদ আছে, ভগবান কেবল তারই পরীক্ষা নেন যে পরীক্ষার যোগ্য। কখনো হাল ছেড়ো না। লড়াই করে যাও।’
‘মাস্টারমশাই শব্দটা লেখা অনেক সহজ। হয়তো মাস্টারমশাই হওয়াটাও সহজ। কিন্তু শেষপর্যন্ত মাস্টারমশাইয়ের দায়িত্ব পালন করা ততটা সহজ নয়। আমি আমার জীবনে মাস্টারমশাই শব্দের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমার বিশ্বাস তানভীর, তুমি অবশ্যই পারবে। সবসময় তুমি মনে রাখবে,’মাস্টারমশাই’ শুধু একটা শব্দ কিংবা একজন শিক্ষককে বোঝাতে ব্যবহার করা হয় না। শব্দটির মানে অনেক গভীর। তুমি এখন উপলব্ধি করতে না পারলেও শেষ বয়সে অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারবে।’
তানভীর স্যার অনিমেষ বাবুর চোখের দিকে তাকালেন। চোখ ছল ছল করছে। স্যারের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারলেন না। অনিমেষ বাবুর চোখদুটো উনাকে বড্ড ব্যাকুল করে তুলছে। যাই হোক, অন্তত একজন মানুষ তো তাঁকে বুঝেছেন। তাঁকে বিশ্বাস করেছেন। এটাই তাঁর প্রাপ্তি।
অনিমেষ বাবু সেদিনই শহরে ফিরে গেলেন। উনাকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌছে দিয়ে, তানভীর স্যার বাড়ি ফিরতে লাগলেন।বাড়ি ফেরার সময় নিজের ক্ষেতের জমিগুলোর দিকে নজর গেল। উনি অনেক সম্পত্তির মালিক। অনেক জমি রয়েছে। তবে কোনো জমিতে তিনি চাষ করেন না। গ্রামের গরিব মানুষদের চাষ করতে দিয়ে দেন। তার বিনিময় উনাদের কাছ থেকে কিছু পরিমাণ ধান নেন। তানভীর স্যারকে অনেকে অনেকবার বলেছেন,ওই জমিগুলো গ্রামের গরীব মানুষগুলোকে দান করে দিতে। এত সম্পত্তি নিয়ে তিনি কী করবেন? কিন্তু তানভীর স্যার তা করেননি। কারণ তিনি মনে করেন, গরীবকে সাহায্য নয়,তাদেরকে সাহায্যের পথ দেখানো উচিত। একদিন নয়, তাদেরকে দীর্ঘদিনের রোজগারের পথ সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
সূর্য প্রায় অস্তগামী। পশ্চিম আকাশ লাল আভায় ভরে উঠেছে। পাখিরা গুঞ্জন করতে করতে বাসায় ফিরছে।রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে নিজের জমি গুলো দেখতে লাগলেন তানভীর স্যার। হঠাৎ করে কোথা থেকে দৌড়ে দৌড়ে কিশলয় উপস্থিত হল। স্যারের সামনে পৌঁছে হাঁপাতে শুরু করলো। তিনি কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। স্যার কিশলয়কে আপাদমস্তক দেখলেন।তার হাতে একটা খবরের কাগজ রয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।তিনি খুব আগ্রহের সাথে খবর কাগজে থাকা জিনিসের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। কিন্তু কিশলয় কিছু বলতে পারলো না। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছে। তার আনন্দের কারণ কি, বুঝতে পারলেন না তানভীর স্যার। তিনি কিশলয়কে শান্ত হতে বললেন। বেশ খানিকক্ষণ দুজন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে আস্তে কিশলয় স্বাভাবিক হলো। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের জল। সে আর অপেক্ষা করতে পারলো না। তাড়াতাড়ি খবরের কাগজ খুলে স্যারকে দেখালো। তিনি খবরের কাগজে চোখ বোলাতে থাকলেন। কয়েকদিন আগে কিশলয় দৈনিক পত্রিকায় কবিতা লিখে জমা দিয়েছিল। শুধু কিশলয় নয়, সঙ্গে অনেকেই দিয়েছিল। এত জনের মধ্যে কিশলয় প্রথম হয়েছে। আর ওই কবিতা খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছে।এতেই কিশলয়ের আনন্দ সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। দু-টাকা দিয়ে খবরের কাগজ সকাল থেকে কিনে এনেছে। স্কুলে স্যারকে দেখাতে চাইছিল। কিন্তু এত জনের সামনে সাহস হয়নি।তানভীর স্যারকে খবরের কাগজ দেখালে অন্যান্য স্যারও দেখতে চাইতেন। কিন্তু তাঁরা প্রশংসার পরিবর্তে বদনাম করবেন।এই সমস্ত লেখা-লেখি দিয়ে কিছু হবে না। যতই ভালো লেখালেখি করো কেউ তোমার লেখা পড়বে না। আগেকার মানুষ যে সমস্ত সাহিত্য রচনা করে গেছেন, এক জীবনে সেগুলো শেষ করার ক্ষমতা কারোর নেই। কেউই নতুনদের বই পড়তে চায় না। আর সেখানে তার বই কি করে পড়বে? যতই ভালো লেখো, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আর বিভূতিভূষণের মতো লিখতে কখনই পারবে না।এখানেই তার লেখক হবার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। জীবনে এগোতে গেলে প্রচুর পরিমাণে পড়াশোনা করতে হবে, চাকরি করতে হবে। বাবা গরিব তাঁকে চাকরি করে সাহায্য করতে হবে। এখন মন চাইছে লেখালেখি করতে কিন্তু পরে এমনটা হবে না। তখন কি করবে? একটা চাকরির অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু তানভীর স্যার এমটা মনে করবেন না। মানুষ নিজের প্রতিভা দিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। তাই তো সে তানভীর স্যারকে খবরের কাগজ দেখানোর জন্য পাগল হয়ে ছিল। এখন তানভীর স্যারকে দেখিয়ে মনটাকে শান্ত করতে পারল। তানভীর স্যার হাসিমুখে বললেন,’তাহলে জীবনে কি সিদ্ধান্ত নিলি?’
‘ আমি অনেক বড় রাইটার হবো। আমার লেখা গল্প সবাই পড়বে। আমার লেখা গল্প পাঠ্য বইর অংশ হয়ে উঠবে। এটাই আমার স্বপ্ন। আর আমার বিশ্বাস আমি ঠিক পারবো।’
‘তোর স্বপ্ন দেখে আমি অবাক হয়ে উঠছি।’ স্যারের কথা শুনে খটকা লাগলো কিশলয়ের। তানভীর স্যার এমন কথা কেন বলছেন? তিনি তো এমনটা নয়। উনাকে দেখলে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। স্বপ্ন পূরণ করার জাগতিক শক্তি মনের মধ্যে আপনা-আপনি চলে আসে। আর তিনি এমন বলছেন। তাহলে তার যে সমস্ত স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। কিশলরের মনের কথা যেন তানভীর স্যার পড়ে ফেললেন। তিনি কিশলয়ের মনের খটকা দূর করতে চাইলেন। তার হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন,’জানিস কিশলয়, স্বপ্ন পূরণ করতে যতটা না সাহস লাগে তার চাইতে বেশি সাহস লাগে স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে। স্বপ্ন দেখা কিন্তু এত সহজ নয়। স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে না। আমি কিন্তু সেই সব স্বপ্নের কথা বলছি না। যারা আজ স্বপ্ন দেখে শিক্ষক কিংবা রিপোর্টার হবে। কিন্তু পাঁচ বছর পর তার মনে হয় শিক্ষক আর রিপোর্টার হতে যথেষ্ট কষ্ট সাপেক্ষ আর সেখান থেকে ইনকাম খুব বেশি নয়। তখন তারা সে-ই স্বপ্ন থেকে সরে আসে। আবার অন্য সপ্ন দেখে। সেটা পূরণ করার চেষ্টা করে। ওই স্বপ্ন সবাই দেখতে পারে। আমি অন্য স্বপ্নের কথা বলছি। একজন মানুষ প্রথম থেকে একটা স্বপ্ন দেখে।আর সে ততক্ষণ সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে থাকে, যতক্ষণ না ওই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। এটাই হচ্ছে আসল স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত একই স্বপ্ন দেখার সাহস কিন্তু সবার মধ্যে থাকে না……।’
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যায় কিন্তু মাহবুব বাড়ি ফিরছে না। বাড়ির সকল সদস্য চিন্তায় বসে আছে। আমিনা বারবার ব্যাকুল হয়ে বাড়ির উঠোনে গিয়ে দেখছে ছেলে ফিরে এলো কি না! কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। সেই সকাল থেকে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছে। কিন্তু এখনো ফেরেনি। এর আগে অনেকগুলো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে কিন্তু সবগুলোতে ব্যর্থ হয়েছে সে। মাহবুব আব্বুকে বলেছিল একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। উনার এক দুঃসম্পর্ক আত্মীয় শহরের নিজস্ব একটা বড়ো কোম্পানি রয়েছে। তানভীর স্যার বললেই তিনি চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। মাহবুব তানভীর স্যারের ছেলে জানতে পারলে,তিনি নিশ্চয়ই মাহবুবকে একটা বড় পদে নিযুক্ত করবেন। মাহবুব সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছিল। প্রথমে আব্বুকে অনুরোধ করেছিল তার চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তানভীর স্যার রাজি হননি। অন্যের দয়ায় নিজের ছেলে মেয়েদের বড় করতে চান না। নিজের প্রতিভার জোরে বড় হবে তারা। একই প্রস্তাব দ্বিতীয়বার তুলতে বারণ করে দেন। আব্বুর জেদের কথা মাহবুবের অজানা নয়।তাই সেও একই কথা দ্বিতীয়বার তোলেনি। নিজের চাকরির ব্যবস্থা নিজে করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। মাহবুব ফিরে আসলো। তার মুখ প্রসন্ন হাসিতে ভর্তি। আমিনা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।মাহবুবের মুখের হাসি বলে দিচ্ছিল সে কোনো সুখবর দিতে চলেছে। ইয়াসমিন কোনো কথা না শুনেই মাহবুবের কাছে ছুটে গেল।তার চাকরির জন্য সে গিফট চাইল। মাহবুব হাসিমুখে ইয়াসমিনকে আশ্বস্ত করল। তারপর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আব্বু, আমার চাকরি হয়ে গেছি।’
চোখের কোনে জল চিকচিক করে উঠলো তানভীর স্যারের। তবে কাউকে বুঝতে দিল না। তিনি শক্ত হাতে ছেলের পিঠে হাত চাপড়ালেন। একজন ছেলে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তখন একজন বাবা কতটা আনন্দিত হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে তানভীর স্যার সেই অনুভবে আন্দোলিত হয়ে উঠছেন। চোখেমুখে দীপ্তির হাসি স্পষ্ট। আমিনা আর ইয়াসমিন পাশে দাঁড়িয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্যর সাক্ষী রইল। তবে এই অপূর্ব দৃশ্য বেশিক্ষণ থাকলো না। তানভীর স্যার মাহবুবকে ছাড়তেই মাহবুব করুন গলায় বলল,’কিন্তু আব্বু,একটা সমস্যা আছে!’
‘সব কাজে সমস্যা থাকে। সমস্যা না থাকলে তা আবার কেমন কাজ!’
মাহবুব আব্বুর কাছে কিছু একটা লুকোচ্ছে। সে বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। বারবার কিন্তু কিন্তু করছে। তানভীর স্যার ছেলেকে শান্ত মাথায় পুরো ঘটনা বলতে বললেন। মাহবুব সমস্ত ইন্টারভিউতে পাশ করে গেছে। সে বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে।তবে একটা শর্ত আছে, আগামী দশ দিনের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। এই টাকা জমা দিতে পারলে তার চাকরি পুরোপুরি কনফার্ম। সে এমন একটা বড় কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ ছাড়তে চায় না। টাকার কথা শুনে বাড়ির কোনো সদস্য আশ্চর্য হল না। পাঁচ লাখ টাকা তাদের কাছে তেমন কোনো ব্যাপার নয়। তানভীর স্যার পাঁচ লাখ টাকা নয় অনায়াসে কুড়ি লাখ টাকা দিতে পারেন। কিন্তু তানভীর স্যার কঠোর গলায় বললেন,’আবার চেষ্টা কর নিশ্চয়ই পারবি। শতবার চেষ্টা করলে মানুষ একবার সফল হয়।আর তুই মাত্র কয়েকবার চেষ্টা করে সফল হতে পারবি না কখনোই।’
তিনি গলা খাঁকরে উঠে পড়লেন। আমিনাকে সবার জন্য খাবার বাড়তে বললেন। মাহবুব মুহূর্তের ঘটনায় হতভম্ব হল।সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এই বিষয়েও আব্বু কঠোর হবে। তার আব্বু সামান্য টাকা দিতে পারবে না। আব্বুর কথায় একসময় গ্রামের স্কুলে পড়ে ছিল। কিন্তু আব্বু এখনো বদলায়নি। সে মানতে পারলো না। রাগে মাথা ভনভন করে উঠলো। কত আশা নিয়ে বাড়ি ফিরে ছিল। এত বড় একটা কোম্পানির সুযোগ কিছুতেই ছাড়া যাবে না। বাবাও কেমন? তার ছেলে এত বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি করবে, পাঁচ লাখ কেন, দশ লাখ চাইলেও দেওয়ার কথা। আব্বুকে কঠোর ভাষায় বলল,’এই টাকা কিন্তু আমার চাই!’
‘আমি কখনো কাউকে ঘুষ দেয়নি।আজও দেবো না। পারলে নিজের প্রতিভা থেকে কিছু করে দেখা। তোকে যদি ঘুষ দিয়ে দিই তাহলে তোর নিজের ট্যালেন্ট বলে কিছু থাকবে না। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাবি। আমি তা কিছুতেই হতে দেবো না।’
‘তুমি যদি টাকাটা না দাও তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। তুমি চাও না তোমার ছেলে বড় কোম্পানিতে চাকরি করুক?’
‘অবশ্যই চাই। তবে তা সৎ পথে।’
‘আব্বু, এতদিন তোমার অনেক কথা শুনেছি। আর শুনবো না। নিজের রাস্তা নিজে তৈরি করে নেব।’
আব্বুকে মনে মনে গালাগালি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সে জানে, আব্বু একবার না বলেছেন মানে তাঁকে কিছুতেই রাজি করানো যাবে না।উনার মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়েছে মানে সেই শব্দই সঠিক। তিনি দ্বিতীয়বার সেই শব্দ ফেরাবেন না। অতিরিক্ত কিছু বলতে গেলে তিনি আরও অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেবেন। ইয়াসমিন আর আমিনা পুরো ঘটনার সাক্ষী থাকলো। আব্বুর উপর কথা বলার সাহস ইয়াসমিনের নেই। সে নিজের রুমে চলে গেল। আমিনা স্বামীর কাছে আসলেন। উনাকে ভালোভাবে প্রখর করলেন। তারপর তাচ্ছিল্য করে বললেন,’সমাজে বুঝি কেউ ঘুষ দিয়ে চাকরি করে না?’
তানভীর স্যার মুখ তুলে স্ত্রীকে দেখলেন। কিছু বললেন না। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো খাবার বাড়তে বলেন। কিন্তু আমিনা স্বামীর কাছ থেকে গেলেন না। তিনি ছেলের হয়ে কথা বললেন। কিন্তু কোনোভাবেই তানভীর স্যারকে রাজি করাতে পারলেন না। নিজের কথায় অটল থাকলেন। আমিনা শেষমেষ রেগে গম্ভীর স্বরে বললেন,’আমরা সমাজে বাস করি। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। আমরা প্রত্যেক মানুষই ভুল,শুধু তুমি একাই সঠিক?’
‘হ্যাঁ,আমি সঠিক।’ শান্ত মাথায় উত্তর দিলেন তানভীর স্যার।
মানুষ কি করে নিজের প্রশংসা নিজে করে আমিনা তা বলতে পারবে না। তিনি স্বামীর ব্যবহারে হাসবেন না কান্না করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। তিনি অদ্ভুতভাবে সমস্ত যুক্তিকে হারিয়ে দিতে সক্ষম। আমিনা জানেন, তাঁর এই যুক্তিকে তাঁর স্বামী নিজের যুক্তি দিয়ে হারিয়ে দেবেন। বেশি সময়ও নিলেন না তানভীর স্যার। তিনি শান্ত মাথায় স্ত্রীকে বললেন,’তোমাদের কথা হচ্ছে সমাজ ও সমাজের চারটি মানুষ সঠিক, আর আমি ভুল। আচ্ছা ঠিক আছে, এক মুহূর্তের জন্য আমি মেনে নিলাম আমি ভুল। বর্তমান সমাজ সঠিক।তাহলে কেন প্রত্যেকদিন খবরের কাগজে প্রথম পাতায় ধর্ষণের ছবি বের হয়? কেন প্রতিদিন খবরের কাগজে গলাকাটা লাশের ছবি বের হয়? কেন প্রতিদিন খবরের কাগজে বের হয় সম্পত্তির লোভে ছেলের হাতে বাবা খুন? দেশে কেন এত বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে? কেন এত অনাথ আশ্রম রয়েছে? সমাজ তো সঠিক। আর সঠিক সমাজে এগুলো তো হওয়ার কথা নয়।’
চলবে