মাস্টারমশাই
পর্ব ২৭ (অন্তিম পর্ব)
শুভজিৎ জানা
চারিদিকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। মাহবুব খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে আব্বুর রুমে প্রবেশ করল। মন অস্থিরতায় ছেয়ে গেছে। কোথা থেকে এক করুণ যন্ত্রনা বুকের মধ্যে বারবার উঁকি দিচ্ছে। বাবা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। খুব ভোরে মাহবুব দেশে ফিরেছে। টিকিট না থাকার দরুন,নিজের স্ত্রী এবং ছেলেকে আনতে পারেনি। পাঁচটা দিন বিদেশের মাটিতে কি করে কাটিয়েছে জানে না। বাবার মৃত্যুর খবর জানার পর বাবার কাছে না এসে,অন্য কোথাও আদৌ কি শান্তিতে থাকা যায়? থাকা যায় না। মাহবুব নিরুপায়। সে থাকতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। আব্বুর রুমে প্রবেশ করতেই চোখ দুটো ভিজে গেল। বুকের স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। জুতো খুলে মাহবুব বাবার রুমের ভেতর গেল। তিনি কখনো কাউকে জুতো পরে রুমের মধ্যে প্রবেশ করতে দিতেন না। তাঁর রুম তাঁর কাছে ছিল অনন্য। মাহবুব হকচকিয়ে গেল। রুম বেশ পরিষ্কার এবং সাজানো গোছানো। মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর পরও রঘু নিজের কাজে গাফিলতি করেনি। পুরো বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। রুমের একদম বামপাশে আব্বুর পড়ার টেবিল,সঙ্গে রয়েছে আরও দুটো চেয়ার। সেখানে তানভীর স্যার আর আমিনা বসে গল্প করেছেন কত রাত। আমিনা মারা যাওয়ার পর তানভীর স্যার ওই চেয়ারে কাউকে বসতে দেননি। নিজের ছেলেমেয়েদেরকেও না। মাহবুব বর্তমানেও চেয়ারে বসার স্পর্ধা দেখাতে পারলো না। চুপচাপ চেয়ারের নিচে বসে পড়লো। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু ভালো লাগছে না। মানুষ দুটো অজস্র স্মৃতি রেখে দিয়ে গেছেন।রেখে দিয়ে গেছেন তাদের তৈরি করা নতুন ভালোবাসার ছন্দ। রেখে গেছেন নিজেদের তৈরি করা কিছু আইন। এগুলো ফেলে তারা এতদিন কি করে বিদেশে পড়ে রইল? সুখ এই বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে আছে। এতদিন সে বুঝতে পারেনি। আজ বুঝতে পারছে। কিন্তু এখন বুঝে লাভ কি? সবকিছুই আজ অতীত। পালঙ্কের উপর আব্বুর দুটো ভাঁজ করা জামা পড়ে রয়েছে। মাহবুব সেগুলো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, বাবা আই লাভ ইউ। আই রিয়েলি মিস ইউ। তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি ছাড়া আমার অস্তিত্ব বিলীন। কিন্তু সে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না। লোকে বলবে এ লোকদেখানো কান্না। সে যদি সত্যিই বাবাকে ভালোবাসতো, তাহলে দীর্ঘদিন কখনো বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকতো না। বাবার দেখাশোনা করতো।
মাস্টারমশাইয়ের দাফন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর, কাবেরী নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। মাস্টারমশাইয়ের বলা কথাগুলো মনে করতে থাকে। উনার দেওয়া বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তিনি বলেছিলেন,বইয়ের প্রতিটি অক্ষর পড়তে। কি রয়েছে এই বইয়ের মধ্যে? যেখানে একটা অক্ষর অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।কাবেরী অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করতে করতে একটা জিনিস লক্ষ্য করল। স্থির চোখে বইয়ের দিকে তাকালো। বইয়ের একটা
জায়গায় (একদম সাইটে) খুব ভালো করে লেখা রয়েছে, মাস্টারমশাই ∆ কিশলয় কুমার দাস ∆ শুভজিৎ প্রকাশনী। কাবেরীর চোখ থেকে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়লো। শুভজিৎ প্রকাশনীর সমস্ত কিছুর দায়িত্বে রয়েছে কাবেরী নিজেই। যদিও বেশির ভাগ কাজ তার স্বামী (সুমন) করে। শুভজিৎ তার জীবনে একটা বিশেষ আঙ্গিনা ছিল। সে চাইছিল তাকে অমর করতে। তাইতো তার নামে নিজস্ব একটা প্রকাশনী চালু করে। বইয়ের জগতে শুভজিৎ কে অমর করে তোলার প্রতিজ্ঞা করে। প্রথম কয়েক বছর এই প্রকাশনী সাফল্য লাভ না করলেও পরের দিকে বেশ সাফল্য আর্জন করে। এমনই একদিন কিশলয় কাবেরীর কাছে গিয়ে ওঠে। সে তার প্রকাশনীতে নিজের বই প্রকাশ করতে চায়। কাবেরী একবারের জন্যও বারণ করেনি। তার ছোটবেলার বন্ধু কিশলয়। তার জন্য এইটুকু সাহায্য খুবই নগণ্য। এ ও জানতো কিশলয় গল্প লেখে, তার দুটো বৃহৎ উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে। কিশলয়ের মাধ্যমে নিজের প্রকাশনীর অনেকটা সুনাম হবে। একবারের জন্যও কিশলয়ের জমা দেওয়া পান্ডুলিপি পড়েনি। কিশলয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। সে-ই বিশ্বাস থেকে তার বই ছাপিয়ে দেয়। কিন্তু সেই বই আজ এতগুলোর কারণ হয়ে উঠবে, সে কখনো জানতো না। সে যদি জানতো ওই বইয়ের মধ্যে মাস্টারমশাইকে অসম্মান করা হয়েছে,তাহলে কখনো বই ছাপিয়ে দিত না। একটা বই বেরোনো ক্ষেত্রে সব সময় লেখক-লেখিকা নয়, প্রকাশনীরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। তাদের গাফিলতির কারণে অনেক ভুলভাল লেখা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের মধ্যে। পুরো একদিন সে কিশলয় আর কিরণের কাছে ছুটে বেড়িয়েছে। তাদের কাছে জবাব চেয়েছে, মাস্টারমশাইকে অপমান করে কি পিয়েছে? কিন্তু এখন সে কার কাছে ছুটে যাবে? মাস্টারমশাইকে অপমান শুধু তারা করেনি। সে নিজেও করেছে। বরং, তাদের অন্যায় অনেক কম। তারা শুধু মাস্টারমশাইকে অপমান করেছে। কিন্তু কাবেরী মাস্টারমশাই সঙ্গে সঙ্গে শুভজিৎ কেও অপমান করেছে। তাকে কলঙ্কিত করেছে। ছোট্ট পবিত্র শিশুটির গায়ে কালো দাগ এঁকে দিয়েছে। এই উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশনীর নামটাও উচ্চারিত হবে।
কাবেরী বুঝতে পারল তার একটা ভুল কতগুলো মানুষকে অসহায় করে দিয়েছে। একটা মানুষ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে। তার পিছনে দায়ী সে নিজেই। একবারের জন্যও মাস্টারমশাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে পারল না। মানুষটাও মৃত্যুর আগে কারোর প্রতি কোনো অভিযোগ রেখে গেল না। সব দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। মাস্টারমশাই ঠিক কথাই বলেছিলেন,বইটি পড়লে সে কখনো তাঁর কাছে ফিরে যাবে না। কাবেরীর আর সাহস হলো না, স্যারের বাড়ির দিকে যেতে।পরের দিন সকালে ব্যাগপত্র গুটিয়ে গ্রাম থেকে বিদায় নিল।
চুপচাপ বাসে বসে রইল। মাস্টারমশাইয়ের বলা কথাগুলো মনে পড়লো। মৃত্যুর আগে কাবেরীকে উদ্দেশ্য করে উনার বলা শেষ কথা ছিল, কাউকে সম্মান করতে না পারিস তা বলে তার সর্বনাশ করিস না। এই কথাটা যেন তার জীবন থেকে নেওয়া। কাবেরী কখনো মাস্টারমশাইকে সম্মান করতে পারেনি, উল্টে সর্বনাশ করে দিয়েছে। বাস ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষন পর চোখ ঘুরিয়ে কাবেরী লক্ষ করল, শহরে আসার সময় তার সহযাত্রী বৃদ্ধ মানুষটি পাশে বসে রয়েছেন। কাবেরী বৃদ্ধ মানুষটিকে আপাদমস্তক লক্ষ করল। তিনি বসে বসে মাস্টারমশাই উপন্যাস পড়ছেন। উনার চোখ থেকেও জলের ফোঁটা পড়ছে। বেশ অনেক্ষণ ধরে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,’আপনি কাঁদছেন কেন?এই উপন্যাসের মধ্যে এমন কি রয়েছে যে একজন বৃদ্ধ মানুষকে কান্না করতে বাধ্য করছে?’
বৃদ্ধ মানুষটি বই বন্ধ করে দিলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের জল মুছলেন। বললেন,’আমি তানভীরকে খুব ভালো করে চিনি। সে এমন মানুষ নয়। আমি একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত এই বইটি তানভীরকে কেন্দ্র করে রচনা করা হয়েছে। আর আমি এটাও জানি সে কখনো কাগজ পোড়ায়নি। সে সত্যিকারের একজন সৎ মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে তার কোনো প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীকে পায়নি।’
সামান্য কথা বলতেই বৃদ্ধ মানুষটি হাঁপিয়ে উঠলেন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর খুব ধীর কণ্ঠে বললেন,’তানভীর বারবার আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলছিল। কিন্তু এই বয়সে এতদুর জার্নি করা কষ্টসাধ্য। তবুও মনের মধ্যে তানভীরকে দেখার ইচ্ছেটা জাগতে থাকে। তার আয়ু কমে এসেছে আমি বুঝতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল সে কিছু বলতে চায়। তাই সবকিছু ফেলে ছুটে এসে ছিলাম তার কাছে। কিন্তু সে তার শেষ কথা না জানিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। আর মৃত্যুর পরেও যোগ্য সম্মান পেল না।’ কথা শেষ হতেই আবার কেঁদে ফেললেন। কাবেরীর কৌতুহল বাড়তে রইল। এই বৃদ্ধ মানুষটি কে? আসল পরিচয় কি? কাবেরী স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করল,’আপনি কে হন তানভীর স্যারের?’
‘আমাকে চিনতে পারবি না। আমি অনিমেষ ভট্টাচার্য। মাত্র তিন বছর এই স্কুলে চাকরি করেছিলাম। সেখানেই তানভীরের সঙ্গে পরিচয় হয়।অল্পদিনে মানুষটার চিন্তা ধারা মানুষটির গতিবিধি সবকিছুই বুঝে যাই। সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা আমার সঙ্গে শেয়ার করত। আমি তাকে উৎসাহিত করতাম। কিন্তু এত কিছু করে জীবনে কি পেল? অসম্মান, অবহেলা আর প্রতারণা ছাড়া কিছুই না।’
কাবেরী চুপ হয়ে গেল। সে অনিমেষ বাবুকে চেনে না। শহরে যাওয়ার পরেই অনিমেষ বাবু এই স্কুলে বদলি হন। অনিমেষ বাবু কাবেরী সঙ্গে আর কথা বললেন না। তিনি আবার বই খুলে পড়তে শুরু করলেন। কাবেরী মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। এই গ্রামে সে আর কখনো ফিরবে না। সমস্ত স্মৃতি ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বুকটা ব্যথায় চিনচিন করছে। সমস্ত যন্ত্রণা তাকে একসঙ্গে ঘিরে ধরেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। এর থেকে মুক্তি চায়। কি করলে সে মুক্তি পাবে? শুধু স্থান পরিবর্তন করলে কি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে? পাবে না। কোনো কিছু থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে এই ‘কিছুটা’ জীবনে আসার কারণ বার করতে হবে। ওইটা যাতে জীবনে দ্বিতীয় বার না আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার কখনো কখনো কোনো যন্ত্রণা থেকে কখনোই মুক্তি পাওয়া যায় না। সারা জীবন ধরে ওই যন্ত্রণাকে বয়ে বেড়াতে হয়। কাবেরী জানে না, সেদিন শুভজিৎ মারা গেছিলো না আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে, মাস্টারমশাই মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। সবাই মিলে তাকে হত্যা করেছে। শুধুমাত্র তরোয়ালের আঘাত কিংবা বন্দুক থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করাকে হত্যা বলে না। কোনো মানুষকে দিনের-পর-দিন যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়ে, তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করাকেও হত্যা বলে। মাস্টারমশাইকে এ ভাবেই হত্যা করা হয়েছে। আমাদের দেশে এই হত্যার জন্য কোনো আইন নেই। মাস্টারমশাই যদি উনার জীবনে উনার প্রাপ্যটুকু পেতেন, তাহলে কখনো এমনটা হতো না। তিনি আরও অনেকগুলো বছর বাঁচতে পারতেন। সবার মধ্যে থাকতে পারতেন।বইয়ের যে কোনো অধ্যায় প্রথমে পড়তে ভালো লাগে। তারপর শুরু হয় বিষন্নতা। সবকিছুই কঠিন লাগে। টেনেটুনে কোনোরকম ভাবে শেষ করে ফেলি। তারপর শেষে আসে অনুশীলনী। অনুশীলনী করতে গিয়ে আমাদের আবার পেছন ফিরতে হয়। ছেড়ে যাওয়া অংশগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হয়। তাদের অর্থ বার করতে। প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় মনে হয়,যদি অধ্যায়টা ভালো করে পড়তাম তাহলে আজ অনুশীলনী গুলো খুব সহজেই হয়ে যেত।আমাদের জীবনটাও কিন্তু একটা বইয়ের অধ্যায়ের মতো। জীবনের প্রথম দিন গুলো খুব হাসি খুশিতে কাটিয়ে ফেলি। জীবনের একটা পর্যায়ে একাকীত্ব চলে আসে। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কখনো অলস ভাবে, আবার কখনো ভ্রমণ করে, আবার কখনো ব্যস্ত শহরে হারিয়ে জীবন কাটিয়ে ফেলি। নিজে কি করলে খুশি হবো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ফ্যামিলির সদস্যরা কোনটাতে খুশি থাকবে -সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারপর আসে শেষ জীবন। মাথায় উঁকি দেয় অজস্র প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের আবার জীবনের প্রথমের দিকে ফিরে যেতে হয়। তখন মনে হয় ওটা এমনটা, সেটা তেমনটা না করলে ভালো হতো। জীবনটা আরও অনেক সহজ হয়ে যেত। কিন্তু তখন আর কিছু করার উপায় থাকে না, যা হওয়ার তা অনেক আগে হয়ে গেছে।
বেলা বাড়তেই মাহবুব নড়েচড়ে বসল। ইয়াসমিন বিকালে আসবে। বাবার অনেক সম্পত্তি রয়েছে। সেগুলো ভাগাভাগি করতে হবে। মাস্টারমশাই যে ধরনের মানুষ, তাতে তিনি কখনোই উনার সম্পত্তি গরিব মানুষদের দান করে যাবেন না,এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত মাহবুব। তিনি জীবনে প্রথম থেকেই বিশ্বাস করেন, গরীবকে সাহায্য নয় সাহায্যের পথ দেখানো উচিত। নিজের অধিকার নিজেকে বুঝে নিতে হয়। তবুও মাহবুব তানভীর স্যারের পুরো ঘর তল্লাশি করল। কোথাও কোনো উইল আছে কিনা! অনেকক্ষণ ধরে পুরো ঘর খোঁজার পর, মাহবুব একটা দু-পাতার চিঠি খুঁজে পেল। এতক্ষণের পর মাহবুব ঘরের মধ্যে আলো জ্বালালো। চোখে চশমা লাগিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করল……..
প্রিয়,
মাহবুব
আমি সবসময় একটা জিনিস নিয়ে গর্ব করি, আমার মাহবুব আর ইয়াসমিন। আমার গর্ব আমার ছেলে-মেয়ে। কিন্তু জীবনের বাতাবরণে তুই কোথায় হারিয়ে গেলি তা আমি জানি না। আমি সব সময় আমার ছেলেকে সেরার সেরা দেখতে চাইতাম। তাই এত শাসন এত আইন তৈরী করেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, সেগুলো সবই ভুল ছিল। যাই হোক, আমি তোদের কাছে কখনো কোনো জিনিস চাইনি। একটা জিনিস চেয়েছিলাম,তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিস। আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। মৃত্যুর আগে আমি আমার সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছি। এখনো তিনিটি কাজ বাকি রয়ে গেছে। সেগুলো শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্তত ওই তিনটি কাজ তুই সম্পন্ন…। তাতে আমার আত্মা শান্তি পাবে।
……স্কুলের পাশে আমাদের বেশ কয়েকটা জমি রয়েছে। কিন্তু স্কুলের ছেলেমেয়েদের খেলার জন্য কোনো বড়ো মাঠ নেই। আমি চাই তুই যে কোনো একটা জমি স্কুলের মাঠ তৈরি করার জন্য দান করে দিস। আর এই বাড়িটা দয়া করে বিক্রি করিস না। এই বাড়ি আমার প্রাণ। এখানে অজস্র স্মৃতি রয়েছে। এই বাড়িটাকে অমর করে রাখিস। এই বাড়িটা লাইব্রেরিতে রুপান্তর করে দিস। গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে বইয়ের অভাবে পড়াশোনা করতে পারে না। তাদেরকেই লাইব্রেরীর মাধ্যমে বিনামূল্যে বই দিয়ে সাহায্য করিস। দেশের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। আর আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা সবচাইতে টলমলে। শুধু পাঠ্যবই নয় আরও অনেক বই রাখিস। যেগুলো থেকে শিশু বৃদ্ধ সবাই কিছু না কিছু শিখতে পারবে।বাচ্চাদের পড়ার সুযোগ করে দিস। অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের পাশাপাশি ক-খ-গ জানাটাও ভীষন জরুরী। দান করে কিংবা গরিবের পাশে থেকে কখনো দেশের গরীব নির্মূল করা সম্ভব নয়। গরিব নির্মূল করতে হলে সমাজকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কিশলয় আমার প্রিয় ছাত্র। আমি এখনও বিশ্বাস করি সে আমার প্রিয়ই আছে। কারণ, প্রিয়রা কখনো অপ্রিয় হয় না। আর যদি ভুলেও অপ্রিয় হয়ে যায়, তাহলে সে কখনো প্রিয় ছিল না। তার বাবাকে মরন রোগে ধরেছে। বাবার চিকিৎসার জন্য বাজারে অনেক ধারদেনা হয়ে গেছে। দিদির বিয়ে দিয়েছে, নতুন বাড়ি বানিয়েছে। বই লিখে আর কত টাকা রোজগার করে?আমাদের বাড়ির সামনে বাঁধের পাশে যে জমিটা রয়েছে তাকে দিয়ে দিস। আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি তোর আর ইয়াসমিনের নামে লিখে দিয়েছি। এবার তোরা যা ভালো মনে করিস ওটা করবি। তোদের জোর করব না। তোদের যদি মনে হয় তিনটি কাজের মধ্যে একটিও করতে পারবি না। তাতেও আমার অসুবিধা নেই। আমার এত সম্পত্তি একা ভোগ করতে চাইলে ভোগ করতে পারিস। আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না।
ইতি
তানভীর আলম
পুরো চিঠি পড়ে মাহবুব আবার একবার কেঁদে ফেলল। মনে মনে স্থির করলো, আব্বুর সমস্ত শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে। টাকা,বাড়ি,গাড়ি,যৌবন এগুলো তার কিছু প্রয়োজন নেই। সে অনেক টাকার মালিক। তানভীর স্যার সমস্ত সম্পত্তি কাউকে ঠকিয়ে কিংবা চুরি করে গুছিয়ে রাখেননি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জন করেছেন। তিনি কখনো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা খরচ করেননি। নিজের ছেলেমেয়েদের পেছনেও বাড়তি এক টাকাও খরচ করেননি। যেটুকু প্রয়োজন সবসময় সেটাই নিয়েছেন। সেগুলোর সমস্ত অধিকার কেবল নিজের। উনার সম্পত্তি উনি যা করতে চান তেমনটাই হবে। বিকেলে ইয়াসমিন আসলো। ভাইয়ের কথায় ইয়াসমিনও সম্মতি জানালো। পরের দিন থেকে মাহবুব কাজে লেগে পড়ল।কানাডা ফিরে যাওয়ার আগে বাবার সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করবে সে।স্কুলের জন্য মাঠ তৈরি করে দিল। নিজের বাড়িকে লাইব্রেরী গড়ে তুলল। যার জন্য এত কাল তাদের বাড়ি সুন্দরভাবে গোছানো রয়েছে, তাকে কাজ থেকে বিতাড়িত করলো না। লাইব্রেরী সমস্ত দায়িত্ব রঘুকে দিয়ে দিলো। রঘু মোটামুটি ভাবে লেখালেখি করতে পারে। পড়াশোনাতে তেমন খারাপও নয়। প্রায় এক মাসের মধ্যে সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে ফেলল। যেগুলো বাকি থাকলো সেগুলো অন্যের উপরে দায়িত্ব দিল। সে আবার তিন মাসের মধ্যে গ্রামের ফিরবে। কাল সকালে মাহবুব কানাডায় ফিরে যাবে। এখনো একটা কাজ বাকি। কিশলয়কে জমির দলিল তুলে দেওয়া হয়নি। তাকে বাঁধের ধারে জমিটি দিতে মাহবুবের মনটা কিনকিন করছে। ভবিষ্যতে সে-ই জমির দাম অনেক হবে। এমন জমি দান করা কি সঠিক হবে? সঠিক হবে না। তবুও বাবার কথা অমান্য করল না মাহবুব। সন্ধ্যার সময় দলিল হাতে নিয়ে কিশলয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বালিয়ে নিজের রুমে এসে বসেছে কিশলয়। ঘরের মধ্যে সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়েছে। চেয়ারের উপর বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আরও একটি উপন্যাস লিখতে চলেছে। অন্ধকারের মধ্যে সে-ই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে কল্পনা করছে। কিন্তু কিছুতেই সে স্থির হতে পারছে না। সমস্ত চরিত্রগুলো তার মনের কোঠায় উঁকি দিতে পারছে না। সবকিছুই এলোমেলো। বারবার তানভীর স্যারের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বেশ কয়েকদিন ধরে সে মনমরা হয়ে আছে। সে সবাইকে বলে দিয়েছে মাস্টারমশাই চরিত্রটা কাল্পনিক। কিন্তু নিজেকে বলতে পারছে না মাস্টারমশাই চরিত্রটা আসলেই কাল্পনিক। নিজের বিবেকে আঘাত আনছে।এমন একটা চরিত্র উপস্থাপনা করল, যেখানে একটা মানুষের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। এটা কি কাকতালীয় নয়? দিদির কথা আজ বার বার মনে পড়ছে। দিদি বলেছিল, সাফল্য আর সম্মান দুটো জিনিস আলাদা। সাফল্য হলো সবার কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা। আর সম্মান হলো নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মান্য করা। সে আজ নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত। নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানতে পারছে না। সে কেবল সাফল্য পেয়েছে,সম্মান নয়। অন্ধকারের বুক চিরে কেউ একটা ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। তার ভেতরে প্রবেশ করার শব্দ কাঠঠোকরা পাখি ঠোঁট দিয়ে গাছে আঘাত করার শব্দের মতো। কিশলয় হকচকিয়ে গেল। কিছুটা দূরত্ব থেকে তার কানে শব্দ ভেসে আসতে লাগলো।
‘বাড়িতে কেউ আছেন? এই যে শুনছেন! কিশলয়! কিশলয়!’
কণ্ঠস্বর তেমন পরিচিত নয়। কিশলয় রুমের আলো জ্বালালো। বাইরে এসে দেখল একজন লম্বা পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে; মাস্টারমশাইয়ের ছেলে মাহবুব। তাকে ভেতরে আসতে বলল। মাহবুব ভেতরে আসলো। তারপর পুরো ঘটনা সংক্ষিপ্ত করে বলল। মাহবুবের তাড়া আছে। সকালে কানাডায় ফিরতে হবে।রাতের মধ্যে ব্যাগ গোছানোর পর্ব শেষ করতে হবে। সে তাড়াতাড়ি করে কিশলয়ের হাতে দলিল তুলে দেয়। তারপর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে যায়। তখনই কিশলয় অস্পষ্ট শব্দে মাহবুবকে ডাকলো। মাহবুব পিছনে ঘুরতেই কিশলয় বলল,’আচ্ছা, এই জমির বর্তমান মূল্য কত হবে?’
‘প্রায় পাঁচ লাখ।’
‘আচ্ছা।’
‘হঠাৎ মূল্য জানতে চাইলে কেন? কোন অসুবিধা থাকলে আমাকে বলতে পারো।’
‘না না… আমার কোনো অসুবিধা নেই। শুধু জানতে চাইলাম।’
মাহবুব কিশলয়কে দ্বিতীয় বার বিদায় জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কিশলয় টেবিলের ওপর দলিল ফেলে দিয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসলো। ঘরের আলো আবার নিভিয়ে দিল। চুপচাপ বসে থাকলো। চোখ থেকে অজান্তেই জলের ফোঁটা পড়ে যাচ্ছে। গভীর অন্ধকারে তার কান্না কেউ দেখতে পারছে না। কাঁদতে হবে। তার কান্নার প্রয়োজন আছে। সে ভাবতে রইল, একটা বই লিখে কত টাকা রোজগার করেছে? বড়জোর এক লাখ। আর মাস্টারমশাই তাকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান করে দিয়ে গেল। সে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠলো। সে মাস্টারমশাইকে বিক্রি করে দিয়েছে। মাত্র কয়েক টাকার বিনিময়ে। সে এখন কি করবে? তার কি করা উচিত? বইটা নতুন করে লিখবে? কিন্তু পৃথিবীতে যে কিছু কিছু জিনিস মাত্র একবারই সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়বার সৃষ্টি হওয়ার কোনো চান্স থাকে না। হলেও সেটা হয় কাকতালীয় কিংবা হিংস্র। সে চাইলেও আর কিছু করতে পারবে না। অসম্মানিত ভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মাস্টারমশাই। এখন সম্মান দেওয়াটা জাস্ট একটা অজুহাত। কিশলয় খুব গরীব পরিবার থেকেই জন্মেছিল।আর মাস্টারমশাই কাউকে সাহায্য করতে কখনোই পছন্দ করতেন না। কারণ, তাঁর আইনের মধ্যে তা ছিল না। তবুও তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কিশলয়কে বই এনে দিতেন। নিজের তৈরি করা আইন কিশলয়ের ক্ষেত্রে বিসর্জন দিয়েছিলেন। আর ওই কিশলয়…..।
দূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। ঝিঁঝিঁ পোকা শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে টিকটিকি অন্ধকারকে বিদ্রুপ করছে। ঘন অন্ধকার। একরাশ স্তব্ধতা নেমে এসেছে। অন্ধকারের মধ্যে কিশলয়ের চোখের সামনে ভেসে উঠল মাস্টারমশাইয়ের প্রতিচ্ছবি। তাঁর গাম্ভীর্য উজ্জ্বল মুখশ্রী। তিনি এখন রেগে রয়েছেন। চেয়ারের উপর বসে একের পর এক স্টুডেন্টের পড়া ধরছেন। যে পড়া করতে পারছে না তার জন্য রয়েছে কড়া শাস্তি। পুরো ক্লাসরুম চুপচাপ। পিনপতন শব্দ নেই। পর পর মানুষটি বৃদ্ধ হয়ে উঠলেন। বৃদ্ধের করুন মুখমন্ডলও স্পষ্ট ভেসে উঠলো। গালদুটো গলে গেছে। কপালের চামড়া কুঁচকানো। মাথায় পুরো চুল সাদা। চেয়ারের উপর বসে তিনি এখনও নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেছেন। কিশলয় মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতি মনে করছে আর কাঁদছে। হঠাৎ তার মনে হল, মাস্টারমশাই তাকে ‘কিশলয়’ ‘কিশলয়’ বলে ডাকছেন। সেও অস্পষ্টভাবে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো,মাস্টারমশাই, ও মাস্টারমশাই।
সমাপ্ত
পুরো উপন্যাস কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।উপন্যাসে কোনো কোনো অংশে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এবং কোনো কোনো অংশ সবচেয়ে খারাপ লেগেছে তাও জানাবেন।
ধন্যবাদ।।