মাস্টারমশাই পর্ব ৭

0
325

মাস্টারমশাই
পর্ব ৭
শুভজিৎ জানা
_______________
শ্রাবণ মাসের প্রথম দিন থেকে অবিরাম বর্ষা হয়ে চলেছে। বর্ষা কমার কোনো নাম গন্ধই নেই। গ্রামের চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে। এ ভাবে আরও কয়েকদিন বৃষ্টি হলে বন্যা অনিবার্য। ইতিমধ্যে গ্রামে অনেক চাষের জমি ডুবে গেছে। তবে গ্রামে কয়েকটি আভিজাত্য বাড়ির মানুষদের কোনো চিন্তা নেই। তারা বৃষ্টি বেশ ভালোভাবে অনুভব করছে। দীর্ঘদিন পর বৃষ্টি হচ্ছে।গরম থেকে রেহাই পেয়েছে। নিজেদের খুশিতে নির্বোধের মতো আচরণ করতেও তাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না।
সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।কাবেরী জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মাঝেমধ্যে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে জোরালো হাওয়া।মা বারবার বিরক্ত হয়ে বলছেন জানালা বন্ধ করতে। মায়ের কথা কানে শুনলেও সেদিকে মনোযোগী হলো না। বৃষ্টি মুখরিত পরিবেশ বেশ সুন্দর লাগছে তার কাছে। জানালার বাইরের পরিবেশ অনুভব করছে ।আজ খোলা আকাশে কোথাও পাখি নেই। সবাই নিজের বাসায় রয়েছে। তারা তো কয়েকদিন ধরে বাইরে বের হতে পারেনি। আচ্ছা,পাখিরা খাচ্ছে কি?প্রচন্ড বাতাসে যেখানে মানুষের তৈরি ঘরবাড়ি ভেঙে যাচ্ছে,সেখানে পাখিরা কি করে গাছে রয়েছে? তাদের বুঝি কষ্ট হয় না?গ্রামের রাস্তায় কোনো মানুষ নেই বললেই চলে। বলতে বলতে স্কুলের সময় হয়ে আসলো। তাকে স্কুল যেতেই হবে। এই বৃষ্টিতে স্কুলে যাওয়া সঠিক কিনা সে জানে না। তবুও যেতে হবে। আগামীকাল প্রথমে ক্লাস তানভীর স্যারের। তিনি নিশ্চয়ই কোনো অজুহাত শুনবেন না। বলবেন, বর্ষাকালে বর্ষা হবে এটাই স্বাভাবিক। তা বলে স্কুল বন্ধ করা চলবে না। শাস্তি পেতে হবে। আবার বৃষ্টিকেও বিশ্বাস নেই। স্কুল যাওয়ার সময় ঠিক বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আগেভাগে রেডি হয়ে নিল।তার স্কুল যাবার সঙ্গী শুভজিৎ কিন্তু কিন্তু করতে থাকলো। সে এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাবে না। কাবেরীও তাকে নিতে চাইল না। দুর্যোগের মধ্যে বাচ্চা ছেলেটিকে জড়ানো উচিত নয়। তাকে তো আবার একা ফিরতে হবে। কিন্তু পায়েল দেবীর কড়া আদেশ, মেয়ে একা স্কুলে যাবে না। শুভজিৎ কে যেতেই হবে। উনি কাজে ব্যস্ত,তিনি যেতে পারবেন না। মন না থাকলেও বাধ্য হয়ে যেতে হলো। তখনো বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমধ্যে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ ভেসে আসছে। কাবেরী রেইনকোট পরে রয়েছে আর ছাতা হাতে শুভজিৎ। দুজনেই ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করেছে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও ভয়ানক দুর্যোগকে অপেক্ষা করে স্কুলে যেতে হলো। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। স্কুলে যাওয়ার পথে শুভজিৎ কতবার কাদায় পা পিছলে পড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। কাবেরীও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তাকে আগলে রাখা।শুভজিৎ কে সামলাতে গিয়ে নিজেও ভিজে গেছে। কাবেরী স্কুলে পৌঁছে শুভজিৎ কে তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে হি হি করে হেসে উঠলো। সে গোটা শরীর কাদা মেখে রয়েছে। গালেও কাদা লেপ্টে রয়েছে। ভীষণ হাসি পেল কাবেরীর। কাকে,কে, স্কুলে ছাড়তে এসে ছিলো, তা বুঝতে পারল না।এইটুকু বাচ্চা যে নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক নিতে পারে না,সে নেবে অন্য একজনের দায়িত্ব। ভীষন কাকতালীয় ঘটনা। গৌণ বিষয়টি মা কেন যে বোঝে না, কে জানে!
‘সাবধানে বাড়ি যাবি। বাড়ি পৌঁছে নিজেকে ভালোভাবে পরিষ্কার করবি। আর বিকেলে আসার দরকার নেই,আমি একা চলে যাব।’ স্বাভাবিকভাবে কথা বলল কাবেরী। তারপর হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো। শুভজিৎ মুচকি একটা হাসি দিয়ে বিদায় নিল।এতক্ষণে বৃষ্টি কমে গেছে।সারাদিন বৃষ্টি হলেও স্কুলের টাইমে ঠিক বন্ধ হয়ে যায়। এটা যেন ভগবানের কারসাজি। তিনি ইচ্ছে করে এইসব করেন। সবার কষ্ট বুঝলেও তিনি কখনও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কষ্ট বোঝেন না। সকালে বৃষ্টি দেখে কত ছাত্র ছাত্রী আসা নিয়ে বসে থাকে, আজ স্কুলে যেতে হবে না। কিন্তু স্কুল টাইমে ঠিক বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। এটা এক প্রকার বিরক্তকর।

বৃষ্টিমুখর দিনে স্কুলের স্টুডেন্টের সংখ্যা খুবই নিম্ন। ভালোমতো ক্লাস হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সে দিকেই নজর সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর। তানভীর স্যার ক্লাসের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের মধ্যে অদ্ভুত এক মৌনতা নেমে এসেছে। ওটা দীর্ঘদিনের পাওনা তানভীর স্যারের। সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকার ক্লাসে হালকা গুনগুন শব্দ হলেও,উনার ক্লাসে পিনপতন শব্দও পাওয়া যায় না। এই নিয়ে তিনি ভীষণ গর্ববোধ করেন। আবার অনেক শিক্ষক এটাকে সহ্য করতে পারেন না। সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমান রেসপেক্ট করা উচিত, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা করে না। তারা সবার সামনেই অন্যান্য স্যারের তুলনায় তানভীর স্যারকে একটু বেশি রেস্পেক্ট করে। এই বিষয়টি অনেক শিক্ষক শিক্ষিকার পছন্দ নয়। তাই ইচ্ছে করে তানভীর স্যারের সঙ্গে মনকষাকষি করে আছেন। তবে আজ তানভীর স্যারকে অন্য রূপে দেখা গেল। তিনি ভীষণ খুশি। ক্লাসের মধ্যে এসে প্রথমে পড়া শুরু করলেন না। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন জীবনযাপন নিয়ে আলোচনা করলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ঠিক বুঝতে পারল না তানভীর স্যার আজ এত খুশি কেন? গত কয়েকদিন আগে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়েছে। স্কুলের অর্ধেকের বেশি ছাত্র-ছাত্রী ফেল করেছে। ফেল করা ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজিতে সত্তর শতাংশের বেশি নাম্বার পেয়েছে। এর চাইতে খুশির খবর কি হতে পারে!তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন কঠোরতা দিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের কেবল মানুষ করা যায়। উনার আইন এবং উনি সঠিক ছিলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে অগাত প্রশংসা পেয়েছেন। তাই তিনি এত খুসি। কথার ছলে ছলে তিনি একসময় কিরণকে উঠে দাঁড়াতে বললেন। কিরণ ক্লাস এইটের ছাত্র। প্রায় তিন বছর একই ক্লাসে পড়ছে। পাস করার কোনো নামই নেই। এতদিন সে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে। বিলাসবহুল ভাবে জীবন যাপন করে। কোনো কাজে তার মনোযোগ নেই। তবে বাবার প্রতি ভীষণ আনুগত্য। উনার সমস্ত কাজে সাহায্য করে। মাঠে যায়, মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে বাজারেও যায়।
‘তোর দাদা তো ফেল করে গেল। দুজনের দ্বারা কিছুই হবে না।’
কিরণ মাথা নিচু করে থাকলো।এত জনের সামনে এই কথাটি না বললে হতো না তানভীর স্যারের? তার মাথা গরম করে ছাড়লো। ক্লাসমেটরা স্যারের সামনে হাসতে না পারলেও মনে মনে ভীষণ হাসছে।তা সে অনুমান করতে পারছে। এর বদলা ঠিক নেবে। বড় হয়ে পুলিশ হবে। কোনো কারন ছাড়াই তানভীর স্যারকে গ্রেপ্তার করবে। তারপর দেখাবে মজা। তাকে অপমান করা,ক্লাসে পড়া না পারলে শাস্তি দেওয়া, সমস্ত বদলা নেবে। কিরণকে কিছু বলতে না দেখে তানভীর স্যার আবার বললেন,’তোর দাদা পারেনি তো কি হয়েছে তুই চেষ্টা কর, আর কতদিন একটা ক্লাসে থাকবি? মানুষের লজ্জা বলে তো কিছু থাকে। তুই সেটাও বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিস।’ কিরণ মাথা নিচু করে শুধু শুনে গেলে কিছু বলতে পারলো না। সময় এলে এর উত্তর ঠিক দেবে। তার নাম কিরণ মন্ডল এতো সহজে হার মানবে না। মন্ডল পাড়ার ছেলে সে। কোনো স্যারকে ভয় পায় না। স্যারের মুখের উপর তর্ক করতে দ্বিধাবোধ করে না। শুধু এক অজানা কারণে তানভীর স্যারকে ভয় পায়।মাঝেমধ্যে ভাবে উনার উপরেও কথা বলবে কিন্তু পারে না। মনের ভেতর কে যেন বাধা দেয়। এক অদৃশ্য আত্মা বলে ওঠে উনাকে রেস্পেক্ট কর। তবেই মানুষ হতে পারবে। না হলে সারা জীবন ছদ্দবেশী মানুষ হয়ে থেকে যাবে।
নানা কথাবার্তার মধ্যে ক্লাস চলতে থাকলো। সবাই একটা জিনিস ভালোভাবে লক্ষ্য করতে পারে স্যার কিশলয়ের প্রতি ভীষণ দুর্বল। তিনি সম্ভবত ওই ছেলেটাকে একটু বেশি ভালোবাসেন। তাকে ভালোবাসার অনেক কারণ রয়েছে। সে কখনো স্যারের অবাধ্য হয় না। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন করে আনে। এখনো পর্যন্ত স্যারের হাতে একদিনও মার খায়নি,যেখানে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা সপ্তাহে কোনো না কোনো কারনে একবার অন্তত মার খিয়ে থাকে। তানভীর স্যার প্রকাশ্যেও কিশলয়ের প্রশংসা করেছেন। উনার যোগ্য ছাত্র কেবল কিশলয়। উনার মতো ছাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিশলয় খুব শান্তশিষ্ট। খেলাধুলো একদমই পছন্দ নয়। সারাক্ষণ বইখাতা নিয়ে বসে থাকে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি প্রচুর গল্প বই পড়ে। নতুন জিনিস জানার প্রতি ভীষণ আগ্রহ। নতুন জিনিস জানতে চাইলে সে সোজা তানভীর স্যারের কাছে চলে যায়। স্যার শত ব্যস্ত থাকলেও তাকে সাহায্য করে। তাকে বলাও ভুল, কারণ একই নিয়ম সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অফিসে হাজারো ব্যস্ততা থাকলেও তিনি কখনো কোনো ছাত্র ছাত্রীকে ফিরিয়ে দেন না। যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তাকে সাহায্য করার। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী তুলনায় কিশলয়ের নতুন জিনিস শেখার প্রতি আগ্রহ মারাত্মক। এই বিষয়টি ভীষণ পছন্দ তানভীর স্যারের। কিশলয় ছাড়া তেমন আগ্রহ তিনি আর কারোর মধ্যে খুঁজে পাননি।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। স্কুল থেকে বেরিয়ে কাবেরী বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করে। তখনই পেছন থেকে কিরণ ডাকলো। কিরনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বরাবরই ভালো। খুব ভালো বন্ধু। বয়সে বড় হলেও কখনও খারাপ আচরণ করেনি। কিরণ বেশিরভাগ সময় হোম ওয়ার্ক করে আনে না। কাবেরীর খাতা দেখে টুকে দেয়। কাবেরী ভাবল,আজও হয়তো কিছু সাহায্য চাইবে।সে হাসিমুখে বলল,’কিছু বলবে?’
‘না, আসলে…..।’ আমতা আমতা করতে লাগল।
‘আরে বাবা কি বলবে বল না। মেঘ উঠেছে বৃষ্টি আসবে তো।’
‘আসলে,তোকে একটা জিনিস দিতে চাই।’
‘এতে এত ভাবার কি আছে? যা দেবে তাড়াতাড়ি দাও।’
কিরণ ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কাবেরীকে দিল। কাবেরী কাগজের ভাঁজ খুলতে চাইল।কিরন বাধা দিয়ে বলল বাড়িতে গিয়ে খুলতে। এখানে খোলার দরকার নেই। তারপর ছুটে চলে গেল। কাবেরী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কাগজের মধ্যে কি রয়েছে? যা এখানে খোলা যাবে না। ভীষন কৌতুহলী হয়ে উঠল।

বিকেলে শেষ সূর্য রশ্মি লালা আভায় ভরিয়ে দিয়েছে আকাশ। দূরদূরান্ত থেকে পাখিদের কুঞ্জন ভেসে আসছে।নিজের রুমের মধ্যে বসে তানভীর স্যার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস পড়ছেন। স্ত্রী আমিনা জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত। এবং আপন-মনে রবীন্দ্র সংগীত গাইছেন। অনেকক্ষণ একই রকম চলল। হঠাৎ,তানভীর স্যার বইটি বন্ধ করে টেবিলের ওপর রাখলেন। গুন গুন করে বললেন,’সংসার বড্ড বিচিত্র। এখনো কিচ্ছু বদলায়নি। সব আগের মতো রয়েছে।’ আমিনা গান থামিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। স্বামী চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখেছেন। আপন-মনে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে পরিবেশ উপভোগ করছেন। চোখে মুখে ক্লান্তির রেখা স্পষ্ট। উনার দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমার কাছে সবই বিচিত্র।’ আমিনার কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন না তানভীর স্যার। শুধু একবার চোখাচোখি করলেন।চুপচাপ বসে রইলেন। আমিনার জামা কাপড় গোছানো শেষ হতেই স্বামীর কাছে গিয়ে বসলেন। উনার পিঠে হাতে রেখে বললেন,’কতদিন হলো কোথাও ঘুরতে যাইনি, চল না একবার বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। শহর-গ্রাম ছেড়ে দুর দুরান্তে,কোথাও নিরিবিলি জায়গায় বেড়াতে যাই।’ আমিনার কথা মন দিয়ে শোনলেন। উনার মখমলে চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,’কি বলছো তা তুমি জানো। এখন আমাদের ঘোরার বয়স নয়। ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করছে,তারা ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। এখন আমাদের তাদের পাশে থাকতে হবে।ঘোরার জন্য অনেক সময় আসবে, কিন্তু ছেলে মেয়েদের বয়স পেরিয়ে গেলে তারা মানুষ হতে পারবে না।ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে তো আবার আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে,আমরা তাদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি। এই অভিযোগ কখনো শুনতে চাই না।’
‘সারাজীবন সংসার নিয়ে থাকো। নিজেদের কথা ভাববে না কখনো? দেখব,বুড়ো বয়সে ছেলে মেয়েরা আমাদের কত দেখাশোনা করে! সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কেউ কখনো কারোর ছিল না, আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। দেখবে,ছেলে মেয়েও এক সময় পর হয়ে যাবে।’
‘আমিনা,আমার ছেলেমেয়েরা কখনো আমাদের পর করে দেবে না। আমি নিজের হাতে তাদের গড়েছি। সহজে বদলে যাবে না।’
আমিনা হাসলো। কথা বলতে বলতে তাঁর কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ এবং চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠেছে। স্বামীর কাঁধে হাত রেখে বললেন,’তোমার কি মনে হয়, তুমি ওদেরকে শাসন কর, তাই তারা তোমাকে ভয় পেয়ে তোমার কথা শুনবে। তারা শাসনকে মোটেও ভালো ভাবে নেয় না। বরং তোমার ওপর রাগ করে।রাগ জমতে জমতে পাহাড় সমান তৈরি হয়ে গেছে। সেই রাগ তারা একদিন ঠিক মেটাবে তোমার উপর দিয়ে।আমি তাদের চোখে মাঝেমধ্যে তোমার প্রতি ঘৃণা দেখেছি।’
‘না আমিনা! আমি বলছি আমার ছেলে মেয়েরা এমন হবে না। তারা এখন ছোট। কোন বয়সে কি করতে হবে তারা জানে না। তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ারটা আমাদের কর্তব্য।’
‘তা তো সময় বলবে, কোনটি ভুল আর কোনটি সঠিক!’
দুজনেই চুপ করে গেলেন। খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর আবার আমিনা বললেন,’আমার একটা কথা রাখবে!’
‘বল?’
‘ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়েছে। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দাও। এই বয়সে আর শাসন করে কোনো লাভ হবে না। তাদের স্বাধীনভাবে থাকতে দাও। অযথা সমস্যা বাড়িয়ে লাভ কি, বল?’
তানভীর স্যার মৃদু হাসলেন। হঠাৎ-ই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্ত্রীর দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,’স্বাধীন,মুক্ত এগুলো চেয়ে তো আজ গোটা বাঙালি জাতিটাই শেষ হয়ে গেল। জানো আমিনা, তুমি একটু বাড়ির বাইরে গিয়ে মানুষজনকে জিজ্ঞেস কর,তাদের প্রিয় সাহিত্যিক কে? বেশিরভাগ মানুষ বলবে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র,শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ ইত্যাদি। জিজ্ঞেস করবে, বাংলায় তারা কোন গান বেশি শুনতে পছন্দ করে? বেশিরভাগ মানুষ বলবে,নজরুল সঙ্গীত নয়তো রবীন্দ্রসঙ্গীত অথবা মান্নাদের গান। জিজ্ঞেস করবে বিখ্যাত বাঙালি সিনেমা পরিচালকের নাম? তারা বলবে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন,ঋত্বিক ঘটক। সবশেষে তুমি জিজ্ঞেস করবে কয়েকজন বিখ্যাত বাঙালির নাম বলতে। তারা অনায়াসে বলবে, বিদ্যাসাগর,রাজা রামমোহন রায় আবার ঘুরে ফিরে সেই নজরুল,বঙ্কিম চলে আসবে।শুধু তাদের কেন, তোমাকে জিজ্ঞেস করলেও তুমিও একই উত্তর দেবে।কিন্তু একবার খেয়াল করে দেখো তো তাদের জন্ম কবে? ওরা কি আজকের দিনের মানুষ? ওরা কি এই দশকের মানুষ? তা তো নয়। ওরা দুই দশকের আগেকার মানুষ। আর আমরা এখনো তাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তারা আমাদের গর্ব। আজীবন তাদেরকে নিয়ে আমাদের বাঁচতে হবে। কিন্তু তার মধ্যে নতুন কিছু আসা দরকার। দুটো দশক পেরিয়ে গেছে তেমন কোনো নতুন বাঙালিকে পেয়েছো? পেলেও হাতেগোনা একটা কিংবা দুটো। কোনো বাঙালির মধ্যে নজরুল কিংবা সত্যজিৎ কে খুঁজে পেয়েছো? তাহলে কি আর বাঙ্গালির প্রতিভার জন্ম হয় না? শুধুমাত্র আঠারো দশকে জন্ম নিয়েছিল। তা কিন্তু নয়। ওই যে এখন একটা জিনিস চলে এসেছে স্বাধীন মুক্ত জীবনযাপন। আসলে এখনকার মানুষদের মধ্যে জানার আগ্রহ খুবই কম। শুধু আড্ডা দিয়ে, অন্যের সমালোচনা করে সময় কাটাতে চায়। আগেকার দিনে ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ক’ বললে, তারা পুরো কলকাতার ইতিহাস জানতে চাইতো। তারপর আস্তে আস্তে করে সেটা হারিয়ে যেতে লাগলো। আর এখন তো ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার আগে সাজেকশন চায়। আর কয়েকবছর যাবে,তারা সাজেকশন দিলে সেই সাজেকশনকে নিজের মতো করে আবার একটা সাজেকশন বানিয়ে ফেলবে। তারপর কি হবে তা আমার জানা নেই।’
দীর্ঘ বক্তব্য রাখতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেন তানভীর স্যার। আমিনা জল এনে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্লাস জল শেষ করে দিলেন। তবুও যেন উনার তৃষ্ণা মিটলো না। উনি আরও কিছু বলতে চাইছিলেন।কিন্তু আমিনা ঘোলাটে মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। আমিনার এই সমস্ত কথা শুনতে ভালো লাগছে না। দেশ,জাতি এগুলো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে খুব ছোট্ট জগতে বসবাস করে। সে ছোট্ট জগতে হাসি খুশিতে থাকতে চায়। কোথায় কি হচ্ছে তা জানতে চায় না। তার পরিবার খুশি থাকলে সে খুশিতে থাকবে। এটুকু হলেই তাঁর হবে। তানভীর স্যার স্ত্রীকে অনেকটা কাছে টেনে নিলেন। আমিনা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেন। স্যার বললেন,’ছাদে যাবে? অনেকদিন যাওয়া হয়নি। চল পাশাপাশি বসে গল্প করি। কতদিন হয়ে গেছে নিজেদের মনের যত্ন নেওয়া হয়নি।’
‘এই বয়সে তোমার আবার ভীমরতি ধরলো নাকি! লোকে দেখলে কি ভাববে?’
‘জানো, মানুষের সবচেয়ে বড় রোগ কি?’ একটা বিব্রতকর হাসি দিয়ে বলল তানভীর স্যার।
‘কি।’
‘লোকে কি বলবে? লোকে কি বলবে? এই কথা ভেবে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের প্রিয় কাজ করে না। যেখানে সে তৃপ্তি পাবে সেই কাজ ছেড়ে দেয়।তুমি ছাদে আমার পাশে বোসতে চাইছো না, লোকে বলবে বুড়োবুড়ি এই বয়সে এসে প্রেম করছে তাই….. আমার ছাদে না গেলে আবার কিছু মানুষ বলবে ওদের শুধুমাত্র যৌবনে প্রেম ছিল। এখন হারিয়ে গেছে। আশেপাশে মানুষ অনেক সময় অনেক কথা বলবে। তাদের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের সব কথায় কান দিতে নেই। ওদের ভালোলাগায়-খারাপলাগায় কেন আমরা নিজেদের বিশেষ মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলবো?’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here