মাস্টারমশাই
পর্ব ৮
শুভজিৎ জানা
_______________
বহতা নদীর মতো এগিয়ে চলে জীবন। নতুন ঘটনা, নতুন অভিজ্ঞতা, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা বাঁকে বাঁকে যে জীবন নিজেকে সম্পন্ন করে। ছোট ছোট স্মৃতি আজীবন থেকে যায়। স্মৃতিকে ঘিরে বেড়ে উঠে মানুষের জীবন। শুভজিৎ বাড়ির উঠোনে কাবেরীর একটা পুরনো বই খুলে বসে আছে। বইয়ের মধ্যে যেখানে যেখানে ‘শ’ দিয়ে কোনো শব্দ রয়েছে সেই শব্দগুলো কেটে দিয়ে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করছে। এর আগে আরও একটা বই এমনটা করে ফেলেছে। এর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে এক তৃপ্তির স্বাদ। কাবেরী তাকে বারন করেনি। খুশি হয়েছে তার আনন্দতে। মাকে বললে রক্ষে নেই। তিনি আবার বইতে আন্ডার লাইন করা কিংবা কোনো শব্দ কেটে নিজের নাম লেখা একদম পছন্দ করেন না। জানতে পারলে মারবেন। কয়েকদিন আগে কাবেরী নিজেই অংক বইতে একটা মেয়ের নাম কেটে নিজের নাম লিখে দিয়েছিল। তাতেই কত মার খেলো সে। তারপর পায়েল দেবী প্রতিটি বই চেক করেছিলেন, এমন ভাবে আর করেছে কিনা!তারপর থেকে বইতে অন্যর নাম কেটে নিজের নাম লেখার সাহস পায়নি। শুভজিৎ বই চাইতেই পুরোনো বই ধরিয়ে দিয়েছে। নতুন বইতে দাগ করলে তার মা আস্ত রাখবেন না। মাকে একটু কাজে সাহায্য করে এসে শুভজিৎ এর পাশে বসল।শুভজিৎ এর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বেহুশের মতো বইতে শব্দ খুঁজে যাচ্ছে। কাবেরীর সৌম্য শান্ত শরীর আজ একটু ঝিরঝির করে উঠেছে।খুসিতে ফেটে পড়েছে। পাখির মতো নীল আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে। তাকে সদ্য খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখির মতো দেখাচ্ছে।সে শুভজিৎ কে জোরে একটা ধাক্কা দিল। শুভজিৎ মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে পেঁচিয়ে তাকে দেখল। অল্প সময়ের মধ্যে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার বইয়ের মধ্যে নিজের মনকে নিমজ্জিত করল। কাবেরী ব্যাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠল।
‘তুই আমার কথা শুনবি না তো, তাহলে আমি চললাম।’ শুভজিৎ তার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। বইয়ের দিকে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল।কাবেরী বিরক্ত হয়ে বই ছাড়িয়ে নিয়ে বন্ধ করে দিল।রাগে কটমট করছে সে। তার কথা অগ্রাহ্য করছে শুভজিৎ।
‘বলেছি না আমার কাজে বিরক্ত করতে না। আমাকে কাজ করতে দাও।’ শুভজিৎ এর কথা শুনে কাবেরীর রাগান্বিত মুখখানি মুহূর্তের মধ্যে হাসিতে ভরে উঠলো। শুভজিৎ এর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বলল,’তুই আবার কোন মহান কাজ করছিস শুনি?’
‘দেখতে পাচ্ছ না বুঝি?’
কাবেরী দাঁড়িয়ে পরল। হি হি করে হাসলো।
‘একটা জায়গায় যাবি?’
‘কোথায়?’
‘বটতলা।’
‘এতদুর কেউ হেঁটে যায়? তুমি যাও আমি পারবো না।’
‘ওরে নবাবের বেটা, সারাদিন তো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াস। আর আমি যেতে চাইছি যাবি না। ঠিক আছে একা যাবো। তুই এখানে একা থাক।’ কাবেরী বাড়ির পেছনের দিকে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে,তার পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল শুভজিৎ। সেখানেই পড়ে থাকল পুরনো বই। আড়চোখে কাবেরী লক্ষ্য করলো তার পেছনে পেছনে শুভজিৎ আসছে। হাসি পেলেও হাসলো না। মুখটা গম্ভীর করে রাখল। শুভজিৎ বারবার বলছে,আমি যাব।আমাকে নিয়ে চলো। কাবেরী কিছু না বলে গনগন করে হাঁটতে লাগল। শুভজিৎ একসময় তার পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো। আমাকে না নিলে তোমাকে যেতে দেব না। কাবেরী আর হাসি থেমে রাখতে পারলো না। তার গাল দুটো টিপে দিয়ে মায়ের কাছে ছুটে আসলো। মা খুব তাড়াতাড়ি পারমিশন দিয়ে দিলেন যাওয়ার জন্য।পায়েল দেবী দুজনকে পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে দিলেন,মাথা আঁচড়ে দিলেন, আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুজনকে দু টাকা করে দিলেন -কিছু কিনে খাওয়ার জন্য, এবং অবশ্যই জুতো পরে বাইরে যেতে বললেন। শুভজিৎ কিছুই বুঝতে পারলো না। বাড়ির বাইরে কিছুটা সময় থাকলে পায়েল দেবী খিটখিট করেন। অথচ আজ তিনি বাড়ির বাইরে যেতে দিচ্ছেন, আবার ভালো করে পরিপাটি করে গুছিয়েও দিলেন।সবটাই কল্পনা মনে হচ্ছে শুভজিৎ এর কাছে।ওই সব নিয়ে বেশি ভাবলো না।দুজন দুজনের হাত ধরে অনেকটা পথ হাঁটে,আবার খানিকটা পথ দৌড়ে যায়।সামনে কোনো বিশেষ বস্তু কিংবা বড় গাছ দেখতে পেলে, বস্তুটি কে আগে ছুঁতে পারবে বলে দৌড়ে যায়। বেশিরভাগ সময় কাবেরী আগে পৌঁছে যায় তখন শুভজিৎ এর মন খারাপ হয়ে যায়। তার মন ভালো করার জন্য কাবেরী পরেরবার ইচ্ছে করে হেরে যায়।চারিদিকে গাছপালায় ভর্তি। ইটের রাস্তা।পথে মানুষের চলাফেলা খুবই কম। যেদিকে চোখ যায় মনে হয় সীমাহীন নীল সমুদ্র। সবুজের সমারোহ। দুজন দুজনের অর্থহীন কথাবার্তায় শুধু হেসেখেলে যাচ্ছে। কিন্তু শুভজিৎ কিছু একটা খুঁজছে।এত দূরে যাওয়ার কারন জানে না। কয়েকবার নিলেশ বাবুর সঙ্গে এখানে এসেছে। তাছাড়া আর আসা হয়নি।মাত্র দুদিন আগেই কাবেরী মায়ের হাতে মার খেয়েছে। এখনো দাগ গুলো উঠে যায় নি। পায়ে লাল কটকটে দাগ গুলো এখনো আছে। অথচ আজ আনন্দের সীমানা হারিয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে স্কুল ফেরার সময় কিরণ একটা চিঠি দিয়েছিল। কাবেরী বাড়িতে এসে লুকিয়ে চিঠিটি পড়ে। কিরণ তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানে কাবেরী কাছে প্রায় নতুন একটা অর্থ।এই অর্থের সমাধান করতে জানে না। তার কাছে ভালোবাসা মানে তার বাবা-মা আর শুভজিৎ।এর বাইরেও যে ভালোবাসা হয়, জানে না। তবে কিরণ চিঠি দেওয়ার পর তার মধ্যে আলাদা এক অনুভুতির জাগরণ হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুভূতির নাম জানে না। তার কাছে প্রেম মানে পাপ।তার ধারণা প্রেম মানে বড় একটা ভুল। একবার রঘু একটা মেয়েকে প্রেম নিবেদন করেছিল।তার বাবা জানতে পেরে প্রচুর মেরেছিল। গ্রামের মধ্যে একটা হুলস্থূল পড়ে গেছিল। সেদিন সবাই মিলে রঘুকে কত খারাপ কথা বলেছিল। সেখান থেকেই কাবেরী বুঝেছে,প্রেম মানে খারাপ।প্রেমের আসল মানে জানে না। জানতেও চায় না। কোনো বড় ভুল করতে চলেছে সে। এই কথা ভেবে, মাকে চিঠিটি দিয়ে দেয়। ভেবেছিল মা নিশ্চয়ই কিরণকে বোকবেন। তার কোনো দোষ দেখতে পাবেন না। কিন্তু পায়েল দেবী সম্পূর্ণ উল্টাটা ভেবেছিলেন। তিনি কিরনের দোষ দেখতে পাননি। দোষ দেখতে পেয়েছিলেন নিজের মেয়ের মধ্যে। চিঠি পড়া শেষ হতেই কাগজটি উনুনের মধ্যে ফেলে দেয়।তারপরে নিম গাছ থেকে একটা সরু ডাল ভেঙ্গে আনে। হঠাৎ করে তিনি বদলে যান। উনার শিরায় কিছু একটা আঘাত করছিল সেই আঘাত মেটালেন নিজের মেয়ের উপর। একটা মারও মাটিতে ফেলেননি, সবকটা মেয়ের পায়ে ফেলেছিলেন। উচ্চস্বরে বলেছিলেন, স্কুলে এইসব করতে যাওয়া হয়?এই বয়েসে প্রেম? মাথা ফাটিয়ে রেখে দেবো।বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দেবো।এই বয়েসে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু দেখতে চান না তিনি। কাবেরী অনেক কেঁদেছিল। অনেক কাকুতি-মিনতি করে ছিল কিন্তু তিনি শোনেননি। লাঠি না ভাঙ্গা পর্যন্ত পায়ে আঘাত এনেছিলেন। কেউ বাধা দেয়নি। যন্ত্রণায় ছটফট করে গেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। কিন্তু মাকে থামাতে পারেনি। মার না খেয়েও কেঁপে উঠেছিল শুভজিৎ। সেদিন পায়েল দেবীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ছিল দু’জনে। মার খাওয়ার পর থেকে তার ভীষণ রাগ হয় মায়ের উপর। তার তো কোনো দোষ ছিল না। সমস্ত দোষ কিরনের, অথচ মার খেলো সে। বাবা এলে সব বলবে এমনটা প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই সবকিছু ভুলে গেছে। খুশিতে মত্ত হয়ে আছে। তার খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতে দেখে শুভজিৎ বলল,’আচ্ছা, আমরা এতদূর কি করতে যাচ্ছি?’
কাবেরী বারবার রাস্তার এ-পাশ ও-পাশ হতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল,’জানিস না তুই? আজ শহর থেকে বাবা আসবে?’
‘বাবু তো মাঝে মধ্যে আসেন। কিন্তু আমরা তো কখনো এত দূরে আসি না!’
‘আরে বোকা, আজকে বাবা আমার জন্য সাইকেল নিয়ে আসবে। তাইতো এত দূরে আসলাম। এইখান থেকে দুজন মিলে সাইকেল নিয়ে যাব কেমন।’
শুভজিৎ চুপ হয়ে গেল। সাইকেল কাবেরীর আসবে তাতে তার কি? সে তো তাদের বাড়িতে কাজ করার জন্য আছে। তার বড় বড় স্বপ্ন দেখা কখনো উচিত না। ওইগুলো বড়লোকেদের ব্যাপার। তার কল্পনা করাটাও পাপ। তবুও এক অজানা কারণে সে কষ্ট পাচ্ছে। কেন কষ্ট হচ্ছে জানে না। আচ্ছা, তার যদি বাবা-মা থাকতো তাহলে তাকেও নিশ্চয়ই সাইকেল এনে দিত। নিজে না খেয়েও ছেলের আবদার পূরণ করতেন।সে কোনোদিন কারোর কাছে আবদার করতে পারল না। আসলে, যার বাবা নেই তার কোনো দামি আবদারও নেই। বাবা থাকলে নিশ্চয়ই পড়াশোনা করতো। যেখানে খুশি যেতে পারত। তাকে কোনো কাজ করতে হতো না। অনেক আদর অনেক যত্ন পেয়ে বড় হতো।তার তো আদর-যত্নের কোনো কিছুর অভাব নেই। তবে সেগুলো ভাবছে কেন?কারোর একটা অনুপস্থিতি তাকে দগ্ধে দগ্ধে মারছে। মাঝেমধ্যে তার কাবেরী ওপর ভীষণ হিংসা হয়। তার সব কিছু রয়েছে। যখন যা চায় তা পেয়ে যায়। তার মা-বাবা রয়েছে, বই-খাতা, ছাতা, জুতো জামা সবকিছু নতুন।সে কেন পুরনো বই পড়বে? কেন সে কাবেরীর ব্যবহার করার জিনিসগুলো ব্যবহার করবে? নিজের বলে কি কিচ্ছু নেই? কাবেরী যখন যা চায় তা পেয়ে যায়। কিন্তু সে তো কখনো পেল না। ভগবান এত নিষ্ঠুর কেন?যাকে দিয়েছেন তাকে দু-হাত ভরে দিয়েছেন, আর যাকে দেননি তাকে এক আনাও দেননি। কাবেরী শুভজিৎ এর মনের কথা ঠিক বুঝে নিল। তার মনের মধ্যে কি চলছে সে বুঝতে পারল।হয়তো,এইজন্য কেউ কেউ বলে, শুধু বয়সে বড় হলে হয় না, অনেক সময় মনটাকেও বড় করতে হয়।বয়সে তো অনেকে বড় হয়েছে,কিন্তু মানুষ কয়জনকে মনে রেখেছে। কেউ কেউ তো বয়সে অনেক ছোট থেকেও বড় হয়ে আছে। শুভজিৎ এর কাঁধে হাত রেখে একগাল হেসে বলল,’চিন্তা করিস না। আমার সাইকেল মানে তোর সাইকেল। আমার সবকিছুই তোর। এতে মন খারাপ করার কি আছে?’ খুশিতে শুভজিৎ এর চোখে জল চলে আসলো। মুখের ভাষা হারিয়ে গেল। ছোট মেয়েটি তার মনের কথা বুঝতে পেরে যায়। অথচ বাবু আর মালিক কখনো তাকে বুঝলো না। তার কোনটাতে ভালো লাগে কোনটাতে খারাপ লাগে সেটাকে কখনো অগ্রাধিকার দিল না।
প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি হাঁটার পর তারা বটতলায় পৌঁছে গেল। মানুষের শোরগোল চোখে পড়ার মতো।শহর থেকে সমস্ত গাড়ি এখানে এসে থামে। কিছু কিছু গাড়ি ময়ূরগঞ্জে যায়। তার পরিমান খুবই সামান্য। নিলেশ বাবু সাইকেল নিয়ে আসবেন।তাই তিনি লরি করে আসবেন। লরি ময়ূরগঞ্জে যায় না। তাই কাবেরী এখানে ছুটে এসেছে। আশেপাশে অনেকক্ষণ বাবাকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু পেল না। উনার আসতে নিশ্চয়ই দেরি হবে। শহর থেকে কোনো গাড়ি সঠিক সময়ে আসে না। তার বাবার গাড়ি যে সঠিক সময়ে আসবে তার কোনো মানে নেই। এ-দিক ও-দিক ঘুরতে ঘুরতে তারা বটতলার কাছে গেল।বট গাছে ঝুলে থাকা শেকড় গুলো ধরে ঝুলতে লাগলো। এদিক ওদিক করে বেশ জোরে জোরে দুজন দুলল।
স্কুলের শেষ ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী হইহুল্লোড় করে বেরিয়ে যেতে লাগলো। বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীর বাড়ি পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের মধ্যে এবং নিম্ন পরিবারে। তারা বেশ জটলা বেঁধে বাড়ি ফিরতে লাগলো। শিক্ষক শিক্ষিকা নিজেদের গন্তব্য স্থলে ফিরল। আবার কিছু ছাত্র ছাত্রী কোনো গাছের আড়ালে লুকিয়ে প্রেম করতে লাগলো। তাদের যাতে কেউ দেখতে না পায় কিংবা সাবধানতার জন্য সামনে রয়েছে আর এক ছাত্র বা ছাত্রী। সেই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় সময় সিঙ্গেল থাকে। সারা জীবন বন্ধুকে সাহায্য করে কাটিয়ে ফেলে। শুভজিৎ কাবেরীর অপেক্ষায় স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নতুন নতুন পোশাক পরে বেরিয়ে যাওয়া স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দেখছে সে।তারও ইচ্ছে করে তাদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে, একই সঙ্গে ঘুরতে। কিন্তু সবার ইচ্ছে তো পূরণ হয় না। মানুষের জীবনের সব ইচ্ছে যদি পূরণ হয়ে যায়, তাহলে সে কার পেছনে ছুটবে?কিছু ইচ্ছে পূরণ না হওয়াই ভালো। অনেক অপেক্ষা করার পর কাবেরী আসলো। তার চোখের কোনে জল। মুখ শুকিয়ে রয়েছে, ঠোঁট দুটো উস্কোখুস্কো, চোখের ক্লান্তি রেখা স্পষ্ট, ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না,তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেকদিন অভুক্ত রয়েছে। শুভজিৎ তার কাছে ছুটে গেল। তার কাছ থেকে স্কুল ব্যাগ নিয়ে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। তারপর হাসিমুখে জানতে চাইল তাকে এমন করুণ দেখাচ্ছে কেন? সকালে তো বেশ সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। কাবেরী কোনো কথা বলল না। বারবার শুধু কেঁপে যাচ্ছে। শুভজিৎ ছাড়ার পাত্র নয়। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকলো।কাবেরী এক সময় বিরক্ত হয়ে সব কিছু বলল।সে আজ পড়া করতে পারেনি।তানভীর স্যার তাকে আজ দুশো বার কান ধরে উঠবস করিয়েছেন সঙ্গে উদোম ক্যালানি দিয়েছেন। কয়েকদিন আগে দ্বিতীয় ইন্টার্নাল এক্সামের খাতা বের হয়। সবাইকে খাতার উপরে গার্জেনের সই করে নিয়ে আসতে বলেন। কাবেরী কম নাম্বার পাওয়ায় সে বাবার কাছে সাইন করতে সাহস পায়নি।কম নাম্বার পিয়েছে জানলে তার বাবা খুব মারবেন,তাই কিরণের কাছ থেকে সাইন করে নেয়। কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গেছিল সে তানভীর স্যারের খাতায় বেয়াদবি করছে। উনার চোখকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। দেখামাত্রই বুঝে গেছিলেন, কিরনের হাতের অক্ষর। তিনি এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কাবেরী উপর বজ্রপাতের মত আঘাত করতে লাগলেন। তার ক্লাসে প্রথম বেয়াদবি করার সাহস দেখালো কাবেরী। তিনি আরও বেশি রেগে গেলেন।পরেরবার যাতে এমন বেয়াদবি কেউ দেখাতে না পারে,তাই তিনি কাবেরীকে দুশো বার কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। অনেক কষ্ট হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিল সব ছেড়ে চলে যেতে। কিছুতেই কান ধরে উঠবস করবে না,কিন্তু কি হলো?শেষ পর্যন্ত স্যারের কাছে মাথানত করতে হলো। কাবেরী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে এমন ভুল সে দ্বিতীয়বার করবে না। সমস্ত ঘটনা শুনে হা হা করে হেসে উঠলো শুভজিৎ।
‘আমার এই অবস্থা দেখে তুই হাসছিস?’
‘তাহলে কি করবো?’
কাবেরী রাস্তায় বসে পরলো। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। হাঁটার শক্তিটুকু হারিয়ে গেছে। তার এখন কি করা উচিত? সে কি তার মাকে গিয়ে সব কিছু বলবে?তার মা থানায় অভিযোগ করবেন। স্যারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। স্যারের শাস্তি হবে। সেও চায় স্যারের শাস্তি হোক। স্যারের নির্দয় হৃদয় গলে যাক। এই অত্যাচারের প্রতিবাদ হোক। কিন্তু তার মা আদৌ কি এইসব করবেন? কাবেরী জানে,তার মা কিছুতেই থানায় যাবেন না। বরং তাকে আরও বেশি মারবেন। শুভজিৎ তার পাশে বসলো।কাবেরী আস্তে আস্তে করে পায়ের ফুলপ্যান্ট উপরের দিকে তুললো। তার পায়ের অবস্থা দেখে ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠল শুভজিৎ।বেশ লম্বা মোটা মোটা লাল দাগ হয়ে ফুলে গেছে। শুভজিৎ স্পর্শ করতেই কাবেরী অস্পষ্ট ভাবে চিৎকার করে উঠলো। ভীষণ ব্যথা। স্পর্শ করতে বারণ করল।
‘তুই বাড়িতে গিয়ে কিচ্ছু বলবি না। মা জানতে পারলে আমাকে আরও মারবেন।’
‘ঠিক আছে।’
‘মনে থাকে যেন। তুই তো আবার ভোলা মহেশ্বরের মত সবকিছু ভুলে যাস।’
‘ভুলবো না। মনে থাকবে ঠিক।’ কোনো রকম ভাবে বাড়ি ফিরল তারা। মাকে কিছুতেই বুঝতে দিল না তার পায়ে করুণ অবস্থার কথা। সারা বিকেল ফুল প্যান্ট পরে রইল। মাঝেমধ্যে পায়ের দাগ গুলো তে থুতু লাগিয়ে হাত দিয়ে ঘষতে লাগলো। যাতে দাগ গুলো মিলিয়ে যায়। বিকেল থেকে রাত গড়ালো কিন্তু পায়ের দাগ কিছুতেই মিলল না। এখনো স্পষ্ট ভাবে দাগ গুলো বোঝা যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পরে শুভজিৎ নিজের রুমে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষন শুয়ে থাকার পর কাবেরী তার রুমে আসলো। সচারাচর কাবেরী কখনো রাতে তার রুমে আসে না। ভীষন আশ্চর্য হলো। সে কি কিছু ভুল করেছে? তেমনটা তো নয়। নিশ্চয়ই এত রাতে তাকে কোনো কাজে পাঠাবে। বিরক্ত হয়ে বলল,’কিছু বলবে?’
‘না,আমি তোর কাছে ঘুমাবো?’ শুভজিৎ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বলল,’মজা করছো?’
‘না রে,সত্যি বলছি।’
‘তোমার মা বুঝি আমার সঙ্গে ঘুমোতে দেবে?’
‘কেন দেবে না? আমি মাকে বলে এসেছি, আজকের রাতে তোর কাছে ঘুমাবো।’
এতক্ষণে শুভজিৎ লক্ষ্য করলো কাবেরীর হাতে বালিশ রয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলছে না। কাবেরী মশারী তুলে তার বিছানার ভেতরে ঢুকলো। তারপর আবার গাঁথার ভেতর মশারি ঢুকিয়ে দিল। শুভজিৎ এর পাশে আরাম করে ঘুমালো। বেশ ভালই লাগছে। তবে শুভজিৎ এর বিছানা তাদের মতো এতো মখমল এবং সুন্দর নয়। তার পাশে ঘুমাতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও মানিয়ে নিতে হবে।এই প্রথম মা ছাড়া অন্য কারোর পাশে ঘুমাচ্ছে। বেশ আলাদা একটা অনুভূতি। তখনো কিছু বুঝতে পারল না শুভজিৎ। চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে। অস্পষ্ট উচ্চারণ করে জিজ্ঞেস করল,’মা থাকতে,আজ হঠাৎ এখানে এসে ঘুমালে কেন?’
‘বোকা ছেলে,এখনো বুঝতে পারছিস না, তোর কাছে ঘুমোতে এলাম কেন?’
‘না।’ কাবেরী শুভজিৎ এর দিকে পাশ ফিরল। তার মুখের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল,’আমি যদি মায়ের কাছে ঘুমাই, তাহলে মা পায়ের ফুল প্যান্ট খুলে ঘুমোতে বলবে। ফুলপ্যান্ট খুললে,মা সবকিছু জানতে পেরে যাবে। তাই মাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালাম। একটা দিন তোর কাছে ঘুমাতে চাই।মা খুব সহজে রাজি হয়ে গেলে।’
কাবেরীর কথা শুনে দুজন হই হুল্লোর করে হাসতে লাগলো। তবে সেই হাসির আড়ালে একটা চাপা কষ্ট থাকল শুভজিৎ এর। সে ভেবেছিল, হয়তো তার কষ্টের কথা ভেবে কাবেরী ঘুমোতে এসেছে। মাঝে মাঝে এমনটা ঘুমোতে আসবে। কিন্তু কাবেরী নিজের স্বার্থের জন্য তার পাশে ঘুমোতে এসেছে। যাইহোক, কাবেরী বেশিক্ষণ তার পাশে ঘুমোতে পারল না।ঘন্টা দুয়েক পর মায়ের কাছে যাবে বলে, বিছানা থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে। পায়েল দেবী এসে মেয়েকে নিয়ে যান। মা ছাড়া কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একটা অস্পষ্ট ভয় শিরায় শিরায় জাগরণ হচ্ছিল। মায়ের কাছে ঘুমিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিন্তু ঘুম আসলো না। কিছু একটা ভাবনায় ডুবে গেল। সে তো মাত্র দু-ঘন্টা মা ছাড়া অন্য কারোর কাছে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু দু’ঘণ্টাও থাকতে পারলো না, অথচ শুভজিৎ দিনের পর দিন মা ছাড়া কি করে ঘুমিয়ে আছে? তার কি কষ্ট হয় না?শুভজিৎ তার চাইতে অনেক ছোট। সে যদি এই বয়সে মাকে ছাড়া ঘুমাতে না পারে,তাহলে শুভজিৎ কি করে ঘুমাচ্ছে? সে আদৌ রাতে ঘুমোতে পারে তো? না,এক করুন যন্ত্রণা তাকে দগ্ধে দগ্ধে করে শেষ করে দিচ্ছে। তার ভালো-মন্দ কখনো তো দেখিনি। তার মুখ রয়েছে, মুখের ভাষাও রয়েছে। কিন্তু অবলা প্রাণীর মতো মুখের ভাষা প্রকাশ করতে পারে না। যে মানুষগুলো তার যন্ত্রণার দাম দেয় নি, সে মানুষগুলো কি করে তার মুখের ভাষার দাম দেবে? মা বাবা না থাকলে বোঝা যায় জীবনের আসল মর্ম কি? কতটা নির্মম হতে পারে এ জীবন?
চলবে