মাস্টারমশাই পর্ব ৯

0
345

মাস্টারমশাই
পর্ব ৯
শুভজিৎ জানা
______________
মাত্র এক মাসের মধ্যে কাবেরী সাইকেল চালানো শিখে গেল।প্রথমের দিকে সাইকেল চালাতে প্রচুর অসুবিধা হতো। ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠল। কাবেরী সাইকেল চালাতো আর পেছনে পেছনে শুভজিৎ ছুটতো। যতই দিন গড়তে থাকে ততই তাদের আনন্দের মুহূর্ত বাড়তে থাকে। খুব অল্প দিনে শুভজিৎ ও সাইকেল চালানো শিখে যায়। তবে সে খুব কম সাইকেল চালায়। বেশিরভাগ সময় কাবেরী চালায়।কাবেরী তার প্রিয় সাদা রঙের ফ্রক পরে সাইকেল চালায়,তার পেছনে চুপ করে বসে থাকে শুভজিৎ। সাইকেলে বসতে তার ভীষণ ভয় করে। যদি কোনোভাবে উল্টে পড়ে যায়। কাবেরীর পেট জাপ্টে ধরে পেছনে বসে থাকে। কাবেরীও টলমল করতে থাকে। কখনো পুকুরে বা কখনো ধান জমিতে সাইকেল নিয়ে পড়ে যায় দুইজন। আবার কখনো কিছুটা সাইকেলে যেতে না যেতে শুভজিৎ এর জুতো খুলে পড়ে যায়। সাইকেল থামিয়ে আবার জুতো তুলে। তারপর হেসেখেলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। প্রথম যখন তাদের সাইকেল এল তখন তারা কাউকে পাত্তা দিল না। সবাইকে অ্যাভয়েড করতে শুরু করে। গ্রামে প্রথম তাদের সাইকেল এসেছে।সাইকেল নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে উল্লাস চোখে পড়ার মতো।শুভজিৎ আর কারোর সঙ্গে মিশলো না। গ্রামের বাচ্চারা খেলতে ডাকলেও গেল না।সে সাইকেল পেয়েছে। সাইকেল তার কাছে স্বর্গের মতো। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে সারাদিন সাইকেলের কাছে থাকে। একটু ধুলো লাগলেই সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলে। তাদের সঙ্গে জুটলো আরও কয়েকটা ছেলে। কাবেরী শুভজিৎ সাইকেলে বসে থাকে আর ছেলেরা তাদের পেছনে পেছনে ছুটতে থাকে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে করতে। গ্রামের মোহ মায়া সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ছেলেমেয়েদের মাধ্যমে। পাহাড়-পর্বত নদী-নালা সবার থেকে গ্রামের সৌন্দর্য আলাদা, তা তারা প্রমাণ করে দেয় বারবার। কখনো হিংসা,কখনো মারামারি, কখনো বন্ধু, আবার কখনো দিনের শেষে আড়ি করে বাড়ি ফিরে যায়। এটাই তো গ্রামের সৌন্দর্য। বড়দের মধ্যে জাতিভেদ বর্ণভেদ নিয়ে প্রায় সময় তর্কাতর্কি চলে। কিন্তু এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। তারা সমস্ত কিছুর উর্ধে সৌহার্দ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তাই তো শিশুরা এত পবিত্র।

সিনেমা হলে পাশাপাশি দুটো সিটে বসে রয়েছে কাবেরী আর শুভজিৎ। মাস তিনেক কেটে গেলেও এখনো সিনেমা হলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জিৎ এর ‘সাথী’ সিনেমা। সিনেমার টিকিট পাওয়া বড্ড মুশকিল। রঘুকে বলে লুকিয়ে দুটো টিকিট আনিয়েছে কাবেরী। তার জন্য আবার রঘুকে অতিরিক্ত দশ টাকা দিতে হয়েছে।বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে সিনেমা দেখতে চলে এসেছে। এতদিন ধরে টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে টাকা জমিয়ে ছিল। সিনেমা দেখা বড্ড সখ কাবেরীর। কিন্তু মা কিছুতেই সেই শখ পূরণ করতে দেবে না। স্কুলের নাম করে সিনেমা দেখতে চলে এসেছে। সিনেমা হলে এক স্তব্ধতা বিরাজ করছে। প্রায় শেষের মুখে সিনেমা। সবার চোখে জল। শুভজিৎ মুখ ফিরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। অনেকক্ষণ ধরে বেশ উত্তেজনা ছিল। হঠাৎ করে হই হুল্লোর বন্ধ হয়ে, নিস্তব্ধতা নেমে এলো কেন? তা বুঝতে পারছে না। আড়চোখে কাবেরীকে দেখল। তার চোখেও জল। কিচ্ছু না বুঝতে পেরে শুভজিৎ সিনেমার পর্দায় চোখ রাখলো। সেখানে সিনেমার নায়ক বিজয়-নায়িকার চোখ অপারেশনের জন্য নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দেয়। বাড়ি ফেরার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল।তখনই একজন ভদ্র বাঙালি একইসঙ্গে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, একটা সুটকেস ধরিয়ে বাথরুমে যায়। কিন্তু বিজয় জানতো না সেই স্যুটকেসে বোম রয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে পুলিশ এসে তাকে ধরে নেয়। এবং সমস্ত দায় তার উপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু এতে দুঃখ পাওয়ার কী আছে তা বুঝতে পারছে না শুভজিৎ। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। কারন,সে পুলিশ দেখতে পেয়েছে। দাঁড়িয়ে ‘পুলিশ’ ‘পুলিশ’ বলে চিৎকার করে উঠল। কাবেরী হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এই ছেলেটার হলো কি? কোথায় কি বলতে হবে তা জানে না। সে তাড়াতাড়ি শুভজিৎ কে টেনে সিটে বসালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু দর্শকের মুখ শুভজিৎ এর দিকে ঘোরলো।তারা হাসিমুখে শুভজিৎ কে দেখে আবার সিনেমার পর্দায় চোখ রাখলো।
‘সেখানে নায়ককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল আর তুই পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করছিস! লোকে কি ভাববে বলতো?’
‘যা ভাবে ভাবুক। তাতে আমার কি? আমি পুলিশ তো দেখেছি।’
‘ওরা তো অভিনয় করার জন্য পুলিশ সেজেছে। কিন্তু এখানে সত্যি সত্যি পুলিশ আছে। দেখবি?’
‘হ্যা চলো….’
‘একটু অপেক্ষা কর। সিনেমা শেষ হলে পুলিশ দেখাবো; প্রমিস।’
কিছুক্ষণ পর সিনেমা শেষ হলো। সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। সারা সিনেমাজুড়ে কষ্টে ভরা থাকলেও শেষে নায়ক-নায়িকার মিল হয়ে গেছে। বেশ হট্টগোল করে দর্শকরা বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষ এসেছেন পাবলিক রিভিউ নেওয়ার জন্য। কোনো দর্শককে বলতে শোনা গেল না সিনেমা খারাপ হয়েছে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আসতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হলো। কাবেরী শুভজিৎ কে পুলিশ দেখানোর জন্য বাইরে নিয়ে যায়। সেখানে বেশ গোলযোগ দেখা দিয়েছে। সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি করা হয়েছে। পুলিশের কাছে যেতে পারল না। অনেক মানুষের ভীড়। এত মানুষের ভিড় ঠেলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।শুভজিৎ তবুও ঘাড় উঁচু করে পুলিশকে দেখার চেষ্টা করল। জাগতিক শক্তি কাজে লাগালো। পারল না। মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা,শিষ্টাচার সব ধুলোয় মিশে গেছে। উপস্থিত মানুষ চেষ্টা করছে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার। জোরালো একটা গন্ডগোল হতে চলেছে। তাদের পুলিশ দেখা আর হলো না। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে; এটাই অনেক। শুভজিৎ এর মন ভেঙে গেলে। পুলিশ দেখা হলো না।পুলিশ দেখার সময় বারবার কিছু না কিছু বিঘ্ন ঘটছে। বিবর্ণ মুখখানা নিয়ে কাবেরীর সাইকেলের পেছনে বসলো। তাকে আঁকড়ে রাখল কিন্তু সারা রাস্তা একটাও কথা বলল না। কাবেরী অনেকবার চেষ্টা করলো তাকে স্বাভাবিক করার। তাকে একদিন ঠিক সত্যিকারের পুলিশ দেখাবে। কিন্তু শুভজিৎ শুনল না। একপ্রকার সে কেঁদেই ফেলল। পুলিশ দেখা যে স্বপ্ন হতে পারে,তা কল্পনার বাইরে ছিল কাবেরীর। পুলিশ তো আর সাধারণ চারটে মানুষের মতোই মানুষ। তাকে এত দেখার কি আছে? এই মায়াবী পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের স্বপ্নগুলো খুব নগণ্য হয়। কিন্তু তারা এতটা অসহায় যে সেই স্বপ্নগুলোও পূরণ হয় না। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আবার কত বড় বড় মানুষের বড় বড় সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম। একজনের দিকে প্রতিকূল তো অন্যজনের দিকে অনুকুল।

সিনেমা হলে ঝামেলার জন্য,বাড়ি ফিরতে তাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। পায়েল দেবী সব বুঝতে পেরে যান। দুজন মার খেলো। পায়েল দেবী দাবি করলেন,শুভজিৎ এর জন্য তার মেয়ে উচ্ছন্নে চলে যাচ্ছে। যদি সে থাকতে চায় তাহলে ভালো মতো থাকতে হবে। না হলে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। কারণ, ভদ্র পরিবারের থেকে অভদ্রের মতো কাজ করা যাবে না।কাবেরী নাকি কখনো বাড়ি থেকে বেরোবার সাহস পেত না, শুভজিৎ এর জন্য সাহস পেয়ে আজ বাবা-মাকে অগ্রাহ্য করে সিনেমা হল পর্যন্ত চলে গেছে। মেয়ের এত বড় স্পর্ধা হলো কী করে তিনি জানেন না। শুভজিৎ এগুলো নিয়ে আদৌ কিছু ভাবলো না। মার খিয়ে বিড়ালের মত গা ঝেড়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ভুলে গেল। পুলিশ দেখার ইচ্ছেটাও ধীরে ধীরে কমে গেল। তার মনের মধ্যে একটি চরিত্র গেঁথে গেল, বিজয়। সিনেমার মধ্যে তার বিজয় চরিত্রটি সবচাইতে ভালো লেগেছে। সব জায়গায় নিজের নাম কেটে বিজয় লিখতে শুরু করলো। তাকে কেউ শুভজিৎ ডাকলে সে শুনল না। সবাইকে তাকে বিজয় নামে ডাকতে বলল। কাবেরীও তাকে বিজয় বলে ডাকতে লাগল। এখন অন্য কোনো নামে ডাকলে ডাক শোনে না সে। কাবেরী মনে মনে ভাবতে থাকে, তার দ্বিতীয় ভুল শুভজিৎ কে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া। একবার যাত্রায় একটা কবিতা তাকে মুখস্ত করতে সাহায্য করেছিল।আর সে প্রায় একমাস অনবরত তার কানের কাছে ওই কবিতা শুনিয়ে গেছে। এবার এসেছে সিনেমার চরিত্র বিজয় আর সিনেমার গান ‘ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও’। এটা যে কতদিন থাকবে তা জানে না। পায়েল দেবী শুভজিৎ এর উপর রাগ করলেও, তার এইসব ছোট ছোট দুষ্টুমি গুলো উনার মনকে গলাতে বাধ্য করে। তিনি রান্নার সময় প্রায়শই রেডিওতে গান শোনেন। মাঝেমধ্যে গান বন্ধ করে দিয়ে শুভজিৎ এর মুখে ‘ও বন্ধু তুমি শুনতে কি চাও’ গানটি শোনে। এই গানটি বেশ ভালোভাবে গাইতে পারে সে। সবার মুখে প্রশংসা শুনলেও ‘সাথী’ সিনেমাটা দেখা হয়নি পায়েল দেবীর, তিনি মাঝে মাঝে সিনেমার গল্প বা অন্য কোনো গল্প শোনেন শুভজিৎ এর কাছে। শুভজিৎ বেশ গুছিয়ে গল্প বলতে পারে। আর ইচ্ছে করে নতুন চরিত্র কিংবা নিজের কল্পনার মতো গল্পে কিছু ঢুকিয়ে দেয়। গল্পের এন্ডিং নিজের ইচ্ছেমতো শেষ করে। কিন্তু পায়েল দেবী ধরতে পারে না। তারপর শুভজিৎ একা একা হাসতে থাকে।তা আবার কাবেরীর কাছে গিয়ে বলে। তারপর দুজন মিলে অট্টহাসি হাসে।

আমিনা বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠার শক্তিটুকু হারিয়ে গেছে। বাড়ির সমস্ত কাজ তানভীর স্যার করেন। নিজের কাজের প্রতি সামান্য দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর স্ত্রী তাঁর কাছে নীল আকাশের মতো বড়ো এবং দামি। স্ত্রীর অসুস্থতা তিনি মানতে পারছেন না।অসুস্থতার জন্য আমিনা শারীরিক ভাবে কষ্ট পাচ্ছেন,তানভীর স্যারও কষ্ট পাচ্ছেন মানসিকভাবে। মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। আমিনার এমন অসুখ বারবার দেখা দেয়। গ্রামের ডাক্তার ধরতে পারেনি, আমিনার কি অসুখ হয়েছে? তানভীর স্যার বারবার বলেন, শহরে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু আমিনা শুনেন না। অদ্ভুত যুক্তি দাঁড় করায়।শহরে যেতে যথেষ্ট অর্থ এবং সময় সাপেক্ষ। শহরে যানবাহন তার একদম পছন্দ নয়। সামান্য অসুখ হয়েছে। একা একা ঠিক হয়ে যাবে। তানভীর স্যার ভীষণ বিরক্ত হয়,কিন্তু স্ত্রীকে রাজি করাতে পারেন না।জমানো টাকা কী করবেন তাও জানেন না। আমিনা বলেন,এই সমস্ত টাকা তিনি সমস্ত গরিব-দুঃখী মানুষদের দান করে দেবেন। নিজের চোখে দেখেছেন মানুষ দু-মুঠো অন্নের জন্য কতটা কষ্ট করে। ওদেরকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু তানভীর স্যার মনে করেন, গরিবদের সাহায্য নয়, ওদের রোজগারের পথ দেখানো উচিত। আজকে আমি সাহায্য করলাম, পরশু অন্য কেউ সাহায্য করল। কিন্তু তার পরের দিন কে সাহায্য করবে? তাদের সাহায্য না করে রোজগারের পথ দেখানো উচিত। এমনই যুক্তি-পাল্টা যুক্তির চলে দুজনের মধ্যে। সমস্ত সম্পত্তি এবং টাকা দান করা আর হয়নি ব্যাঙ্কে জমা হয়ে আছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসার মুহূর্ত। সূর্যের শেষ রশ্মি আমিনার মুখে পড়েছে। সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতা আর আমিনার মুখের উজ্জলতা মিলে এক নতুন রঙের সৃষ্টি হয়েছে। মুখের উজ্জলতা খুব গাঢ়। তানভীর স্যার এক কাপ চা নিয়ে এসে আমিনার পাশে বসলেন। আমিনা ঘুমিয়ে রয়েছেন। গা থেকে কম্বল তুলে উনাকে ওঠালেন। তখনো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নিজের একটা হাত দিয়ে উনাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। তারপর তানভীর স্যার চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে আমিনাকে খাওয়ালেন। আমিনা তীক্ষ্ণ চোখে স্বামীকে দেখলেন।এই বয়সে এসেও স্বামীর ভালোবাসা কমেনি। এখনও ভীষণ ভালোবাসেন। কেয়ার করেন সব সময় আগলে রাখেন। তার অস্তিত্ব তার বেঁচে থাকার চাবিকাঠি আমিনা। তাই তো তিনি স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। কিন্তু এত ভালোবাসা কি আদৌ সইবে? অজান্তেই চোখে জল চলে আসে আমিনার। এক অজানা আশঙ্কা কাজ করে মনের মধ্যে। মনে হয় এত ভালবাসার যোগ্য সে নয়। একদিন কোথাও হারিয়ে যাবে এই ভালোবাসা। চা খাওয়া শেষ হতেই আমিনাকে আবার ঘুমিয়ে দিতে চাইলেন তানভীর স্যার। কিন্তু আমিনা ঘুমোতে চাইলেন না। তিনি কিছুক্ষণ বসতে চান, স্বামীর সঙ্গে থাকতে চান। আমিনার কথামত পাশে বসলেন তানভীর স্যার।
‘আমিনা, বারবার তোমার জ্বর হওয়া আমার ভালো লাগছে না। চলো আমরা শহর থেকে একবার ডাক্তার দেখিয়ে আসি।’
আমিনা সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলেন। সোজা হয়ে বসে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,’একই কথা বারবার কেন বলো? বলছি না সামান্য জ্বর হয়েছে ভালো হয়ে যাবে? শহরে মিছেমিছি গিয়ে এত টাকা খরচ করার কোনো মানে হয়? এছাড়া ছেলেমেয়েরা বাড়িতে থাকবে,ওদেরকে কে রান্না করে খাওয়াবে, বলো? সামনে তাদের পরীক্ষা রয়েছে।’
‘ধন-সম্পদ যৌবন কিছুই নয়, ওসব হলো সুন্দর সুন্দর একটি বঞ্চনা। মনেপ্রাণে সব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুধু একজনের আপন হওয়ার চেষ্টা করো, যাকে পেলে এই সৃষ্টির সব ঐশ্বর্য পাওয়া যাবে।’
আমিনা পালঙ্কে হেলান দিয়ে বসলেন। মাথা ভীষণ ব্যাথা। অস্বস্তি বোধ করছেন। কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার অতীতের স্মৃতি মনে পড়ছে। মানুষ বলে, মৃত্যুর আগে নাকি পুরনো সব স্মৃতি মনে পড়ে। আমিনার তাই হচ্ছে। তবে কি তিনি মারা যাবেন? হঠাৎ এমন ভাবনা মনে জেগে ওঠায় তিনি কেঁপে উঠলেন। ওই যে পাশে রয়েছে মানুষটি তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে নেই। উনার সবকিছুর অংশীদার হতে চান তিনি। বোধ হয় তা আর বেশি দিন বাকি নেই। এতগুলো বছরে সে যে এত ভালোবাসা পেয়েছে এটাই অনেক। এটাই তার পূর্ণতা। তিনি স্বামীর হাতের উপর হাত রাখলেন। উনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। আমিনার চোখ ছল ছল করছে। আমিনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,’আমরা আজ কতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে ফেললাম। মনে হচ্ছে এই তো কদিন আগে বিয়ে করেছি। খুব অল্প দিনে যেন সময় গুলো বেরিয়ে গেল। মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত তাই না! সারাদিন ফ্রক পরে মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়াতাম, খেলতাম,সকাল আটটা না হলে বিছানা থেকে উঠতাম না। হঠাৎ করে বাবা একদিন এসে বললো তোকে আর ফ্রক পরতে হবে না এবার থেকে শাড়ি পরবি। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরতে শুরু করলাম। আমাদের সমাজে সেটাকেই বলে বিয়ে। তখন আমার বয়স পনেরো থেকে ষোলো বছর। কিছু বুঝতাম না। তখনও চুড়িদার পরাটাই হয়নি। বিয়ে, মনের মধ্যে আলাদা এক অনুভূতি। মনের মধ্যে খুব আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারলাম বিয়ের আসল মানেটা কি!নিজের বাড়ি পরের বাড়ি হয়ে গেল। একটা অচেনা মানুষ আপন হতে শুরু করলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে যেতাম, বিয়ের পর নামাজ পড়ার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজে লেগে পড়তে হলো। সারাদিন অজস্র কাজ রাতে শান্তিতে ঘুমও নেই, স্বামীকে ভালোবাসায় উজাড় করে দিতে হবে। না হলে তিনি বিরক্ত হবেন। উনারর সমস্ত দায়িত্ব আমার।আমার ভালো-মন্দ কেউ কখনো বুঝলো না। বাপের বাড়ি যাব বললে কত মানুষের কত কথা। সংসার করে পাঁচ-ছয় দিন অন্তর বাপের বাড়ি গেলে চলে নাকি?সংসার দেখতে হবে, ছেলে মানুষকে মানুষ করতে হবে, নিজের সংসার নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে….এভাবে কেটে গেল দিনগুলো। সারা জীবন মেয়েদের মানিয়ে নিতে নিতে কেটে গেল।এখন মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই শাড়ি খুলে ফেলে ফ্রক পরেনি। দিলেই তো সব ঝামেলা শেষ।’
কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলেন আমিনা। উনাকে আর বসিয়ে রাখা ঠিক হবে না। বিছানায় শুইয়ে দিলেন। পাশের তানভীর স্যারও শুয়ে পড়লেন। আমিনার মাথায় হাত বোলিয়ে বললেন,’আজ অনেকগুলো বছর পর পুরনো স্মৃতি মনে করে লাভ কি? হ্যাঁ আমি মানছি তখন তোমার ভালোলাগা খারাপ লাগা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তুমি আমার কথা একবার ভাবো। তখন আমার বয়সটা কত হয়েছিল? আমি মাত্র বাইশ বছর বয়সী যুবক। কিছু বুঝতাম না,কোনটা ভালো কোনটা খারাপ? আজকাল ছেলে মেয়েরা খুব অল্প বয়সে ম্যাচুরিটি হয়ে যায়। আট-দশ বছরের ছেলেরা অনেক স্মার্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সময় তা ছিল না। আমাদের বয়স যখন ছয় সাত বছর তখন আমরা ‘অ’ ‘আ’ শিখেছি। আর এখনকার বাচ্চারা ছয়-সাত বছরের দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তখন আর এখন এর মধ্যে অনেক পার্থক্য। তখন আমার বাবা-মা যা শিখিয়ে ছিল আমি তাই করেছি।যখন বুঝতে পেরে গেছি কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তখন থেকে তোমাকেও গুরুত্ব দিতে শিখেছি। একবারের জন্যও অবহেলা করিনি।’
তানভীর স্যার থামলেন। স্ত্রীর চোখে আজ কেমন একটা অন্যরকম ভাবমূর্তি প্রকাশ পেয়েছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে। তানভীর স্যার স্ত্রীর চোখ থেকে জল মুছে দিয়ে আবার বললেন,’তোমরা সমস্ত মেয়েরা ভাবো, সব সময় মেয়েরা মানিয়ে নেয়। ছেলেরা মানিয়ে নিতে পারে না। হ্যাঁ,তা ঠিক মেয়েরা একটু বেশি মানিয়ে নেয়। কিন্তু ছেলেদেরকেও মানিয়ে নিতে হয়।একটা ছেলে যখন সারাদিন কাজ সেরে রাতে বাড়িতে ফিরে, তখন সে শান্তি চাই, একটু ভালোবাসা চায়। কিন্তু অধিকাংশ ছেলেরা তা পায় না।বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী একটা কথা শোনায়, ছেলে-মেয়ে একটা কথা শোনায়, বাবা-মা একটা কথা শোনায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাতে পরিবারের সদস্যদের ঘ্যানঘ্যানানি কার ভালো লাগে বলতো? মা-বাবা,স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে সবাই তার আপন। কার কথা রাখবে সে?একজনের কথা রাখলে অন্যজনের মন খারাপ। স্ত্রীর কথা শুনলে বাবা মা বলে বেড়াবে, আমাদের ছেলেটাকে বৌমা শেষ করে দিলো। বউয়ের কথায় উঠে বসে। আবার বাবা-মার কথা শুনলে বউয়ের কাছে খারাপ হতে হবে। সবার ভালো লাগা দেখতে গিয়ে কখন নিজের ভাললাগাটাই হারিয়ে যায়,তা কখনো ছেলেরা বোঝে না। ধীরে ধীরে অন্যের ভালোলাগাটা নিজের ভালোলাগা হয়ে ওঠে। নিজের আবদার, নিজের ভালোবাসা, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু শেষ হয়ে যায়। তা কি কেউ খোঁজ রাখে? আর এটা কি মানিয়ে নেওয়া নয়?’ সংসার থেকে এগুলো কখনো যাবে না। এটাই সংসারের নিয়ম। সংসার করা এত সহজ নয়। সংসার যতটা সহজ ঠিক ততটা কঠিনও। বড্ড জটিল এই সংসার জীবন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here