#মায়াপ্রপঞ্চ,পর্ব সংখ্যা ১
#পলি_আনান
– আমি বিয়েটা করছি পবন ভাই,এইসব পীড়াপীড়ি করে লাভ নেই।যা ভাগ্য আছে তাই হবে।তুমি হাতটা ছাড়ো!
আরমিনের কথায় আরক্ত দৃষ্টিতে তার দিকে ঘুরে তাকায় পবন।হাতটা ছেড়ে সম্পূর্ণ দৃষ্টি রাখে তার চোখে দিকে।
– বিয়েটা তুই সত্যি করবি?তোর মাথায় এই বিয়ের ভূত কে ডুকিয়েছে বলতো?
– কেউ না।আমি আমার সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি এখন বড় হয়েছি।
আরমিন কথাটা বেশ দৃঢ় ভাবে বললেও তা তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে উড়িয়ে দেয় পবন।আড় চোখে পবনের দিকে তাকিয়ে আরমিন ভাবছে হয়তো বা ছেলেটার রাগ মাটিতে পড়ছে।কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় ছেলেটা তার গন্তব্য।হাতে বেশ চোট পড়ায় আরমিন চাপা আর্তনাদ করে তাতেও হেলদোল হলো না ছেলেটার।বরং প্রবল রোষ নিয়ে আরো শক্ত করে চেপে ধরে আরমিনের হাত।
.
বাইরে থেকে বেশ পুরনো কালসিটে দাগের একটি বাড়িতে প্রবেশ করে দুজনে।বাড়ির গেট পেরিয়ে সদর দরজার সামনে ‘জাবির মাতবর’কে দেখে পা থামায় পবন।তৎক্ষনাৎ আরমিনকে ছুড়ে মারে তার পায়ের কাছে।চেয়ারের কোনে মাথা লাগার আগেই তাকে আগলে নেয় জাবির।
– কিরে বাপ রেগে আছিস?আরমিনকে ছুড়ে মারলি কেন?
– তুমি জিজ্ঞেস করো তাকে,কেন আমি এমন করছি।
জাবির চশমাটা ঠিক করে তাকায় আরমিনের দিকে।মেয়েটার গায়ে ক্যাটকেটে হলুদ রঙের শাড়ি।হাতে বাটা মেহেদীর প্রলেপ।তার সাজ পোশাকে জাবির সাহেবের বুঝতে দেরি হয়নি আসল ব্যাপার টা।ইতিমধ্যে পবনের চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে বাড়ির বাদ বাকি সদস্যরা।পবনের মা ‘নাহার বেগম’ তাকিয়ে আছে নির্বাক চিত্তে।পবন আরমিনের দিকে তাকিয়ে জাবিরকে উদ্দেশ্য করে রেগে বলে,
– আব্বা তুমি বলো এই মেয়ের পড়াশোনা থেকে বাদ বাকি সব দায়িত্ব আমাদের।শুধু একমাত্র তার নয় পরিবারের বাকি সদস্যদেরো দায়িত্ব আমরা নিয়েছি কিন্তু তার অকৃতজ্ঞ মা কি করে পারে এতবার মেয়েটার বিয়ে ঠিক করতে তাও আমাদের না জানিয়ে।তিনি ভাবেন কি, এই পবনের কানে কথা আসবে না?হাহ এই এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছি আর এই এলাকায় বিয়ে হবে আমি জানবো না।আমি একটু এলাকার বাইরে গেলাম দুইদিনের জন্য আর তাতেই তোর মা পয়সাওয়ালা টাকলা ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।এই সহ চারটা বিয়ে ভে°ঙ্গেছি।সামনে থেকে আর যতগুলো বিয়ের পাত্র আসবে তখন আর বিয়ে ভা°ঙ্গবো না ডাইরেক তাদের হাড়গোড় ভে°ঙ্গে দেবো।মাইন্ড ইট।
পবন কথা শেষ করেই কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরমিনের দিকে।মেয়েটা চুপচাপ চোখের জল ফেলছে।এটা তো আর নতুন নয়।কেউ তাকে বিয়ে দিতে চাইছে আর কেউ ভা°ঙ্গতে চাইছে।
এতক্ষণে মুখ খুললেন নাহার বেগম।আরমিনের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
– তোর মায়ের কি কোন বিবেক নেই?আমরা এতকিছু করেও কি তোদের আপন হতে পারলাম না?কি করে পারে সে তোর বিয়ে দিতে,তাও আমাদের না জানিয়ে।অন্তত তুই আমাদের জানাতে পারতি।নাকি তুই নিজেও বে°ই°মানি করছিস।
আরমিন এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠলো।শাড়ির আচঁলে চোখ মুছে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
– আমি নিজেও জানতাম না আন্টি।সকালে বললো আজ দুপুরে আমার বিয়ে তাও হালকা করে গায়ে হলুদ হবে আমি যেন তৈরি থাকি।হলুদ ছোঁয়ানোর আগেই পবন ভাই বিয়েটা ভেঙ্গে দিলো।
– তো তুই কি চাস বিয়ে টা হোক?
নাহার বেগমের প্রশ্নে উত্তর খুজে পেলো না আরমিন।সে শুধু কাঁদতেই থাকলো।মেয়েরটার কান্না দেখে জাবির মাতবর বুকে আগলে নিয়ে যান তাকে ঘরের ভেতর।
সোফায় বসিয়ে নাহার বেগমের দিকে ইশারা করে বলেন,
– আরমিনকে কিছু খেতে দাও।আজ সে এখানেই থাকুক।বাড়ি ফিরলে নির্ঘাত আজ রক্ষে থাকবে না তার।নিশ্চই তার মা ক্ষেপে আছে।
নাহার বেগম রান্না ঘরের দিকে চলে যান।জাবির মাতবরো তার রুমে প্রবেশ করে।সে সুযোগে আবার আরমিনের সামনে দাঁড়ায় পবন।হাতে থাকা মলমটা ছুড়ে মারে আরমিনের কোলে।আকস্মিক কান্ডে লাফিয়ে উঠে মেয়েটা।
– আরে রিলেক্স আমি।
পবনের কথায় দাঁত কিড়মিড় করে তাকায় আরমিন।দৃষ্টি সরিয়ে এবার মলমের দিকে আরেকবার হাতের দিকে তাকায় সে।লাল হয়ে বেশ খানিকটা চামড়া ছি°ড়ে গেছে হাতের।তার হাতে যেন দানবের থাবা পড়ছে।
– নখ কি কা°টেন না পবন ভাই?আমার হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
– আমার নখ কা°টার দরকার নেই।তবে তোর হাত আমি কে°টে দেবো, যদি আর দেখি ধেই ধেই করে বিয়েতে রাজি হতে।
– কেন আমি কি বিয়ে করতে পারবো না?নাকি আপনারা সবাই চান আমি আইবুড়ো হয়ে থাকবো আজীবন।
– সবে ইন্টারে পড়িস।পড়াশোনাটা এগো,বিয়ের বয়সটা ঠিকঠাক ভাবে হোক।আমরা তখন উপযুক্ত পাত্র দেখে তোকে বিদায় করবো।এইসব টাক মাথার, ভুড়ি ওয়ালা লোকের সাথে নয়।
– এই যুগে টাকার মূল্য সবচেয়ে বেশি পবন ভাই।এইসব জোয়ান ছেলে দেখে বিয়ে করে লাভ কী বলো?রূপ দেখে কি পেটে ভাত জুটবে।
– হয়েছে আর বিজ্ঞ সাজতে হবে না।যা বলেছি মাথায় রাখ।নেক্সট টাইমে যেন আর তোর বিয়ের সম্পর্কে কোন কথা না শুনি।আর আজকে বাড়ি ফিরিস না।আন্টি মা°রবে তোকে।
পবন কথা শেষ করে চলে গেলো।আরমিন মলমটা হাতে নিতে আবারো তার কাছে ফিরে আসলো পবন।
– আরমিন এই শাড়ি তোকে কে দিয়েছে?
– ছেলের বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে।
– এমন ক্যাটকেটে হলুদ রঙের শাড়ি তোকে মোটেও মানাচ্ছে না।বিশ্রি রং।এই শাড়ি পড়ে আর ঘুরঘুর করিস না।আম্মাকে বল তোকে নতুন শাড়ি দিতে।
__
বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত।তার সাথে দমকা হাওয়া।চিনের চালের উপর থাকা গাছগুলোর নড়াচড়ায় বেশ শব্দ হচ্ছে চালে।জানলার দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সুপারি গাছগুলো এদিক থেকে সেদিক হেলেদুলে পড়ছে।ঝড়ের কবলে পড়ে তারা যেন নিত্য করতে ব্যস্ত।বাইরের ঝড়ের সাথে সাথে কিছুক্ষণ ঘরের ভেতরেও ঝড় বয়ে গেছে।আরমিনের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় ক্ষু°ব্ধ তার মা সালেহা।এই সহ চারবার ভেঙ্গে গেছে ‘মাতবর’ বাড়ির কারণে মেয়েটার বিয়ে।মাতবর বাড়ির কাছে চিরকাল ঋনি থাকবে তারা কিন্তু তাই বলে আরমিনকে নিয়ে তাদের বেশি বেশি দুশ্চিন্তা তিক্ত করে তুলছে তাকে।তিনি চান না মেয়ে এত পড়াশোনা করুক।লেখনিতে পলি আনান বড়লোক ছেলে দেখে যতদ্রুত সম্ভব মেয়ে বিয়ে দেওয়া উচিত।আরমিনের পিছনেই বড় হয়ে উঠছে তার নাইনে পড়ুয়া বোন রিহানা।তাকেও বিয়ে দিতে হবে।ক্রমশ মেয়েটাও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠছে।
বাড়িতে প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন তার স্বামী ‘আব্দুল্লাহ কায়িম’ দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর।এই সংসারের ভার সালেহার উপর পড়েছে।তাই ভালো মন্দ সবটা বিচার করতে হচ্ছে তাকে।
জানলা দিয়ে আসা বৃষ্টির ছিটায় ভিজে যাচ্ছেন সালেহা।তাকে ভিজতে দেখে এগিয়ে আসে রিহানা।
– আম্মা জানলা বন্ধ করো ভিজে যাচ্ছো তুমি।
রিনাহার দিকে সাহেলা ঘুরে তাকাতেই মেয়েটার গালে কষে একটা চ°ড় পড়লো।মূহুর্তেই যেন দুনিয়া ঘুরে গেলো তার।
– পবনকে খবর তুই দিয়েছিস তাইনা?
– ন..না আম্মা।
– আমাকে মিথ্যা বলবি না।তোর কোন ভাই আছে?এই সংসার কে দেখবে?কতকাল আর মাতবর’রা আমাদের জন্য করবে।যদি আজ আমি ম°রে যাই কাল তোদের কি হবে?দুইবোন বেশি আকাশে উড়ছিস।আরমিনের আগে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি আমি।তৈরি থাকিস।
সালেহা কথা শেষ করে বৃষ্টির মাঝে বেরিয়ে যান রান্না ঘরের দিকে।এতজন মানুষের জন্য তৈরিকৃত খাবার গুলো পড়ে আছে যত্নে।
_
বৃষ্টির সাথে বাতাসের গতি কমে এসেছে।এখন শুধু প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়ছে।সেই সুযোগে ছাদে প্রবেশ করলো আরমি।মন খারাপের এই দিনে বৃষ্টিতে না ভিজলে হয় না।ছাদে বেশ খানিকটা পানি জমে।গেছে।সেই পানিতে তাল মিলিয়ে ভিজতে ব্যস্ত সে।হুট করে নাকে সিগারেটের গন্ধ পেতে সিড়িঘরের পেছেনের দিকটায় ছুটে যায় সে।অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে।
– পবন ভাই তুমি সিগারেট টানছো?
আরমিনের কথায় চমকে তাকায় পবন কেউ জানে না সে সিগারেট টানে।অবশেষে কী না আরমিনের চোখেই পড়লো।পবন উত্তর দেওয়ার আগে আগাগোড়া দেখে নিলো আরমিনকে। মেয়েটা ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে।ছাদের স্বচ্ছ পানিতে হলুদ রঙ মিশে যাচ্ছে।সেদিক তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে পবন।
– কিরে আরমিন তোর শাড়ি থেকে রঙ উঠছে কেন?কি শাড়ি দিলো তোকে যে এক ধোয়ায় রঙ উঠে যাচ্ছে।খোঁজ নিয়ে জেনেছি লোকটার এর আগেও দুইটা বিয়ে হয়েছে এবং লাস্ট যাকে বিয়ে করেছে সে নাকি অতিরিক্ত মা°র খেয়ে মা’রা গেছে।তোর সাথে যদি লোকটার বিয়ে হতো এইভাবে মে°রে তোর জীবনের রঙটাই তুলে দিতো।
আরমিন উত্তর দিলো না।পবন সিগারেটা ছাদের বাইরে ছুড়ে ফেলে শিষ বাজাতে বাজাতে নিচে নেমে যায়।
#চলবে…..