মায়াপ্রপঞ্চ,পর্ব সংখ্যা ৪৩(খ)

0
689

#মায়াপ্রপঞ্চ,পর্ব সংখ্যা ৪৩(খ)
#পলি_আনান

_________________
দুপুরের রোদের দাপট ধীরে ধীরে কমে এলো আরমিন বাড়ি ফিরেছে কিয়ৎক্ষণ আগে। পবনের কথার ধাঁচ খুব একটা গায়ে মাখলো না সে।আজ সুহাইল আসবে,সুহাইলের জন্য অসীম অপেক্ষায় আছে।প্রতি এক মিনিটকে আজ তার এক ঘন্টা লাগছে সময়টা যেন কচ্ছপের ন্যায় ধীর গতি নিয়ে চলছে।আরমিন হেলেদুলে প্রবেশ করে সালেহার রুমে।সালেহা তসবি হাতে বাইরে তাকিয়ে আছে।

– আম্মা কি করো?
সালেহা প্রত্যুত্তর করলো না।বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।তার চিন্তিত মুখখানি এক নিমিষে ধরে ফেললো আরমিন।

– কী নিয়ে চিন্তা করছো আম্মা?

– জানি না।ভালো লাগছে না।

– কেন লাগছে না শরীর খারাপ?

– না।

সালেহা আবারো নীরব রইলো আরমিন কিছু বলবে বলে উদ্যত হলে কানে আসে এম্বুল্যান্সের তীব্র শব্দ।জানলা দিয়ে উঁকি দিতে দেখতে পেলো একটি লা/শ বাহী ফ্রিজিং গাড়ী তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে।সালেহা করুন চোখে তাকালো গাড়িটার দিকে।পেছনে একটি সাদা মাইক্রোবাস দেখা গেলো।অজানা আতংকে বুকের ভেতরটা মুষড়ে উঠে আরমিনের।

– আম্মা কে মরছে?

সালেহা ভয় পেয়ে গেলেন।শ্বাস-প্রশ্বাসের আন্দোলন ক্রমাগত বেড়েই চলছে।হাতের তসবি বিছানায় রেখে এগিয়ে গেলো সদর দরজায়।আগের টিনের ঘরটি ভেঙ্গে ফেলায় সেখানে এখন বড় উঠান হয়েছে।সেই উঠনে এসে থামলো লাশবাহী গাড়িটি।আরমিনের কলিজায় ছেদন ঘটেছে।কার কি হয়েছে ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঝ উঠনে দাঁড়ায় ততক্ষণে লা/শবাহী গাড়িটির পিছুপিছু এলাকার বাচ্চারা এসে ঢল জমায়।কয়েকজন মুরব্বি পুরুষ বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার চেষ্টায় আছে কি হচ্ছে সালেহার বাড়িতে?কার লা/শ গাড়িতে!

পেছনের গাড়ি থেকে একে একে নেমে আসে শাওন, সিয়াম,জাবির,বারেক,আছীম এবং মাফী। সকলের বিধ্বংস অবস্থা।শাওনকে দেখে আরমিনের চোখ মুখের প্রতিক্রিয়া পালটে যায়।সেই আগের হ্যাংলা-পাতলা শাওনের সাথে বর্তমান শাওনের মিল নেই।রক্তিম দৃষ্টিতে আরমিনের দিকে খানিকটা তাকালো শাওন গলা ধরে এসেছে তার।আরমিন তাকালো সিয়ামের দিকে দু’চোখ ফোলা রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে সে চোখে।কোমল ছেলেটির চোখ মুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে জর্জরিত অবস্থা।আরমিনের তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে কি হচ্ছে তার সাথে সুহাইল কই?সবাই গাড়ি থেকে বের হলো কিন্তু সুহাইল আসেনি কেন?কাঁপা কাঁপা দু পা নিয়ে সিয়ামের মুখোমুখি দাঁড়ালো আরমিন।মেয়েটার ঠোঁট যুগল কেমন যেন কাঁপছে গলা শুকিয়ে আসছে বারংবার।সিয়াম আরমিনের তুলনায় লম্বা হওয়ায় মাথা তুলে তাকালো আরমিন।অবশ গলায় সন্দিহান স্বরে বলে,

– তোমার ভাইয়া আসেনি সিয়াম?

ছেলেটা এত ক্ষণ বিধ্বংস অবস্থা দাঁড়িয়ে থাকলেও আরমিনের প্রশ্নে সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পড়লো।ঝটকায় জড়িয়ে নিলো আরমিনকে।সিয়াম আরমিনকে অতিশয় শক্ত হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে বুকের সাথে।থমথমে বাড়ির নিরব পরিবেশ ভেঙ্গে গেলো সিয়ামের আহাজারিতে।

– ভাবি আমি পারলাম না,ভাবি আমি ভাইকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।তোমার কথা আমি রাখতে পারি নাই ভাবি।

এক ঝটকায় সিয়ামকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো আরমিন।ছেলেটার কলার চেপে ধরে শক্ত হাতে।শাসানো ভঙ্গিমায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– সিয়াম ভাইয়া মজা করিও না।সত্যটা বলো তোমার ভাই কই?

সিয়াম আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখলো লা/শবাহী গাড়িটির দিকে।আরমিন থমকে যায় দু’পা পিছিয়ে যায় লাহমায়।দ্রুত গাড়িটির সামনে এসে দরজায় ধাক্কাতে থাকে,

– সুহাইল আপনি এসেছেন?এই সুহাইল আপনি কই সিয়াম ভাইয়া কাঁদছে কেন?

আরমিনকে টেনে সরিয়ে আনে সিয়াম।ফারজানা এত ক্ষণ মাতবর বাড়িতে ছিলো হঠাৎ বাড়ি ফিরে এত ভীড় দেখে চমকে যান।

– এই সুহাইলের আব্বা গাড়িটা কার?এখানে কেন?

বারেক খন্দকার প্রত্যুত্তর করলেন না।দাঁড়ানো স্থানেই মাটিত বসে পড়লেন তিনি।জাবির আগলে নিলেও লাভ হলো না তিনি মাটিতে লেপ্টে বসে পড়েন।ফারজানা বিরক্ত হয়ে গলা ধাক্কালো তার।

– এই সুহাইলের বাপ কথা বলেন।

– আমাদের কলিজার টুকরা আর নেই গো,আমাদের কলিজার টুকরা আর নাই।তোমার সুহাইল এই দুনিয়ায় নাই।

ফারজানা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন, কিয়ৎক্ষণের মাঝেই ঘুরে পড়লেন শাওনের বাহুর কাছে।তড়িঘড়ি করে সবাই ফারজানাকে আঁকড়ে ধরে।আরমিন মাথা ঘুরিয়ে তাকায় গাড়িটার দিকে এখানে তার তরতাজা স্বামীর মৃত দেহ পড়ে আছে।কী করে সম্ভব!মানুষটার তো বলেছে ফিরবে কিন্তু এভাবে ফিরবে তা তো বলেনি।আরমিন বাচ্চাদের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো সিয়ামের দিকে ছেলেটার মাথা নতজানু।চোখের পলকে আরমিন তার গালে বসিয়ে দিলো এক চ-ড়।ক্ষণিকেই সিয়ামের গালটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয় কিন্তু বুকের ভেতরের ব্যথার থেকেও বেশি ধারালো নয় সে ব্যথা।

– বলেছিলাম তোমার ভাইয়ের যত্ন নিবে,দেখে রাখবে।এখন এসব কি বলছে ফুফা?

সিয়াম মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠে সালেহার চোখ ভিজে আছে নোনা জলে দ্রুত এসে হাত আগলে ধরলেন আরমিনকে।ইতোমধ্যে একে একে মাতবর বাড়ির সবাই উপস্থিত।খোলা উঠনে সবাই আরমিনকে দেখছে মেয়েটা যেন পাগল হয়ে গেছে।সবার মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে সবাই ব্যাকুল আগ্রহে আছে কী করে মা/রা গেলো সুহাইল তা জানার আশায়।শাওন এগিয়ে এলো কাধ চাপিয়ে ধরলো সিয়ামকে।ছেলেটা একদম ভেঙ্গে পড়েছে।শাওন সবার উদ্দেশ্য নিস্তেজ স্বরে বলে,

-গত ছয়দিন আগে রোড এক্সিডেন্টে স্পট ডেথ হয়েছে সুহাইল ভাইয়া।যেহেতু রোড এক্সিডেন্ট পুলিশ কেস তাই সকল কার্যাবলী শেষে দেশে আনতে দেরি হলো।লাশের অবস্থা বেশি ভালো নয় বডির অনেকাংশ থ্যাঁতলে আছে বাজে ভাবে যত দ্রুত সম্ভব দাফনের কাজ সম্পূর্ণ করা জরুরি।

আরমিন ক্লান্ত চোখে তাকালো গাড়িটার দিকে।মনে পড়ে যায় শেষ বারের মতো সুহাইলকে দেখার মুহূর্ত।তার হাত ধরে এক গাল হেসে বলেছিলো,
– আল্লাহ হাফেজ মরিয়ম।আমি ফিরে আসবো তোমার দোয়ায় আমায় রেখো।

আরমিনের দোয়ায় তো সুহাইল সব সময় ছিলো তবে সশরীরে ফিরলো না কেন।ক্রমশ অচল হয়ে পড়ছে আরমিনের শরীর।সালেহার বুকে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলে,

– আম্মা বলছো না আমার কপালে সুখ বেশি দিন সয় না দেখলে তো…..

আরমিনের মুখটা থেমে গেলো চেতনা হারিয়েছে ততক্ষণাৎ।
.
বাড়ির চারিপাশে মানুষের গিজগিজে অবস্থা।ফারজানার চেতনা ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই।সালেহাকে জড়িয়ে এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছেন তিনি।
আরমিনের পিট পিট চোখে তাকালো চারিপাশে।সবার আহাজারি দেখে মেয়েটা যেন ভড়কে গেছে।

– তোমরা কাঁদো কেন?কি হইছে?

আমীনা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরমিনকে।আরমিন ছাড়িয়ে নিয়ে তাকালো নিষ্পাপ চোখে,

– কি হয়েছে?

– স…সুহাইল নাইরে মা।

আরমিন থম মেরে রইলো গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সবার দিকে।এলোমেলো কাপড় জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়, ফারজানা দ্রুত এসে জড়িয়ে ধরলেন আরমিনকে,

– মারে আমার কলিজার টুকরা নাইরে।আমার বুক খালি করে আল্লাহ তারে নিয়ে গেলো।

– ফুফু উনার কিচ্ছু হয় নাই।উনি আমাকে বলছে ফিরবে বাইরে সবাই মজা করছে।

আরমিনের ভোলা স্বর।ছুটে চলে যায় ঘরের বাইরে।মুরব্বিরা চেয়ারে বসেছিলেন আশেপাশে চেনা-অচেনা মানুষের ঢল নেমেছে।একদল কুসংস্কার প্রতিবেশির মুখে রটিয়ে যাচ্ছে ‘আরমিন নোয়া জামাইরে খাইছে’ কেউ বা আফসোস করে এক ফোঁটা জল ছাড়লো চোখ থেকে।কেউ কেউ বলছে আরমিনের ভাগ্যটা তার মায়ের মতো করুন।

আরমিন কয়েক কদমে এগিয়ে এলো সিয়ামের কাছে।খুবলে ধরলো সিয়ামের শার্ট,

– তোমরা মজা করছো তাই না?আর মজা করিও না ওনার মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারবো না পাগল হয়ে যাবো।

– ভ..ভাবী মজা নয় ভাইয়া….

সিয়াম নতজানু হয়ে কেঁদে উঠে আরমিন ছুটে যায় মাফীর কাছে।

– মাফী ভাইয়া আপনি অন্তত সত্যিটা বলেন,

– বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে আরমিন।

আরমিন থমকে গেলো।কয়েক কদম এগিয়ে এলো জাবিরের কাছে

– ফুফা ও ফুফা বলেন না উনি আছে আপনারা মজা করছেন।

বারেক আরমিনকে জড়িয়ে ধরলো নিশব্দে কাঁদেন তিনি।সুহাইলের সাথে রাতে খাবার টেবিলে বলা শেষ কথাগুলো এখনো কানে বাজে ।সেদিন করুন কন্ঠে বারেকের চোখে চোখ রেখে বলেছিলো,

– আব্বা দেশে ফিরলে আপনি মরিয়মকে কটু কথা আর কখনো বলিয়েন না।আমার ভালো লাগে না কেউ যদি তাকে নিয়ে খারাপ কথা বলে।

বারেক সেদিন অবাক হয়েছে বটে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া করেননি।পরদিন খবর এলো সুহাইলের গাড়ি ব্রেক ফেল করে এক্সিডেন করেছে।

– ও ফুফা বলেন না।

– মারে সুহাইল তোমার স্বামী হয়েছে আজ কয়েকমাস কিন্তু আমার ছেলেকে ছোট থেকে লালন পালন করেছি আমার কি অবস্থা হচ্ছে তুমি বুঝতে পারছো?সত্যটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর গতি নেই আল্লাহ যা চাইবেন তাই হবে।আমার ছেলেটা আর নেই।

আরমিন ভেঙ্গে পড়লো কিন্তু কাঁদলো না।চোখে মুখে ফুটে আছে নিরবতা।আমীনা দ্রুত এসে তুলে নিলো আরমিনকে।মেয়েটা ঠায় দাঁড়িয়ে রয় লা/শবাহী গাড়িটার দিকে তাকিয়ে।আরমিনের বিধ্বস্ত অবস্থায় তীব্র জ্বালা বেড়ে গেলো পবনের।দূর থেকে করুন চোখে দেখছে সে।আরমিন কষ্ট বরাবরি তার সহ্য হয় না কিন্তু আজ যা হলো মন কিছুতেই মানছে না।

জাবির মাতবর বারেক খন্দকারকে কিছু বললেন, লাহমায় বারেক উচ্চ আওয়াজে ডাকলেন ফারজানাকে।দূর্বল শরীর নিয়ে ফারজানা উঠনের দিকে এগিয়ে এলো।

– সুহাইলের দাফনের কাজ আমাদের দেশের বাড়িতেই হবে।এখানকার সবাই শেষ দেখা দেখে নিলে আমরা তাহলে রওনা হবো।

আরমিন তড়িৎ গতিতে তাকালো বারেকের দিকে।অবাক পানে তাকিয়ে শুধালো,

– দেশের বাড়ি মানে?

– সুহাইলের দাদার বাড়ি নবাবগঞ্জ(কাল্পনিক) সেখানে আমাদের পারিবারিক কবরস্থান।যেতে যেতে চারঘন্টার বেশি সময় লাগবে।মা তুমি শক্ত কর নিজেকে তোমাকেও যেতে হবে সেখানে।

– এসব কি কথা দাফনের কাজ শেষ হলেই শেষ?আমি আমার সুহাইলকে একা রেখে আসবো নাকি?কোনদিন না আমার সুহাইল একা থাকতে পারবে না, সেখানে কে থাকবে?আপনারা তো বিলেতে ফিরে যাবেন আমি চলে আসবো এখানে।তাহলে আমার সুহাইল কি নবাবগঞ্জে একা পড়ে থাকবে?

আরমিনের ঝাঁঝালো কথায় চমকে গেলো উপস্থিত সবাই।পরিস্থিতি নিগূঢ় নিশ্চুপ।

– মারে এভাবে আর কতক্ষণ যেতে যেতে দেরি হয়ে যাবে তুই সামলে নে নিজেকে।

জাবির মাতবর করুন স্বরে শুধালেন।আরমিন কেঁদে ফেললো।জড়িয়ে ধরলো ফারজানার দু’ চরণ।
– ফুফু সুহাইলকে নিয়েন না ফুফু, আমি ম/রে যাবো।আমার দম বন্ধ লাগে ফুফু একটু দয়া করেন।

– আমাদের হাতে কিছু নাই মা।আমরা পরিস্থিতির শিকার।তুই রাজি হয়ে যা এভাবে আর কতক্ষণ!

আরমিন উঠে দাঁড়ালো দৌড়ে গেলো গাড়ির দিকে।গাড়ির পেছন থেকে দু’হাতে যথা সাধ্য আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে বলে,

– এই আমি ধরলাম এখান থেকে যদি ওনাকে নিতে হয় তবে আমাকেও লা/শ বানিয়ে নিয়ে যাও।ঝামেলা পুরোপুরি মিটে যাবে ওনার আর একা লাগবে না আমি থাকবো ওনার পাশে।

বোনের পাগলামো তিলে তিলে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে রিহানাকে।মুখে ওড়না গুজে নিশব্দে কাঁদছে সে।এই তো সকাল বেলায় কত আনন্দে ছিলো কিন্তু কে জানতো আনন্দটা এক নিমিষে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
আরমিন করুন চোখে তাকালো বারেকের দিকে আবদার স্বরে বলে,

– ফুফা আমার একটা কথা রাখবেন?আপনার ছেলেকে এই বাড়িতে দাফন করেন।এই বাড়িটা ওনার নিজেরি এত দূর নেওয়ার কি দরকার?

বারেক মাথা দুলালেন কিছু সময় পর ফারজানার চোখে চোখ রাখলেন ফারজানা দ্বিমত পোষণ করে বলেন,

– বাড়ির ভেতর কবর এটা হয় না।এখন কবর দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে সমস্যা হবে এই জমি সালেহার আর ভবিষ্যতে মালিক তার দুই মেয়ে হবে।
– ফুফু কিচ্ছু হবে না ফুফু আমার কথাটা রাখেন ফুফু।নবাবগঞ্জে নিতে হলে আমার লা/শ নিতে হবে সাথে।

মুহূর্তে পরিবেশটায় সৃষ্টি হলো হট্টগোল।নানান জনের নানান মত।তার মাঝে আরমিন এখনো আঁকড়ে ধরে আছে গাড়িটি।সে সরে গেলে কেউ যেন গাড়িটি নিয়ে চলে যাবে।একটা সময় এই মানুষটা আশেপাশে থাকলেও অসহ্য লাগতো,দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতো আর আজ এই মানুষটাকে আঁকড়ে ধরার জন্য গগন কাঁপানো আহাজারি।
অল্প কয়েক মাসের সংসারটা চোখের পলকে নাই হয়ে গেলো।সুহাইল নামক একজন বউপাগল স্বামী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে আর সেই স্ত্রী তাকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সবার মতামত শুনছিলেন জাবির এতদিনে সুহাইলের সাথে তার বেশ সখ্যতা জমেছিলো আর সেই সুহাইল এখন নেই কথাটা মানতেও কলিজা লাগে।

– আমি একটা প্রস্তাব রাখি আশা করি কেউ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।সুহাইলকে তার মামার পাশে কবর দেওয়া হোক।

জাবিরের কথা বারেক অসম্মতি জানালেও পরিশেষে তিনিও রাজি হলেন।
.
দ্রুত ব্যবস্থা করা হলো সব কিছুর।কয়েকজন মানুষ কবর খনন করছেন,কেউ বা বরই পাতার মিশ্রণে গরম পানি করছে।মৃত ব্যক্তিকে শেষ বিদায় জানাতে সবার আয়োজন চলছে।আরমিন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির কাছে।সিয়াম এক নজর দেখে নিলো মেয়েটাকে।পরনের হলুদ শাড়িটি সুহাইল নিজে পছন্দ করে কিনেছিলো সেদিন পাশে ছিলো সিয়াম।শাড়িটা ভালোভাবে পরখ করে সিয়ামের উদ্দেশ্য বলে,

– শাড়িটায় বেশ সুন্দর লাগবে তোর ভাবীকে তাইনা?

– ভাবীকে সব রঙে মানায়।এটাও মানাবে নিয়ে নাও।

আজ সেই শাড়ি আরমিনের গায়ে মেয়েটাকে অপরূপ লাগছে কিন্তু দু’চোখ ভরে দেখার সাধ্য হলো না তার ভাইয়ের।সিয়ামের ঠোঁট কামড়ে নেয় কান্না কিছুতেই থামছে না।

অবশেষে লা/শবাহী গাড়ি থেকে শাওন,পবন,সিয়াম সহ অন্যদের সাহায্য সুহাইলের মৃত দেহ নামানো হলো।আরমিন চেয়ে ছিলো অশ্রু ভরা নয়নে।গাড়ি থেকে কফিন নামানো হলো খুব সাবধানে।লা/শের মুখ অনাবৃত হতে আরমিনের চোখে পড়ে সুহাইলের ফ্যাকাশে মুখটায়।সুহাইলের চেহারা দেখে বাড়িতে কান্নার দমক পড়লো আরো একবার।ফারজানার আহাজারি শুরু করে মাথা দুলিয়ে কাঁদছেন।আরমিন হাত এগিয়ে দিলো সুহাইলের মুখে।সবাই তাকে ধরতে মানা করলেও কারো কথা কানে নিলো না সে।মাফীর কলিজা ফেটে যাচ্ছে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বারংবার।সুহাইলের বুকে হাত রাখলো আরমিন।বিহ্বল চোখে তাকালো মাফীর দিকে।

– দেখেন না ভাইয়া সুহাইলের বুকে ধুকপুক শব্দ নাই।নিরিবিলি পরিবেশে এই বুকে মাথা রেখে মানুষটার হার্টের শব্দ শুনেছি।আর আজ কোন শব্দ নাই।

আরমিন চুপ রইলো ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো খানিকটা সময়।

– সুহাইল এই বুকে মাথা রেখে আমি ঘুমাবো না আর?আর কি ঠাই হবে না?জড়িয়ে ধরেন না একটু।জড়িয়ে ধরে বলবেন না মরিয়ম এটা করো না ওটা করো না।তোমায় নিয়ে এখানে যাবো,ওখানে যাবো।আমাকে অসহায় করে দিলেন।আপনি আমার জীবনে অভ্যাস হয়ে গেছেন আপনি নামক অভ্যাস আমি ছাড়বো কি করে?

কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে দিলো সুহাইলের ঠোঁটে।শুষ্ক হয়ে আছে দু’ঠোঁট,

– আপনি একটু হাসেন সুহাইল।আপনি ঠোঁট কামড়ে হাসলে আমি আর বলবো না আপনার হাসি আমার অসহ্য লাগে।একটু হাসেন না।

আরমিনে পাগলামোতে সবাই মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।আমীনা তাকে সরিয়ে আনতে নিলে হাত ঝাঁকি দিয়ে সরিয়ে নেয়।

– সুহাইল আপনি দেখবেন না আমাকে।আপনার দেওয়া শাড়িটি পরেছি।আপনি বলেছিলেন যেদিন আপনি আসবেন সেদিন এই শাড়িটি যেন পরি আমি আমার কথা রেখেছি আপনি রাখেননি।আমার সাথে প্রতারণা কেন করলেন সুহাইল।মায়াটা বড্ড বেশি জমে গেলো সুহাইল,এই মায়ার বাঁধন ছেড়ে এত সহজে তুমি চলে গেলেও আমি যেতে পারবো না।আমি তোমার মতো প্রতারণা করতে শিখিনি।কেন কথা দিয়ে কথা রাখতে পারোনি। আমায় ছেড়ে কেন গেলে কী অপরাধ আমার?আমি তোমার মায়া জমিয়েছিলাম বলে?নাকি ভালোবেসেছিলাম বলে?

আরমিন কফিন ঝাঁকিয়ে কেঁদে উঠলো সবাই তাকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনে।গায়ে লেগে যায় ধুলোবালি।পা/গলের মতো চিৎকারের একটা পর্যায়ে থেমে গেলো আরমিন।ছুটে এগিয়ে গেলো সুহাইলের কাছে।সুহাইলের গালে দু’হাত রেখে আক্ষেপ সুরে বলে,

– আমি কখনো কিছু আগলে রাখতে পারি না।দেখলেন না আপনাকে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম।আমি নির্বোধ বোকা অশুভংকর অধিকারীনি একজন ব্যক্তি!

আরমিন কিয়ৎক্ষণ বিড়বিড়িয়ে কিছু বললো অতঃপর লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

চোখের পলকে ধুলোয় মিশিয়ে গেলো একটি ভালোবাসার ছোট্ট সংসার।সেখানে ছিলো এক আকাশ ভরসা,ভালোবাসা,বিশ্বাস,আস্থা,অপেক্ষা।সেদিন সুহাইল বলেছিলো তুমি কাঁদবে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখবো। আজ প্রিয়তমা স্ত্রীর আহাজারি চোখে পড়ছে না মৃত স্বামীর।গলা কা-টা মুরগীর মতো ছটফট করছে মেয়েটা।কত শত প্রতিশ্রুতি ছিলো,স্বপ্ন ছিলো তা পূর্ণ হওয়ার আগেই একলা একা হয়ে পড়লো আরমিন।নির্মম বাস্তবতার মুখে পড়ে অসহায় দু’হাত বাড়িয়ে সুহাইলকে ছুঁয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।অবশ্য আজকের পর থেকে ছুঁয়ে দেওয়া বারণ।আদুরে দু’ঠোঁটের স্পর্শ এই কপালে আর ছুঁয়ে দেবে না।হাতে হাত রেখে কথোপকথন গুলো শুধু স্মৃতি হিসেবেই রইলো।

পবন দূর থেকে তাকিয়ে সবটা হজম করছে।এতদিন আফসোস ভুলে মনে মনে একটা কথাই বলে,

– আল্লাহ এটা যেন স্বপ্ন হয়।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here