#মায়াপ্রপঞ্চ,০৬,০৭
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৬]
_______________
থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরটা নিয়ে কোন ক্রমে রান্না ঘরে এসে স্থির হলো সালেহা।বুকের কম্পন এখনো থামছে না।শরীররটা কাঁটা দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।তার অবস্থা দেখে রান্না ছেড়ে এগিয়ে এলো সুমনা।
বাড়ীর বেশ পুরোনো কাজের মেয়েটার নাম সুমনা।
– আপা আপনার কী হয়েছে? অসুস্থ দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?
– আমারে একটু পানি দে’তো।
সুমনা দ্রুত জগ থেকে পানি ঢেলে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে।
– এবার ঠিক আছেন?
– হুম।
সালেহা ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে আবারো বেরিয়ে যায় রান্নাঘর ছেড়ে।যত দ্রুত সম্ভব আরমিনকে খুঁজে বের করতে হবে।
_
মনীরার সাথে আমীনার রুমে বসে গল্পে মশগুল আরমিন।ছোট্ট মনিরাকে মন মত সাজিয়ে দিচ্ছে সে।বাচ্চা মেয়েটাও লক্ষি মেয়ের মতো বসে আছে চুপটি করে।শহর থেকে অতিথি আসছে বাড়িতে তাই সবারি গায়ে নতুন জামা এবং হালকা সাজ।মনিরাকে সাজিয়ে দিলে মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।আরমিন দরজা সেঁটে বেরিয়ে আসতে চাইলে সালেহা টেনে নিয়ে যায় তাকে রুমের ভিতর।সালেহার আতংকিত মুখ দেখে মূহুর্তে ঘাবড়ে যায় আরমিন।
– আম্মা কী হয়েছে তোমার?শরীর খারাপ করছে?
– ন..না।তোকে কিছু বলার আছে।
– বলো কী বলবে?
আরমিন কৌতুহল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সালেহার দিকে।সালেহা শুষ্ক ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে নিলো জিহ্বা দিয়ে।
– ত..তোর ফুফার কথা মনে আছে?তোর বারেক ফুফা!তোর ফুফাতো ভাই সুহাইলের কথা মনে আছে?
– হ..হ্যা কিন্তু হঠাৎ ওদের কথা তুলছো কেন?
– আজকের বাড়ির অতিথি তারা,তোর জাবির আংকেলের বন্ধু বারেক খন্দকার’ তার ছেলে ‘সুহাইল খন্দকার’।
মূহুর্তেই আরমিনের মাঝে যেন ঝড় বয়ে গেলো।অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলো সালেহার দিকে।
– তুমি ঠিক বলছো মা?
সালেহা শুরু থেকে সবটা খুলে বললো আরমিনকে।মেয়েটা অতীতের কিছু স্মৃতি ভাবতেই মূহুর্তে বিষিয়ে উঠলো।বেশ কয়েকবার ঢোক গিলে বিছানার কোনায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসলো।
– বড় আন্টি আগে তোমায় বলেনি আজ বাড়িতে কে আসবে?তুমি জিঙ্গেস করো নি?
– তাতো করেছিলাম সেই সকালেই,কিন্তু তোর আন্টি বললো রতন আসবে।আর তোর আন্টি নাকি তাদের বিশেষ ভাবে চেনেন না।কারন তারা থাকতেন শহরে।আমিও আর বিশেষ ভাবে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।এই রতন যে বারেক আমি সেটা জানতাম নারে।
– তোমাকে তো নিশ্চই চিনে ফেলেছে আম্মা?ওদের সাথে আমাদের কোন কথা নেই।ঠিক এই বাড়ির সূত্রে যতটুকু কথা বলার প্রয়োজন ততটুকু বলবে এর বাইরে বেশি না।
– আমায় চিনলেও বা কী বলতো?তোর ফুফি আমার বিয়ের হবার পর থেকে কোনদিন তার ভাইয়ের বউ হিসেবে সমাজে পরিচয় করিয়ে দিতেন না।গরিব ঘরের মেয়ে ছিলাম বলে তোর দাদার বংশের আমাকে নিয়ে সে কী লজ্জা।তোর বাবাকে নিয়ে আলদা হয়ে গেলাম।বিপদে একটু ভরসা নিয়ে তোর ফুফুর দরবারে হাজির হলাম একটু আপন ঠিকানার আশায়, উলটো সর্বহারা হয়ে ফিরে আসতে হলো।তোর নানা আমাকে ত্যাজ্য করেছে সেই বিয়ের পরেই।আপন বলতে আমার জীবনে আর কেউ ছিল।আমার অন্যয় ভালোবেসে বিয়ে করেছি।এই অন্যয়ের বোঝা আজ এত বছর আমি গ্রহন করছি।
– আমাদের কাউকে প্রয়োজন নেই।তুমি একদম ওদের সাথে কথা বলবে না।এরা এখন আমাদের ভালো চাইবে না খারাপ চাইবে তাই দূরে দূরে থাকবে।আর তোমার পরিচয় বারেক ফুফা কখনোই জাবির আংকেল’কে বলবে না।কেননা তাদের প্রেস্টিজে আ/ঘা/ত লাগবে।
– কিন্তু আমার তো চিন্তা হচ্ছে তোকে নিয়ে।তুই আবার অতীতের রেষ ধরে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবি না তো?
-তুমি নিশ্চিন্ত থাকো আম্মা।আমি ওদের নিজের মুখটাও দেখাবো না।কাজ তো প্রায় শেষ আমি বরং বাড়িতে আব্বার সঙ্গে সময় কাটাই।
– তবে যা তুই সাবধানে যাস।
.
কেউ যেন আরমিনকে না দেখতে পায় তাই বাড়ির পেছনের রাস্তাটা দিয়ে হাটা শুরু করেছে সে।আজ বাড়ির পেছনের পুকুরটায় মাছ ধরা হচ্ছে।বিশাল জমি জুড়ে এই পুকুরটায় বছরে ২ বার মাছ ধরা হয়।আজ মেহমান আসার উপলক্ষ্যে জাল ছোড়া হয়েছে।ইতোমধ্যে বেশ বড় সাইজের দুটি কাতলা,রুই এবং ছোট কিছু মাছ পাওয়া গেছে।পুকুরে মাছ ধরতে দেখে এলাকার বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে পুকুর পাড়ে।তাদের সাথে সামিল হয় আরমিন।মাছ ধরা শেষ অবধি দেখে তবেই বাড়ি ফিরবে সে।
– এই আরমিন এখানে কী করিস?আম্মা তোকে বাড়িতে খুঁজছে।
পবনের ডাক শুনে বামে ঘুরে তাকায় আরমিন।ছেলেটা তার দেওয়া সেই টি-শার্ট পড়েছে।কালো রঙটায় বেশ মানিয়েছে তাকে।পবনের দিকে সে এতটাই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়েছে,আশেপাশে কেউ আছে বা নেই সেই দিকে হেলদোল হলো না তার।
অপরদিকে অবাক পানে তার দিকে চেয়ে আছে এক জোড়া চোখ।পবন কথার মাঝে ঘুরে তাকায় সুহাইলের দিকে।ছেলেটার প্রশ্নাত্মক চোখ দেখে বুঝে নেয় সে হয়তো আরমিনের পরিচয় জানতে চাইছে।তাই পবন ভনিতা না করেই বলে,
– সুহাইল ও হলো আরমিন।আর আরমিন ও হলো বাবার বন্ধু বারেক আংকেলের ছেলে সুহাইল।
ইতোমধ্যে আরমিনের চোখ পড়লো সুহাইলের দিকে।আজ থেকে প্রায় ছয়/সাত বছর আগের সুহাইলের সাথে ঠিক তেমন মিল।হয়তো বয়সের ভারে শরীরটা আরো বলিষ্ঠ হয়েছে।তবে সেই শান্ত দু’চোখ,অজান্তে কা°মড়ে ধরা ঠোঁট সেই বদঅভ্যাস এখনো পাল্টায়নি তার।পবনের ইশারায় সুহাইলকে সালাম জানায় আরমিন।সুহাইল ঠোঁট ইশারায় সালাম গ্রহন করে।পবন আর আরমিন দুজনেই আবার কথায় মনোযোগী হয়।কিন্তু কথায় মন দিতে পারেনি আরমিন।অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরেছে।সুহাইলের এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার ভেতরটায় নাড়িয়ে তুলছে বার বার।তাদের কথার মাঝেই সুহাইল সহজ গলায় প্রশ্ন করে,
– মেয়েটা তোমার কী হয় পবন?
মূহুর্তে থমকে যায় পবন।আরমিন তার কী হয়?কিংবা এই পরিবারের কী হয়?তার যোগ্য জবাব জানা নেই পবনের কাছে।সালেহার পরিবার তো তাদের কাছে আরেকটি পরিবার তবে এই মূহুর্তে সঠিক কী বলা প্রয়োজন তা বুঝলো না পবন।আরমিন চোখ ছোট করে তাকায় পবনের দিকে।পবনের দ্বিধা বুঝে মাথা নুইয়ে নেয় মেঝেতে।চারিদিকে মৃদুমন্দা বাতাস বইছে,আকাশের সাদা মেঘ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে এপার থেকে ওপার।এত সুন্দর পরিবেশেও এক বিদঘুটে পরিস্থির মাঝে পড়েছে আরমিন।হঠাৎ কানে আসে পবনের কন্ঠ,
– আরমিন আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয় সুহাইল।
পবন কথাটি বলে স্মিথ হাসলো।তার হাসিতে ঠিক মন খুলে হাসতে পারলো না সুহাইল।তার কোথাও যেন আঘাত পড়লো।
_
বারেক খন্দকারের সাথে প্রায় সবারি পরিচয় পর্ব শেষ শুধুমাত্র সালেহা ছাড়া।অবশ্য সালেহা ইচ্ছে করেই বারেকের সামনে পড়েনি।হাজার খানে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে কী না।
কিন্তু তার সব চেষ্টাকে ভেস্তে দিলেন জাবির।বারেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাকে ডাকা হলো বসার ঘরে।
– ভাইজান আমাকে ডেকেছেন?
সালেহার কন্ঠে তার দিকে ঘুরে তাকায় বারেক।
আগের সেই রূপ জৌলুস কিছুই নেই মহিলাটির মাঝে।অথচ একটা সময় তার স্ত্রীর ভাই এই মহিলাটির জন্য পাগল ছিল।এতটাই পাগল ছিল যে মেয়েটার সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে আনলো।কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে সবাই পেলেই সুখী হয় না।কোথাও কোথাও যেন আধাঁর নেমে আসে চিরকালের জন্য।যেমনটা হয়েছে সালেহার সাথে।ছোট ছোট দুইটা কন্যা সন্তান জন্ম হলো ঘর আলো করে।কিন্তু কয়েক বছর পেরিয়ে স্বামী হয়ে গেলো প্যারালাইজড।ছোট্ট দুটি বাচ্চার দায়িত্ব পড়লো সালেহার উপর,খেটে খেয়ে যে চলছে তার দিন তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।
– সালেহা উনি হলেন বারেক খন্দকার আমার ছোট বেলার বন্ধু।
– আসসালামু আলাইকুম।
সালেহা ধরা গলায় সালাম জানালো,বারেক হাসি মুখেই সালাম গ্রহণ করলো।সালেহার জড়তা বুঝতে পেরে যেন বেশ মজাই পাচ্ছেন বারেক।
– উনি কে রে জাবির?চিনতে পারলাম না।
– সালেহা আমার বোনের মতো।আমাদের সাথেই থাকে,মাঝে মাঝে তোর ভাবীকে কাজে সাহায্য করে।তাছাড়া তার দুটি লক্ষি মেয়ে।বলতে গেলে এই পরিবারের সদস্যই তারা।
– সব তো বুঝলাম ভদ্র মহিলার স্বামী কোথায়?কি করেন তিনি?
– ওই তো ম/রেও বেঁচে আছে বলা চলে।কয়েকবছর যাবৎ প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
তাদের কথার মাঝেই চলে গেলো সালেহা।বাহ কিন্তু সুন্দর অভিনয়!এরাই কি না তার আপন মানুষ।চিনেও চিনলো না।তাদের ঠকানোর কারনে আজ সারাটা জীবন রাস্তার কীটের মতো বাচঁতে হচ্ছে সালেহাকে
_
দোতলার পবনের পাশের ঘরটাতেই সুহাইলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।ফ্রেশ হয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখছে সে।তার দুচোখ চাতক পাখির ন্যয় খুঁজে চলছে আরমিনকে।মেয়েটার সাথে কথা বলা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আযান পড়বে।পকেটে সিগারেটের প্যাকেট পুরে ছাদের দিকে পা বাড়ালো সুহাইল।ঘরে বসে স্মোক করতে এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে না।তার থেকে ভালো গোধূলিলগ্নের আকাশটাও দেখা যাবে।বিদেশের মাটিতে থেকে ভীষণ ভাবে মিস করছিল প্রিয় এই বাংলাদেশটা।
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে ছাদের দিকে ছুটে চললো আমীনা।ইদানীং শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে তার।ডাক্তার বলেছে প্রেসার একদম লো।নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করতে এবং প্রয়োজন মতো বিশ্রাম গ্রহণ করা তার জন্য আবশ্যক।তাকে সিড়ি দিয়ে উঠতে দেখে ডেকে উঠলো আরমিন।
– ছোট আন্টি ছাদে কেন যাচ্ছো?
– কবুতর গুলো খাওয়ার দিয়ে খুপরিতে ঢুকাতে হবে আর জামা কাপড় আছে।
– তুমি না অসুস্থ?দ্রুত নামো আমি যাচ্ছি।
– এমা না না আরমিন তুই বাড়ি চলে যা।বিশ্রাম নিয়ে পড়তে বস।রেজাল্ট আবার খারাপ হলে পবন তোকে মে/রে/ই ফেলবে।
– আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না কাজ শেষ করেই আমি বাড়ি ফিরে যাবো।
আমীনাকে নামিয়ে দিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো আরমিন।ছাদে উঠেই লম্বা করে শ্বাস টানলো।আজকের আকাশটা বড্ড সুন্দর।কমলা, আকাশী,সাদা এবং ছাই রঙের মিশ্রণের আকাশ।তার মাঝে মুক্ত ভাবে ছুটে চলছে পাখিগুলো।তাকে দেখেই ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা গুলো ছুটে আসলো,তাদের সাথেই আপন মনে কথায় মশগুল হলো মেয়েটি।
– কিরে খিদে পেয়েছে তোদের?এই নে…
আরমিন হাতের মুঠোয় ভর্তি গম ছুড়ে দিলো মেঝেতে।কবুতর গুলো উড়ে এসে খাবার গ্রহণে ব্যস্ত।লোহার দরজার ক্যাচ ক্যাচ শব্দে ঘুরে তাকালো আরমিন।পেছনে সুহাইল দাঁড়িয়ে।দরজাটা সে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।
– একি দরজা বন্ধ করলেন কেন?
– কেমন আছো মরিয়ম?
‘মরিয়ম’ নামটা শুনতেই টনক নড়লো মেয়েটির।মূহুর্তেই অতিতের স্মৃতিচারণ তাকে বিষফোড়ার মতো কতল করে নেয়।ঠোঁটের সাহায্য জিভ ভিজিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বলে,
– আপনি অসহ্যকর সরে যান সামনে থেকে!
#চলবে…..
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৭]
____________
– এতটা অসহ্যকর তোমার কাছে কবে হয়েছি?
– জেনে কী করবেন?
– জানার যে বেশ আগ্রহ হচ্ছে।
– আগে এটা বলুন কবেই বা আপনি আমার সহ্যর সীমানায় ছিলেন?
আরমিনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না সুহাইল।ঠোঁট বাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে দু’ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট পুরে নিলো।ছাদের রেলিং এ বসে থাকা পায়রা গুলোর দিকে তাকিয়ে বেশ উচ্চ আওয়াজে শিষ বাজালো।তাতে পায়রা গুলো ডানা ঝাপটে কিছুটা সরে গেলো।আরমিন বিরক্তের ভাব নিয়ে দঁড়ি থেকে জামা নামাতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
– মরিয়ম কিছু কথা ছিল।
– একদম আমাকে ওই নামে ডাকবেন না।আমার দম বন্ধ লাগে।
– মরিয়ম এটা কি তোমার নাম নয়?
– হ্যা আমারি নাম।তবে সেটা স্কুল কলেজের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ।বাদবাকি সবার কাছে আমি আরমিন।আপনাকে ভরা মজলিসে আমার নাম আদিখ্যেতা করে মরিয়ম ডাকতে হবে না।
হিসহিসিয়ে কথাটি বলে থামলো আরমিন।তার দিকে পর্যবেক্ষণের চোখে তাকিয়ে আছে সুহাইল।কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে চুপ হয়ে যায় আরমিন।সুহাইল সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ছুড়ে বাইরের দিকে ফেলে দেয়।খানিকটা এগিয়ে আসে আরমিনের কাছে।
– মরিয়ম জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?
আরমিন খানিকটা ডানে সরে গেলো,খুপরির দরজা লাগাতে লাগাতে উত্তর দিলো,
– ইচ্ছে নেই।
– তোমার ফুফির কথা অন্তত জিজ্ঞেস করো।এটলিস্ট তার শরীরে তোমার রক্ত বইছে,এতটাও নির্দ*য় হইয়ো না।
– নির্দ*য় কে নির্দ*য় আমরা নাকি আপনারা?কী ভেবেছেন সবটা ভুলে গেছি?আজ আমাদের এই দশা আপনাদের কারনে।আপনার মা-বাবা আপনজন না আমাদের।আমরা একাই ভালো আছি।
আরমিনকে রাগান্বিত হতে দেখে কথা ঘুরিয়ে নিলো সুহাইল।মেয়েটাকে যেতে দেখে ছাদের গেটের সামনে হাত ছড়িয়ে দাড়ালো আরামসে।
– রাস্তা থেকে সরুন।আমাকে যেতে হবে।
– আমার সাথে কথা শেষ করে যাও।
– আপনাদের সাথে কথা বলার আমার কোন মুড নেই।
আরমিনের প্রখর তেজযুক্ত কথার পিঠে কথা বলতে মন আর সায় দিলো না সুহাইলের।পকেটে হাত পুরে গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।নিজেকে স্থির করে ভালোভাবে পর্যবেক্ষকের চোখে তাকালো।
– তুমি তো আগের থেকেও চিমটে গেছো মরিয়ম।মনে আছে ছোট বেলায় কত পুষ্ট ছিলে।গাল দুটো ছিলে টসটসে টমেটোর মতো।আমি ইচ্ছে করে তোমার গাল দুটো চটকে দিতাম আর তুমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে-কাদঁতে ছুটে যেতে মামির কাছে।
অতীতের স্মৃতিচারণে বুকের ভেতরটায় মুচড়ে উঠে আরমিনের।এই সুহাইল নামক জীবটা ছিল তার কাছে আতংক।আর এখন সেই আতংক আবার ফিরে এসে কোন বিপদ টেনে আনে আল্লাহ জানে।আরমিনকে ছোট চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সুহাইল।
– এই মেয়ে কত কথা আছে তোমার সাথে জানো?অনেক কিছু বলার আছে।
– আমার কোন কথাই শোনার নেই সরে যান।
আরমিন এবার ক্ষিপ্ত হয় তার রাগ দেখে যেন বেশ মজাই পাচ্ছে সুহাইল।লগ্ন পেরিয়ে আযানের ধ্বনি কানে আসছে।দূর প্রান্তের মসজিদ গুলোতে আযান দেওয়া হচ্ছে।সে কী মধুর সুর কতবছর পর কানে এলো সুহাইলের।আরমিন পড়েছে ভারী যন্ত্রণায় যত দ্রুত সম্ভব তাকে বাড়ি ফিরতে হবে আজকের পর থেকে সে ভুলেও মাতবর বাড়িতে আসবে না।অন্তত সুহাইল যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভুলেও এই বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখবে না।
_
নামাযের বিছানায় বসে মোনাজাতে হুহু করে কেঁদে উঠলেন সালেহা।তার কান্না শুনে ছুটে আসে রিহানা।এই কান্না নতুন নয় প্রতিদিনি কাঁদে কিন্তু আজকের কান্নার সুরটা যেন ভিন্নতর।নামাযের বিছানার কাছটায় চুপচাপ বসে রইলো রিহানা।
কিছুটা দূরে বিছানায় শুয়ে আছেন কায়িম রহমান।চোখ গুলোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনি দেখতে চাইছেন কে কাঁদছে।কিন্তু অসাড় শরীর নিয়ে হেরে গেলেন তিনি।ভারী ভারী শ্বাস নিয়ে ছটফটানো শুরু করে।তার ছটফটানো দেখে এগিয়ে গেলো রিহানা।বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে নির্দেশ দিচ্ছে।সালেহা মোনাজাত শেষে তজবি নিয়ে বসে ঘরের বাইরের বারান্দাটায়।আরমিন এখনো আসলো না।মেয়েটার আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছেন তিনি।
অতীতের রেষ তার মন থেকে কিছুতেই কাটেনা।চোখের কোনে জল নিয়েই আরেকবার ডুব দিলো অতীতে।
.
‘আরমিন তখন ক্লাস ফাইভের পড়ছে রিহানা থ্রিতে।হঠাৎ গাড়ি এক্সিডে^ন্টে কায়িম রহমান অসুস্থ হয়ে যান।দুটো মেয়ে নিয়ে কী করবে কোথায় যাবে ভেবে পেলেন না সালেহা সন্ধ্যাগ্রাম ছেড়ে বেশ আশা নিয়ে শহর মুখী হলেন।কেননা কায়িম রহমানের বোনের পরিবার সেখানেই বসবাস করে।হয়তো ভাইয়ের এমন অসুস্থতায় বোনটাই হাত বাড়িয়ে দেবে সাহায্যর।সালেহার শশুড় বাড়ির কেউ তখন ছেলের এমন বিপদে এগিয়ে এলো না।তাই বাধ্য হয়ে শহরমুখী হলেন।
বারেক খন্দকার তাদের থাকতে দিয়েছিলো ঠিকি তবে টাকাপয়সা দিয়ে খুব একটা সাহায্য করেননি।এতে শরীর ক্রমশ অবনতির দিকে যায় কায়িমের।সেই বাড়ির বড় ছেলে সুহাইল তখন হাই স্কুলে অধ্যয়নরত।ছেলেটি ছিল বেজায় রাগি এবং একরেখার।মামা মামির ভক্ত ছিল সে।রিহানাকেও বেশ আদর করতো কিন্তু আরমিনের সাথে তার মোটেও মিল বনিবনা ছিল না।ছোট বেলা থেকেই জ্বালিয়ে মা°রে আরমিনকে।আড়ালে আরমিনের খেয়াল রাখতো সবসময়।সুহাইলের মা “ফারজানা” বাড়ির বাইরে গেলেই লুকিয় খাবার নিয়ে যেতো মামা মামির জন্য।প্রায় তিন মাস সে বাড়িতে থাকার পর স্বামীর কোন উন্নতি না দেখে সালেহা ঠিক করেন জমি বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা করবে।কিন্তু জমি বিক্রির মিথ্যা নাটক সাজিয়ে সেই জমিগুলো আত্মসাৎ করে নেয় ফারজানা এবং তার স্বামী বারেক।সালেহার জন্য রাখে কেশবপুরের মাত্র কয়েক বিঘা জমি।
জমি আত্মসাৎতের পর ফারজানা এবং বারেক সিধান্ত নেয় দেশের বাইরে পাড়ি জমাবে।সালেহার হাতে মাত্র দু’হাজার টাকা দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে ফারজানা।সব হারিয়ে কেশবপুরে নতুন করে থাকতে শুরু করে।তখন সালেহার কাছে ছিল কেশবপুর একটি নতুন স্থান।আগের “সন্ধ্যাগ্রাম” নামক স্থানটিতে থাকলেও সময়ের তালে সবটা হয়ে যায় তার কাছে অতীত।
জাবির মাতবর কায়িম নামক কর্মচারির এমন বিপদ শুনে সাহায্যর হাত বাড়ান।সব ঠিকানা খোঁজ খবর পেয়ে আগলে নেন আরমিন এবং রিহানাকে।এভাবেই আজ এতদূর সালেহার পরিবার।তবে অতীতের এত ঘটনা কোনো কিছুই জানেননা জাবিরের পরিবার।সালেহা শুরুতেই তাদের জানিয়ে দিয়েছিলো কায়িমের আপন বলতে কেউ নেই।আর সালেহা ত্যাজ্য করা হয়েছে।অতীতের রেশ ধরে সালেহা আঘাত পাবে বলে কোনদিন ঠিক ভাবে তার বাবার বাড়ির সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি জাবির।’
আরমিন সবে গেট দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো।তাকে দেখে বারান্দা থেকে ছুটে এগিয়ে এলো সালেহা।
_
যতই তালবাহানা সাজাক সালেহা এবং আরমিন মাতবর বাড়িতে যাবে না বলে,কোন কিছুতেই কোন ভাবে সফল হতে পারেননি তারা।গত দুইদিন সালেহা এবং আরমিন কেউ মাতবর বাড়ির ত্রিসীমানায় যায়নি।মিথ্যা অজুহাতে থেকে গেছে বাড়িতে।অপর দিকে তাদের অনুপস্থিতিতে নাহার বেগমের সাথে সাথে বেজায় চটে গেছেন জাবির।তার সোজাসাপটা একটাই কথা,মেহমান থাকাকালীন রোজ তিনবেলা সালেহাও তাদের সঙ্গে খাবেন।সাথে আরমিন রিহানা থাকবে।জাবির আজ সকালেই বেশ রা/গা/রাগি করে করে গেছেন।তাই বাধ্য হয়ে বেলা এগারোটায় আরমিন মাতবর বাড়ির দিকে যায়।
পবন তাকে দেখেই বেশ কড়া নির্দেশে রুমে ডাকে।আরমিনো পিছু পিছু যায় রুমের দিকে।পবন দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে আরমিনের হাতে লাল, নীল, কালো, হলুদ চার সেট চুড়ি হাতে ধরিয়ে দেয়।রেশমি চুড়িগুলো দেখে মূহুর্তেই আরমিনের চোখে মুখে আনন্দের আভাস ছড়িয়ে যায়।
– এগুলো কার?
– তোর।সেদিন ভেঙ্গে দিয়েছিলাম তাই আজ নিয়ে আসলাম।
আরমিন দ্রুত কাগজ থেকে চুড়ি ছাড়িয়ে লাল কালো চুড়ি গুলো হাতে ডুকিয়ে নেয়।দু’হাত নাড়িয়ে রিনঝিন শব্দ তুলে আয়নার কাছে এগিয়ে যায়।পবন তার দিকে আছে অনমনা হয়ে।
– পবন ভাই আমাকে কেমন লাগছে?
– একদম বাজে।
পবন উত্তর দিয়ে ফোন হাতে চলে যায় রুম থেকে।এদিকে আরমিনের বেশ রাগ হয়।ঠোঁট বাকিয়ে দ্রুত চুড়িগুলো খুলে ডয়ারে আড়াল করে রাখে।বাড়ির কেউ দেখলে উলটা পালটা ভাবতে পারে।যাওয়ার সময় চুড়িগুলো নিয়ে যাবে।
_
নাহার তখন মনীরাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলেন।তার সাথে মাঝে মাঝে এক’দু লোকমা মুখে তুলছে প্রমা।আরমিনকে আসতে দেখে মোড়ায় বসার জন্য নাহার তাকে ইশারা করে।
– দেখি হা কর।
– এই অবেলায় আমি ভাত খাবো না বড় আন্টি।
– দিবো একটা চ-ড়।মুখ খোল।
আরমিন বাধ্যে মেয়ের মতো মুখ খুললো।এক গাল ভাত নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
– আমি বড় হয়েছি আমার কি আর আগের দিন আছে নাকি?তুমি আমাকে কত আদর যত্নে ভাত খাইয়ে দিয়েছো সব মনে আছে আমার।কিন্তু এখন আমার সময় নয় ওদের খাওয়াও।
– চুপ করবি তুই?আমার কাছে তুই এখনো সেই ছোট আরমিন।
বেশ কিছুক্ষণ খাওয়াদাওয়ার পালা চুকিয়ে উঠে গেলেন নাহার।তার সাথে প্রমা এবং মনীরাও চলে যায়।ভাতের শেষ লোকমাটা মুখে রেখে বেশ আরামসে চবনে ব্যস্ত আরমিন।হঠাৎ তার চোখে পড়ে সুহাইলের দিকে।ছেলেটা বুকের সাথে হাত ভাজ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে গভীর দৃষ্টিতে।
মূহুর্তেই আরমিনের নাকটা জ্বলে উঠে।গলায় ভাতের দলা আঁটকে কাশতে থাকে বেশামাল ভাবে।সে ছুটে চলে রান্নাঘরের দিকে।তার করুন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সুহাইল।নিজের কপালে হাত চাপড়ে আফসোস সুরে বলে,
– উফফ শীট আমার কারনে।
আরমিনের পিছুপিছু সে নিজেও রান্না ঘরে ছুটে চলে।চারিদিকে ছটফট করে খুঁজেও পানির জগটা পেলো না আরমিন।নাকের তালুতে অস্বস্তিকর জ্বলতে থাকায় সবচেয়ে বড় বিপাকে পড়েছে সে।সুহাইল ততক্ষণে এসে গেছে পানির জগ না দেখেই ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে আরমিনের হাতে দেয়।লেখনীতে পলি আনান।তৃষ্ণার্ত পাখির মতো দিশাহীন ভাবে পানিটা মুখে পুড়ে নেয় সে।পানি পান শেষ ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে।শরীরটা এত ক্লান্ত লাগছে কেন বুঝতে পারলো না আরমিন।
– আপনি কেন আমার পিছু ছাড়ছেন না সুহাইল?আপনাকে দেখলে আমার অস্বস্তি দু’গুন বেড়ে যায়
– কিন্তু আমার মনে যে প্রশান্তি কাজ করে মরিয়ম!তোমাকে দেখলেই আমার চারিপাশের পরিবেশটা অগোচর লাগে।
– উফফ আপনি আমার সাথে এত নরম সুরে কেন কথা বলেন?বাদ বাকি সবার সাথেই কেমন যেন শক্ত গলায় বলেন।আমার কিন্তু এসব ভালো লাগছে না।
– আমার যে ভালো লাগছে।
– আপনি বের হন রান্নাঘর থেকে।কেউ দেখে ফেললে আমার জান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
– তুমি নিচে বসেছো কেন?উঠে দাঁড়াও।
– আপনি যান আমি উঠবো।
– আমি তো যাবো না।
– আমিও উঠবো না।
আরমিনের কথায় ভ্রু কুচকায় সুহাইল।অজান্তে আবারো সে ঠোঁট কামড়ে ধরে।সুহাইলের এই অভ্যসটা মারাত্নক বিদঘুটে লাগে আরমিনের কাছে।সুহাইল এগিয়ে এলো খানিকটা তার কাছে বেশ নরম স্বরে বলে,
– সরি মরিয়ম।
কথাটি বলেই বেশ জোরেই হেঁচকা টানে দাড় করায় আরমিনকে।এত জোরালো থাবায় মেয়েটার হাতের কবজি যেন ছুটে গেছে।বাম হাত দিয়ে ডান হাত ধরে কিছু বলতে নিলেই আরমিনের চোখ যায় দরজার বাইরে।সেখানে ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে দুটো চোখ।সেই চোখের ব্যাক্তিটি রান্না ঘরের কান্ডে যেন বেশ ক্ষুব্ধ।লাহমায় দু’দন্ড পিছিয়ে গেলো আরমিন।ভয়ের তাড়নায় কুঁকড়ে গেছে সে।অপর দিকে সুহাইল তাকিয়ে আছে সহজ চোখে।যেন সে কোন অন্যয় করেনি অবিচার করেনি।সে তার কাজে বেশ খুশি!
#চলবে….