#মায়াপ্রপঞ্চ,১২,১৩
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১২]
________________
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সন্ধ্যায় মাতবর বাড়িতে প্রবেশ করে আরমিন।তাকে দেখে বাড়ির সকলে ভূত দেখার মতো অবস্থা।আমীনা দ্রুত এগিয়ে আরমিনের হাত ধরে টেনে আনলো ঘরের দিকে।
– কিরে আরমিন তোর না জ্বর ছিল?চোখ মুখ এত ফোলা কেন কেঁদেছিস?
– না ছোট আন্টি।আমি ঠিক আছি।
আমীনার কথা শুনে আরমিনকে একবার পরখ করলো নাহার বেগম।মেয়েটার গালে হাত দিয়ে বেশ ক্ষোভের সুরে বলে,
– আমারে সত্যি করে বল,সালেহা কী তোরে বিয়ার জন্য আবার জোরাজোরি করছে?তোর গায়ে হাত তুলছে?এক পাশের গাল ফোলা কেন?
– বড় আন্টি শুধু শুধু চিন্তা নিও না আমি ঠিক আছি।পবন ভাই আছে?
– হ্যা প্রমাকে পড়াচ্ছে তুই যা।
আরমিন দ্রুত গতিতে দোতলায় চলে গেলো।আরমিনকে বাড়িতে ডুকতে দেখে প্লাবন ছুটে যায় সুহাইলের কাছে।সুহাইলের সাথে অবশ্য ছেলেটার এখন বেশ ভাব হয়েছে আরমিনের বিষয়ে টুকটাক খোঁজ খবর চালান করছে তাকে।অবশ্য ভাব হবারি কথা সুহাইলের পক্ষ থেকে দামি দামি গিফট গ্রহন করছে সে।এই তো গত সাপ্তাহে সুহাইল নামকরা ব্র্যান্ডের একটা ঘড়ি গিফট করেছে তাকে।আর সেই ঘড়ি পড়ে স্কুলে গেলে সকল বন্ধুরা অবাক চোখে চেয়ে থাকে।এত দামি ঘড়ি প্লাবনের হাতে আগে কেউ দেখেনি।অবশ্য প্লাবনের হাতে কেন তাদের ক্লাসের কারো হাতেই এই দামি ঘড়ি দেখার সাধ্য মেলেনি।
আরমিন রুমের দরজার কাছে বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।বুকের ভেতরটায় ধুকপুক শব্দ দিগুন বেড়ে গেছে।তাকে দেখে কী রিয়েক্ট করবে পবন সেটা ভেবেই জান যায় যায় অবস্থা।
– আসবো পবন ভাই?
প্রমা,পবন দুজনেই ঘুরে তাকায় দরজার দিকে।আরমিনকে দেখে দুজনের ভূ*ত দেখার মতো অবস্থা হয়েছে।প্রমা অবাক হয়ে শুধালো,
– আরমিন আপু তুমি!
তৎক্ষণাৎ পবন তার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙানি দেওয়ায় প্রমা আবারো পড়তে শুরু করে।পবনের হাতের ইশারা পেয়ে আরমিন রুমে ডুকে যথা স্থানে বসে পড়ে।ব্যাগ থেকে বই বের করে এগিয়ে দেয় পবনের দিকে।আড় চোখে একবার পবন তাকালো মেয়েটার দিকে।দু’চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।দেবে গেছে চোখ দুটো।পাংশুটে মুখটা মলিন হয়ে আছে।তার অবস্থা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে পবন।কয়েকদিন আগে আরমিনের বান্ধবীদের কাছে শাওনের চলে যাওয়ার বিষয়টি অবগত হয় সে।অবশ্য তাতে বেশ খুশি হয়েছে পবন।চুপচাপ নীরস আরমিনকে দেখতে মোটেও ভালো লাগছেনা পবনের।আগের মতো প্রফুল্ল আরমিনকে ফিরে পেতে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে।চট করে পবন একটা সিদ্ধান্ত নিলো।
– প্রমা আজ তোর ছুটি।আমরা ছাদে যাচ্ছি সুমনা খালাকে বলবি দুইটা চা করে যেন ছাদে নিয়ে আসে।
প্রমা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠে চলে যায়।আরমিন এখনো মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে বইয়ের দিকে।হাবভাব এমন পবনের কোন কথাই যেন তার কানে আসে নি।
– আরমিন উঠ।
– আমি পড়তে এসেছি পবন ভাই।এখন কোথাও যাবো না।
– এখন তোকে পড়ানোর মুড নেই আমার।চল ছাদে যাই।
– আমি যাবো না।
আরমিনের দৃষ্টি এখনো বইয়ের দিকেই নত।চঞ্চল মেয়েটার এরূপ আচরণ খুব একটা হজম করতে পারছে না পবন।আরমিনের দিকে সামান্য ঝুঁকে স্বল্প স্বরে বলে,
– হুট হাট তোকে ছুঁয়ে দিতে আমার দ্বিধা লাগে আরমিন।তাই তোকে এখন ছুঁতে চাই না।আমার সাথে আয়।
আরমিন বাধ্যে মেয়ের মতো পবনের পিছে ছুটলো।এতদিন শাওনকে নিয়ে পবনের সাথে বেশ চড়াই-উতরাই করেছে কিন্তু সব শেষে মাঝ পথে শাওনের হাত ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।তার উপর পবনের সামনে বসে থাকতেও লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে।
.
ছাদের কোনায় একটি সোডিয়ামের বাতি ঝুলে আছে।সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছে গোটা ছাদ।যদিও এক সাইডে কিছুটা আবছা অন্ধকার রয়েই গেছে।পবন চায়ের কাপে চুমুক বসালেও আরমিন চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।
– আরমিন তুই কেন এত বিষন্ন তা আমি জানি।যা হয়েছে তা বাদ।আগের মতো হাসি খুশি থাক।
– বাদ বললেই তো আর বাদ দেওয়া যায় না পবন ভাই।
– কে বললো যায় না?আচ্ছা এটা ভাব শাওন থাকা কালিন তোর জীবনে কী ছিল আর এখন কী নেই?
আরমিন পবনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না।মাথাটা ঝুকে রেখেছে এখনো মেঝের দিকে।
– তুই বড্ড বোকা,শাওন আর তোর সম্পর্কের কোন ভালোবাসা ছিল না।যেটা ছিল সেটা টাইম পাস।তুই শাওনের সাথে ঠিক যতটুকু নিজের মন থেকে মিশেছিস তার থেকেও বেশি মিশেছিস আমাকে জ্বালানোর জন্য।আমি তোদের দেখলেই গন্ডোগোল করি তাই তুই আমাকে বা-দ-র নাচ নাচানোর জন্য এমন করেছিস আরমিন।সবটাই মানলাম কিন্তু শাওন ছেড়ে যাওয়ায় এত কান্নাকাটির কি আছে?
আরমিন চকিতে তাকালো পবনের দিকে।লজ্জায় নিংড়ে যাচ্ছে সে।কী করে বলবে সে শাওনের সাথে যেদিন থেকে জুড়েছে সেদিন থেকে বান্ধবীদের সাথেও তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে।আলাদা ভাব নিয়ে চলতো সে।আর এখন শাওন তাকে ছেড়েই চলে গেলো।মানসম্মান তো কিছুই রইলো না তার।
পবন আরমিনের চিন্তিত মুখটা দেখে শব্দ করে হেঁসে উঠলো।আরমিনের মাথায় গাট্টা মে-রে বলে,
– সবাই বেইমানি করলেও এই পবন তোর সাথে বেইমানি করবে না।এই বান্দাকে বিশ্বাস তো করাই যায়!করিস বিশ্বাস আমায়?
আরমিন হাসে।একগাল হাসি দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।এই মূহুর্তে সবটাই হালকা লাগছে তার।শাওন নামের মানুষটার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।তার জীবনে মা, বাবা, বোন, পবন ভাই,বড় আন্টি, ছোট আন্টি,বড় আঙ্কেল, ছোট আঙ্কেল আছে এদের ছেড়ে আর কাকেই বা চাই তার?এরাই তার সবচেয়ে বেশি আপন।
_
আরমিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত দশটা বেজে এসেছে।একই গলির রাস্তায় বাড়ি হওয়ায় সে এত রাতে একাই যেতে পারে।মাতবর বাড়ির গেট থেকে বের হতেই দেখা হয় সুহালের সাথে।ছেলেটা ফোনে কারো সাথে কথা বলে ডুকছে আরমিন তাকে দেখে দ্রুত বাড়ির দিকে যেতে নেয়।তৎক্ষনাৎ পথ আটকে দাঁড়ায় সুহাইল।
– কেমন আছো মরিয়ম?
– ভালো।রাস্তা আটকালেন কেন?আমি বাড়ি যাবো সরুন সামনে থেকে।
– এতদিন কোথায় ছিলে?তোমার দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছিলো।
– জাহান্নামে ছিলাম।
আরমিন আবারো হাটা শুরু করে তার সাথে পা মেলায় সুহাইল।ছেলেটা কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে,
– তুমি আমাকে কেন সহ্য করো না মরিয়ম?
– আপনি একজন বিরক্তিকর ব্যাক্তি।সেই ছোট থেকেই জ্বালাচ্ছেন আমাকে এবার একটু রেহাই দিন।
– অন্তত যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোমার রেহাই নেই।আর এত বিরক্ত হচ্ছো কেন?আমরা তো বন্ধুর মতো তোমাকে আমি জ্বালাই তুমি অন্তত আমায় জ্বালাও দেখবে শোধবোধ।
– আপনার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়ার ইচ্ছা আমার নাই।আগে বোকা ছিলাম এখন চালাক হয়েছি বুঝেছেন?
– নিজেকে নিজে চালাক ভাবাও কিন্তু বোকার কাজ।
সুহাইল কথাটি বলে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে।নিজের কথায় নিজে লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে যায় আরমিন।সুহাইল হাসতে হাসতে আবারো উলটো দিকে হাঁটা শুরু করে। ফিরে আসে মাতবর বাড়ির গেটের সামনে।সেখানে বারেক খন্দকার দাঁড়িয়ে আছেন গম্ভীর দৃষ্টিতে।সুহাইল তার বাবাকে দেখে ভয়ে একবার ঢোক গিলে।
– সুহাইল তোমাকে বলেছিলাম ওই উটকো ঝামেলার গোডাউনের সদ্যদের সাথে মিশবে না।তারপরেও তুমি কি কথা বলছিলে মেয়েটার সাথে?
সুহাইলের বাবার কথার ধাঁচে বেশ রাগ লাগে তার।তবুও নিজেকে দমন করে বলে,
– বাবা অপমান করছিলাম হেঁসে হেঁসে।তাদের বোঝাচ্ছিলাম তাদের অবস্থান আর আমাদের অবস্থান।আমরা কত সুখে আছি।ওইসব নিয়ে ভেবো না তুমি আমি ওদের সহ্যই করতে পারি না।আসো ঘরে ফিরি।
ছেলের কথার ভঙ্গিতে সন্তুষ্ট হলেন বারেক।এতদিন ভয়ে পেয়েছিলেন ছেলেটা আগের মতো না বেঁকে বসে।
__
সন্ধ্যার পর থেকে টুম্পার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে বলা চলে।তার চাচা চাচী বেশ দাম্ভিক মানুষ।সর্বদা নিজের স্বার্থ বিচারে তারা এক ধাপ এগিয়ে।টুম্পার পরিবার অস্বচ্ছল বলে তার চাচা,চাচীর কাছে থেকে পড়ে মানুষ হচ্ছে সে।কোন দিন কোন কিছুর ত্রুটি রাখেনি তারা।মেয়েটাকে রাজার হালে রেখেই বড় করছে।বিয়ের বয়স যখন এসেই পড়েছে তখন টুম্পার জন্য বেশ নামি-দামি ঘর থেকে একটি বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছেন তারা।ব্যবসায়ী হওয়ার খাতিরে বেশ উচ্চবিত্ত মানুষের সাথে উঠা বসা টুম্পার চাচা তোফাজ্জলের।কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবের কথা টুম্পাকে জানাতে সে বিয়ে করবে না বলে জানায়।পবনের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে মাথায় যেন রক্ত উঠে গেছে তোফাজ্জলের।সন্ধ্যার পর থেকে বেশ তর্ক ঝামেলা চলেছে টুম্পা এবং তার চাচা চাচির সাথে।অবস্থা এতটাই বেগতিক কখন যে তোফাজ্জল টুম্পার গায়ে হাত তুলে বসেন সেই ভয়ে আছে বাড়ির বাকি সদস্যরা।
– মাতবর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব রাখতেও কলিজা লাগে বুঝস তুই?আমি যত বড় ব্যবসায়ী হই না,আমার থেকেও বড় ব্যবসায়ীর পোলার লগে তোর বিয়া ঠিক করছি।
– চাচা একবার জাবির আংকেলে কাছে প্রস্তাব নেন তারা নিশ্চই মানবে।
– তোর মাথা ঠিক আছে?পবন ছেলেটা এখনো নিজের পায়ে দাঁড়ায় নাই সেই ছেলেকে কিছুতেই বিয়া দিবেন না মাতবর আমি জানি।আর তোর পরিবারের আর্থিক দিক বিচার করতে গেলে সাহায্যর হাত বাড়াই দিবে বাড়ির বউ করবো না।
– চাচা একবার বলে দেখুন হ…..
টুম্পা কথা শেষ করার আগেই তোফাজ্জল রাগটা দমাতে পারলেন না।হাতের সামনে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ছুড়ে মারলেন টুম্পার গায়ে।ভয়ে আর্তনাদ করে উঠে টুম্পার চাচি।ভাগ্য ভালো গ্লাসটা দেয়ালের সাথে বারি লেগে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে টুম্পার গায়ে কোন আঘাত আসেনি।
#চলবে…..
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৩]
________________
বারেক খন্দকার সুহাইলের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ ছেলেটা কার সাথে যেন বেশ রাগারাগি করে কথা বলছে।তবে কী নিয়ে ছেলেটার মাথা গরম তা বুঝলেন না বারেক।দরজা নক করে ডুকেন তিনি,তাকে দেখে ফোন রেখে ঘুরে বসে সুহাইল।
– বাবা কিছু বলবে?
–
– হ্যা।আমি দেশে এসেছি ঠিক কোন কাজে তুমি জানো।ঢাকায় যে জমিগুলো আছে যেগুলো বিক্রি করে নতুন বাড়ি কিনতে চাই।আমি একজন ক্রেতা পেয়েছি।সেই ভদ্রলোক জমি কিনতে ইচ্ছুক আমি যে দামে বিক্রি করতে চেয়েছি তার থেকেও বেশ বেশি লাভ করেই বিক্রি করতে পারবো।
– তবে বেঁচে দাও।সমস্যা কোথায়?
– এই বাড়িতে আর কত দিন থাকবে?মাস ফুরিয়ে এলো আমাদের বরং এখন ঢাকায় ব্যাক করা উচিত।
ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে দমে গেলো সুহাইল।ঢাকায় গেলে আরমিনকে আর দেখতে পাবে না সে।বুকের ভেতরটায় শুরু হয় অসহ্যকর চিনচিন ব্যাথার।তার প্লানিং এ পৌঁছাতে হলে তাকে ঢাকায় অবশ্য যেতে হবে।বাবা মায়ের আড়ালে নিজের জন্য আলাদা ফ্লাট কিনবে সে।সেখানে আরমিনদের পরিবার থাকবে।সবটা যখন পরিকল্পিত তখন দেরি করা ঠিক হবে না।তাই বারেক খন্দকারের কথায় তাল মেলায় সুহাইল।
– কাল রাতে চলো।আমরা কাল রাতের বাসে করেই ঢাকায় ফিরবো।
– তুমি বাসে যাবে?
– হ্যা সমস্যা কোথায়?
– আমি যাবো না।আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি তাতেই যাবো।ভাড়া একটু বেশি যাবে তাতে সমস্যা নেই।তুমি তোমার ব্যাগপ্যাক ঘুছিয়ে তৈতৈরি থেকো।
বারেক চলে গেলো সুহাইল দ্রুত গায়ের টি-শার্ট খুলে শার্ট পরে নেয়।এখন আরমিনের সাথে দেখা করা তার বড্ড জরুরি।
_
সুহাইল বিকেলে আরমিনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলেও দেখা করতে পারেনি কোন মতে।তবে প্লাবনের সাহায্য রিহানার সাথে কথা হয়েছে তার।পরের দিন আরমিন সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বের হবে পশ্চিম বাজারের কাছটায় ক্লাস সেভেনে পড়া একটি মেয়েকে পড়ায় সেই সময়।তাই সাড়ে সাতটা নাগাদ বড় সড়কের মোড়ে আরমিনকে পাওয়া যাবে।
এত সুন্দর একটা সুযোগ পেয়ে সড়কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সুহাইল।এত সকাল সকাল তার ঘুম থেকে তার ওঠা না হলেও আরমিনের জন্য আজ তাকে উঠতেই হচ্ছে।
বেশ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছে আরমিন।রাস্তায় তেমন কোন যানবাহনের দেখা নেই।লং থ্রি পিছের সাথে হিজাব করে নিয়েছে সে।সকালের পরিবেশটা উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলছে মেয়েটা।
– শুভ সকাল মরিয়ম!
চট করে ঘুরে তাকালো আরমিন।অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটিকে দেখে দু’কদম পিছিয়ে যায় সে।এই মূহুর্তে সুহাইলকে দেখতে পাবে তা জীবনেও ভাবেনি সে।
– আপনি এখানে?
– তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আরমিন সুহাইলের কথার মানে বুঝে বড় বড় পা ফেলে হাটা শুরু করলো।সুহাইল তার হাটার গতি ধরে নিজেও পা চালালো।
– আল্লার দোহাই আমার সাথে আসবেন না।আমাকে আর আপনাকে কেউ দেখলে বাজে কিছু ভেবে নেবে।আপনার বাবা দেখলে চিরতরে আমাদের জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে।
– এত ভয় পাও কেন?আমার বাবা তোমাদের জীবন জাহান্নাম সরূপ করলে তার পুত্র তোমাদের জীবন বেহেশতের মতো করে দিবে।একটু তো বিশ্বাস করতেই পারো।
– শু-কুরের পেট থেকে কখনো বাঘ হতে দেখেছেন?শু-কুরের পেট থেকে শু-কুর জন্মায়।
আরমিন বেশ ঘৃণা নিয়ে কথা বলে চলে যায়।লাহমায় থমকায় সুহাইল।কথাটা যেন তার বেশ ভালোভাবেই গায়ে লেগেছে।অপমানে থমথমে হয়ে গেছে তার মুখ।তবুও আরমিনের প্রতি একটুও ক্ষোভ জন্ময়নি বরং আবারো পিছু চললো আরমিনের।
– আমি আজ রাতেই চলে যাবো মরিয়ম।এটাই হয়তো আমাদের এই পর্যন্ত শেষ দেখা।
– আল্লাহ কবুল করুক।এটাই যেন আমাদের শেষ দেখা হয়।
– উহু ভুলেও না।তবে এরপর এমন ব্যবস্থা করে আসবো সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতে তুমি আমার মুখ দর্শন করবে বুঝলে?
আরমিন উত্তর দিলো না।দ্রুত গতিতে চললো নিজের গন্তব্যস্থলে।সুহাইল এগিয়ে যেতে খেয়াল করে জাবির মাতবর একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।লায়মায় উলটো পথে হাঁটা শুরু করে সে।কিছুতেই জাবিরের কাছে সন্দেহের পাত্র হতে চায় না সে।
_
সন্ধ্যায় জাবির মাতবর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন আয়েশ করে তার পাশেই পান সাজাতে বসেছে নাহার বেগম।স্বামীর চিন্তিত মুখটা দেখে শুধালেন তিনি,
– কি ভাবছেন পবনের আব্বা?
– আমি দীর্ঘদিন একটা কথা ভাবছি বুঝলে তবে সাহস কুলিয়ে তোমায় বলতে পারছি না।
– কী কথা?
– আমরা তো চাই আরমিনের একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে।এবং এটাও চাই মেয়েটা যেন সুখে সংসার করতে পারে।আমরা নিশ্চিন্ত মনে থাকি।
– তা আর বলতে।হিরের টুকরো মেয়েটার জন্য প্রতি মোনাজাতে এই দোয়াই করি
আমি।
– আমি ভাবছিলাম পবনের জন্য আরমিনকে আনলে কেমন হয়?মানে মাতবর বাড়ির বড় ছেলের পুত্র বধূ আরমিনকে করতে চাই।
নাহার বেগমের মুখটা মূহুর্তে পাংশুটে হয়ে গেছে।ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ জাবিরের দিকে।তার এমন চাহনীর কারন বুঝলো না জাবির।
– আপনার মাথা ঠিক আছে পবনের আব্বা?আপনি কিসব ভাবছেন।
– মন্দ কি ভাবলাম?
– আরমিনকে আমরা মানুষ করেছি আমরা
জানি আরমিন কেমন নিঃসন্দেহে মেয়েটা ভালো।তাই বলে আমি আমার ছেলের বউ করে আনবো?মাতবর বাড়ির বড় ছেলের সে।তার বউ হবে কোন উচ্চ বংশের ঘরের মেয়ে শিক্ষিত।আরমিনের কোন বংশ পরিচয় আজ পর্যন্ত আমরা জানি না।আপনার মাথায় এইসব কথা আসলো কী করে?
– তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?আরমিন খারাপ কোন দিক দিয়ে?
– আমি আর এই ব্যাপারে কিচ্ছু শুনতে চাই না।আরমিনের সাথে আমার ছেলের বিয়ে কিছুতেই আমি দেবো না এটাই আমার শেষ কথা।তোমার চিন্তা ভাবনা তুমি বদলাও।আমি খুব শীঘ্রই আরমিনের বিয়ে দেবো তোমার বিশ্বাস নেই কখন জানি বিয়ের কথা পাকা করে বসো।
_
কেটে গেলো আরো দু’দিন।সুহাইল সেদিন রাতেই ঢাকায় ফিরে গেছে এতে যেন সন্তুষ্ট সালেহা এবং আরমিন।আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে দুজনেই স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।অপর দিকে টুম্পার কোন খোঁজ পাচ্ছে না পবন।মেয়েটা হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গেলো।অবশেষে প্রমাকে কাজে লাগিয়ে পাঠানো হয় টুম্পার চাচার বাড়ি সেখান থেকেই জানতে পারে টুম্পা তাদের বাড়িতে বিশেষ প্রয়োজনে দুদিন আগে চলে গেছে।ফোনটা ভেঙ্গে যাওয়ায় সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
বন্ধুদের আড্ডায় আজ যুক্ত হয়েছে সোহাগ।ছেলেটা নারায়ণগঞ্জ শহরেই থাকে।বছরে একবার দেখা হয় বন্ধুদের সাথে।বন্ধুদের কথার মাঝে সবাই মিলে সিধান্ত নেয় তারা ঘুরতে যাবে তবে কোথায় যাবে সেটা নিদিষ্ট নয়।প্রথমে চট্রগ্রাম শহটার পর্যটন এলাকা ঘুরে দেখবে,এভাবে দুই,তিনটি শহর ভ্রমন শেষে কেশবপুরে ব্যাক করবে তারা।সবাই সিধান্তে একমত পোষণ করলে পবন জানায় তারা আগামীকাল রাতেই বেরিয়ে যাবে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্য।রাতের জার্নিটা অন্যরকম আনন্দ দেয় তাই এই সুযোগ মিস করতে রাজি নয় সে।
.
দীর্ঘক্ষণ যাবৎ সালেহার ব্রেন ওয়াশ করছে আরমিনের বান্ধবী মনি এবং তাসনিম।মনির দেশের বাড়ি টাঙ্গাইলের কোন এক গ্রামে।মনির বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্য তাসনিম এবং আরমিনকেও দাওয়াত করা হয়েছে।তাসনিমের পরিবার তাকে যেতে দিতে রাজি হলেও সালেহা কিছুতেই আরমিনকে যেতে দিতে চায়না।তাই দুই বান্ধবী মিলে সালেহার ব্রেন ওয়াশে ব্যস্ত।অবশেষে সালেহা মনির মায়ের সুপারিশে আরমিনকে যেতে দিতে সম্মোতি জানান।তিন বান্ধবী একা গ্রামে ঘুরতে যাবে ভেবে খুশিতে আত্মহারা।
_
রাস্তার মোড়ের একটি ভ্যারাটিজ দোকানে বসে রঙ চায়ে চুমুক বসালো পবন।সামনে বসে আছে তার দুই তিন বন্ধু সোহাগ,সায়মন,রিজু।আজ সকালেই তারা চট্রগ্রাম এসে পৌছে গেছে।তবে নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার আগেই তাদের মাঝ রাস্তায় দাঁড়াতে হলো।সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু।চারজনেই দুটো বাইকে আসায় সবাইকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো বৃষ্টির ফোঁটারা।তারাও বেশ ইঞ্জয় করছিলো সময়টা কিন্তু মুহূর্তে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরিনতি হলো ভারী বর্ষণে তাই দোকানের ছাউনির এক পাশে বাইক দাড় করিয়ে তারা এসে বসে যায় দোকানে।চার বন্ধুর নিরবতা ফেলে সোহাগ পবনের উদ্দেশ্য একটা কঠিন প্রশ্ন করে বসলো।
– টুম্পারে কী আসলেই ভালোবাসিস নাকি?মেয়েটার ব্যাপারে যতটুকু জানলাম বুঝলাম এটাতো টক্সিক রিলেশন।ফোর্স করে প্রেমের ফাঁদে ফেললো আর তুইও তার তালে নেচে যাচ্ছিস অদ্ভুত।
সোহাগের প্রশ্নে পবন কোন উত্তর দিলো না।সে বাইরে তাকিয়ে আছে শক্ত দৃষ্টিতে।নিজের কাছেই মাঝে মাঝে প্রশ্ন বদ্ধ হয় সে আসলেই কী টুম্পাকে ভালোবাসে?নাকি মিথ্যা মায়া।অবশ্য মেয়েটার প্রতি তার কোন মায়াও আসে না।কিন্তু কেন আসে না তা জানেনা সে।একটা সম্পর্কে মায়া,মমতা অনুভূতি না থাকলে কি করে সেই সম্পর্কের নাম ভালোবাসা দেয়া যায় সেই প্রশ্নের কোন উত্তর পায় না পবন।
সায়মন কাপে থাকা শেষ চা’টা ছুডে মারলো পিচ ঢালা রাস্তায়।বেঞ্চিতে আয়েশি ভঙ্গিয়ে বসতে বসতে বেশ রোষ নিয়ে বলে,
– আরে আমি কত দিন বললাম এটা কোন ভালোবাসা না।এটা জাস্ট একটা আজাইরা প্যাচাল চলছে পবনের জিবনে।সময় থাকতে ব্রেকাপ কর ভাই।এইসব আজাইরা সম্পর্কের চাইতে সিঙ্গেল থাকাই ভালো।
এবারো পবন উত্তর দিলো না।ছেলেটার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে।তার শোচনীয় অবস্থা বুঝতে পেরে কথা পালটে নেয় রিজু।
– এই বাদ দে তো এই টপিক।আমিও জানি পবন টুম্পাকে ভালোবাসে না।আমরা এত বলেও লাভ হবে না যতক্ষণ না পবন তার নিজের ডিসিশন নিজে নিচ্ছে।
রিজু কথা এড়িয়ে গেলো।চোখ ইশারা করলো বাকি দুই বন্ধুকে।সোহাগের যেন কোন গরুত্বপূর্ন কথা মনে পড়ে গেছে।দ্রুত কাপে থাকা শেষ চা’টা শেষ করে বলতে থাকে,
-এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই বলিনি।আমার চাচাতো ভাই এবার দেশে ফিরেছে।দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ।সৌদি আরব থাকে তার ভালোই ইনকাম।বাড়িতে দোতলা ঘর করেছে।তার জন্য একজন ঘরনী মেয়ে চাই।আরমিনকে তো আমি চিনি ভাবছি আরমিনের জন্য প্রস্তাব রাখবো।কি বলিস পবন তোর সম্মোতি আছে?
– একদমি না।
গম্ভীর কন্ঠে হুট করেই বলে উঠলো পবন।হাতে থাকা চায়ের কাপটি ধরেছে বেশ শক্ত করে।মস্তিকে হঠাৎ রাগের আনন্দোলন হওয়ার কারনটা সে নিজেও বুঝতে পারলো না।সায়মন পবনের পিঠ চাপড়ে আশ্বাস শুরে বলে,
– আরে ভাই ভালো সম্বোধন।পরিচিত কারো হাতে তুলে দিতে পারলে সবাই নিশ্চিন্ত থাকতে পারবি।
– দরকার নেই।আরমিনের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে নিয়ে তোদের মাথা ব্যাথা কেন?
পবনের অর্থহীন রাগ দেখে মুখ বাকালো রিজু।এতদিন মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত কথাগুলো বলে দিলো নিমিষেই।যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা পবন।
– আরে এই শা*লার এইসব আজাইরা তেজ তোরা দাম দিস না।আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ডুবে ডুবে আধা জল খেয়ে ম*রছে সে।কার জন্য জানিস আরমিনের জন্য।ভালোবাসে মেয়েটাকে।
স্থির নয়নে রিজুর দিকে একবার তাকালো পবন।একবার ঢোক গিলে শুষ্ক গলাটা ভিজিয়ে নিলো।মাথার ভেতরটা সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।কিছুক্ষণ আগের রাগের রেশ কেটে হৃদয়টা হঠাৎ পুলকিত হয়ে উঠেছে।চোখের সামনে ভেবে উঠে আরমিনের মুখটা।কী যে মায়া এই মুখখানায়।বুকের ভেতরটায় খা খা করে উঠে লাহমায় যেন বুকটা আজ শূন্য উদ্যান।আরমিনকে এই মূহুর্তে বড্ড বেশি মিস করছে।সায়মন এগিয়ে এলো পবনের হাত থেকে কাপটা নিয়ে হেয়ালি স্বরে বললো,
– আরে এই ব্যাটার মনে আরমিনের জন্য ভালোবাসা নাই।যা আছে সব হলো উলটা পালটা রাগ।
– আছে!
– কী?
– ভালোবাসা।
পবনের সহজ স্বীকারোক্তিতে ভূত দেখার মতো চমকে তাকায় তিন বন্ধু।পবনের দৃষ্টি তখনো পিচ ঢালা রাস্তায়।বৃষ্টির গতিক বেড়ে গেছে।তিন বন্ধু মহা উল্লাসে এগিয়ে আসে তার কাছে।রিজু অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে পবনের দিকে।তবুও শিওর হতে পুনরায় প্রশ্ন করে।
– ওই কি বলছিস সোজা সাপ্টা বল।
রিজুর কথায় পবন উত্তর দিলো না।দ্রুত সিগারেট জ্বালিয়ে এগিয়ে গেলো বাইকের কাছে।ত্বরান্বিত বাইকে বসে বাইকটাকে নিয়ে যায় সরু রাস্তায়।বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোর বলে,
– আমি ফেসে গেছিরে খুব বাজে ভাবে ফেসে গেছি।তোরা আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছিস।এই মায়া থেকে বেরিয়ে আসার কোন রাস্তা নেই।
#চলবে..