#মায়াপ্রপঞ্চ,১৬,১৭
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৬]
________________
বিয়ে বাড়ির হই হুল্লোড়ে বেশ সকাল করেই ঘুম ভেঙ্গে যায় সুহাইলের।গত রাত আরমিনের সাথে কথা শেষ করার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে যায় ফলে রাতের খাওয়াও হয়নি।এই সকালে এখন তার ভীষণ খিদে পেয়েছে।খাওয়ার আগে তাকে ফ্রেশ হতে হবে তাই রুম ছেড়ে বাইরে বের হলো সে।মাঝ উঠনে নানান মানুষকেই দেখা যাচ্ছে।তাদের মাঝে সবাই মহিলা পরিচিত কোন পুরুষের দেখা নেই।কিছুটা খুঁজে ঘরের কোনে দেখা পেলো আরমিনের।মেয়েটা দাঁত মাজতে ব্যস্ত।ত্রস্তব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো সুহাইল।
– গুড মর্নিং মরিয়ম।
আরমিন তড়িৎ গতিতে তাকালো।বিরক্তিকর অনুভূতির মতো কুচকে গেলো তার মুখ।
– শুনুন আঠার মতো আমার সাথে থাকবেন না।গ্রামের মহিলারা এসব মোটেও পছন্দ করেনা।আমার দিকে বিশ্রি কথা তুলে অপবাদ ছুড়ে দিতে দু’বারো ভাববে না।তাই দয়া করে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন।
– ইসসস কি আমার মানুষরে যে তার সাথে লেগে থাকবো।মাফী তোমায় বলেনি আমার যত্ন নিতে তার যেহেতু বিয়ে সে এখন ব্যস্ত থাকবে।মনি তাসনিম তো আমার সামনেও আসে না।তুমি যেহেতু আমায় চেনো আমার দেখভালের দায়িত্ব তোমায় দেওয়া হয়েছে তোমার মনে নেই?নাকি মাফী বলেনি?
– হ্যা মাফী ভাইয়া আমাকে বলেছি।বলুন আপনার কী চাই?
– ওয়াশরুমে যাবো তুমি বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে থাকবে।
– অদ্ভুত আপনি যাবেন আমি দাঁড়িয়ে থাকবো কেন?
– এদের বাথরুম দেখেছো?দরজা নড়বড়ে আমার তো ডুকলেই গা কাঁপে কখন জানি দরজা ফসকে খুলে আসে।না হয় কেউ ডুকে যায়।বাবা আমাকে বার বার সর্তক করেছিলো গ্রাম তোমার জন্য না।তুমি মানাতে পারবেন না।কিন্তু আমি একপ্রকার যু-দ্ধ করে এখানে এসেছি।সব কিছুর মাঝেই ইঞ্জয় করার একটা ব্যাপার আছে।গ্রামের এই পরিবেশটাও আমার জন্য অভিজ্ঞতা সরূপ।কী ঠিক বলেছিনা মরিয়ম?
আরমিন কিছু বললো না সে শুধু ঠোঁট টিপে হাসছে।সুহাইলের গায়ে সাদা টি-শার্ট,থ্রি কোয়াটার প্যান্ট।দু’চোখ ফুলে রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে।সে এগিয়ে গেলো বাড়ির শেষ কোনায়।বাথরুমের দরজা খুলে ডুকতে একবার মুখ কুচকে তাকালো আরমিনের দিকে আরমিন হাঁসছে।সুহাইল ভেংচি কেটে প্রবেশ করে টয়লেটে।
ব্যাগ থেকে নিজের জামা বের করতে ব্যস্ত সুহাইল।এই সকালে গোসল না সারলে সারাটা দিন তার মন্দ কাটবে তাই জামা,গামছা নিয়ে মাফীকে ডেকে পাঠায়।
– আমাকে ডেকেছিস সুহাইল?ক্ষুদা লেগেছে?আম্মা খিচুড়ি করেছে আনবো?
– না ভাই আগে গোসলের ব্যবস্থা করে দে।গা ঘিন ঘিন করছে এই মূহুর্তে আগে গোসল জরুরি।
– পুকুর ঘাটে চল সেখানেই গোসল করতে হবে।
– কী!আমি সাতার পারি না।যদি পা পিচলে পড়ে যাই আমাকে তুলবে কে?আর তোদের পুকুর বেশ বড়।
– আরে মগ দেবো এত চিন্তা নিস না চল ব্যাটা।অনেক তো কানাডার হাওয়া গায়ে লাগিয়েছিস এবার অন্তত এই বাংলার হাওয়া লাগা।
সুহাইল ঠোঁট কামড়ে হাসে।মাফীর সাথে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় পুকুর ঘাটে।আরমিন পুকুর ঘাটের সিড়িতে বসে আছে।কানে তার ফোন নিশ্চই কারো সাথে কথা বলছে।বিষয়টা বোঝার জন্য এগিয়ে গেলো সুহাইল।কয়েক সেকেন্ডেই বুঝে নিলো সালেহার সাথে কথা বলছে সে।
– এই আরমিন!
মাফীর ডাকে ঘুরলো সে।মাফী ইশারায় সুহাইলকে ইঙ্গিত করে বলে,
– ও সাতার পারেনা।একটু দেখো আমার কাজ আছে কাজ সেরে আসি।
মাফী চলে গেলো নিজের কাজে।আরমিন দ্রুত ফোন কেটে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে সুহাইলের উপর।
– গোসল করবেন?তো করেন সময় দশ মিনিট দিলাম এর বেশি দেরি হলে আমি কিন্তু চলে যাবো।
– আহ এত গরম দেখাও কেন আমি যদি এখন পড়ে ডুবে যাই তাতে তোমারি লস।অল্প বয়সে জামাই হারাবে।
– জামাই!কে জামাই?
– কেন আমি।বিয়েটা আমার সাথেই হবে দেখে নিও।ঢাকায় ফ্লাট কেনা শেষ তোমাকে নিয়ে সেখানে উঠবো আমার ভাই ‘সিয়াম’ তো সারাদিনি ফোন করে জ্বালিয়ে মারে ভাবির সাথে কথা বলিয়ে দাও, ভাবির সাথে কথা বলিয়ে দাও।
– এই আপনার আজাইরা প্যাচাল শুনতে আমি রাজি নই গোসল করুন।আমি গেলাম পানির নিচে সিড়িতে নামবেন না মগ কেটে করে উঠে আসুন।
সুহাইলকে রেখেই আরমিন চলে গেলো বাড়ির দিকে।
.
সময় যত পেরিয়ে যায় বিয়ে বাড়ির পরিবেশ তত পাল্টাতে থাকে।মেহমান গিজগিজ হয়ে গেছে পুরো বাড়ি।তার মাঝেও সুহাইলকে বিশেষ যত্নে রাখছে মাফীর পরিবার।মনি কাজের মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ ব্যস্ত করে নিয়েছে।তার সাথে হাতে হাত মেলাচ্ছে তাসনিম এবং আরমিন।বাড়ির রাস্তা থেকে সারা উঠোন জুড়ে মরিচ বাতি এবং আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে সাজানো।মাঝ উঠনে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।কাঁচা গাঁদা,গোলাপ,বেলি ফুলের সাহায্য স্টেক ডেকোরেড করা।সুহাইল কাঁঠালি রঙের পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়ে নিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।মাফীর বন্ধুদের সাথে তার কিছুটা ভাব জমে গেছে।অপরদিকে আরমিনরা সব ফ্রেন্ড কাজিন মিলে একই রঙের শাড়ি পড়েছে।হলুদ,লাল,কমলার মিশ্রনে জামদানি শাড়িতে সবাইকে বেশ সুন্দর লাগছে।একটা রুমে ড্রেসিং টেবিল থাকায় সবাই বেশ হুড়োহুড়ি করে রেডি হচ্ছে।বাদ বাকি রুম গুলোতে মুরব্বিদের অবস্থান পরিলক্ষিত।আরমিনের সাজ প্রায় শেষের দিকে শুধু চুলটা সেট করতে কিছুতেই জায়গা পাচ্ছেনা।বিরক্ত হয়ে বাদ বাকি সব রুম চেক করে সুহাইলের রুমের সামনে পড়ে।রুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো অবশ্য মাফী সবাইকে বার বার সর্তক করে দিয়েছে সুহাইলের রুমে কেউ যেন প্রবেশ না করে তাই এই রুমটাই ফাঁকা পেলো আরমিন।রুমটা ফাঁকা পেয়ে দরজা খুলে সেখানে প্রবেশ করে সে।দ্রুত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল খোপার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।
বাইরে উঠনে সবার সাথে টুকটাক আড্ডা শেষে ক্লান্ত লাগছে সুহাইলের কাছে।গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে তাকে অবশ্য হিমশিম খেয়ে হচ্ছে তবুও কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে হাসিমুখে চলছে সে।দরজা ঠেলে ভেতরে ডুকতে চলমান পা দুটি স্থির হয়ে যায়।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরমিন।মেয়েটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত।উন্মুক্ত পিঠে চোখ পড়তে বুকের ভেতটা ধুক করে উঠে সুহাইলের।প্রমত্ত হৃদয়টা ব্যাকুল হয়ে যায় লাহমায়।বিক্ষিপ্ত মনটায় এই মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার অভিলাষ জেগে উঠেছে।খোলা জানলায় মৃদুমন্দা বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে হৃদয়কুল।হঠাৎ আলোকিত পরিবেশটা বিদায় জানিয়ে বিদ্যুৎ চলে যায়।ঝাপিয়ে নামে অন্ধকার।সবার মাঝে শুরু হয় হইচই।আরমিন ঘুরে তাকালো আবছা আলোয় দেখতে পেলো না কাউকে।বিরবির করে উগরে দিলো তার রাগ।
– অসহ্যকর এই বাড়িতে আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ চলে যায়।এই গরমে ফ্যান ছাড়া কি টেকা যায়?নাকি বিয়ে বাড়িতে লাইট ছাড়া চলা যায়।
আরমিনের কথাগুলো শুনছিলো সুহাইল।এগিয়ে গেলো খানিকটা তার পায়ের আওয়াজে নড়ে উঠে আরমিন।
– কে?কে রুমে?
সুহাইল উত্তর দিলো না বরং এগিয়ে গেলো আরো কাছে।অন্ধকার ঘিরে থাকা রুমটায় আরমিন অনুভব করে কারো গরম শ্বাস প্রশ্বাস তার চোখে মুখে আঁচড়ে পড়ছে।ভয়ে দু’পা পিছিয়ে যায় সে।ফল সরূপ ড্রেসিং টেবিলের সাথে বেশ শব্দ করে ধাক্কা লাগে।
– কে?কথা বলছেন না কেন?
আরমিনের কন্ঠটা এবার ভীতু শুনালো।জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দটা কানে গেলো সুহাইলের।সুহাইল এবার খানিকটা এগিয়ে গেলো।বাইরে সবাই মোবাইলের ফ্লাশ লাইট কেউ বা মোমবাতির ব্যবস্থা করেছে।সেখান থেকে ছটাক আলো ডুকছে রুমে।তাতেও খুব একটা ঠাহর করা যাচ্ছে না উপস্থিত সুহাইলকে।
– মরিয়ম আমি!
সুহাইলের কন্ঠে শিউরে উঠলো আরমিন।কেমন যেন ঘোর লাগা সেই কন্ঠ।।
– আপ…আপনি রুমে ডুকলেন কখন?আর আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?
সুহাইল হাসলো সেই হাসির ধরন দেখতে পেলো না আরমিন।সুহাইল তৎক্ষনাৎ একটা বিমূঢ় কাজ করে বসলো।থাবা বসালো আরমিনের পিঠে।এগিয়ে নিলো তার একদম কাছে।আরমিন যেন সুহাইলের পরবশে নিঙড়ে গেলো।ছেলেটার ছোঁয়ায় অপ্রতিভ অবস্থায় পড়লো সে।সুহাইলের হাত তখন মেয়েটার পৃষ্ঠে বিচরণ করছে।প্রণয়ের তীব্র যতণা মুষড়ে দিচ্ছে সেই হাত দুটোর অধীকারিকে।
– সু…সুহাইল?
– হু।
– ছেড়ে দিন এমন কেন করছেন?
সুহাইল উত্তর দিলো না।বরং আচম্বিতে প্রণয়িনীর কাঁধে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো।প্রমত্ত মনটকে বাঁধা দিতে পারেনি সে।বুকের ভেতরটায় ধুকধুক শব্দ তুলছে বারংবার।প্রণয়িনী মেয়েটার কেঁপে উঠলো সর্বাঙ্গ।শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল সমীরণ বয়ে গেলো।কণ্ঠনালি থেকে কেউ যেন বাক্য শক্তি লুটে নিয়ে গেছে।ভয় ভীতিতে বক্ষঃস্থলের উঠানামা সমাপতন বুঝতে পারলো সুহাইল।ঠোঁট কামড়ে হেসে খুলে দিলো খোপার কাটা।দীঘল কেশ হেলেদুলে নেমে গেলো কোমড়ের কাছটায়।এতক্ষণের অতর্কিত কান্ডে জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছে সে।লাহমায় ফিরে এলো বিদ্যুত।অন্ধকার রুমটায় ঝাপিয়ে নামলো আলো।কালবিলম্বে পালটে গেলো সুহাইলের প্রমত্ত হৃদয়,ছিটকে দূরে সরে যায় আরমিনের কাছ থেকে।
– খোপা করার দরকার নেই।চুল ছেড়ে রাখো।
সৎবিৎ ফিরলো মেয়েটার।ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটার দিকে।রাগের রসদ যেন সুহাইলের এই কথাটায় ছিল।চট করে সুহাইলের গালে চ-ড় বসিয়ে দিলো আরমিন।রাগে সারা শরীর রিরি করছে।মনে স্পৃহা জেগেছে টেনে হিচড়ে ছিড়ে দিতে ছেলেটার চুল।সুহাইল কয়েক সেকেন্ড মাথা নুইয়ে থাকে।চট করে মাথাটা তুলে তাকালো আরমিনের দিকে।দুচোখে তার ঘোর।প্রমত্ত নেশা জাগিয়ে চেয়ে আছে প্রণয়িনীর দিকে।গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ায় তারপর শব্দ করেই হেঁসে উঠলো সে।যেন এই চড়ে কিছু আসে যায় না তার।
– ইসসস হাউ সুইট!মেরেছো,আমি মাইন্ড করিনি।যতদিন না তোমার মনে ভালোবাসা জাগবে এভাবে চ/ড়, থা/প্প/ড়, লা/থি, উ/ষ্টা, কি/ল, ঘু/ষি সব মেরো আমি সহ্য করে ভালোবেসে যাবো।
– ছিহহ একা পেয়ে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নিলেন।আজকাল দেখছি চরিত্র পালটে গেছে আপনার।অবশ্য পাল্টানোর কথা বিদেশে থাকছেন কত মেয়ের সঙ্গ পেয়েছেন দেশে এসে কী সেই অভ্যস বদলাবে নাকি।
– বাজে কথা বন্ধ করো।তোমার সামনে ভালো চরিত্র আর খারাপ চরিত্র কী?পর কাউকে ছুঁয়ে দিলাম কই?হবু স্ত্রীকে দিয়েছি।খোপা করো না।এত পিঠ কাটা ব্লাউজ পড়েছো কেন?
– আমি খোপা করেছি করবো আপনার সমস্যা থাকলে চোখ বন্ধ রাখুন।বের হন রুম থেকে।
– মনে আছে ছোট বেলায় স্লিভলেস ফ্রক পড়ায় পিঠে আইস্ক্রিম ছুড়ে মেরেছিলাম আজ আবার সেই একই কাজ করবো যদি কথা না শুনো।
আরমিন রোষানলে চেয়ে রইলো সুহাইলের দিকে।এই ছেলের চোখে মুখে একটুও অনুশোচনার আভাস নেই।কি স্বাভাবিক।অথচ শকে পড়েছে সে নিজে।
– দ্রুত রেডি হয়ে এসো।বাইরে অপেক্ষা করছি।
সুহাইল চলে গেলো।আরমিন দাঁড়িয়ে রইলো মূর্তির মতো।
#চলবে…..
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৭]
_______________
কলপাড়ের সামনে পেছনে হাত লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাফীর চাচাতো ভাই।ছেলেটা মনির দু’বছরের বড়।তার দাঁড়ানোর ভাব ভঙ্গিমা দেখে এগিয়ে এলো সুহাইল।বাড়ির ছেলেপুলের সাথে সুহাইলের অবশ্য বেশ ভাব জমে গেছে।
– হাত লুকিয়ে এই নিরিবিলি পথে দাঁড়িয়ে আছো কেন?কী করছো এখানে?
– এ..এমনি ভাইয়া,এমনি দাঁড়িয়ে আছি।
– উহ এমনি নয়।তোমার হাতে যে দুটি বেলিফুলের মালা আমি দেখেছি।আমাকে একটা মালা দাও।
– মালা দিয়ে আপনি কী করবেন?
– এত প্রশ্ন কেন?দিতে বলেছি দাও।
– যদি না দি?
– মাফীর কাছে বিচার যাবে তুমি মনির সাথে গোপনে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আছো।
চট করে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো ছেলেটা।ঘাবড়ে গেলো লাহমাহ।বেফাঁস মাফীর কানে এই খবর গেলে থাপ্প-ড়ে একটা দাঁতো আর তার চোয়ালে থাকবে না।বাধ্য হয়ে মেকি হাসলো ছেলেটা।
– ভাই আপনি কী করে জানলেন?
সুহাইল ঠোঁট কামড়ে হাসে।প্রমত্ত মনটায় কতল করে নিয়েছে সেই মেয়েটা।তার বদৌলতে আজ ভালোবাসার মানে বুঝে সে।সুহাইল খানিকটা এগিয়ে এলো স্বগোতক্তি করে বলে,
– আমিও এই ছোট্ট বুকে প্রেম পুষি।প্রেমের তীব্র ঢেউ আমাকেও আছড়ে নেয়।তাই সহজে কোন প্রেমিকের চোখ দেখলেই বুঝি স্বচ্ছ দু’চোখের ভাষা।
সুহাইল ঠোঁট কামড়ে হাসলো।ছেলেটা তার দিকে একটি মালা এগিয়ে দেয়।
– ভাইয়া মনিকে যে ভালোবাসি তা বুঝলেন কী করে?
– কারন গত রাতে তোমরা আমার জানলার সামনে গিয়ে প্রেমের বাক্যালাপ করেছিলে।
সুহাইল হাসছে ছেলেটা মাথা নিচু করে মৃদু হাসছে।
.
পুকুরে কৃত্রিম ঝরনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।কিছু রঙবেরঙে লাইট সেখানে আলো নিক্ষেপ করছে,আশেপাশে মরিচ বাতি গুলো গাছের চারিপাশে সাজিয়ে দিয়েছে।মন মুগ্ধকর পরিবেশটা একাই উপভোগ করছে আরমিন।এতক্ষন হাতের ফোনটা দিয়ে কিছু ছবি তুলে নেয়।পুকুর ঘাটের বসার আসনে বসে ঝরনার দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে।মাফীকে স্টেজে বসানো হয়েছে তাই সবাই সেখানেই হট্টগোল লাগিয়েছে।আরমিনের আর সেদিকে যেতে ইচ্ছে করছেনা এই মূহুর্তে।
– মরিয়ম!
চেনা কন্ঠে ঘুরে তাকায় আরমিন।সুহাইল এসেছে।সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো সে।তখনকার কথা স্মরণে আসতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠে আরমিন।কান দিয়ে যেন ধোঁয়া উড়ছে।দ্রুত প্রস্থান নিতে গেলে আগলে দাঁড়ায় সুহাইল।
এক ঝলক দেখে নেয় আরমিনকে।চুলে কোন খোপা নেয় সম্পূর্ণ চুলটা ছেড়ে দিয়েছে।
– মাশাল্লাহ,আমার হুর!
চকিতে তাকালো আরমিন।মোহ আবেশে মিহিয়ে গেলো সে।বুকের ভেতর হৃদযন্ত্রটা আবারো বেশামাল গতিতে উত্থাল-পাত্থাল শুরু করেছে।সুহাইল আকড়ে ধরলো আরমিনের হাত।আরমিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছাড়াতে নিলে টেনে ধরে সে।হাতে পড়িয়ে দেয় বেলিফুলের মালা।আচম্বিতে হাসির ঝলক দেখাগেলো আরমিনের চোখে,মুখে।
– এবার একটু বেশি সুন্দর লাগছে মরিয়ম।
– সরে দাঁড়ান কেউ দেখলে কী ভাববে।
– যা ই….
সুহাইল কথা শেষ করার আগেই আরমিনের ফোন এলো।হাতে ফোনটা পরখ করতেই দেখা গেলো হোয়াটসঅ্যাপে পবন ভিডিও কল দিয়েছে।আরমিন ভড়কালো না পবন আগেই বলেছে রাতে কল করবে।কিন্তু কপালের চামড়াটা কুচকে গেলো সুহাইলের।আরমিন দ্রুত ফোন ধরলো।
– পবন ভাই কেমন আছেন?
– মাশাল্লাহ!তোকে তো বেশ সুন্দর লাগছে।
– ধন্যবাদ।কি করছেন পবন ভাই?আসবেন কবে?
– আসবো,আসবো তুই ফিরে আয় আমিও চলে আসবো।তোকে অনেক কথা বলার আছে।
– কী কথা?
– সামনা সামনি এলেই বলবো।
সুহাইলের বুকের ভেতরটায় মুষড়ে উঠে।পবনের ভাব গতি আগেই তার কাছে বেশামাল মনে হয়েছিল কিন্তু এখন তো লাগামহীন লাগছে!সুহাইল সেখানে দাঁড়ালো না চলে এলো স্টেজের সামনে।অপর দিকে মনি তাসনিম এসে ডেকে নিয়ে গেলো তাকে মাফীর হলুদ দেওয়ার কাজ মুরব্বিদের শেষ এখন বাদবাকি ছেলেমেয়েদের পালা।
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে।হাসি আনন্দে সকলে একসঙ্গে মেতে উঠেছে।মাফীকে গায়ে হলুদ ছুঁয়ে দিতে স্টেজে উঠে আরমিন তার সাথে পাশেই কায়দা করে উঠে বসে সুহাইল বিষয়টা দেখে মিটিমিটি হাসছে মাফী।আরমিন খানিকটা হলুদ নিয়ে মাফীর গালে কপালে লেপ্টে দেয়।তখনি সুহাইল ঠোঁট উলটে বলে,
– মেডাম আমাকে একটু লাগাইদেন।শুনেছি সুন্দরিদের হাতে হলুদের ছোঁয়া পেলে নাকি খুব দ্রুত বিয়ে হয়ে যায়।
সুহাইলের এমন অযৌক্তিক কথায় চোখ পাকায় আরমিন।তবে স্টেজের সামনে থেকে সুহাইলের পক্ষ নিয়ে সবাই হইহই করে উঠে।মাফী একগাল হেসে আরমিনের কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে,
– আরে লাগিয়ে দাও,একটু হলুদি তো!
আরমিন এক থাবা হলুদ নিয়ে সুহাইলের গালে লেপ্টে দেয়।বিষয়টা দেখে সবাই বেশ মজা পাচ্ছে।ক্যামেরাম্যান তাদের এই খুনশুটির বিষয়টা বন্দি করছে ক্যামেরায়।সুহাইল খানিকটা হলুদ নিয়ে আরমিনের গালে লাগিয়ে।মেয়েটা দাঁত কিড়মিড় করে তাকায় তার দিকে।
– আমি একা সুন্দরি নই এখানে আরো সুন্দরিরা আছে।আপনার বিয়ে যেন তাড়াতাড়ি হয় তাই সব সুন্দরির উচিত আপনাকে হলুদ মাখানো।কী বলো সবাই?
আরমিনের কথার মারপ্যাঁচে পড়ে যায় সুহাইল।বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত মেয়েদল এতটা সময় সুহাইলের সান্নিধ্য আসার চেষ্টা করেছে কিন্তু ভাবলেশহীন ছেলেটা কাউকে পাত্তা দিলো না।আরমিনের বক্তব্য সবাই যখন সুহাইলকে হলুদ মাখানোর অনুমতি পেলে একদল মেয়ে ঝাপিয়ে পড়ে সুহাইলের উপর।টেনে হিঁচড়ে তাকে নামিয়ে আনে স্টেজ থেকে।সবাই যে যার ইচ্ছে মতো হলুদে লাগাতে ব্যস্ত তাকে।সুহাইল পড়েছে দারুন বিপাকে।সবার কাছ থেকে এক ছুটে ঘরে চলে যায়।তার করুন দশা দেখে আরমিন অট্টহাসিতে মেতে উঠে।
_
নির্ঘুম রাত কেটে যাচ্ছে সুহাইলের।বুকের ব্যথা শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগে থেকেই।পবন আরমিনকে ভালোবাসে নাকি বাসে না।তার কী ভুল ধারনা?মাথার ভেতর এই প্রশ্নগুলো জটলা পাকিয়ে আসছে।অপরদিকে আরমিনকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।কলেজে পড়ুয়া মেয়ে আবেগের সাগরে ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।একটু আদুরে মাখা কথার তাল পেলে,গিফট পেলে যে আরমিন পটে যাবে সেটা বেশ ভালো করেই যানে সুহাইল।কিন্তু এভাবে আরমিনের মন জয় করার ইচ্ছে নেই।সে চায় আরমিন কাছে আসুক,সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে আসুক।কিন্তু এতটা সময় আরমিনকে দিতে পারবে না সে।এই গ্রাম ছেড়ে কেশবপুরে পা রাখলে যে পবন তাকে নিজের কবজায় নিয়ে আসবে,তখন সুহাইল গলা ফাটিয়ে ভালোবাসার কথা বললেও কাজ হবে না।মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।অসহ্যকর পরিস্থিতিতে কান্না আসছে তার।বাড়ির সবাই ঘুমে।কিন্তু ঘুম নেই সুহাইলের চোখে।সেই দীর্ঘ বছর আরমিনের অপেক্ষায় ছিল আর আজ যদি সমীপে পেয়েও হারিয়ে ফেলে তবে সেটা হবে সবচেয়ে বড় হেরে যাওয়া।
মোবাইলটা হাতে তুলে সালেহার নাম্বারে কল দেয় সুহাইল।রাত এখন দুইটা বত্রিশ।
.
এতরাতে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসায় ঘাবড়ে যায় সালেহা।কার কোন বিপদ হলো নাকি ভেবে কলিজা ধরে গেছে।আরমিন তার নিকটে নেই অনেক দিন,মেয়েটার জন্য চিন্তায় সারাদিন বিভর থাকে সে।কায়েমের পাশ থেকে উঠে দরজার সামনে দাঁড়ায় সালেহা।দ্রুত ফোন রিসিভ করে বলে,
– হ্যালো কে বলছেন?
– মামি আমি সুহাইল বলছি।
– তুমি এত রাতে!কি প্রয়োজন?
– মামি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল।আসলে…
– কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
– মামি আমি আমার দিক থেকে সব প্রস্তুতি নিয়েছি শুধু আপনার মতামতের অপেক্ষা।
– কিসের মতামত?
– মরিয়মকে বিয়ে করতে চাই আমি।আপনি যত বছর বলবেন অপেক্ষায় থাকবো।আমার বাবা মা কেউ তাকে একটু আঘাতো দিতে পারবেনা।মরিয়মের জীবনের সম্পূর্ণ সুখ আমি আমার সাধ্যমতো ঢেলে দিবো আপনি শুধু রাজি হন মামি।
– অসম্ভব।আমি আমার মেয়েকে কে/টে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিবো তাও তোমার হাতে তুলে দিবো না।
– এতটা ঘৃণা আমার প্রতি কবে জন্মালো তোমার মামি?আমাকে না তুমি ভালোবাসতে।আমি তো কোন অন্যায় করিনি তবে আমার সাথে এত নির্দয় হও কেন?
– তুমি ছেলেটা ভালো আমি জানি।তবে এখানে আমার মেয়ের জীবনের প্রশ্ন।তাকে এভাবে উদ্দেশ্যহীন ছেড়ে দিতে পারিনা।তোমার বাবা-মা কোন দিন সুখে থাকতে দেবেনা তোমাদের।
– ওনাদের কেন টানছো?আমি যার দায়িত্ব নিতে চাই সে আমার মাঝে সুখে থাকবে।তারা তাকে আঘাত দেওয়ার সুযোগি পাবেনা।তুমি জানো মামি আমি চাইলেই মরিয়মকে এক্ষুনি বিয়ে করে তোমার সামনে আনতে পারি সে ক্ষমতা আমার আছে কিন্তু তাতে কী লাভ?তোমার দোয়া,ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবো।
– এত রাতে এসব আজাইরা প্যাচাল করতে ফোন করেছো তুমি?ফোন রাখো আরমিনের আব্বার শরীর ভালো নেই আমি আমার চিন্তায় বাঁচিনা তুমি তোমার লেকচার নিয়ে আছো।
সালেহা ফোন কেটে বন্ধ করে দিলেন।সুহাইল রাগ সংযমন করতে না পেরে মোবাইল ছুড়ে ফেলে বিছানায়।মাথার চুল টেনে বসে পড়ে মেঝেতে।চোখের কোনে জল জমে গেছে।রাগ নিয়ন্ত্রণে বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।একটা সময় বিছানায় মাথা ফেলে কেঁদেই দিলো সে।তার উপর কত দায়িত্ব নির্ভর করছে।কিন্তু এই দায়িত্বের মাঝে যদি আরমিনকে না পায় তবে এইসব দায়িত্ব তার কাছে ঠুনকো।
রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি।সুহাইল ফোন করলো বিদেশে অবস্থানরত তার ভাই সিয়ামকে।সিয়াম পবনের আড়াই বছরের ছোট।
– ভাইয়া এত রাতে তুমি কল করেছো।ঘুমাও নি?
– ঘুম আসছে নারে।
– কেন কী হয়েছে?গলা এমন লাগছে কেন তোমার?এই তুমি কেঁদেছো ভাইয়া?
সুহাইল এবার ফুঁপিয়ে উঠলো।শরীরটা তার ভেঙ্গে আসছে রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
– আরে থামো কী হয়েছে বলো আমায়।
সুহাইল শুরু থেকে শেষ সবটাই বললো সিয়ামকে।
– দেখ ভাইয়া বাবা,মা যা করেছে তা কিন্তু মোটেও ভালো করেনি।মামি আর আরমিনের পরিবর্তে আমরা হলে একই ব্যবহার করতাম।বলতে গেলে আরো খারাপ ব্যবহার করতাম।কিন্তু আমাদের পেরেন্স যা করেছে তা তো আমরা অস্বীকার করতে পারিনা।আমরা সব ঠিক করতে চাই আর আমরা হেরে যাবো না।অবশ্যই তোমার ইচ্ছা পূরন হবে।
– হুম।ওদিকের সব কি খবর,আম্মু ভালো আছে?
– আম্মু ভালো আছে এদিকে সব ঠিক ঠাক।তুমি চিন্তা নিও না।
#চলবে..