মায়াপ্রপঞ্চ,১৮,১৯

0
802

#মায়াপ্রপঞ্চ,১৮,১৯
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৮]
_______________
সকাল থেকেই মনমরা হয়ে বসে আছে সুহাইল।তার এমন মূঢ় অবস্থা লক্ষ্য করেছে মাফী।মাফী কিছুক্ষণ আগেই গোসল সেরে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।কিছুক্ষণ পরেই বর যাত্রী বেরিয়ে পড়বে।

– তোর কী হয়েছে সুহাইল।গ্রাম ভালো লাগছেনা?

– তেমন কিছুনা।ইঞ্জয় করছি সবার সাথেই।তুই রেডি হ দেরি হয়ে যাবে।

– আমি তোর চোখ মুখ দেখেই বুঝে যাচ্ছি তোর কিছু একটা হয়েছে।চোখ লাল আর ফোলা কেন?এই সত্যি করে বল কি হয়েছে?

– মামী আমাকে কখনোই মানবেনা।আমি হয়তো সাধ্যর বাইরে বেশি কিছু চেয়েছি।

– তোর মামীর রেগে থাকাটা স্বাভাবিক।তাই বলে হেরে যাবি নাকি।দেখ ভালো,মন্দ,ঘাত,প্রতিঘাত আসবেই হেরে গেলে চলে না।

– মোটিভ দিস না।আমি ব্যাক করবো কানাডা।যে ফ্লাট কিনেছি সেটা পড়ে থাকুক সমস্যা নেই।বাবা ফোন করেছে যে বাড়িটা পছন্দ হয়েছে সেটা গতকাল কাগজপত্র ঠিক করে কিনে নিয়েছেন।আমাদের এখন আর বাংলাদেশে তেমন কাজ নেই।কানাডা ব্যাক করে ভেবে চিনতে মামীর সম্পত্তি ফিরিয়ে দিবো।হয়তো আগের জায়গা পাবো না কিন্তু অন্য জায়গায় নতুন করে কিনে দেবো।

– তুই শিওর?মন থেকে বলছিস সব কথা?

– হ্যা আমি শিওর।কানাডায় গেলে আমি সব ভুলে থাকবো এখানে আমার জন্য সবটাই বিষাক্ততায় ঘেরা।

মাফী কিছু বললো না।অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে।মরিয়ম,মরিয়ম বলে যে ছেলেটা তার কান পঁচিয়ে দিয়েছে সে এখন বলছে মরিয়মকে ছেড়ে চলে যাবে কি অদ্ভুত।ভালোবাসা তবে দূর থেকেই সুন্দর।
.
কনে পক্ষের বাড়ি যেতে প্রায় আধা ঘন্টার রাস্তা।একটি বাস এবং দুটো বড় মাইক্রবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।আরমিন,সুহাইল,মনি,তাসনিম সবাই বর পক্ষের মাইক্রোবাসে চড়ে বসে।আরমিন আজ অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করেছে সুহাইল তাকে ইগ্নোর করছে।কিন্তু কেন করছে তার জানা নেই।আরমিনো বিষয়টা ততটা গায়ে মাখলো না।সে তার মতো করে ইঞ্জয় করেছে পুরো বিয়েটা।

সুহাইল আড় চোখে ঘুরে ফিরে বার বার তাকাতে ব্যস্ত আরমিনের দিকে।মেয়েটাকে কৃত্রিম সাজে মন্দ লাগছে না।সবার মাঝে ঘুরে ফিরে কেন যে মেয়েটার দিকে চোখ যায় আর এক সমুদ্র মায়ায় ডুবে যায় সে!নিজের প্রতি নিজেই একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে বরযাত্রীর গাড়িগুলো।মাইক্রোর সামনের দরজাটা খুলে সিটে গা এলিয়ে বসে আঙুলের ডগায় পুরে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা মুখ পুরে নেয়।জোর কদমে শ্বাস নিয়ে ধোঁয়া মুক্ত করে দেয় রাস্তার দিকে।আনমনে চেয়ে আছে আকাশের পানে।মেঘের চাপা গর্জন কানে আসছে,আকাশে ছড়িয়ে আছে গুমুট মেঘ।কনের বিদায়ের পালা শুরু নিশ্চই বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল পড়েছে।সুহাইলের ফোন ভাইব্রেট হতে স্কিনে তাকায়।বারেক খন্দকার ফোন করেছে।

– হ্যালো বাবা বলো।

– কেমন আছো?ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছো,ভারী মশলার ঝাল খাওয়ার তুমি তো খেতে পারো না।

– একটা সময় মানুষকে সব পারতে হয়।না চাইলেও মানিয়ে নিতে হয়।

সুহাইলের কথাটায় বড্ড মনস্তাপে ঠেসা।তার কথার ধরনে ভড়কালো বারেক।

– সুহাইল বাবা তোমার কী হয়েছে?

– কিছুনা।তোমার ঢাকার কাজ শেষ?

– হ্যা।বাড়ির জন্য কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে।

– তাহলে আমরা কানাডায় ব্যাক করবো।চারদিন পরেই যাবো।

– এত তাড়াতাড়ি!

– বাংলাদেশটা আর ভালো লাগছেনা।এখন ফোন রাখো কনেকে নিয়ে সবাই রাস্তার দিকে আসছে।
_

বন্ধুদের নিয়ে একটি রিসোর্টে উঠেছে পবন।ছোট একটা এক্সিডেন্টে ডান পায়ে আঘাত পেয়েছে সোহাগ।তাই তাদের ঘোরাঘুরি সাময়িক বন্ধ।রিজুর আবদারে রিসোর্টে উঠেছে তারা।সেখানেই চলছে তাদের মাস্তি।সন্ধ্যারপর সবাই মিলে বেলকোনিতে বসেছে।গালগল্পে মেতে আছে।সবার বর্তমানে আড্ডার টপিক পবন কি করে আরমিনকে প্রপোজ করবে।বন্ধুদের এই নিয়ে যেন তোষামোদের শেষ নেই।পবন নিশ্চুপ তাদের কান্ড দেখছে।

– পবন তুই তোর আগের স্টাইলে আরমিনকে টানতে টানতে নিয়ে আসবি।সাথে কিছু ধমক ফ্রি এরপর ধুম করে প্রপোজ করে বসবি আরমিনকে।তোর প্রপোজে আবার বেচারি অজ্ঞান না হয়ে যায়।

রিজুর কথা শুনে গা দুলিয়ে হাসলো সবাই।পবন স্থির চিত্তে তাকিয়ে আছে।বুকের ভেতরটায় কত ভালোবাসা জমে আছে কী করবে সে।আরমিনকে কী করে বলবে!ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়।বন্ধুদের কথার মাঝেই পবনের ফোন বাজলো।আননোন নাম্বার দেখে খানিকটা হকচকালো।

– কে ফোন করেছে?

সোহাগের প্রশ্নে চকিতে তাকায় সে।ঠোঁট উলটে বলে,

– জানি না।

পবন দ্রুত ফোন রিসিভ করলো,

– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

– পবন!

ফোনের অপর পাশ থেকে টুম্পার কন্ঠে চমকে উঠলো সে।এতদিন ফোন ছাড়া কোথায় ছিল সব প্রশ্ন যখন মাথায় খেলা করছিলো,প্রশ্ন করতে মনটা গাইগুই গুরু করে,তখনি তাকে অবাক করে দিয়ে টুম্পা সত্যটা প্রকাশ করলো।

– আমার বিয়ে হয়ে গেছে পবন।

– কি!

টুম্পার কথা শুনে পবন চমকে।মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে এসেছে।এমন সত্য জানার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

– কি বলছো টুম্পা?কবে,কখন,কোথায়?

– সেদিন চাচা আমায় জোর করে বাড়িতে আনে তারপর তাদের পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।আমি তোমার কথা বলেছিলাম তাদের কিন্তু কেউ মানলো না।বরং আব্বা আমার গায়ে হাত তুলেছে।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।বিয়ে হয়েছে গত দুইদিন আগে।এই দুইদিনে আমার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে তুমি জানো না।আমি সহ্য করতে পারছিনা কিছু আমার শুধু তোমাকে লাগবে।তুমি আমাকে নিয়ে যাও আল্লার দোহাই।

– শান্ত হও টুম্পা একটা কথা বলো তোমার হাজবেন্ড কেমন?সে সবটা জানে?

– ছেলেটা ভিষণ ভালো,সহজ সরল।বিয়ের দিন রাতেই আমি তাকে সব বলে দিয়েছি।এরপর সে আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি।শুধু একটাই কথা বলেছে তোমার ইচ্ছে হলে তুমি চলে যাও তোমার প্রেমিকের কাছে।তবে আমি এমন সংসার করতে পারবো না যে সংসারে ভালোবাসা আমার নামে নেই।

পবন স্থির হয়ে যায়।টুম্পার উম্মাদের মতো কথা বলার ধরনে বুঝে নিয়েছে সে তাকে ছাড়বে না।তবুও নিজের জীবনের গল্প সাজাতে একটা গল্পের বিদায় দিতেই হবে।নিজেকে শান্ত করলো সে।বন্ধুদের পাশ থেকে সরে আসলো খানিকটা।

– তুমি তোমার সংসারে মন দাও।আমাকে নিয়ে আর ভেবো না টুম্পা।

– ক..কি বলছো তুমি।আমি ভালোবাসি তোমায়।তোমায় ছাড়া কি করে থাকবো আমি?

– আমি তোমায় ভালোবাসি না টুম্পা।আসলে তোমাকে ভালোবাসার চেষ্টাই করে গেছি কিন্তু ভালোবাসতে পারিনি।আমি… আমি আরমিনকেই ভালোবাসি।তোমার সন্দেহ ঠিকি ছিল আমার মনে প্রাণে আরমিন নামক মেয়েটারি বিচরণ।

টুম্পা কয়েক সেকেন্ড শান্ত হয়ে যায়।পবন ফোনের ওপাশ থেকে নিস্তব্ধতা ছাড়া কিছুই পেলো না।কয়েক সেকেন্ড পর উম্মাদের মতো কেঁদে উঠে মেয়েটা।আশেপাশে যা পেয়েছে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছিলো সে আর সেই শব্দগুলো ফোনের অপরপাশ থেকে শুনছিলো পবন।

– পাগলামি করে লাভ নেই টুম্পা।আমি ফিরবো না।

– আমি তোমায় ভালোবাসি পবন।আমাকে ভালোবাসা ভিক্ষা দাও।তোমার থেকে দূরত্ব আমাকে আধমরা করে দিয়েছে আর আজ তোমার বলা কথাগুলো আমায় প্রাণহীন করে দিয়েছে।আমি সইতে পারছিনা পবন।

– দেখো যাকে বিয়ে করেছো তাকে নিয়ে সুখে থাকো।অতীত ভুলে যাও।আমি ফিরবো না।আর সব কিছুর জন্য আমি সরি।

টুম্পা হুহু করে আবারো কেঁদে উঠে।বুকের ভেতরের চাপা আগুন বেরিয়ে আসছে লাগামহীন।এই যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে কেউ যদি তাকে মে-রে ফেলতো তবেই বোধহয় যন্ত্রণা লাঘব হতো।পবনের প্রতিটা কথা বুকের ভেতরটায় আঘাত আনছে।এ যেন তার ভালোবাসার অপমান করা হলো।টুম্পা স্থির হলো।গলা খেঁকিয়ে বলে,

– রুহের বদদোয়া বলে একটা কথা আছে জানো পবন।একটা শেষ কথা বলি তুমিও ভালোবাসা ভিক্ষা চাইবে কারো কাছে।এই ভালোবাসা পাওয়ার দহনে তুমিও পুড়বে সময় আসুক।আমাকে তো ছাই করে দিয়েছো।আগুনে জ্বলে তুমিও পুড়বে।আমার মতো ছাই হয়ে যাবে…..

টুম্পার কথা শেষ হওয়ার আগেই পবন ফোন কেটে দেয়।টুম্পা বুঝতে পেরে ফোনটা দেয়ালের দিকে ছুড়ে মা-রে।হাটু মুড়ে কেঁদে উঠে শব্দ করে।

– যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই,পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য র‍তন!

পরিচিত কন্ঠে ভেজা চোখ নিয়ে ঘুরে তাকায় টুম্পা,হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে তার নব বিবাহিত বর।ছেলেটা টুম্পার সামনে লেপ্টে বসে মেঝেতে।

– আমার ফোনটা ভেঙ্গে দিলেন মিসেস।আচ্ছা থাক সমস্যা নেই।আপনি পুড়ে ছাই হয়েছেন তো কি হয়েছে?আমি রত্ন খুঁজে নেবো আপনার মাঝে।ঠোঁট কুচকে আছেন কেন?কান্না আটকে ব্লা’স্ট হয়ে যাবে।কাদুন সমস্যা নেই।ঘরে যা যা ভেঙ্গেছেন আমি পরিষ্কার করে নিবো।ভাগ্যিস বাড়িতে কেউ নেই।নাহলে সবাই কি ভাবতো বলুন তো?একটা কথা বলি?

টুম্পা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে ছেলেটার দিকে।

– চিন্তা করবেন না আমি আছি আপনার পাশে।এবার বোধহয় আপনাকে সংসারে মনোযোগ দিতেই হবে।তবে চলুন দুজন মিলেই সংসার করি!
_
রাত এগারোটার কাছাকাছি।আকাশের গম্ভীর গর্জন শোনা যাচ্ছে।মৃদু বাতাস বইছে চারিদিকে।বাইরে আগুন জ্বালিয়ে রান্নার তোড়জোড় চলছে।আগামীকাল বৌভাত।একদল মেয়ে বউয়ের পাশে বসে আছে।
বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা হইচই করছে উঠন জুড়ে।গ্রামের মহিলারা একের পর এক ভিড় জমাতে ব্যস্ত।তাদের উদ্দেশ্য নতুন বউ দেখবে।মাফী চাচাদের সাথে হাতে হাত মিলে কাজ করছে।সব মিলিয়ে ব্যস্ত পরিবেশ।
সুহাইল নিরিবিলি নিশ্চুপ বসে আছে পুকুর ঘাটে।আনন্দো যেন তার জীবন থেকেই মরে গেছে।আরমিনকে নিয়ে ভাববে না সে।না চাইতেও ভাবতে হয় বারংবার।

তাসনিমের সাথে কথা বলছিলো আরমিন হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন আসায় খানিকটা দূরে সরে আসে।

– আম্মা কেমন আছো?

– আরমিন মারে তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।তোর আব্বা কেমন জানি করতাছে।আমি কি করমু,তোর জাবির আঙ্কেল ডাক্তার আনতে গেছে।আমার মনে কু ডাকে মা তুই ফিরে আয়।

– কি বলো মা।এত রাতে আমি আসবো কী করে এত দূরের রাস্তা।মনিরা ফিরতে ফিরতে প্রায় এক সাপ্তাহ লেগে যাবে।আমি….

– তাও ঠিক ত..তুই থাইকা যা।এদিকটা তোর আন্টিরা আছে আমি সামলে নিবো।মারে আমার মনে কুডাকে তোর আব্বার জন্য দোয়া কর।

সালেহা ফোন কেটে দিলো।আরমিন এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও ফোনটা হাত থেকে রেখেই কেঁদে উঠে তার কান্না দেখে আশে পাশে সবাই অবাক হয়ে যায়।মনি তাসনিম সহ বাড়িএ অন্যরা এগিয়ে এসে সত্যিটা জানলে ঘাবড়ে যায়।এত রাতে বাড়ি ফিরবে কী করে?তাও এত দূরের রাস্তা।আরমিন হেঁচকি তুলতে তুলতে তাকায় জানালার বাইরে।পুকুর পাড়ে একা বসে আছে সুহাইল।সব চিন্তা ঝেরে আরমিন দৌড়ে যায় সুহাইলের কাছে।তোড়জোড় করে অসংলগ্ন গতিতে ছুটে আসা মেয়েটাকে দেখে ঘাবড়ে যায় সুহাইল।তার পায়ের কাছে বসে আরমিন আকুতির স্বরে বলে,

– দয়া করে আমাকে কেশবপুরে দিয়ে আসুন।আমার আব্বা ভালো নেই,আব্বা কেমন জানি করছে!

#চলবে….
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১৯]
_______________
মাফীর মা ফিরোজার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে আরমিন।মনি,তাসনিম ত্রস্তব্যস্ত পায়ে আরমিনের ব্যাগ গোছগাছ করতে ব্যস্ত।আকাশের মৃদু আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে।বাড়ির সকলেই আরমিনকে নানান ভাবে স্বান্তনার বানী শোনাতে ব্যস্ত।কিন্তু যার দুঃখ সেই বোঝে।কান্না কিছুতেই কমছে না মেয়েটার।পাশের রুমে সুহাইল নিজের ব্যাগপত্র গোছগাছ করছে।তার পাশে মাফীও সাহায্য করছে।থেমে থেমে আরমিনের কান্নার শব্দ সুহাইলের কানেও আসছে।আরমিনের কান্নার শব্দ ক্রমশ দূর্বল করে দিচ্ছে সুহাইলকে।এভাবে তাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে।

– তোর সম্পূর্ণ বিয়েতে থাকতে পারলাম না মনে কিছু নিস না ভাই।দেখলি তো পরিস্থিতি কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে?

– বিয়েতে তো আমার পাশে ছিলি সেটাই অনেক।তুই দেরি করিস না।এই মূহুর্তে বাস পাবি কি না সন্দেহ, যেতে পারবি তো বাকিটা পথ?আমি তোদের বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত দিয়ে আসবো।

– তার কোন দরকার নেই।অলরেডি সাড়ে এগারোটা বাজে।তোর বিশেষ রাত আজ।আমি চাইনা আমাদের কারনে এইভাবে নষ্ট হোক।আমি যেতে পারবো।

মাফী সুহাইল দুজনেই থামলো।আরমিনের কান্নার আওয়াজ সুহাইলের কানে আসতে ঘুরে তাকায় মাফীর দিকে।

– এ..এভাবে যদি আমার সাথে কাঁদতে কাঁদতে যায় আমি ও’কে তাহলে নিতে পারবো না।

– কেন ভাই?

– ওর কান্না আমার অসহ্য লাগছে।

সুহাইলের ভাবভঙ্গিমা দেখে হাসলো মাফী।ছেলেটার পিঠ চাপড়ে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরলো।

– অলদা বেস্ট দোস্ত।যত রাতেই ফিরিস আমাদের ফোন করে জানাস।

– অবশ্যই।
.
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিএনজিতে উঠে পড়েছে দুজনে।সিএনজি দিয়ে এখন তাদের পৌছতে হবে বাস স্ট্যান্ড,এরপর বাস নিয়ে আরেক স্টেশনে যেতে হবে।ব্যাগপত্র আকড়ে ধরে নিরিবিলি বসে আছে আরমিন।মেয়েটা মিহিয়ে গেছে থেমে থেমে চোখের জল পড়ছে।তার থেকে খানিকটা দূরে বসে আছে সুহাইল আড় চোখে আরমিনের দিকে একবার পরখ করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।সিএনজি চলছে দ্রুত গতিতে।গ্রামের রাস্তা হওয়ায় বারোটার মধ্যেই সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে অন্ধকার রাস্তা জুড়ে চলছে সিনএনজি।আকাশের গর্জন বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ।আরমিন মাথাটা এলিয়ে দিলো পাশে।নড়ে চড়ে বসলো সুহাইল।আরমিনের সঙ্গে কথা বলতেও জড়তা কাজ করছে বর্তমানে।সব ভুলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে।

– তোমার কি খারাপ লাগছে মরিয়ম?পানি দিবো?

– না।

– মামার সম্পর্কে কোন খোঁজ পেয়েছো?আপডেট কি?

– জানি না।আমার ফোন বন্ধ চার্জ নেই।

– আমরা পৌঁছে যাবো চিন্তা করো না।

আরমিন জবাব দিলো না তাকিয়ে আছে অন্ধকার পরিবেশের দিকে।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সিএনজি পৌঁছে যায় বাস স্টেশনের সামনে।সুহাইল ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে যায় কাউন্টারের কাছে।এই সময় বাস আসবে কি না সেই সম্পর্ক খোঁজ নেওয়া জরুরি।
কাউন্টারের সামনে বসে আছে মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ।তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুমে নেতিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

– আসসালামু আলাইকুম চাচা হাজারিগঞ্জের(কাল্পনিক)বাস আসবে কখন?

মধ্যবয়স্ক লোকটি চশমার ফাঁকে তাকালো সুহাইলের দিকে।আরেকবার পরখ করে নিলো আরমিনকে।রয়ে সয়ে তিনি বলেন,

– ওয়ালাইকুম আসসালাম।হাজারিগঞ্জের বাস তো আজ আর যাবে না।লাস্ট বাস সাড়ে এগারোটায় ছেড়ে গেছে।কাল ভোর ছয়টায় আবার যাবে।

– আমাদের তো জরুরি ভিত্তিতে যাওয়া প্রয়োজন।এখন কী ব্যবস্থা করা যায়!

– যাবেন কোথায়?

– কেশবপুর।কেশবপুরে ডাইরেক বাস তো যায় না।ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হবে আমাদের।এখান থেকে হাজারিগঞ্জ। হাজারিগঞ্জ থেকে মতিগঞ্জ(কাল্পনিক)।তারপর সিএনজি দিয়ে কেশবপুর।অনেকটা রাস্তা আসা করি বুঝতে পারছেন।

– হুম।কিন্তু কিছু তো করা নাই।তবে একটা রাস্তা আছে,এখান থেকে পীর বাজার যাও।বাজারের মোড়ে বাস পাওয়া যাবে হাজারিগঞ্জের।

– পীর বাজার!সেটা আবার কোন দিকে?

– সিএনজি পাও কিনা দেখো এখানে।সিএনজি ওয়ালাকে বলো সে নিয়ে সাবে পীর বাজার যেতে প্রায় এক ঘন্টার মতো লাগবে।

আশার আলো পেয়ে চকচক করে উঠলো সুহাইলের চোখ মুখ।লোকটিকে সালাম জানিয়ে মেইন রোডে দাঁড়িয়ে রইলো সে।আকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।তার সাথে মৃদু গর্জন।আরমিনের এই মুহূর্তে বড্ড ভয় লাগছে।সুহাইল তার থেকেও খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ে কাবু হয়ে আরমিন ঘেসে গেলো সুহাইলের কাছটা।আড়চোখে তার দিকে একবার চাইলো সুহাইল।সে বেশ ভালো ভাবেই বুঝেছে আরমিন ভয় পাচ্ছে তবুও কোন প্রতিক্রিয়া করলো না।বেশ কিছুক্ষণ পরেই একটি সিএনজির দেখা পাওয়া গেলো।সুহাইল সিএনজি ওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে বলে,

– ভাই যাবেন?

– কই?

– পীরবাজার।

– উইঠা আসেন।তুফান আইবো।

লোকটার কথায় বেশ খটলা লাগে সুহাইলের।কেমন যেন বাজে দূর্গন্ধ তার মুখে।কথাগুলো মাঝে মাঝে গুলিয়ে যাচ্ছে।তবুও বিপদে এত কিছুর ভাবা সময় নেই।সুহাইল ঝটপট আরমিনকে নিয়ে উঠে পড়ে সিএনজিতে।
আরমিনের এর মাঝে কান্না আবার শুরু হয়েছে।মেয়েটা মাঝেসাঝে হেঁচকি তুলছে সুহাইল কি বলবে ভেবে পেলো না।নিরিবিলি তাকিয়ে রইলো তার দিকে।বাতাসের তান্ডব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলো,আকাশটাও ডাকছে বেশামাল ভাবে,অন্ধকার গ্রামটায় মিনিটে মিনিটে আলোর ঝলক পড়ছে।প্রতিটা মুহূর্তে কেঁপে উঠছে আরমিন।তার ভয় দেখে সুহাইল হাতটা পাঁচ আঙুলের মুঠোয় নেয়।নিশ্চুপ আরমিন চকিতে তাকালে ইশারায় বুঝিয়ে বলে,”আমি আছি তো!”।
প্রায় একঘন্টা পর সিএনজি ওয়ালা থামলো বাজারের কাছে।

– ভাড়া কত দিবো ভাই?

– দু’শ দেন।

– এখানে হাজারিগঞ্জের বাস থামে কোথায়?

– এহানে হাজারিগঞ্জের বাস থামে না।কি কন মিয়া।

– তবে কাউন্টারের লোক যে পীরবাজার আসতে বললো!

– হেইডা তো দক্ষিন পীরবাজার,আমনে আইছেন পূর্ব পীর বাজারে।

– ও মাই গড!তো আপনি আমাদের জেনে উঠাবেন না।আমাদের ভুল জায়গায় আনলেন কেন?আর এই পরিবেশটাতো সুবিধা লাগছে না।এখনি তুফান আসবে।

– আমনে যাইবেন আমনে ঠিকানা কইবেন।এহন আমার দোষ দেন কেন আজাইরা ফাউল লোক।

ইতোমধ্যে সুহাইল বুঝে গেলো লোকটা মাতাল।তাই নিজেকে সংযত করে মিহি গলায় বলে,

– আমাদের দক্ষিন পীর বাজার নিয়ে যান ভাই।আমরা ভীষণ বিপদে আছি।

– পারুম না।ট্যাকা দেন।তুফান আওনের সময় হইছে বাড়ি যামু।অন্য গাড়ি পান কি না দেখেন।

– ভাই চলেন প্লিজ।বাড়তি টাকা দিবো তবুও চলেন এত রাতে যে করে হোক বাস পেতে হবে আমাদের।

– না যামু না।ট্যাকা দেন দ্রুত।

– যাবেন না মানে কি?আনলেন কেন ভুল রাস্তায় এখন আমাদের দক্ষিন পীর বাজার দিয়ে আসবেন।

– ওই ব্যাডা কইছি না যামু না।খা*পোলা বেশি নমুনা করলে এহানেই পুইতা দিমু।সর কু**বাচ্চা।

মুহূর্তেই রেগে গেলো সুহাইল।সুপ্ত রাগটা আবারো বেড়েছে,সিএনজি চালকের কলার টেনে তাকে বাইরে বের করে আনে।লোকটার মুখে অকথ্য ভাষায় গালি শুনে শরীরের শিরায় উপশিরায় রক্ত রাগে সঞ্চার হয়েছে।বেশামাল ভাবে লোকটার গালে থাবা বসায় সে।আরমিন মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে আছে।এই মুহূর্তে কি করা উচিত তার মাথায় আসলো না।শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে।

– যা বলার আমাকে বলবি আমার মা তুলে গালি দিলি কেন?শালা গাজাখোর।

– ব্যা***পোলা ছাড় আমারে তোর কইলজা কতখানি হইলে আমার এলাকায় আমারে মারস।

– তোকে তো!

দুজনের মাঝেই শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি।কেউ কারো থেকে কম যায় না।লাগামহীন মা-রামা-রি চলছে আজ।আরমিন চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে।বিলাপ করে দুজনকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠে।ততক্ষণে লোকটির মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে,পিচ ঢালা রাস্তায় ধস্তাধস্তি করায় সুজাইলের হাত,পা,মুখ ছিড়ে র-ক্ত বের হচ্ছে।শুনশান অন্ধকার রাস্তায় এমন করুন পরিস্থিতির শিকার আগে হয়নি আরমিন।এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।তুফানের গতি বেড়ে গেছে চারিদিকে বজ্রপাত।বাজের শব্দে কানে হাত দিয়ে ছিটকে সরে যায় আরমিন।ভয়ে রূহ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে তার।অপরদিকে সুহাইলের হাত মচকে গেছে, লোকটা মাথা ফাটিয়েও বেগতিক হারে সুহাইলের দিকে তেড়ে আসছে।দুজনের রোষানলের চিৎকার,আরমিনের অনুনয়বিনয়ের বিলাপে এক ভীত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।আজ যেন রাতের গম্ভীর আকাশটা চোখ পাকিয়ে ভয় দেখচ্ছে তাদের।বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে এর মাঝে।আরমিন শত চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলো না সুহাইলকে।বরং ঝ-গ-ড়ার মাঝেই নিজের শরীরে সিএনজি ড্রাইভার লোকটার হাতের বাজে থাবার স্বীকার হয়েছে।চাপা অপমানে,রাগে এই মুহূর্তে তার কাছে যেন মরে যাওয়াই শ্রেয়।অস্বস্তিকর,বিপদগ্রস্ত পরিবেশে নিজেকে এক অসহায় মানবী মনে হচ্ছে।আশার আলো দেখিয়ে টচ লাইট হাতে আইলের রাস্তা ধরে বেশ কয়েকজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখলো আরমিন।অন্ধকারে লোকগুলো তাদের দিকেই আলো ছুড়েছে।

– এই কেরে ওখানে?মা/রা/মা/রি করতাছে কে?
#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here