#মায়াপ্রপঞ্চ,২০,২১
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২০]
________________
বৃষ্টির গতিক ক্রমশ বেড়ে গেছে।বাতাসের ধাপটে সরু লম্বা সুপারি গাছগুলো এদিকে থেকে সেদিক হেলেদুলে পড়ছে।বাজের শব্দ কেঁপে উঠছে ধরণি।আলোর ঝলকে পরিবেশটাকে এই মুহূর্তে রণক্ষেত্র মনে হচ্ছে আরমিনের কাছে।আশেপাশে সবার উপস্থিতি বৃদ্ধমান।সবার শোরগোলের দিকবেদিক থেকে ছুটে আসছে এলাকার মানুষজন।আরমিন ভরসা পেয়ে তাকিয়ে রইলো সবার দিকে।সিএনজি ড্রাইভার মেঝেতে পড়ে আছে।তাকে আগলে নিলো মাঝ বয়সি দুটো ছেলে।সুহাইল ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বসে পড়লো রাস্তার কিনারায়।উৎসুক জনতার ভীড় বাড়ছে ধীরে ধীরে।
– এই পোলা এহানে কী হইতাসে?এত রাতে মা/রামা/রি করো কিল্লাইগা?
মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে সরু চোখে তাকালো সুহাইল।বৃষ্টির ঝাপটায় ছিড়ে যাওয়া চামড়াগুলো বেশ জ্বালা করছে।মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলো আরমিনকে।মেয়েটা ভিজে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সুহাইল ঢোক গিল কিছু বলতে উদ্যত হয় তার আগেই আ-হ-ত সিএনজির ড্রাইভার ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
– চাচা এলাকায় ন-ষ্টা-মি করতে আইছিলো আমি বাঁধা দিসি তাই……
– এই মুখের ভাষা ঠিক করেন।কাকে কী বলছেন ভেবে চিনতে বলুন।
সুহাইলের হুংকারে থম মে-রে যায় লোকটি।আরমিনের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে।সবাই ইশারায় ইঙ্গিতে বাজে মন্তব্য করছে তাকে,তা বুঝতে পেরে সুহাইল রেগে যায়।
– আপনারা ভুল বুঝবেন না।এই লোকটা মাতাল,আমাদের ভুল ঠিকানায় নিয়ে আসে কিন্তু সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিতে বললে বিশ্রি ভাষায় গালি দেয়।আর….
– চাচা বিশ্বাস কইরেন না।ডাহা মিচা কতা।এই পোলা মাইয়া দুইডারি চরিত্র খারাপ।গত মাসেও এমন এক জোড়া ধরছিলেন মন আছেনি?
নিয়ন্ত্রিণহীন হয়ে পড়ে সুহাইল।ক্রুদ্ধ হয়ে লোকটাকে মারতে নিলেই তাকে আটকে দেয় বেশ কয়েকজন যুবক।তাদের মাঝে কেউ বলে উঠে,
– ন-ষ্টা-মি করস আবার বড় গলা।চাচা ওদের ব্যবস্থা করেন না হয় গন ধোলাই দিয়া মাইরা ফেলমু।
সুহাইল রাগের মাথায় নানান কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু তার কথায় কেউ কানে তুললো না বরং সবাই তাকিয়ে আছে মুরুব্বি লোকটার দিকে।বোঝাই যাচ্ছে সবাই কতটা মান্য করে তাকে।মহিলারা ঘিরে আছে আরমিনের আশেপাশে সবাই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।ইশারা ইঙ্গিতে বাজে মন্তব্য ছুড়ছে তারাও।এসব যেন সহ্য করার বাইরে চলে গেছে।
– ওদের দুজনকে আমার বাড়িতে নিয়া যাও।বাকি কথা সেখানেই হইবো।
.
বৃষ্টির কমতি নেই তুমুল বর্ষণে ধরণি কাঁপিয়ে তুলছে।আরমিনকে,সুহাইল শুকনো কাপড় পড়ে বসে আছে।দুজন আলাদা আলাদা কামড়ায়।সুহাইল শত চেষ্টা করেও নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে পারেনি।অপর দিকে আরমিনকে নিয়ে নানান বাজে মন্তব্য করছে সবাই।সবটা শুনে যেন পাথর বনে গেলো মেয়েটা।কেঁদে কেটেও আজ কুল কীনারা পাচ্ছে না।ফজরের আজানের ধ্বনি কানে আসছে চোখ তুলে তাকায় মেয়েটা।সুহাইলের দেখা নেই অনেক্ষণ যাবৎ কোথায় সে!
সুহাইল চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে তার ফোনটি পকেটে নেই।কোথায় আছে সে জানেনা।হয়তো রাস্তায় ধস্তাধস্তি করায় পড়ে গেছে।এই বাড়ির কাউকে সে বিশ্বাস করাতে পারলো না তার কোন দোষ নেই।বরং প্রতিবাদ করায় কয়েকজন যুবক তাকে মেরেছে।তাই এখন স্থির হয়ে আছে সে।এমন তাজ্জব পরিস্থিতিতে আগে পড়েনি কখোনই।
.
ধীরে ধীরে ধরণির আলো ফুটতে শুরু করেছে।বৃষ্টি থেমে গেছে ইতোমধ্যে।সিএনজি ড্রাইভারের মাথায় ব্যান্ডেজ করিয়ে ফিরছেন সেই মুরব্বি তার নাম ফজলে মিয়া।
– ছেলেটা আর মেয়েটাকে বাইরে আনো।
ফজলে মিয়ার ডাকে আরমিন এবং সুহাইলকে রোয়াকে আনা হয়।তিনি থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সুহাইলের দিকে।
– এই ছেলে এখানে কেন এসেছিলে?
ফজলে মিয়ার কথায় এবার যেন বিরক্ত সুহাইল।এমন বেকায়দা পরিস্থিতি মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না কিছুতেই তার।
– আর কত বার বলবো?কত শত বার বললে বিশ্বাস করবেন?আমরা খারাপ কাজ করতে এখানে আসিনি।বরং ড্রাইভার আমাদের এখানে এনেছে।
– চাচা হুনবেন না এই পোলার কথা ধরা পড়লে সব একই রকম লেচকার দেয়।ন-ষ্ট পোলাপাইন সমাজডা শেষ কইরা দিসে।
ছেলেটার কথা শুনে ক্রোধে গর্জন করে উঠে সুহাইল।সে তেড়ে যেতে নিলে কয়েকজন ছেলেপেলে আটকে ধরে।আরমিন এমন কান্ডে কেঁদে দিলো শব্দ করে।ফজলে মিয়া পানের পিক ফেলে তাকালো তার দিকে,
– তুমি এই ছেলের সাথে কী করো?
– আমরা বিয়ে বাড়িতে ছিলাম।আমার বাবা অসুস্থ তাই….
– বিশ্বাস করবো কী করে তোমাদের কথা?ধরা পড়লে সবাই একই কথা বলে।তোমরা দুজনেই টগবগে জোয়ান তরুন,তরুণি।গত মাসেও এমন এক জোড়া ধরেছিলাম।মা বাবার সম্মান নষ্ট করে অন্য ছেলের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসো লজ্জা লাগেনা তোমাদের?
ফজলে মিয়া ধমকে উঠলেন।সুহাইল আবারো রেগে গেলো।নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে,
– বার বার বলছি বিচার না করে আজে বাজে মন্তব্য করবেন না।
উপস্থিত সিএনজি ড্রাইভার এবার মুখ খুললেন।কাচুমাচু হয়ে বলেন,
– বিশ্বাস কইরেন নিজের চোহে দেখছি আমার গাড়ির ভিত্তে না-ষ্টা-মি করে।এরপর আমি যহন ডাক দিসিলাম তহনি খেইপা মারা শুরু করে।এর বিচার চাই আমরা।
সিএনজি ড্রাইভারের কথায় সবাই সুর মেলালো।ফজলে মিয়া আশেপাশে মুরুব্বি দুজনের সাথে আলাপচারিতা করে সিদ্ধান্ত নেন।
– তোমাদের দুজনকেই বলছি এখন তোমাদের বিয়ে দেওয়া হবে।তোমাদের মতো কিছু ছেলেমেয়ের কারনে সমাজে পাপাচার বেড়ে যাচ্ছে।
– অসম্ভব এই বিয়ে করবো না।
সুহাইল দৃঢ় চিত্তে কথাটি বলে ঘুরে তাকায় আরমিনের দিকে।আরমিন মাথা দিয়ে ইশারায় সহমত পোষণ করে।সে বিয়ে করবেনা।
– তোমাদের মতামত চাই নাই।এটা আমাগো সিদ্ধান্ত।
– জীবন আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক আপনারা কেন হবেন?
– ন-ষ্টামি করার আগে মনে ছিল না।কুলাঙ্গার পোলাপাইন।
ভিড়ের মাঝে মধ্যবয়স্ক একজনের কথায় আবারো রেগে যায় সুহাইল তাকে তেড়ে মারতে নিলে ভিড়ের মাঝে কয়েক জন যুবকের সাথে হাতাহাতি হয়।এতে আবারো আঘা-ত পায় ছেলেটা।ফজলে মিয়া সবাইকে সরিয়ে আগলে নেন সুহাইলকে।চেয়ারে বসতে ইশারা করে তিনি নিজেও বসে যান।
– কাজি সাবরে খবর পাঠা।মিয়া বাড়িতে আসতে বল।
ফজলে মিয়ার আদেশে চকিতে তাকালো আরমিন।ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।ধম বন্ধকর কি বাজে পরিস্থিতি।
– আমি বিয়ে করবো না মরে গেলেও না।আপনারা শুধু শুধু কেন বাড়াবাড়ি করছেন।
আরমিনের ধমকে একজন মহিলা তার গাল চেপে ধরে।বিশ্রি বিশ্রি কয়েকটি গালি ছুড়ে দেয় তার দিকে।এতে ক্ষিপ্ত হয় সুহাইল রাগারাগির এক পর্যায়ে আবার হাতাহাতি হয়।ঠোঁট কেটে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।ফজলে মিয়া সবাইকে সরিয়ে আবারো আগলে নেন তাকে।কিছুতেই তিনি পরিস্থিতির দুর্গতি চাননা।ভিড়ের মাঝে কয়েকজন ছেলে আরমিন এবং সুহাইলের ছবি তুলছে তা দেখে দ্রুত আরমিন মুখে ওড়না দেয়।কোন বিপাকে পড়েছে সে কে রক্ষা করবে তাকে।
.
ঝলমলে আলো উঠনে সারি সারি মানুষের ভীড় যেন গ্রাম শুদ্ধ লোক আজ মিয়া বাড়িতে উপস্থিত।মচকে যাওয়া হাতের ব্যাথা তীব্রভাবে বেড়েছে সুহাইলের।চামড়া ছিড়ে যাওয়া জায়গা গুলোতে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি তাকে নাড়িয়ে তুলছে বারংবার।আরমিন কাঁদতে কাঁদতে পাথর বনে গেছে।তার সামনে সুহাইলকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।মেয়েটা মুহূর্তে মৃত্যুকে স্মরণ করছে বার বার।এই মুখ নিয়ে সালেহার সামনে কি করে যাবে সে।এদিকে কায়েমের কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না।এরি মাঝে কাজি এসে উপস্থিত।কাজি যখন চেয়ারে বসলো তখন সুহাইল স্থির কন্ঠে বলে,
– করবো না এই বিয়ে চলে যান।
কাজি তাকালো ফজলে মিয়ার দিকে তিনি কাজিকে বসতে ইশারা করেন।
– কি হলো যেতে বলেছি এই বিয়ে করবো না।আমাকে একবার শুধু ছাড়েন তখন কে করে বিয়ে দেখিয়ে দিবো।
কাজি তোড়জোড় করে বিয়ের কাজ শুরু করে।আরমিন সুহাইলকে নাম বলতে বললে কেউ মুখ থেকে একটুখানি কথাও বের করলো না।এতে রেগে যায় সুহাইলের সমবয়সী কয়েকটা ছেলে।এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে তাকে।ছেলেটার নাক থেকে রক্ত ঝরছে আরমিন তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে সবটাই কল্পনার মতো।
– ত..তুমি কিছু বলো না।মামির সম্মতি ছাড়া এই বিয়ে করবো না।যেখানে মামি উপস্থিত থাকবে না সেখানে এই বিয়ে আমি করবো না।
জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কথাটি বললো সুহাইল।মাথাটা নেতিয়ে পড়েছে চেয়ারের কিনারায়।একজন মহিলা এসে আরমিনের চুলের মুঠি চেপে ধরলো কিছু বিশ্রি গালি আবারো ছুড়ে দিলো তার দিকে।সুহাইল নির্বাক ভঙ্গিতে সেটা দেখলো।
– ওর গায়ে কেউ হাত দিয়েন না।ওকে মারবেন না।আমার আমানত!
সুহাইল মাথাটা নুইয়ে নেয়।ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে থাকা ভিড়ের মাঝে একটি ছেলে এসে সুহাইলের চুলের মুঠি চেপে গাছের সাথে প্রহার করে।গলগল স্রোতে রক্ত ভেসে যাচ্ছে ছেলেটার চোখ মুখ,লাহমায় আরমিন শব্দ করেই কেঁদে উঠলো ছেলেটি এগিয়ে এলো আরমিনের দিকে রোষানলে তপ্ত স্বরে বলে,
– পোলাডারে আরো মারমু রাজি হইয়া যা।রাতে পালাইবার আগে তহন মনে ছিল না। নাকি দে*হ ব্য*ব*সা করস?
আরমিনের সহ্যর সীমানা শেষ পথে চোখ মুখ খিচে তাকালো ফজলে মিয়ার দিকে।তিনি যেন সার্কাসের মজা দেখছেন।একে একে সবটা বললো আরমিন।দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হয়।নতুন জীবনের সূচনা এত তিক্ততায় ঘেরা বাকিটা জীবন নিশ্চই উত্তপ্ত লাভার মতো তেজস্বী হবে!
#চলবে…..
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২১]
_______________
– আমি মানি না,এই বিয়ে আমি কিছুতেই মানি না।মানবো না।এই ছেলে আমার কাছে আসবি নায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
আরমিনের চিৎকারে অন্ধাকার বাসটায় সবাই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে।চিৎকারের উৎস খুঁজতে ঘুরে তাকায় পেছনের দিকে।একটা মেয়ে ঘুমের মাঝে আবোল-তাবোল বকছে।নিস্তব্দ বাসটায় লাহমায় সবার কোলাহলে মুখোরিত হয়।পাশে বসে থাকা সুহাইল তাজ্জব বনে তাকিয়ে আছে আমিনের দিকে মেয়েটাকে এত রাতে কি জিন ভূতে ধরেছে নাকি?সুহাইলের সৎবিৎ ফিরতে আরমিনের কাধ ঝাকরে ডাকা শুরু করে,
– এই মরিয়ম তোমার আবার কি হলো?
– আমি মানি না এই বিয়ে।আমাকে ছেড়ে দিন।আমি বাড়ি যাবো।
– আরেহহহ পা/গল হলে নাকি তুমি?
সুহাইল বিরক্ত হয়ে বেশ জোরেই ধাক্কা দেয় আরমিনকে।মেয়েটা তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে তাকায় আশেপাশে।সবাই তাকে পরখ করছে এক দৃষ্টিতে কিন্তু কেন?পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো সুহাইল দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।সুহাইলকে এত রেগে যেতে এর আগে কখনোই দেখেনি সে।
– সু..সুহাইল আপনার আবার কী হলো?রেগে আছেন কেন?
– তুমি চিৎকার করছিলে কেন?
সুহাইল প্রশ্ন করে সোজাসুজি বসে যায়।বাসের বাকি সদস্যরা বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে বকাবকি করছে তাদের।আরমিন বাস্তবতায় ফিরতে লজ্জায় মিহিয়ে থুতনিটা গলার কাছটায় মিশে যায়।সবার দিকে তাকিয়ে অনুনয় সরে সরি বলে মাথাটা এলিয়ে দেয় বাসের সিটে।চোখ বন্ধ করে সুহাইলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– আমাকে একটু পানি দিবেন?গলা শুকিয়ে গেছে।
সুহাইল আড়চোখে তাকালো মেয়েটার দিকে।মেয়েটা দেদারসে ঘামছে।কি অদ্ভুত কান্ড কিসের বিয়ে বিয়ে করছিল সে।সুহাইল হাত ঘড়ির দিকে তাকালো সময়টা দুইটা ছাপ্পান্ন মিনিট।বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিশ্চই সকাল হয়ে যাবে।
– মুখে পানির ঝাপটা দাও ভালো লাগবে।
আরমিন তাই করলো,নিশ্চুপ কাজ সেরে জানলাটা কিছুটা ফাঁক করে দিয়ে আবারো সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো।জানলা দিয়ে তখন অশেষ বাতাসের ঝাপটায় শিতল করছিলো তাকে।সুহাইল তার মায়াবী মুখখানায় তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।এই মায়া তাকে শেষ করে দিচ্ছে বছরের পর বছর।এই মেয়ের প্রেমের উষ্ণতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়ে প্রতিটি ক্ষণে।
– কি স্বপ্ন দেখছিলে মরিয়ম?
– আপনার আর আমার বিয়ে!
নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দিলো আরমিন।সুহাইল তখন আশ্চর্যের শেষ সীমায়।আগ্রহ নিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইলো আরমিনের দিকে।
– মজা করছো আমার সঙ্গে?
– আজ্ঞে না।
– ও মাই গড।বলনা কি স্বপ্ন দেখেছিলে।
– পারবো না বলতে ঘুমোতে দিন বিরক্ত করবেন না।
সুহাইল নাছোড়বান্দা কিছুতেই ছাড়লো না আরমিনকে।আরমিন বাধ্য হয়ে সবটা খুলে বললো।তারা তখন পূর্ব পীরবাজারে ভুল ঠিকানায় গিয়েছিল ঠিক তবে আরেকটি সিএনজির সাহায্য দক্ষিন পীরবাজারে উপস্থিত হয় এবং দু’গুন বেশি ভাড়া দিতে হয়।ভাগ্যক্রমে প্রায় দশ মিনিট দাঁড়ানোর পর একটি বাস পেয়ে যায়।তখন ঝড়ের তান্ডব প্রায় শুরু হয়েছিল।সুহাইল আড় চোখে দেখছিলো মেয়েটার ভীতু চেহারা।তবে এই ভীতু মেয়ে যে স্বপ্নে এতটা গালগল্প সাজিয়ে ফেলবে ভাবতেই হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যায় সুহাইলের।তার অট্টোহাসিতে বাসের সবার ঘুম ফের ভেঙ্গে যায়।চরম বিরক্ত নিয়ে তাদের দিকে আবারো তাকায় সকলে।মধ্যে বয়স্ক একজন লোক দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্য বলে,
– ওই বাসটা কি কিন্না লইছো?এক জন হাসে একজন কাঁদে।এত উল্লাল করতে হইলে নাইমা যাও বাস থেকে।যত্তসব!
লোকটা বসে পড়ে।তার কথায় তাল মেলায় অনেকে।আরমিন লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে রাখে।সুহাইল তখনো মুখে হাত চেপে হেলেদুলে হাসছে।
– আপনি থামবেন!অ-সভ্য কোথাকার।
– অ-সভ্য চিন্তা ভাবনা তো তোমার,আমার নয়।ভাগ্যিস বিয়ে পর্যন্ত এগিয়েছো বাসর পর্যন্ত যাওনি তবে কী হতো?
সুহাইল আবারো অট্টোহাসিতে মেতে উঠে।বাসের প্রত্যকটা লোক বিরক্ত হয়ে বাজে ভাষায় গা-লাগা-ল শুরু করে।আরমিন নিজের কপালে নিজে থা-প-ড়ে মেকি কান্নায় তাকায় সুহাইলের দিকে।সুহাইল দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তবে শেষ রক্ষা হলো না দশ সেকেন্ড পরেই আবারো অট্টোহাসিতে হেসে উঠে সে।খোলা জানালায় হঠাৎ বৃষ্টির ঝটকায় ভিজে যায় দুজনেই মূহুর্তে চুপ হয়ে যায় সুহাইল গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরমিনের দিকে।
_
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।সারারাত বৃষ্টিতে কাঁদা জলে টইটুম্বুর রাস্তাঘাট।বাস স্টেশনে দাড়ালে একে একে সবাই নেমে যায়।সুহাইল আরমিন মুগ্ধকর পরিবেশটা উপভোগ করছিলো।সুহাইল হামি তুলে এগিয়ে গেলো টং দোকানের কাছে।
– আসো আরমিন একটু চায়ের আড্ডা হয়ে যাক।
– আমার মুড নেই আমি বাড়ি যেতে চাই।
-আহ আমি খোঁজ নিয়েছি বাড়িতে,মামার শারীর অবস্থা উন্নতি।বাড়িতে দেরিতে গেলেও এখন সমস্যা হবে না।তবে আসো চা নি।
আরমিন এগিয়ে গেলো।বসলো সুহাইলের কাছে।দোকানি তাদের এগিয়ে দিলো দু’কাপ দুধ চা।গরম গরম চায়ে চুমুক বসিয়ে আকাশে তাকালো আরমিন।কে বলবে গতকাল রাতে এত মেঘলা এই নীল আকাশটাই ছিল।
– তারপর বলো প্লেনিং কি?
– কিসের প্লেনিং?
– আমাদের বিয়ের।
– দেখুন মজা করবনে না।আমি যে কেন এই স্বপ্নটা দেখেছি নিজেই বুঝতে পারছিনা।তবে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি আপনার যা বাজে অবস্থা হয়েছিলো এখনো ভুলতে পারছিনা।মনে হয়েছিলো সবটাই জীবন্ত।মানসিক ভাবে এফেক্ট করেছে আমায়।
সুহাইল চায়ের কাপ হাতে গা দুলিয়ে হাসলো।তার হাসির কমতি নেই তখন থেকে।মনে পড়লেই হাসছে সে।
– আশায় আছি তোমার স্বপ্নটা সত্যি হোক।
– কোন দিন না আমাকে বিয়ে করার আশা ভুলে যান।
– বিশ্বাস করো ভুলেই গেছিলাম।মামুর ওই অবস্থা,এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে জার্নি করা চেলেঞ্জিং বিষয়।আমি শুধু ভাবছিলাম কখন বাড়ি ফিরবো আর তুমি কি করলে ডাইরেক সপ্নেই বিয়ে করে বসলে।তবে বুঝলাম আমার থেকেও তুমি শত গুন এগিয়ে আমাদের সম্পর্কে।আমার না এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।চলো না প্লিজ বিয়ে করে ফেলি!
আরমিন রেগে গেলো।হাতের ব্যাগটা নিয়ে উঠে বসলো বেঞ্চি থেকে।যেদিকে দু’চোখ গেছে সেদিকেই হাটা শুরু করলো সহসা।সুহাইল ঘাবড়ে গিয়ে চায়ের বিল মিটিয়ে আরমিনের পেছনের হাটা শুরু করে।
– এই বউ দাঁড়াও না।
– এই আপনি কী আমাকে একটু শান্তি দিবেন না?দেখবেন আপনার জ্বালায় আমি মরেই যাবো।
হাস্যজ্বল সুহাইল হঠাৎ থমকে গেলো।আষাঢ়ের মেঘ ভর করেছে তার মুখে।ছোট ছোট পা ফেলে হাটে আরমিনের পাশে পাশে।
– কী অদ্ভুত আমরা তাই না!আমার শান্তি নাম তুমি আর তোমার অশান্তির কারণ আমি।
বেশ আফসোস নিয়ে কথাটা বললো সুহাইল।নিদারুণ যন্ত্রণাটা বুকে চেপে রাখলো সে।পাশ দিয়ে সাই সাই করে ছুটে চলছে যানবাহন।উড়িয়ে দিচ্ছে আরমিনের ওড়না।সুহাইল সরু পিচ ঢালা রাস্তাটায় তাকালো কত গাড়ির ভিড় সেখানটায়।আরমিনের দিকে আবারো আফসোস নিয়ে ছুড়ে দিলো কিছু কথা।
– আমার মৃত্যু তোমার সহ্য হলেও,তোমার মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারবো না মরিয়ম।তুমি একবার আমার জায়গায় তোমাকে বসিয়ে দেখো,এতদিনে উপেক্ষার যন্ত্রণায় তুমি এই সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে হারিয়ে যেতে।
_
সকাল ছয়টায় বাড়ি ফিরে আরমিন সুহাইল।আরমিনের সঙ্গে সুহাইলকে দেখে সবাই অবাক হয়েছিলো।মাফীর বন্ধু শুনে সবাই স্থির হয়।তবে সবাই স্বাভাবিক ভাবে বিষয়টা মাথা থেকে ঝারলেও বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিলো না সালেহা।আরমিনের দিকে কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি।প্লাবনের কাছ থেকে জানতে পেরেছে আরমিন ফিরেছে সুহাইলের সাথে এবং সে আগে
মাতবর বাড়িয়ে গিয়েছিলো।
– তোর ক-লিজাডা খুইলা দেখতে মন চায় আমার।
– কেন আম্মা আমি আবার কি করছি?
– তুই সুহাইলের সাথে কি করস?আমি তোরে কি বলছিলাম এই বংশের কারো সাথে আমাদের সম্পর্ক নাই।
– আমি জানি আম্মা।তবে আর যাই হোক বিপদে পড়েই তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম।এর বেশি কিছু না।
– আমি তোরে শুধু আর ওই পোলার লগে দেখি তবে বুঝবি সালেহা কতটা খারাপ।
আরমিন ঠোঁট উল্টালো।চোখ ভাঙ্গিয়ে ঘুম আসছে তার।বিয়ে বাড়িতে মোটেও ঘুম হয়নি।বাসে যাও ঘুমালো তাও অদ্ভুত স্বপ্নে মাথাটায় ধরে যায়।বিছানায় বালিশ ছুড়ে এলিয়ে দিলো গা।পাশে মোবাইল চার্জ হচ্ছে।চোখটা যখনি বুজে আসছিলো তখনি পবনের ফোন পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে।
– বলো পবন ভাই।
– কন্ঠো এমন লাগছে কেন তোর?
– ঘুম ধরেছে আমার।বলো কি বলবে।
– তুই কোথায় এখন?বিয়ে বাড়িতে এত সকাল পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?
– আমি তো আমার বাড়িতে রাতেই রওনা হয়েছিলাম আব্বার শরীর খারাপ ছিল তাই চলে এলাম।
– এত রাতে তুই একা এসেছিস এত দূর থেকে তোর মাথা কি খারপ হয়ে গেছে।
পবনের কন্ঠে বেশ রাগ ছিল।আরমিন মুখ কুচকালো উঠে বসে বালিশটা কোলে নিয়ে বলে,
– আমি একা আসিনি সুহাইল ভাইয়া সঙ্গে ছিল।মাফী ভাইয়ার বন্ধু তিনি।তাকে রাতে বললে নিয়ে আসে।
– এত রাতে তোরা এক এসেছিস।
– হুম!
মুহূর্তেই চাপা রাগের সঞ্চার হয় পবনের মনে।আরমিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনটা কেটে বিছানায় ছুড়ে ফেলে।অসহ্যকর অনুভূতি হচ্ছে তার তিক্ততায় ঘিরে ধরেছে চারিদিক।
#চলবে…