#মায়াপ্রপঞ্চ,২৬,২৭
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৬]
______________
জাবির মাতবর নিজের ব্যবসায়ীক কাজে এই কয়েকদিন পুরোদমে ব্যস্ত আছেন।এতটাই ব্যস্ত দুপুরের খাওয়ারটা বাড়িতেও খাওয়া হচ্ছে না।লোকদের কাজ বুঝিয়ে একটি দোকানে এসে বসলেন তিনি।ঘেমে নেয়ে শরীরটা একাকার অবস্থা।সুহাইল তাকে ফোন করেছিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু কাজে ব্যস্ত থাকায় ধরতে পারেনি।তাই এখন ব্যস্ততা শেষে ফোন করেন তিনি।
– সুহাইল বাবা কিছু কি বলবে?এতবার ফোন করেছিলে।আমি তো ব্যস্ত ছিলাম।
– আংকেল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– কী সিদ্ধান্ত বাবা?
– মামীদের জন্য নতুন করে বাড়ি করবো।মামীর বাড়ির পাশের জায়গাগুলো কার?দেখলাম জঙ্গলাবৃত হয়ে আছে।
– আমার,তবে কাজে লাগছে না বলে পড়ে আছে।তবে আগামীতে বিক্রি করার ইচ্ছা আছে।
– বর্তমান বাজার মূল্য দামেই আমি জায়গাগুলো কিনে নিবো।আমি সব ব্যবস্থা করছি আপনাকে কিছু করতে হবে না আংকেল।
সুহাইলের কথায় মিহি হাসলো জাবির।প্রশান্তিতে ভরে উঠলো তার মনপ্রাণ।
– ঠিক আছে বাবা তবেই তাই হোক।আমি বরং লোক পাঠিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করার ব্যবস্থা করছি।তুমি ভালো আছো?ভাবীর কি অবস্থা?
– আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।আম্মুকে সেদিন আরমিনের ছবি দেখিয়েছি তার পছন্দ হয়েছে এবং আমাকে কথাও দিয়েছে বড় ছেলের বউ আরমিনকেই করবে।
– তিনি কি জানেন না আরমিন তার ভাইজি?
– না জানার সুযোগ দি নাই।আম্মু যখন একবার আমাকে কথা দিয়েছে সেই কথার খেলাপ কখনোই করবেন না।
জাবির হাসলেন।অবশেষে আরমিনকে বিশ্বাসযোগ্য কারো হাতে তুলে দিবেন ভেবে মনে প্রাণে প্রশান্তি ভরে যায়।
.
প্লাবন আর আরমিন ছাদে বসে আমড়া কেঁ-টে খাচ্ছে।লবন মরিচের মিশ্রণের আমড়ার টুকরো মিশিয়ে মুখে পুরে তৃপ্তি নিয়ে চবনে ব্যস্ত।প্লাবন গাছ থেকে আমড়া পেড়ে চাকুর সাহায্য টুকরো করে আরমিনের হাতে দিচ্ছে।পবন ঠোঁটের ডগায় সিগারেট পুরে ধৌয়া উড়াতে ব্যস্ত।ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ দেখে যাচ্ছে আরমিনকে।প্লাবন কিংবা আরমিন কেউ খেয়ালি করলো না পবন এখনানে উপস্থিত।ছোট্ট মণিরা একটু একটু আমড়া মুখে তুলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।প্রমা এতক্ষণ নিচ তলায় ছিল হঠাৎ ছাঁদে ছুটে এসে আরমিনের সামনে দাঁড়ায়।
– আরমিন আপু রুমন ভাইয়া তোমায় ডাকছে।
– এই ছেলেটা ব-দ-মাইশ পথে ঘাটে দেখলেই ডেকে উঠে বিরক্ত করে।অসহ্যকর একটা ছেলে।এখন কেন ডাকছে বলেছে কিছু?
প্রমা কিছু বলার আগেই প্লাবণ ক্ষিপ্ত হয়।হাতের চা’কুটা দিয়ে ইশারায় বলে,
– আমার আরমিন আপুকে বিরক্ত দাঁড়াও মজা দেখাবো।
– আরমিন আপু রুমনের বোন রুমা আমাকে বলেছিল তার ভাই নাকি তোমায় পছন্দ করে।স্কুলে কাল ক্লাসে বলেছিলো তোমায় বলতেই ভুলে গেছি।
প্রমার কথায় আরমিন প্রত্যুত্তর করলো না।তার হাভ ভাব এমন সে যেন কথাটা শুনতেই পায় নি।
গলির রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে ছিল রুমন।আরমিনকে দেশে এক গাল হেসে প্লাবনের নাম ধরে ডাক দেয়।সবাই চকিতে ঘুরে তাকালে রুমন আরমিনকে হাত ইশারায় ডাকে।এতক্ষণ সবটা পর্যবেক্ষণ করছিলো পবন।পিলপিল পায়ে এগিয়ে এলো আরমিনের কাছে।আরমিনের পিঠের উপর দিয়ে উবু হয়ে একবার দেখে নিলো রুমনকে।কানের পাশে ফসফস শ্বাসের শব্দে চমকে উঠে আরমিন।ঘুরে তাকাতে নিলে ধাক্কা লাগে পবনের চওড়া বুকের সাথে।
– প…বন ভাই কখন এলে?
– প্রেম নিবেদন চলছিলো?
আরমিন উত্তর দিলো না।প্লাবনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলে।আরমিনকে নিরব থাকতে দেখে পবন প্রমার গালটা বৃদ্ধ আঙুল আর তর্জনির আঙুল দিয়ে আলতো হাতে চেপে ধরে।অন্য হাতে থাকা সিগারেটা ছুড়ে ফেলে,হিসহিসিয়ে বলে,
– বোন হয়ে ভাইয়ের কপাল ফুটো করছিস বাহ!তোর ব্যবস্থা পরে করবো আগে ওটার ব্যবস্থা করি।
মুহূর্তে পবন ছুটে নিচে চলে যায়।আরমিনের আর বুঝতে বাকি নেই বেচারা রুমনের কপালে শনি দোল খেলছে।ছাদ থেকেই তারা দেখতে পেলো পবন রুমনের পিছনে ছুটছে।
_
রাত এগারোটার পর বাড়ি ফিরলেন জাবির মাতবর।আগামীকাল থেকে আরমিনদের বাড়ির কাজ শুরু হবে।আগের বাড়ির পাশেই একতলা ঘর করা হবে।সালেহা সহ বাদবাকি অনেকেই জানতে চেয়েছে এই জমিতে কার ঘর হবে,জাবির সবাইকে একটাই কথা বলেছে যখন সম্পূর্ণ হবে তখনি দেখতে পাবে।
সব প্রস্তুতি শেষে জাবির বাড়ি ফিরলো।নাহার বেগম তার চেহারার ভাব ভঙ্গিমা দেখেই বুঝে নিয়েছে জাবিরের মনটা আজ খারাপ।
– তোমার কি হয়েছে মুখটা শুখনো লাগছে কেন?
– কিছু না।পবন কি তার রুমে?
– হ্যা।তোমাদের বাপ ব্যাটার কি হয়েছে বলতো?পবন মাথা গরম করে ঘুরছে আমার সাথেও কেমন যেন ব্যবহার করছে দু’দিন থেকে।
– তুমি যাও এখন।তাকে বলো আমার রুমে আসতে কিছু কথা আছে।
নাহার বেগম ছুটে যায় পবনের রুমে।কয়েক মিনিটের মাঝেই পবন জাবিরের সামনে উপস্থিত হয়।ছেলেটার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা হতাশায় ডুবে আছে।
– তোমার কি কিছু হয়েছে পবন?
– আমার আবার কি হবে?আমি ভালো আছি।
– রুমন ছেলেটাকে কেন মেরেছিলে?একা মারলেও পারতে গন ধো-লাই দিয়েছো বন্ধুরা মিলে এর কারন কি?
– ইচ্ছে হয়েছে মেরেছি।
– তোমার ইচ্ছে হলেই মারবে এটা কোন কথা?ছেলেটার অবস্থা খারাপ,তার বাবা পুলিশ কেস করবে বলেছে জানো তুমি?আমি বেশ তোষামোদ করে এই কেসটা ঠেকিয়েছি।তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করেছি।তোমার এমন অধঃপতনের কারনটা কী?তুমি এলাকায় সম্মানীয় ব্যাক্তির ছেলে।তোমাকেও সেই ব্যাক্তির সম্মান ধরে রাখার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
– আরমিনকে দীর্ঘদিন উত্ত্যক্ত করছিলো ছেলেটা।তাই মেরেছি।
– তাকে বুঝিয়ে বললেও পারতে।মারলে কেন?আরমিনকে নিয়ে তোমার একটু বেশি বাড়াবাড়ি সবসময়।
পবন উত্তর দিলো না ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ।আমীনা তখন শরবত হাতে রুমে ডুকে,পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা তার কানেও গেছে।আমীনার দিকে একপলক তাকিয়ে পবন শুধালো,
– আব্বা আরমিন এই বাড়ির বউ হলে সমস্যা কি?
জাবির তখন শরবত মুখে তুলছিলো পবনের এমন কথায় জাবিরের নাক,মুখ ছিটকে শরবর বেরিয়ে যায়।
– কি বললে তুমি?
– যা শুনেছো তাই।
– ছিহ!এমন অধঃপতন তোমার।আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি.. ছিহহ।
– আব্বা আমি খারপা কিছু বলিনি।আমি শুধু আমার উত্তরটা চাইছি।
জাবির কিছু বললো না।আমীনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকে চলে যেতে ইশারা করে।আমীনাও নিশ্চুপ বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
– তুমি কি বাড়ির বড় বউ হিসেবে আরমিনকে চাইছো নাকি?
– যদি বলি হ্যা।
– তবে সেটা সম্ভব নয়।
পবন আশাহত চোখে তাকালো জাবিরের দিকে।বুকের ভেতরের হৃদযন্ত্রের চলাচল লোপ পেয়েছে।অশান্ত মনটা শান্ত করার কোন মাধ্যমি খুজে পাচ্ছে না সে।
– কেন সম্ভব নয়?
– কৈফিয়ত দিতে তোমাকে বাধ্য নই।
– দেখো আব্বা আমার পেছনে ছোট ভাই আছে।আজ যদি আমি উগ্র হয়ে যা সে নিজেও ঠিক তেমন হবে ভবিষ্যতে ভয় বলতে তার কাছে কিছুই থাকবে না।কারন তার বড় ভাইয়ো উগ্র ছিল এই উদাহরণের দোহাই দিয়ে চলবে সে।তাই ভালোয় ভালোয় কি সবটা মিটমাট করা যায় না?আমি লজ্জিত তোমার সামনে এসব কথা আলোচনা করতে কিন্তু এসব না বলেও উপায় নেই।শুনলাম আরমিনের নাকি বিয়ে ঠিক করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো।আমি যাকে ভালোবেসেছি তাকে যদি না পাই তবে ভালোবাসলাম কেন?
– যে ভাবে ভালোবেসেছিলে সে ভাবেই ভুলে যাও।তোমার আম্মা এই সম্পর্ক মানবে না।
– আম্মা মানলেও আমি ভালোবেসে যাবো, না মানলেও ভালোবেসে যাবো।এটা তো জামা না যে পছন্দ হয় নাই পায়ের তলায় দিয়ে পাপোশ বানিয়ে ফেলবো।এটা আবেগ,অনুভূতি,মায়া,সব মিলিয়ে ভালোবাসা।তার মায়ার অতলে ডুবে গেছি আমি আব্বা।তোমার কাছে তো বেশি কিছু চাই নাই।সাধ্য অনুযায়ী চাইছি পূরন করতে পারবে না আব্বা?
– এই মায়ায় কবে ডুবেছো?
– জানিনা।মায়া থেকে যে কবে মায়াপ্রপঞ্চে গেলো আমি টেরি পেলাম না।তবে এটাই যানি যদি তোমরা আমার সিদ্ধান্তে সহমত না দাও আমি যে শেষ হয়ে যাবো আগের পবন আমায় তুমি পাবে না।
জাবির উত্তর দিলো না।নিশ্চুপ চেয়ে রইলো মেঝের দিকে।পবন যেতে নিলেই রুক্ষ স্বরে বলে,
– তোমার আম্মা যেন এইসব কিছু না জানে।হার্টের রোগী ডাক্তার বলেছে সাবধানে চলতে।
পবন বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।জাবির আড় চোখে চাইলো পবনকে।এই মুহূর্তে আরমিনের বিয়ে যে সুহাইলের সাথে ঠিক তা জানানো যাবেনা।তাহলে জল অন্য দিকে গড়িয়ে যাবে।
_
নিকষ কালো আঁধারে ডুবে থাকা রাতটা পেরিয়ে যাচ্ছে।এর মাঝে কেউ ঘুমে কাবু কেউবা দু’চোখ মেলে আছে যন্ত্রণা বুকে চেপে।বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে আছে পবন।বাড়ির শেষ সিমানায় জ্বলতে থালা সোডিয়ামের বাতিতে আলোকিত হয়ে আছে বাইরের পরিবেশ।আকাশটা আজ গুমুট।দেদারসে ডেকে চলছে ব্যাঙ।হয়তো বৃষ্টি নামবে।ব্যাঙের অসহ্যকর ডাকে বিরক্ত হয়ে রুমে ফিরে পবন।বিছানার এক কোনে লম্বালম্বি শুয়ে আছে প্লাবন।পবন নিজেকে আর মানাতে পারলো না।সাহস নিয়ে আরমিনের ফোনে কল করেই বসলো।রাত তখন আনুমানিক একটার কাছাকাছি।
পড়ার টেবিল গুছিয়ে উঠছিলো আরমিন।এত রাতে পবনের ফোন পেয়ে বেশ ঘাবড়ে যায়।বিপদ আপদের কথা ভেবে দ্রুত রিসিভ করে ফোন।
– হ্যালো পবন ভাই সব ঠিক ঠাক তো?
– হুম সব ঠিক ঠাক।সবাই ঠিক আছে।
– তবে এত রাতে ফোন করলে যে?
– কি করছিস তুই?
– ঘুম পাচ্ছে ঘুমোবো।
– তাহলে ঘুমা।
– ফোন রাখছি তবে।ভা…..
– নানা কাটিস না।তুই ঘুমা ফোনটা কানের উপর রেখে দে।ভাল্লাগছে না।
আরমিন চমকালো,ভড়কালো।পবনের এমন উদ্ভট আচরণ সে আগে দেখেনি।
– নেশা করেছো নাকি পবন ভাই?
– হুম।এমন নেশা করেছি এই নেশা সহজে কাটবে না।মৃত্যুর আগে না।
– এই ভাই তোমার অহেতুক কথা রাখো আমি ঘুমালাম।
– ফোন কাটবি না খবরদার তাহলে কাল কপালে শনি ঘুরবে।
আরমিন বাধ্য হয়ে ফোন কাটলো না।প্রচন্ড ঘুম আসায় সে ঘুমিয়ে গেলো।কান থেকে ফোনটা গড়িয়ে পড়লো বালিশে।পবন নিস্তব্ধ পরিবেশে শুনতে থাকে আরমিনের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ।একটা সময় সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
#চলবে..
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৭]
________________
পুকুর ঘাটে মন মরা হয়ে বসে আছে পবন।আমীনা নিচের সিড়িতে বসে জামা কপড় কাচঁতে ব্যস্ত।ছেলেটার মন ম-রা হওয়ার কারন কিছুক্ষণ আগেই জেনেছে।আরমিন তাকে কাট কাট গলায় বুঝিয়ে দিলো যতদিন না পবনের বাবা,মায়ের সম্মোতি পাচ্ছে ততদিন এই সম্পর্কে জড়ানো ভুল।ভুল বললেও হয়না এ যেন মহা ভুল।আমীনা ঘাড় বাঁকালো।পবনের হালচাল দেখে শুধালো,
– তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না রে।
– কেন হবে না?
– তুই ভাইজান কে সরাসরি কেন বললি আরমিনকে বাড়ির বউ করতে চাস?বোকা নাকি তুই?
– বলেছি তো কি হয়েছে।আমার মাথা ঠিক নেই বিশ্বাস করো চাচী সবটা এলোমেলো লাগছে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই।
আমীনা প্রত্যুত্তর করলো না।নিজের কাজে মন দিলো।এভাবে ব্যয়িত হলো খানিকটা সময়।
– পবন তুই এখন বাবার হোটেলে চলিস।নিজের বলতে তোর কিছুই নেই।তুই যে দাবি করে বসবি আমার জীবন আমি যাকে চাই তাকে,এমনটা বললেও হবে না।তোর বাবা মায়েরো তোকে নিয়ে স্বপ্ন থাকতে পারে।আবার আরমিনকেও তারা প্রচন্ড ভালোবাসে সব মিলিয়ে তোর চান্স আছে শুধু চেষ্টা চালিয়ে যা।
– করবো টা কি আমি?আমার মাথায় কিছু আসছে না।
– সুহাইল ছেলেটাকে দেখেছিস?নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি কত সুন্দর ব্যবসা করছে।পরিবারেও তার এখন আলাদা দাম, সম্মান।তার কথা তোর বারেক আংকেল ফেলতে পারে না।বেকার ছেলেদের গুরুত্ব কোথাও নেই বুঝলি।তুই যদি তোর ভিত্তি পাকা করিস দেখবি সবার কাছে তোর কত দাম।তুই যখন আদেশ করবি আরমিনকে এ বাড়িতে আনার দেখবি সবাই আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।তখন তোর কথার দাম থাকবে।তারা ভেবেই নিবে আবেগে সিদ্ধান্তটা নিসনি।বুঝে শুনেই নিয়েছিস।
– আমি করবো টা কি?আব্বার সব তো আমাদেরি।আপাতত চাচ্চু আর আব্বা সামলাচ্ছে ভবিষ্যতে আমি।
– এসব বলে লাভ নেই ছেলে।নিজের পায়ে নিজে দাঁড়া।আজকাল কার ছেলেরা এই বয়সে কত কি করে।চাইলে কোন কোচিং সেন্টারে ক্লাস করাতে পারিস।অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেও কোচিং সেন্টার খুলতে পারিস।ধরে নে ভবিষ্যতে আরমিনকেও সেখানে চাকরি দিবি।আমি কি বলছি ভেবে দেখ পবন।শূন্য থেকেই মানুষ পূর্ণ হয়।
– তোমার কথায় যুক্তি আছে চাচী।তবে কী কাজে লেগে পড়বো?
আমীনা মিহি হাসলো।পুনরায় কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে তুললো সে।আরমিন আর পবনের বিয়েটা সে খুব করে চাইছে।আরমিনের মতো মেয়েটা পাওয়া এই পরিবারের জন্য খুব জরুরি।
.
কেটে গেছে দুদিন।এই সময়টা প্রত্যকেই প্রত্যকের দৈনন্দিন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।সন্ধ্যার পর সালেহার সাথে কায়িমের চিকিৎসার ব্যপারে আলাপচারিতা হয়েছে জাবিরের।সালেহা যখন জানতে পারলো আগামীকাল কায়িমকে ঢাকা নেওয়া হবে ভালো চিকিৎসার জন্য তখন কৃতজ্ঞতায় ডুবে গেলেন তিনি।জাবিরের পায়ের কাছটায় নুইয়ে কেঁদেকেটে একাকার করেছেন।সেই সময়টায় লজ্জায় মিহিয়ে যাচ্ছিলো জাবির।তিনি তো কিছুই করছেন না সবটা কৃতিত্ব দায়িত্ববান সুহাইল ছেলেটার।ছেলেটা সাহায্যর হাত না বাড়িয়ে দিলে তিনি কখনোই এমন ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ চালাতে পারতেন না।
এশারের নামায আদায় করে সালেহা কোরআন শরীফ পড়ছেন।কায়িম আজ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।সকাল থেকেই নিশ্চুপ মানুষটি খুব একটা নড়াচড়া করার চেষ্টা করেন নি।আগের মতো ধড়ফড়িয়ে উঠার চেষ্টা চালান নি।সারা শরীর জুড়ে তার ঘামছে।কপালে ক্ষণে ক্ষণে সাদৃশ্যমান হচ্ছে চিকন ঘামের।সালেহা বেশ কয়েকবার কায়িমের শরীর মুছে দিলেন ভেজা গামছার সাহায্য।খানিকক্ষণ আগেই আরমিন আরেকবার শরীর মুছে দিয়ে পাশের রুমে পড়তে বসে,সালেহা তখন কায়িমের পাশে টানটান স্বরে কোরআন পড়তে ব্যস্ত।কোরআন পড়ার মাঝ পথেই মশার উপদ্রবে বিরক্ত হয়ে ডাকলেন রিহানাকে,
– রিহানা তোর আব্বার খাটের নিচে একটা মশার কয়েল দিয়ে যা।
সালেহা আবারো কোরআন শরীফ পড়ায় মনোনিবেশ করে।রিহানা এগিয়ে এলো,মশার কয়েল রেখে কায়িমের দিকে তাকাতে কপালটা কুচকে যায়।কায়িমের শরীরটা নিস্তেজ।ঘেমে নেয়ে আবারো একাকার।নিশ্বাসের ফসফস শব্দ নেই।রিহানা তার বাবার নাকের কাছে হাতটা রাখলো।নাহ কোন নিশ্বাস নেই।প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো মেয়েটা।এমন তো আগে হয়নি।
– আম্মা আব্বার নিশ্বাস নাই কেন?
সালেহা তড়িৎ গতিতে তাকালো কায়িমের দিকে।পাশের রুম থেকে আরমিন শুনে ছুটে আসে।নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখে তার বাবার শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন ক্রিয়া বন্ধ।আরমিন লাহমায় ভয় পেয়ে গেলো।যার দরুণে ঘামছে তার শরীর, মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝালো শ্বাস নেই।সালেহা কোরআন বন্ধ করে ছুটে আসে।পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কায়িম যে এই দুনিয়ায় আর নেই তিনি ইতোমধ্যে বুঝে নিয়েছেন।সালেহা স্বামীর বুকে হাত রাখলেন,অতি অল্প সময়েই তার মাথাটা নেতিয়ে যায় কায়িমের বুকে।আরমিন মায়ের কাঁধ ঝাকড়া দিতে বুঝতে পারে তার মা চেতনা হারিয়েছে।আরমিন কি করবে ভেবে পেলো না এই মুহূর্তে নিজেকে সবচেয়ে অসহায় লাগছে।রিহানা বিলাপ দিয়ে কেঁদে উঠলো।আরমিনো তার সাথে কেঁদে উঠলো, “আমার আব্বা আর নাই গো”!দুই বোনের বিলাপে এলাকা বাসি ছুটে আসে।মাতবর বাড়িতেও শোনা গেলো সেই কান্না।জাবির সহ বাড়ির প্রতিটা সদস্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো সালেহার বাড়ি।
_
ভ্যাপসা গরমে ফর্সা মুখখানা রক্তিম হয়ে আছে সুহাইলের।আগামীকাল কায়িমকে আনা হবে সে জন্য আগে ভাগে সব ব্যবস্থা করে রাখছে সে।এদিকে বাবা-মাকে বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ঘুরে আসার জন্য অফার করে দুই ভাই।এটি মূলত তাদের চাল, বারেক,ফারজানা শহরের বাইরে গেলে তাদের কাজ করতে সুবিধা হবে।ফারজানা শোনা মাত্রই রাজি হয়ে যায়।তাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা সুহাইল নিজেই করেছে।সব কাজ শেষে বাড়ি ফিরলো দুই ভাই।দুজনেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত।ফ্রেশ হয়ে সিয়াম সুহাইলের সাথে পরামর্শ করতে রুমে আসে।
– ভাইয়া মানুষের জীবন মরণ আল্লাহর হাতে।কে কখন চলে যায় তার হিসেব নেই।আমি বলছিলাম কি মামা বেঁচে থাকতেই আম্মুকে সবটা বলে দাও।দেখো পরে হয়তো বা কোনো অঘটন ঘটে যাবে।মামার কাছে মাফ চাওয়া দরকার।
সুহাইল নিশ্চুপ ভাবলো।মিহিয়ে এলো তার কন্ঠ,
– আমাদের বাবা মা যা করেছে তার খেসারত না তার সন্তানদের দিতে হয়।পিতা,মাতার পাপ পূণ্য সন্তানের উপরেও প্রভাব ফেলে কোননা কোনো ভাবে।
ফারজানা দু’সন্তানের জন্য লেবুর শরবত করে রুমে ডুকছিলো।তখন সুহাইলের সম্পূর্ণ কথা শুনে সে ঘাবড়ে গেলো।কিসের কথা বলছে সুহাইল।নক না করেই রুমে প্রবেশ করলেন ফারজানা।সন্দিহান চোখে তাকালো সুহাইলের দিকে।
– তোরা কি বলছিলি?তোদের বাবা মা কি করেছে যে তার খেসারত সন্তানদের দিতে হবে?
সুহাইল, সিয়াম দুজনেই চমকে তাকালো।কথার ধারাবাহিকতা পালটে নিলো সুহাইল।
– মা আজ একটা মুভি দেখেছিলাম সেটারি আলোচনা করছিলাম দুজনে।তুমি কষ্ট করে শরবত আনতে গেলে কেন, বাবা কোথায়?
সুহাইল কথার তালে ঘুরিয়ে দিলো বিষয়টা।এভাবে কেটে যায় খানিকটা সময়।উপস্থিত ফারজানার সামনেই কল আসে সুহাইলের।জাবির মাতবর ফোন করেছেন।গুরুত্বপূর্ণ কল বলে বারান্দায় চলে গেলো ছেলেটা,
– বাবা তোমার চাওয়া আল্লাহ পূরণ করলেন না।তোমার মামা সাড়ে নয়টার দিকে ইন্তেকাল করেছেন।
সুহাইল স্থির হয়ে গেলো।ফোনের অপরপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।জাবিরের সাথে দু’চারটা কথা বলে রুমে ফিরে আসে সে।ফারজানার কোলে মুহূর্তে মাথা এলিয়ে দিলো সুহাইল।সে যেন ভীষণ বাজে ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
– আম্মু তোমার ভাইয়ের কথা মনে পড়েনা?একটা মাত্র ভাই তোমার।
সুহাইলের কথায় চমকে গেলেন ফারজানা।এত বছর পর সুহাইলের মুখে তার মামার কথা শুনতে বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন।দু’চোখ লাহমায় ঝাপসা হয়ে এলো।কলিজাটায় যেন ছেদ করে দিয়েছে।
– মনে পড়লেও মনে পড়া বারণ বাবা।এসব কথা তুলিস না তোর আব্বু শুনলে আমার সাথে রাগারাগি করবে।
টপটপ দু’ফোটা চোখের পানি পড়লো ফারজানার চোখ থেকে।সেই পানি পতিত হলো সুহাইলের গালে।
– এতটা স্বার্থপর লো’ভী ছিলে তোমরা।আমার ভাবতে এখনো কষ্ট লাগে ছিহহ।
– আল্লার দোহাই চুপ কর।তোর বাবা শুনতে পাপে।তখন অত শত বুঝতাম না তোর বাবা যেভাবে বলতো সেভাবে চলেছি কিন্তু বছর গড়াতেই বুঝতে পারি আমি ভীষণ অন্যয় করেছি।মায়ের পেটের ভাইয়ের সাথে বেইমানি করেছি।আল্লাহ আমাকে কখনো ক্ষমা করবেনা।তারা এখন কী করছে কোথায় আছে কে জানে।
– মরে গেছে।কিছুক্ষণ আগে মামা মরে গেছে মা।
সুহাইল স্থির কন্ঠে আক্ষেপ স্বরে কথাটা বললো, সিয়াম অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো সুহাইলের দিকে।ফারজানা বুকে চেপে রাখা কষ্ট দমাতে পারলেন না।বিলাপ তুলে কেঁদে উঠলেন তিনি।তার কান্নায় ছুটে আসলেন বারেক খন্দকার।বারেককে দেখে ক্ষিপ্ত হলো ফারজানা এলোপাতাড়ি বারেকের বুকে আ-ঘাত করতে থাকেন।কিল,ঘুষি,থাপ্পড় একে একে লাগায় বারেক নিজেও চমকে গেছে।এখনো পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।সিয়াম দ্রুত এসে ফারজানাকে সরিয়ে নিলো।সুহাইল ঠাই বসে আছে বিছানায়।আশেপাশে মানু্ষগুলোর কোন কার্যকলাপ যেন তার কানে আসছে না।
.
চার দেয়ালের মাঝে থাকা চারটা মানুষের মাঝে চলছে নিস্তব্ধতা।বারেক অবশেষে জানতে পেরেছে কায়িমের মৃত্যুর সংবাদ।এতে কোন হেলদোল নেই তার।পৃথিবী থেকে তার আপন একটা মানুষ বিদায় নিয়েছে তাতে কী যায় আসে,এমন ভাব নিয়ে পড়ে আছেন তিনি।নিস্তব্ধতা বার বার উগড়ে দিচ্ছেন ফারজানা।তার হুহু শব্দে কান্নায় নিরবতার ছেদ ঘটছে।
– ফারজানা যত ইচ্ছা কাঁদো তবে আমার শেষ বক্তব্য তুমি কেশবপুরে যাবেনা।যে মরে গেছে তাকে নিয়ে এত তোষামোদ না করলেও চলবে এর আগেও তোমাদের যোগাযোগ ছিল না এখন….
বারেক কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই গর্জে উঠে সুহাইল বাবার দিকে তেড়ে আসতে সিয়াম তাকে আটকে দেয়।
– বাবা তোমার বিচার বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হচ্ছি।ছিহহ তুমি মানুষ?
– দেখ সুহাইল আবেগ নিয়ে চললে হবে না।এটা বাস্তবতা।এখন যদি আমরা কেশবপুরে যাই তোর মা যদি সবটা বলে দেয় জাবিরের কাছে আমার সম্মানটা মাটিতে মিশে যাবে।তুই তোর বাবার সম্মান ন-ষ্ট হতে দিবি?
বারেকের কথা শুনে গা দুলিয়ে হাসলো সুহাইল।সে যেন মজার কোন গল্প শুনেছে।
– জাবির আংকেল সব জানে বাবা।আমি সবটা বলেছি তোমার আর মায়ের স্বার্থপরতার কথা।
বারেক চমকালো।রোষানলে জ্বলে উঠে লাহমায়।সামনে থাকা দু’টো কাঁচের গ্লাস হাতে তুলে আঁছাড় মা-রলেন মেঝেতে,ক্রুদ্ধ স্বরে কিছু বলতে গেলে সুহাইল হাত উঠিয়ে চুপ করতে ইশারা করে।কাট কাট স্বরে তর্জনির আঙুল তুলে শাসানো ভঙ্গিতে বলে,
– কেশবপুরে সবাই যাবে।একদম সবাই।কেউ যদি যেতে দ্বিমত পোষণ করে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।আর আমি কতটা খারাপ সেটা পুনরায় প্রমান করতে চাই না।
#চলবে