মায়াপ্রপঞ্চ,৩০,৩১

0
553

#মায়াপ্রপঞ্চ,৩০,৩১
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩০]
_________________
অন্ধকার আবদ্ধ রুমটায় উটকো গন্ধে গা গুলিয়ে আসে আমীনার।সিগারেটের ঝাঁঝালো দুঃসহ গন্ধ সারা রুম জুড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।অথচ একটা সময় এই রুমটাই ছিল খোলামেলা সতেজ।অকৃত্রিম আলোয় দিনের বেলা জ্বলজ্বল করতো রুম।আর যেই রুমের এখন বিশ্রি অবস্থা কেউ কী ভাববে এখানে একজন ব্যাক্তির বসবাস!হ্যা গত এক সাপ্তাহ যাবৎ একজন ব্যাক্তি নিজেকে এইভাবেই গুটিয়ে নিয়েছে।দিন-রাতের ফারাক সে জানে না।বিশেষ কারন ছাড়া এই এক সাপ্তাহ রুমের বাইরে যায়নি সে।তার কাছে আলো সিগারেটের জ্বলজ্বল করা অর্ধ পোড়া সেই অংশটুকু।দেয়ালের সাথে উবু হয়ে বসে এখনো সিগারেট টানায় মশগুল সে।আমীনা এগিয়ে এলো হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নিলো মানুষটাকে।

– বাবা পবন?

– কেন এসেছো চাচি?

– ত…তুই এভাবে আর কতদিন চলবি?

– যতদিন ইচ্ছা।আমি তো তোমাদের কাউকেই বিরক্ত করছি না,আরমিনের সাথেও যোগাযোগ ছিন্ন করেছি আমি আমার মতো বেশ ভালো আছি।

আমীনা প্রত্যুত্তর করলো না সিগারেটের গন্ধে ইতোমধ্যে তার সব যেন উগড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে।কোন মতে নাকে শাড়ি পেঁচিয়ে বলে,

– তোর রুমটা পরিষ্কার করে দি?বিশ্রি গন্ধ।

– লাগবে না আমার রুম আমার কাছে ভালো লাগে।তোমার খারাপ লাগলে যাও এখান থেকে।

– তোর বন্ধুরা এসেছে, ভাগ্যিস ভাবীর সাথে দেখা হয়নি না হলে আজ তোর বন্ধুদের ধোলাই দিয়ে ছাড়তো।

আমীনা চুপ রইলো খানিকক্ষণ।পবনের চুলে হাত বুলিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলে,

– ভাবী কোথায় গেছে জানিস?তোর জন্য মেয়ে দেখতে!তুই কী বিয়ে করবি পবন?

– করবো আরমিনকে!

– জেদ করিস না বাবা।যে তোর সে তোরি থাকবে।হাজার বাঁধা বিপত্তির পরেও তোর হবে।এমন তো না তোরা একে অপরকে ভালোবেসেছিস তুই তোর দিক থেকে দূর্বল ছিলি কিন্তু আরমিন তো না।

– তো?আরমিন আমার সামনে দিয়ে চলে যাবে বউ সেজে আমার বাড়ির উপর দিয়ে এটা কি আমি মানতে পারবো?একমাত্র মায়ের কারনে আমি চুপ আছি আর চুপ থাকবো নাহলে এতদিন এই বিয়ের সিদ্ধান্ত আরো আগেই ভেস্তে দিতাম।আম্মা আমার সাথে এমনটা কেন করলো?আরমিন তো খারাপ মেয়ে না আমি তো বলছিনা এখনি বিয়ে হোক তবুও……

– তোর মা বড় ঘর,বংশ প্রতিপত্তি দেখে ছেলের বউ আনবে।সব ভুলে যা বাবা,সে যদি তোর থাকে একটা সময় তোর হবে আর না থাকলে কিছু করার নেই।এভাবে কদিন পা-গ-লামি করবি?একমাস,দুমাস এরপর দেখবি সব ভুলে গেছিস।

– লেকচার দিও না চাচী রুম থেকে যাও।প্রিয় মানুষ হারানোর অবস্থানটায় যে আছে সে বুঝে কতটা তীব্র যন্ত্রণা হাহাকার বাকিরা শত গালগল্প বললেও মন মানে না।

আমীনা প্রত্যুত্তর করলো না।পবনের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরেই রুমে আসে তার দু’বন্ধু।অন্ধকার রুম, পবনের বিচ্ছিন্ন চালচলন দেখে দুজনেই ভড়কে যায়।এটা তো তাদের সেই আগের বন্ধু না।

– পবন।

রিজুর ডাকে ডাঁটিয়াল হাসলো ছেলেটি।সিগারেট জ্বালিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,

– সিমপ্যাথি দেখাতে এসেছিস?নাকি আরমিনকে ভুলে যেতে বলতে এসেছিস?যদি আমার অনুমান ঠিক হয় তবে রুম থেকে যা আর আমাকে একা থাকতে দে।

সায়মন এগিয়ে এসে পবনের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে আ্যাশট্রেতে রাখে।

– পবন আমরাই দোষী।তোকে যদি সেদিন চাপাচাপি না করতাম তাহলে এমনটা হতো না।তুইও স্বীকার করতি না আরমিনকে ভালোবাসিস।সবটাই চাপা থাকতো।

সায়মন পবনের ঘাড়ে হাত দিয়ে মাথা নুইয়ে নেয়।হঠাৎ বাইরে থেকে শোরগোলে চকিত হয় পবন।বাইরে থেকে আরমিনের কন্ঠ কানে আসছে তার।জানালাটা খানিকটা ফাঁক করতে দেখতে পেলো প্লাবনের সাথে কি নিয়ে তর্ক করছে আরমিন।খানিকক্ষণ বাদেই প্লাবনকে জোরজবরদস্তি করে পেয়ারা গাছে উঠতে তোষামোদ করে।আরমিনের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে প্লাবন গাছে উঠে তাতেই হইহই করে উঠে মণিরা,প্রমা সহ এলাকার কয়েকটা ছেলেমেয়ে।পবন তৃষ্ণার্ত চোখে চাইলো আরমিনকে।পবনের মুখের দিকে নির্বাক চেয়ে আছে রিজু,সায়মন।ছেলেটার চেহারা বেশ পালটে গেছে যাকে বলে বিধস্ত অবস্থা।তিরতির পবনের ঠোঁট কাপছে,বাম হাত চুলের কাছটায় নিয়ে মাথার চুল চেপে ধরে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে।মেঝেতে বসে দেয়ালের সাথে গড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠে আচম্বিতে।সায়মন, রিজু তাজ্জব বনে তাকিয়ে আছে।যেন কোন বাচ্চা কাঁদছে হামাগুড়ি দিয়ে।

– এই পবন পাগলামি করিস না ভাই।তুই এত ভেঙ্গে পড়িস না।

রিজুর কথায় কান দিলো না ছেলেটা।রিজুর কাঁধে মাথা গুজে ফ্যাচফ্যাচ শব্দে কাঁদতে থাকে।এভাবে জীবনের একটা পর্যায়ে নিজের বিবেক বুদ্ধি লোপ পাবে সে কল্পনায়ো ভাবেনি।

বন্ধুর চোখের পানি ভেতরটা নাড়িয়ে তুললো সায়মনকে।জানালার কাছটায় এসে কিড়মিড়িয়ে দেখে নিলো আরমিনকে।রোষানলে জ্বলছে বুকের ভেতরটা।সায়মন এগিয়ে এসে পবনের কাঁধে হাত চাপড়ে বলে,

– দোস্ত তুই শুধু একবার বল আরমিনকে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে নিয়ে আসবো।তোদের বিয়ে আমরা সব বন্ধুরা মিলে দিবো।

পবন ঠাট্টার স্বরে হেসে উঠলো।গা দুলিয়ে বসলো দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে।চোখের পানি বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে শক্ত কন্ঠে বলে,

– বেঁচে থাকতে এসব কথা আর ভাবিস না।আমার মায়ের কসম আছে।আমি চাইনা মায়ের অবাধ্য হতে।

সায়মন নিশ্চুপ তাকালো রিজুর দিকে।রিজুও জেদের মুখে বিশ্রি কয়েকটা গা-লি দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে।পবন উঠে দাঁড়ায়।আবারো সিগারেট জ্বালাতে নিলে রিজু ঝটপট হাত থেকে নিয়ে নেয় সিগারেট।

– এখন কি করবি?এভাবে তোর দিন তো জেতে পারে না।অন্তত আমরা তোকে এমন থাকতে দিবো না।

রিজুর কথায় মিহি হাসলো পবন।ধরা গলায় বলে,

– আমার স্বপ্নেরা কত সুন্দর ছিল কিন্তু এখন সবটা ধোয়াশায় ঘেরা।
_

সন্ধ্যায় বই খুলে বসে আছে আরমিন।বিয়ের চিন্তায় পড়াশোনা মোটেও হচ্ছে না তার।ইদানীং পবনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না আমীনা বললো ছেলেটা নাকি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।বিষয়টা আদতে সত্য কি না জানা নেই আরমিনের।আগামীকাল শেষ পরিক্ষা এরপরেই এক সাপ্তাহ পর সুহাইলের সঙ্গে তার বিয়ে।নতুন মানুষ,নতুন পরিবেশের সঙ্গে কি করে থাকবে সে ভাবতেই দম বন্ধ লাগে।এই বিয়ে নিয়ে সালেহার কোন হেলদোল নেই।তিনি তার মতো ব্যস্ত।রিহানা ছুটে এলো আরমিনের কাছে।ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বিরক্ত নিয়ে বলে,

– কতক্ষণ থেকে ফোন বাজে ধরো না কেন?

– কে করেছে?

– দুলাভাই হিহিহি!।

রিহানা ছুটে পালায়।আরমিনের সামনে পড়লে নির্ঘাত দু’চারটা চ-ড় পড়বে তার গালে।

– হ্যালো।

– পড়ছিলে?বিরক্ত করার জন্য স্যরি।

– কি বলবেন বলুন।

– শপিং করতে এসেছি। তুমি বিয়েতে কি পড়বে শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা?

আরমিন স্তব্দ হয়ে গেলো।বিয়ে নিয়ে তার কোন ফিলিংস নেই।নেই কোন আশা আকাঙ্খা।তার কাছে সবটাই পাংশুটে লাগছে।

– আমার কোন ইচ্ছা নাই।আপনাদের যা ভালো লাগে তা কিনেনিন।

– এভাবে বলছো কেন?বিয়েতো দু’বার করছো না একবারি করবে তাহলে কী মনমতো সাজা উচিত নয়?

– দেখুন আপনাদের যা ভালো লাগে তা নিন।আমাকে এত প্রশ্ন করবেন না।

সুহাইল খিটখিটিয়ে হেসে উঠলো।আরমিন এতে আরো অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।

– ঠিক আছে সাজবে তো আমার জন্য আমি না হয় আমার পছন্দের সব সাজপোশাক কিনে নিবো।
.
পরের দিন রাত বারোটার কাছাকাছি।পরিক্ষার কারনে বেশ দখল গেছে আরমিনের উপর তাই আজ বেশ তাড়াতাড়ি ঘুমের প্রস্তুতি নিলো সে।এতদিন রাত জেগে পড়াটা শেষ করতো সে।সালেহার আচার ব্যবহার ইদানীং তার কাছে বড্ড অদ্ভুত লাগে কিছু একটা যেন লুকাচ্ছেন তিনি।আরমিন ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই তড়িঘড়ি করে রুমে ডুকলো সালেহা।

– তোর ফোন কই?

– এই তো আম্মা।

আরমিন ফোন এগিয়ে দিলো।সালেহা দ্রুত ফোনটা নিয়ে আরমিনের দিকে একটা প্যাকেট ছুড়ে দেয়।

– এটা কি?

– এখানে একটা শাড়ি আছে দ্রুত তৈরি হয়ে নে।

– কেন আম্মা?

– তোর বিয়ে।বাজারের ফার্মেসী দোকানির ছেলে মকবুল, তার সঙ্গেই বিয়ে হবে কিছুক্ষণ পর।আর খবরদার সুহাইল যেন কিছু না যানে।

আরমিনের গা শিউরে উঠে।সালেহা এমন দুঃসাহস কল্পনায়ো ভাবেনি সে।সুহাইল যদি যানে তবে রণক্ষেত্র তৈরি হবে।মকবুলেরো সাহস কম নয় সেদিন ভরা বাজারে সুহাইলের হাতে বেদম মা-র খেয়ে আরমিনকে নাচতে নাচতে বিয়ে কর‍তে চলে এলো বাহ!

– তুমি তাদের কথা দিয়েছিলে আম্মা।এসব কি বলছো।আর মকবুল ছেলেটা ভালো নয় গত বছর তার আগের বউ নির্যাতনে মা-রা গেছে।সে যে বউ পিটায় এটা পুরো কেশবপুর জানে।তুমি…..

– চুপ!কথা কম বলবি।আগে যা করছে সেটা ভুলে করছে এখন আর করবো না।তাছাড়া বউ যে ভালো ছিল তার প্রমান কি?সেই মাইয়ারো দোষ থাকতে পারে।

– আমি বিয়ে করবো না।

– তাইলে তোর বাপরে যেমনে মাটি দিয়া আইসত আমারেও মাটি দিয়া আসিস।

সালেহা দাঁত কিড়মিড়িয়ে কথাটি বলে তাকায়।আরমিন এবার কেঁদেই দিলো।

– পারো তো এসবি বলতে।এসব বলেই তো দমন করছো।আমি জাবির আংকেলকে বলে দিবো।

সালেহা কালবিলম্ব করলো না শব্দ করে বসিয়ে দিলো আরমিনের গালে এক ঘা।রাগে শরীর কাঁপছে তার।সুহাইলের সাথে কিছুতেই বিয়ে দিবেন না তিনি।এতে যেন তিনি হেরে যাবেন চিরতরে।

– শাড়ি পরতে বলছি পর।আজ রাতে বিয়ে হলে মকবুল তোরে নিয়া খুলনা চলে যাবে সেখানে তার খালার বাড়ি।যদি আমার কথা না শুনস তাহলে আমি কি করবো তুই জানস।

আরমিনের এবার সবচেয়ে অসহায় লাগলো নিজেকে।সব পরিস্থিতির শিকার তাকেই কেন হতে হবে।জেদের তাড়নায় তার মা যে জীবনটা ধংস করে দিচ্ছে সেটা সে বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে তবুও অবুজের মতো চেয়ে রইলো।

#চলবে…

#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩১]
_______________
পরনে লাল শাড়ির আঁচলটা খামচে বসে আছে আরমিন।তার পাশে বসে আছে দু’জন বয়স্কা মহিলা।পাশের রুম থেকে শোনা যাচ্ছে ফিসফিসিয়ে বলা কয়েকজন পুরুষের কন্ঠ।আরমিন ভয়ে জমে গেলো পাশে বসে থাকা মহিলা গুলো প্রচন্ড খুঁত স্বভাবের।তারা যেন বাজারে কাপড় কিনতে এসেছে,আরমিনের হাতে পুড়ে যাওয়া দাগটা দেখে ইশারা ইঙ্গিতে নানান ভাবে মন্তব্য কর‍তে বসে যায়।তার সাথে আরমিনকে নিয়ে বহুবিধ খোটা তো আছেই।আরমিন তাদের মাঝে অচলের মতো পড়ে আছে।কী বলবে কী করবে বুঝে আসলো না তার।সালেহা ছোটাছুটি করে সবটা ব্যবস্থা করছে রিহানা একপাশে নির্বাক ভঙ্গিয়ে চোখের জল ফেলছে।বিয়েটা নিয়ে বিন্দুমাত্র খুশি নয় সে।আরমিন মেয়েটার দিকে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো,দু বোনের চোখাচোখি হতে রিহানা আরমিনকে হাত দিয়ে ইশারায় বলে স্থির থাকতে।এছাড়াও কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে আরমিন বুঝতে পারলো না মেয়েটা কি বলছে।

মকবুলের বাবা তাড়া দেখালো দ্রুত বিয়ের কাজ সারতে।আরমিনের ভয়টা বেড়ে গেলো এমন পরিবারের মানুষের সাথে কি করে বাকিটা জীবন কাটাবে,ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তার।তাদের কার্যক্রমের মাঝেই দরজায় ‘ঠকঠক’ শব্দ হয়।সালেহা ভয় পেয়ে গেলো কে এসেছে এই মুহূর্তে।দ্বিতীয়বার শব্দ হতে সালেহা ভয় নিয়ে দরজা খোলে।দরজার অপরপাশে দাঁড়িয়ে আছে জাবির,আছিম।

– আপনারা?

– কাজটাকি ভালো করেছো সালেহা?এই আমাকে ভাই মানো,এই আমাকে ভরসা করো?

সালেহা থতমত খেয়ে গেলো।জাবিরকে দেখে বাকি সবাই ঘাবড়ে যায়।সবারি মুখ বন্ধ।আছিম ভেতরের রুমে ডুকে আরমিনকে খুঁজতে থাকে এবং পেয়েও যায়।

– তুই এই বিয়েতে মত দিয়েছিস আরমিন?

আছিমের কথায় ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠে আরমিন।পরিবেশটা পর্যবেক্ষণ করে আছিম বেরিয়ে যায় রুম থেকে।জাবির তখন মকবুলের পরিবারের সাথে বাক্যালাপে ব্যস্ত।

– আপনারা জানেন এই মেয়েটার বিয়ে ঠিক?তাহলে কেন বিয়ে করতে এলেন?

– ক…কই আমরা তো এসব কিছু যানি না।

মকবুলের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে সালেহার দিকে তাকায় জাবির।

– সালেহা তুই আমাকে অপদস্ত করতে এসব আয়োজন করেছিস?

– ন… না ভাইজান।

– তাহলে?আমি যখন বিয়ের কথা তুলেছিলাম তখন তোর সম্পূর্ণ মতামত ছিল।

সালেহা প্রত্যুত্তর করলো না।লজ্জায় নুইয়ে রাখলো মাথাটা।জাবির হতাশার শ্বাস ছেড়ে বলে,

– সুহাইল এই জন্যই সন্দেহ করছিলো তোকে।তোর কি ধারনা সুহাইল এমনি এমনি ঢাকায় ফিরেছে?যাওয়ার আগে আমাকে বার বার বলে গেছে তোর দিকে নজর রাখতে।তার বন্ধু মাফী সর্বোপায়ে তোর খোঁজ নিয়েছে।মাফী যদি খবর না পেতো তাহলে আমরা কেউ জানতামি না তুই এমন একটা কাজ করছিলি।

জাবির৷ চুপ হলেন, তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কতটা রেগে আছেন।আছিম সালেহার পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য সুরে বলে,

– মকবুলের মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন? বাহ আপা বাহ!তার আগের বউয়ের কথা কি বেমালুম ভুলে বসে আছেন?

সালেহা প্রত্যুত্ত করলো না।মাথা গুজে কাঁদতে থাকলো।মকবুলের পরিবারের সাথে ইতোমধ্যে তার তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পরেই নাহার বেগম উপস্থিত হয়।জাবির সবাইকে চুপ থাকতে বলে আছিমকে নির্দেশ করে সুহাইলকে ফোন করতে।

– ভাইজান আর আঁধা ঘন্টা লাগবো।সুহাইলরা সিএনজিতে।

আছিমের কথাটা আরমিনের কানেও গেলো।ফলে তার ভয় আরো দু’গুন বাড়লো।এখন কি হবে,নিশ্চই সুহাইল এসে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে।
.
কাঙ্ক্ষিত সময় অবশেষে এসেই পড়লো।বাড়িতে উপস্থিত হয়,সুহাইল সিয়াম এবং তার বাবা মা।সবাই ভেবেছিলো তারা আসলে হয়তো রেষারেষি হবে কিন্তু না তারা সবাই ছিল স্থির।চুপচাপ সবাই যে যার স্থানে বসে পড়লো।সুহাইল ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা।গায়ে থাকা অফ হোয়াইট শার্টটা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে তার গায়ে।জুলফি বেয়ে দরদর নেমে যাচ্ছে ঘাম।সুহাইল মুরব্বিদের পাশ কাটিয়ে মকবুলের পাশে বসলো।মকবুল তাকে দেখেই ক্রুদ্ধ হয়।সেদিনের বেদম মা-রের কথা কিঞ্চিৎ পরিমানেও ভুলেনি সে।

– সেদিনের মারের কথা কি ভুলে গেছিস?কাজি নিয়ে আবার আরমিনকে বিয়ে করতে চলে এসেছিস?তোর তারিফ করতে হয়।

– যদি তোর আর আরমিনের বিয়ে হয় তবে আমার সাথে বিয়ে ঠিক করলো কেন গোপনে?

– সেসব আমার জানার বিষয় নয়।বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখানে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।তোর অতীত কী আমি জানি না ভেবেছিস?সবটা খুঁটিয়ে দেবো।

মকবুল ভয়ে স্থির হয়ে যায়।তার বাবা তাকে ইশারা করে চুপ থাকতে।ফারজানা নতুন শাড়ি নিয়ে চলে যায় আরমিনের কাছে।তোড়জোড় যতটুকু পেরেছে সাজিয়ে নেয়।আরমিনের সবটাই ঘোরের মধ্যে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে,অবশেষে তাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।
_
ভোরের আলো ফুটেছে।পাখিদের কলতনে মুখোরিত পরিবেশ।ঘুটঘুটে অন্ধকার চার দেয়ালের রুমটার জানলার কাচ গলিয়ে এক ফালি আলোর আভাস ছড়িয়ে আছে।বেশ কয়েকদিন নাওয়া-খাওয়া বাদ দেওয়ায় শরীরে এক রতি শক্তি নেই ছেলেটির।গা গুলিয়ে বারবার উগলে আসছে সব।তবুও নিজের জেদ-হতাশার কাছে অনড় সে।মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসলো পবন।আর মাত্র ছয়দিন বাকি আছে আরমিনের বিয়ের।তারপরেই অন্যর ঘরে বসত হবে তার।যেটা পাবে না সেটা নিয়েই দুনিয়ার মানুষের হতাশা,আকাঙ্খা যেন বহুগুন বেশি।অন্যর বিরহে নিজেকে অতলে ডুবিয়ে নিতে বেশি সুখ পায়!কিছু স্মৃতি রোমন্থনে বারবার মিহি হাসে সে,কিছু স্মৃতি রোমন্থনে গুমরে কেঁদে উঠে।এভাবেই যাচ্ছে দিন কাল।বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।শরীরটা ভীষণ ম্যাজম্যাজ করছে,পেটের ভেতরটা মরু উদ্যানের ন্যায় খা খা করছে।দ্বারের কড়া ঘাতের শব্দে চমকে যায় পবন।কেউ যেন দ্বারটা ভেঙ্গেই ফেলবে।পবন বিরক্ত হলো হেলেদুলে এগিয়ে দ্বারটা খুলে দিলো।রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রমা, মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে।

– কি চাই তোর এখানে?

– আরমিন আপুকে নিয়ে যাচ্ছে ভাইয়া তুমি চলো।

– নিয়ে যাচ্ছে মানে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

– মাঝ রাতেই নাকি সুহাইল ভাইয়ার সাথে বিয়েটা হয়ে যায় এখন তারা চলে যাবে। আরমিন আপু আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে।তুমি আসো আমি গেলাম।

প্রমার কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো পবনের।আরমিনের বিয়ে হয়েছে তাও মাঝরাতে।ভেজা মুখ না মুছেই পবন ছুটে নিচে চলে যায়।উঠনে আরমিন মণিরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে,আশেপাশে রিহানা,প্লাবন,প্রমার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।মেয়েটার গায়ে মেরুন রঙের হালকা কাজের শাড়ি।পবন স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে আছে।কি অপরূপ লাগছে মেয়েটাকে!সুহাইলকে পাশে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরটা মুষড়ে উঠলো তার।যন্ত্রণা আরো বহু গুন বেড়ে গেছে।এক প্রকার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার।

– পবন ভাই?

ডাকটা পবনের কানে এলেও নিজেকে এখনো সম্পূর্ণ রূপে স্বাভাবিক করতে পারলো না সে।আরমিন এগিয়ে এলো তার দিকে।মেয়েটা কাঁদছে তার কান্নাতেও যেন মুগ্ধ হচ্ছে পবন।মেয়েটা কার জন্য কাঁদছে?পবনের জন্য?এই ব্যর্থ অব্যক্ত প্রেমিকের জন্য?যৎসামান্য এই মানুষটার জন্য।

– পবন ভাই তুমি আমার বিয়েতে ছিলে না কেন?

পবন উত্তর দিতে পারলো না কি উত্তর দিবে সে!সে তো জানতেই পারলো না আরমিনের বিয়ে।মাঝ রাতে নিজেকে সিগারেটের ধোঁয়ায় মত্ত রেখেছিলো কে যানতো সেই রাতেই চিরতরে পর হয়ে যাবে আরমিন।অধিকার হারিয়ে ফেলবে এক নিমিষে।

আরমিন এবার ভয়ংকর কাজ করে বসলো,অবশ্য পবনের কাছে ভয়ংকর নয় এটি দুঃসাহস কাজ বলা চলে।আরমিনের কান্নার গতি দি’গুন বাড়তেই পবনকে জড়িয়ে ধরে।পবনের বুকে মাথা রেখে বুক ভাসিয়ে কাঁদে।সমাজের কাছে তখন বিষয়টি কটূক্তি হলেও আরমিনের কিছু যায় আসে না।এই ব্যাক্তি তাকে আগলে রেখেছিলো আদরে, যত্নে,ঝগড়ার মাঝে হলেও ভুল থেকে সংশোধন দিয়েছে।বিদায়কালে এই ব্যাক্তিকে ধরে কাঁদাই যায়।পবন আরমিনকে ধরলো না এই অধিকার তার নেই।যদি একবার ধরতে পারে তবে তারি হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন।শত বাঁধাতেও সে ছাড়তে পারবেনা।

নাহার বেগম এগিয়ে এলেন কথার ছলে আরমিনকে সরিয়ে দিলেন পবনের কাছ থেকে।ততক্ষণে একটা গাড়িতে বারেক,ফারজানা উঠে বসে।অন্য গাড়িয়ে আরমিনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো সুহাইল। আরমিন গাড়িতে বসতে সুহাইল উঠে বসে।সামনে সিয়াম।সকলকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি তার আপন গন্তব্য ছুটে চলে।আজকের দিন কারো পূর্ণতার কারো অপূর্ণতার,যার রেশ সারাজীবন ব্যাপি বহমান।কখনো হাসতে,কাঁদতে,উল্লাসে মেতে থাকতেও মনে পড়ে যাবে আমার একজন ভীষণ প্রিয় মানুষ ছিল যাকে আমি আমার করে পাইনি।

গলির মাঝ রাস্তায় সবাই আরমিনের বিয়ে সম্পর্কে আলোচনা করছিলো।সালেহা কাঁদতে কাঁদতে নাহার বেগমের ঘাড়ে মাথা ফেলে দিয়েছে।রিহানা চুপচাপ চোখের জল ফেলছে।সকলেই যখন নিজ কার্যকলাপে ব্যস্ত তখন বিকট শব্দে ঘুরে তাকায়।লোহার বিশাল দ্বারে মাথা ঘুরে ছিটকে পড়ে আছে পবন।ক্ষয়িত লোহার ধারালো অংশ লেগে কপালের খানিকটা অংশে ছিদ্র হয়ে কেটে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে।পবন ঝাপসা চোখে চেয়ে আছে গলির শেষ প্রান্তে থাকা গাড়িটার দিকে।মায়ার ব্যাকুলতা কাটিয়ে মেয়েটা চললো নতুন গন্তব্য,নতুন ঠিকানায়।
#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here