#মায়াপ্রপঞ্চ,৩৮,৩৯
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩৮]
________________
– আমার ছুটিটা শেষ হয়ে এসেছে সুহাইল।আমাদের যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।
মাফীর কথা শুনে আড় চোখে তাকালো সুহাইল।এক সাপ্তাহ ঘোরাঘুরির প্লানিং করে মাত্র দুইদিন হতেই বাড়ি ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছেলেটা।এমন তো কথা ছিলো না নিশ্চই কোন ঘাবলা আছে।
– আমরা তো হাতে এক সাপ্তার টাইম এনেছিলাম তবে?
– আগামী সাপ্তাহে কাজিনের বিয়ে ঠিক তাই সেখানে যেতে হবে এরপরেই আমাকে ব্যাক করতে হবে কানাডায়।
– ওকে।
ঘোমড়া মুখে সম্মোতি দিলো সুহাইল।সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে একটি টেবিল দখল করে বসে আছে তারা।সামনে কফি মগ,টুকটাক কিছু স্ন্যাকস অর্ডার করেছিলো মাফী।রাতের আকাশটা একদম পরিষ্কার।শান্ত আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করছে তারা’রা।মাফী এবং সুহাওল আলোচনা করছিলো কাল কোথায় যাবে।রাত্রি বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে,
– এটা অন্যয় হচ্ছে আমার সাথে, বলেছিলাম সামুদ্রিক মাছ খাবো কিন্তু কেউ আমার কথায় পাত্তা দিলো না।
– যাবো আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো শরীর ক্লান্ত লাগছে আমার।
মাফীর কথায় হতাশার শ্বাস ছাড়ে রাত্রি।মন তো তার এখানে নেই মন তার সমুদ্রের পাড়ে।
_
সাগরকন্যা কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের পছন্দের খাদ্য তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাছের বারবিকিউ, ফ্রাই ও কাঁকড়া। সন্ধ্যা নামলেই সৈকতের দুইপাশের দোকানগুলোতে বিভিন্ন মাছের স্বাদ নেওয়ার জন্য পর্যটকদের ভিড় বাড়তে থাকে।সামুদ্রিক তাজা মাছ পাওয়া যায় বলে সবারি আগ্রহ থাকে বহুগুন
রিসোর্ট থেকে হেটে হেটে সমুদ্রের সামনে উপস্থিত হয় তারা।আকাশের বুকে চাঁদটা জ্বল জ্বল আলো ছড়িয়ে দিয়েছে নিঃস্বার্থ স্নেহময় রূপে।সমুদ্রের শনশন হাওয়া গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছে ঠান্ডার আভাস।সোডিয়ামের আলোতে মার্কেটের পরিবেশটা বেশ ভালো ভাবেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।তারা এগিয়ে গেলো একটি মাছের দোকানে।জ্যান্ত কাঁকড়া দেখে আরমিন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
– সুহাইল আমি কাঁকড়া খাবো।এর আগে খাওয়ার কখনো সুযোগ হয়নি।
– অবশ্যই নিবো।আর কি কি মাছ খাবে?
– পরিচিত কোরাল আর চিংড়ি ছাড়া একটা মাছেরো নাম জানি না আমি।
সুহাইল মিহি হাসলো আরমিনকে ঘুরে ঘুরে প্রতিটা দোকানের মাছের নাম বলতে থাকে।
– এই যে লেজ চিকন মাছটা দেখছো এটা টুনা মাছ।পাশে ছাই রঙা সাদাটা স্কুইড,আর বৃহৎ শাপলা পাতার মতো যে মাছটা তার নাম শাপলা মাছ।আর তারার মতো খানিকটা দেখতে মাছটার নাম অক্টোপাস।এই তুমি অক্টোপাস খাবে?
– দেখতেই কেমন জানি খেতে কেমন হবে?
আরমিন নাক ছিটকালো সুহাইল হাসলো। মাফীকে ইশারা করলো ফ্রাই করার জন্য মাছ অর্ডার করতে তারা গিয়ে বসে পাশে থাকা টেবিলে।
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তাদের কাঁকড়া ভাজি দিয়ে গেছে পনেরো/ষোল বছর বয়সি একটা ছেলে।চার জনেরি খাওয়ার খাওয়া শুরু।তার মাঝে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ রাত্রি এবং আরমিনের।
– কাঁকড়ার স্বাদ তো পুরাই চিংড়ি মাছের স্বাদ।
আরমিনের প্রশ্নে মাথা নাড়ালো সুহাইল।
– হুম একই ধাঁচের স্বাদ।দেশের বাইরে এগুলো আমাদের খাওয়া হয়।সেখানে এসব এভেইলেবল।
একে একে তাদের অর্ডার করা,কোরাল,টুনা মাছের বারবিকিউ,এবং অক্টোপাস, স্কুইড মাছের ফ্রাই নিয়ে আসে ছেলেটি।তবে সবচেয়ে বেশি অক্টোপাস খেতে গিয়ে হিমশিমে পড়লো আরমিন এবং রাত্রি।রাবারের মতো খেতে এই অক্টোপাস তাদের কাছে বড্ড বিদঘুটে লেগেছে।সুহাইল এবং মাফী তাদের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে।সুহাইলের নিশ্চিন্তে খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে ভ্রু কুচকালো আরমিন।
– আপনি কি করে খাচ্ছেন?আপনার গা গোলাচ্ছে না?
– আমার অভ্যাস আছে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে তারা এগিয়ে যায় বিচের পাড়ে মার্কেটের কাছে।খোলামেলা মার্কেটে প্রবেশ করতে আরমিনের মনে হয়েছে তারা যেন মেলায় ঘুরতে এসেছে।আশেপাশে হরেক রকমের দ্রব্য সামগ্রী বিকিকিনি করছে।সুহাইল একটি দোকান থেকে বড় একটি ক্যাপ নিয়ে আরমিনের মাথায় পড়িয়ে দেয়।ফ্লোরাল বেবি পিংক রঙের ক্যাপটি পড়ে মেয়েটা যখন উচ্ছ্বাসিত হাসছিলো সুহাইল বুকের বা পাশে হাত রেখে স্বগোতক্তি সুরে বলে,
– আমার দুনিয়া থমকে গেলো।
সুহাইলের কথায় খিলখিলিয়ে হাসলো আরমিন।এরপর তারা পছন্দ মতো, আচার,চকলেট,কিছু জুয়েলারি ক্রয় করে।একটি শামুকের দোকানে এসে পা থেমে যায় আরমিনের।সাদা,ব্রাউন রঙ সহ বিভিন্ন রকমের শামুক,ঝিনুক,শঙখ বিক্রি হচ্ছে দোকানটায়।
– সুহাইল আমাকে ঝিনুক কিনে দিন।
– যত ইচ্ছা নাও।
– আপনার বোধহয় টাকা কাড়ি কাড়ি যে দোকানে যাই সেখানেই বলেন,যা ইচ্ছা নাও,যা ইচ্ছে নাও।
– আল্লাহর রহমতে তোমার এই ছোট খাটো শখ পূরণ করতে আমার টাকার ঘাটতি হবে না।
আরমিন প্রসন্ন হাসলো।বড় একটি শঙখর ন্যায় ঝিনুক কিনে নেয়।ঝকঝকে সাদা ঝিনুকটি দেখতে সত্যি মুগ্ধকর।আরমিন বড় একটি শামুকে তাদের দুজনের নাম লেখায়।
– এই শামুকটা সারাজীবন আমি নিজের কাছে রেখে দিবো সুহাইল।
– পুরো আমিটাকেই রেখে দিও।
.
রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি রিসোর্টে ফিরে আসে তারা।রিসোর্টের মুখে ডুকতেই কানে আসে গিটারের মধুর সুর।
– বারবিকিউ পার্টি হচ্ছে বোধহয় চল আমরাও যোগদান করি।
মাফীর কথায় দ্বিমত পোষণ করলো সুহাইল,
– পেট লোড হয়ে আছে ভাই।রুমে চল।
– খেতে হবে না আয় গান শুনবো।ভার্সিটির ছেলেগুলো আসার পর থেকেই রিসোর্ট জমজমাট হয়ে উঠেছে।
আজ সকালেই এক দল বন্ধু সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টে উঠে।তারা আসার পর থেকেই হইহুল্লোড়ে মেতে রেখেছে পরিবেশ।তারা সবাই মিলে বারবিকিউ পার্টি করছে তাদের সাথে সামিল হয় চারজন।ছেলেগুলো সুহাইলদের দেখে এগিয়ে আসে।
– আরে ভাইয়ারা যে ভাবীদের নিয়ে এসেছেন আমরা ধন্য!আসুন আমাদের সাথে যোগদান করুন চিকেন বারবিকিউ হচ্ছে।রাতের খাবারটা কিন্তু আমাদের সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হবে না শুনবো না।
– নানা আমরা কিছু খাবো না।তোমরা গান করছিলে শুনলাম তাই এলাম।
ছেলেগুলো মিহি হাসলো।দলের ভেতরে থাকা সবচেয়ে চিকন, পাতলা গড়নের ছেলেটির হাতে গিটার।আরমিন সহ বাকিরা মোড়ায় বসলো।সামনেই আগুন জ্বলছে।বারবিকিউর সুভাস ছড়িয়ে যাচ্ছে পরিবেশে।
– আপনারা ভালোবেসে বিয়ে করেছেন?
দলের মাঝে একটি ছেলের প্রশ্নে মাফী এবং রাত্রি মাথা নাড়ায়।আরমিন এবং সুহাইল তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দ্বিধাদ্বন্দে।কী বলবে তারা?
– আর আপনাদের?
ছেলেটির প্রশ্নে মিহি হাসলো সুহাইল।মাথা চুলকে লাজুক ভঙ্গিতে বলে,
– ওয়ান সাইড লাভ ব্রো।সে আমায় পাত্তা দেয় না।
– পাত্তা না দিলে বিয়ে হলো কি করে?ইন্টারেস্টিং!
– ওই যে পাওয়ার ইন লাভ।একটু জোর খাটিয়ে মধ্যে রাতে দু’পক্ষের পরিবার সাক্ষি রেখে বিয়ে সেরে একদিন পরেই কুয়াকাটা হাজির।
সুহাইলের কথায় হইহই করে উঠলো বন্ধুরা।”কেয়া বাত হে” “সাব্বাশ ভালোবাসার জয় হোক” প্রত্যকের সংলাপে লজ্জায় মিহিয়ে গেলো আরমিন।সুহাইলকে কনুইর সাহায্য ধাক্কা দিয়ে দাঁতে,দাঁত চেপে বলে,”কী হচ্ছে কী?”সুহাইল প্রত্যুত্তর করলো না।শুধু হাসলো।
– ভাবীর মুখ দেখেন ভাই লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছে।সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভাবীর মনেও অনুভূতির ঢেউ খেলে যাচ্ছে।নব বিবাহিত দম্পত্তিদের জন্য তবে একটা গান হয়ে যাক?
– হয়ে যাক!
কথাটি সবাই একসঙ্গে তাল মেলালো।সবার কথার মাঝেই সুহাইল আরমিনের হাতটা আলতো ভাবে আঁকড়ে ধরে
“এখন অনেক রাত,
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়।
ছুঁয়ে দিলে হাত,
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায় (x2)
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি,
পাখার ব্লেডের তালে সোজাসুজি কথা বলি।
আমি ভাবতে পারি নি,
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ
আমি থামতে পারি নি,
তোমার গালে নরম দুঃখ
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ।
_
– আমার মনটা এত বেহায়া কেন চাচী বলতে পারো?এত মার খেলাম তাও ঘুরে ফিরে আরমিনকেই ভাবছি।একটুও ঘৃণা কেন আসছে না তার প্রতি?
– কারন তুই যে ভুলতে চেষ্টা করিস না।
– মুখস্ত সত্তাকে কি করে ভোলা যায়?
আমীনা প্রত্যুত্তর করলো না।হাতে থাকা স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ স্যুপ এগিয়ে দিলো তার দিকে।
– চাচী সত্যি করে বলতো আরমিনের সাথে আমার বিয়ের বাদ সাধলো কে?আব্বা নাকি আম্মা?
– আর কয়বার বলবো তোকে?তোর আব্বাতো চেয়েছিলো কিন্তু তোর আম্মাই মানলো না।জানিস রাতে ভাইজান সে কি কান্না!আমি তো ভয় পেয়েছি অতিরিক্ত চাপে আবার স্টোক করে না বসে।তবে সালহা ভাবীর সাথে এভাবে কথা বলা তোর উচিত হয় নি।
– আমি তো জানতাম না সালেহা আন্টি মকবুলের সাথে বিয়ের এত নাটক সাজিয়েছেন জানলে এমনটা করতাম না।ক্ষমা তো চেয়েছি। কেউ তো কিছু সাফার করছে না করছি আমি।শারীরিক এবং মানসিক দু’দিকেই সাফার করছি।আমি আমার আম্মাকে কোন দিন ক্ষমা করবো না।তিনি তার ইগো দেখাতে গিয়ে….
পবন এবার কেঁদেই ফেললো।বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কামড়ে কান্না দমন করছে।
আমীনা নিশ্চুপ রইলো মনে মনে অস্থিরতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার মাঝে।তিনি খুব করে চাইছে পবনের জীবনে এমন কেউ আসুক যে কী না ছেলেটার সকল দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।
.
নাহার বেগম চুপসে আছেন।জাবির খুব একটা তার সাথে কথা বলছে না বিষয়টা তিনি বেশ ভালো ভাবেই লক্ষ্য করেছেন।একদিকে ছেলের শোক অন্য দিকে স্বামীর অভিমানে তিনি ভেঙ্গে পড়েছেন মারাত্মক ভাবে।নাহার বেগম ছাদে উঠে এগিয়ে গেলো জাবিরের কাছে।জাবির কবুতরকে গম ছুড়ে দিচ্ছিলো তখন।
– পবনের আব্বা শুনছেন?
– হু।
– আমি বোধহয় ভুল করেছি?মস্ত বড় ভুল তাই না?নাম,খ্যাতি দিয়ে কি হবে যদি সন্তানি ভালো না থাকে!
– এখন বুঝে কাজ নেই।এখন যে তুমি বুঝতে পেরেছো অনুশোচনায় ভুগছো বিষয়টা আমার কাছে নাটক লাগছে।তোমার চোখের জলের দাম দিতে পারছি না দুঃখিত।আমার সামনে থেকে চলে যাও।
নাহার বেগম ভড়কালো,চমকালো।বিয়ের এত বছরেও কোন দিন দুটো শক্ত কথা শুনায়নি তাকে জাবির।আর আজ এমন অনাদৃত ভাব, সত্যি তাকে কতল করছে।তবুও নিজেকে সামলে নেন তিনি।
– বাজারে যান,পবনের মামা হানিফ আসছে পবনকে দেখতে।
জাবির অবাক পানে ঘুরে তাকালো।কয়েক সেকেন্ডে মুখে ফুটে উঠে তাচ্ছিল্যর হাসি।
– হাহ!সূদুর ভারত থেকে সে কেন আসছে?
– পবনকে দেখতে।
– আমার ছেলে এমনিতেই আধা পাগ!ল হয়ে আছে তোমার ভাই এলে তাকে পুরো পা!গল করে ছাড়বে আমি জানি।
– এভাবে বলছেন কেন?
– হানিফ কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে না পেয়ে দীর্ঘ ৩৫ বছর বয়সেও অকৃতদার পড়ে আছে।আমার ছেলেকেও নিশ্চই ফুসলাবে ‘পবন ভাগিনা তুই বিয়ে করিস না।মামা ভাগিনা মিলে সারাজীবন অকৃতদার হয়ে থাকবো।যত্তসব রঙ্গমঞ্চ পেয়েছে আমার বাড়িটাকে।
নাহার বেগম মাথা নিচু করে নেয়।ইদানীং স্বামীর কাছে একটু বেশি অপমানিত হচ্ছেন তিনি।
– শুনো নাহার হাড়িতে চাল বসাও আমি বাজারে গেলাম।হানিফকে আমি স্নেহ করি ছেলেটার সব দিকেই ভালো শুধু বিয়ে করেনি এই বিষয়টা মানতে পারি না।সে এলে তাকে বলে দিও এবার যেন বিয়ে করে যায়।
#চলবে.
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩৯]
_________________
– মামা তুমি!
– কেমন সারপ্রাইজ দিলাম ভাগনে?
ব্যথাহত শরীরটা টেনে উঠে বসার চেষ্টা করলো পবন।অবশ্য তাতে লাভ হলো না মুখ থুবড়ে পড়লো সহসা।আমীনা চটজলদি এগিয়ে গেলো পবনের কাছে তাকে উঠতে সাহায্য করে সালাম জানালো পবনের মামা হানিফকে।আমীনার সাথে দু’চারটা কথা বলে আমীনাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন হানিফ তিনি একান্ত পবনের সাথে কথা বলতে চান।
– কিসব শুনলাম তোমার নামে।তুমি তো দেখি আমার মতোই হয়েছো প্রেমে পড়ে জ্ঞান বুদ্ধি সব বিলিয়ে দিয়েছো হা হা হা।
হানিফ অনেকটা রসিক স্বভাবের মানুষ।অল্প কথায় হাসতে থাকেন।কারনে অকারণে ডা-কাতের মতো উচ্চ স্বরে হাসা তার স্বভাব।কিন্তু এই মানুষটার মনে কতটা আক্ষেপ,যন্ত্রণা বিঁধে আছে তা সহজে কেউ অনুমান করতে সক্ষম নয়।
– আরমিন মেয়েটাকে ভালোবেসেছো ভালো কথা কিন্তু কাছে রাখার চেষ্টা করো নি কেন?
হানিফের কন্ঠ গম্ভীর এতক্ষণে হাসতে থাকা মানুষটার মুখচ্ছবিটা পালটে গেলো এক নিমিষে।
– মায়ের কসম ছিলো।আমি স্বাধীন ছিলাম স্বাধীনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে গেছি কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া করতে পারিনি।কেন জানো? অদৃশ্য শেকলে বন্দি ছিলাম।
পবনের কন্ঠে ভিজে এলো।নুইয়ে গেলো মাথাটা।
– বুঝলাম।এখন কি করবে?পা-গলামি টা কি আজীবনি চলবে?
– জানিনা মামা।তোমার কাছে নিয়ে যাবে আমায়?ইন্ডিয়া চলে যাবো দেশে থাকলে আরমিনের সঙ্গে সুহাইলকে সহ্য করতে পারবো না আমি।
হানিফ আবারো হো হো শব্দে হেসে উঠলো পবন যেন তাকে মজার কোন জোক্স বলেছে।
– ভালো যখন বেসেছো ঘাত-প্রতিঘাত,যন্ত্রণা, সুখ-আনন্দ সবটা গ্রহণ করতে হবে তোমায়।
– আমি যেদিন থেকে বুঝেছি আরমিনকে ভালোবাসি সেদিন থেকে আমার জীবনে আনন্দ, সুখ হারাম হয়ে গেছে।প্রতিটা নিশ্বাসে চিন্তা,হতাশা,উৎকণ্ঠের বেষ্টনী আমাকে ঘিরে রেখেছে।
– শুনো এসব বলেও লাভ নেই।সবাই তোমার কথা শুনে আপসোস করবে।বুলেটের মতো ছুড়ে দিবে আশার বানী।বস্তায় বস্তায় স্বান্তনা দেবে কিন্তু কেউ তোমার মনের অবস্থা বুঝবে না।এসব অবস্থা আমিও পার করেছি ভাগিনা।
– তোমার জীবনের ঘটনাটা তো আমায় বললে না।সারাজীবন শুনে গেলাম কার প্রেমে মরিয়া ছিলে।
– আমার আর ঘটনা।আমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসতাম সে মেয়েটার বাবা ছিলো চাকমা এবং মা মুসলিম বাঙালী।অবশ্য মেয়ের বাবা বিয়ের সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মুসলিম হিসেবে জীবন শুরু করে।আমি যাকে ভালোবাসতাম তার নাম ছিলো রুষা।মেয়েটার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো চার বছর সাত মাস।সবটা ঠিক ঠাক চলছি।আমি পড়াশোনার কারনে চট্রগ্রামে থাকতাম তখনি মেয়েটার সাথে পরিচয়।কিন্তু বিয়ের সময় তোর নানার বাড়ির লোকজন আমাদের সম্পর্ক মানলো না।কারন মেয়ের বাবা চাকমা সম্প্রদায়ের।অথচ তিনি মুসলিম ছিলেন।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করতেন।প্রথম প্রথম রুষার বাবা মা দ্বিমত পোষণ করেন এতদূর মেয়ের বিয়ে দেবে না।পরবর্তীতে অবশ্য তারা সম্মোতি জানায়।কিন্তু তোর নানান বাড়ির লোকের সে কি কান্ড।ভালোয় ভালোয় তারা বিয়ের কথা বলে রুষার বাবা-মাকে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করে আনে।এরপর শুরু হয় তাদের নাটক।রুষার বাবা – মাকে কথার ভাজে ভাজে নানান ভাবে অপমান করে আমি প্রতিবাদ করলে ফল বিপরীত হয়।আমার পরিবার ভেঙ্গে দিলো আমাদের বিয়ের কথা।তারা রাজি না।আমি তখন স্বল্প বেতনে একটা চাকরি করতাম।আমার অবস্থাটা একদম তোর মতই হয়েছিলো।পা-গলের মতো হয়ে যাই।উঠতে বসত চোখে পানি ঝরতো।ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিটপটাং হয়ে থাকতাম।সিগারেটে তো সাথে আছেই হা হা হা৷ এরপর কি হলো জানিস?
– কি?
– আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পালিয়ে বিয়ে করবো। সেদিন রওনা হই চট্রগ্রামের উদ্দেশ্য কিন্তু…
– কিন্তু?
– রুষার বিয়ে হয়ে যায় আর আমি জানতেও পারিনি।পাগলের মতো দিন কাটতে থাকে আমার অফিসের চাকরিটাও হারিয়ে ফেলি।ভার্সিটির বড় ভাই অফার করলেন ইন্ডিয়ান এক কোম্পানির চাকরির কথা।কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যাই।এক মাসের ভিতর চলে গেলাম ইন্ডিয়া।তখন আমার বয়স ছিলো ছাব্বিশ।
– তোমার প্রাত্তনের সাথে যোগাযোগ হয় তোমার?
– হুম হয়।এখনো দুজন দুজনকে সম্মান করি বন্ধুর মতো আছি।জানিস তার ঘরে দুটো মেয়ে আছে।দেখতে পুরোই রুষার মতো।
পবন মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো হানিফকে মানুষটার কথার মাঝে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
– তোমার হিংসে হয় না মামা?আমি তো আরমিনের সাথে সুহাইলের কথা ভাবলেই বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলি।
– এসব ঠিক না পবন।স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের জন্য উত্তম জীবন সঙ্গী পাঠান।স্রষ্টার উপর ভরসা রাখো।তুমি কি চাও আরমিন অসুখী হোক?
– একদমি না।
– তাহলে?আরমিন যার সাথে ভালো থাকবে মেলবন্ধন তার সাথেই হয়েছে।তাহলে এসব কেন করছো?তোমার কীর্তি গুলো যদি আরমিনের কানে যায় মেয়েটার উপর কী প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছো?
– আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না মামা।
– শুনো যে তোমার নসিবে আছে সে আসবেই!আজ হোক কাল হোক আসবে মানে আসবে।খোলা রোদের আকাশে কি টুপ করেই বৃষ্টি পড়ে?বৃষ্টি পড়ার আগে গুমুট মেঘ হয়,মৃদু বাতাস ছড়ায় তারপর জমিন কাঁপিয়ে বৃষ্টির ধারা বয়।ঠিক এমনি যে আসবে সে শত বাধাবিপত্তির পরেও আসবে।আর যে নেই তোমার নসিবে তাকে জোরজবরদস্তি করেও পাবেনা।নিজেকে স্বাভাবিক করে নাও পবন।
– সব তো বুঝলাম তুমি বিয়ে করবে কবে?বয়স তো বুড়োর ভাগে চলে গেছে।গত মাসে আম্মুকে দেখলাম তোমার জন্য মেয়ে খুঁজছে।
– তোমার মায়ের কথা ছাড়ো তো।আমার বয়স যখন বত্রিশ তখন একবার দেশে এলাম।তোমার মা একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করেছে আমিও তাকে দেখতে গেলাম পরে শুনি মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে বুঝো কান্ডো।কোথায় বত্রিশ বছরের ছেলে আর কোথায় এইটে পড়ুয়া মেয়ে হা হা।
পবন হাসলো এতদিনে তার মুখে একটু হাসির আভাস পাওয়া গেছে।
– এভাবে কদিন চলবে মামা?বিয়ে করবে না?
– সত্যি কথা বলতে তিন মাস আগে আমি বিয়ে করেছি।তবে কেউ জানে না।
– সত্যি?
– হুম।মেয়েটার হাসবেন্ড পরোকিয়ায় আসক্ত।মেয়েটাকে ছেড়ে চলে যায় তার ঘরে চার বছরের বাচ্চা ছেলে আছে।বাচ্চাটার সাথেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। সে কি মিষ্টি একটা ছেলে!এরপর তার মায়ের সাথে পরিচিত হয় পরে জানলাম সবটা। আমরা বন্ধুর মতোই সম্পর্ক গড়ি।তেরো মাস পর মন থেকে সিগনাল পেয়েছি নাহ এই বাচ্চা ছেলেটাকে ছাড়া আমার থাকা মুশকিল।বাচ্চা ছেলেটার মায়ের মায়ায় পড়ে গেলাম।অবশেষে তাকে বিয়ে করি।
– কি বলছো তুমি।কেউ তো জানে না।
– আমি কাউকে বলিনি।আমি জানি সবাই বাদ সাধবে কারন তোর মামির এক বিয়ে হয়েছে তার উপর চার বছরের একটা বাচ্চা আছে।
– বাহ!তুমি তো কামাল করে দিয়েছো।
– শোন পবন,ফর্সা-শ্যামলা,চিকন-মোটা,ধনী-দরিদ্র,অন্ধ-লেংড়া কিচ্ছু ভাববে না।যার সাথে মনের মিল হবে তাকেই আঁকড়ে ধরবে।একজন মানুষের সব গুন আছে কিন্তু তোমার সাথে মনের মিলি নেই তাহলে লাভ কী?সারা জীবনের লাইফ পাটনার যদি তোমায় বুঝতে না পারে তাহলে সঙ্গীহিন তাকাই ভালো।
– তবে আগে কেন ধরলে না রুষাকে?
– ওই যে বললাম সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলেছি।তবে যা হয়েছে নিশ্চই ভালোর জন্য হয়েছে।তোমার নতুন মামীকে বিয়ে করার আগে আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাই অনেক ডাক্তার দেখাই, চেকাপ করা অবশেষে ডাক্তার আমাকে একটি তিক্ত সত্য জানায়।
– কি সত্য?
– আমার ফিজিক্যাল প্রবলেম আছে বাবা হতে পারবো না।
– কি বলছো মামা!
– হ্যা এটাই সত্যি।কথাটা শুনে আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম।তখন আমাদের বিয়ের মাত্র সাতদিন বাকি।কিন্তু তোমার মামি এসব গায়ে মাখলো না।সে বিয়েটা করে ক্ষান্ত হয়।পরবর্তীতে আমি ভাবলাম রুষার কথা তার সাথে বিয়ে হলে মেয়েটা মেন্টালি প্রেসারে পড়তো।কারন আমাদের বাচ্চা হতো না।আমাদের সমাজে সব সময় মেয়েদের দোষ দেওয়া হয় ছেলেদের না।এবার ভাব আমি যদি রুষাকে পেতাম তার মাতৃত্ব স্বাদ থেকে তাকে বঞ্চিত করতাম।
– হাহ!
– আজ তোর সাথে যা হচ্ছে আগামী কয়েক বছর পর হয়তো মনে হবে যা হয়েছে তোর সাথে ভালোই হয়েছে।এই যে আমি তোর নতুন মামিকে পেয়ে বড্ড খুশি।মেয়েটা আমাকে বুঝেরে খুব বুঝে।
_
হাত ভরতি সাদা ঝিনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরমিন।এতক্ষণ আনন্দ নিয়ে ঝিনুক কুড়িয়েছে সে অথচ এখন কী করবে এই ঝিনুক নিয়ে মেয়েটা ভেবে পেলো না।সুহাইল দু’হাত বুকের সাথে ভাজ করে চুপচাপ মেয়েটার কান্ড দেখেছে।
– এত ঝিনুক দিয়ে আমি কি করবো সুহাইল?
– তুমি জানো তুমি কি করবে।এতক্ষণ কুড়ালে কেন?
– আমি তো একা নই রাত্রি আপুও কুড়িয়েছে।
– সে তো তোমার মতো দুহাত ভরে নেয়নি।
আরমিন আড় চোখে তাকালো সুহাইলের দিকে।হাতে থাকা ঝিনুক গুলো নিয়ে এগিয়ে গেলো সমুদ্রের তীরে সেখানে ঢেউ এসে ধাক্কায় মিলিয়ে যায়।
– মরিয়ম পানির কাছে একা যেও না খবরদার।
– তবে আপনিও আসুন।
সুহাইল গিয়ে যায় আরমিনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কান্ড দেখছে মেয়েটার।হাত থাকা ঝিনুক গুলো ছুড়ে দিচ্ছে সমুদ্রে।
– ঝিনুক গুলো নিলেই কেন আর ফেলেই বা দিলে কেন?
– আনন্দ লুটছি।আপনি ওসব বুঝবেন না।
– উহ্ আমিও লুটেছি।
– কি?
– আনন্দ!
– কী করে?
– সাগরকন্যা কুয়াকাটার তীরে এসে একজন মেয়ে যখন উচ্ছ্বাসিত হয়ে ঝিনুক কুড়িয়ে নিচ্ছিলো তখন আমার মনে হয়েছে এই সমুদ্রের তীরে আলৌকিক সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হলো।
সহসা আরমিনের মুখটা রাঙা হয়ে গেলো।লজ্জায় চিবুক ছুঁয়েছে গলায়।
– আপনি আমায় এত ভালোবাসেন কেন সুহাইল?
– কারন আগে কাউকে ভালোবাসি নি তো তাই সব ভালোবাসা তোমায় উজার করে দিলাম।
আরমিন প্রসন্ন হাসলো।চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে পাশে তাকিয়ে দেখলো রাত্রি আর মাফী ঝগড়া করছে।
_
বিকেলের সময়টাতে আবারো বিচে এসে উপস্থিত আরমিনরা।আজকে তাদের উদ্দেশ্য ঘোড়া চড়বে।যদিও আরমিন ভয়ে আছে এর আগে কখনো ঘোড়ায় ওঠার অভিজ্ঞতা নেই তার।কিন্তু রাত্রী মেয়েটা ঝটপট দামদর করে একটি ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে।তার পেছনেই বসে মাফী।বিচের পাড়ে অনেক ঘোড়া থাকলেও কিছু ঘোড়া ছোট।মাফী যে ঘোড়াটি নিয়েছে তা দেখতেও রুষ্ট পুষ্ট।সাদা এবং বাদামি রঙের মিশ্রণে ঘোড়াটি বেশ নজর কাড়া।কিছুক্ষণ পরে আরমিন আর সুহাইল ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো।ঘোড়াটা টগবগিয়ে হাটছে।
– সুহাইল আমার ভয় লাগছে!
– আমি আছি।
– যদি পড়ে যাই?
– খপ করে ধরে নিবো।ইঞ্জয় ইউর টাইম মরিয়ম!
দুহাত দুদিকে ছেড়ে দিলো আরমিন।সুহাইল তাকে ধরে ছিলো পেছন থেকে।আশেপাশে পর্যটকদের আনাগোনা,কোলাহলে মুখরিত।কিন্তু সেসব আরমিনের কানে ডুকছে না।মেয়েটা চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে সময়টা।সমুদ্রের আদুরে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে।ঝুটি করা চুল উড়ছে হেলেদুলে।নিজেকে মনে হলো রাজ্যহীন রাজকুমারী আর তাকে ধরে আছে একজন প্রেমিক রাজকুমার।আরমিনের কান্ডে মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিলো সুহাইলের মাঝে।সময়টা আরো আশ্লেষে করতে সুহাইলের আদুরে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় আরমিনের গালে।আরমিন চোখ খুলে ঘাড় ফিরে ঘুরে তাকায়।
– ঘোড়াটা দৌড়ে না কেন সুহাইল?আমি তো সিনেমায় দেখেছি টগবগিয়ে ছুটে চলে ঘোড়া আর এটা হাঁটে খুব একটা দৌড়তেও পারেনা।
আরমিনের স্বরে বিষণ্ণতার আভাষ।
– পা-গলা ঘোড়ার পিঠে চড়ে আমরাও ঘুরবো শুধু সময়ের অপেক্ষা।
_
বাজার থেকে টুকটাক কেনাকাটা করে ফিরেছেন সালেহা।রিহানা তার পাশে বসে সবজি গুলো ঝুড়িতে রাখছে।সালেহা বটি এনে মাছ কাঁটতে বসেছেন।কিছুক্ষণ পর তাদের বাড়িতে উপস্থিত হয় একজন প্রতিবেশি।মহিলাটি দেখতে সালেহার বয়সী,মুখে পান চবনে ব্যস্ত তিনি।একটি মোড়া নিয়ে বসলেন সালেহার সামনে তার হাভভাভ এমন যেন কোন বক্তিতা দিতে বসেছেন।
– ভাবী কী করছেন?
– দেখতেই তো পারছেন মাছ কাটছি।
– ওহ তাও কথা।আরমিন কেমন আছে, মেয়েটা আসবে না?
– ভালো আছে।আসবে,সুযোগ মতো আসবে।
মহিলাটি স্থির হলো।আশেপাশে তাকিয়ে কথার ছুতো খুঁজতে ব্যস্ত।
– পবনের কি হইছে?মাতবরের সাথে হঠাৎ এত লাগালাগি কেন হইলো তার?
– ওসব ওনাদের পারিবারিক আমি কেন বাইরে প্রকাশ করবো?
– পারিবারিক কথা কতদিনি পারিবারিক থাকে?এলাকায় তো মানুষ রটাইছে আরমিনের বিয়ের কারনেই পবন এমন করতাছে।সত্যি করে কও সালেহা আরমিন আর পবনের কোন সম্পর্ক ছিলো?
– না কোন সম্পর্ক ছিলো না।মানুষ সন্দেহের জেরে অনেক কথাই বলতে পারে।তাই বলে সব কথা আমি কানে তুলবো না।
– শুনো যা ঘটে তা রটে।আরমিন যখন বিয়েতে বিদায় নিলো পবন ঘুইরা পড়লো কেন?এলাকার মানুষ কি দেখেনাই পবন ঘুইরা পড়ছে?
– পবন অসুস্থ ছিলো তখন তাই এমনটা হয়েছে।
– শাক দিয়া মাছ ঢাইকো না সালেহা।তোমার মাইয়ার লগে পবনের মিলমিশ এলাকার সবাই দেখছে।
সালেহার রাগ বাড়লো নিজেকে সংযত রাখতে চুপচাপ মাছ কাটায় মনোনিবেশ করেন।কিন্তু তাতেও মুখ থামলো না মহিলাটির।
– এখনকার পোলামাইয়াগো বিশ্বাস নাই ভিতরে এক বাইরে আরেক।খুটাইয়া দেখো পবনের সাথে মেলামেশা তার কোন পর্যায়ে গেছে।বিছানা পর্যন্ত গেছে কী না কে জানে!
সালেহা রক্তিম দৃষ্টিতে তাকালো মহিলার দিকে।আরমিনের নামে এমন কুশ্রী তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না।হাতের বটি তুলে কো/প দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়।রিহানা দ্রুত এসে ধরে নেয় সালেহার হাত।
– এই বাড়ি থাইকা বাইর হ।এক কো/পে কল্লা ফালাই দিতে দুইবার ভাবমু না।আমার মাইয়ার সম্পর্কে কতটুকু জানস তুই?নিজের পেটের সন্তানরে সামলা দু’বছর আগেই তোর মেয়ে পালাইছে আর তুই আসছত আরেকজনের মেয়ের সম্পর্কে কুশ্রী রটাইতে।
মহিলাটি আরো কিছু বলার জন্য তেড়ে আসে কিন্তু ততক্ষণে সালেহা বটি নিয়ে এগিয়ে আসতে দ্রুত বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।
_
আমাগীকাল ছাড়তে হবে এই মায়াময় শহরটা।রুমের জানলা দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে আরমিন।অনবরত পবনকে দশবারের উপর কল করা হয়েছে কিন্তু পবন কল রিসিভ করা তো দূরের কথা একটা পর্যায়ে ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছে।পবনের এই অবহেলা আরমিন মেনে নিতে পারছেনা।ঠিক কি কারনে রাগ বিষয়টা তাকে ভাবাচ্ছে বারংবার।সুহাইল রিসোর্টের বাইরে আছে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাই আরমিনকে বলেছে ভুলেও যেন সে রুম থেকে বের না হয়।তাই বাধ্য মেয়ের মতো রুমে বসে রইলো সে।দরজা খোলার শব্দে ঘুরে তাকায় আরমিন।সুহাইল এসেছে ছেলেটা ঘেমে জুবুথুবু অবস্থা।
– কোথায় ছিলেন সুহাইল?
– শাড়িটা পড়ে নাও মরিয়ম হাতে সময় কম।
আরমিন ঘড়ির দিকে তাকালো সময় নয়টা বারো।এই রাতে শাড়ি পড়বে কেন মাথায় এলো না আরমিনের।প্যাকেট থেকে শাড়িটা নিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো তার।আকাশী রঙের একটি তাঁতের শাড়ি।সুহাইল এক গাল হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।আরমিন ছুটে এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে,
– এই এই শাড়ি পড়বো কেন?কোথায় যাবো?
– সমুদ্রের পাড়ে।অন্তিম বিদায় নিতে হবে তো।তুমি শাড়িটা পড়ে নাও, নো মেকাপ।
.
থালার মতো গোলগাল চাঁদ দিকে তাকিয়ে রইলো আরমিন।আজকে চাঁদের আলোটাও তীর্যক ভাবে পড়ছে।সমুদ্র উত্তাল ঢেউয়ের কলকল শব্দ কানে আসছে প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে।চাঁদের আলোয় আজ ভাসছে সমুদ্র।অচেনা সমুদ্রটা আরও বেশি রহস্যময়ী হয়ে পড়েছে।
– আজকের চাঁদটা সুন্দর তাই না সুহাইল?
– হুম!আমি এত মুগ্ধ হয়ে কখনো চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করিনি।
থালার মতো চাঁদ থেকে জোছনা চুইয়ে পড়ছে সাগরের জলে।চিকচিকে বালিতে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের জোছনা!অদ্ভুত এক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে পৃথিবী।এই অপার্থিব সৌন্দর্য কোথায় যেন অস্পষ্ট এক হাহাকার জাগিয়ে তোলে, মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বেঁচে থাকার আনন্দটা তখন প্রবলভাবে জাপটে ধরেছে দুজনকে। আজ চাঁদটার দিকে তারা তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে কানে তুলছে উত্তাল সুর।আরমিনের শাড়ির আঁচলটা উড়ে থুবড়ে পড়ছে সুহাইল বুকে। সেই আঁচলটা সুহাইল মুড়িয়ে পেচিয়ে দিলো আরমিনের শরীর।
– আসো ফানুস উড়াই।
– ফানুস পাবো কোথায়?
আরমিন ঘুরে তাকালো সুহাইল মিটিমিটি হাসছে।হাত নাড়িয়ে দূরে কাকে যেন কিছু একটা ইশারা করে সুহাইল।কয়েকজন ছায়া মানবকে লক্ষ্য করলো আরমিন।মুহূর্তে বিকট শব্দে সমুদ্রের কোনায় একে একে ফুটতে থাকে আতশবাজি।হঠাৎ আওয়াজে আরমিন ভয় পেয়ে যায় খুবলে ধরে সুহাইলের বুক পকেট।তার ভয় দেখে স্বগোতক্তি স্বরে সুহাইল বলে,
– ভয় পেয়ো না।তাকাও আকাশের দিকে!
আরমিন তাকালো একে একে বিকট শব্দে ফেটে উঠলো আতশবাজি।আহা সে কি মুগ্ধকর দৃশ্য!আশেপাশে পর্যটকরা ছুটে আসে বিচের দিকে।সবাই মুহূর্তটা ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত।আকাশের চাঁদ যেমন মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে ঠিক তেমনি আতশবাজির ঝলমলে আলো পালটে দিলো এই রাত্রি।গতকাল গিটার বাজানো পাতলা গড়নের ছেলেটি এগিয়ে এলো,তার হাতে একটি ফানুস।আর একটি দিয়াশলাই।
– ভাবী আপনি বেশ ভাগ্যবতী।
আরমিন প্রত্যুত্তর করলো না ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে।ছেলেটা যেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসেছে আবার ব্যস্ত ভঙ্গিয়ে চলে গেছে।
– এই ছেলেটা….
– আরে ওদের বলেছিলাম তোমায় কি করে সারপ্রাইজ দেওয়া যায়।তারাই তো বুদ্ধি দিলো সবটা।আমি তো যাস্ট শাড়িটা কিনেছি আর তোমায় এখানে এনেছি বাকি সব এই ছেলেগুলোই করেছে।এই আতশবাজি তারাই ফাটিয়েছে।আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তাদের কাছে।
আরমিন প্রসন্ন হাসলো।সুহাইল তাকে টেনে নিলো সামনের দিকে দুজনে মিলে ফানুস উড়ানোর কার্যক্রম করছে কিন্তু বাতাসের দাপটে সব ভেস্তে যাচ্ছে।আলোর উৎস চোখে পড়তে আরমিন পাশে তাকালো একে একে একটা,দুটো,তিনটে, চারটে আরো অনেক, অনেক ফানুস উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে।কিয়ৎক্ষণ বাদে সুহাইল ফানুস জ্বালাতে সক্ষম হয়।আরমিনের হাতে হাত রেখে উড়িয়ে দিলো মায়াবী ফানুসটা।আরমিন উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলো সুহাইলের গলা।পেছনে চোখ যেতে লজ্জায় মিহিয়ে গেলো সে।পেছন থেকে একটা ছেলে ক্যামেরা হাতে তাদের ভিডিও করছে।
– সরি ভাবী আমাকে দেখে লজ্জা পাবেন না, আপনার লাস্ট শটে ভিডিওটা পরিপূর্ণ হয়েছে আরো সুন্দর হয়েছে।
আরমিন দুরে সরে দাঁড়ায়।ছেলেটা সুহাইলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– আমি গেলাম ভাই আপনারা ইঞ্জয় করুন।
ছেলেটা চলে গেলো।আরমিনের দীর্ঘ আঁচল বালিতে দোল খেলছে।সুহাইল তার হাতে হাত রেখে টেনে এগিয়ে নিলো সামনে।যেদিকে মানুষজনের ভিড় নেই।নেই মানুষের কোলাহল।এখানে শুধু মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে পরিবেশের মাঝে।মৃদ্যু বাতাসে শিউরে উঠলো আরমিনের শরীর।ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে গেলো অনেকটা পথ।
পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে।নোনা জলে ভিজে যাচ্ছে পা।নিরব অনুভূতিতে ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে দুজনের হৃদয়!
– আসুন আমরা বালির উপর বসি।
সুহাইল আরমিনের কথা মতো শুকনো বালিতে বসলো।আরমিন দ্বিধাহীন সুহাইলের ঘাড়ে মাথা রাখে।ক্রমশ এই মানুষটার প্রতি সে দূর্বল হতে শুরু করেছে।ইচ্ছে করছে নিজের কাছে বন্দি করে রাখতে কিন্তু এই মানুষটাতো আগে থেকেই তার জালে বন্দি তবুও মন ভরে না তার।তাকে যতটা কাছে পায় ততটা হারানোর ভয় পায়।
– কী ভাবছো মরিয়ম?
– কিছু না।পরিবেশটা সুন্দর না?
– হুম। তুমি আছো বলে আমার মনে সুখ আছে।আর সুখ আছে বলেই পরিবেশটা এত ভালো লাগছে।
– আপনি আমায় এত ভালোবাসেন কেন সুহাইল?
– জানি না।কেন তুমি কি আমায় এখনো ভালোবাসতে পারো নি মরিয়ম?
– আমি বোধহয় আপনাকে ভালোবাসার আগে এই সমুদ্রকে ভালোবেসে ফেলেছি।
– তাতে কী?ভালোবাসো আর না বাসো আমার কাছেই থাকতে হবে।থাকতে থাকতে একদিন ভালোবাসা ধরা দেবেই।
আরমিন উঠে দাঁড়ালো এগিয়ে গেলো পানির কাছে।পায়ে থাকা জুতোটা খুলে ইশারায় ডাকলো সুহাইলকে সুহাইল এগিয়ে এলো তার কাছে।প্রবল হাওয়া এসে বিশাল ঢেউ টেনে এনে তীরে ফেলছে।নোনা পানির জলে ভিজ গেলো আরমিনের শাড়ির নিচের খানিকটা অংশ।সুহাইল তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।ছেলেটার দৃষ্টি চাঁদের দিকে আবদ্ধ।আরমিন সুহাইলের পায়ের উপর পা রেখে ভর করে দাঁড়ায়।লাহমায় চমকে তাকায় সুহাইল।তার ভড়কানো চেহারায় লাজুক হাসলো মেয়েটা।
– মরিয়ম!
– হু!
বেশ ঘোর নিয়ে ডাকলো সুহাইল।আরমিন উত্তর দিলো অস্পষ্ট স্বরে।আরমিনের নিশ্বাসে সে কম্পন টের পাচ্ছে।অনুভূতিরা আরো প্রখর হয়ে উঠেছে।এই মেয়েটা তাকে এলোমেলো করে দেয়।পাগল করে দেয় এক নিমিষে।নির্জিত অনুভূতিকে আগলে নিয়ে সুহাইলের শুষ্ক ওষ্ঠ মিলিয়ে দিলো নিজের ওষ্ঠে।কয়েক সেকেন্ডে পুলকিত হয় সুহাইল।চকিতে তাকালো আরমিনের দিকে মেয়েটা আজ সেচ্ছায় ধরা দিয়েছে, মনে মনে অবশ্য সুহাইল প্রসন্ন হাসলো।দু’হাত আগলে ছুঁয়ে দিলো মেয়েটার কটিদেশ।বিশাল ঢেউ এসে আরেকবার ভিজিয়ে দিলো দুজনকে! হিমশীতল জলের স্পর্শে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো দুজনেরি। তবুও ভালো লাগছে,আলিঙ্গনে আবদ্ধ দুজন কপোত-কপোতীকে জোৎস্না ভিজিয়ে দিচ্ছে
তার সাথে সমুদ্রর উত্তাল ঢেউ । কাছ থেকে বিশাল সমুদ্র জোৎস্নার আলোয় গা ভিজিয়ে আপন মানুষটাকে কাছে পাওয়া এক অন্যরকম অনুভূতি।
_
সময়টা ধীরে ধীরে পেরিয়ে গেলো। কারো সুখে কারো বা এক বুক হতাশা নিয়ে।পবনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছে দু’দিন আগে।হানিফ মামাও চলে গেলেন মাত্র তিনদিন থেকে।এই তিনদিন পবনকে মেন্টালি সাপোর্ট দিয়েছিলেন তিনি।ভেবেছিলো পবন হয়তো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসবে কিন্তু তাকে ভুল প্রমান করে দিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরতেই নিজেকে আবারো এক রুমে বন্দি করে নেয়।সিগারেটের নেশা যেন তাকে ছাড়ে না।ওষুধ গুলো পড়ে আছে অযত্নে।জাবিরের সাথে পবনের সম্পর্ক স্বাভাবিক যেন বাপ ছেলের মাঝে কিছুই হয়নি কিন্তু নাহার বেগমের উপর বেসামাল রেগে আছে পবন।মায়ের সাথে দু’চারটা কথা বলতেও যেন তার জড়তা কাজ করে।
ছাদের এক কোনায় বসে সিগারেটে মত্ত সে।দিন দুনিয়া তার জন্য যেন নয় নিজেকে বৈরাগী ঘোষণা করেছে।বাড়ির নিচ তলা থেকে হইচই শব্দ কানে এলো পবনের কিন্তু তাতে পাত্তা দিলো না সে, যার যা ইচ্ছে করুক তার কী?
প্রমা এগিয়ে এলো ছাদে মেয়েটা কাঁদছে।এলোমেলো পায়ে পবনের সামনে দাড়ালো সে,
– ভা..ভাইয়ারে নিচে চল আম্মুর কি যেন হয়েছে নাকে মুখে ফেনা উঠে গেছে।
– কি?
– তু…তুই চল ভাইয়া। আব্বা,চাচা কেউ বাসায় নেই।
পবন দিশে হারা হয়ে ছুটে চলে যায় নিচে।নাহার বেগম রান্না ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে।আমীনা,সুমনা তার মাথায় পানি ঢালছে।চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে তাতেও জ্ঞান ফিরলো না তার।মায়ের অবস্থা দেখে থমকে গেলো পবন।এক নিমিষে ভুলে গেলোঅতীত,বর্তমান,ভবিষ্যত।
#চলবে….