#মায়াপ্রপঞ্চ,৪২,৪৩(ক)
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪২]
________________
রাতে খাবার টেবিলে চুপচাপ সবাই সবার খাওয়ার খেতে ব্যস্ত।কিন্তু আরমিনের গলা দিয়ে খাবার নামছে না।ইদানীং মানসিক শান্তি ম-রে গেছে।বারেক তাকে দেখলেই দু’চারটে কথা শুনিয়ে দেয় সুহাইলের অন্তরালে।অপরদিকে পবনের জন্য বড্ড বেশি চিন্তা হচ্ছে।তার উপর পড়াশোনার প্রেসার সব মিলিয়ে তার পা/গল পা/গল অবস্থা।সুহাইল মুখে খাবার তুলে তাকালো বারেকের দিকে।
– এত হেয়ালি ভাবে ব্যবসা করলে তো লসের মুখে পড়বেই বাবা।
বারেক চোখ তুলে তাকালেন। হাতে থাকা কাটা চামচ’টা প্লেটে রেখে দিলেন শব্দ করে।
– মানে! কি বলতে চাইছো তুমি?
– সেদিন তোমার ডিল ক্যান্সেল হয়নি বরং তারিখ পেছানো হয়েছে।আর তুমি তিলকে তাল বানিয়ে বিশ্রি কান্ড ঘটিয়েছো।
বারেকের দৃঢ় চিত্ত মনো ভাবটা নিভে এলো।পানির গ্লাসটা এগিয়ে নিয়ে ঢকঢক শব্দে সম্পূর্ণ পানিটা শেষ করেন।ফারজানা তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।
– তুমি তাহলে পরবর্তীতে আমাকে কেন বললে না এটা তোমার ভুল ছিলো?জানো কতটা চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম।
ফারজানার রুক্ষ স্বর।যেন চোখের দৃষ্টিতেই ভস্ম করে দেবে বারেককে।
– বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু বলা হয়ে উঠেনি।
– কেন বলা হয়ে উঠেনি?তোমার তো উচিত ছিলো আরমিনের কাছে মাফ চাওয়ার।মেয়েটাকে এতটা নিচু ভাষায় অপমান করেছো যদি সেদিন কোন অঘটন ঘটতো তবে?
– ফুফু থামুন।
আরমিনের দিকে চোয়াল শক্ত করে তাকালো ফারজানা।আরমিন থতমত খেয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।সুহাইল বেশ আরাম করে বসে খাবার মুখে তুলছে, সে আজ মজা লুটছে।ফারজানা একের পর এক কথা শুনিয়ে গেলো বারেককে।কিন্তু বারেক নিশ্চুপ।
খাবার শেষে সবাই যে যার রুমে চলে যায়।আরমিন ফারজানাকে রুমে পাঠিয়ে রান্না ঘরের টুকটাক কাজ করছে।এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় বারেক।
– কি করছো তুমি?
বারেকের উপস্থিতিতে ভয় পেয়ে যায় আরমিন।দু’পা পিছিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে বলে,
– এই তো একটু কাজ করছিলাম ফুফা।
– ঘুমাতে যাওনি কেন?
– যাবো এক্ষুনি।
বারেক নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরমিনের দিকে।মেয়েটার দৃষ্টি মেঝের দিকে।নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে সে।তার ভাব ভঙ্গিমায় বেশ বোঝা যাচ্ছে বারেকের সামনে সে বিব্রতবোধ করছে।
– যা হয়েছে তা নিয়ে আমার কিছু বলার নাই।তবে আমার বড় ছেলের বউ যেহেতু হয়েছো তোমায় তো আর ফেলে দিতে পারিনা।
আরমিন প্রত্যুত্তর করলো না।দৃষ্টি তার মেঝের দিকেই আবব্ধ।
– বিয়ের মাস কেটে গেলো তোমায় এখনো কোন উপহার দিতে পারিনি।সবাই তো সব কিছু দিলোই।
– আমার কোন উপহার চাই না ফুফা।
বারেক একটুখানি হাসলেন।হাতে থাকা কাগজের প্যাকেট থেকে বের করলেন লম্বালম্বি একটি বক্স।বারেক বক্সটা হাতে দিলেন আরমিনের এবং খুলতে ইশারা করে।আরমিন বক্স খুলে দেখতে পেলো স্বর্ণের ব্রেসলেট।
– তোমার জন্য।
– এ..এসবের আমার প্রয়োজন নেই ফুফা।আপনি শুধু শুধু….
– চুপ করো তোমার শশুর দিয়েছে প্রথম উপহার আর তুমি গ্রহণ করবে না?
আরমিন চকিতে তাকালো।’শশুর’ শব্দটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেলো বেশ কয়েকবার।অচল পায়ে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করলো সে।বারেক তবে তাকে মেনে নিয়েছে।আরমিনের ভাবনার মাঝেই বারেক মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
– যাও ঘুমাতে যাও।আমি জানি,আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য তবুও এই অধমকে ক্ষমা করিও।
আরমিনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা জল।বারেক ততক্ষণে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেছে রান্না ঘর ছেড়ে।হাতে থাকা উপহারের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো আরমিন।
– ক্ষমা!ক্ষমা কোন দিন করবো না।আপনাকে ফুফুকে কোন দিন ক্ষমা করবো না।আপনাদের কারনে অন্যর আশ্রিতা হয়ে বেঁচে ছিলাম,আরাম,আয়েশ, ভোগ কোনদিন করতে পারেনি।আমার মায়ের জীবন কেটেছে ছন্নছাড়া আর আমার বাবার জীবনটা কেটেছে নরক সমতুল্য যন্ত্রণার মাঝে।আমি বর্তমানে সুখী হলেও অতীত কোন দিন ভুলতে পারবো না।আপনারা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না।
.
সুহাইলের বক্ষে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত অবস্থায় আরমিন।সুহাইল নড়লো না মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ব্যস্ত সে।এই কয়েক মাসে পোষমানা পাখির মতো সুহাইলের দ্বারে দ্বারে অবদার নিয়ে ছুটেছে মেয়েটা।যখন যা চেয়েছে সুহাইল তাই করেছে।পড়াশোনায় ব্যস্ত রেখেছে সর্বদা।তার সাথে আনন্দ,হইহুল্লোড়ে মেতে রেখেছে প্রতিটা দিন।আজ দুপুরের পর রওনা হবে কেশবপুরের উদ্দেশ্য।সেদিনের পর কেটে গেছে দুই মাসের বেশি সময়।এই দুইমাস আর কেশবপুরে যাওয়া হয়নি তাদের।এই সাপ্তাহ বাদে আরমিনের পরিক্ষা শুরু।পরিক্ষা চলবে প্রায় এক মাস ব্যাপি।সুহাইলের ফ্লাইট দু’দিন পর।সব কাজ শেষে দেশে ফিরতে লাগবে প্রায় তিনমাস।এই তিনমাস তার মরিয়মকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।
সুহাইল হাত বাড়িয়ে জানলার পর্দাটা আংশিক সরিয়ে দিলো।সূর্যের প্রখর আলো না পড়লেও অন্ধকার রুমটায় হঠাৎ আলোর আভাসে কুচকে গেলো আরমিনের চোখ।
– সকাল নয়টা বাজে উঠে পড়েন।
– আরেকটু ঘুমাই।
– ব্যাগ প্যাকিং করতে হবে অনেক কাজ উঠে যাও।
আরমিন আড়মোড়া কাটিয়ে উঠলো।অলস ভঙ্গিমায় হেলিয়ে বসলো সুহাইলের বুকে।
– এমন সকাল আর পাবো না তাই না সুহাইল?
– পাবে, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।
– তাই বলে তিনমাস!আমার দম বন্ধ লাগবে সুহাইল আমি নির্ঘাত ম_রেই যাবো।
সুহাইল গা দুলিয়ে হাসলো।দু’হাত আগলে নিলো আরমিনের উদরে।
– এভাবে বলে না।আমি কি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো নাকি?আমারো খারাপ লাগবে তাছাড়া সেখানে গেলে তোমার সাথে আমার কথা হবে মাত্র দিনে একবার।
– একবার!
– আমি নিজেকে সর্বদা কাজে ব্যস্ত রাখবো।তাছাড়া এখন পড়ার সময় তুমি পড়বে এত কথা বলার প্রয়োজন নেই বুঝতে পেরেছো?তুমি জানো আমার পরিক্ষা আছে এর মাঝে নিজেকেও প্রিপেয়ার করতে হবে।
– পরিক্ষার সময় এখনি পড়তে হলো আর কোন সময় ছিলো না।
– অবুঝের মতো কথা বলো কেন তুমি?আমি পড়াশোনায় প্রচন্ড সিরিয়াস আর আমার বউ যদি নিজের পড়ায় সিরিয়াস না হয় তাহলে এত শত আদর বাতিল করতে বাধ্য হবো আমি।
আরমিন প্রত্যুত্ত করলো না সুহাইলের বুক থেকে উঠে অলস পায়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।ততক্ষণে সুহাইল ব্যাগপত্র গোছগাছে লেগে পড়ে।প্রায় এক ঘন্টা পেরিয়ে যায় কিন্তু আরমিনের বের হওয়ার নাম নেই।বাধ্য হয়ে সুহাইল দরজা ধাক্কালো।কিয়ৎক্ষনের মধ্যে দরজা খুললো আরমিন।
– মরিয়ম তোমার এই হাল কেন?
– আমি ঠিক আছি।
– তুমি ঠিক নেই।চোখ লাল মুখটা……তুমি কেঁদেছো তাই না?কেন কেঁদেছো বলবে?
আরমিন ঠোঁট কুচকায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে পুনরায়।সুহাইলের বুকে মাথা রেখে গুমরে ওঠে আবারো।অশ্রুর বাধ মানছে না সব কিছু তুচ্ছ লাগছে নিজের কাছে।বার বার মন বলছে শুধু এই মানুষটাকেই চাই এই মানুষটাকে পেলে আর কিচ্ছু চাই না।
– আপনি যাইয়েন না।আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
– আরেহ বোকা মেয়ে কান্নার কি আছে?
– জানি না।আমি শুধু জানি আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
– আমি না গেলে টাকা রোজগার হবে কী করে?এত মাস যে দেশে পড়ে আছি তুমি কি জানো আমার কতটা লোকসান হচ্ছে।যখন টাকা থাকবে না তখন এই ভালোবাসাও থাকবে না।
সুহাইলের কথায় আরমিন রেগে গেলো।মাথা তুলে তাকালো তার দিকে,
– আপনি কি বোঝাতে চাইছেন টাকার কারনে আপনাকে ভালোবাসি?
– না আমি তা বলি নি।কিন্তু টাকাটাই আসল।যখন টাকা থাকবে না আমার চিন্তা বেড়ে যাবে।আমি খিটমিটে হয়ে যাবো।তোমায় আগের মতো কদর করতে পারবো না।তুমি তখন হাজারটা অভিযোগ সাজাবে ক্রমশ সম্পর্কের অবনতি ঘটবে বুঝতে পেরেছো?
আরমিন প্রত্যুত্তর করলো না।চোখের পানি মুছে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সুহাইল বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে মেয়েটা রেগে গেছে।
– মরিয়ম পড়াশোনায় মনোযোগী হও।সুহাইল খন্দকারের পাশে হাটতে হলে তার যোগ্য অবশ্যই তোমায় হতে হবে।
– হবো না আমি যোগ্য তাতে কার কী?
আরমিনের ঘাড় ত্যাড়া কথায় সুহাইল কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলো।সে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে ছয়ে নয়ে এই মেয়েকে কবজা করা সম্ভব নয় তাই কয়েকটা শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে উদ্যত হয়।
– এই দেশে যেমন তেমন চলছি-চলছো কিন্তু কানাডায় গেলে এভাবে তোমার লাইফ স্টাইল থাকবে না।তুমি যদি আমার যোগ্য না হও সে দেশে আমার বন্ধুরা তোমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে টিটকারি করবে।সবাই বলবে দেখ দেখ সুহাইল এটা কি বিয়ে করেছে এই মেয়ে তো তার নখের যোগ্য নয়।এসব নিন্দাসূচক কথা শুনতে ভালো লাগবে তোমার?তখন তো আমিও ভালোবাসবো না তোমায়।নিজের যোগ্য মতো কাউকে খুঁজে নিবো।
আরমিন তড়িৎ গতিতে তাকালো সুহাইলের দিকে।কোমল মনটায় গাঢ় জেদের সঞ্চার হয়েছে।চোখে মুখে ফুটে উঠেছে জেদের আভাস।
– তুমি খুব ভালো স্টুডেন্ট আমি জানি।আমাকে পবন বলেছে প্রতি ক্লাসেই ভালো রেজাল্ট করেছো।কিন্তু শেষ মুহূর্তে এভাবে হেলাফেলা চলবে না।
– এত কথা শুনতে চাই না।আপনার সাথে মুখোমুখি হবো তিন মাস পরে।
সুহাইল মিটিমিটি হাসছে।আলমারি থেকে একটি প্যাকেট বের করে ধরিয়ে দিলো আরমিনের হাতে।
– কাল এই হলুদ শাড়িটা এনেছিলাম।যেদিন আমি আসবো সেদিন এই শাড়িটা পরে সেজে থাকবে আমি আমার হলদিয়া মরিয়মকে দেখতে চাই।
.
সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত উঠন জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহাইলের পরিবারের সকলে।জাবিরের সঙ্গে বারেকের নানান বিষয়ের কথা চলছে আরমিন সুহাইল এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।সালেহা এশারের নামায শেষ করে এসে দাড়ালো সবার মাঝে।উঠনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এতক্ষণ তার অপেক্ষায় ছিলো।সালেহাকে ঘর করে দেওয়ার বিষয়টি জেনেছেন বারেক এবং ফারজানা এতে কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি।বরং তারা যেন দায় থেকে বেঁচেছেন।
– মামি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।এই কাগজ গুলো নাও।
সালেহা কাগজগুলো হাতে তুললো দেখেই বোঝা যাচ্ছে জমির দলিল।
– এসব কার আমায় দিচ্ছো কেন?
– যার কাগজ তাকেই দিচ্ছি।
– মানে কী?
– মামি ঘরটা দেখছো এটা তোমার ঘর।এই বাড়ির সম্পূর্ণ মালিকানা তোমার।
সালেহা অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সুহাইলের দিকে।আপনা-আপনি কেঁপে উঠলো তার হাত।দু’চোখ বুলিয়ে তাকালো জাবিরের দিকে।
– ভাইজান এইসব কি বলছে?এসব তো আপনার জমি আমি তো আশ্রিতা।
– ছিহ এসব কি বলছো সালেহা?আমি তোমাকে আমার বোনের চোখে দেখেছি।আর আজ তোমার মুখে একথা শুনে ভেবেই নিলাম তুমি আমাদের আপন করতে পারোনি।
সালেহা মাথা নুইয়ে নিলেন।হাতে থাকা কাগজগুলো আঁকড়ে ধরলেন বুকের সাথে।তার দু’চোখ জলে ভাসছে।সুহাইল আগলে নিলো সালেহাকে।
– মামী বিশ্বাস করো সবটা তোমার।কর্মজীবনে কাউকে এতটা দিতে পারিনি তোমাকে দিলাম।কায়িম মামা আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ সেই মানুষটাকে আমি হারিয়েছি ঠিক কিন্তু তার পরিবার যেহেতু আমার কাছে তাদের হারানো প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতেই পারি।
– এই কাগজপত্র তুমি নিয়ে যাও।আমার কিচ্ছু চাই না।একমাত্র জাবির ভাইজানের দান গ্রহণ করেছি আর কারো দান নিয়ে নিজেকে ছোট করতে চাই না।
সুহাইল আড় চোখে তাকালো আরমিনের দিকে।আরমিন মাথা নত করে রেখেছে সালেহা ঠিকি বলেছে সুহাইলের এই বাড়ি নেওয়া তাদের উচিত হবে না।তাই সুহাইলের ইশারা সে সম্মোতি দিতে পারলো না।পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ফারজানা এগিয়ে আসেন।হাতটা চেপে ধরে সালেহার।
– ভাবী রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি যে পাপ করেছি তার মাশুল এজীবনে দিয়ে শেষ করতে পারবো না।তোমাদের যে সম্পদ হারিয়েছো মনে করো এগুলো সেই সম্পদ।সব ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সাধ্য আমাদের নেই যতটুকু পেরেছে আমার ছেলে নিজ দায়িত্বে সবটা করেছে।এগুলো দান নয় ভাবী আমার ছেলের উপহার।
সালেহা এখনো নত মাথায় কাঁদছে।জাবির এগিয়ে এসে সালেহাকে আশ্বস্ত করেন।সুহাইলের দেওয়া জমির দলিল গ্রহণ করতে আদেশ করেন।জাবিরের কথা ফেলতে পারলো না সালেহা।দলিলটা সাদরে গ্রহণ করে সে।
.
ভোরের মিষ্টি আলো ফুটতে শুরু করেছে।এত বছরের জীবনে আজ বাপের বাড়িতে আরমিনের একটি অন্যরকম সকাল শুরু হয়েছে।উঁচু পাকা ভবনটি আরমিনদের।বাড়ির বাইরে চারিদিকে দেয়ালের কাজ চলছে।সুহাইল বাড়ির নাম ঠিক করেছে “সালেহার সুবসতি”।কয়েকদিন পর নেমপ্লেট লাগানো হবে।আজ সুহাইল ফিরে যাবে ঢাকা, পর দিন তার ফ্লাইট।সুহাইল,সিয়াম,বারেক তারা তিনজনেই কানাডায় ফিরে যাবে শুধুমাত্র সালেহার সাথে কেশবপুরে থেকে যাবে ফারজানা।
ভোর থেকে আরমিন এবং সালেহা মিলে রান্নার কাজ শুরু করেছে।বিভিন্ন পদের নাস্তা বানিয়ে আরমিন নিজের রুমে ফিরে আসে।সুহাইল তখনো ঘুমে কাবু।ব্যাগ থেকে হাফ সিল্কের একটি শাড়ি বের করে ঝটপট তৈরি হয়ে নেয়।
সুহাইলে চুলে হাত বুলিয়ে অতীতের কথা ভাবছে মেয়েটা।এই মানুষটার সাথে অল্প সময় কাটালেও কতশত স্মৃতি জমা হয়েছে,মায়া জমে গেছে একটু বেশি।ইদানীং সুহাইলের প্রতি এতটাই মোহে ডুবেছে কেউ যদি সুহাইলকে নিয়ে একটু নিন্দা কথা বলে সঙ্গে সঙ্গে চটে যায় আরমিন।আর সেই মানুষটাকে আগামী তিনমাস দেখবে না ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।কান্নাগুলো দলাপাকিয়ে এলো গলার কাছে নিজেকে দমন করতে পারলো না সে, এক নিমিষে হুহু শব্দে কেঁদে উঠলো ঝাঁপিয়ে পড়লো সুহাইলের বুকে।ঘুমন্ত সুহাইল অতর্কিত হা-মলায় ঘাবড়ে যায়।তড়িঘড়ি তাকায় সামনে আরমিনকে দেখে খানিকা চিন্তা মুক্ত হয়।
– এই কি হয়েছে কাঁদছো কেন তুমি?
– আপনি চলে যাবেন!আমাকে ছেড়ে যাইয়েন না।
– এসব কি কথা মরিয়ম?
– আমার কষ্টটা আপনি বুঝেন না তাইনা!
আরমিন কাঁদতে থাকে।সুহাইল আগলে নিলো আরমিনকে।কপালে বসিয়ে দিলো তার শুষ্ক ওষ্ঠ।
– দেশে যে কত প্রবাসী আছে তাদের বউদের বছরের পর বছর রেখে যায়।কোন কোন মেয়ের বিয়ের মেহেদীর রঙ উঠার আগেই স্বামী দেশের বাইরে চলে যায়।কবে ফিরবে নির্দিষ্ট তাদের জানা নেই।সেসব মেয়েরা কী থাকে না?তারাও দিব্যি দিন কাটায়।অথচ দেখো আমি আসবো মাত্র তিনমাস পর।এই তিনমাসে তোমার চোখের পলকে সময় কেটে যাবে।তাছাড়া তোমার ফুফুকে রেখে যাচ্ছি তার দেখভালের দায়িত্ব তোমার
– আমি তো ভাবতেই পারি না আপনাকে ছাড়া থাকবো।ছিহহ এতটা মায়া কেন জমা হলো?
আরমিনের বাচ্চা সুলভ কথায় শব্দ করে হাসলো সুহাইল।বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশটায় দাঁড়ালো।আজকে চকচকে রোদের ঝিলিক ফেলছে জানালার কাঁচে,আকাশটাও গাঢ় নীল।
– মায়া কী শুধু তোমার আছে আমার নেই?আমার বাম পাশের বিছানাটা খালি পড়ে থাকবে।হালকা অনুভব হবে বুক পাটা।আমিও একজনকে খুব মিস করবো,মিস করবো তার হাসি,কান্না,আর বায়না গুলো।সময় তো বেশি না।যত দ্রুত সম্ভব আমি ফিরে আসবো মরিয়ম।কথা দিচ্ছি ফিরে আসবো!
_
– আসবো ভাইয়া?
– এসো ভাবী।
আরমিন ঝটপট রুমে প্রবেশ করে বসে পড়ে সিয়ামের পাশে।ছেলেটা জুতার ফিতে বাঁধছে আরমিনকে দেখে নত মস্তক উপড় করে।
– কিছু বলবে ভাবী?
– হ্যা।তোমার ভাইয়ার যত্ন নিও।আমাকে টাইম টু টাইম ফোন করে জানাবে কি অবস্থা তার।তুমি নিজের যত্ন নিও ফুফার যত্ন নিও।
– জানতাম এটাই বলবে।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক ঠাক ভাবে সম্পূর্ণ হবে।ভাইয়া ফিরে আসার পর তোমাদের জন্য উপহার রেডি রাখবো।
– কিসের উপহার?
– দেওর হিসেবে বিয়েতে কিছু দিতে পারিনি তাই বলে কি পরেও দিবো না।তোমাদের হানিমুন প্যাকেজের ব্যবস্থা করে দিবো।
সিয়ামের মুখে হানিমুনের কথা শুনে গলা খেঁকিয়ে কাশতে থাকে আরমিন।সিয়াম জড়তা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসে।
বেলা বারোটার কাছাকাছি বাড়ির বাইরে একটি কার অপেক্ষায় আছে।সুহাইল,সিয়াম,বারেক এক্ষুনি ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবে।আরমিনের সঙ্গে শেষ বারের মতো বিদায় নিতে রুমে ফেরে সুহাইল।
– বিছানার তোষকের নিচে কয়েক হাজার টাকা রেখেছি।অলসেমি করবে না যা লাগবে খরচ করবে।আম্মুর কাছে লজ্জা পাবে না যখন টাকা লাগবে বলবে।যখন যা প্রয়োজন আম্মুকে জানাবে।আমি কিন্তু সব খোঁজ খবর নেবো।আমাকে ফোনে না পেলে সিয়ামকে ফোন করবে।সব শেষে নিজের যত্ন নেবে।পড়াশোনা মন দিয়ে করবে।
মেয়েটার মস্তকের পেছনটায় আকড়ে ধরে সুহাইল।শব্দ করে চুম্বন বসায় মসৃণ কপালটায়।আরমিন সুহাইলকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।নিশ্চুপ ভাবটা উবে গেলো এক নিমিষে কেঁদে ফেললো ঝরঝরে।
– আমাকে ছেড়ে না গেলে হয় না সুহাইল?
– না হয় না।
আরমিনের কান্না থামলো না বরং দিগুন বাড়লো।সুহাইলের খারাপ লাগছে।ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে সে।তবুও আরমিনের সামনে নিজেকে দৃঢ় রাখার চেষ্ট চালিয়ে যায়।
– এইরে আমার বুকটা ভাসিয়ে দিলে নোনা জলে।
– এই বুক ভাসানোর জন্য আমি যখন থাকবো না তখন বুঝবেন আমার চোখের জলের কতটা মূল্য।
সুহাইল খিটমিটে হাসলো।আরমিনকের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে।একে একে জাবির সহ সুহাইলকে বিদায় জানাতে মাতবর বাড়ির সবাই উপস্থিত।ভরা মজলিসে দেখা গেলো পবনকেও।কিন্তু তাতে খুব একটা মন বসালো না আরমিন।তার দু’চোখের আকুলতা ঘিরে আছে সুহাইলের মাঝে।সুহাইল এগিয়ে গেলো জাবির মাতবরের কাছে।
– সবার খেয়াল রাইখেন আংকেল।আপনি আছেন বলেই আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারছি।
– তুমি সাবধানে যেও বাবা।
সবাই এগিয়ে গেলো সুহাইল দরজা খুলে বসে পড়লো গাড়িতে।সিয়াম ইশারায় ডকালো আরমিনকে এক গাল হেসে ইশারায় বলে,
– ভাবী জাস্ট তিনমাস তারপরেই বিশাল সারপ্রাইজ।
কান্নার মাঝেও হাসলো আরমিন।সুহাইল মাথা বের করে আরমিনের হাতটা আকড়ে ধরে।
– আল্লাহ হাফেজ মরিয়ম।আমি ফিরে আসবো তোমার দোয়ায় আমায় রেখো।
– আল্লাহ হাফেজ।
গাড়ি ছুটলো আপন গন্তব্য।আরমিন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো গেটের সামনে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণি দাঁড়িয়ে থাকলো সে।চোখ থেকে আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।মেয়েটা জানলো না তার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।পবন এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো আরমিনের দিকে।আপন মনে তাচ্ছিল্য হাসলো সে।
– আমি কাঁদি তোর জন্য তুই কাঁদিস আরেক জনের জন্য।আমার জগৎটাই উলটা পালটা,এবড়োখেবড়ো খানিকটা বেহায়া ধাঁচের।
#চলবে
#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪৩(ক)]
_________________
গুরুত্বপূর্ণ কাজে আজ ভার্সিটিতে আসতেই হলো পবনকে।এতদিন পড়াশোনা নামক আপদ্ থেকে দুরে থাকলেও বন্ধুদের রেষারেষিতে আবারো ভার্সিটিতে আসতেই হলো।মাঠের এক প্রান্তে গাছের কাছে বসে সিগারেট হাতে বন্ধুদের সাথে টুকটাক কথা বলছিলো সে।আগের মতো আনন্দরা জীবনে ধরা দেয় না তার।সারাটা দিন কাটে বিস্বাদে।ঢিলে ঢালা বোরকা নেকাব পরাহিত একটি মেয়ে এগিয়ে এলো পবনের দিকে।চোখ দুটি পরিচিত লাগলেও পবন শুরুতে চিনতে পারলো না মেয়েটা কে।
– কেমন আছেন পবন সাহেব?
সেই পরিচিত কন্ঠ।মেয়েটা এক ঝটকায় মুখ থেকে নেকাব সরায়।পবনের দিকে তাকিয়ে ডাঁটিয়াল হাসে।পবন আড় চোখে তাকালো বন্ধুদের দিকে।বন্ধুরা টুম্পাকে দেখে পবনের মতো শকে আছে।
– কি হলো আমার কথার উত্তর দিলে না।কেমন আছো পবন।
– ভালো।
– কেমন ভালো নেশা খোরের মতো ভালো।ছি ছি ড্যাশিং বয় পবনকে এমন বিদঘুটে লাগে কেন দেখতে।চোখের নিচে এক থাবা কালি,দু’গাল দাড়িতে গিজগিজে অবস্থা,দু’ঠোট কালো কুচকুচে বাহ বাহ কেয়াবাত।কাবির সিং হয়ে গেলে নাকি?
পবন প্রত্যুত্তর করলো না।রিজু সায়মন বেশ ভালোভাবেই বুঝেছে টুম্পা পবনকে খোঁচাতেই এসেছে।
– তা টুম্পা এখানে কি খোঁচাখুঁচি করতে এসেছো নাকি?
সায়মের রুক্ষ স্বর।টুম্পা মিহি হাসলো।
– আরে না খোঁচাখুঁচি করে আর কি হবে?পবনের এই অবস্থা দেখে মনটা জুড়িয়ে গেলো।আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো না।এক পাক্ষিক ভালোবেসেই গেলাম।
– পবন তো তোমায় ভালোবাসার সম্ভাষণ দেয় নি।বরং তুমি নিজেই ফোর্স করে ভালোবেসেছো।
– আমার কি কমতি ছিলো?এরপর এতটা মাস একসাথে কাটিয়েছি দুজন, তখন কি ভালোবাসা যে তো না?
– গা-জা না খেয়েও কি গা-জার পিনিক নিয়ে এসেছো নাকি?এসব কথা বলতে চাইলে রাস্তা খালি আছে নিজের কাজে নিজে যাও আমাদের বিরক্ত করবে না।
রিজুর কথায় মুখটা থমথমে হয়ে যায় টুম্পার।তাদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো পবন।টুম্পার সাথে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় কথা বলে সে,
– তোমার হাজবেন্ড কেমন আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো।কপাল করে এমন স্বামী পেয়েছি যিনি আমাকে বুঝেন আগলে রাখেন।
– আমি ছেড়ে গেছি বলেই এমন স্বামী পেয়েছো।
পবন কথাটা বলে মিহি হাসলো তার সাথে খিটমিটিয়ে হাসলো রিজু,সায়মন।টুম্পার রাগ দ্বিগুন বাড়লো।চোখে চোখ রাখলো পবনের।
– তুমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নও পবন।তাই তো আরমিন ছেড়ে চলে গেছে।বেচারি মেয়েটা বেঁচে গেছে শুনলাম বড়লোক বাড়িতেই বিয়ে হয়েছে রাজরানী করে রেখেছে তাকে।
– আরমিনকে আমি ধরে রাখিনি যে সে আমায় ছেড়ে যাবে।আরমিন হলো মুক্ত আকাশের পাখি যখন যে পোষ মানায় তার কাছেই থাকে।
হাতের সিগারেটা ছুড়ে ফেলে পবন উলটো পথে হাটা শুরু করে।টুম্পার কথাগুলো কাঁটা তারের মতো বিঁধছে বুকে।
.
চোখের পলকে কেটে গেলো দেড় মাসের বেশি সময়।আরমিনের পরিক্ষা শেষ হয়েছে গত সাপ্তাহে।দেড় মাস সময়টাতে আরমিন ভুলেও পবনের সঙ্গে দেখা করেনি।মাতবর বাড়িতে গেছে হাতে গনা দু’দিন।
রাত দশটার পর খাওয়া দাওয়া শেষে সুহাইলকে ফোন করে আরমিন ছেলেটা তখন অনলাইনেই ছিলো।
– কেমন আছো মরিয়ম?
– বেশ ভালো।আপনি কেমন আছেন?
আরমিনের প্রশ্নে উত্তর দিলো না ছেলেটা।নিরবতায় কেটে গেলো খানিকটা সময়।
– আমি ভালো তবে মন ভালো নেই।
– কি হয়েছে আপনার?
– তোমায় মিস করছি অনেক অনেক বেশি মিস করছি।আম্মুকে মিস করছি।
– আমিও আপনাকে মিস করছি সুহাইল।কাজ শেষে দ্রুত ফিরে আসুন।
আবারো নিরবতা ঘিরে ধরলো দুজনের মাঝে কেউ কোন কথা বললো না।চুপচাপ কেটে গেলো কিছুটা সময়।আরমিনের কানে এলো সুহাইলের দীর্ঘ শ্বাস।
– ফিরে আসলে ভাবছি আবার কুয়াকাটা যাবো আমি সেই দিন গুলো মিস করছি।
– না আমরা পাহাড় দেখবো সুহাইল।উচু পাহাড়ে দু’জন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো উপভোগ করবো পাহাড়ের নিরবতা।
– বেশ তবে তাই হবে।তোমায় আজ বড্ড মিস করছি।
– আর কতবার বলবেন বলেন তো?
– জানি না
আবারো চুপচাপ দুজনে।সুহাইলের কোলে ল্যাপটপ সে গাঢ় দৃষ্টিতে দেখছে আরমিনকে।কুয়াকাটায় ঘুরতে যাওয়া ছবিগুলো বার বার জুম করে দেখছে।
– তুমি কাদলে তোমায় খুব সুন্দর লাগে।
আনমনে কথাটি বললো সুহাইল।আরমিন হকচকালো মিহি হেসে প্রত্যুত্তর করে,
– তাই নাকি তাহলে আমি কাঁদলে বকেন কেন?
– আর বকবো না।এবার থেকে তুমি যত ইচ্ছে কাঁদবে আর আমি দেখবো দু’চোখ ভরে।চোখ,নাক লাল টমেটোর মতো টসটসে মুখে যখন তাকাবে আমার দিকে, আমি তখন টুপ করে চুমু খাবো কপালে।
আরমিন খিলখিলিয়ে হাসলো এভাবে কেটে গেলো অগনিত সময়।সুহাইল আজ ফোন ছাড়লো না।আরমিন যখন ঘুমিয়ে পড়ে,তখন ঘুমানোর মাঝেও মেয়েটার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকে।
_
সেদিনের পর পেরিয়ে গেলো সাতদিন। সুহাইলের সাথে গত সাতদিন যোগাযোগ হয়নি আরমিনের।অবশ্য সিয়ামের সাথে কথা হয়েছে।সিয়াম বলেছে সুহাইল ব্যবসায়ীক কাজে একটু বেশি ব্যস্ত।বিষয়টি জানতে পেরে আরমিন আর বিরক্ত করেনি সুহাইলকে।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ওযু করতে পুকুর পাড়ে নামে আরমিন।সেই সময়ে বাড়িতে তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করে জাবির মাতবর।
– আরমিন তোর আম্মা কই?
– ঘরেই আছে আংকেল।কেন বিশেষ দরকার?
জাবির মাতবর খানিকটা ইতস্ত হলেন।মানুষটার মুখখানি কেমন ফ্যাকাশে লাগলো আরমিনের কাছে।
– তোর আম্মা কই তারে বলতাম।
– আমি ডেকে দি আসেন ঘরে আসেন।
জাবির পিছুপিছু গেলো আরমিনের।মুখোমুখি হলো ফারজানার।
– আপা ভালো আছেন?
– জী ভাইজান আসেন বসেন।
জাবিরের কথা শুনে ছুটে এলো সালেহা।আরমিনকে চা বসাতে ইশারা করে দাড়ালো জাবিরের সামনে।
– ভাইজান দরকারি কথা নাকি?
– দুজনে আছেন যখন তখন বলেই ফেলি।আগামী কাল হয়তো বা দুপুর নাগাদ বিদেশ থেকে সুহাইলরা কেশবপুরে আসবে।তারা ইতোমধ্যে রওনা হয়েছে।
জাবিরের কথায় মুখ কুচকে যায় ফারজানার।নিজের স্বামী-পুত্র বিদেশ থেকে আসবে অথচ তিনি জানেন না তাজ্জব ব্যাপার।
– সুহাইলের বাবা কিংবা সুহাইল তো আমাকে কিছু বলেনি।তাছাড়া গত তিনদিন তাদের সাথে আমার কথা হয়নি।সিয়ামের সাথে হয়েছে সে বলেছে তারা নাকি মিটিং এ ব্যস্ত।হঠাৎ দেশে আসবে কারন কী?
– সেসব আমি জানি না।আমাকে বারেক বলেছে তারা আসছে দেশে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।আমি আর আছীম কাল ভোরেই রওনা হবো ঢাকার উদ্দেশ্য।
– তাহলে বেশ ভালোই হয় আপনারা গেলে চিন্তা মুক্ত হই।
ফারজানা হাসলেন সালেহা চুপচাপ তাকিয়ে ছিলেন জাবিরের মুখ পানে।মানুষটাকে দেখতে কেমন যেন চিন্তিত লাগছে।ততক্ষণে চা হাতে উপস্থিত হয় আরমিন।
– বড় আংকেল চা নেন আমি বানিয়েছি।
জাবির তৎক্ষণাৎ খুশি হলেন, আরমিনের হাত টেনে এনে বসালেন তার পাশে।মাথায় হাত বুলিয়ে ঢোক গিলে বলে,
– তোর হাসি দেখলে আমার কলিজা জুড়ায় মা।আমার বাড়িতে এখন আর যাস না কেন?পর হয়ে গেছি আমরা?
– না আংকেল এমনি যাওয়া হয় না।বলেছো যখন কাল একবার যাবো।
– তোর পছন্দের ময়ূর কবুতর জোড়া বাচ্চা দিয়েছে।দেখে আসিস।
আরমিন পুলকিত হয়।খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে তার চোখ মুখ।
– আমি নিশ্চই যাবো।
জাবির চলে গেলেন।আরমিন নামায শেষে রান্না ঘরের দিকে যায়।
– আম্মা আংকেল কি বলে গেলো?
– কাল নাকি সুহাইল আসবে।তোকে কিছু বলেছিলো?
– কই না তো।সিয়ামের সাথে কাল কথা হয়েছে সে আমায় কিচ্ছু বলেনি।
ফারজানা মিহি হাসলো।আরমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– হয়তো আমাদের চমকে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমরা তো জেনেই গেলাম।
_
আজকের সকালটা একটু বেশি সুন্দর! না কী আরমিনের কাছে বেশি চমকপ্রদ লাগছে।হয়তো তার কাছেই লাগছে।সকাল থেকে রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে ফারজানা এবং সালেহা।আরমিনকে রূপচর্চার কাজে ব্যস্ত রেখেছে রিহানা।কিছুক্ষণ পর পর এটা ওটা নিয়ে রুমে আসছে।কিছুক্ষণ আগেই আলুর রস নিয়ে আরমিনের মুখে মাখিয়ে দিয়েছে।এখন এনেছে চন্দনের পেস্ট।
– রিহানা এসব অসহ্যকর কাজ তোকে কে শিখিয়েছে বলতো?
– আহ আপু এত প্রশ্ন করো না।চন্দন লাগাও দেখবে মুখটা কি চকচক করবে দুলাভাই আজ চোখ ফেরাতে পারবে না।সময় বেশি নেই এগারোটা বেজে গেছে।
রিহানা যত্ন সহকারে আরমিনের মুখে চন্দন লাগিয়ে দিলো।সময়টা কেটে গেলো চোখের পলকে আরমিন গোসল সেরে সুহাইলের দেওয়া সেই হলুদ শাড়িটা গায়ে জড়ালো।কানে পড়লো স্বর্নের ঝুমকো।গলায় সীতা হার দিয়ে হালকা সেজে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
– আপুরে কি সুন্দর লাগছে।
– দূর বেশি কথা বলিস না।আমি মাতবর বাড়িতে গেলাম।ময়ূর কবুতরের নাকি বাচ্চা হয়েছে দেখতে যাবো।
– যাও দ্রুত এসো।
আরমিন বহুদিন পর মাতবর বাড়িতে প্রবেশ করে।নাহার বেগম আজ মেয়েটাকে একটুও এড়িয়ে যায়নি বরং হাত টেনে বুকে জড়িয়েছে।আমীনাও ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে ঠেসে দিয়েছে আরমিনের মুখে।
– তোকে কি সুন্দর লাগছে রে আরমিন।সারাজীবন চেয়েছি তুই বড় বাড়িতে যা।তোর মায়ের কপালে সুখ আসেনি কিন্তু তোর কপালে যেন সুখ ফিরে।তোর সুখ দেখে তোর মা মরলেও শান্তি পাবে।
নাহার বেগমের কথায় খানিকটা হাসলো সে।নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী লাগছে সুহাইলের মতো জীবন সঙ্গী তার পোড়া ভাগ্যে ধরা দিয়েছে।
.
দুপুরের সময়টায় ছাদে কড়া রোদ।মাথায় আঁচল চাপিয়ে কবুতরের খুপরির কাছে যায় আরমিন।খুপরির মাটির থালার উপর বসে আছে দু’টো কবুতরের বাচ্চা।
– ওমা কি সুন্দর!এই তোরা বড় হলে আমি নিয়ে যাবো, আমার কাছে থাকবি?জানিস তোদের মা বাবার কি যত্ন করেছি আমি ইসস তোদের যত্ন করতে পারবো না রে সময় হবে না।তোরা বড় হয়ে যা আমি আমার কাছে নিয়ে আসবো।
– দিবো না আমি।এই কবুতর জোড়া আমি কিনেছিলাম সেই কবুতর বাচ্চা হলে সেই বাচ্চা গুলোর মালিক আমি তুই কেন নিবি?
পবনের কথায় চমকে পেছনে তাকায় আরমিন।ছাদে যে পবন ছিলো একটুও টের পেলো না সে।কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না তাই ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো পবনের দিকে।ছেলেটার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
– স্মোক করতে হলে দূরে যাও পবন ভাই আমার গন্ধ সহ্য হয় না।অসহ্য লাগে।
– অথচ তোর অসহ্যটা আমি সহ্য করছি।
– মানে?
– কিছু না।আমাকে দেখলে পালিয়ে যাস কেন?
– তুমি তো বললে দূরে থাকতে।
পবন চুপ রইলো কিয়ৎক্ষণ।সিগারেটটা ছুড়ে ফেললো ছাদের কোনায়।
– প্লাবন তোকে সব বলেছে তাই না?মে-রে পিঠের চামড়া তুলে নিয়েছি এত পাকনামি কেন করেছে।
– প্লাবনকে মে-রেছো?
– হুম।
পবন আবারো চুপ হয়ে যায়।অদ্ভুত ভাবে দু’চোখ ঝাপিয়ে অশ্রু পড়ছে।ভীষণ জ্বালা করছে চোখ গুলো।বুকের ভেতর হৃদযন্ত্রটা কেউ যেন খুবলে খাচ্ছে।ধরা গলায় পবন বলে,
– আরমিন একটা কথা বলবি আমার কসম লাগে,শুধু এই কথাটা জানা আমার বহু দিনের শখ।বলবি?
– ক…কি?
– তুই কি আমার প্রতি দূর্বল ছিলি না?আমার প্রতি ইমোশন কাজ করেনি তোর?
আরমিন ভড়কালো।পিছিয়ে গেলো দু’পা।ইতস্তবোধ করছে সে।
– এসব এখন বলে কী লাভ আমাকে যেতে দাও।
– একদম না আমার কসম লাগে যা জানতে চাইছি সত্যটা বল।
– ছিলো পবন ভাই কিন্তু এসব বলে এখন লাভ নেই।আমার স্বামী আছে আর বর্তমানে আমি আমার স্বামীকেই ভালোবাসি।অতীত ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই।
পবন চুপচাপ তাকিয়ে রইলো আরমিনের দিকে।বিচারের কাঠগড়ায় সে নিজেই দোষী।সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় বিষয়টা পবনের সাথে তেমনি হয়েছে।আরমিনে সামনে নিজেকে সামলে নিলো সে এখন তার দুঃখ গুলো আরমিনের কাছে নাটক ছাড়া কিছুই মনে হবে না।
পবন আগাগোড়া দেখে নিলো আরমিনকে।মেয়েটা আজ হালকা সেজেছে কিন্তু তার মাঝে সৌন্দর্যের কমতি নেই।না তাকে হয়তো এতটাও সুন্দর লাগছে না কিন্তু পবনের চোখে তাকে বরাবরি স্নিগ্ধ মায়াবী লাগে।
– এমন ক্যাটক্যাটে হলুদ শাড়ি তোকে কে দিয়েছে?একদম বিশ্রি রঙ!একটুও মানায়নি তোকে।বুঝলি,তোর মানুষটা রং নির্বাচনে কাঁচা।তোকে কোন রঙ মানায় সেটাও বুঝেনা অপদার্থ!
পবন অলস পায়ে হেটে নিচে চলে যায় আরমিন থমকে যায় ঠিক এমন ভাবেই নাক উঁচিয়ে পবন আরো একবার তাকে হলুদ শাড়ি নিয়ে খোটা দিয়েছে।চকচকে এই হলুদ রঙটা কি আসলেই তাকে মানায় না।নাকি রঙটা পবনের পছন্দ নয়?
#চলবে