মায়াপ্রপঞ্চ পর্ব-৩৪,৩৫

0
480

মায়াপ্রপঞ্চ পর্ব-৩৪,৩৫
#পলি_আনান
৩৪

তোমরা ঠিক ঠাক ভাবে পৌঁছে গেছো ভাইয়া?
– হুম সব ঠিকঠাক।আম্মুকে বলবা চিন্তা না নিতে।
– খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক ভাবে করো।আর আমার ভাবীর যত্ন নেবে কিন্তু।
সিয়ামের কড়া নির্দেশে স্মিথ হাসে সুহাইল।ছেলেটা ইদানীং ভাবী-ভাবী করে মুখের ফেনা তুলে ফেলে।
– তুমি চিন্তা নিও না সিয়াম।আম্মু-আব্বুর দায়িত্ব তোমায় দিয়ে এলাম।আর আমার ইমেল চেক করো।আমি তো এখন সময় পাবো না ঠিকঠাক।
– ওকে, অলদা বেস্ট ভাইয়া।
সুহাইল ফোন কাটলো এগিয়ে গেলো বান্দার দিকে।পর্দা তুলে দিতেই কাঁচের দরজা গলিয়ে সূর্যের সোনা রোদ ঝিকিমিকি খেলছে।সকাল সাতটার কাছাকাছি কুয়াকাটা চৌরাস্তায় বাস থামে।আগে থেকে রুম বুকিং রাখায় বেশি বেগ পোহাতে হয়নি তাদের।সরাসরি ‘সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টেই’ উঠে তারা।সফেদ বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা ঘুমে কাবু আরমিন।ঘড়ির দিকে একবার তাকালো সুহাইল সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি।আরমিনের এই মুহূর্তে ঘুম ভাঙ্গানো জরুরি।অযত্নে এলোমেলো এক গোছা বেনুনি এলিয়ে আছে বালিশের কাছে,সুহাইল চুল ঠিক করে আরমিনের হাতে হাত রাখলো,
– এই যে মরিয়ম আপনি উঠবেন না?আগামী দিন গুলো আপনার জন্য প্রতিটা মুহূর্তের সৌন্দর্যেরা অপেক্ষা করছে।অপেক্ষা করছে বিশ্বাস্ত মানুষটার হাতে হাত ধরে সমুদ্রের পাশে হাটার।ঘুম পরীরা জলদি জলদি আমার বিবির মুখ ভাঙ্গিয়ে দিন।
সুহাইলের কথাগুলো কানে আসলো আরমিনের।সে এতক্ষণ জেগেই ছিলো।অলসতা কাজ করায় বিছানা ছাড়েনি।সুহাইলের কথার ভাব ভঙ্গিমায় মিহি হেসে চোখ খুললো।

– ওহ আপনার ঘুম ভেঙ্গেছে।চলেন ফ্রেশ হয়ে নিবেন।কিছু খেতে হবে।
আরমিন উঠে বসলো গায়ে ওড়না জড়িয়ে বিছানা থেকে নামলো ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে সুহাইল তার হাত টেনে কাঁচের দরজা সরিয়ে বারান্দার সাইডে দাড় করায়।আরমিনের ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়।
– আমি কাছে আসলে এখন আর জড়তা হয় না তোমার?
সুহাইলের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় আরমিন।খনিকটা সরে রেলিং ঠেসে দাঁড়ায়।সুহাইল কোমড়ে হাত গুজে পেলব দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটার দিকে।ফোলা চোখে মুখে লজ্জার আভাস লাহমায় ছড়িয়ে যায়।
– আমার সন্দেহ হয় জানেন।
– কী সন্দেহ?
– আপনি তো দেশের বাইরে থাকেন তাও কানাডায়।এমনো তো হতে পারে আপনি বিবাহিত দেশে এসে আরেক বিয়ে করেছেন আচ্ছা এটাও তো হতে পারে আপনি ভা-র্জি-ন নন।স্যরি টু স্যা, হতেই পারে।
সুহাইল কিছু সময় মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে থাকলেও কালবিলম্বে হো হো শব্দে হেসে উঠে তার হাসিটা গায়ে মাখলো না আরমিন।তার দৃষ্টি বাইরে।সুহাইল এগিয়ে এলো দু’হাত আবদ্ধ করে নেয় রেলিং এ।তার বন্ধনীতে আটকা পড়ে আরমিন।মেয়েটার উড়ন্ত চুল তার মুখে এসে হুঁটোপুঁটি খেলছে।
– আমি ভা-র্জি-ন তবে মনের দিক থেকে নয়!
– মানে?
– মনটা দুষিত করে দিয়েছো তুমি।
কথাটা বলে আবার হাসলো সুহাইল।আরমিন বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে সুহাইল তাকে বেশ নাস্তানাবুদ করছে।
– অসভ্য!
– আমি সভ্য ছেলে কিন্তু তোমার সামনে পড়লে সভ্যতা লোপ পায়।অসভ্যতা মাথা চড়ে বসে।
আরমিন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সুহাইলকে হঠাৎ কেন জানি মারাত্নক ভাবে রাগ উঠেছে তার।ব্যাগ থেকে জামা নিতে নিতে রাগ ঝারতে ব্যস্ত সে।
– আমার সামনে এলে একদম অসভ্যতা করবেন না।
– অন্যর বউয়ের সাথে করেছি নাকি?আমি আমার বউয়ের সাথে করেছি।তাছাড়া অসভ্যতা কখন করলাম?কবে করলাম?আমার তো মাথায় আসছে না।যা করছি এটা তো কিছুই না।
– অন্যদের সামনে এত ভদ্র সাজেন কি করে বলেন তো?দু’মুখো রূপ নিয়ে চলেন।আর আমার সামনে এলেই অসভ্যতা শুরু।মিচকা শ/য়/তা/ন।
– এই শুনো বিয়ের পর মেয়েরা অত-শত ভদ্র ছেলে পছন্দ করে না।অভদ্র ছেলেই পছন্দ করে।মেয়েদের সাফ সাফ রুলস অভদ্রতা করো তবে বউয়ের সাথে এর বাইরে নয়।তাই বউয়ের সাথে বে/হা/য়া,অভদ্র সবটা হওয়া যায়।
– তো?আমি ভদ্র কাউকেই চাই।
– আমার সাথে থাকতে থাকতে তুমিও অভদ্র হয়ে যাবে মিলিয়ে নিয়ো।তখন দুইয়ে দুইয়ে চার হবে।
সুহাইল কনফিডেন্স সহকারে কথাটা বললো আরমিন ভাব নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে বেশ শব্দ করে।

রিসোর্টের বাইরে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা আছে।লেকের পাড়ে বড় বড় বৃক্ষের নিচে সারি সারি টেবিল সাজিয়ে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা করা হয়।পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে অবস্থানটা বেশ সুন্দর।সামনে একটা পিৎজা নিয়ে চারজনেই ভাগাভাগি করে হালকা নাস্তা সারছে।পিৎজার স্লাইসে কামড় বসিয়ে সুহাইলের উদ্দেশ্য শুধালো মাফী,
– আমার পরিচিতো গাইড থেকে দুটো বাইক ভাড়া করেছি একটা তোর আরেকটা আমার।
– গুড।তবে সাথে গাইড রাখা জরুরি।আমি তো কুয়াকাটার তেমন কিছু চিনি না।
– গত তিন বছর আগেও ঘুরে গেছি এখান থেকে আমার বেশ পরিচিত।
আরমিন গোলগোল চোখ নিয়ে তাকালো মাফীর দিকে।বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,
– তাই নাকি?আমার মনে আছে মনি আমাকে আচার দিয়েছিলো তার ভাই নাকি সমুদ্রে গেছিলো ঘুরতে।
– তোমায় কত ছোট দেখেছিলাম আরমিন তাও একবার স্কুল মাঠে তখনো কি জানতাম তুমি আমার বন্ধুর সেই মরিয়ম।অদ্ভুত!
আরমিন আড় চোখে তাকালো সুহাইলের দিকে।সুহাইলের ভাব ভঙ্গিমা পাল্টালো না।সে খাবার নিয়েই ব্যস্ত।
– চলো আজ গোসল করবো সমুদ্র।এর পরে বাকি জায়গা গুলো ঘুরে দেখবো।
রাত্রির কথায় তাল মেলায় আরমিন মেয়েটার আগ্রহ দেখে সুহাইলের বেশ ভালো লাগছে।এখানে আসা যেন তার জন্য চরম সার্থকতা।

গায়ের শার্ট থেকে মারাত্মক ভাবে ঘাম এবং সিগারেটের গন্ধে তার পাশে দাঁড়ানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে জাবিরের।ছেলেটা এমন ভাবে ভেঙ্গে পড়বে জীবনেও ভাবেননি তিনি।রুম জুড়ে সিগারেটের গন্ধ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।সফেদ রঙের ব্যান্ডেজটায় লাল র-ক্ত সাদৃশ্যমান।
– এভাবে তোমার জীবন চলবে?তোমার মাথা সেদিন আঘাত পেয়েছে গভীর ভাবে তুমি আজ কি করলে,দেয়ালের সাথে মাথা প্রহার করলে।পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে আবার রক্ত ঝরছে এসব কি শুরু করেছো তুমি?
পবন নিস্তেজ ভঙ্গিতে কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে।জাবির মাতবরের কোন কথাই যেন তার কানে ডুকছে না।
– আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করছি।
– উত্তর দিতে ইচ্ছুক নই আমি রুম থেকে যান।আমাকে একা থাকতে দিন।
– ব্যান্ডেজ ভেসে যাচ্ছে রক্তে।
– তো?
পবনের ত্যাড়ামো দিন দিন বাড়ছে।এভাবে তিনি সইবেন না।যতই নিজেকে শান্ত,দায়িত্বশীল মানুষ সাজায় ভেতরে ভেতরে তিনি বেশ রাগি।কিন্তু আদরের বড় ছেলে।আগে তো সে এমন ছিলনা।নিজের বাবাকে সম্মান করতো আর এখন সবটা উবে গেলো।এভাবে তিনি বেশি সহ্য করবেন না এ বাড়িতে থাকতে হলে ভালোয় ভালোয় থাকবে না হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় করবেন।পবনের দিকে আরেকবার তাকিয়ে জাবির বিরক্ত হলো চেঁচিয়ে ডাকলো গৃহকর্মী সুমনাকে।নির্দেশ দিলেন দ্রুত যেন রুমটা পরিষ্কার করে ফার্মেসি থেকে ডাক্তার আনা হবে।অতি দ্রুত ব্যান্ডেজ পালটানো জরুরি।
– কোচিং সেন্টার খোলার জন্য যে দু’টো রুম ভাড়া নিয়েছো তার কি হবে?যেহেতু কোচিং সেন্টার খুলতে চাইছো তবে দ্রুত কাজে লেগে পড়ো।এত অতীত ভুলবে।
– দরকার নেই আমার কোন কাজ কর্মের।কোন কাজ আমি করবো না।যার জন্য নিজেকে স্বাবলম্বী করতে চেয়েছি সে এখন আমার নয় আমার এসব কিছু প্রয়োজন নেই।
জাবির মাতবর নিশ্চুপ চেয়ে রইলেন।হাসি আড্ডায় মেতে থাকা ছেলেটা আজ ছন্নছাড়া এই দিন যে তার দেখতে হবে কখনো কল্পনা করেননি তিনি।
– এভাবে কতদিন তোমার নাটক চলবে পবন?

– যতদিন না পুরোনো স্মৃতি ভুলছি।
জাবির উঠে এলো আস্তে ধীরে নেমে এলো নিচের তলায়।সোফায় গা এলিয়ে পড়ে আছেন নাহার বেগম।আমীনা তার মাথায় তেল মালিশ করছে।ছেলের বেগতিক দশাতে তার নিজেরো শারীর অবস্থার অবনতি ঘটেছে।জাবিরের চাহনীতে আমীনার সাথে চোখাচোখি হয়।শ্লেষ হাসলো জাবির।নাহারের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞা নিয়ে মনে মনে বলে,
– তোমার অহেতুক যুক্তির জেদে আমার ছেলেটাও আজ ছন্নছাড়া।
_
বালির উপর গা ভাসিয়ে বসে আছে চারজনেই।চার জনেই ভিজে জুবুথুবু অবস্থা।আরমিন আগ্রহ নিয়ে সবটা জানতে চাইছে মাফীর কাছে। মাফীও বিরক্ত না হয়ে কুয়াকাটা সম্পর্কে সবটা বলছে আরমিনকে।
– মাফী ভাইয়া কুয়াকাটা নামটা শুনেছি কোন কূয়াকে উদ্দেশ্য করে রাখা হয়েছে।
– কুয়াকাটা নামের পেছনে রয়েছে আরকানদের এদেশে আগমনের সাথে জড়িত ইতিহাস। ‘কুয়া’ শব্দটি এসেছে ‘কুপ’ থেকে। কুয়াকাটা নামকরণের ইতিহাসের পেছনে যে কুয়া সেটি এখনও টিকে আছে।
মাফীর কথায় প্রফুল্লচিত্তে তাকালো সুহাইল।এক গাল হেসে বলে,”গ্রেট নিউজ”।আরমিনের হাত টেনে খানিকটা নিয়ে এলো মাঝামাঝি দুজনেই এবার বুক সমান পানিতে অবস্থান করছে।
– দোস্ত কুয়াতে কবে ঘুরতে যাবো।
– কাল চল আজ না।
মাফীর কথায় আরমিন ঘুরে তাকালো।চোখ মুখ কুচকে সন্দিহান স্বরে বলে,
– কাল কেন?আজ গেলে কী হবে?
– আজ না গেলে কী হবে?
– ভারী অন্যয় হবে।এখানে আমরা বিশ্রাম নিতে আসিনি ঘুরে ফিরে সময় ব্যয় করবো।
– বাপরে বিজ্ঞ ব্যক্তির আবদার না রেখে পারা যাবে না।তবে আজি যাবো দ্রুত গোসল সেরে উঠা উচিত আমাদের।
– ঠিক আছে তবে আমি কুয়াকাটার ইতিহাসটা জানতে চাই।
আরমিনের কথায় তাল মেলালো সুহাইল এবং রাত্রি।মাফীর চোখে থাকা প্লাস্টিকের চশমাটা খুলে কথায় মনোযোগী হলো,

– কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছে রাখাইনদের বাসস্থল, কেরানীপাড়ার শুরুতেই প্রাচীন কুয়ার অবস্থান।ধারণা করা হয় ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরকানরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে আর তাদের মাধ্যমেই এই স্থানটির নামকরণ হয় কুয়াকাটা।লোকে বলে,১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ রাজা বোদ্রোপা আরকান জয় করে রাখাইনদের ওপর অ-ত্যা-চার ও নি-র্যা-তন চালায়। ১৫০টি রাখাইন পরিবার বার্মিজদের হাত থেকে মুক্তির জন্য ৫০টি নৌকায় তিনদিন তিনরাত বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা থানাধীন মৌডুবি এলাকায় উপস্থিত হন।সেই অঞ্চলটি তখন বন জঙ্গলে ভর্তি ছিল। তারা বনের হিং-স্র জীব জ-ন্তু-র সঙ্গে যু-দ্ধ করে, জঙ্গল কে-টে পরিষ্কার করে ধান ফল-মূলের বীজ বপন করে জীবিকা নির্বাহ করতোম।তখন নাকি ওই বনের কোনো নাম ছিল না হয়তো থাকলেও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন তার নাম জানত না। যার ফলে সাগর পাড়ি দিয়ে ওই স্থানে বসবাস শুরু করায় রাখাইন ভাষায় তারা নামকরণ করে কানশাই। কিন্তু রাখাইন লোকজন এখানে বসবাস করলেও তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাড়ায় পানি। সাগরের পানি লবণাক্ত হওয়ায় তা খাওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য তারা নিজ উদ্যোগে একটি কুয়া খনন করে তা থেকে মিঠা পানি পান করত। মিঠা পানির কুয়ার নামানুসারে স্থানটির নামকরণ হয় কুয়াকাটা।কুয়ার সন্নিকটেই তারা স্থাপন করে ৩৭ মণ ওজনের ধ্যানমগ্ন অষ্টধাতুর বৌদ্ধ মূর্তি। মন্দিরের নির্মাণ সৌন্দর্যে ইন্দোচীনের স্থাপত্য অনুসরণ করা হয়। দেখলে মনে হবে থাইল্যান্ড, লাওস বা মিয়ানমারের কোন মন্দির। প্রায় সাড়ে তিন ফুট উঁচু বেদির উপর মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে ৮৩ বছর পূর্বে অষ্টধাতুর ওই মূর্তিটি ওই স্থানে স্থাপন করা হয় বলে রাখাইন সম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়। প্রায় ৭ ফুট উচ্চতার এ বৌদ্ধ মূর্তিটি স্থাপন করেন উপেংইয়া ভিক্ষু। মন্দিরের নীচেই হচ্ছে ঐতিহাসিক কুয়াটি। বর্তমানে সেই কুয়ার পানি খাওয়ার অনুপযোগী অর্থাৎ পরিত্যক্ত। তারপরও কুয়াকাটার ঐতিহ্য ধরে রাখতে কুয়াটিকে নতুনভাবে সংস্কার করা হয়েছে।

কথাটি শেষ করলে দম ছাড়লো মাফী।আরমিন,এবং রাত্রি আশাহত চোখে তাকালো মাফীর দিকে।তাদের মনেটা খচখচ করছে ইসস যদি কুয়ার পানি তোলা যেতো।কিন্তু কুয়াটি পরিত্যক্ত।
– মাফী ভাইয়া আপনি এত সব জানেন কি করে?
আরমিনের কথায় মাফী হাসলো।চোখে চশমা পড়ে এগিয়ে গেলো সমুদ্রের আরো কাছে,
– বছরের একটা সময় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আমি ট্রেভেল করি।আমার একটা ই’উ’টি’উ’ব চ্যা’না’ল আছে।আমার ঘোরাঘুরির সকল ভি’ডি’ও সেখানে আপ-লো-ড করা হয়।তাই দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে হয়।
আরমিন অবাক পানে তাকায় মাফীর দিকে।আজ প্রশ্নের ঝুড়ি সাজিয়ে বসেছে সে।মাফীর সাথে তার এত সখ্যতায় কেন যেন সুহাইলের মনে ঈর্ষা জাগিয়েছে।সে জানে এটা অহেতুক তবুও কেন এমন লাগছে বুঝতে পারছে না সে।আরমিন পুনোরায় প্রশ্ন করতে উদ্যত হলে সুহাইল তাকে হাত টেনে আরো কাছে আনে।ভেজা চোখে তাকায় আরমিনের দিকে সে চাহনীতে মোহো জড়িয়ে আছে।
– হিসসস আর কোন প্রশ্ন নয়।

বড় বড় ঢেউ গুলো আছড়ে আসছে তাদের দিকে।আরমিন হকচকিয়ে সামনে তাকায় ভয়ে সুহাইলের কাছে খানিকটা এগিয়ে কাঁধ জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।কয়েক সেকেন্ডে একটি ঢেউ এসে পরিপূর্ণ ভিজিয়ে দেয় তাদের।আরমিন খলবলিয়ে তাকায় পেছেনে মাফী নেই,নেই রাত্রিও।অল্প সময়ে তারা কই গেলো।সন্দিহান চোখে বামে তাকাতে লক্ষ্য করলো তারা দূরে একসঙ্গে সময় ব্যয় করছে।আরমিন তাকালো সুহাইলের দিকে ছেলেটা ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
– ওনারা দূরে চলে গেলো কেন?
সুহাইল আবারো হাসলো।পরপর দুটো ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিলো তাদের।সুহাইল আরমিনের কপালে কপাল ঠেকালো স্বগোতক্তি স্বরে বলে,
– কারন এই সময়টা আমাদের একান্ত।
বিশাল বিশাল ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে।পর্যটকেরা দল বেধে গোসল করছে।তারা লাফঝাঁপ করে মাতিয়ে তুলছে সমুদ্রের পাড়।ঝাঁঝালো সূর্যটা মাথা বরাবর কিরণ দিচ্ছে।এখানে কেউ এসেছে পরিবার নিয়ে,কেউ বা কপোত কপোতি। শ’য়ে শ’য়ে স্পিড বোট শাঁ শাঁ করে ছুটে চলছে এক পাশে।এক পাশে দেখা মিললো ওয়াটার বাইক রাইড,এবং ঘোড়ার রাইড অনেকেই আগ্রহ নিয়ে দেখছে সবটা।সাগরের পাড়ে আছে ঘন অরণ্য।পানি বন-বনানী। সেখানে আছে নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলি।আরমিন সবটাই পর্যবেক্ষণ করছিলো আর সুহাইল পর্যবেক্ষণ করছিলো তাকে।আদুরে জল গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার কপাল বেয়ে গালে,ধীরে ধীরে ঢালু হচ্ছে গলার দিকে।অকৃত্রিম সৌন্দর্যের যে রোশনাই তা ফুটে আছে আরমিনের চোখে মুখে।তারা অল্প পানিতে বালির উপর হাটু মুড়ে বসে সমুদ্র বিলাশে ব্যস্ত।কাঁধ সমান পানি টটইটুম্বুর করছে।ধীরে ধীরে ঢেউয়ের গতি বাড়তে থাকে আরমিন গলা পেঁচিয়ে ধরে সুহাইলের।
– ভয় পাচ্ছো?
– একদমি না।
– কেন?
– আপনি আছেন তো!
সুহাইল হাসলো,এ যেন তৃপ্তির হাসি।প্রিয়তমা তাকে ভরসা করে এর চেয়ে আর খুশির কিছু নেই তার কাছে।সুহাইল চাতুর্যে আরেক ধাপ এগিয়ে আনলো আরমিনকে।ক্রমশ তাদের দূরত্ব ঘুচে গেছে।জলের কলতনে অনুভূতিরা আরো চনমনিয়ে উঠে।আদুরে ওষ্ঠে ঠোঁটে জল লেগে থাকায় আরো স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে।সুহাইলের বাধ্য মনটা এবার অবাধ্য হয়ে উঠলো।অবচেতন মন বার্তা দিলো অন্য কিছুর।আরমিনের পিঠে রাখা হাতটা কোমড়ে ঠেকালো সে স্বগোতক্তি স্বরে বলে
– একটা ভুল করি?
– একদমি না।
– করি ভুল?
– না।
– লজ্জা পাচ্ছো?
– যাহ।
সুহাইল হাসলো ঠোঁট কামড়ে তাকালো আরমিনের দিকে।মুখটা কাছে আনতেই আরমিন ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।অনুভূতিরা আজ শীর্ষে বাধা দেওয়ার শক্তি সামথ্য যেন তার নেই।দুজনের নিশ্বাস উথাল-পাতাল শতগুন বেড়ে গেলো।সুহাইল সেকেন্ডে আরমিনের কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো।ছিটকে সরে এলো আরমিনের কাছ থেকে।
আরমিনের হতবুদ্ধি অবস্থা,ভেবেছিলো কি হলো কি।চোখ মুখ কুচকে বিরক্ত নিয়ে তাকালো সুহাইলের দিকে।সুহাই হো হো শব্দে ডা-কাতের মতো হাসছে।আরমিন রেগে অল্প পানির দিকে ছুটে যায় নিজের কান্ডে নিজেরি লজ্জা পাচ্ছে এখন তার থেকেও বেশি হচ্ছে রাগ।সুহাইল হাতটা পেছন থেকে টেনে ধরলো তার।
– দেখলে বলেছিলাম আমার সাথে থাকতে থাকতে তুমিও অসভ্য বনে যাবে।তোমার না সভ্য বর লাগবে।দেখো আমি সভ্য হয়ে গেছি।
– দূর ভাল্লাগেনা।
আরমিন উঠে এলো পাড়ে।সুহাইল মাফীকে দূর থেকেই ডাকলো,
– তোরা কি আসবি নাকি যাবি?
– কিছুক্ষণ পর যাবো।
মাফী ভ্রু কুচকে তাকালো রাত্রির দিকে।রাত্রির হাতে একটা ডাব চোখে কালো সানগ্লাস।
– সুহাইল ব-জ্জা-তটা বাংলাদেশকে এখন অল্পের জন্য কানাডা বানিয়ে দিতো।শা-লা-র মাঝ সমুদ্রে প্রেম উতলে উঠেছে।
– সবাই তো আর তোমার মতো না।নিশ্চই কানাডার বিচে লটরপটর করে এসেছো তাই দেশের বিচে তোমার মন বসছে না।ডাফার একটা।
রাত্রি হাতে ডাব নিয়ে উঠে চললো,মাফী বেকুব বনে তার দিকে তাকিয়ে আছে।রাত্রির সন্দহপ্রবল বিষয়টা বারবার তাকে রাগিয়ে দেয় তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
#চলবে

#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩৫]
_______________
রিসোর্টে ফিরে দুপুরের খাওয়ারটা সেরে রুমে ফিরে আসে চারজনে।ক্লান্ত শরীরটায় কিছু সময় বিশ্রামের প্রয়োজন।তারপর আবারো ঘোরাঘুরি শুরু করতে হবে।সুহাইল হাতে একটা কফির মগ নিয়ে রুমে ফিরে আরমিন একাই বারান্দায় বসে ছিলো তখন।

– কি দেখছো?

সুহাইলের প্রশ্নে ঘুরে তাকালো সে।অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ছেলেটা হাসছে এই প্রশ্নে হাসির কি আছে জানা নেই আরমিনের।

– আপনি হাসছেন কেন?কারনে অকারণে ঠোঁট কামড়ে হাসাটা আপনার বড্ড বাজে স্বভাব।

– হই হই আমার এ বাজে স্বভাব কোন দিন যাবে না।

– দূর ছাই।গানের মানসম্মান লুটে নিয়েছে।

আরমিনের নাক কুচকানো দেখে একই ভঙ্গিতে পুনরায় হাসলো সুহাইল।

– তবে মনমরা করে আছো কেন?

– আমার ফোনে টাকা নেই আম্মার সাথে কথা বলবো।চিন্তা হচ্ছে আমার।

– মামির সাথে আমি কথা বলেছি সকালে।এখন বলবে ফোন দেবো?

আরমিন মাথা নেড়ে সায় দেয়।রিং হতে সুহাইল ফোন দেয় আরমিনের হাতে।

– আম্মা ভালো আছো?

– হ্যা তুই কেমন আছিস?

– ভালো।ওইদিকের সব ঠিক ঠাক?

সালেহা ইতস্ত হলো,বলবে কি বলবে না ভেবে বলেই ফেললো।

– পবনের অবস্থা ভালো না রে।ছেলেটার কি হয়েছে কে জানে।নেশাটেশা করে মনে হয়।

– নেশা করে মানে?

– সিগারেটের নেশা ধরেছে এই ছেলেরে।বাড়ির সকলের সাথেই মনোমালিন্য।তুই যাওয়ার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়।রক্তে ভেসে যায় কপাল।আজ নাকি দেয়ালের সাথে মাথা ঠুইক্কা ফাটাই ফেলছে।এখন তো অবস্থা খারাপ হসপিটাল ভর্তি।

আতংকগ্রস্ত মুখটায় মুহূর্তে কান্নার ভাব চলে এলো আরমিনের।সুহাইল নির্বাক ভঙ্গিমায় পর্যবেক্ষণ করছে তাকে।

– এসব কেন করছে পবন ভাই?

– কোন মেয়ের নেশা জাগছে মনে কে জানে।তুই ফোন রাখ আমি এখন হসপিটাল যামু।

আরমিন ফোন রাখলো দুশ্চিন্তায় ছেঁয়ে গেলো সময়টা।সুহাইল এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিলো টেনে নিলো আরমিনকে বিছানায়।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

– কী হয়েছে পবনের?

আরমিন খুলে বললো সবটা।আরমিন ভেবেই নিলো টুম্পার শোকে কাতর ছেলেটা। কিন্তু সুহাইলের মনে সন্দেহের জট বাঁধে।সে আগে থেকেই জানতো আরমিনের প্রতি পবন কোন না কোন ভাবে দূর্বল।পবনের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভয় পেলো সুহাইল।ভয় পেলো তার মরিয়মকে হারানোর।চিন্তার আন্দোলনে মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধ বেড়ে গেলো।আপনা-আপনি ভেতরটায় অসীম জেদের মাত্রা বেড়ে গেছে।সুহাইল তখন ধরে ছিলো আরমিনের বাহু ক্রোধের তাড়োনায় ঢিলে হাতটা শক্ত হয়ে এলো।চামড়ে ভেদ করে সুহাইলের আঙুল যেন মাংসপিন্ডে চলে যাবে।আরমিন হাতের ব্যাথায় ক্ষীণ আর্তনাদ করে উঠে।

– সুহাইল লাগছে আমার।

তড়িৎ গতিতে আরমিনের দিকে তাকালো সুহাইল।আরমিন চোখ রাখলো সুহাইলের মুখমন্ডলে।এসির মাঝেও ঘামছে ছেলেটা।

– আপনার কী হয়েছে সুহাইল?আপনি এত ঘামছেন কেন?শরীর কি খারাপ লাগছে?

সুহাইল প্রত্যুত্তর করলো না।আরমিনকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে স্বগোতক্তি স্বরে বলে,
– একদম নড়াচড়া করো না মরিয়ম, ঘুমিয়ে পড়ো।

আরমিন ঘুমালো না ছেলেটার হৃদযন্ত্রের উথাল-পাতাল ক্রিয়া শুনতে ব্যস্ত।হঠাৎ ঘাবড়ে যাওয়ার কারন খুঁজে পেলো না আরমিন।সূর্যের ফালি রোদ জানলার কাঁচ গলিয়ে ছুঁয়ে দিলো তাদের।এই মুহূর্তটা কেমন যেন,আকুলতায় ছোঁয়া।অচেতন মনটায় কেমন যেন বার্তা দিচ্ছে সে, বার্তা অসংগত আরমিনের কাছে।তবুও মন,মস্তিকের মিল ঘটাতে পারলো না সে।মন বলছে সুহাইলের কি হয়েছে জানা উচিত,মস্তিষ্ক বলছে দূরে থাকো।দ্বিধাদ্বন্দে নিশপিশ করছে মন।আরমিন খানিকটা মাথা তুলে দেখলো সুহাইলের মুখ।রক্তশূণ্য পাংশুটে সেই মুখখানি।সুহাইল ঘুমায়নি আরমিনের অস্থিরতা অনুভব করছিলো সে।গলা খাঁকিয়ে বন্ধ চোখ খুলে চোখ পাকিয়ে কপট রাগ দেখালো।আরমিনের মস্তকের পেছনের কেশে হাত আঁকড়ে ধরে ছিটকে নিলো বুকে।মাথাটা দৃঢ়তা নিয়ে চেপে ধরলো বক্ষঃস্থলে।

– আমাকে দেখে কাজ নেই ঘুমাও মরিয়ম।
_
দুপুরের সময়টাতে তাদের ঘুম হলো না।আরমিন নিস্তেজের মতো লেপ্টে ছিলো সুহাইলের বক্ষঃস্থলে।তার বাধা দেওয়ার সাধ্য কোথায় যেখানে পবিত্র সম্পর্ক জুড়ে গেছে তাদের মাঝে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আপাদমস্তক দেখো নিলো আরমিন।সে যেন জোর কদমে নিজেকে সুহাইলের মতো করে নিতে চাইছে।মিস্টার সুহাইল খন্দকারের স্ত্রী তার মতো না হলে ভারসাম্যপূর্ণ নয় যেন।অবশ্য সুহাইল এইসব বিষয়ে আরমিনকে জোরাজোরি করে না।আরমিনের যেমন ইচ্ছা সে তেমনি থাকবে তবুও সুহাইলের পাশে হাটতে হলে তার যেন আলাদা ভাবগাম্ভীর্যের প্রয়োজন আছে।আরমিন নিজেকে সুহাইলের সমতুল্য করতে চায় যেমনটা মাফীর পাশে রাত্রী।মাফী যেমন রঙচটা হীন,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তেমনি রাত্রীও স্টাইলের দিক দিয়ে খুব সচেতন মেয়ে।এমন তো নয় অশালীন চালচলন,শালীন চালচনের মাঝে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছে রাত্রী মেয়েটা।আরমিন পড়েছে বিপাকে একবার বেনুনি আরেকবার ছাড়ছে চুল।জিন্সের সাথে হাটু সমান রাউন জামা পড়েছে কিন্তু ম্যাচিং চুল বাধতে পারছে না।কোনো ভাবেই যেন মানানই হচ্ছেনা।সুহাইল পেছনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছিলো আরমিনের কান্ড অনেকক্ষণ যাবৎ চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করে।

– চুলে কি সমস্যা এত বিরক্তি দেখাচ্ছো কেন?

– ইয়ে…. চুলটা সেট করতে পারছিনা ভালোভাবে।

– একদম উপরে তুলে ঝুটি করো তোমার তো লম্বা চুল।সামনে দুপাশে হালকা চুল বের করবে ব্যস্ত দারুন লাগবে।

– আমি তো ভালো খোপাই আনি নাই।

– আমি যে বার বার বলেছি কি লাগবে বলো আমরা এখনি শপিং করে নি,তখন তো মুখে কুলুপ এঁটে ছিলে।

কপট রাগ দেখালো সুহাইল।সাইড টেবিল থেকে ফোনটা তুলে সম্পূর্ণ নজর দিলো আরেকবার।

– চলো রাত্রি সেট করে দেবে।
_
সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো একজন রাইডার।আজকের বাকিটা পথ তার নির্দেশেই পাড়ি জমাবে তারা।লোকটার পাশে আরো দু’টো বাইক দাঁড়ানো।একটাতে চড়ে বসলো মাফী এবং রাত্রি।অন্যটাতে সুহাইল আরমিন।রাইডার বাইক ঘোরালো তার পিছুপিছু চললো বাকি বাইক দুটো।বাইক চালাতে বেশ দক্ষ সুহাইল তাই তার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।তবুও বাংলাদেশের রাস্তার সাথে তাল মেলাতে খানিকটা হিমশিমে পড়ছে সে।আরমিন নিরুদ্‌বিগ্ন মনে সুহাইলের কাধ চেপে ধরে।মিহি হাসলো সুহাইল জড়তা তবে কাটছে ধীরে ধীরে।

– মনে কোন জড়তা,সন্দেহ,চিন্তা আছে?

সুহাইলের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো আরমিন।কি বলবে সে?তবুও সন্দিহান কন্ঠে বলে,

– হুম কিছুটা।

– সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দাও এই সমুদ্রে।যদি মনে জড়তা,সন্দেহ রাখো ভালো ভাবে ইঞ্জয় করতে পারবে না মনে রাখবে জীবনে কিছু মায়াময় সুযোগ একবারি আসে।

আরমিন হাসলো তার হাসিতে তালে মেলালো সুহাইল।
.
মাফী মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলো সুহাইলকে।ছেলেটার উচ্ছ্বাস মুখচ্ছবিতে ভেসে উঠছে।

– সুহাইলের দীর্ঘ বছরের ছটফট আমি দেখছি রাত্রি।আর এই সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য তার ছটফটের অবসান ঘটিয়ে উল্লাসটাও আমি দেখছি।

– তুমি আমাকে সুহাইলের মতো ভালোবাসো না।কেয়ার করো না।কখনো আমার রাগ ভাঙ্গিয়েছিলে?প্রেমের সম্পর্ক চলা কালিন কখনো আমার রাগ ভাঙ্গাতে না।যেচে পড়ে আমি ভাঙ্গিয়েছি।আমাকে পেয়ে তোমার মুখে কোন খুশির আভাস দেখিনি মনে হয়েছে গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছো।

মাফী মাথা দুলিয়ে হাসলো।মেয়েদের এই এক সমস্যা তুলনা করা।তুলনা করা বিষয়টা বড্ড খারাপ দিক।সবার ভালোবাসার ধাচ এক হবে কেন?কেউ নিগূঢ় প্রাণ উজার করে ভালোবাসবে কেউ বা উন্মাদের মতো।খাবারে যেমন এলাচের চবন অপছন্দ,তেমনি কথার মাঝে তুলনা করাও মাফীর অপছন্দ।

– সুহাইলের প্রথম প্রতিজ্ঞা তার মামীর হারানো সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া।আর দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা ভালোবাসার জয়।আমি ওর মতো পা-গ-ল নই একজনের মাঝে আসক্ত হয়ে দিন রাত কাটাবো।আমি যেমন ভালোবাসতে জানি, আমি তেমন নিজেকে ভালো রাখতে জানি।তোমার আমার সম্পর্ক অনলাইন ভিত্তিক একি আকাশের দুটি আলদা দেশে।তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে আমি পা-গ-ল হয়ে যেতাম না।ডিপ্রেশড হতাম ঠিকি তবে শক্ত ভাবে মানিয়ে নিতাম।জীবনটা আমার এত ফেলনা নয় রাত্রি,আমি আমার জীবনটা আমার মতো করে ভালোবাসি।যদি নিজেকে বুঝতে না পারি, ভালোবাসতে না পারি তবে রক্ত মাংসে গড়া অন্য মানবের মনকে কী করে বুঝবো আর ভালোই বা কি করে বাসবো।তবে এখন তুমি আমার জীবনের অংশ,এখন আমি তোমাতে মত্ত।শত কিছুর পরেও ছেড়ে তো যেতে পারবে না।

– কেন ছেড়ে যেতে পারবো না?

– কারন আমি ছাড়বো না।

মাফী হাসল তৃপ্তি নিয়ে। হাসলো রাত্রিও। বাইকের গতি বেড়ে গেছে।বাতাসের ঝাপটা শীতল করে দিচ্ছে শরীরটা।আর কথার ভাজে শীতল হয়েছে মন।
.
গন্তব্যে পৌছে গেলে তিনটে বাইক এক সঙ্গে থেমে যায়।তারা অবস্থান করছিলো কুয়াকাটার বৌদ্ধ মন্দিরে।এখানে একটি কুয়া এবং মন্দির আছে।জনপ্রতি বিশ টাকায় টিকেট কেটে প্রবেশ করে দুই দম্পত্তি।আরমিন মুগ্ধ চোখে দেখছিলো সবকিছু।বৌদ্ধ মন্দির সম্পর্কিত টুকটাক বর্ননা বইতে পড়লেও আজ সামনে থেকে দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত সে।রাত্রি ফোন বের করে পুরো স্থানটা ক্যামেরায় ধারন করে নেয়।আরমিন হাটছে সুহাইলের পাশাপাশি।টাইলসে আবৃত, গ্রিল ধারা বাধাই করা এবং উপরে টিনের ছাউনি বেশ সরু কুয়াটির সামনে দাড়ালো আরমিন।যেটি নির্মাণ হয় ১৭৮৪ সালে এবং এই কুয়ার ভিত্তিতেই কুয়াকাটা নামটি নির্ধারণ করা হয়।এটাও মিঠা পানি সংরক্ষণের জন্য রাখাইনরা খুড়েছিলো।কুয়া দেখা শেষ করে তারা এগিয়ে যায় মন্দিরের দিকে।মন্দিরের প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি সিড়ি দেখা যাচ্ছে।সিড়ির পাশেই দুটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।এই মূর্তিগুলোর নাম ‘চুন্দ্র মূর্তি’।রাখাইনদের বিশ্বাস অনুসারে এই মূর্তি দুটি হলো এই মন্দিরের রক্ষাকর্তা।সবুজ,সোনালী এবং মুখাকৃতি সাদা রঙে রাঙিয়ে সাজানো হয়েছে মূর্তি দুটো।যেহেতু মন্দির পবিত্র স্থান তাই তারা জুতা খুলে প্রবেশ করে সিড়িতে।মূল মূর্তি দেখতে তারা সিড়ি বেয়ে এগিয়ে গেলো উপরের দিকে।
মূল মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল আরমিন এবং সুহাইল।পুরো মূর্তিটি দেখতে স্বর্ণের মতো।সুহাইল পর্যবেক্ষণের চোখে তাকালো মূর্তির দিকে মাফীর পিঠ চাপড়ে বলে,

– তোর তো ধারণা আছে এই মূর্তিটির ওজন কত?

– পঁয়ত্রিশ মন,উচ্চতা ছয় ফুট।

গোলগোল চোখে তিনজনেই তাকালো মাফীর দিকে।মূর্তি থেকে দূরে এক পাশে একটি বিশাল আকৃতির ঘন্টা রয়েছে।কারুকার্য খচিত ঘন্টাটি দেখতে বেশ চমকপ্রদ।আরমিন এবং সুহাইল এগিয়ে গেলো সেই ঘন্টার কাছে সেখানে একটি কাগজে লেখা ছিলো ‘স্পর্শ করা নিষেধ’
.
মন্দির দেখা শেষে তারা চলে গেলো প্রায় ২০০ বছর পুরোনো একটি পাল তোলা নৌকা দেখতে। নৌকাটি ছিলো অর্জুনকাঠ,শালকাঠ এবং লোহা কাঠের সাহায্য তৈরি ফালি ফালি কাঠের টুকরো ধারা নির্মিত।তখনকার সময় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা না থাকায়।কোন ফিনিশিং ছাড়াই তৈরি করা হয় নৌকাটি।আরমিন ঘুরে ঘুরে দেখলো পুরোনো নৌকাটি।রাত্রি তখন সবটা ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত।

– তখনকার আমলের মানুষের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়।বুদ্ধি আর কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কি এই নৌকা বানানো সম্ভব!

সুহাইলের কথা মিহি হাসলো মাফী।

– একদম ঠিক।চেষ্টা থাকলে সফল হওয়া যায়।চেষ্টা ছাড়া কি নব্বই টন ওজনের একটি নৌকা বানানো সম্ভব হয়।

– বলিস কী এত ওজন!

– হুম।এই যে দেখছিস নৌকাটা লম্বায় ৭২ ফুট,চওড়া ২৪ ফুট হাইট ১০ ফুট ৬ ইঞ্চি।
রাখাইনদের দাবি এ নৌকায় তারা ২০০ বছর আগে ব্যবহার করেছেন। মতান্তরে কেউ বলে সাধু সওদাগরের ধান-চালের কাজে ব্যবহৃত নৌকা। কেউ কেউ বলে পর্তুগীজদের ব্যবহৃত পাল তোলা ছোট্ট জাহাজ।আবার কেউ বলে চান সওদাগরের নৌকা।নৌকাটা ঘিরে এখনো অনেক রসহ্য লুকিয়ে আছে।

– বাহ! এরপর কোথায় যাবো?

– তুই যেটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করিস নাক ছিটকাস সেখানেই যাবো।

মাফী কথাটা বলে হাটা শুরু করে।আরমিন,রাত্রি সুহাইল কেউ বুঝলো না মাফী কিসের কথা বুঝিয়েছে।বাধ্য হয়ে তিন জনেই হাটা দিলো মাফীর পিছু।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here