#মায়ারণ্যে,পর্ব-১৩
#লেখিকা -মেহরুমা নূর
আজ রাইসার সংগীত ফাংশন। সবাই যে যার মতো ডান্স প্রাকটিস করায় ব্যস্ত। কে কার সাথে আর কোন গানে নাচবে সেগুলো সিলেকশনে ব্যাস্ত। রাইসার রুমে মেয়েরা ডান্স প্রাকটিস করছে। সারা বারবার ট্রাই করেও গানের সাথে ডান্স স্টেপস মিলাতে পারছেনা। শেষে রাগ করে সারা বেডের ওপর দুম করে বসে পড়লো। গাল ফুলিয়ে বললো।
–ধূর করবোই না ডান্স। আমি কিছুই পারি না।
মায়া সারার কাছে গিয়ে মুচকি হাসতেন বললো।
–আরে আমার কিউট আপুনি টা রাগ করছে কেন? আরে এটাতো সামান্য ব্যাপার। তুমি একটু ট্রাই করলেই পেরে যাবে।
সারা অভিমানী সুরে বললো।
–কিছুই পারবোনা। কখন থেকে টিভি দেখে দেখে ট্রাই করছি হচ্ছেই তো না।
–আচ্ছা ঠিক আছে চলো আমি তোমাকে হেল্প করছি।
সারা খুশী হয়ে বললো।
–সত্যিই আপু তুমি শেখাবে আমাকে? ওয়াও তাহলে তো অনেক মজা হবে। চলো চলো আগে তুমি আমাকে একটু ডান্স করে দেখাও। তারপর আমি করছি।
মায়া ওর ওড়নাটা কাঁধের উপর দিয়ে এনে কোমড়ের কাছে বেঁধে নিল। মিউজিক প্লেয়ারে গান প্লে করে গানের সাথে সুন্দর ভঙ্গিতে নৃত্য পরিবেশন শুরু করলো মায়া।
♬ ন্যানো ওয়ালো নে ও ও ও
♬ ন্যানো ওয়ালো নে ছেড়া মানকা পেয়ালা
♬ ঝাল কাই মাধু সালা
♬ মেরা চ্যান, রেন,ন্যান আপনে সাথ লে গায়া
♬ ন্যানো ওয়ালো নে আহা,
♬ ন্যানো ওয়ালো নে
মায়ার এতো সুন্দর নৃত্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে । অরণ্যও তখন করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। রাইসার রুম থেকে মিউজিকের শব্দ শুনে অরণ্য কৌতুহল বশত সেদিকে তাকালো। দরজার খোলাই ছিল। গানের সাথে নৃত্য করা মায়াকে দেখে অরণ্যের হৃৎস্পন্দন থমকে গেল।মায়ার এই নতুন রুপ দেখে অরণ্যের মাঝে এক অন্যরকম ছন্দের দোলা দিচ্ছে। মায়াকে এমুহূর্তে ওর কাছে কোন অপ্সরা লাগছে। মেয়েটির মাঝে কি আছে কে জানে? যত দিন যাচ্ছে ততই যেন নতুন নতুন রুপে গুনে মোহিত করে তুলছে ওকে। যেন ধীরে ধীরে রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে ওর সন্ধ্যামালতী। এখন যে নিঃশ্বাস টাও তার নামেই বের হয়।
___
রাত ৮ টা
সংগীতের অনুষ্ঠান পুরোপুরি ভাবে শুরু হয়ে গেছে। জমকালো আয়োজনে চারিদিক মুখোরিত হয়ে উঠেছে। সবাই সাজ সজ্জিত হয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে। স্টেজের সামনে সবাই বসে আছে। একটু পরে সাহিল ওখানে মাইক নিয়ে উপস্থিত হলো। সবার বলতো শুরো করলো।
–তো সাহেবান,মেহেরবান,কদরদান,পানদান,থুকদান, আপনার জান,আমার জান, সবার জান, জানের জান প্রিয়জন, আমাদের পুরো খানদান। সবাইকে আজকের অনুষ্ঠানে স্বাগতম। সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে শুরু করছি আমাদের আজকের সংগীত অনুষ্ঠান। তো আমরা সবাই জানি আজকে রাইসার বিয়ের সংগীত অনুষ্ঠান। তো সেই উপলক্ষে আজ এখানে নাচ গানের আয়োজন থাকবে। তবে, তবে দেয়ার ইজ অ্যা টুইস্ট। সাধারণ নাচ গান তো সবাই করে। তাতে কি আর মজা আছে। তাই আমরা আজকের অনুষ্ঠানে একটা ইন্টারেস্টিং টুইস্ট দেবো। টুইস্টের নাম হলো রিভার্স টার্ন। এই টুইস্টের থীম হলো। ওল্ড স্টার রা ইয়াং হবে, আর ইয়াং স্টার রা ওল্ড হবে। মানে যারা ওল্ড স্টার মানে বড়রা আজকাল কার গানে সেইভাবে করে নাচবে। আর ইয়াং স্টার রা আগের দিনের গানে সেইভাবে নাচবে। সবাই বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়। আর হ্যাঁ সবাইকে কিন্তু কোন না কোন পার্টনারের সাথে ডান্স করতে হবে। এটাই নিয়ম। সবাই যার যার পার্টনার সিলেক্ট করে নাও। তো শুরু করা যাক?
সাহিলের কথায় সবাই তালি বাজালো। তারপর কে কার পার্টনার হবে সেটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। ইহান এসে ইরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
–ইরাবতী এই অধমের ডান্স পার্টনার হবে? এই সিঙ্গেল বেচারার তুমি ছাড়া আর কোন ভরসা নেই।
ইরিনও মুচকি হেসে রাজি হয়ে গেল। সারা বেচারি এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে ডান্স পার্টনার খুঁজছে। কিন্তু ওর পছন্দসই কাওকে পাচ্ছে না। হঠাৎ সাহিল পেছন থেকে এসে সারার কানে ফু দিয়ে বললো।
–কিরে ডান্স পার্টনার খুজছিস বুঝি?
সারা হকচকিয়ে পেছনে ঘুরে বললো।
–আপনি?
–হ্যাঁ আমি। বায়দা ওয়ে আমিও কোন পার্টনার পাচ্ছি না। আমার জন্যেও একটা পার্টনার খুঁজে দিসতো।
কথাটা বলে সাহিল চলে যেতে নিলেই সারা কিছু একটা ভেবে তড়িৎ গতিতে সাহিলকে ডাকলো। সাহিল থেমে গিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিল। তারপর স্বাভাবিক ভাবে সারার দিকে তাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ বল কি হয়েছে?
সারা কাচুমাচু করে বললো।
–না মানে বলছিলাম যে। আমারও পার্টনার নেই, আপনারও নেই। তাই কেমন হয় যদি আমরা দুজন পার্টনার হয়ে যাই? তাহলে আর আমাদের কষ্ট করে পার্টনার খুঁজতে হবে না তাইনা? ভালো না আইডিয়া টা?
সাহিল মনে মনে খুশি হলেও উপরে উপরে গম্ভীর ভাব ধরে বললো।
–তুই যখন বলছিস তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু তুই আমার সাথে ম্যাচ করতে পারবি তো? আমি কিন্তু অনেক ভালো ডান্স করি।
সারা অতি কনফিডেন্স এর সাথে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো পারবো। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।
–ঠিক আছে চল তাহলে প্রাকটিস করি।
–হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন।
সারার নিজের ওপর অনেক প্রাউড ফিল হচ্ছে। কেমন বুদ্ধি খাঁটিয়ে সে সাহিল ভাইয়াকে রাজি করালো। কেউ কি পারতো এমন করতে? বাহ্ সারা আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। ?
প্রায় সবাই তাদের ডান্স পার্টনার খুঁজে নিয়ে পারফরম্যান্স এর জন্য রেডি হচ্ছে। তবে দুজন ব্যাক্তি এসবের ধারে কাছেও নেই। তারা বসে শুধু সবার টা দেখে যাচ্ছে। তারা আর কেউ না, মায়া আর সাহিল। ওরা দুজন দুপাশে বসে সবার কার্যক্রম দেখে যাচ্ছে। ইহান অরণ্যের পাশে বসে বললো।
–কিরে মামা এমন দেবদাসের মতো বইসা আছস ক্যান? আর ভাবি কই? তোরা ডান্স করবি না?
রিয়ার কথা জিজ্ঞেস করায় অরণ্যের প্রচুর বিরক্ত বোধ হলো। এখন এই ইহান কে কিভাবে বলবে, ওই মেয়েটার সাথে ডান্স তো দূরের কথা, ওর পাশাপাশি থাকতেও অসহ্য লাগে। তবুও ইহানকে বুঝ দেওয়ার জন্য বলে উঠলো।
–ওর নাকি পা ব্যাথা শুনলাম। তাই ও ডান্স করবে না।
–কস কি? এখন তাইলে তুই কার লগে ডান্স করবি?
–আরে বাদ দেনা। সবাই যে নাচতে হবে এমন কোন কথা নেই। এমনিতেও আমার এসবের মুড নেই। তোরা নাচ না।
রাইসা বলে উঠলো।
— এটা কি বলছ ভাইয়া? আমার বিয়েতে তুমি নাচবে না? এটা কিন্তু চলবে না। তোমাকে তো নাচতেই হবে। ভাবি নেই তো কি হয়েছে? অন্য কারোর সাথে নাচো।
সারা ফট করে বলে উঠলো।
–ভাইয়া তুমি মায়া আপুর সাথে ডান্স করো। মায়া আপুরও কোন পার্টনার নেই। দুজন দুজনার পার্টনার হয়ে যাও।
সারার কথায় মায়া অরণ্য দুজনেই চমকে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। অরণ্যের মনে মনে খুশি লাগলেও উপরে কেমন রিয়্যাকশন দিবে তা বুঝে উঠতে পারছে না ও। আর মায়া তো এখনো ওর বিস্ময়ই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সারার কথায় বাকি সবাইও সায় দিয়ে ওদের একসাথে নাচতে বললো। সবার কথায় আর মায়া মানা করতে পারলো না। অগত্যা রাজি হয়ে গেল। আর অরণ্যের তো মানা করার প্রশ্নই আসে না। মায়ার কাছে যাওয়ার কোন উছিলায় সে দূরে সরাতে চায় না।
সবার রেডি হওয়া শেষে। ডান্স পারফরম্যান্স শুরু হলো। তো সবার প্রথমে সিনিয়র দের দিয়ে শুরু হলো। প্রথমে আসলো অরণ্যের বাবা মা। রায়হান আর তনিমা বেগমের ড্রেস আপ দেখে সবাই হা হয়ে গেল। রায়হান হোসেন আজকাল কার ছেলেদের মতো ফ্যান্সি প্যান্ট আর টিশার্ট পরেছে, তার ওপর রঙবেরঙের একটা জ্যাকেট পড়েছে। চোখে সানগ্লাস, মাথায় ক্যাপ (যেমনটা সিঙ্গার বাদশাহ পরে থাকে)। আর তনিমা বেগম লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়েছে( জ্যাকলিনের মতো করে)। মিউজিক চালু হতেই তনিমা বেগম আগে আগে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে আর রায়হান তার পেছনে ঘুরে ঘুরে নানান ভঙ্গিতে হাত নাচিয়ে গাইছে।
♬ চালে যাব লাটাক মাটাক
♬ লন্ডো কে দিল পাটাক পাটাক
♬ সাসে যায় আটাক আটাক
♬ আতা মাজি সাটাক সাটাক
♬ বাম তেরা গোতে খায়
♬ কামাড় পে তেরি বাটারফ্লাই
♬ বডি তেরি মাখান জেইসি
♬ খানে মে বাচ তু বাটার খায়
♬ কাম অন বেবি কিক ইট কিক ইট
♬ কাটু তেরি টিকেট টিকেট
♬ খেলতা নেহি ক্রিকেট বিকেট
♬ পার লেলু তেরি উইকেট উইকেট
(তনিমা বেগম তার আঁচল ছড়িয়ে নেচে নেচে গাইলো)
♬ বড়ো লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল
♬ এমন মাথায় বেঁধে দেব লাল গেন্দা ফুল
♬ বড়ো লোকের বেটিলো লম্বা লম্বা চুল
♬ এমন মাথায় বেঁধে দেব লাল গেন্দা ফুল
ওদের ডান্স দেখে সবাই জোরে জোরে তালি বাজাতে লাগলো। সাহিল মুখে আঙুল দিয়ে শিস বাজিয়ে বললো।
–জিও মামা কি পারফরম্যান্স দিছেন। একদম জমে ক্ষীর হয়ে গেছে। যাকে বলে পয়সা উসুল পারফরম্যান্স। আর মামি আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন একদম।
তনিমা বেগম বেচারি লজ্জায় লাল গেলেন।
এরপর আসলেন সাজ্জাদ আর এলিসা বেগম। তাদের ড্রেস আপ দেখে তো সবাই আরও একদফা হা হয়ে গেলেন। সাজ্জাদ রকস্টার দের মতো জিন্স প্যান্ট, হাতা কাটা টিশার্ট, গলায় চেইন, চোখে ফ্যান্সি সানগ্লাস। আর এলিসা বেগম পড়েছে জিন্স প্যান্ট, টিশার্ট, টিশার্টের উপরে লেদার জ্যাকেট, চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া, চোখে চশমা, হাই হিল। এলিসা বেগম ফরেনের হওয়ায় তার এসব পড়ে অভ্যাস আছে। অতঃপর মিউজিক চালু হতেই তারাও ডান্স শুরু করে দিলো। এলিসা বেগম সাজ্জাদের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নানান ভঙ্গিতে নেচে গাইলো।
♬ তুজছে মান নেহি ইয়ে ভারতা
♬ আব তু হি হে কার্তা ধার্তা
♬ অর তু পানি তাক পিনে না দে,পিনে না দে
♬ তেরা বাজ মুঝে জিনে না দে,জিনে না দে
♬ তেরা বাজ মুঝে জিনে না দে,জিনে না দে
ওদের ডান্স শেষে সবাই আবারও তালি বাজালো। সাহিল আবারও শিস বাজিয়ে বললো।
–বাহ মামা, কেয়া বাত কেয়া বাত। সত্যিই বলছি মামা তুমিই হচ্ছো রিয়েল হিরো। এক্কেরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
সাহিলের প্রসংশায় সাজ্জাদ বাবু যেন সত্যি সত্যিই নিজেকে বাঘ মনে করছেন। ইহান বলে উঠলো।
–এলিসা মামি আপনাকেও কিন্তু অনেক সুন্দর লাগছে।
এলিসা বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন।
–ধন্যপাদ ধন্যাপাদ।
এরপর এলেন সাহিলের মা বাবা। তারাও ওয়েস্টার্ন ড্রেস আপ করে, হাই রেটেড গাবরু গানটাতে নাচলেন।
এবার এলো ছোটদের পালা। তো সবার আগে ডাকা হলো ইহান আর ইরিনকে। ওরা সাদা কালো যুগের মতো ড্রেসআপ করেছে। ইহান ঢিলাঢালা একটা প্যান্ট শার্ট পড়েছে। আর ইরিন একটা সিম্পল জর্জেট শাড়ী পড়েছে। গান চালু হলো। ইরিন শাড়ীর আঁচল ধরে লাজুক ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে আর ইহান ওর পিছে পিছে যেতে যেতে গাইছে।
♬ লেকে পেহলা পেহলা পেয়ার
♬ ভার কে আখো মে খুমার
♬ যাদু নাগরি সে আয়া হে কয়ি যাদুগার
♬ ও লেকে পেহলা পেহলা পেয়ার
ওদের পারফরম্যান্স শেষেও সবাই তালি বাজালো। তারপর এলো সাহিল সারা। সারা পুরাণো দিনের নায়িকাদের মতো পেচিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ী পড়েছে।মাথার ওপর বিশাল বড়ো খোঁপা করা,চোখে মোটা করে কাজল দেওয়া। সাহিল তার পিচ্চি পরিটার থেকে নজর সরাতেই পারছে না। সাহিলও আগের দিনের মতো স্টেট প্যান্ট পরেছে। শার্ট ইন করে রেখেছে। গান শুরু হতেই ওরাও নেচে নেচে গাইতে লাগলো।
♬ মেরে সাপনো কি রাণী কাব আয়েগি তু
♬ যায় রুত মাস্তানী কাব আয়েগি তু
♬ চালি আ তু চালি আ
♬ ও মেরে সাপনো কি রাণী কাব আয়েগি তু
ওদের ডান্স শেষে সবাই করতালি বাজালো। সারা খুশিতে গদগদ হয়ে নিজেই তালি বাজাতে লাগলো। সারার খুশী দেখে সাহিলও তৃপ্ত।
এবার পালা এলো মায়া অরণ্যের। ওরা দুজন স্টেজে এলো। মায়া একটা কালো শাড়ী পড়েছে। আর অরণ্য ঢোলাঢালা কালো রঙের কোট প্যান্ট পড়েছে। প্যান্ট টাকনুর উপরে উঠানো।গান চালু হতেই দুজনে একটা ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করলো।
♬ পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া হে
♬ পেয়ার সে ফির কিউ ডারতা হে দিল
♬ কেহতা হে দিল রাস্তা মুশকিল
♬ মালুম নেহি কাহা মানজিল
♬ আ আ আআআ
♬ পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া হে
♬ পেয়ার সে ফির কিউ ডারতাহে দিল
গান গাইতে একজন আরেকজনের চোখে আটকে গেল ওরা। চোখের ভাষায় দুজন দুজনার মনের অব্যক্ত অনুভূতি গুলো বোঝাতে চাইছে। যেন আশেপাশের কোন কিছুর হুঁশ নেই ওদের। এই মুহূর্ত টাতেই ওদের বিরাজ। সবার করতালির আওয়াজে ঘোর কাটলো ওদের। নড়েচড়ে উঠে সরে দাঁড়াল ওরা।
এভাবেই নাচ গানের মাধ্যমে সংগীত অনুষ্ঠান শেষ হলো।
রাত ১২ ট প্রায়, অরণ্য ছাঁদে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তখনকার মুহূর্ত টা বারবার চোখের সামনে ভাসছে। মায়ার চোখে ও কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু ও যা ভাবছে তাকি সত্যিই? মায়ার চোখের ভাষায় কি সেটাই ছিল যেটা আমার মন বলছে? নাকি আমি ভুল ভাবছি? ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ পেল অরণ্য। ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকিয়ে দেখলো ইহান দাঁড়িয়ে আছে। আর ওর পেছনে সাহিল। ইহান বলে উঠলো।
–এতো রাতে এখানে কি করছিস? নতুন বউ রেখে রাত বিরাইতে বাইরে ঘোরাঘুরি করস ক্যান? ভাবসাব তো সুবিধার মনে হচ্ছে না তোর। কাহিনি কি কতো?
অরণ্য থতমত খেয়ে বললো।
–কি আবার হবে কিছুই না। এমনি একটু ফ্রেশ হাওয়া নিতে এসেছিলাম।
ইহান এবার একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।
–দেখ অরণ্য ভনিতা করে লাভ নেই। তুই সবাইকে বোকা বানাতে পারিস আমাকে না। আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর ভালো মন্দ সব না বললেও বুঝতে পারি আমি। তুই কি মনে করিস আমি কিছু বুঝিনা? বিয়ের পর থেকেই তোকে কেমন বিষন্ন আর অন্যমনষ্ক দেখছি। আগেও কয়েকবার তোকে জিজ্ঞেস করছি কিন্তু তুই এরিয়ে গেছিস। তবে আজকে তোকে বলতেই হবে। ঘটনা কি? কি হয়েছে তোর?
সাহিলও বলে উঠলো।
–হ্যাঁ ভাইয়া আমিও বিষয় টা খেয়াল করেছি। কি হয়েছে ভাইয়া বলো আমাদের? এভাবে নিজের মাঝে না রেখে কোন সমস্যা হলে আমাদের সাথে শেয়ার করো। হয়তো আমরা তোমার কোন হেল্প করতে পারবো।
অরণ্য সামনের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এ এমন কিছুই না। তোরা হয়তো একটু বেশিই ভাবছিস।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ অরণ্যের নজর গেল নিচে। নিচে মায়া একা একা সুইমিং পুলের কাছে হাঁটছে। আপাতত নিচে আর কোন লোকজন নেই। সবাই যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটারও কি আমার মতো ঘুম আসছে না? তাই বুঝি বাইরে হাঁটতে এসেছে। তারতো আবার রাত অনেক পছন্দ। অরণ্য তাকিয়ে দেখছে মায়াকে। মায়া আনমনা হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বেখেয়ালি ভাবে হাঁটছে।হঠাৎ নিচে পিচ্ছিল কিছুর ওপর পা পড়ায় মায়ার পা পিছলে গেল। আর শরীরের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মায়া পিছলে গিয়ে সুইমিং পুলের পানিতে পড়ে গেল। মায়া সাঁতার জানে না বিধায় পানিতে ছটফট করতে লাগলো। এসব দেখে অরণ্য স্তব্ধ হয়ে গেল। নিঃশ্বাস যেন গলায় আটকে গেল ওর। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে এলো অরণ্যের। অরণ্য চিৎকার করে বললো।
–মায়াআআআ…..
অরণ্য এক ছুটে পাগলের মতো দৌড়ালো নিচে যাওয়ার জন্য। অরণ্যকে এভাবে যেতে দেখে ইহান আর সাহিল ঘাবড়ে গিয়ে ওরাও ওর পেছনে দৌড়াল। অরণ্য প্রচন্ড বেগে দৌড়ে নিচে এলো। আজকের এতটুকু পথও যেন ওর হাজার মাইল মনে হচ্ছে। অরণ্য সুইমিং পুলের কাছে এসে দেখলো মায়া এতক্ষণে ছটফট করাও বন্ধ করে দিয়েছে। অরণ্য এক মুহূর্তও দেরি না করে পুলে ঝাপ দিল। সাহিল আর ইহানও এসে ওখানে এসে দাঁড়াল।আসল ঘটনা কি সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে ওরা।
একটু পরেই অরণ্য মায়াকে কোলে করে পানির ভেতর থেকে বের করে নিয়ে এলো। মায়া এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। অরণ্য মায়াকে পুলের পাশে শুইয়ে দিয়ে দুই হাতে মায়ার মাথাটা ধরে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–মায়া, এই মায়া ওঠ । চোখ খোল প্লিজ। কিচ্ছু হবেনা তোমার সন্ধ্যামালতী। আমি কিচ্ছু হতে দেবনা তোমার।
অরণ্য দুই হাত একসাথে করে মায়ার পেটের ওপর চাপ দিয়ে পেটের পানি বার করতে লাগলো আর বারবার মায়াকে ডাকছে। ইহান আর সাহিল অরণ্যের মায়ার জন্য এমন পাগলামি দেখে প্রচন্ড অবাক হয়ে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
মায়ার পেটের পানি অনেক টা বেরিয়ে গেছে তবুও এখোনো মায়ার জ্ঞান ফিরছে না। অরণ্য যেন আরও উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।ভয়ে হাত পা কাপছে ওর। অরণ্য আবারও দুই হাতে মায়ার মুখটা ধরে মায়ার কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো।
–ওঠনা সন্ধ্যামালতী। প্লিজ ওঠো। চোখ মেলে তাকাও। তোমার কিছু হতে পারে না। আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না তুমি। এখনো যে তোমাকে অনেক কথা বলা হয়নি সন্ধ্যামালতী। সেসব কথা যে তোমাকে শুনতে হবে। প্লিজ ওঠনা প্লিজ প্লিজ..
কথাগুলো বলতে বলতে অরণ্যের চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। ইহান আর সাহিল যেন অবাকের শীর্ষে। তাদের জীবনে কখনো তারা অরণ্যকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। আর আজ কিনা একটা মেয়ের জন্য ও এভাবে কাঁদছে? তাও আবার নিজের বউয়ের বোনের জন্য? কিন্তু কেন? এসব হাজারও প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে ওদের। তবে আপাতত মায়ার জ্ঞান ফেরানো টা বেশি জরুরি। তাই ইহান বলে উঠলো।
–অরণ্য আই থিংক মায়াকে মাউথ টু মাউথ দিতে হবে। কিন্তু কে দিবে? আমরা তো….
বাকি কথা বলতে পারলোনা ইহান। ইহানের প্রথম কথাটা শোনার সাথে সাথে অরণ্য কোন ভাবনাচিন্তার তোয়াক্কা না করে মায়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে মাউথ টু মাউথ দেওয়া শুরু করে দিল। এটা দেখে ইহান আর সাহিল যেন এবার পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ওরা আর কোন কথাই বলতে পারলোনা।
কিছুক্ষন মাউথ টু মাউথ দেওয়ার মাঝেই হঠাৎ মায়া কেশে উঠলো। মায়ার জ্ঞান ফেরা দেখে অরণ্যের আটকে থাকা নিঃশ্বাস টা যেন এতক্ষণে আজাদ হলো। মহামূল্যবান কিছু ফিরে পাওয়ার খুশী ভেসে উঠলো অরণ্যের মুখমন্ডলে। মায়া চোখ খুলে তাকালো। তবে এখনো সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে ওর কাছে। জ্ঞান ফিরলেও পুরোপুরি ঘোরটা কাটেনি ওর। মায়াকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে অরণ্যে হঠাৎ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে মায়াকে দুই হাতে তুলে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। অরণ্যের আপাতত কোন হুঁশ নেই ও কি করছে। ওতো শুধু ওর মায়াকে ঠিক দেখে খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওর মায়ার কিছু হলে যে সে বেঁচে থেকেও মরে যেত। জীবন্ত একটা লাশ হয়ে যেত সে। অরণ্য মায়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো।
–তুমি ঠিক আছ মায়া?
মায়ার মাথাটা এখনো কেমন ঘুরছে। ও ভালোকরে কিছু ঠাওর করতে পারছে না। ওর সাথে কি হয়েছে সেটা ভালো করে বোঝার চেষ্টা করছে ও। তাই ও কোনরকমে বললো।
— হ হ্যাঁ ঠিক আছি আমি।
মায়ার হঠাৎ খেয়াল হলো ওর শরীর পুরো ভেজা। আর ভেজা কাপড়ে এদের সামনে এভাবে থাকতে প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে ওর। মায়া জড়সড় হয়ে বসে হাত ভাজ করে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে। অরণ্য ব্যাপার টা বুঝতে পেরে ওর গায়ের কোট টা খুলে মায়ার কাঁধের উপর দিয়ে পড়িয়ে দিল। মায়া ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করছে কিন্তু মাথাটা অতিরিক্ত ভার হওয়ায় শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারছে না ও। হাঁটতে নিয়ে কেমন যেন পড়ে যেতে নিচ্ছে। সেটা দেখে অরণ্য হঠাৎ মায়াকে পাঁজা কোলে তুলে নিল। অরণ্যের এহেন কাজে চমকে গেল মায়া। পানিতে ভিজে মায়া এমনিতেই কাঁপছে, তারওপর অরণ্যের ছোঁয়ায় যেন আরও কেঁপে উঠল মায়া। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–ক কি করছেন? ছা ছাড়ুন প্লিজ। আমি একাই যেতে পারবো।
অরণ্য ভাবলেশহীন ভাবে মায়াকে কোলে নিয়ে যেতে যেতে বললো।
–হ্যাঁ কত পারছিলে তাতো দেখতেই পারছিলাম। এখন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ থাক। নাহলে কিন্তু এক আছাড় দিয়ে ফেলে দিবো বলে দিলাম। কে বলেছিল এতো রাতে এখানে একা একা আসতে? খুব বীর বাহাদুরি দেখাতে মন চায় তাইনা? আমি যদি তখন না দেখতাম তাহলে কি হতে পারতো সে ধারনা আছে তোমার? ইডিয়ট একটা।
অরণ্যকে এভাবে শাসন করতে দেখে কেন যেন মায়ার অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যেন অতি আপন কেও তার অধিকার নিয়ে বকছে ওকে। আচ্ছা এই লোকটা আমার জন্য এতো পেরেশান হচ্ছেন কেন? শুধু কি আমি তাদের বাড়ির মেহমান বলে? নাকি অন্য কিছু?
অরণ্য মায়াকে রুমে এনে সোফায় বসিয়ে দিল। সারা আর রাইসা ঘুমে কাঁদা হয়ে আছে। তাই ওদের আর ডাকলো না। মায়াকে বসিয়ে দিয়ে বললো।
–তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
কথাটা বলে অরণ্য চলে যেতে নিলেই মায়া পেছন থেকে বলে উঠলো।
–শুনুন,
অরণ্য ফিরে তাকিয়ে বললো।
–বলো।
–ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য।
অরণ্যের বলতে ইচ্ছে হলো,আমি তোমার না আমার নিজের জান বাঁচিয়েছি। কিন্তু সেটা আর না বলে সৌজন্যমূলক হাসি দিল। মায়া বলে উঠলো।
–আর আপনিও জলদি চেঞ্জ করে নিয়েন। নাহলে জ্বর আসতে পারে।
অরণ্য মুচকি হেসে চলে গেল।
চলবে……