মায়ারণ্যে,পর্ব-১৪

0
1857

#মায়ারণ্যে,পর্ব-১৪
#লেখিকা- মেহরুমা নূর

ছাঁদের ওপর মাথা নিচু করে বসে আছে অরণ্য। ওর সামনেই দুই জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মস্তিষ্কে তাদের হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যেগুলোর উত্তর কেবল অরণ্যই দিতে পারবে। ইহান এবার অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো।
–কিরে মুখের ভিতরে কি দই জমিয়ে বসে আছিস? কিছু বলবি আমাদের? নাকি এখনো মিথ্যে বলবি? নিচে কি চলছিল ওসব? সত্যি করে বল ঘটনা কি?

অরণ্য বুঝে গেছে এখন আর চুপ করে থেকে লাভ নেই। এদের সবকিছু খুলে না বললে এরা কিছুতেই পিছা ছাড়বে না। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরণ্য প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বললো ওদের। সবটা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ওরা দুজন। অরণ্যের জীবনে এতকিছু হয়ে গেল অথচ ওরা জানেই না। ইহান চিন্তিত সুরে বলতে।
–এটা তো সত্যিই অনেক বড়ো ঘাপলা হয়ে গেছে। তো এখন কি করতে চাচ্ছিস তুই? কিছু ভেবেছিস এ ব্যাপারে?

অরণ্য দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ক্লান্ত সুরে বললো।
–জানি না ইয়ার। আমার মাথায় কিছুই কাজ করছে না। একদিকে আমার ভালোবাসা, অন্যদিকে আমার পরিবারের সম্মান। বাবার কথা ভেবে আমি চেয়েও কিছু করতে পারছি না। একদিকে ওই রিয়া নামের মেয়েটাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মানা অসম্ভব। ওকে সামনে দেখলেই কেমন রাগে শরীর টা ফেটে যায় আমার। আর অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষটাকে সামনে দেখেও তাকে না পাওয়ার কষ্ট কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। এতো প্রেশার আর আমি নিতে পারছিনা। মাঝে মধ্যে মাথাটা আমার ফেটে যায়।

ইহান বলে উঠলো।
–দেখ যা হবার তাতো হয়ে গেছে। এখন কি তুই মায়াকে ভুলে রিয়াকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারিসনা?

–তোর কি মনে হয় আমি কি চেষ্টা করিনি? আরে একবার নয় হাজার বার করেছি। কিন্তু কোনভাবেই এই জিদ্দি মন থেকে মায়াকে সরাতে পারিনি। আর না পেরেছি রিয়াকে আমার স্ত্রী হিসেবে মানতে। এই শরীরে প্রাণ থাকতে হয়তো মায়াকে ভোলা সম্ভব না আমার পক্ষে। ওকে ছাড়া যে আমার চলবে না তা আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। জানিস যখন ওকে পানিতে ডুবতে দেখলাম, এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো আমার পুরো পৃথিবীটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। মায়াকে হারানোর ভয় আমাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। আজ মায়াকে হারাবার ভয় আমার ভেতর টাকে জাগ্রত করে দিয়েছে। সে জানিয়ে দিয়েছে মায়াকে ছাড়া আমি নিঃশ্ব। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবোনা। তাই একবার রাইসার বিয়েটা পার হয়ে যাক। তারপর যেকোনো একটা পদক্ষেপ নিতেই হবে আমাকে। তাছাড়া আমি থাকতে পারছি না।

ইহান অরণ্যের কাঁধে হাত রেখে বললো।
— ঠিক আছে ইয়ার। তোর খুশীই আমাদের খুশী। তুই জা চাবি তাই হবে। তুই যাই করিস আমরা তোর সাথে আছি।

–আমি জানি তোরা থাকতে আমার কোনো চিন্তা নেই।

সাহিল সিচুয়েশন একটু হালকা করার জন্য বলে উঠলো।
–যাই বলো ভাই। এই ভালোবাসা নামক জিনিসটাই অনেক প্যারার। যার জীবনে আসে তার জীবন হেল করে দেয়।

ইহানও সাথে সায় দিয়ে বললো।
–হরে ভাই এক্কেরে মনের কথা কইছস। এর জন্যই তো শাহরুখ ভাই কইছে ♬ কারদে মুশকিল জিনা,ইস্ক কামিনা।

অরণ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো।
–তবে একটা কথা হারে হারে বুঝে গেছি। কাউকে ভালোবাসলে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলতে দেরি করতে নেই। নাহলে আমার মতোই পরে পস্তাতে হয়। আমি যদি ওকে প্রথম দেখার সময়ই ওকে মনের কথা বলে দিতাম তাহলে হয়তো আজকে এই সিচুয়েশন আসতই না। আর আজ আমি চাইলেও ওকে মনের কথা বলতে পারছি না। সত্যিই আমার মতো হতভাগা যেন কেউ না হয়।

অরণ্যের কথায় হঠাৎ ইহানের টনক নড়ে উঠলো। ও নিজেও তো একই ভুলই করছে। যে ভুলের মাশুল ও আগেও একবার দিয়েছে। ও আগেও ওর মনের কথা বলতে দেরি করেছিল যার দরুন ইরিন অন্য কারোর প্রেমে পড়ে যায়। যদিও ইহান তখন অরণ্য দের সাথে বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। তাই তখন ওসব জানতে পারেনি। ইহান ছোটবেলা থেকেই ইরিন কে ভালোবাসে। কিন্তু সেটা কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি ইহান। কারণ ইরিন ইহানের চেয়ে বয়সে বড়ো ছিল। তাই ইহান ভয় পেত নাজানি ইরিন এই ব্যাপার টা কিভাবে নেয়। ইহান ভেবেছিল পড়াশোনা শেষ করে যখন সেটেল্ড হবে তখন সে ইরিনকে তার মনের কথা বলবে। কিন্তু তার আগেই ইরিন অন্য ছেলের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে নেয়। যেদিন প্রথম ইহান ইরিনের বিয়ের কথাটা শুনেছিল তার ওপর কি বয়ে গিয়েছিল তা শুধু ইহানই যানে। চোখের সামনে যেন পুরো পৃথিবী টাই থমকে গিয়েছিল ওর। নিয়তি ওকে আবারও একটা চাঞ্চ দিয়েছে ।এবারও সে একই ভুল করছে নাতো? না না আরও একবার ইরাবতীকে হারাবার ক্ষমতা আমার নেই। অরণ্য ঠিকই বলেছে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে পস্তাতে হয়। আর আমি এবার সেই আগের ভুলটা দ্বিতীয় বার করবো না। একদমই না।

কথাগুলো ভেবে ইহান তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। সাহিল ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিরে ভাই কই যাস?

আমার একটা জরুরি কাজ আছে আমি পরে আসছি। কথাটা বলেই ইহান তড়িঘড়ি করে ওখান থেকে চলে গেল। সাহিল দুষ্টুমি করে বললো।
–বেচারার বোধহয় প্রকৃতির ডাক এসেছে।
___

ইরিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙে এলো ওর। এতরাতে এভাবে দরজায় জোরে জোরে নক করার শব্দে ভ্রু কুঁচকে এলো ইরিনের। এতরাতে আবার কে এলো? ইরিন গায়ের ওড়না টা ঠিক করে তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই ইহান হুড়মুড় করে রুমের ভেতরে ঢুকে এলো। এতরাতে ইহানকে এখানে দেখে হকচকিয়ে গেল ইরিন। বিস্ময়কর সুরে বললো।
–ইহান? তুমি এতরাতে এখানে? কোন সমস্যা হয়েছে?

ইহান ইরিনের চোখে চোখ রেখে বললো।
–হ্যাঁ সমস্যা তো হয়েছে। অনেক বড়ো সমস্যা। তবে আজ সেটার সমাধান করে দিবো আমি।

ইরিন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মানে?

ইহান হঠাৎ ইরিনের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো।
–ইরাবতী, বিয়ে করবে আমাকে?

ইরিন প্রতিবারের মতো এবারও ইহানের কথাটাকে মজা ভেবে বলে উঠলো।
–ইহান,, এটা কোন সময় হলো মজা করার? আমি আরও ভাবছি কি না কি।

ইহান এবার ইরিনের হাতদুটো শক্ত করে ধরে নিজের কাছে টান দিয়ে চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বললো।
–আই অ্যাম নট কিডিং ইরাবতী। আমি মজা করছি না। না আজ মজা করছি, আর না আগে আমি মজা করছিলাম। আমি সবসময় শুধু সত্যি টাই বলেছিলাম। তুমিই আমার সত্যি টাকে মজা ভেবে উড়িয়ে দিতে।

ইহানের কথায় ইরিন প্রচুর পরিমাণে চমকে গেল। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো।
— ক কি বলছো এসব তুমি? পাগল হয়ে গেছ? নেশা টেশা করোনি তো?

ইহান এবার কন্ঠে আরও তীব্রতা এনে বললো।
–হ্যাঁ পাগল হয়েছি,তোমার পাগল। তোমার নেশায় আসক্ত হয়ে গেছি। শুধু আজ এখন না। সেই ছোটবেলা থেকে। যেদিন থেকে বোঝা শিখেছি। সেদিন থেকেই এই মনে শুধু তোমারই নাম লিখেছি। হ্যাঁ ইরাবতী ভালোবাসি তোমাকে। অনেক ভালোবাসি। সেই ছোটবেলা থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনো বলার সাহস পায়নি। তবে আজ আমি না বলে থাকতে পারবোনা। আজ আমি আমার মনের সবকথা তোমাকে বলবো।

ইরিন কতক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইহানের দিকে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হঠাৎ ঠাস করে একটা চড় মেরে দিল ইহানের গালে। ইহানের মাথাটা হালকা কাত হয়ে গেল। তবে ইহান অবাক হলো না। বরং মুচকি হাসলো। সে জানতো এমনই কিছু হবে তার সাথে। তাই সে এটার জন্য আগের থেকেই প্রস্তুত ছিল। ইহান ইরিনের দিকে আবার তাকালো। ইরিন রাগী কন্ঠে বললো।
–তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে ইহান? কিসব আবোল তাবোল বলছ? তোমার সাহস কি করে হলো আমাকে এসব বলার? আরে আমিতো তোমাকে সবসময় আমার ছোট ভাইয়ের মতো দেখেছি। আমার কাছে অরণ্য,সাহিল আর তুমি একই রকম। আর তুমি কিনা ছিহ্হ। আরে কমছে কম দুই বছরের বড় আমি তোমার। এমন একটা অবান্তর কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধল না?

ইহান ভাবলেশহীন ভাবে বললো।
–না বাঁধে নি। কেন বাঁধবে? আমিতো কোন পাপ কাজ করছি না। যাকে ভালোবাসি তাকে মনের কথাটা বলছি। আর বয়সের বড় ছোট আমার কাছে কোন ম্যাটার করে না। আর কথা আসে আমাকে ভাইয়ের নজরে দেখার। তো বলবো এতে দোষটা আমারই। আমি তোমাকে আমার অনুভূতি গুলো তোমাকে আগে বোঝাতে পারিনি। তাই তুমিও আমাকে অন্য নজরে দেখোনি। তবে এখন যখন আমি আমার মনের কথাটা তোমাকে বলেছি, তাই তুমিও তোমার নজর চেঞ্জ করে আমাকে অন্য নজরে দেখা শুরু করো। খুব একটা কঠিন না চেষ্টা করলেই পারবে।

ইহানের খাপছাড়া কথাবার্তায় ইরিন অবাকের শীর্ষে। ছেলেটা এতো সহজে কেমন সবকিছু বলে যাচ্ছে। যেন কোন মজার কথা বলছে। ইরিন আবারও রাগী সুরে বললো।
–বাস, অনেক হয়েছে। তুমি এখুনি আমার রুম থেকে বের হও। মাথার নাট বল্টু ঠিক না করা পর্যন্ত আমার সামনে আসবেনা তুমি। যাও এক্ষুনি।
কথাটা বলে ইরিন এক প্রকার ঠেলেই ইহানকে রুম থেকে বের করে দিল। ইহানকে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দরজা লাগাতে গেলেই ইহান হাত দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে ফেলে মাথাটা একটু বের করে দুষ্টু হেসে বললো।
–বায়দা ওয়ে ইরাবতী, তোমাকে রাগলে কিন্তু হেব্বি লাগে।একদম কিউটি কিউটি বউ বউ লাগে।

অন্য সময় হলে হয়তো ইরিন ইহানের কথা টাকে মজা ভেবে হেঁসে দিত। কিন্তু আজ ওর হাসির বদলে চরম রাগ উঠছে। ইরিন দাঁত কিড়মিড় করে ঠাস করে দরজা টা লাগিয়ে দিল। ইহান বাইরে থেকে নিঃশব্দে হাসলো।ইরিনকে মনের কথা বলে আজ ওর মনটা অনেক হালকা লাগছে। ইরাবতী আজ হয়তো রেগে আছে। তবে ও একদিন ঠিকই ওর ইরাবতী কে মানিয়ে নিবে।
____

রোজকার মতো ঘুম থেকে উঠে মায়া বারান্দায় আসলো। আর আজও একই ভাবে অরণ্যকে ওর ব্যালকনিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। অরণ্যকে এভাবে দেখে কেমন মায়া লাগছে ওর। ঠান্ডার ভেতর কেমন জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। মায়ার মনে চাচ্ছে একটা চাদর নিয়ে অরণ্যের গায়ে জড়িয়ে দিতে।লোকটার কষ্ট কেমন যেন সহ্য হয়না ওর। মনের অজান্তেই যে সে ওই লোকটার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে।হয়তো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই এমন।না চাইতেও এক মায়াবী টানে জড়িয়ে যায়। আচ্ছা রিয়া কি এসব টের পায়না? উনাকে এভাবে রেখে ও ভেতরে আরামে কিভাবে ঘুমায়? আচ্ছা ওদের বিয়ে করে নেওয়ার কথা ছিল।এতদিনে কি রিয়া উনাকে কোন বাহানায় বিয়ে করে নিয়েছে? মনের মাঝে নানান প্রশ্ন জন্মালেও সেগুলোর উত্তর জানা নেই মায়ার।

আজ রাইসার হলুদের অনুষ্ঠান। যথারীতি এটারও আয়োজন জমকালো ভাবে করা হয়েছে। সবার জন্য কালার থীম ড্রেস কোড রাখা হয়েছে। মেয়েরা হালকা গোলাপি শাড়ি বা ড্রেস পড়বে।আর ছেলেরা হালকা গোলপি পাঞ্জাবি পড়বে। সবাই রেডি হয়ে অনুষ্ঠানে এসে হাজির হচ্ছে।

বাড়ির মহিলারা নানান কাজে ব্যাস্ত। মায়াও তাদের সব কাজে হেল্প করছে। মায়ার ব্যাবহার আচারে সবাই মুগ্ধ। বিশেষ করে তনিমা বেগম। মেয়েটার প্রতি একটা মায়া এসে গেছে তার। এমন মায়াবী মেয়েটার জন্য টান আসাটাই স্বাভাবিক। রিয়া তার নিজের ছেলের বউ হয়েও এখন পর্যন্ত তাদের মনে জায়গা করতে পারলো না। সংসারের দায়িত্বর ব্যাপারে কেমন উদাসীন। বাড়ির কোন কাজে তাকে পাওয়া যায় না।বেশির ভাগ সময় শুধু সেজেগুজে বাইরে বাইরে ঘুরে বেরায়।রিয়ার এমন বিহেভিয়ার তনিমা বেগমের ভালো লাগে না। তবুও সে তেমন শক্ত কথা বলে না। তিনি রিয়াকে সময় দিতে চান। ভাবেন হয়তো সময়ের সাথে রিয়া সংসারের প্রতি দায়িত্ববান হবে। তবে অরণ্যের ফুপু রাবেয়া বেগম মাঝে মধ্যে রিয়ার এমন ব্যাবহারে বিরক্ত হয়ে কিছু কথা বলেন। তবে সেই কথা রিয়ার ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলে বলে মনে হয়না। বরং রিয়া ওর মন মতোই চলে।

রাবেয়া বেগম রান্না ঘরে কাজ করতে করতে তনিমা বেগমের উদ্দশ্যে বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো
–ভাবি তুমি না অনেক সহজ সরল। এতো নরম হলে চলবেনা বুঝেছ। রিয়াকে একটু শাসন করো। নাহলে কিন্তু হাত থেকে বেড়িয়ে যাবে বললাম। বিয়ে বাড়ির কোন কাজে তাকে পাওয়া যায় না। এটা কেমন কথা? তার কি কোন দায়িত্ব নেই?

তনিমা বেগম বলে উঠলেন।
–আমিও বুঝি সবকিছু। কিন্তু নতুন নতুন দেখে তেমন শক্ত হচ্ছি না। আগে একটু ভালো ভাবে বলে দেখি। একটু সময় দেই। তারপর নাহয় দেখা যাবে।

রাবেয়া বেগম আবার বললেন।
–অথচ দেখ তারই ফুপাতো বোন হয়েও মায়া মেয়েটা কত লক্ষি। না বলতেও সবার কতো হেল্প করে। আমার মনে হয় রিয়ার বদলে মায়াই এবাড়ির বউ হলে ভালো হতো।

রাবেয়া বেগমের কথায় তনিমা বেগমও ভাবনায় পড়ে গেলেন। সত্যি তো মায়ার মতো একটা লক্ষি মেয়ে তার ঘরের বউ হলে কতোই না ভালো হতো। কিন্তু এখন আর সেটা ভেবে কি হবে? অরণ্যের বিয়েতো হয়েই গেছে। কথাটা ভেবে তনিমা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
__

সন্ধ্যা ৭-৩০
হলুদের জমজমাট হতে শুরু করেছে। রাইসাকে স্টেজে বসিয়ে সবাই একে একে হলুদ দিচ্ছে আর হাসি আনন্দে মেতে উঠেছে।
রাইসার শশুর বাড়ির পক্ষ থেকে হলুদ দিতে এসেছে। নিশানের ভাই জোবানও এসেছে। আর এসেই সারার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে আর ন্যাকামি করছে। সেটা দেখে যথার্থ ভাবেই সাহিলের চন্ডি গরম হয়ে যাচ্ছে। এই আইটেম টাকে তো সৌরজগতের দর্শন করিয়েই ছাড়বে সাহিল।

সাহিল জোবানের কাছে গিয়ে খুবই স্বাভাবিক সুরে বললো।
–জোবান তোমার সাথে একটু জরুরি কথা আছে একটু আমার সাথে এসো।

জোবানও বেশি না ভেবে মাথা ঝাকিয়ে সাহিলের সাথে গেল। সাহিল জোবানকে নিয়ে এক কোনায় সাইডে এসে দাঁড়াল। জোবান বলে উঠলো।
–জ্বি ভাইয়া বলুন কি বলবেন?

সাহিলের ভেতরে ভেতরে রাগের অগ্নিশিখা জ্বললেও,সে উপরে খুবই স্বাভাবিক আর শান্ত সুরে বললো।
–আজ তোমাকে একটা কথা বলতে চাই একটু মন দিয়ে শুনো কেমন? সারার যখন দশ বছর বয়স তখন স্কুলের একটা ছেলে খেলার ছলে সারার হাতে ব্যাথা দিয়েছিল। আর যার জন্য আমি ওই ছেলের হাত ভেঙে দিয়েছিলাম। যদিও পরবর্তীতে তার চিকিৎসার টাকাও আমরা দিয়েছিলাম। এমন আরও অনেক কুকীর্তি আছে যা আমি সারার জন্য করেছি আর দরকার হলে সামনেও করবো। তো মোরাল অফ দ্যা স্টোরি ইস, সারা ইস মাই ম্যাডনেস। ওর জন্য আমি জীবন দিতেও পারি, আবার ওর দিকে আসা যেকোনো কু নজর কারীর জীবন নিতেও পারি। ওর দিকে যে চোখ তুলে তাকাবে তার চোখ উপরে ফেলতে আমার দুই সেকেন্ডও লাগবে না।
সাহিলের এমন শান্ত গভীর হুমকিতে বেচারা জোবানের মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। মুখটা পুরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার। অবস্থা টা এমন যে, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাচি। জোবানের ভীতু চেহারা দেখে সাহিল ইনোসেন্ট ভাব ধরে বললো।
–আরে আরে ভয় পাচ্ছ কেন? আমিতো জাস্ট তোমার সাথে কথাটা শেয়ার করলাম। তুমি এখন আমাদের আত্মীয় হতে যাচ্ছ, তো আমাদের সম্পর্কে তোমার জানকারী থাকা দরকার তাইনা? তাই বললাম। ইউ ডোন্ট ওয়ারি।
সাহিল জোবানের কলারটা একটু ঠিক করে দিয়ে বললো।
–স্মাইল,টেক এ চিল পিল বয়।
কথাটা বলে মুচকি হেসে চলে গেল সাহিল। আর বেচারা জোবান ওখানেই তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একটু পরেই ওখান থেকে লেজ গুটিয়ে পালালো। ওর জীবন থাকতে আর কখনো সারার সামনে আসবে না। বেঁচে থাকলে জীবনে আরও মেয়ে পাওয়া যাবে।

অনুষ্ঠান জাঁকজমক ভাবেই চলছে। অনেকে নাচ গানও করছে। তখনই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো।
–সুয়াগাত নেহি কারোগি হামারা

কন্ঠ টা শুনে সবাই পেছনে তাকালো। রাইসা হটাৎ খুশিতে চিল্লিয়ে বললো।
–মিহাদ ভাইয়া…

মিহাদ দুই হাতের আঙুল তুলে রাইসার দিকে ইশারা করে বললো।
–সেহি পেহচানা.

–ওয়াও ভাইয়া তুমি এসেছ? আই অ্যাম সো হ্যাপি।

–আমার ভুতনির বিয়ে আর আমি আসবোনা তাকি হয়? ভুতনিকে তাড়াতে তো আসতেই হবে।
মিহাদের কথায় সবাই হেঁসে দিল। মিহাদ হলো সাহিল যেন রাইসার খালাত ভাই। মিহাদ এগিয়ে গিয়ে সাহিল আর বাকি সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। তারপর রাইসার কাছে গিয়ে ওকে হলুদ লাগিয়ে দিল। হলুদ লাগিয়ে উঠে আসতে নিল। মায়া রাইসার জন্য জুস নিয়ে আসছিল। হঠাৎ করে মিহাদ উঠে ঘুরতেই মায়ার হাতে থাকা ট্রের সাথে থাক্কা লাগলো। আর জুস গুলো সব মিহাদের গায়ে গিয়ে পড়লো। আচমকা এমন হওয়ায় মায়া একটু হড়বড়িয়ে গেল। মায়া অপরাধী সুরে বললো।
–অ্যাম সো সরি। আমি খেয়াল করিনি।

মিহাদ মুচকি হেসে বললো।
–ব্যাপার না মিস,ছোটি ছোটি দেশো মে এইসি বাড় বাড়ি বাতে হতি রেহতি হে। সো টেনশন নট। বায়দা ওয়ে আপনার শুভ নামটা কি জানতে পারি? না মানে আপনাকে আগেতো কখনো দেখিনি।

মায়া বললো।
— জ্বি আমি মায়া।

–ওয়াও মায়া। নাম টা সত্যিই সার্থক।আপনার নামের মতো আপনি সত্যি সত্যিই মায়াবী।

সারা পাশ থেকে বলে উঠলো।
–মিহাদ ভাইয়া মায়া আপু রিয়া ভাবির বোন।

–ওওও তাহলে তো আমাদের বিয়াইন সাহেবা। এখন জমবে মজা।আপনার মতো বিয়াইন থাকলে বিয়ের মজা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। বায়দা ওয়ে বান্দাকে মিহাদ বলে ডাকে। আপনি চাইলে অন্য কিছুও বলতে পারেন। আই ওন্ট মাইন্ড।

মায়া কিছু না বলে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ওখান থেকে চলে যেতে নিলো। তখনই মিহাদ পেছন থেকে গেয়ে উঠলো।
♬ এইযে বিয়াইন সাব
♬ মাইন্ড খাইয়েন না।
♬ এতোগুলা পোলা যেন দেইখাও দেখেন না
♬ আরে এইযে বিয়াইন সাব ভাব লইয়েন না
♬ কালা চশমা পড়লে কিন্তু বেল পাইবেন না
♬ একেতে রুপের আগুন
♬ তার আবার জবর দিগুন
♬ আপনার দয়া মায়া সবকি আপনার
♬ ভ্যানিটি ব্যাগে রাখছেন
♬ আপনে দেখতে ঝাক্কাস
♬ শুনছি নাচেন ভালো
♬ তবে আজকে রাতে কেন থাকবে
♬ ডান্স ফ্লোর খালি
♬ বিয়াইন আপনার জন্য ঢাকা থাইকা ডিজে আনছি
♬ প্রাণ খুইল্লা নাচেন আপনে
♬ হেব্বি বিটে গান ছাড়ছি

মিহাদ মায়ার আগে পিছে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। ওর সাথে সারা সহ আরও কিছু ছেলেমেয়ে নাচতে শুরু করেছে। তবে মায়ার এসবে মোটেও মন নেই। সেতো শুধু ওখান থেকে যেতে চায়ছে। তবে সবাই ওকে ঘিরে নাচায় ও যেতেও পারছে না। তাই ভদ্রতার খাতিরে জোরপূর্বক সৌজন্যমূলক হাসি দিচ্ছে।

এসব কিছুই অরণ্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভেতরে কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে ওর। রাগে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে ওর। হাতের বাঁধন হয়ে উঠছে শক্ত থেকে শক্তকর। রাগের সাথে কেমন একটা ভয়ও হানা দিচ্ছে ওর মনে। বুকের ভেতর ব্যাথার অনুভব হচ্ছে। চোখের পাতায় লাল বর্নে ছেয়ে উঠছে। ওর সন্ধ্যামালতীর জীবনে অন্য কারোর পদার্পণ হচ্ছে নাতো?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here