মায়ারণ্যে,পর্ব-১৫

0
1829

#মায়ারণ্যে,পর্ব-১৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

আজ রাইসার বিয়ে। সকাল থেকেই সবাই নানান কাজে ব্যাস্ত। মেহমানে মেহমানে পুরো বাড়ি ভরে উঠেছে। যে যার মতো আনন্দ উল্লাসে ব্যাস্ত।

ইরিন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ফুলের মালা বানাচ্ছে। তখনই ইহান ওখানে এসে ধপ করে ইরিনের গা ঘেষে বসলো। আর যথারীতি ইরিনের কানে একটা ফুল গুঁজে দিয়ে মুচকি হেসে বললো।
–ওয়াও ইরাবতী অনেক সুন্দর লাগছে। চলনা আমরাও আজকে বিয়ে করে ফেলি।আর কতকাল সিঙ্গেল থাকবো। শীতের দিনে একা একা ঘুম আসেনা বুঝেছ ইরাবতী। আমি মা বাবাকে বলে আসি কেমন?

ইরিন রাগি চোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–তুমি যে এতো অসভ্য তা আমার আগে জানা ছিল না।

ইহান বুকের বাম হাত রেখে বাঁকা হেসে বললো।
–ওয়াহ্ ইরাবতী, প্রিয়তমার মুখে অসভ্য শোনার মাঝে যে কি মজা তা আজ বুঝলাম। আরেকবার বলোনা ইরাবতী।

ইরিন চোয়াল চিবিয়ে বললো।
–আসলে ভুলটা আমারই। তোমার সব কথাকে মজা ভেবে উড়িয়ে না দিয়ে তখনই যদি তোমাকে শাসন করে দিতাম তাহলে আর এসব করার সাহস পেতে না। তোমাকে না বলেছি আমার সামনে আসবেনা। সরো এখান থেকে।

–কি বলো ইরাবতী, হবু বরের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? একটু ভালোবেসে বলোনা? তোমার জন্য জীবনও দিয়ে দিতে পারবো।

–ইনাফ, তুমি যাও বলছি এখান থেকে। নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।

–ওকে ওকে বাবা যাচ্ছি। এতো রাগছ কেন? মানলাম রাগলে তোমাকে একটু বেশিই কিউট লাগে। তাই বলে সবসময় তোমার কিউটনেস দেখাতে হবে নাকি? আমিতো ডিসট্রাক্ট হয়ে যাই।
কথাটা বলেই ইহান এক চোখ টিপ মেরে দিল। ইরিন রেগে আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইহান হেসে দিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেল।

বাইরে লনে সবাই নানান কাজ করছে। অরণ্য আর সাহিলও কাজে ব্যাস্ত। বোনের বিয়ে বলে কথা। ওদের কাধেও অনেক দায়িত্ব। মায়া আর সারা বসে বিয়ের ডালা সাজাচ্ছে।যে ডালা থেকে বরযাত্রী আসলে তখন তাদের ওপর ফুল ছিটানো হবে। হঠাৎ বেখেয়ালিতে একটা ডালা উল্টে পড়ে গেল। মিহাদ ওখানেই আসছিলো তখন ডালার ফুলগুলো ওর গায়ে উড়ে গিয়ে পড়লো। মিহাদ হাসিমুখে বলে উঠলো।
–বাহ্ বিয়াইন সাহেবা আই অ্যাম ইমপ্রেসড। মানে প্রথমে জুস দিয়ে, এখন আবার এই ফুল দিয়ে। আপনি সবসময় আমাকে এমন ওয়ার্ম ওয়েলকাম জানান। আমিতো সত্যিই পুলকিত। নিজেকে কেমন যেন বহুত স্পেশাল মনে হচ্ছে। একদম রাজা মহারাজা টাইপস। এই সারা শোন,আমাকে ভালো করে দেখে নে।

সারা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কেন ভাইয়া??

–আরে দেখছিস না আমি সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছি। পরবর্তীতে আর আমার দর্শন পাবি কি না পাবি তাই এখুনি ভালো করে দেখে নে। সাথে অটোগ্রাফও নিয়ে নে। পরে আর সেটারও চাঞ্চ পাবিনা।

মিহাদের এমন হাস্যকর কথায় সারা হেঁসে দিল। সাথে মায়াও হালকা হাসলো। আসলে মিহাদ প্রচুর হাস্যরসিক ছেলে। ওর কাজকর্ম আর কথাবার্তায় কেউ না হেঁসে থাকতে পারে না। তাই মায়াও না হেঁসে পারলো না। এভাবেই মিহাদ মায়াদের কাছে বসে নানান রসিকতা করতে লাগলো।

অরণ্য কাজ করতে করতে হঠাৎ নজর গেল ওদের দিকে। মায়াকে মিহাদের সাথে এভাবে হেঁসে কথা বলতে দেখে অরণ্যের রাগের মাত্রা যেন তরতর করে বেড়েই চলেছে। এমনিতেই কালকে মিহাদ আসার পর থেকেই দেখছে, মিহাদ বেশির ভাগ সময় মায়ার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে। নানান বাহানায় মায়ার সাথে বন্ধুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এসব কিছুই অরণ্যের চোখের আড়াল হচ্ছে না। আর আজ এভাবে মায়াকে মিহাদের সাথে হাসতে দেখে অরণ্যের বুকের যন্ত্রণা টা যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। সারা শরীরে প্রচন্ড জ্বলন ধরে যাচ্ছে।শুধুমাত্র বোনের বিয়ে বলে অরণ্য তেমন কিছু বলছে না।তবে কতক্ষণ যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে তা জানা নেই। যেকোনো সময় ওর রাগের অগ্নিকুণ্ড ফেটে যেতে পারে।
____

রাত ৮ টা
বরযাত্রী চলে এসেছে। সারাসহ কিছু মেয়ের দল বরযাত্রীর সামনে গিয়ে ফিতা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। টাকার দাবি পুরন না করা পর্যন্ত ভেতরে ঢুকতে দিবে না। এটা নিয়েই তর্কবিতর্ক চলছে। আজকে বেচারা জোবান সামনেই আসছে না। নিজের ভাই না হলে হয়তো বিয়েতেই আসতো না।

লোকজন সব বেশির ভাগই বাইরে। বাসার ভেতর তেমন কেও নেই। মায়ার রেডি হতে হতে একটু দেরি হয়ে গেছে। মায়া রেডি তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যেতে নিলেই হঠাৎ অরণ্যের রুমের সামনে দিয়ে যেতে নিলেই রিয়া আর ওর মামীর কন্ঠ শুনতে পায় ও। রিয়ার মা বাবাও আজ বিয়েতে এসেছে। তাই ওর মামী রিয়ার সাথে কথা বলতে এসেছে হয়তো। তবে মামীর একটা কথায় মায়ার পা আটকে গেল। ও শুনতে লাগলো ওদের কথোপকথন। ওর মামী রিয়াকে বলছে।
–তুই অরণ্যকে বিয়ের জন্য মানাস নি এখনো?

রিয়া বললো।
–আরে নাহ এখনো সে সুযোগই পায়নি।

–কি বলিস? এখনো বলতে পারিস নি? তুই আমার মেয়ে হয়ে এতো গাধা হলি কিভাবে? আরে এতোদিন ধরে এবাড়িতে আসিছ, অথচ এইটুকু কাজই পারিস নি?

–আরে আমি কি চেষ্টা কম করি নাকি। কিন্তু সেই সুযোগ টাই তো দেয়না। আরে অরণ্য তো আমার সামনেই বেশি থাকে না। সবসময় আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। সে কখন আসে কখন যায় আমি জানতেই পারিনা। তাহলে বলবো টা কখন?

–তারমানে তুই বলতে চাস অরণ্য আজপর্যন্ত তোর কাছে আসেনি?

–আরে কাছে আসা তো দূরের কথা। অরণ্যকে আমি কখনো বিছানাতেই শুতে দেখিনি। সে রাতে কখন আসে আর কখন চলে যায় আমি জানতেই পারি না।

এদের কথোপকথন শুনে মায়া কেমন বিস্মিত হয়ে গেল। তারমানে উনি আজপর্যন্ত রিয়ার সাথে স্বামী স্ত্রীর মতো কোন সম্পর্কই তৈরি করেনি? কিন্তু কেন? উনিতো রিয়াকেই পছন্দ করেছিল বিয়ের জন্য। তাহলে কি এমন হলো? মায়ার মন মস্তিষ্ক জুড়ে ভাবনার বিশাল পাহাড় জমছে। কিন্তু কোন কিনারা পাচ্ছে না সে। মায়া এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে হাঁটতে লাগলো। আর বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়ে পড়ে যেতে নেয় মায়া। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই হঠাৎ ওখানে মিহাদ এসে মায়ার হাত ধরে ফেলে।এতে করে মায়া পড়ে যাওয়া থেকে বাচে। মিহাদ মায়ার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে চিন্তিত সুরে বললো।
–আপনি ঠিক আছেন বিয়াইন সাহেবা?

মায়া সৌজন্যমূলক হেঁসে মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো। তখনই কোন একটা কাজে অরণ্য বাসার ভেতরে এসেছিল। সিড়ির ওপর দিকে তাকাতেই দেখলো মিহাদ মায়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখামাত্র অরণ্যের পা থমকে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো অরণ্য। রাগ যেন ওর সর্ব সীমায় পৌঁছে গেল।কপালের রগ নীল হয়ে উঠলো। চোখ থেকে যেন রক্ত বের হবে। চোয়াল আর হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–মিহাদ…

অরণ্যের ডাকে মিহাদ আর মায়া সেদিকে তাকালো। মায়া ওর হাতটা মিহাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল। মিহাদ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ অরণ্য বলো কিছু বলবে?

–বাইরে চাচা তোমাকে ডাকছে দেখ গিয়ে কি দরকার।

–ও ওকে আমি দেখছি।
মিহাদ মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।
–আপনি একটু দেখেশুনে চলবেন বিয়াইন সাহেবা। না মানে সবসময় তো আমি বাঁচাতে পারবো না। তবে আপনার পড়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে আমাকে ডেকে নিয়েন। বান্দা আপনার খিদমতে হাজির হয়ে যাবে কেমন।
কথাটা বলে মিহাদ হাসিমুখে নিচে চলে গেল।

অরণ্য তার রাগের অগ্নিশিখা নিয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।যা সময়ের সাথে বাড়ছে বই কমছে না। মায়াও সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে অরণ্যকে পাশ কেটে চলে যেতে নিলেই অরণ্যে পেছন থেকে খপ করে মায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো। মায়া চমকে উঠে পেছনে অরণ্যের দিকে ঘুরে তাকালো। অরণ্যের এভাবে হাত ধরায় বুকটা কেঁপে উঠল মায়ার। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–ক ক কি করছেন? ছা ছাড়ুন প্লিজ।

মায়ার কথা অরণ্যের উপর খুব একটা প্রভাব ফেললো বলে মনে হলোনা। অরণ্য মায়ার হাত টা টান দিয়ে নিজের কাছে এনে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–কেন আমার হাত ধরায় খারাপ লাগছে বুঝি? আর ওই মিহাদ যে ধরেছিল তখন অনেক ভালো লাগছিল বুঝি?

অরণ্যের এমন অদ্ভুত কথার মানে কিছুই বুঝতে পারছে না মায়া। মায়া ঘাবড়ানো কন্ঠে বললো।
–কি বলছেন এসব? ছাড়ুন প্লিজ কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।

অরণ্য মায়াকে ছাড়ার বদলে ওর হাত ধরে টানতে টানতে একটা ফাঁকা রুবেল নিয়ে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে মায়াকে রুমের দেয়ালে চেপে ধরলো।অতিরিক্ত রাগে অরণ্য কি করছে তার হুঁশ নেই। অরণ্য অগ্নি চোখে তাকিয়ে তিব্র রাগী কন্ঠে বললো।
–কি করছিলে তুমি ওই মিহাদের সাথে হ্যাঁ? এতো কিসের কথা তোমার ওর সাথে? ওর সাহস কি করে হলো তোমাকে ছোঁয়ার হ্যাঁ?টেল মি ড্যাম ইট।

অরণ্যের এমন অদ্ভুত আচরণে মায়া পুরো হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। একেতো অরণ্যের এতো কাছে আসায় মায়ার হাত পা এমনিতেই অসার হয়ে আসছে। তারওপর অরণ্যের কথার আগামাথা সে কিছুই সে বুঝতে পারছে না। তবে অরণ্যের মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছে যে,অরণ্য প্রচুর পরিমাণে রেগে আছে। কিন্তু রাগের কারণ টা ধরতে পারছে না সে। মায়া আমতা আমতা করে বললো।
— কি কি হয়েছে আপনার? এসব কি বলছেন আপনি? প্লিজ ছাড়ুন আমাকে। কেউ দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।

অরণ্য ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো।
— যাক যা খুশি তাই হয়ে যাক। তুমি আমার কথার জবাব না দিয়ে কোথাও যেতে পারবেনা। বলো কেন এতো হাসাহাসি ওই মিহাদের সাথে হ্যাঁ? এতো কিসের কথা তোমাদের? আর ও তোমাকে ছুলো কেন? বলো কেন ছুলো তোমাকে? তোমাকে অন্য কেউ কেন ছুঁবে? কেন অন্য কেউ তোমার প্রতি মোহিত হবে বলো?

অরণ্যের কথাবার্তায় মায়া চরম অবাক হয়ে গেল। তারমানে কি উনি আমাকে মিহাদের সাথে দেখে এতো রেগে গেছেন? কিন্তু কেন? আমার অন্য ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতায় উনি কেন রাগ করবেন? মায়া ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এক মিনিট! প্রথমত মিহাদ আমাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য আমার হাত ধরেছে। আর দ্বিতীয়ত এমন প্রশ্নই বা কেন করছেন আপনি? অন্য কেউ আমাকে ছুলে তাতে আপনার কি? আপনি এতো রাগছেন কেন?

–আমার অনেক কিছু? ইনফ্যাক্ট আমারই সবকিছু। আমি ছাড়া তোমাকে অন্য কেউ ছুবে না। কখনোই না।

–কেন? অন্য কেউ আমাকে ছুলে তাতে আপনার কি? আমি যার সাথে যা খুশী তাই করি। হাসি, কথা বলি, নাচি গাই যা খুশি তাই করি তাতে আপনার কি যায় আসে? আপনি কেন হাইপার হচ্ছেন? বলুন কেন?

অরণ্য মায়ার মাথার পাশে দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি মেরে তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো।
–কজ আই লাভ ইউ ড্যাম ইট…..

মায়া বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরণ্যের দিকে।মুহূর্তেই যেন সবকিছু থমকে গেল। থমকে গেল হৃদস্পন্দন। সারা রুম জুড়ে যেন “আই লাভ ইউ ” ওই একটা বাক্যই বাড়ি খেতে লাগলো।বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মায়া। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে কোনরকমে বলে উঠলো।
–কি কি যাতা ব বলছেন? মা মাথা ঠিক আছে আপনার? আপনি জানেন কি বলছেন আপনি?

অরণ্য মায়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বললো।
–একদম ঠিক বলছি আমি। হ্যাঁ ভালোবাসি আমি তোমাকে। অনেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। শুধু আজ থেকে না প্রথম থেকে আমি তোমাকেই ভালোবাসি।

মায়ার মন মস্তিষ্কে যেন ভুমিকম্প শুরু হয়ে গেল। কি বলছেন উনি এসব? মায়া স্তম্ভিত সুরে বললো।
–ভা ভালোবাসেন মানে? কি বলতে চান আপনি?

–হ্যাঁ সত্যিই বলছি আমি। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি সন্ধ্যামালতী। তোমাকে সেই প্রথম দেখেই তোমার চেহারা না দেখে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আরে আমিতো তোমাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আর বিয়ের প্রস্তাবও আমি তোমার জন্যই পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তোমার বদলে রিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

মায়ার চোখের সামনে যেন সবকিছু গোলগোল ঘুরছে। অরণ্যের কথাগুলো কান দিয়ে প্রবেশ করলেও মস্তিষ্কে গিয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মায়া একটা ঢোক গিলে বললো।
–এসব কি বলছেন আপনি? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।

অরণ্য মায়াকে প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বললো।তারপর বললো।
–কিন্তু মায়া আমার মনে তুমি ছাড়া আর কারোর জায়গা নেই। আমার পুরোটা জুড়ে শুধু তুমিই আছ। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। বিশ্বাস করো আমি আজপর্যন্ত রিয়াকে ছুঁয়েও দেখিনি। আমি জানি আমার এভাবে তোমাকে এসব কথা বলা হয়তো অনুচিত হচ্ছে ।এটা হয়তো লোকচক্ষুতে খারাপ দেখায়। কিন্তু আমার কাছে যে আর কোন উপায় নেই। আমি যে মনের হাতে পরাস্ত। তার যে শুধু তোমাকেই চাই।

সব শুনে মায়া যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। ওর এইসময় কি রিয়্যাকশন দেওয়া উচিত তা ভেবে পাচ্ছে না ও।মায়ার যেন সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। অরণ্য প্রথম থেকে তাকেই ভালোবাসে? আর সে বিয়েও ওকেই করতে চেয়েছিল? এটা কি সত্যি? তারমানে ওদের বিয়েটা ঘটনা চক্রে হলেও বিয়েটা তো ঠিক মানুষের সাথেই হয়েছে। অরণ্য যাকে চেয়েছিল তার সাথেই বিয়ে হয়েছে। আর আমি কিনা তাকেই এতোবড় ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছি?

হঠাৎ তখনই বাইরে থেকে কেউ অরণ্যের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। অরণ্য নড়েচড়ে উঠে বললো।
–আমাকে হয়তো কেউ ডাকছে। আমাক যেতে হবে। তুমি একটু এখানেই থাক। আমি একটু পরেই আসছি। তোমার সাথে আরও অনেক কথা আছে আমার। তুমি কোথাও যেওনা প্লিজ।
কথাটা বলেই অরণ্য বাইরে চলে গেল।

আর মায়া ধপ করে নিচে বসে পড়লো। মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। এটা সুখের না দুঃখের অশ্রু তা জানা নেই ওর। মনের মাঝে শুধু অরণ্যের বলা কথাটাই ঘুরছে। উনি আমাকে ভালোবাসে। হ্যাঁ ভালোবাসে আমকে। আর আমি কিনা নিজের অজান্তেই তাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি। অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে ভেবে সে কষ্ট পাচ্ছে। অথচ সে জানেই না তার ভালোবাসার সাথেই তার বিয়ে হয়েছে। না না আমি আর তাকে কষ্ট দিবোনা। তাকে অন্ধকারে রাখব না। আমি আজ এখুনি তাকে সবকিছু বলে দিবো৷ হ্যাঁ বলে দিবো।

কথাগুলো ভেবে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল মায়া। অরণ্যকে সবকিছু খুলে বলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো ও। কিন্তু দুই কদম এগুতেই কেউ ওর হাত ধরে টানতে টানতে অন্য দিকে নিয়ে গেল।
______

সারা এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে নানান পোজে সেলফি তুলছে। হঠাৎ তখনই ওর নজর গেল ওর সাহিলের ওপর। কিছু আল্ট্রা মডার্ন মেয়েরা সাহিলকে ঘিরে ধরে রেখেছে। যেন বিয়ে বাড়ির বিরিয়ানি রোস্টের বদলে সাহিলকেই তারা খেয়ে ফেলবে। সারার কেন যেন খুব রাগ হচ্ছে। মেয়েগুলো ড্রেসে গরম গরম ডাল ঢেলে দেওয়ার মতো শখ জাগছে। সারা এদিক ওদিক তাকিয়ে এক পা দু পা করে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কান খাঁড়া করে ওদের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করছে। ওদের ভেতর একটা মেয়ে বলছে।
–আরে সাহিল তুমিতো আগের থেকেও অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে গেছ। বিদেশে আমিও তোমাদের সাথে পড়তাম মনে আছে?তখন তো আমার দিকে ঠিকমতো তাকাতেও না। তাকাবেই বা কি করে। বিদেশি মেয়েগুলোর থেকে নজর সরলে না দেখবে। তুমিতো সবসময় ওদের সাথেই চিপকে থাকতে। নাজানি কতগুলোকে ডেট করেছ।তা এখানে এসেও কি যোগাযোগ রাখো নাকি? না এবার নতুন কোন বাঙালি মেয়ের ওপর ট্রাই করছো?

সাহিলও দুষ্টু হেসে বললো।
–হ্যাঁ বলতে পারো এমনই কিছু।

এদের কথাবার্তা শুনে সারার চরম রাগ লাগছে। ছিহ্ কি অসভ্য এরা। আর ওই সাহিল ভাইয়া টাও কত্ত বড়ো লুচু? আমি আগেই ঠিক ভাবতাম। উনি আসলেই একটা বদ লোক। সারার কেমন যেন খুব খারাপ লাগছে। ও আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ওখান থেকে সরে গেল।
__

ঘন্টা খানিক পর বাইরের কাজ কিছুটা সামলে নিয়ে আবারও ভেতরে আসলো অরণ্য। দ্রুত রুমে ঢুকে দেখলো মায়া রুমে নেই। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও মায়াকে পেলনা। অরণ্য ভাবলো মায়া হয়তো বাইরে চলে গেছে। অরণ্য বাসার ভেতর বাইরে সবজায়গায় খুঁজে দেখলো কোথাও মায়া নেই। অরণ্য মায়াকে ফোন দিলে ফোন বন্ধ পেল। এবার অরণ্য একটু ঘাবড়ে গেল। কোথায় গেল মায়া?

দেখতে দেখতে রাইসার বিয়ে হয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এতসময়েও অরণ্য মায়াকে কোথাও পেল না। অগত্যা অরণ্য সারাকে একপাশে ডাক দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো।
–আচ্ছা সারা তোর মায়া আপু কোথায় রে? না মানে অনেক ক্ষণ হলো দেখছিনা।

সারা বলে উঠলো।
–মায়া আপুতো চলে গেছে।

অরণ্যের বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো।
–চ চলে গেছে মানে? কোথায়? কখন চলে গেল?

–সেতো অনেক আগেই। মায়া আপুকে দেখলাম তার মামীর সাথে চলে গেল।
কথাটা বলেই সারা আবার চলে গেল।

অরণ্য থমকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ধপ করে নিচে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চলে গেল মায়া? আমাকে রেখে চলে গেল?একবার আমাকে বলারও প্রয়োজন মনে করলোনা। সে কি আমার বলা ওই কথাগুলোর জন্যই চলে গেল? তারমানে কি তার মনে আমার জন্য কিছুই নেই? কিন্তু তার চোখ তো অন্য কিছু বলছিল। নাকি সেটাও আমার ভুল ছিল? হ্যাঁ ভুলই হবে হয়তো। তাই তো সে এভাবে আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেল। আমার ভালোবাসা কি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে? আমার সন্ধ্যামালতী কি কখনোই আমার হবে না?

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here