#মায়ারণ্যে,পর্ব-১৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
তোর মুখের দর্শনের সৌভাগ্য টা নেওয়া যাক নাকি?
কথাটা বলে ওই বদমাইশটা মায়ার মুখের দিকে হাত বাড়ালো মায়ার নেকাব খোলার জন্য। মায়া চোখ বুজে মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকছে। এই নরপশু ওর শরীরে হাত দেওয়ার আগে ওর মৃত্যু হয় সেটাই চাচ্ছে ও। হাতটা প্রায়ই মায়ার নেকাব ছুবে তখনই দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের শব্দ এলো। ওরা সবাই একটু ঘাবড়ে গেল। মায়ার কাছে থাকা ছেলেটা বলে উঠলো।
–এখানে আবার কে আসতে পারে? গিয়ে দেখতো।
আরেকজন গিয়ে দরজা খুলতেই পেট বরাবর একটা লাথি খেয়ে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। সাথে সাথে সবগুলো হড়বড়িয়ে গেল। সবাই তাকিয়ে দেখলো সামনে অরণ্য অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন তার আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। এখম একটা হিংস্র বাঘের মতো লাগছে অরণ্যকে। মায়াও এবার চোখ খুলে তাকায়। অরণ্যকে দেখে যেন ওর জানে পানি ফিরে আসে। মায়া অরণ্যের দিকে করুন চোখে তাকায়। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু তার অসহায়ত্বের বয়ান দিচ্ছে । যা তীর হয়ে অরণ্যের কলিজা ভেদ করে দিচ্ছে। মায়ার এমন করুন চাহুনি অরণ্য নিতে পারছে না।
বদমাইশ গুলো অরণ্যের কাছে এসে ওকে আঘাত করতে চাইলে অরণ্যের প্রতিঘাতের সামনে কেউই টিকতে পারলোনা। সবগুলোকে একসাথে কুপোকাত করে দিল অরণ্য। রাগের মাথায় সবগুলোকে ইচ্ছেমতো বেধরম মারা মারছে।ছেলেগুলোর আধমরা অবস্থা হয়ে গেছে। তবুও মেরেই যাচ্ছে। আর মারতে মারতেই ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলছে।
–হাউ ডেয়ার ইউ বাস্টার্ড? তোদের সাহস কি করে হলো মায়ার গায়ে হাত দেওয়ার? তোদের কে আজ আমি মেরেই ফেলবো। যাতে আর কখনো কোন মেয়ের সাথে এমনটা করার সাহস না পাস।
অরণ্য পাশে পড়ে থাকা একটা রড হাতে তুলে নিয়ে ছেলেটার মাথায় বাড়ি মারার জন্য উদ্যত হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মায়া উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো।
–অরণ্য….
সাথে সাথে থেমে গেল অরণ্যের হাত। এই প্রথম মায়া অরণ্যের নাম ধরে ডাকলো। অরণ্য রড ফেলে দিয়ে দ্রুত মায়ার সামনে গিয়ে বসে মায়ার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। দুই হাতে মায়ার মুখটা ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–তুমি ঠিক আছ? কিছু হয়নি তো তোমার? ওই সয়তান গুলো তোমার কোন ক্ষতি করেনি তো?
মায়া ছলছল চোখে তাকালো অরণ্যের দিকে। মায়া অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে হঠাৎ অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। হাত পা এখনো কাঁপছে মায়ার। আজ অরণ্য সময়মত না আসলে ওর কি হতো তা ভাবতেই রুহ কেঁপে উঠছে।
মায়ার হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় কিছুসময়ের জন্য থমকে গেল অরণ্য। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে অরণ্য নিজেও দু’হাতে মায়াকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অরণ্য বুঝতে পারছে মায়া এই মুহূর্তে অনেক আতঙ্কে আছে। তাই হয়তো এমন করছে। অরণ্য মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো।
–হুশশ হুশ কাঁদে না। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি না। আমি থাকতে কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।
একটু পরে মায়া একটু শান্ত হয়ে এলো। ওর হুঁশ এলো ও কি করছে। তাই আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। অরণ্যের দিকে তাকাতেও এখন লজ্জা করছে ওর। মাথা নিচু করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। অরণ্য ব্যাপার টা বুঝতে পেরে বলে উঠলো।
–চলো যাওয়া যাক এখন।
মায়া আস্তে করে মাথা ঝাকিয়ে উঠে দাঁড়াতে নিল। কিন্তু এতক্ষণ হাত পা বাঁধা থাকায় কেমন যেন দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না ও। দাঁড়াতে নিয়েই কেমন পড়ে যেতে লাগলো। তখন অরণ্য মায়াকে ধরে ফেললো। কোনকিছু না বলে মায়াকে পাঁজা কোলে তুলে নিল সে। কোলে নিয়ে সামনের দিকে এগুলো। তার নজর শুধু সামনের দিকে। আজ আর মায়া কিছু বললো না। শুধু কেমন মায়াবী চোখে তাকিয়ে রইলো অরণ্যের দিকে।
_____
সারা রান্নাঘরে এসেছিল পানি খেতে। তখনই তনিমা বেগম সারার হাতে একটা গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললো।
–যাতো সারা মা এই কফিটা তোর সাহিল ভাইয়াকে একটু দিয়ে আয়।
সারা অবাক সুরে বললো।
–আমি??
–হ্যাঁ তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে? যানা মা একটু। আমার এখানে অনেক কাজ আছে।
তনিমা বেগমের কথা ফেলতে না পেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সারা কফির মগটা হাতে নিয়ে সাহিলের রুমের দিকে এগুলো।ধ্যাৎ যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কেন যে নিচে এসেছিলাম? এখন আমাকে ওই লুচু লোকটার সামনে যেতে হবে। কি আর করার, কপাল খারাপ হলে এমনই হয়। নিজের মনে এমন বকবক করতে করতে সারা সাহিলের দরজায় এসে নক করলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সারাশব্দ না এলো না। সারা এবার দরজাটা একটু খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো সাহিল ভেতরে নেই। হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছে। এটা দেখে সারা খুশীই হলো। এখন টুপ করে কফিটা রেখে চলে যাবো। ওই লুচু লোকটার সামনে আর পরতে হবে না। কথাটা ভেবে সারা পা টিপে টিপে রুমের ভেতরে ঢুকলো।
টেবিলের ওপর কফির মগটা রেখে ফিরতে নিলেই হঠাৎ সারার চোখ পড়লো বেডের পাশে থাকা ছোট টেবিলের ওপর। টেবিলের ওপর একটা ডাইরির ভেতর থেকে একটা ছবির অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে।ছবিটা কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছে ওর কাছে। মনে হচ্ছে আগে কোথাও দেখেছে ও। সারা কৌতুহলী হয়ে ডায়রিটার দিকে এগিয়ে গেল। ডায়রিটা হাতে তুলে প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখতে পেল, পুরো পাতা জুড়ে একটা বড় লাভ শেফ আকানো। আর তার মাঝে লেখা “আমার পিচ্চি পরি”। লেখাটা দেখে সারার ভ্রু কুঁচকে এলো। পিচ্চি পরি? এটা আবার কে? সারা এবার ছবিটা দেখার জন্য যেই ছবিটা বের করতে যাবে অমনি সাহিল এসে তড়িৎ গতিতে সারার হাত থেকে ডায়রিটা ছিনিয়ে নিল। আচমকা সাহিল আসায় সারা একটু হকচকিয়ে গেল। সাহিল সারাকে পেছনের দেয়ালে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–এখানে কি করছিস তুই হ্যাঁ? আমার ডাইরি চুরি করতে এসেছিস? লজ্জা করে না তোর?
সাহিলের কথায় সারার চরম রাগ উঠে গেল। সারা রাগী কন্ঠে বললো।
–একদম ফালতু কথা বলবেন না। আমার বয়েই গেছে আপনার ওই ফালতু ডাইরি চুরি করতে। আমিতো এমনই দেখছিলাম। এমনিতেও আমি এখানে নিজের ইচ্ছেয় আসিনি। আমাকে বর মা পাঠিয়েছে কফি দিতে তাই এসেছি। এখানে আমার কোন দোষ নেই।
সাহিল সারার মুখের ওপর ঝুঁকে নেশাক্ত কন্ঠে বললো।
–এটাই তো তোর সমস্যা। তুই জানিসই না তোর দোষটা কোথায়? তুই যে আমার কতো ক্ষতি করছিস তার ধারনাই নেই তোর।
সাহিলের এতো কাছে আসায় এমনিতেই কেমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে সারার।তারওপর ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না সারা। সব ওর মাথার উপর দিয়ে বাউন্সার যাচ্ছে। সারা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি আবোল তাবোল বলছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।
সারার কথায় সাহিলের হুঁশ নেই। ওরতো সারার নেশা জেগেছে। সাহিল আরেকটু ঝুঁকে লো ভয়েসে বললো।
–তুই জানিস রাগলে তোকে একদম পাকা স্টবেরির মতো লাগে। ভুলে তোকে খেয়ে ফেললে কি মাইন্ড করবি তুই?
সারা চমকে উঠে চোখ বড়বড় করে তাকালো। আচমকা সারা সাহিলকে দুহাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো।
–আপনি সত্যিই একটা অসভ্য লুচু লোক। আপনি কি ভেবেছেন আমি কিছু বুঝিনা? বোকা হলেও এতোটা বোকা না আমি। বিদেশি মেয়েদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এখন আবার বাঙালি মেয়েদের নিয়ে খেলতে চান? তো আপনার সেই টার্গেট টা কি আমি? বলুন আমাকেও কি ওইসব মেয়েদের মতো….
আর বলতে পারলো না সারা। তার আগেই সাহিল উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–সারাআআআ..
সাহিলের রক্তের প্রতিটি কনা যেন রাগে টগবগ করছে। সারার কথা শুনে সাহিল রাগের সাথে সাথে প্রচুর আহতও হলো। সাহিল সারার হাত চেপে ধরে অগ্নি চোখে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
— আজকের পরে খবরদার আমার সামনে আর আসবিনা তুই। সত্যি বলছি খুন করে ফেলবো তোকে আমি। দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।
কথাটা বলে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলো সারাকে। তারপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল। সাহিলের এমন আচরণে সারার ভীষণ খারাপ লাগছে। কেমন কান্না পাচ্ছে ওর।কিন্তু কেন হচ্ছে তা জানা নেই ওর। সারা মন খারাপ করে ওখান থেকে চলে গেল।
সাহিলের রাগে যেন পুরো শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে। সারার রেখে যাওয়া কফি মগটা উঠিয়ে দেয়ালে ঠাস করে আছার মেরে দিল। ঘরের আরও জিনিসপত্র ভাংচুর করতে লাগলো। পুরো পৃথিবীতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। সারা ওকে কিভাবে ওসব কথা বলতে পারলো। ওর নিঃশ্বাস টাও যার নামে লেখা সেই ওকে এভাবে বলে গেল? কেন এলি তুই আমার জীবনে? আমার কাল হয়ে কেন এলি তুই? সারাআআআআ….
_______
অরণ্য মায়াকে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।দুজনের মাঝে তেমন আর কোন কথা হচ্ছে না। আসলে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না ওরা। দুজনের মাঝেই কেমন জড়তা কাজ করছে। শুধু চোরা চোখে একজন আরেকজন কে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ি একটা জায়গায় আটকে গেল। বারবার স্টার্ট দিয়েও গাড়ি এগুচ্ছে না। অরণ্য বের হয়ে দেখলো জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় গাড়ির চাকা আটকে গেছে। গাড়ির ইঞ্জিন চেক করে দেখলো সেখানেও সমস্যা হয়েছে। অরণ্য পড়ে গেল আরেক মুশকিলে।এখন এতরাতে এই জনশূন্য এলাকায় গ্যারেজ বা মেকানিক কোথায় পাবে? আর দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন যানবাহন পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
অরণ্যকে আসতে না দেখে মায়া একটু চেক করার জন্য গাড়ি থেকে নেমে এলো। অরণ্যের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো।
–কি হয়েছে? কোন সমস্যা?
— হ্যাঁ আসলে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যাবো কিভাবে তাই ভাবছি।
অরণ্যের কথায় মায়াও চিন্তায় পড়ে গেল। এতরাতে কি করবে এখন? অরণ্য কাওকে ফোন করার জন্য ফোন বের করতেই দেখলো ওর ফোনের চার্জও শেষ। আর মায়ার ফোনতো কোথায় তা মায়া নিজেও জানে না। তাই ওরা ফোনও করতে পারছে না। অরণ্য তখন বলে উঠলো।
–আমাদেরকে বোধহয় হেটেই যেতে হবে। দেখি সামনে গিয়ে কোন সাহায্য পাই কিনা। তুমি হাটতে পারবে তো?
মায়া মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো। এখন অনেক টা ঠিক হয়ে গেছে।
–ঠিক আছে তাহলে ধীরে ধীরে চলো।
অরণ্য ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
–আমার হাতটা ধরো। নাহলে অন্ধকারে পড়ে যাবে।
মায়া আস্তে করে নিজের হাতটা অরণ্যের হাতে রাখলো। অরণ্য মায়ার হাত ধরে ওকে নিয়ে সাবধানে হাঁটতে লাগলো। অরণ্যের হাতে হাত রেখে মায়া যেন অনেক ভরসা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই হাতটা সবচেয়ে আস্থার জায়গা। এই হাতটা থাকলে ওর কোন ভয় নেই।
এভাবে কিছুদূর যেতেই হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নেমে পড়লো।এ যেন মরার ওপর খরা। দুজনেই আরও বেশি মুশকিলে পড়ে গেল। অরণ্য মায়াকে নিয়ে দ্রুত কোন সেফ জায়গার খোজ করতে লাগলো। এরই মধ্যেই দুজন ভীজে কাক হয়ে গেছে। এই শীতের মৌসুমে বৃষ্টিতে ভিজে মায়া থরথর করে কাঁপছে। অরণ্য নিজের কোটটা খুলে মায়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। মায়াকে নিয়ে প্রচুর চিন্তা হচ্ছে অরণ্যের। এভাবে থাকলে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে যাবে। আগে জানলে গাড়ির ভেতরেই থাকতো।কিন্তু এখন তো গাড়ি থেকে অনেক দূর চলে আসা হয়েছে। আর উল্টো দিকে যাওয়া টাও ঠিক হবে না। এমনিতেও এতো রাতে জঙ্গলে থাকাটা সেফ না।
অরণ্য মায়ার হাত ধরে দ্রুত হাঁটছে। কিছুদূর আসার পর ওরা একটা ছোট্ট বাড়ি দেখতে পেল। বাড়িটা দেখে অরণ্য একটা আশা পেল। হয়তো এখানে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে। অন্তত বৃষ্টি থেকে তো বাচা যাবে। কথাটা ভেবে অরণ্য মায়াকে নিয়ে ওই বাড়িটাতে গিয়ে ঘরের দরজায় টোকা দিল। একটু পরে এক বৃদ্ধ লোক এসে দরজা খুলে দিল। ওদের দেখে বৃদ্ধ লোকটা বলে উঠলো।
–জে আফনেরা কারা? এতরাইত্তে এইহানে কি চাই?
অরণ্য বললো।
–জ্বি আঙ্কেল আমরা একটু বিপদে পড়েছি। আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে আর বৃষ্টিতেও ভিজে গেছি। আমরা কি একটু আজকে রাতটার জন্য আপনাদের এখানে থাকতে পারি? সকাল হতেই চলে যাবো।
ওদের কথার মাঝেই বৃদ্ধ লোকটার স্ত্রী এসে হাজির হলো। সে বলে উঠলো।
–তোমরা কি জামাই বউ?
অরণ্য ভাবলো এদের না বললে হয়তো থাকতে দিতে নাও পারে। আর মায়ার জন্য এখন একটা সেফ জায়গার খুবই দরকার। তাই অরণ্য বলে উঠলো।
–হ্যাঁ আমরা স্বামী স্ত্রী।
অরণ্যের কথায় মায়া চমকে তাকালো অরণ্যের দিকে। অরণ্য চোখের ইশারায় মায়াকে ব্যাপার টা বুঝালো। মায়াও আর কিছু বললো না। তখন বৃদ্ধ মহিলাটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো।
–আরে আরে আহো ভিতরে আহো। আহারে ভিইজ্জা কি হইছে পোলা মাইয়াডা।
অরণ্য মায়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে বৃদ্ধা মহিলাটিকে বললো।
–চাচী মা ওকে কিছু শুকনো কাপড় দিবেন প্লিজ। বৃষ্টিতে ভিজে ওর ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে।
বৃদ্ধা মহিলাটি বললো।
–হ হ অহনি দিতাছি।
মহিলাটি মায়াকে নিয়ে পাশের ছোট রুমটাতে গেল। এদিকে অরণ্যেরও কাপড় চোপড় পুরো ভেজা। বৃদ্ধ লোকটা একটা গামছা অরণ্যকে দিয়ে শরীর মুছে নিতে বললো। তারপর একটা লুঙ্গি আর স্যান্ডেল গেঞ্জি জাতীয় কিছু অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–লও ভেজা কাপড় বদলাইয়া এইগুলান পইড়া লও। আমরা গরীব মানুষ এর থাইক্কা ভালা কিছু নাই আমগো কাছে। পইড়া লও।
অরণ্য সৌজন্যেমূলক হাসি দিয়ে বললো।
–আরে এভাবে বলছেন কেন? বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছেন এটাই অনেক।
তারপর অরণ্য বৃদ্ধ লোকটার দেওয়া কাপড়চোপড় নিয়ে পড়ে নিল। লুঙ্গি পড়ার অভ্যাস নেই অরণ্যের। তবুও কোনরকম পেঁচিয়ে রাখলো। তবে এখনো শীত শীত লাগছে। অরণ্য নিজের হাত ঘষছে। বৃদ্ধ লোকটা বলে উঠলো।
–কিরে ব্যাটা শীত করতাছে? এমন জোয়ান মরদের আবার শীত লাগে নাকি?
লোকটা একটা গ্লাসে কিছু পানীয় এনে অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–এই লও এক চুমুকে খাইয়া ফালাও। দেখবা সব শরীরে গরমী আইসা গেছে।
অরণ্য বললো।
–এটা কি?
–এইডা তারী( নেশা জাতীয় পানীয়) । খাইলে শরীর গরম হইয়া যাইবো গা।
অরণ্য প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও লোকটার জোরাজুরিতে গ্লাস হাতে নিয়ে খেয়ে নিল। পানীয় টা কেমন তিক্ত আর ঝাঁঝালো। খেতেই কেমন যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। লোকটা আরও এক গ্লাস নিয়ে এলো। এভাবে দুই তিন গ্লাস খেয়ে ফেললো অরণ্য। সত্যি সত্যিই শরীরের ঠান্ডা ভাবটা কেটে গেছে। মাথাটা হালকা চক্কর দিচ্ছে। কেমন ঘোর ঘোর লাগছে অরণ্যের।
তখনই বৃদ্ধা মহিলাটি এসে বললো।
–তোমার বউয়ের কাপড় পাল্টাই দিছি। অহন তুমি যাও ওই ঘরে গিয়া হুইয়া থাকো গিয়া।
মহিলার কথায় অরণ্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মায়ার সাথে এক ঘরে কিভাবে থাকবে ও? কিন্তু এদের সামনে তো সেটা বলা যাচ্ছে না। তাই আর কোন উপায় না পেয়ে অগত্যা পাশের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মনে মনে ভয় লাগছে নাজানি মায়া এই বিষয় টা কিভাবে নিবে? অরণ্য গলা খাঁকারি দিয়ে আস্তে করে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো।
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে পেছনে ফিরে তাকাতেই অরণ্যের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা। চোখের দৃষ্টি যেন ঝলছে উঠছে ওর। ওর সামনে মায়া উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে তার ভেজা চুল ঝাড়ছে। পড়নে তার একটা সুতি শাড়ী। শাড়ী টা গ্রামের আদিবাসী মেয়েদের মতো ব্লাউজ ছাড়া পেঁচিয়ে পড়েছে। হয়তো মহিলাটি এভাবে পড়িয়ে দিয়েছে। এমন মরণঘাতী দৃশ্য যে অরণ্যের দৃষ্টির ধারণক্ষমতার বাইরে। অরণ্যের সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাইরে আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টির ঘনঘটা আর ঝড়ো হাওয়া বইছে। এমন রোমাঞ্চিত পরিবেশে প্রিয়তমার এমন আবেদনীয় রুপ অরণ্যের ভেতরে কালবৈশাখী ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই ওই লোকটার দেওয়া পানীয় খাওয়ার জন্য অরণ্যের কেমন ঘোর ঘোর লাগছে। তারওপর মায়াকে এই রুপে দেখে অরণ্যের নেশা ধরে যাচ্ছে। নিজের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সে।
অরণ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মায়ার কাঁধে হাত রাখলো। মায়া চমকে পেছনে ফিরে তাকালো। ফেরার সময় মায়ার ভেজা চুলগুলো অরণ্যের মুখে বাড়ি খায়। অরণ্য আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। মায়ার কেশবনে হারিয়ে যাচ্ছে সে। মায়ার ভেজা চুলের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে যাচ্ছে অরণ্য। অরণ্যকে এভাবে সামনে দেখে মায়া পুরো জমে গেল। হাত পা থরথর করে কাপছে ওর। লজ্জায় তাকাতে পারছে না অরণ্যের দিকে। অরণ্য এভাবে চলে আসবে জানলে হয়তো কোথাও লুকিয়ে পড়তো। বৃষ্টির কারণে হয়তো অরণ্যের আসার শব্দ পায়নি মায়া। ওই মহিলাটি ওকে এভাবে শাড়ী পরিয়ে দিয়ে গেছে। এখন অরণ্যের সামনে লজ্জায় মরে যাচ্ছে মায়া।
মায়ার লজ্জায় লাল হওয়া চেহারা অরণ্যের সর্বনাশ ডেকে আনছে। সব হুঁশ জ্ঞান লোপ পাচ্ছে। মায়ার মায়াজালে ডুবে যাচ্ছে সে। অরণ্য নেশাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে দুই হাতে মায়ার মুখটা ধরে ওপরে তুললো। মায়ার শরীরের কাঁপুনি আরও শতগুণ বেড়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অরণ্য মায়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে নেশালো কন্ঠে বললো।
–কেন এমন হয় বলনা? কেন তোমার কাছে আসলে ঠিক বেঠিকের হুঁশ থাকে না আমার? কেন তোমার মায়াজাল থেকে বের হতে পারিনা? তোমার কাছে আসা খারাপ জানা সত্বেও কেন এটাই আমার কাছে ঠিক লাগে? কেন মনে হয় এটাই সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক? এটাতে কোন ভুল নেই? কেন বলনা? মন মস্তিষ্কের লড়াইয়ে আমি অনেক ক্লান্ত মায়া। প্লিজ আমাকে মুক্তি দাওনা? আমাকে একটু শান্তি দাওনা? বুকে জ্বলতে থাকা আগুন টাকে নিভিয়ে দাওনা।
অরণ্যের আবেগি কথাগুলো মায়াকে কেমন মোহিত করে দিল।দুজনের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। অরণ্যের তৃষ্ণার্থ নজর মায়ার কম্পিত অধর জোড়ায়। অরণ্যের চাওয়া বুঝতে পারছে মায়া। মায়ার নিজেরও আজ বাকি দুনিয়ার সব বাধ্যবাধকতা ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। আজ একটু স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করছে। আজকের জন্য নাহয় ও ওর স্বামীর ভালোবাসা পেল। এতে ক্ষতির কি আছে? লোকটা তো তারই স্বামী। হ্যাঁ আজ সে স্বার্থপর হবে। স্বামীর ভালোবাসায় নিজেকে হারাবে সে।
মায়া চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মুখটা হালকা উঁচু করে নিল। মায়াতে বিভোর অরণ্য মায়ার এমন আহবানে কিভাবে সারা না থাকতে পারে। অতঃপর অরণ্য মায়ার অধরের সাথে নিজের অধরযুগল মিলিয়ে নিল। মায়ার অধরসুধাপান করতে লাগলো। মায়া নিজের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছে।দুই হাতে অরণ্যের গেঞ্জি খামচে ধরে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দীর্ঘ পাঁচ মিনিট ধরে চললো তাদের সুধাপান। তারপর অরণ্য মায়াকে কোলে তুলে নিয়ে এসে বেডের ওপর বসিয়ে দিল। মায়া লজ্জায় উল্টো দিকে ঘুরে বসলো। অরণ্য মায়ার পিঠের ওপর থেকে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে একপাশে রেখে, মায়ার খোলা পিঠে ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগলো। মায়ার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরলো। পিঠে চুমু খাওয়া শেষে অরণ্য মায়াকে আবার নিজের দিকে ঘুরালো। ডুব দিল আবারও মায়ার ঠোঁটে। মায়াকে নিয়ে পাড়ি দিল ভালোবাসার রাজ্যে।
___
রাত মাঝ প্রহর, অরণ্যের বাহুডোরে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে মায়া। আর অরণ্য মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে দেখছে তার সন্ধ্যামালতীকে। মায়ার গালে হাত রেখে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে আলতো করে স্লাইড করছে। মনে মনে বলছে, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না সন্ধ্যামালতী। আর একটা সেকেন্ডও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি।এখন তো তোমার মনের কথাও বুঝে গেছি আমি। আমি কালই বাবাকে সবকিছু বলে দিবো। যা হওয়ার হবে। আমি আর কিছুর ভয় করি না। হয়তো রিয়ার সাথে একটু অন্যায় হবে।কিন্তু আমার কিছু করার নেই। এমনিতেও আমি ওকে কখনো মেনে নিতে পারবোনা।তার চেয়ে ভালো ও এই মিথ্যে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে অন্য কারোর সাথে সুখে থাকুক। আমার শুধু তোমাকে চাই। আর কিছু না। ভালোবাসি সন্ধ্যামালতী। অনেক ভালোবাসি।
অরণ্য মায়ার কপালে চুমু দিয়ে তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে একসময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।
চলবে…..