#মায়ারণ্যে,পর্ব-২২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
দুই ঘন্টা পার হয়ে গেল তবুও মায়া আসছে না অরণ্যের আর সহ্য হচ্ছে না। বুকটা কাঁপছে ওর। মায়া যদি ওকে ভুল বুঝে ওকে ছেড়ে চলে যায়। তাহলে কি করবে ও? না না আবারও মায়াকে হারাতে পারবোনা আমি। কিছুতেই না। অরণ্য আর থাকতে পারলোনা। দ্রুত এসে দরজা খুলে বাইরে তাকালো। কিন্তু একি! মায়াতো নেই। কোথায় গেল ও? মায়া যে কারোর রুমে যাবেনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত অরণ্য। তাহলে কোথায় গেল ওর মায়া? সত্যি সত্যিই ওকে ছেড়ে আবার চলে গেল নাতো? না না মায়া আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। কিছুতেই না।
অরণ্য ওর সাথে আসা মেয়েটাকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে বললো।
–আপনি এখন যেতে পারেন।
মেয়েটা বলে উঠলো।
–আপনার মতো মানুষ আমি আগে কখনো দেখিনি। একজন মানুষ তার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসে তা আপনাকে না দেখলে হয়তো জানতামই না।আপনার স্ত্রী সত্যিই অনেক লাকি। আমি দোয়া করবো আপনাদের মাঝে সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।
কথাটা বলে মেয়েটা বেড়িয়ে গেল।
আর অরণ্য পাগলের মতো সবজায়গায় ওর সন্ধ্যামালতীকে খুঁজতে লাগলো। নিচে এসে কোথাও পেল না মায়াকে। ভয়ে বুক কাঁপছে অরণ্যের। কোথায় গেল আমার সন্ধ্যামালতী? কোথায় খুঁজবো এখন? প্লিজ মায়া ফিরে এসোনা। আই প্রমিজ আর কষ্ট দেবোনা তোমাকে। প্লিজ ফিরে এসোনা। অরণ্যের হঠাৎ ছাদের কথা মনে হলো। মায়ার তো রাতের বেলায় ছাঁদে যাওয়ার অভ্যাস আছে। কথাটা মনে হতেই অরণ্য দ্রুত ছাদের দিকে দৌড়ালো। দৌড়ে ছাদের দরজায় আসতেই অরণ্যের পুরো পৃথিবী থমকে গেল। মায়াকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে অরণ্যের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। বৃষ্টি এতক্ষণে থেমে গেছে। শুধু নিস্তেজ মায়া পড়ে আছে অবহেলায়। এই দৃশ্য যে অরণ্যের কাছে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে কম না। অরণ্যের আত্মা যেন গলায় আটকে গেল। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের করতে পারছে না ওর।
অরণ্য ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা পায়ে সামনের দিকে এগুলো। তারপর হঠাৎ একছুটে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ার মাথাটা তুলে নিজের কোলে নিয়ে দেখলো জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে মায়ার। অরণ্যের হাত পা কাঁপতে লাগলো। মায়ার গালে হাত দিয়ে কম্পিত গলায় বলতে লাগলো।
–মা মায়া,এ এই মায়া উঠছ না কেন? এই মায়া, মায়া…
মায়ার কোন রেসপন্স না পেয়ে অরণ্য পুরো পাগল হয়ে গেল। অস্থির হয়ে মায়াকে ডাকতে ডাকতে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলো।
–এই মায়া, আমার সন্ধ্যামালতী ওঠনা প্লিজ? কি হয়েছে তোমার? এই সোনা আমার ওঠনা?
অরণ্য মায়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো।
–আই অ্যাম সো সরি, সো সরি। আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন করবো না।আর কষ্ট দেবনা তোমাকে। প্লিজ ওঠনা কলিজাটা। আমাকে এতবড় শাস্তি দিস না। বাঁচব না তোকে ছাড়া। প্লিজ ওঠনা সোনা। এবারের মাফ করে দে আমাকে। প্লিজ প্লিজ প্লিজ…
অরণ্য আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত মায়াকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে সবাইকে ডাকতে লাগলো। মায়াকে রুমে এনে বেডে শুইয়ে দিয়ে মায়ার হাত পায়ের তালু ঘষতে লাগল। অরণ্যের ডাকে বাসার সবাই এসে হাজির হলো। মায়াকে এই অবস্থায় দেখে বাসার সবাই প্রচুর ঘাবড়ে গেল। সবাই শুধু বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কিভাবে কি হয়েছে। অরণ্য বললো।
–এতকিছু এখন বলার সময় নেই। সাহিল তাড়াতাড়ি ডক্টর আঙ্কেল কে ফোন করে আসতে বল।
–ওকে ভাইয়া আমি এখুনি ফোন করছি।
ইরিন এগিয়ে এসে বললো।
–মায়ার কাপড় তো ভেজা। ওর কাপড় পাল্টে দিতে হবে। সবাই একটু বাইরে যাও।
সব পুরুষ গুলো বাইরে চলে গেল। ইরিন মায়ার কাপড় পাল্টে দিলো। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার চলে এলো। ডক্টর এসে মায়ার চেক আপ করছে। বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। অরণ্যের অবস্থা করুন। নিঃশ্বাস আটকে আসছে ওর। নিজেকে ওর খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আজ ওর জন্য মায়ার এই অবস্থা হয়েছে। মায়ার কিছু হয়ে গেলে কি করবে ও? কিভাবে বাঁচবে? অরণ্য শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। আমার মায়াকে ঠিক করে দাও আল্লাহ। আর কিছু চাইনা আমি।
তনিমা বেগম অরণ্যের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–কি করেছিস তুই মেয়েটার সাথে? ভালো করেই বুঝতে পারছি নিশ্চয় তুইই কিছু করেছিস? এখন নিশ্চয় শান্তি লাগছে তোর। এটাই তো চাইছিলি তুই।
অরণ্য করুন চোখে তাকিয়ে বললো।
–মা…..আ,
–খবরদার মা মা করবি না। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে আমি তোকে কখনোই মাফ করবো না।
একটু পরে ডক্টর বাইরে এসে বললো।
–দেখুন অনেকক্ষণ পানিতে ভেজার কারণে উনার এই অবস্থা হয়েছে। আর মনে হচ্ছে উনি খাওয়া দাওয়াও করেনি তাই বিপি অনেক লো। যাইহোক আমি ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। আশা করি সকালের ভেতর উনার জ্ঞান ফিরে আসবে। তানাহলে হয়তো হসপিটালে ভর্তি করা লাগতে পারে। সকালে জ্ঞান না ফিরলে আমাকে ফোন দিয়েন।
–জ্বি ঠিক আছে।
ডাক্তারের কথায় অরণ্যের ভয় আরও বেড়ে গেল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর।
রাত চারটা বাজে।এখন আর কারোর চোখে ঘুম আসবেনা।তাই সবাই বসে আছে মায়ার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়। তবে অরণ্য এখানে নেই। ও মায়াকে এই অবস্থায় দেখে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। তাই রুম থেকে বেড়িয়ে ছাঁদে এসে মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে ও।
একটু পরে ইরিন এসে ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। অরণ্য মাথা তুলে ইরিনকে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখাতে পারলোনা। ইরিনের পায়ের ওপর মাথা রেখে কেঁদে উঠে বললো।
–আমি অনেক বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি আপু।আমি অনেক খারাপ হাসব্যান্ড। আমি কি করবো এখন? মায়ার কিছু হয়ে গেলে আমিও শেষ হয়ে যাবো আপু।মায়া চোখ খুলছে না কেন? আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে।দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার। আপু প্লিজ আমার মায়াকে ঠিক করে দাওনা। উঠতে বলো ওকে। ও তোমার কথা নিশ্চয় শুনবে। প্লিজ বলনা আপু। আই প্রমিজ আমি আর ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না।ভালো হাসব্যান্ড হয়ে দেখাবো। শুধু একবার উঠতে বলো ওকে।
অরণ্যের এমন অবস্থা দেখে ইরিনের প্রচুর খারাপ লাগছে। ওর ভাইটাকে আগে কখনো এভাবে ভেঙে পড়তে দেখেনি। ইরিন অরণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো শান্ত হ ভাই। এতো ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে।মায়ার কিছু হবে না। দেখবি একদম ঠিক হয়ে যাবে ও। তোকে কষ্টে রেখে ও বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না।
দেখতে দেখতে সকালের আলো ফুটে উঠলো। মায়ার জ্ঞান এখনো ফিরছে না। অরণ্য বোধশক্তিহীন হয়ে পড়ছে। মাথাটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে ওর। মায়াকে হারানোর ভয়ে আত্মা কাঁপছে ওর। ও এখনো ছাদেই বসে আছে। হঠাৎ তখনই সারা দৌড়ে এসে বললো।
–ভাইয়া ভাবির জ্ঞান ফিরে এসেছে।
অরণ্যের যেন আটকে থাকা নিঃশ্বাস টা ছাড়া পেল। নতুন জীবন ফিরে পেল বোধহয়। অরণ্য খুশিতে পাগল হয়ে দৌড়ে নিচে নেমে। তবে দরজার কাছে আসতেই ওর কদম আটকে গেল। ভেতর ঢোকার সাহস নেই ওর। কোন মুখে যাবে ও মায়ার সামনে? ওর জন্যই তো আজ ওর মায়ার এই অবস্থা হয়েছে। মায়াকে কিভাবে এই মুখ দেখাবে ও। অরণ্য দরজার আড়াল থেকেই মায়াকে দেখতে লাগলো। মায়ার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ও বাসার বাকি লোকজনের সাথে কথা বলছে।
মায়া সবার সাথে কথা বললেও ওর নজর শুধু অরণ্যকেই খুঁজছে। সবাই এসেছে কিন্তু উনি একবারও এলোনা। নাকি এখন আমার চেহারাও দেখতে চায়না সে। হয়তো এতটাই তিক্ত হয়ে গেছে সে আমার ওপর। জ্ঞান টা আর কখনো না ফিরলেই হয়তো ভালো হতো। তাহলে সবাই এই বোঝা থেকে মুক্তি পেয়ে যেত।
সকাল ৯ টা
তনিমা বেগম সহ বাকি লোক ড্রয়িং রুমে বসে আছে। মায়া আপাতত ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। তখনই বাসার কলিং বেল টা বেজে উঠলো। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিলে একটা মধ্যে বয়স্ক লোক ভেতরে ঢুকলো। পাঞ্জাবি আর টুপি পরিহিত। লোকটা তনিমা বেগম দের সামনে এসে বললো।
— আসসালামু আলাইকুম। জ্বি আমি মায়ার চাচা।
তনিমা বেগম তড়িঘড়ি দেখিয়ে বললো।
–ও আচ্ছা। বসুন না ভাই সাহেব।
লোকটা বসে বললো।
–মায়া কি আপনাদের এখানে?
–জ্বি এখানেই। আসলে মেয়েটা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই আরাম করছে।
–ওও। অরণ্য কি আছে? ওর সাথে একটু কথা বলতাম।
তনিমা বেগম অরণ্যেকে ডেকে পাঠালো। একটু পরে অরণ্য নিচে নেমে আসলো। মায়ার চাচাকে দেখে অরণ্যের ভ্রু কুঁচকে আসলো। লোকটাকে চিনতে তার বেশি সময় লাগলো না। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–আপনি???
মায়ার চাচা বলে উঠলো।
–হ্যাঁ আমি। জানি আমাকে দেখে হয়তো তোমার মনে অনেক ক্ষোভ জাগছে। আর এই বিষয় নিয়েই আমি কথা বলতে এসেছি।
–কি বলবেন বলুন।
লোকটা তখন কিভাবে মায়ার সাথে অরণ্যের বিয়ে পড়ায় সেটা খুলে বললো। তারপর অসহায় কন্ঠে বললো।
–দেখ বাবা যা হয়েছে এতে মায়ার কোন দোষ নেই। মায়ার মামা মামী ওকে এমনটা করতে বাধ্য করেছে। সেদিন আমি চলে যাওয়ার পরে যে এতকিছু হয়েছে তা আমি জানি না। জানলে আমি কখনোই হতে দিতাম না। আজ মায়ার সাথে দেখা করার জন্য ওর মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর সেখানেই সবটা জানতে পারি। আর সাথে সাথেই আমি এখানে চলে আসি। তোমার সাথে কথা বলা অনেক জরুরি ছিল। আসলে মায়া মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই অনেক চাপা স্বভাবের। মা বাবা মরা মেয়েটা নিজের কষ্ট কাকেই বা বলবে। তাইতো ছোটবেলা থেকেই নিজের কষ্ট নিজের মাঝেই রাখতে শিখেছে। অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিবে। তবে নিজের অধিকার কখনো আদায় করবো না। ওর মামা মামী যেমনই হোক তাও তাদেরই নিজের মা বাবা মনে করে ও। তাইতো তাদের কথা রাখতে সেদিন ওমন একটা কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল। আর আমিও ভেবেছিলাম হয়তো উপরওয়ালার এটাই ইচ্ছে। তাই তোমাদের বিয়টাকে বৈধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটার সাথে যে এতবড় অন্যায় হয়েছে তা আমি জানতামই না। আর আমি নিশ্চিত ওর মামা মামী ওকে কোন কোন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ওকে রাজি করিয়েছে। আর পরবর্তীতেও ও চাইলেও ওর মামা মামীর জন্য কিছু বলতে পারেনি।
মায়ার চাচার কথায় অরণ্য সহ বাকি সবারই চোখে পানি চলে এলো। অরণ্যের অপরাধ বোধ আরও আসমান সমান হয়ে যাচ্ছে। মায়ার চাচা এবার দুই হাত জোর করে অনুনয়ের সুরে বললো।
–বাবা তোমার কাছে অনুরোধ। মা বাবা মরা এতিম মেয়েটির ওপর কোন অত্যাচার করোনা। ও সারাজীবন কষ্টই পেয়ে এসেছে। ও কখনো মুখ ফুটে নিজের সুখ চাইবে না। তুমি ওকে একটা সুযোগ দাও। দেখবে তোমাদের পুরো পরিবারটাকে সুখে ভরিয়ে দিবে।
অরণ্য মায়ার চাচার হাত ধরে বললো।
–আরে আরে কি করছেন, এসব করবেন না প্লিজ। আর হ্যাঁ আপনার ওপরও আমার কোন রাগ নেই। আপনি হয়তো জানেন না আপনি আমার কতবড় উপকার করেছেন। আপনি অজান্তেই ঠিক মেয়েটিকেই আমার জীবনসঙ্গিনী করে দিয়েছেন। এজন্য আমি চির ঋণী থাকবো।
অরণ্যের কথায় মায়ার চাচা কিছু বুঝতে পারছে না। তাই অরণ্য সবকিছু খুলে বললো। সব শুনে মায়ার চাচা হাসিমুখে বললো।
–আলহামদুলিল্লাহ। এটা তো অনেক সুখবর। আল্লাহ তোমাদেরকে সহিসালামত রাখুক। তোমারা সুখে থাক এটাই দোয়া করি। মেয়েটা অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। এবার ওকে একটু সুখী রেখ।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে মায়ার সাথে দেখা করে মায়ার চাচা চলে গেল।
চাচার কথায় অরণ্যের অপরাধ বোধ আরও বেড়ে গেল।নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাক্তি মনে হচ্ছে। না জেনে ওর মায়াপরি কে কতো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। এর প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করবে ও?
ভাবনার মাঝেই তনিমা বেগম অরণ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–আর কতক্ষণ এভাবে থাকবি বাবা? যা বউমার সাথে দেখা কর গিয়ে।
অরণ্য মায়ের দিকে অপরাধী চোখে তাকিয়ে বললো।
–কোন মুখে যাবো মা? ওর চোখে তাকানোর সাহস যে পাচ্ছি না আমি।
–মুখে না বললেও মেয়েটার চোখ দুটো যে তোকেই খুঁজছিল। যা গিয়ে দেখা কর। একবার কথা বল সব ঠিক হয়ে যাবে। দূরে থাকলে দূরত্ব আরও বাড়বে। আর ভুল বোঝাবুঝিও বাড়বে।
তনিমা বেগমের কথায় অরণ্য মাথা ঝাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর রুমের দিকে পা বাড়ালো। তবে এখনো মনের মাঝে অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিভাবে ও মায়ার সামনে যাবে? ভাবনার মাঝেই অরণ্য দরজাটা হালকা করে খুললো। ভেতরে ঢুকতে নিয়েও আবার ফিরে আসতে চাইলো। তখনই দেখলো মায়া পানি খাওয়ার জন্য বেডের পাশে ছোট টেবিলের ওপরের পানির গ্লাস টা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শরীর দূর্বল থাকায় উঠতে কষ্ট হচ্ছে ওর। অরণ্য এটা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে গেল ওখানে। গ্লাসে পানি ঢেলে মায়ার হাতে দিল। মায়ার মাথার নিচে হাত দিয়ে মায়াকে বেডের মাথার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে পানি খেতে সাহায্য করলো। অরণ্যের নজর নিচের দিকে। মায়ার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। তবে মায়ার নজর অরণ্যতেই আবদ্ধ। যেন কত জনমের তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। পানি খাওয়া শেষে গ্লাসটা রেখে দিল অরণ্য।
মায়া অরণ্যের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে।
–এখন কি আমার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না আপনার?
মায়ার কথায় বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো অরণ্যের। অরণ্য অপরাধী চোখে তাকালো মায়ার দিকে। মায়া ধরা গলায় বলে উঠলো।
–সরি আপনাকে হয়তো আবারও ডিসিপয়েন্ট করে দিলাম। মরে গেলে হয়তো এই জঞ্জাল থেকে মুক্তি পেয়ে যেতেন। কিন্তু এখানেও আমার দূর্ভাগ্য জিতে গেল। আর আপনার ওপর বোঝা হয়ে আবারও ফিরে এলাম।
মায়ার কথাটা যেন ধারালো ছুরি হয়ে অরণ্যের হৃদপিণ্ড ভেদ করে গেল। চোখে রক্ত উঠে গেল ওর। অরণ্য রেগে উঠে মায়ার দিকে হাত উঠিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–মায়াআআআ..
চড় মারার জন্য হাতটা উঠালেও সেটা করতে পারলো না অরণ্য। হঠাৎ দুই হাতে মায়াকে টেনে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেন বুকের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে শান্তি। তারপর বলে উঠলো।
–তোমার সাহস কি করে হলো এটা বলার? জানো তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার কি হাল হয়েছিল? জান বেরিয়ে গিয়েছিল আমার। আর তুমি এটা বলতে পারলে?
অরণ্যের আলিঙ্গনে মায়াও থাকতে পারলো না। অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অরণ্য দুই হাতে মায়ার মুখটা ধরে সারা মুখে পাগলের মতো চুমু খেয়ে, মায়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে অশ্রু ঝরাতে লাগলো। মায়ার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলো।
–অ্যাম সরি সোনা। অ্যাম সো সরি।আমি জানি আমি খুবই খারাপ হাসব্যান্ড। আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আই প্রমিজ আর কখনো এমন করবো না। কখনো না। আমার সন্ধ্যামালতীকে আর কোন কষ্ট দিবোনা আমি। কখনো না। আর একটা সুযোগ দাও আমাকে।
মায়া বলে উঠলো।
–আপনি কেন সরি বলছেন? অন্যায় তো আমি করেছি। আপনার রাগ করা জায়েজ।
–না না তোমার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমিই তোমাকে না বুঝে কষ্ট দিয়েছি।অনেক অন্যায় করেছি আমি। তবে আমি সত্যি বলছি আমি ওই মেয়েটার সাথে কিছুই করিনি। আমিতো শুধু তোমাকে দেখানোর জন্য ওই মেয়েটাকে এনেছিলাম। বিশ্বাস করো আমি….
অরণ্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই মায়ার অরণ্যের ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল চেপে ধরে বললো।
–হুঁশশ,, আমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সব জানি। আপনার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। যে ছেলে নিজের বউ মনে করা সত্বেও, এতদিন ধরে একই ঘরে থাকা একটা মেয়েকে ছুয়েও দেখেনি। সে যে বাইরের কোন মেয়ের সাথে কিছু করবে, সেটা আমি কখনই বিশ্বাস করবো না।
মায়ার অরণ্যের প্রতি বিশ্বাস দেখে অরণ্যের ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি ভেসে উঠলো। অরণ্য মায়ার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো।
–কিন্তু তুমি আমাকে আগে কেন সবকিছু খুলে বললে না? তাহলে তো তোমাকে ভুল বুঝে এতো কষ্ট দিতাম না।
মায়া বলে উঠলো।
–কারণ অন্যের ওপর যতই দোষ গড়াই। তাতে আমার দোষটা কম হবে না। যেভাবেই হোক না কেন,দোষ আমারও আছে। তাইতো আমার ভুলের শাস্তি ভোগ করছিলাম।
অরণ্য মায়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
–যা হবার তা হয়ে গেছে। তুমি আমার কাছে আছো। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর কিছু চাইনা আমি। আজ থেকে পুরনো সব ভুলে নতুন করে আমাদের জীবন শুরু করবো। যেখানে কোন দুঃখ গ্লানি থাকবে না। থাকবে শুধু সীমাহীন ভালোবাসা।
কথাটা বলে মায়ার কপালে চুমু দিয়ে আবারও বুকে জড়িয়ে নিল। মায়াও পরম আবেশে অরণ্যের বুকের মাঝে মিলিয়ে গেল। এটাই যে পরম শান্তির জায়গা ওর।এটারই অভাব ছিল ওর জীবনে। যেটা আজ পূর্ণতা পেল। আর কিছু চাওয়ার নেই ওর।
চলবে…..