#মায়ারণ্যে,পর্ব-৯
#লেখিকা- মেহরুমা নূর
রাইসার বিয়ে উপলক্ষে সবাই শপিং মলে এসেছে শপিং করতে। মায়া আসতে চাইছিল না কিন্তু সারার জোরাজুরিতে আসতে বাধ্য হয়েছে। মায়া আসায় অরণ্যেরও ভালো লাগছে। নাহলে হয়তো ও নিজেও আসতো না।
নিশান আর ওর ভাই জোবানও এসেছে ওদের সাথে শপিং করতে। সবাই মলে ঢুকে মনের আনন্দে নিজেদের মতো শপিং করে যাচ্ছে। বড়ো একটা লেহেঙ্গার দোকানে ঢুকে সবাই লেহেঙ্গা দেখছে। বিয়ের সব ফাংশনের জন্য আলাদা আলাদা লেহেঙ্গা পছন্দ করছে। মায়া শুধু সবারটা দেখে যাচ্ছে। তার এমন অত্যাধুনিক শপিং করার না অভ্যাস আছে না দরকার। দুই তিনটা টিউশনি করে নিজের সব খরচ চালাতে হয় ওকে। অপ্রয়োজনীয় এতো টাকা খরচ করাটা মায়ার পছন্দ না। একটা দিনের জন্য এতো টাকা নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। হয়তো এদের কাছে সব সুবিধা আছে বলেই এরা টাকার মূল্য বোঝে না। যাদের কাছে নেই তারা বোঝে টাকার আসল মূল্য। যত টাকা এরা নষ্ট করছে তা দিয়ে কতো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জামাকাপড় হয়ে যাবে। তবে সবাই যে একইরকম ভাববে সেটাতো আর জরুরি না। ওরা ওদের মনের আনন্দের জন্য খরচ করছে। তাই ওদের দিক দিয়ে ওরা ঠিকই আছে।
নিশানের ভাই জোবান সারার পাশে বসে ওকে নানান রকমের লেহেঙ্গা বেছে বেছে দেখাচ্ছে আর ন্যাকামি করছে। যা দেখে সাহিলের মেজাজ টপফ্লোরে উঠে যাচ্ছে। এই জোবান নামের আইটেম টা যদি নিশানের ভাই না হতো তাহলে এতক্ষণে ওকে দুমড়েমুচড়ে পার্সেলে ভরে নাম না জানা গ্রহে পাঠিয়ে দিতো। তাই আপাতত নিজের রাগটাকে পানি ছাড়াই গিলে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে কোন কিছু না বলে সারার হাতটা শক্ত ধরে ওকে টানতে টানতে দোকানের বাইরে চলে গেল। বেচারা সারা সাহিলের হঠাৎ আক্রমণে থতমত খেয়ে গেল। সাহিলের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলতে লাগলো।
–আরে কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে। আমার লেহেঙ্গা নেওয়া হয়নি এখনো।
তবে সাহিলের সাথে কি আর ওর মতো ননির পুতুল পেরে ওঠে? সাহিল যেতে যেতে সবার উদ্দেশ্যে বললো।
–তোমারা এখানে শপিং করো। আমি সারাকে অন্য কিছু দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।
সবাই আর তেমন কিছু বললো না। জানে সাহিল শুনবে না। ও অনেক জিদ্দি স্বভাবের।
সাহিল সারাকে একটা ফাঁকা দোকানে নিয়ে গেল। যেখানে শুধু মহিলা স্টাফ আছে। সাহিল সারাকে দোকানে বসিয়ে দিয়ে স্টাফদের উদ্দেশ্যে বললো।
–ম্যাডামের যা লাগে দেখান। আর যতক্ষণ আমরা এখানে আছি অন্য কোন কাস্টোমার যেন না আসে। তার জন্য আপনাদের এক্সট্রা পেমেন্ট করা হবে।
কথাটা বলে সাহিল একপাশে গিয়ে বসে পড়লো। আর স্টাফরা সারাকে ড্রেসেস দেখাতে লাগলো। সারা সাহিলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো।
–আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন? আমি ওখানেই সবার সাথে শপিং করবো।
কথাটা বলে সারা উঠে চলে যেতে লাগলো। তখনই সাহিল পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে বললো। –দোকানের বাইরে যদি পা রেখেছিস তাহলে তোর আজকের সব শপিং বন্ধ। রাইসার বিয়েতে তোকে কিছুই কিনে দেওয়া হবে না মনে রাখিস।
সারা সাহিলের তাকিয়ে চোখ কুঁচকে তেজী সুরে বললো।
–কেন কেন? আপনি বললেই হলো নাকি? আমার শপিং এর টাকা কি আপনি দিবেন নাকি? আমি আমার বাবার কাছ থেকে যথেষ্ট টাকা নিয়ে এসেছি বুজেছেন? আর কম পড়লে অরণ্য ভাইয়া দিবে। তাই আপনার কথা আমি কেন শুনতে যাবো?
কথাগুলো বলে সারা আবারও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হতেই সাহিল সারার হাত ধরে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছিস? দিনদিন দেখছি তোর সাহস বেড়েই চলেছে। আমার কথার অমান্য হলে এর পরিণাম তোর জন্যে মোটেও সুখকর হবে না। তাই নিজের ভালো চাসতো চুপচাপ এখানে বসে যা যা লাগবে কিনে নে। নাহলে আমি তোর সারাজীবনের জন্য শপিং এ আসা বন্ধ করে দিবো মনে রাখিস।
সারা এতক্ষণ সাহস দেখালেও এবার ও দমে গেল। বেচারির ছোট্ট মাসুম জান,এই রাক্ষস দানবের সামনে কি আর টিকতে পারে? সারার কাছে সাহিলকে রুপকথার ভয়ংকর কোন রাক্ষস দানবের মতো লাগে। যেন এখুনি তার বিশাল দাঁত বের করে তাকে খেয়ে ফেলবে। তাই সারা ভীতু ভাবে মাথা ঝাকালো। মানে সে সাহিলের কথা মানতে রাজি। সাহিল সারাকে ছেড়ে দিলে সারা গিয়ে ওর শপিং করতে লাগলো আর মনে মনে সাহিলকে গালির বন্যায় ভাসিয়ে দিল।
___
ইহান একটা লেহাঙ্গার ওড়না ইরিনের কাঁধে রেখে বললো।
–ওয়াও ইরাবতী এটাতে তোমাকে অনেক মানিয়েছে। অনেক সুন্দর লাগছে। তুমি এটা ট্রাই করে দেখোনা।
ইরিন মুচকি হেসে লেহেঙ্গা টা নিয়ে ট্রায়াল রুমে চেঞ্জ করতে গেল। কিছুক্ষণ পর ইরিন চেঞ্জ করে বাইরে এসে ইহানকে বললো।
–কেমন হয়েছে?
ইহান কি জবাব দিবে? সেতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মুদিত নয়নের মুগ্ধতায় সিক্ত হচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আঁখি ভেজাচ্ছে ইরিনের সৌন্দর্যের ঝলকানিতে। ইহানের মুগ্ধতার মাঝেই ইরিন আবারও বলে উঠলো।
–কি হলো ইহান? ভালো লাগছে না?
ইরিনের কথায় ইহানের ঘোর কাটলো। নিজের পাখা ছড়ানো মনটাকে একটু সামলে নিয়ে মুচকি হেসে বললো।
–আরে চমৎকার পারফেক্ট লাগছে। একদম নতুন বউ বউ লাগছে।
ইহান ইরিনের কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো।
–চলো আজই বিয়ে করে ফেলি।
ইরিন আবারও হেঁসে দিয়ে বললো।
–ধ্যাৎ তুমিও না। সবসময় শুধু মজা করা।
ইরিন আবারও চেঞ্জ করতে চলে গেল। আর ইহান নিজের ওপর নিজেই হাসলো। সেকি কখনো ইরিনের সামনে মজাটাকে সত্যি প্রমান করতে পারবে? পারবে তার মনে জমে থাকা হাজারো অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে? এতোসব প্রশ্নের মেলা থাকলেও, নেই কোন উত্তরের অবকাশ।
কথাগুলো ভেবে ইহান গুনগুন করে গেয়ে উঠলো।
♬ শাহেদ কাভি না কেহ সাকু মে তুমকো
♬ কাহে বিনা সামাঝ লো তুম শাহেদ
♬ শাহেদ মেরে খেয়ালো মে তু ইকদিন
♬ মিলো মুঝে কাহি পে গুম শাহেদ
♬ জো তুম না হো রাহেঙ্গে হাম ভি হাম নেহি
♬ না চাহিয়ে তুমছে জিয়াদা তুমছে কাম নেহি
__
রিয়াতো আসা থেকেই চোখের সামনে যা পছন্দ হচ্ছে কিনেই যাচ্ছে। বাদবাকি আর কিছুর আপাতত হুঁশ নেই ওর। হুঁশ রেখেই বা কি করবে।ওর কাছে তো এগুলোই মোস্ট ইম্পরট্যান্ট। এসবই তো ওর চাওয়া ছিল। আর আজ যখন ওর চাওয়া পুরণ হচ্ছে তখন বাকি কিছু দেখার টাইম নেই।
অরণ্য কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিল। মাঝে মধ্যে মায়াকে দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আশে পাশে তাকাতেই হঠাৎ একটা মানেকুইনে রাখা একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ী দেখতে পেল। শাড়িটা দেখে অরণ্যের কেন যেন মনে হলো, এই শাড়িটাতে সন্ধ্যামালতীকে অনেক মানাবে। শাড়িটাতে মায়াকে কল্পনা করছে অরণ্য। অরণ্যের খুব ইচ্ছে হচ্ছে মায়াকে এই শাড়িতে দেখার। কিন্তু এটা কি সম্ভব? মায়াকে কিভাবে দিবে এই শাড়ি? আর দিলেও যে মায়া নিবে তারও সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু তার যে খুব মন চাইছে মায়াকে শাড়িটা দেওয়ার। কিন্তু কিভাবে দিবে?
কিছুক্ষণ ভাবার পর অরণ্যের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। অরণ্য আস্তে করে রাইসাকে নিজের কাছে ডাক দিয়ে বললো।
–শোন তোর ওই শাড়িটা কেমন লাগে?
রাইসা দেখে বললো।
–অনেক সুন্দর ভাইয়া। তুমি কি ভাবির জন্য নিবে?
–আরে না ও এসব নিবে না। ও ওর পছন্দ মতো শপিং করছে।
–তাহলে কার জন্য নিবে?
–তুই নিবি? তোকেও কিন্তু ভালো মানাবে।
–কিন্তু ভাইয়া আমিতো সব ফাংশনে লেহেঙ্গা পড়বো। আর লেহেঙ্গা অনেক গুলো চয়েজও করে ফেলেছি।
—হুমম,তাহলে কাকে দিবো শাড়িটা? আসলে শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।
রাইসা কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
–ভাইয়া এক কাজ করি মায়া আপুকে দেই। মায়া আপুকে অনেক মানাবে শাড়িটাতে।
অরণ্য কিঞ্চিৎ বাঁকা হাসি দিল। সেতো এটাই চাচ্ছিল। অরণ্য বললো।
–কিন্তু মায়া কি নিবে শাড়ী?
–আরে নিবে না কেন? আমি দিবো আপুকে।
–আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমার কথা যেন বলিসনা। তাহলে হয়তো নিবেনা। বলবি তুই পছন্দ করে দিয়েছিস।
–আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এখুনি গিয়ে দিচ্ছি।
রাইসা শাড়িটা নিয়ে মায়াকে দিয়ে পড়ে ট্রাই করতে বললো। মায়া অনেক মানা করলেও রাইসার জেদের সামনে মায়া শাড়ি টা নিতে বাধ্য হলো। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়া শাড়ি নিয়ে ট্রায়াল রুমে গেল। বোরকা খুলে পাশের হ্যাঙ্গারে রেখে শাড়ি পড়তে লাগলো। মায়াকে শাড়ি নিতে দেখে অরণ্য মনে মনে খুশি হয়ে গেল। ট্রায়াল রুমের একটুখানি দূরেই দাঁড়িয়ে রইলো মায়াকে দেখার আশায়।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও মায়াকে বাইরে আসতে না দেখে অরণ্যের একটু চিন্তা হলো। মায়ার কোন সমস্যা হলো নাতো? বাইরে আসছে না কেন? অরণ্য এবার দ্বিধা ভুলে মায়ার ট্রায়াল রুমের বাইরে এসে দরজায় হালকা টোকা দিয়ে বললো।
–মায়া? সব ঠিক আছে তো? আর ইউ ওকে?
ভেতর থেকে কোন আওয়াজ এলো না। অরণ্য আরও ঘাবড়ে গেল। অরণ্য আবারও নক করে বললো।
–মায়া কি হয়েছে? কথা বলছ না কেন? দরজা খোল।
একটু পরে দরজা খোলার শব্দ পেল অরণ্য। দরজা হালকা খুলে মায়া ওর মাথাটা হালকা বের করে ইতস্তত ভাবে বললো।
–আ আপনি একটু সারা বা রাইসা কাউকে ডেকে দিতে পারবেন প্লিজ?
–কিন্তু সারাকে তো সাহিল কোনদিকে যেন নিয়ে গেল। আর বাকি মেয়েরাও ড্রেস ট্রায়াল দিচ্ছে। কেন? কোন সমস্যা হয়েছে? আই মিন কিছু মনে না করলে আমাকে বলতে পারো।
মায়া অনেক টা ইতস্তত ভাবে বললো।
–আ আসলে আমার ব্লাউজের পেছনের হুকের সাথে আমার চুল পেচিয়ে গেছে। আমি কিছুতেই ছাড়াতে পারছিনা।
–ওহ,কিন্তু এখানে আশেপাশে তো ফিমেল স্টাফও দেখছি না। সব মেল স্টাফ।
মায়া বেচারি চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কি করে বের হবে এখান থেকে? অরণ্য ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বলে উঠলো।
–দেখ তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে আমি কি তোমার হেল্প করতে পারি?
মায়া চমকে উঠে বললো।
–আ আপনি?
–হ্যাঁ, মানে তুমি যদি চাও আর কি।ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। আমি চোখ বন্ধ করে নিবো।
মায়া কি বলবে বুঝতে পারছে না। আপাতত আর কোন পথও পাচ্ছে না ও।আজ পর্যন্ত কোন পরপুরুষ ওকে ছুতেও পারেনি।তবে এই লোকটার ওপর কেন যেন ওর ভরসা হয়। আর সে মানুক না মানুক এই লোকটা তো তার স্বামী কোন পরপুরুষ তো আর না। তাই আর উপায়ন্তর না পেয়ে পেছনে সরে এসে দরজা টা আরও একটু খুলে দিল মায়া। অরণ্য ভেতরে ঢুকে দেখলো মায়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার দেওয়া সেই নীল শাড়ী। অরণ্যের কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে তাঁর সন্ধ্যামালতীকে। যেন এই শাড়িটা শুধু মায়ার জন্যই তৈরি হয়েছে।আসলে ভালোবাসার মানুষকে বুঝি সব রুপেই অপরুপা লাগে। অরণ্যের মনে হচ্ছে সময়টাকে এখানেই থামিয়ে দিতে, যাতে জনম জনম ধরে অরণ্য মায়াকে এভাবেই দেখে যেতে পারে।
অরণ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া গলা খাঁকারি দিয়ে অরণ্যের সম্ভূতি ফেরানোর চেষ্টা করলো। অরণ্যের ঘোর কাটলো। অরণ্য আস্তে করে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বললো।
–ঘুরে দাঁড়াও।
মায়া আস্তে করে ঘুরে দাঁড়াল। অরণ্য চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মায়ার পিঠে হাত রাখলো। পিঠে হাতের ছোঁয়া পড়তেই কেঁপে উঠল মায়া। এই প্রথম কোন পুরুষের ছোঁয়া লাগলো মায়ার শরীরে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মায়ার এতে কেন যেন কোন অস্বস্তি বা খারাপ মনোভাব হচ্ছে না। যেখানে কোন পরপুরুষের খারাপ চাহুনিতেও মায়ার অস্বস্তি লাগে। সেখানে এই লোকটার ছোঁয়ায় কোন রকম অস্বস্তিই কাজ করছে না। বরং রাজ্যের লজ্জা ঘিরে ধরছে মায়াকে। দেয়ালে টানানো আয়নায় তাকিয়ে দেখলো অরণ্য সত্যিই চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এটা দেখে লোকটার প্রতি ওর ভরসা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেল। অরণ্য হাতের চার আঙ্গুল দিয়ে মায়ার চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দিল। চুল সরানোর সময় অরণ্যের আঙুল গুলো মায়ার খোলা পিঠ ছুঁয়ে গেল। মায়ার হৃদকম্পন আরও বেড়ে গেল। দুই হাতে শাড়ী খামচে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে ওর। অরণ্য হাতড়িয়ে মায়ার হুকে পেঁচিয়ে থাকা চুলগুলো ধীরে ধীরে ছাড়াতে লাগলো। অরণ্য খুবই সাবধানে কাজটা করছে যাতে মায়া কোন ব্যাথা না পায়।
চুল ছাড়ানো শেষ হলে অরণ্য চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই বললো।
–হয়ে গেছে তাইনা?
অরণ্যের কথায় মায়া চোখে খুলে তাকালো। পিঠে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই হয়ে গেছে। মায়া আঁচল টেনে পিঠ ঢেকে নিয়ে অরণ্যের দিকে ঘুরে বললো।
–হ্যাঁ হয়ে গেছে, ধন্যবাদ।
অরণ্য এবার চোখ খুলে তাকালো। মায়ার দিকে তাকাতেই দেখলো মায়ার মুখটা কেমন লাল বর্ন হয়ে উঠেছে। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, মায়া কি লজ্জা পেয়েছে? কিন্তু আমার জন্য লজ্জা পাবে কেন? আমি নাহয় ওকে ভালোবাসি? কিন্তু ওতো আর আমাকে সেই নজরে দেখেনা। নাকি দেখে? ধূরর আমি কি না কি ভাবছি। ওর মতো পবিত্র মেয়ে নিজের মনে আমার জন্য এমন ধরনা হয়তো কখনোই আনবে না। ওর জন্য তো আমি ওর বোনের স্বামী। তাই আমার প্রতি ওর এমন ধারণা আসার কোন সম্ভাবনাই নেই। অরণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে চলে গেল। একটু পরে মায়াও চেঞ্জ করে বোরকা পরে বেড়িয়ে এলো।
অনেকক্ষণ শপিং করার পর সবাই ফুড কর্নারে গিয়ে বসলো। সবাই যার যার পছন্দ অনুযায়ী খাবার অর্ডার করে দিলো। শুধু মায়া বাদে। আসলে ওর এসব জায়গায় আসার অভিজ্ঞতা নেই। তাই এখানকার কোন খাবারের নামও ও জানে না। তাই চুপচাপ বসে রইলো। অরণ্য সেটা দেখে বললো।
–মায়া তুমি কিছু অর্ডার করলে না? কিছু খাবে না তুমি?
মায়া কিছু বলার আগেই রিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–আরে ও কি অর্ডার করবে? অর্ডার এর অ ও জানে ও? বাপের জন্মে এসব দেখলে না জানবে। ওকে তো যা দেওয়া যায় তাই খেয়ে নেয়।
রিয়ার মায়াকে এমন তিরস্কার করে কথা বলায় অরণ্যের হঠাৎ চরম পরিমাণ রাগ উঠে গেল। চোয়াল শক্ত করে হাতের মুঠো জোড়ালো করে বললো ।
–এটা কি ধরনের কথা? মায়া তোমার বোন। তুমি সবার সামনে এভাবে কিভাবে ওকে ছোট করে কথা বলতে পারো? মানুষের ভদ্রতা শুধু কাপড়চোপড় আর চালচলনেই শোভা পায় না। তার কথাবার্তা আর কাজকর্মেও শোভা পায়। তাই কথা বলার আগে একটু ভেবেচিন্তে বলা উচিত।
বাকি সবারও রিয়ার কথাটা ভালো লাগলো না। রিয়ার মনমানসিকতা যে এতো নিচুস্তরের তা জানা ছিলনা ওদের। ওর মত ছোট মনের মেয়েকে অরণ্যের কিভাবে পছন্দ হলো সেটাই ভাবছে সবাই। সিচুয়েশন স্বাভাবিক করার জন্য মায়া বলে উঠলো।
–আরে থাকনা। আসলে রিয়া আপু ঠিকই বলেছে। আমি এসব জায়গায় কখনো আসিনি। তাই এখানকার এসব খাবারের নামও জানি না। আর এমনিতেও আমার তেমন ক্ষিদে পায়নি।
অরণ্য বলে উঠলো।
–আমরা সবাই বাসা থেকে সেই সকালে খেয়ে বের হয়েছি। আমাদের সবার যদি ক্ষিদে লেগে থাকে তাহলে তোমার কেন লাগবে না? তাই মিথ্যে না বলে তাড়াতাড়ি কি খাবে তাই বলো।
অরণ্য একটা মেনু কার্ড মায়ার হাতে দিয়ে বললো।
–এখান থেকে যা চাও অর্ডার করে দাও।
মায়া এবার বাধ্য মেয়ের মতো খাবার অর্ডার দিয়ে দিল। খাবার আসতে আসতে সবাই নানান কথাবার্তা বলছে। তখনি হঠাৎ দুটো মেয়ে ওদের টেবিলের কাছে এসে অরণ্যের উদ্দেশ্যে বললো।
–আরে অরণ্য? অনেক দিন পর দেখলাম তোমায়। কেমন আছ তুমি?
অরণ্য একটু ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এক্সকিউজ মি, ডু আই নো ইউ??
–আরে বাহ, ভুলেও গেলে আমাদের? আরে আমি তিন্নি আর ও সাবা। আমরা তোমার কলেজের ফ্রেন্ড ছিলাম মনে নেই।
অরণ্য একটু মনে করার চেষ্টা করে হঠাৎ মনে পড়তেই বললো।
–আরে তিন্নি? ওহহ এখন মনে পড়েছে। আসলে অনেক দিন দেখা হয়না তো তাই মনে পরছিল না। তা কেমন আছ তোমারা?
–আমরা ভালো আছি।
–বসনা প্লিজ।
ওরা বসতেই ইহান বলে উঠলো।
–চিনবে কি করে?তোরা তো তখন এক একটা হাতির বাচ্চার মতো ছিলি। আর এখন তো একদম হিরোইন হয়ে গেছিস।
ইহানের কথায় সবাই হেঁসে দিল। তিন্নি অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–তবে যায় বলো তুমি কিন্তু এখনো সেই হ্যান্ডসামই আছ। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছ। আমাদের কলেজের সব মেয়েদের ক্রাশ ছিলে। তা বিয়ে শাদি করেছ নাকি এখনো সিঙ্গেলই আছ?
বিয়ের কথা শুনে অরণ্যের মুখটা হঠাৎই চুপসে গেল। তবে ইহান বলে উঠলো।
–আপনাদের অতি দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে। মিঃ অরণ্য এখন বিবাহিত পুরুষ হয়ে গেছেন। আর এই হলো উনার ওয়াইফ।
রিয়ার দিকে ইশারা করে বললো কথাটা।
রিয়াকে অরণ্যের বউ হিসেবে পরিচয় দেওয়ায়। না চাইতেও মায়ার মনের কোনে চিনচিন ব্যাথার অনুভব করলো। তবে ঠোঁটে ফেক হাসি ঝুলিয়ে সেই ব্যাথার অনুধাবন বাইরে আসতে দিলোনা।
তিন্নি আবারও বলে উঠলো।
–এটা তো সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের মিঃ ক্রাশ বিয়ে করে ফেললো। এখন তার আশায় বসে থাকা মেয়েগুলোর কি হবে। লিমা নামের সেই মেয়েটির কথা মনে আছে?
ইহান বলে উঠলো।
–লিমা মানে সেই মেয়েটি না? যে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী ছিল? আর আমাদের অরণ্য বাবুর দিওয়ানি ছিল?
–আরে হ্যাঁ সেই লিমা। শুধু দিওয়ানি না। বলতে গেলে পাগল দিওয়ানি ছিল। বেচারি কতো ট্রাই করতো অরণ্যকে পটানোর।কিন্তু অরণ্যের মন গলাতে পারলোনা। বেচারি তো এখনো অরণ্যের আশায় বসে আছে।
অরণ্য স্মিত হেসে বললো।
–আরে ওসব তো সব আগের কথা। বাদ দাওনা। আর এমনিতেও আমার কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য মাইনে রাখে না। মনের সৌন্দর্য টাই আসল সৌন্দর্য। বাহ্যিক সৌন্দর্য তো একসময় ক্ষীণ হয়ে যায়। তবে মনের সৌন্দর্য সবসময়ই থেকে যায়।
অরণ্যের কথায় মায়া অনেক টা অবাক হলো। উনি যা বলছে তাকি সত্যিই বলছে? নাকি শুধুই মন ভোলানো বাণী গাইছে? সত্যিই কি উনার কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য মাইনে রাখে না? মায়া নিজের মনের ওপর নিজেই তাচ্ছিল্য করে বললো, হুহ্ সবই লোক দেখানো কথা। বাহ্যিক সৌন্দর্য যদি মাইনেই না রাখবে তাহলে রিয়াকে কি দেখে পছন্দ করলো? বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়া আর কোন ভালো গুন তো রিয়ার ধারে কাছেও নেই। যে যতই বলুক না কেন, দিনশেষে সবাই প্রথমে বাহ্যিক রুপটাই দেখে। কথাগুলো ভেবে মায়ার মনটা আবারও কঠিন চাদরে ঢেকে নিল। চায়না সে কোন মিথ্যে মায়ায় মন ভোলাতে।
কিছুক্ষণ পরে মেয়ে দুটো চলে গেল। ওদেরও খাওয়া দাওয়া শেষের দিকে। মায়া দেখলো টেবিলে প্রায় সবারই খাবার আধো খওয়া
হয়ে আছে। খাবারের এতো অপচয় দেখে মায়ার ভালো লাগছে না। কত নিরীহ মানুষ এক বেলা খাবারের অভাবে না খেয়ে মরছে। আর এখানে কতো খাবার নষ্ট হচ্ছে। একটু পরে ওয়েটার টেবিল পরিস্কার করতে আসলো। ওয়েটার প্লেট উঠাতে নিলে মায়া ওদের উদ্দেশ্যে বললো।
–আচ্ছা ভাইয়া আপনারা এই বাকি খাবার গুলো কি করবেন?
–কি করবো ম্যাম, ডাস্টবিনে ফেলে দিবো। এটো খাবার তো আর অন্য কাস্টোমার কে দেওয়া যাবে না।
–তাহলে একটা কাজ করবেন প্লিজ? এই খাবার গুলো একটা প্যাকেটে ভরে আমাকে দিতে পারবেন?
–ওকে ম্যাম এখুনি দিচ্ছি।
রিয়া মায়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বললো।
–এই তুই কি আমাদের মানসম্মান ডোবাবি? এভাবে এটো খাবার প্যাকেট করে নিয়ে যেতে হবে তোর? লোকে কি বলবে?
এই রিয়ার ওপর অরণ্যের রাগ বেড়েই যাচ্ছে। নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।
–মায়া তুমি বাসার জন্য পার্সেল নিতে চাইলে আমাকে বলতে আমি ওয়েটারকে বলে দিতাম।
মায়া বললো।
–না না এটা বাসার জন্য না।
–তাহলে?
–আসলে এখানে এতো খাবার নষ্ট হচ্ছে। আর খাবার নষ্ট করা একদম ঠিক না। আল্লাহ নারাজ হন। তাই খাবার গুলো নষ্ট না করে প্যাকেট করে নিয়ে গেলে রাস্তার পথশিশুদের দেওয়া যাবে। এমনিতেও এই খাবার গুলো ওনারা ফেলেই দিবে। তারচেয়ে ভালো কিছু অসহায় বাচ্চাদের আহার হোক। খাবারও নষ্ট হবে না। আর অনাহারীকে খাওয়ালে ছোয়াবও পাওয়া যাবে। তাই নিতে চাচ্ছিলাম।
মায়ার এমন মহৎ ভাবনা রিয়া বাদে বাকি সবার মন ছুয়ে গেল। সত্যিই এমন করে ওরা কখনোই ভাবেনি। মায়ার চিন্তাধারা দেখে সবাই মুগ্ধ। মেয়েটা সত্যিই একটা নেক আর পবিত্র মনের অধিকারী।
আর অরণ্য আজ আবারও একবার মায়ায় চিন্তাধারায় মোহিত হলো। ওর মন ভুল কাওকে পছন্দ করেনি। ওর মন সত্যিকারের এক পবিত্র মনের মানুষকেই পছন্দ করেছে। তবে দূর্ভাগ্যবশত সেই মেয়েটাকে পেয়েও পাওয়া হলোনা ওর। এই না পাওয়ার গ্লানি কিভাবে বয়ে বেড়াবে তা জানা নেই অরণ্যের।
চলবে……