মায়ার-সংসার,পর্ব-০১

0
1227

#মায়ার-সংসার,পর্ব-০১
#মাকসুদা খাতুন দোলন

ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বার। ‘হোয়াইট হল’ কমিউনিটি
সেন্টারে সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিটের আগেই পার্লার থেকে সেজো জা’য়ের সাথে কনের স্টেজে এসে বসলাম। শুরু হলো ফটোসেশন।আস্তে আস্তে অতিথিরা আসতে শুরু করলেন। শ্বশুর এবং বাবার বাড়ির লোকজন,আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবে মুখরিত পুরো হল রুম। কুশল বিনিময়,আলাপচারিতা,খাওয়ার পর্ব শেষ করে অতিথিরা বিদায় নিলেন। রাতও বাড়তে থাকে। তিন জা, হাজব্যান্ড,শ্বশুর বাড়ির কাছের লোকজনদের সাথে খেতে বসলাম। অল্প একটু খেয়ে উঠে পড়লাম। কেন জানি খেতে ইচ্ছে করলো না। খাওয়া শেষ করে পারিবারিক বেশ কিছু গ্রুপ ছবি তুলে একে একে সবাই বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো। জা’রা বিদায় নিতে আসলে বললাম,
– ভাবি,আমাকেও আপনাদের সাথে বাড়ি নিয়ে চলুন! আমার এখানে একা একা ভালো লাগবে না। জন্মস্থান হলো মানুষের মূল,শেকড়। গ্রামের বাড়ি হলো আসল ঠিকানা। বাড়ির সবার সাথে কিছুদিন থেকে তারপর
এখানে টুনাটুনির সংসার শুরু করবো। শ্বশুরবাড়ির ধুলো,মাটি চরণে মেখে,নির্মল বাতাসে কিছুদিন সবার সাথে আনন্দ করে তারপর এই ইট-পাথর,কংক্রিটের
শহরে ফিরে আসবো।

আমার কথা শুনে ভাবিরা একজন আরেক জনের দিকে
তাকিয়ে হাসলেন। বড় জা আমার হাত ধরে হেসে বললেন,
-সত্যিই মনটা আনন্দে ভরে গেল বোন! নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়িতে যাবে। নতুন বিয়ে হয়েছে এখন ক’টা দিন দু’জন তোমাদের মতো সময় কাটাও। এদিকে আমরাও একটু গোছগাছ করি। আদরের ছোট দেবরটা স্বামী হিসেবে
কেমন তা ভালোভাবে বুঝে নাও। এখানে কেউ তোমাদের যখন তখন ডিস্টার্ব করবে না।
বড় ভাবির কথায় অন্য জা’য়েরা হাসছে। ভাবি নিজেও ঠোঁট টিপে হাসছেন। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলেও ভাবির কথাগুলো খুব পছন্দ হয়। বড় ভাবি আবার বললেন,মায়া বাসায় ক’টা দিন শাড়ি পরে থেকো। ভাবিরা কিছু উপদেশ,পরামর্শ, দুষ্টুমির কথা বলে বিদায় নিলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।

রাতে মেকাপ তুলে সব কিছু চেঞ্জ করে শুভকে বললাম,
-মা,বাবা বেঁচে থাকলে ঘরে ঢুকে প্রথমে ওনাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া চেয়ে নিতাম। আমার দুর্ভাগ্য ওনারা জীবিত নেই। ওনাদের কাছে পেলাম না। ছবি থাকলে দেখতে চাই। ছবিতে ওনাদের দেখে মনে মনে দোয়া চেয়ে সংসার জীবন শুরু করতে চাই।
শুভ সাজানো খাটে শুয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে টিভির রিমোট চাপছিল। কথাগুলো শোনা মাত্রই শান্ত গলায় বলল,
-মা মারা গেছেন যখন কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি।
ওনি ১৯৮৬ সালে লিভার সিরোসিসে মালিবাগ রাশমনো
হসপিটালে মারা যান । বাবা মারা যান ১৯৯২ সালে ট্রাক এক্সিডেন্টে। তখন আমি ঢাবির সূর্যসেন হলের ছাত্র। অল্প বয়সে মা,বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যাই।
বড় ভাইয়েরা বাবা,ভাই দুটোর দায়িত্বই পালন করেছেন। ভাবীদের অবদানও জীবন থাকতে ভুলবো না। খুব আফসোস হয় নিজের উপার্জনের একটা টাকাও মা,বাবার পিছনে খরচ করতে পারি নি তার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এ যে কত বড় কষ্টের বিষয় তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না মায়া! মা,বাবা আগের দিনের মানুষ ছিলেন। মা,বাবার তেমন কোনো ছবি নেই। অসুস্থতার সময় হয়তো মায়ের কিছু ছবি উঠানো হয়েছিল। আমার কাছে দু’একটা ছবি ছিল। ব্যাচেলরদের এলেবেলে জীবন। বাসা বদল করেছি কতবার। কোথায় রাখছি মনে করতে পারছি না। আছে হয়তো কোথাও। খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে। আজ রাতেই ছবি খুঁজতে গিয়ে সুন্দর সময় নষ্ট করা কি উচিত হবে? চুপ থেকে শুধু বললাম,না মোটেও উচিত হবে না। আমি কালকে খুঁজে দেখে নিব।

দুই রুমের ভাড়া বাসায় চৌধুরিকে নিয়ে দু’জনের টুনাটুনির সংসার শুরু হলো।
সকালে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখি চৌধুরি মশারি গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কি অদ্ভুত! মশারি
না টানিয়ে গায়ে দিয়ে ঘুমানোর দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। চৌধুরিকে ডেকে বললাম,মশারি টানাস নি কেন? সজাগ হয়ে চোখ মিটমিট করে বলল,মামি আমি
তো মশারি টানাই না। কোনোদিন মশারি গায়ে প্যাঁচ দিয়ে ঘুমাই আর না হয় গায়ে এরোসল মেখে ঘুমাই।
শুনে থ হয়ে যাই। ভাবি বলছিল এই ছেলের মাথা কিছুটা এলোমেলো আছে এখন দেখছি এর মাথা পুরোটা নষ্ট। শুভ কি করে এই পাগল নিয়ে আছে! আল্লাহ মালুম জানেন।

শুভ ঘুম থেকে উঠলে চৌধুরির বানানো পরোটা,ডিম ভাঁজা দিয়ে একসাথে নাস্তা করতে বসেছি। হাত ধুতে ধুতে শুভ বলল,চৌধুরি খুব ভালো রাঁধতে জানে। তোমার কোনো চিন্তা নেই মায়া! চৌধুরি মজার মজার রান্না করবে তুমি শুধু খাবে আর চাকরির লেখাপড়া করবে। মুচকি হেসে বললাম, হুমম,তাইতো দেখছি! মজার পরোটা বানিয়েছে। ঘরে আস্তো একটা বউ থাকতে আপনাকে চৌধুরির হাতের রান্না খেতে দিচ্ছে কে শুনি? আমার স্বামীর জন্য আমিই রাঁধবো,লেখাপড়াও করবো। শুভর হাসিমাখা মুখ দেখে মনে হলো কথাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। খাওয়া শেষ করে কানে কানে বলল,দ্রুত শোবার ঘরে আসো। একটা জরুরি কথা আছে।
বললাম,হাত ধুয়ে আসছি। ভাবলাম আজ থেকেই শুভকে রান্না করে খাওয়াবো। নিজের হাতের বানানো চা খাওয়ানোর জন্য ঝটপট দু’কাপ চা বানাতে গেলাম কিচেনে। গিয়ে দেখি চৌধুরি পানিতে দুধ,চিনি মিশিয়ে চুলায় নাড়ছে। আমাকে দেখে চোখ মিটমিট করে বলল,মামি আপনি যান। আপনের আর মামার চা নিয়ে এহনি আইতাছি। চলে আসলাম শোবার ঘরে। শুভ দরজার কাছে লম্বা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। ওর পাশে বসতেই একটানে ওর লোমশ বুকের কাছে চেপে ধরলো। কপালে অধর ছুঁয়ে বলল,ভেজা চুল বাঁধা থাকলে মাথা ব্যথা করবে। বাসায় তো আর কেউ নেই। চুল ছেড়ে রাখো। ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে যাবে।
আমার গালের সাথে গাল মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে যখন বলল,লাল শাড়িতে তোমাকে…….ঠিক তখনি চৌধুরি চায়ের কাপ হাতে সামনে হাজির। মামা,এই যে চা ধরেন! শুভ তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল,এখন থেকে এই ঘরে আসলে বলবি মামা, ভিতরে আসবো? আর না হলে বলবি মামি ভিতরে আসবো? মনে থাকবে? চৌধুরি আমার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে হেসে বলল,হুমম মামা,মনে থাকবে। শুভ এবার বলল,যা এবার তুই তোর জন্য ডিম ভেঁজে নাস্তা করে থালা-বাসন ধুয়ে রাখ। চৌধুরি খালি ট্রে নিয়ে চলে গেল।
শুভ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-ভাবিরা দু’জনকে নিরিবিলিতে ছেড়ে গেঞ্জামের দল নিয়ে চলে গেল। এখন দেখছি ভাইগ্না চৌধুরিই জ্বালিয়ে মারবে। যখন তখন টিভি দেখার জন্য ঘরে ঢুকবে। বাংলা সিনেমার পোকা। মান্না,ডিপজলের সিনেমা দেখা শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত জায়গা ছেড়ে এক কদমও নড়বে না। আমি বাসায় না থাকলে পুরো বাসা তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বাসায় ফিরে অবশ্য সব গোছানোই পাই।
উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম,
-চৌধুরি কতদিন ধরে আপনার কাছে আছে?
– তিন মাস হলো। অফিসের বস মতিন স্যার তার এলাকা থেকে এনেছে। আগে যে ছেলেটা কাজ করতো। নাম ছিল রহিম।বাবার অসুখের কথা শুনে বাড়িতে গেল আর ফিরে আসে নি। রহিম চলে যাওয়ার পর খাওয়া নিয়ে খুব কষ্ট হতো। স্যার আমার সমস্যার কথা জেনে চৌধুরিকে নিয়ে আসলেন। ছেলেটার মা খুব অভাবী। ওর বাবা নেই। আট ভাইবোন নিয়ে ওদের সংসার।
চৌধুরি দেখতে ছোট,রোগা হলেও বয়স চৌদ্দ পনেরো বছর হবে। ছোটবেলায় টাইফয়েড হয়েছিল। তারপর থেকে ওর আচরণ একটু অন্যরকম,কিছুটা এবনরমাল। তার ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে চায়। একটু বুঝিয়ে, মানিয়ে চালাতে হবে। ও একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
দুপুরে কিন্তু দু’জনের দাওয়াত আছে। আমার স্কুলকালের বন্ধু সুজনের বোনের বাসায়। এই তো কাছেই সুজনের বোন লাভলীর বাসা। আমার বাসার
তিনটে বাসার পরেই। আমি আগে ওদের বাসার পিছনের গলিতে ভাড়া থাকতাম। লাভলীই তার ভাই পরিচয়ে ভাড়া ঠিক করে দিয়েছিল। যখন দেখেছে আমি ব্যাচেলর দুইমাস থাকার পর না করে দিল। ব্যাচেলর ভাড়া দিবে না। কারণ বাড়িওয়ালা খুব পরহেজগার মানুষ ওনার পাঁচটা মেয়ে ছিল। কোনো ছেলে ছিল না।

চায়ের কাপ রাখতে যাবো। উঠে দাঁড়াতেই শুভ আমার হাত ধরে আবার তার কোলের উপর বসিয়ে দিল। দু’হাতে ঝাপটে ধরে বলল,
-আপনি সম্বোধন কতদিন বহাল থাকবে শুনি?এই যুগে স্বামীকে কেউ আপনি আপনি করে বলে?
সামনে টেবিলের উপর কাপ রেখে শুভর নাক চেপে মুচকি হেসে বললাম,
-কেউ না বলুক। আমি আপনিই বলবো। আমার দাদি,নানি তাঁদের স্বামীকে আপনি বলতেন। এতে কি স্বামীর প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,যত্নআত্তি কখনো কম ছিল? বরং বেশি ছিল। তখনকার সময়ে স্বামী,স্ত্রীর মধ্যে এত ঝগড়াঝাঁটি হতো না। স্ত্রীরা স্বামীর অনুগত ছিল। স্বামীর কথার অবাধ্য হতো না। তাদের বাচ্চাকাচ্চাও বেশি ছিল। ছেলে-মেয়েগুলিও বেশি ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে উঠে খাবার ভাগ করে খাওয়া,একে অপরের প্রতি মায়া, দায়িত্ব,কর্তব্য এইসব বিষয়গুলো ছোট থেকেই শিখে বড় হতো। মোট কথা ভাইবোনদের বন্ধনটা মজবুত থাকতো। মায়েরা স্বল্পশিক্ষিত ছিল। সন্তান মানুষ করা, সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা ছিল না।
ছেলেমেয়েরা নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই লেখাপড়া করতো। আর এখন দিন বদলে আধুনিক যুগ এসেছে।
যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার হয়েছে। সবাই আলাদা থাকতে পছন্দ করে। আবার অনেককেই প্রয়োজনের তাগিদে আলাদা থাকতে হয়। এখন অনেক স্বামী,স্ত্রী দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। সামান্য ঝগড়াঝাঁটি হলে,ভুল বোঝাবুঝি হলে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলছে। এক পর্যায়ে বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে।
এখনকার অধিকাংশ পরিবারে একটা,দুটো বাচ্চা থাকে। কারো কারো একটা বাচ্চা থাকে। প্রায় পরিবারে ছেলেমেয়েগুলি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক চাহিদা পেয়ে বড় হয়। নিজেদের ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে চায়, পেতে চায়। একা একা বড় হয়। সবকিছু বেশি পেতে পেতে এদের মধ্যে শেয়ার করা,দায়িত্ববোধ,কর্তব্য এই বিষয়গুলো খুবই কম দেখা যায়। স্বামী,স্ত্রী যদি উভয়ই উভয়কে গভীরভাবে বুঝতে পারে। একে অপরের ভালো লাগা,মন্দলাগা, প্রিয়,অপ্রিয় বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারে। আর দু’জন দু’জনের প্রতি সমান শ্রদ্ধা,ভালোবাসা, মায়া,সহযোগিতা,সহমর্মিতা প্রকাশ করে তাহলে তারাই সবচেয়ে সুখি দম্পতি। তাদের সংসার জীবন সবচেয়ে সুখের হয়। সংসারের সুখ,শান্তির জন্য দু’জনের তুই,তুমি,আপনি সম্বোধন কোনো মুখ্য বিষয় না। আর একটা কথা,ব্যস্ততা কখনোই সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দূরত্ব তৈরি হয় অবহেলা আর বিশ্বাস ভেঙে গেলে। শত ব্যস্ততার মধ্যে সম্পর্ক মধুর এবং সুখময় করার কিছু উপায় আর উভয়ের অল্প কিছু সময়ই যথেষ্ট। ছোট ছোট সুন্দর মুহূর্ত দিয়ে উভয় উভয়ের মন ভালো করে দিতে পারে। শুভ চোখ বন্ধ করে কথাগুলো শুনছিল। হঠাৎ চোখ মেলে আমার গাল চেপে শক্ত করে একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে বলল,এই যে এখন আমি যা করলাম এটাই হলো অল্প সময়ের সেরা উপহার। দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। গালে হাত রেখে বলি,তুমি একটা বানর! ইস্ এত জোরে কেউ……কথা শেষ করতে পারি নি। থেমে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি চৌধুরি সাহেব দাঁড়ানো।
শুভ আওয়াজ তুলে হু হু করে হেসে উঠলো।
-এই তো এবার আমার বউ আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে
আধুনিক যুগে পা রেখেছে।
হাসতে হাসতেই চৌধুরিকে বলল,
-ভাইগ্না কিছু বলবা?
চৌধুরি হেসে জবাব দিল,
-মামা, আইজ অফিসে যাইবেন না?
শুভ আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোর মামি ভয় পায়। নতুন ঢাকা শহরে আইছে তো!
আমি অফিসে গেলে তোর মামিকে দেখে রাখতে পারবি না?
চৌধুরি চোখ মিটমিট করে দুপাটি বের করে কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,
– মামা এইডা একটা কতা কইলেন? এইডা কোনো ব্যাপার? ঢাকা শহরে আমি আপনের একমাত্র ভাইগ্না। আমি থাকতে মামির কোনো ডর ভয় নাই। মামিরে সব
চিনায়ে দিব। মামিরে নিয়া আমি বাজার সদাইও করতে পারবো।
চৌধুরির কথা শুনে শুভ শরীর ঝাঁকিয়ে হাসছে। আমার
রাগও হচ্ছে,হাসিও পাচ্ছে। দু’জনের দিকে বড় বড় চোখে তাকাতেই শুভ তাড়াতাড়ি রিমোট চেপে টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করে।

নীচতলার দুই রুমের বাসাটিতে টুকটাক সব ফার্নিচার আছে। বেড রুমের সাথে লম্বা একটা বারান্দা। শোবার ঘরটিতে খাট,ড্রেসিং টেবিল, টিভি,ওয়ারড্রপ, আর অ্যাঁশ কালারের মখমল কাপড়ের সোফা। অন্য ঘরটিতে
একটা খাট,চার চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিল,স্যামসাং কোম্পানির সাদা রংয়ের ফ্রিজ। দুই জানালা,দরজার পর্দাগুলো পুরানো এবং প্রিন্টের। পছন্দ হলো না। ঘরের
আসবাবপত্র সেট করা মোটেও ভালো লাগছে না।
চৌধুরিকে নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম ঘর গোছানোর কাজে। ড্রেসিং টেবিল আগের জায়গা থেকে সরিয়ে কিছুটা ফাঁকায় রাখলাম। ড্রয়ারগুলি সব লক করা। একটা শুধু খোলা পেলাম। খোলা ড্রয়ারে কিছু কাগজ,পারফিউমের খালি বোতল। চৌধুরি পুরানো টুকরো কাপড় দিয়ে সব মুছে পরিষ্কার করছে।
শুভ আস্তে করে সোফা থেকে উঠে চাবির ছরা নিয়ে আমার কোমরে গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচল খুলে বেঁধে
দিতে দিতে বলল,
-সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। যে সংসারে লক্ষী,শান্তশিষ্ট একটা বউ থাকে সে সংসার সব সময়ই
সুখের হয়। সংসারের আয়,রোজগার বাড়তেই থাকে। ঘরের কর্তীর আঁচলে চাবির গুছা না থাকলে বেমানান।
চাবি রাখার দায়-দায়িত্ব আজ থেকে তোমার উপর। অনেক বছর বউ ছাড়া ব্যাচেলর এই এলোমেলো সংসারটাকে আগলে রেখেছি। আজ থেকে আমার ছুটি।
হেসে বললাম,
– জনাব,আমার উপর সংসার চালানোর এই অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে এবং অতি গুরুত্বসহকারে পালন করার চেষ্টা করিব। আপনি কোনো চিন্তা করিবেন না।
-আবার আপনি?
-হুমম,এটা বলবৎ থাকবে।
শুভ হেসে কানের কাছে মুখ এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-চৌধুরি কাছে না থাকলে বুঝতে এতক্ষণে কি ঝড় বইয়ে যেতো।
-হুমম,আপনার ঠোঁট, চোখ,হাতদুটো দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি।
-সুযোগ আসলে ঠিক টের পাবে।
দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বললাম,
-যখন আসবে আমি সামাল দিব। এখন কাজ করতে দাও।
শুভও হাসতে হাসতে প্রকৃতির ডাকে ওয়াশরুমে চলে গেল। চাবি নিয়ে ওয়ারড্রপ খুলে এটা ওটা ঘাঁটাঘাঁটি করছি। সব কিছু এলোমেলো। ভাবছি সব নামিয়ে মুছে সাজিয়ে রাখবো। পুরোনো তিনটে ডায়েরি বের করতেই ছবির এলবাম চোখে পড়লো। সাথে সাথেই বের করে খাটের উপর একটার পর একটা ছবি দেখছি। সেজো ভাইয়ের বিয়ের ছবি,মেজো ভাইয়ের বড় ছেলের জন্মদিনের ছবি দেখতে দেখতে পুরোনো সাদাকালো চারটি ছবি পেলাম। মাথায় কাপড় টানা চেয়ারে বসা ছবিটি দেখে বুঝতে পারলাম এটা শাশুড়ি মায়ের ছবি।
ছবির একপাশের অংশ ঝাপসা বুঝাই যাচ্ছে অনেক বছর আগের ছবি। চোখ ডুবিয়ে বেশ কয়েকবার ছবিটা দেখলাম। ছবির মানুষটাকে খুব আপন মনে হচ্ছিল। কেন যেন খুব মায়া কাজ করছিল। মুখভর্তি চাপদাড়ি
পায়জামা,পাঞ্জাবি পরা শ্বশুরের ছবিটা ততটা নষ্ট হয়নি। শ্বশুর আব্বার ছবিটাও বেশ কয়েকবার দেখলাম। ছবি চারটি আলাদা রেখে এলবামের পাতা উল্টাতেই চোখ আটকে গেল শুভর সাথে এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে……….

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here