মিছে_মায়া(২য় পর্ব)

0
673

#মিছে_মায়া(২য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

পতিতালয়ের মহিলাদের সাথে আমার মাকে তুলনা করেছে। এর প্রতিবাদ করেছি বলেই বাবা আমাকে গ্রেফতার করানোর জন্য বাসায় পুলিশ ডেকে নিয়ে আসে।

সকালে ঘুম ভাঙলেই দেখি আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছে। কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমাকে গ্রেপ্তার করে ফেললো।

আমাকে গ্রেপ্তার করতে দেখে আমার মা আর আমার ছোটবোন কান্না করতে শুরু করল। কিন্তু কাউকে কোন কিছু বলার সুযোগ দিলো না। আমাকে গ্রেফতার করে থানায় জেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো।

আমার বাবা আমার মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আমার মায়ের পরিবার তখন মেনে নেয়নি। আমার মা বাবার হাত ধরেই বাবার কাছে চলে এসেছিলেন। যখন আমার মায়ের পরিবার মেনে নেয় তখন আমার বাবা, মাকে কখনোই সেই পরিবারে যেতে দেয়নি। আমার মাকে বেশ কয়েকবার তার পরিবার নিতেও এসেছিলেন। অপমানিত করে আমার বাবা পাঠিয়ে দেয়।

আমার মা বাসায় খুব একাকীত্ব ভাবে কাটিয়েছে। মা যদি কখনো তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি কারণ বাবা তাদের সাথে কথা বলতেও দেয় নি।

সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আমার বাবা আরেকটি বিয়ে করে। সে যে কোম্পানিতে জব করতো সেই কোম্পানির এর মহিলাকে বিয়ে করে আমার বাবা। এই বিয়ের জন্য আমার মা প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনি। আমার মা কিছু বললেই তখন হাত তুলতেন তার গায়ে।

বাবা তার সাথে সংসার করতে শুরু করলেন। আমার আর আমার মায়ের কোন খোঁজ খবর নিতো না আমার বাবা। মাস শেষে বাবা মায়ের কাছে আসছে আর কিছু টাকা দিয়ে গেছে। সেই টাকা দিয়েই কোন মতে মা আমাদের সংসার চালাতেন।

আমার মা-বাবার পায়ে পরে কান্না করতেন। তারপরও আমার বাবা মায়ের কথা শুনেন নাই। বাবা সেই বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে পারে নাই। কয়েক মাস পরেই বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে তিনি চলে যায়। এরপর থেকে বাবা-মায়ের সাথে আরও খারাপ আচরণ করতে শুরু করে।

আমাদের পারিবারিক অবস্থা একদম খারাপ নয়। আস্তে আস্তে বাবা আমাদেরকে কেয়ার করা আরো কমিয়ে দেয়। সত্যি বলতে আমরা দুইটা ভাই বোন আমার বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমাদের দুইটা ভাই বোনের মনে হয়েছে যে আমাদের মাঝে বাবা থাকতেও নেই। আমার মা তিনি বাবা এবং মায়ের ভালোবাসা একাই আমাদের দুইটা ভাই-বোনকে দিয়েছেন। সকাল বেলা খাবার খেয়ে বাবা বাসা থেকে বের হয়ে যেতেন আর মধ্যরাতে বাসায় ফিরতেন। আমরা যে বাসায় আছি সেদিকে বাবা কোন খেয়ালই ছিল না। একটা দিনও আমাদের কোনো খোঁজখবর নিতেন না

আমার স্পষ্ট মনে আছে মা একদিন আমার সামনে বলেছিলেন….

– তোমার কি সন্তানদের প্রতি কোন মায়া নেই? ওরা দুইটা ভাই বোন ওদের কি ইচ্ছা হয়না বাবার ভালোবাসা পেতে? নিরার ছয়টা মাস হতে চললো অথচ একটাবার তুমি ওকে কোলে তুলে নাও নি। তোমার কি ইচ্ছা হয়না ওদের একটু আদর করতে?

– আমার এসব একদম ভালো লাগেনা। আর তাছাড়া আমি তো ওদের দেখাশোনা করতেছি তাই না?এ সব বলার কোন মানে আছে?

– তুমি এত নিষ্ঠুর কেনো? নিরা এতটা বড় হয়ে গেল তার পরেও তুমি ওকে কখনো তোমার কাছে নাও না।

– এসব প্যাঁচাল বাদ দিবা আমার ভালো লাগতেছে না শুনতে। আর কিছু বলার থাকলে বলো নতুবা বাদ দাও।

– হ্যাঁ এখন তো তোমার ভালো লাগবে না। বিয়ের আগে ছেলে সন্তান নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলে তুমি! আর তোমার কি হলো আমি জানিনা হঠাৎ করেই তোমার পরিবর্তন।আচ্ছা আমার কি কোনো দোষ ছিলো বলো? তুমি আমাকে যখনই বলেছিলে তোমার হাত ধরে তোমার কাছে চলে আসতে। আমি ঠিক তখনি ছুটে এসে ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার পরিবার এই বিয়েটা মেনে নিতে পারে নাই। আর সেই রাগটা ধরে তুমি এখনো আছো। আচ্ছা আমার কি ইচ্ছে হয়না বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে ভাই বোনদের সাথে যোগাযোগ করতে? তুমি তাও দিলে না আমাকে। তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কতবার এসেছে কিন্তু তুমি কি করলে? তাদের অপমানিত করে এই বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলে।

– আমার তো এ সব শুনতে ইচ্ছে করতেছে না। আমি নিষেধ করেছি তো এত কিছু বলতে। তারপরও কেন বলতেছিস?

আমি শুধু বাবা-মার কথা গুলো হা করে শুনছিলাম। তখন আমি হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারি নাই। যখন আস্তে আস্তে বড় হই তখন বাবার রূপ আমি দেখতে পাই।

সেই ছোটবেলায় একদিন বায়না ধরেছিলাম বাবার সাথে আমি বাসার বাহিরে যাবো ঘুরতে যাবো। সে আমাকে নেয়নি। বাসা থেকে যখন সে বের হয়ে যায় তখন আমি বাবার হাত ধরে টেনে রাখছিলাম। তারপরও সে আমাকে নেয়নি। সেদিন আমি প্রচুর কান্না করেছিলাম। আমার কান্না দেখেও তার একটুও মায়া হলো না।

আমার মা বসে বসে কান্না করতেন আর বলতেন তোরা একদিন বাবার ভালোবাসা পাবি কষ্ট পাস না বাবা।

দেখতে দেখতে আমি আজ এত বড় হয়েছি। আমি ছোটবেলায় বাবা-মাকে না জ্বালাতন করলেও আমার ছোট বোনটি আমার মাকে প্রচুর জ্বালাতো। বাবা বাসায় আসলেই তার কাছে যেতে চাইতো। যখন দুই একটা কথা বলতে পারে তখন বাবাকে বলতো এটা খাবো ওটা খাবো এটা এনে দাও। বিরক্তির ছাপ নিয়ে এনে দিলেও তার ইচ্ছাকৃতভাবে কখনোই কিছু এনে দিতো না। মাঝে মাঝে বাবাকে খালি হাতে দেখলে ছোট বোনটি কান্না করত প্রচুর কান্না করতো।

বন্ধুদের সাথে আমিও একদিন মাঠে খেলতে গিয়েছিলাম সেই খেলতে যাওয়ার কারণে আমি বাবার হাতে মার খেয়েছিলাম। মা বাবাকে রাগ করতেন।কিন্তু বাবা কে কার কথা শুনে?

তারপরও বাবার চোখের আড়াল হয় বন্ধুদের সাথে আমি মাঠে খেলতে যেতাম। আমার ছোটবেলা থেকেই খেলার প্রতি অনেক নেশা ছিলো।

দিন যায় বড় হতে থাকি। আমার পিছু পিছু আমার বোনটি ঘুরঘুর করতে থাকে। আমি ওকে নিয়ে রাস্তায় বের হয় দোকানে যাই খাবার কিনে দেই। দুই ভাই বোনে ঘুড়তে যাই। সেই থেকেই আমার ছোট্ট বোনটি আমার পাগল। আমার সাথে সব সময় থাকে। স্কুল থেকে ফিরলে বোনটা আমার কাছে ছুটে আসতো আর বলতো ভাইয়া কি আনছো দাও। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে আমার বোনের জন্য খাবার নিয়ে আসতাম। কিন্তু আমার বাবা কখনো নিজের ইচ্ছায় আমাদের জন্য একটা কিছু নিয়ে আসেনি। যখন ঈদ আসত তখন মা বাবার পিছে ঘুরতো আর বলতো ছেলেমেয়েদের জন্য কাপড় চোপড় কিনবে না?ঈদ তো চলে আসলো। মায়ের হাজারো রিকোয়েস্টের পর বাবা আমাদের জন্য কাপড় কিনে নিয়ে আসতেন।

এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনার খরচ আমি নিজেই চালিয়েছি। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে টিউশনি করাতাম। সেই টাকা দিয়েই আমি চলতাম এবং পড়াশোনা করতাম। এরপরে আমার মনে হয়না আমি বাবার কাছ থেকে একটা টাকা চেয়ে নিয়েছি? এইচএসসি পাস করে ভালো রেজাল্ট একটা ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য বাবার কাছে রিকোয়েস্ট করি। কিন্তু আমি বাবার কাছে সাহায্য পাইনি। তাই একটা নরমাল কলেজে ভর্তি হয়েছি।

যাই হোক আমি সবকিছুই ভুলে গিয়েছিলাম। বড় হয়ে মায়ের উপর বাবার অত্যাচার আমি আর সহ্য করতে পারতাম না।

গতকাল আমাকে থানায় এরেস্ট করে নিয়ে এসেছে। থানায় নিয়ে আসার সময় অনেক কান্নাকাটি করছে। বাবার দুই পা পর্যন্ত মা ধরেছে।কিন্তু শুনেনি। বাবার কথায় আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে।

তিনদিনের দিন আমার সাথে দেখা করার জন্য নিশু থানায় আসে। ওর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু আমি এখন কোথায় যাব কার বাসায় যাব? আমার তো কোনো আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি ওই বাসায় আর কখনোই যাবনা। তার আগে তো আমার কিছু একটা করতে হবে। আমার বোন আমার মাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে হবে। ওদের ওই বাসায় রাখবো না।

থানা থেকে ছাড়া পেয়ে শুধু নিশুকে একটা ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। ওর সাথে কথা বলার কোন শক্তি আমার মাঝে ছিল না। রাস্তার পাশ বেয়ে আমি আর নিশু হেঁটে যাচ্ছি। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমার সাথে কথা বলার সাহস পেলো না।

নিশু যে যে রাস্তার মাঝে আমার হাত ধরে হাটতেছে এটা আমি লক্ষ্য করতে পারিনি।

নিশু আমাকে বলল ওর একটা পরিচিত বন্ধুর বাসায় যেতে। ও নাকি সেই বন্ধুর সাথে কথা বলেছে এবং আমার কোন একটা চাকরির জন্য কথা বলতেছে।

রাতের বেলায় আমি আমার বাসার সামনে গেলাম একটা পলক আমার মা এবং বোন কে দেখার জন্য। কিন্তু বাসার সামনে গিয়েই আমার শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললাম। দরজার সামনেই আমি ঢলে পড়ে গেলাম……

[চলবে……]

With- Md. Nazmul Huda

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here