#মিছে_মায়া(৫ম এবং শেষ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
ঢাকায় ফিরে আসলাম। মায়ের যা অবস্থা তাতে জোর করে তাকে নিয়ে আসলে আরো বেশি ক্ষতি হবে। তাকে আরো কিছুটা সময় দিতে হবে। আমি আরো কিছুদিন পরে গিয়ে নিয়ে আসব। আর আমার যতটুকু মনে হয় বাবা অযত্ন করবে না। তার চোখ দেখে অনুশোচনা আর ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি আমি। যতই হোক আমার বাবা তো। চোখের ভাষা পড়তে পারি। কিন্তু তার এত বছরের অপরাধ গুলোও ক্ষমা করতে পারব না। সে পারবে না আমার সুন্দর ছোটবেলা ফিরিয়ে দিতে, আমার মায়ের এতগুলো বছর ফিরিয়ে দিতে। আর না তো আমার বোনের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে।
ঢাকায় এসে জবে মন দিলাম। নিয়মিত অফিসে যেতে লাগলাম। আর মন দিয়ে কাজ করলাম। অল্প দিনে কাজে উন্নতি করলাম। বস আমার কাজে খুশি হয়ে প্রমোশন দিয়ে দিলেন। ম্যাচ ছেড়ে দিয়ে ফ্ল্যাট বাসা নিলাম। ভেবেছি মাকে এখানে নিয়ে আসার পরে নিশুকে বিয়ে করে নিব।
প্রায় ছয় মাস পরে আবার বাড়িতে গেলাম। যদি মা একা না আসতে চান তাহলে বাবাকে ও নিয়ে আসব। উনি যেমন ই হোক আমার মা তাকে ভালোবাসে আর তার কাছেই খুশি থাকে।
বাড়িতে গিয়ে কিছুটা অবাক হলাম। কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে। দরজা ভেতর থেকে দেওয়া। কিন্তু বাবা বাসায় থাকলে তো দরজা বন্ধ করে রাখেনা। আর যদি কোথাও যেত তাহলে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যেত। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজায় নক করলাম। এক অপরিচিত মহিলা দরজা খুলে দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। আমার বাড়ি অথচ বাড়ির লোকদের আমি চিনি না।
– কে আপনি? কাকে চাই?
– আমি মিহির। কিন্তু আপনি কে? আর আমাদের বাড়িতে আপনি কি কিরছেন?
– ওহ আচ্ছা আপনি তাহলে আসলাম সাহেবের ছেলে।
– জি।
– আসুন ভেতরে আসুন।
আমি ভেতরে গেলাম। বাসার ভেতরে গিয়ে আবারো অবাক হলাম। দেয়ালে বাবার ছবিটার বদলে এই ভদ্রমহিলা আর একজন লোকের ছবি টানানো। এছাড়া আসবাবপত্র সব কিছুই অন্যরকম। এগুলো কিছুই আমাদের নয়।
এ বাড়িটা বাবা শখ করে বানিয়েছেন। চাইলে শহরে বাড়ি টা করতে পারতেন। প্রাইভেট ফার্মে জব করায় তার অর্থের অভাব নেই। কিন্তু এটা তার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি।তাই এখানেই তিনি সুন্দর করে একটা দোতলা বাড়ি বানিয়েছেন। কিন্তু এ বাড়িতে এনারা কারা বুঝতে পারছি না। মহিলা আমাকে সোফায় বসতে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরে কফি নিয়ে আসলেন।
– আচ্ছা আপনি কে আর আমাদের বাড়িতে কি করছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলুন তো এখানে হচ্ছে টা কি?
– আসলে আপনার বাবা এই বাড়িটা আমাদের কাছে বিক্রি করেছেন। গত সপ্তাহেই আমরা এখানে এসেছি।
ভদ্রমহিলার কথা শুনে চূড়ান্ত পর্যায়ে অবাক হয়ে গেলাম। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
– মানে কি? এটা কি রকম ইয়ার্কি করছেন?
– দেখুন আমি সত্যি বলছি। আপনার মায়ের মানসিক সমস্যার কথা তো আপনি জানেন ই। তারই চিকিৎসার জন্য তিনি এই বাড়িটা বিক্রি করেছেন।
– ওনারা এখন কোথায় আছে বলতে পারবেন কিছু?
– না আমাদের কিছুই বলে নি।
– ওহ আচ্ছা। তিনি কত টাকায় বাড়িটা বিক্রি করেছেন?
– ৭ লাখ টাকায়।
– আপনাদের টাকা আমি ফেরত দিয়ে দেব। বাড়ি ছেড়ে দিন আপনারা।
– এ বাড়িটা আমরা কিনে নিয়েছি। তাই এটা আপনি আর পাবেন না।
– দেখুন আমার বাবা বাধ্য হয়ে এত কম দামে বিক্রি করেছেন। এটার দাম আরো ৫ গুন বেশি হবে। আপনারা যদি স্বেচ্ছায় না দিন তাহলে আমি আইনের সাহায্য নিতে বাধ্য হবো। আসি এখন।
বাড়ি থেকে বের হয়ে নিশুকে ফোন করে সব খুলে বললাম। নিশু আমাকে আস্বস্ত করলো যে ওর এক রিলেটিভ আছে যিনি একজন ভালো লয়ার। তার সাহায্য আমরা বাড়িটা ফেরত পেতে পারি। কিন্তু আমি এখন সাত লাখ টাকা কোথায় পাব? আমার কাছে চার লাখ এর মতো আছে।
– তুমি চিন্তা করো না আমি দেব বাকি টাকা।
– না নিশু এটা কখনো হয়না। তুমি এমনিতেই আমাকে অনেক হেল্প করেছো। আমি তোমার কাছে অনেক ঋণি। দয়া করে আর ঋণী করো না আমাকে।
– আচ্ছা একটা কথা বলো। আজ যদি আমি তোমার জায়গায় থাকতাম আর তোমার আমাকে হেল্প করার মতো সুযোগ থাকত, তবে কি তুমি আমাকে হেল্প করতে না?
– সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু আমি তোমার থেকে আর হেল্প নিতে পারব না নিশু।
– পর করে দিচ্ছো? নাকি আপনই ভাবতে পারো নি?
– এভাবে বলছো কেন?
– তো কিভাবে বলা উচিত? শোনো তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা। তুমি বাবা মাকে খুঁজে বের করো।
– হুম রাখছি।
চিন্তায় মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। এত সমস্যা কেন এইটুকু একটা জীবনে? লড়াই করতে করতে উপভোগ করার সময় টাই থাকেনা। মা কে নিয়ে বাবা কোথায় যেতে পারে? আশেপাশে কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করলাম। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে মায়ের একটা অপারেশন করাতে হবে। তাহলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। আর এর জন্য দশ লাখ টাকার প্রয়োজন। তাই তিনি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। হয়তো ঢাকায় গেছেন মা কে নিয়ে।
আমাকে আজই ঢাকায় ফিরতে হবে৷ কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না যে তার এত টাকা থাকতেও কেন বাড়ি বিক্রি করতে হলো? তবে কি উনি মিথ্যে নাটক করেছেন? মাকে মেরে ফেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল নাকি?
নাহ এসব কি ভাবছি। এমন কিছুই হয়নি। আমার মা ভালো আছে। কিচ্ছু হয়নি তার।
ঢাকায় গিয়ে সব জায়গায় খুঁজলাম। ঢাকার মধ্যে যতগুলো মানসিক হসপিটাল আছে সবগুলোতে খুঁজলাম। কিন্তু কোত্থাও নেই। তার মানে এই বাবা নামক লোকটা মিত্থ্যে বলেছে। নিশ্চয়ই আমার মায়ের সাথে কিছু করেছে। আমি ওকে পেলে মেরেই ফেলব। এইদিকে এক বন্ধু পুলিশ ইন্সপেক্টর। ওর কাছে সব কিছু খুলে বললাম। আর বাবার নামে একটা কেইস ফাইল করলাম। ওকে বলেছি লোকটা কে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে৷
প্রায় এক মাস হয়ে গেছে মায়ের কোন খোঁজ পাইনি। এত বড় শহরে কোথায় খুঁজব মাকে? এদিকে নিশু বিয়ের কথা বলতেছে। ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে। কিন্তু আমি এখন কিভাবে বিয়ে করব? আমার মা এক মাস ধরে নিখোঁজ। আমি জানিনা তার সাথে কি কি হয়েছে। আমি মানসিকভাবে মোটেই প্রস্তুত নই বিয়ের জন্য। এটা নয় যে নিশুকে আমি ভালোবাসি না, আমি নিশুকে প্রচন্ড ভালোবাসি আর সারাজীবন এর ওকেই চাই। কিন্তু এই মূহুর্তে সবার আগে আমার মাকে খুঁজে বের করতে হবে৷ কিন্তু দিনদিন নিশুর বিয়ের জন্য প্রেশার দেয়া টা অসহ্য লাগছে। তাই তাকে বিয়ে করতে বলে দিলাম।
তিনদিন পরে নিশু এসে বিয়ের কার্ড দিয়ে গেল। কোন কথা বললো না আমার সাথে। সবসময় পাশে বসে বকবক করেই যেত আর আজ একটা কথাও বলছে না। আমি মুচকি হেসে কার্ডা টা নিয়ে চলে এলাম।
বাসায় এসে প্রচুর কাঁদলাম। আমার কাছের মানুষ গুলো সব আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে৷ প্রথমে নিরা, তারপরে মা আর এখন নিশু। আচ্ছা এতটুকু একটা জীবনে এতকিছু হারিয়ে ফেললে বাঁচার জন্য কি থাকে? কিছুই থাকেনা। মরে যাব আমি। রাতে প্রচুর ড্রিংকস করলাম। পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো দেখি বিকেল তিনটা বাজে। আস্তে করে উঠলাম। পাশের রুম থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ছে আমি এখানে একাই থাকি।
দরজার সামনে গিয়ে একেবারে শকড। নিশু বসে মা বাবার সাথে গল্প করছে। কিন্তু এটা কি করে হতে পারে? বাবা আমাকে দেখে উঠে আসলেন। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। কিছু বুঝতে না পেরে আমি পাথর এর মতো দাঁড়িয়ে আছি। কি হচ্ছে এসব? বাবা এই প্রথম বার আমাকে বুকে টেনে
কি হচ্ছে এসব? বাবা এই প্রথম বার আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমি আমার অনুভূতি টা বুঝতে পারছি না। অতিরিক্ত আবেগে মানুষ জমে যায়।
কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে মা-ই কথা বললেন।
– জীবনে যদি কিছু সঠিক কাজ করে থাকি সেটা হলো তোর বাবাকে ভালোবাসা। মানুষ টা রাগী কিন্তু অনেক ভালো মনের। আমাকে সুস্থ্য করার জন্য নিজের বাবার বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন। আমার ওষুধ কেনার জন্য রিকশা চালিয়েছেন। তুই তোর বাবাকে ভুল বুঝিস না বাবা। এটা তোর মায়ের অনুরোধ।
আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা আমার কাঁধের ওপর হাত রাখলেন।
– সবসময় ভেবেছি রাগ আর শাসন করলে বুঝি তোমরা আমাকে ভয় পাবে আর আমার সব কথা শুনবে। এজন্য আমি সবসময় তোমাদেরকে আমার কঠিন রূপ টা দেখিয়েছি। কিন্তু তোমরা ঘুমানোর পরে কপালে চুমু দিতে ভুল করিনি কখনো, তোমাদের চাওয়ার আগে সব চাহিদা পূরন করেছি। কিন্তু কখনো বুঝিনি সব কিছুর আগে ভালোবাসা প্রয়োজন। এটা নিরা চলে গিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসা দিয়ে যেটা হয় সেটা ভয় দিয়ে হয়না। তোমার মায়ের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি, চেয়েছি সে আমাকে ভয় পাক কিন্তু কখনো চাইনি সে খারাপ থাকুক বা আমার থেকে দূরে যাক। জানি এটা অন্যায় আর আমি এজন্য অনুতপ্ত। আমাকে ক্ষমা করে দিবি বাবা?
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। ছোট বাচ্চাদের মতো। বাবাও কাঁদছে। বাবা নিশুর দিকে তাকিয়ে আমাকে বললো,
– জীবনে সঠিক মানুষকে নির্বাচন করেছিস।
নিশু লজ্জা পেল। বাড়ির দলিল টা বাবার হাতে দিলো।
– কিন্তু বাবা আপনি বাড়ি বিক্রি করলেন কেন? আপনার তো টাকার অ….
– আসলে আমার টাকা সব তোমার মায়ের একাউন্টে। তার সাইন ছাড়া টাকা তোলা সম্ভব না। তার জন্য অনেক সময় প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তোমার মাকে সুস্থ্য করা আমার জন্য আর্জেন্ট ছিল। বাড়ি তো পরেও পেতাম।
– কিন্তু আমাকে তো বলতে পারতেন।
– আসলে তোমার ঠিকানা আমার জানা ছিলো না। আর তুমি এখনো অনেক ছোট। বাবা মায়ের দায়িত্ব আরো পরে নিও। আমার যতটুকু করা প্রয়োজন ছিলো আমি করেছি। দুদিন আগে গ্রামে গিয়ে নিশুকে সাথে করে নিয়ে আসলাম।
বাবা মা অন্য রুমে চলে গেলেন। নিশু আমার কলার ধরে বললো,
– কি ভাবছিস তুই হু? এত সহজে ছেড়ে দিব? বদমাশ কোথাকার।
আমি চোখ বন্ধ করে হাত পা সোজা করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবটা এমন যে আমি বেহুশ হয়ে গেছি। কিন্তু তারপরেও কিল ঘুষি থেকে শেষ রক্ষা হলো না।
#সমাপ্ত
With- Md. Nazmul Huda