মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ০৩
লেখকঃ আবির খান
তাহসান আলমারি খুলতেই মাইরার কান্নাসিক্ত নয়ন দুটি বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ ও কি দেখছে এগুলো! তাহসানের এর সাথে একটা মেয়ের অনেকগুলো ছবি। প্রতিটি ছবিতেই দুজন অনেক খুশী। মাইরা অবাক নয়নে প্রতিটি ছবি দেখছে৷ ওর আশেপাশে সময় যেন থমকে গিয়েছে। তাহসানের সাথে এই মেয়েটা কে? সেকি এতটাই কাছের যে তার এতগুলো ছবি তাহসান ওর আলমারিতে রেখে দিয়েছে এত যত্ন করে! মাইরা বিষ্ময়মাখা মুখখানা নিয়ে তাহসানের দিকে তাকায়। আর কান্নাসিক্ত গলায় বলে,
~ মেয়েটা কে?
তাহসান আলমারির সাথে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে অসহায় ভাবে বলে,
– আমার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা। আমার হাসি, আমার সব।
তাহসানের কথা শুনে মাইরা স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর মনে হচ্ছে, কে যেন ওর ভিতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। মাইরার চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। ও নিজের দিকে একবার তাকায়। লাল বেনারসি আর গহনা গুলো এখনো ওর গায়ে৷ সদ্য তাহসানকে বিয়ে করে ও এই বাসায় এসেছে। কত স্বপ্ন কত ইচ্ছা ছিলো তাহসানকে নিয়ে ওর। কিন্তু সব শেষ করে দিয়েছে তাহসানের অতীত। মাইরা কি করবে বুঝতে পারছে না। ও খেয়াল করে তাহসান আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে। মাইরার কেন জানি মনে হচ্ছে তাহসান খুব কষ্ট আছে, ও খুব একা। ওর কারো প্রয়োজন। তাহসানের অতীতে কি হয়েছে ওকে তা জানতে হবে৷ মাইরা আস্তে আস্তে তাহসানের পাশে গিয়ে বসে। তাহসান বুঝতে পারছে না ও কি করবে৷ মাইরা আস্তে করে তাহসানের কাঁধে হাত রাখে আর বলে,
~ আপনার ভালবাসা কেন হারিয়ে গেল? আমাকে বলবেন?
তাহসান মাথা তুলে মাইরার দিকে তাকায়। ওর কান্নাসিক্ত চোখগুলো এখন অবাক। মাইরা এমন কিছু বলবে ও ভাবে নি। তাহসান ভেবেছে মাইরা ওকে বকাবকি করবে। ওকে খারাপ বলবে। ওকে প্রতারক বলবে৷ কিন্তু না, মাইরা ওর অতীত জানতে চাচ্ছে। তাহসানকে চুপ দেখে মাইরা আবার বলে,
~ আপনার জীবনের সাথে হয়তো আমি আপনার অনিচ্ছায় জড়িয়ে গিয়েছি। সবার কাছে আমি আপনার স্ত্রী, কিন্তু আপনি হয়তো আমাকে তা ভাবেন না৷ আমি বলবোও না আপনাকে ভাবতে। তবে আমাকে আপনার বন্ধু বানাবেন? বন্ধু হিসেবে আমাকে সবটা বলবেন?
তাহসান প্রতিনিয়ত অবাক হচ্ছে৷ বন্ধু! হ্যাঁ একজন বন্ধুর ওর খুব প্রয়োজন ছিলো। ওর কষ্টগুলো কেউ বুঝে নি। কেউ বুঝার চেষ্টাও করে নি। কিন্তু মাইরা কি বুঝবে? তাহসান মাইরার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। কেন জানি ওর বিশ্বাস হচ্ছে মাইরাই সেই ওর একজন বন্ধু হবে৷ তাহসান মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে,
– জানি আমার আচরণ লজ্জাজনক। কিন্তু আমি না আর পারছিলাম না এত কষ্ট ধরে রাখতে৷ আমি এখনো পারছি না৷
~ বন্ধু হিসেবে আমাকে আপনার কষ্ট গুলো শেয়ার করবেন? যদি একটু শান্তি পান আপনি।
– তুমি সত্যিই ভাগ চাচ্ছো?
~ হ্যাঁ।
– তাহলে শোনো, আজ থেকে চার বছর আগে তমার সাথে আমার পরিচয় হয়৷ তখন আমি একটু লজ্জাশীল ছেলে ছিলাম। মেয়েদের সাথে একদম মিশতে পারতাম না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তমা আমার জীবনে চলে আসে। ও আমার জীবনের প্রথম মেয়ে এবং প্রথম ভালবাসা ছিলো। ওকে নিয়েই আমি ভালবাসতে শিখেছি। ওকে নিয়ে সারাজীবনের স্বপ্ন দেখেছি। ও আমাকে একদম বদলে দিয়েছে। আমার সব কিছু জুড়ে শুধু ও ছিলো। আমার হাসি, আমার আনন্দ আমার ভালো থাকা সব ও ছিলো। কিন্তু… (তাহসান কেঁদে দেয়)
~ প্লিজ থামবেন না।
– কিন্তু একদিন ও আমার কাছে এসে আমাকে বলে, আমি যে ওকে পাগলের মতো ভালবাসি, সারাদিন ওকে নিয়েই থাকি, সবসময় ওকে খুশী করার জন্য অনেক কিছু করি, এসব কিছু ওর কাছে প্যারা লাগে। ও নাকি জানেই না ভালবাসা কি! ওর নাকি মনে হয় ও আমাকে ভালবাসে না৷ সবটাই নাকি নিছক ভালো লাগা ছিলো। তাহলে চারটা বছর একসাথে থাকার মানে কি! আমার মতো কেউ কাউকে এত ভালবাসতে পারবে না। কিন্তু ও সেটা বুঝে নি। ও আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার মনকে আয়নার মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমার ভিতরটাকে ও শেষ করে দিয়েছে। ও একবারও ভাবে নি আমি ওকে কতটা ভালবাসি, আমার মতো ওকে কখনো কেউ ভালবাসতে পারবে না। সেটা ও জানে না। ওর কাছে সবটাই টাইমপাস ছিলো। ও আমার অনুভূতি গুলো বুঝে নি। ও আমাকে বুঝে নি। ও আমাকে কখনোই ভালবাসে নি। কখনোই না৷ (তাহসান অনেক জোরে কান্নায় ভেঙে পড়ে)
মাইরাও তাহসানের কান্না দেখে কেঁদে দেয়। অজান্তেই তাহসানকে ওর সাথে জড়িয়ে ধরে। তাহসানও মাইরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এতদিন একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে ও কেঁদেছে৷ আজ একটা কাঁধ পেয়েছে ও। মাইরা বুঝতে পারছে, একটা ছেলে ঠিক তখনই কাঁদে যখন সে সত্যিকারী কষ্ট পায়। তাহসানও পেয়েছে। অনেক অনেক বেশী পেয়েছে। মাইরা তাহসানকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবছে,
~ আমি ওনাকে কখনো ছাড়বো না। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি ওনার এভাবে পাশে থাকবো। হোক সেটা বন্ধু হয়ে কিংবা যদি কোন একসময় উনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয় তাহলে স্ত্রী হয়ে৷ যত যাই হোক ওনার আমাকে প্রয়োজন আর আমার ওনাকে৷ যেভাবে হোক ওনার সব কষ্ট আমাকে মুছে দিতে হবে৷ আজ থেকে আমার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য, ওনাকে আগের মতো করা। আমাকে পারতেই হবে। যেভাবে হোক আমাকে পারতেই হবে।
দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। তাহসানের অনেকটা ভালো লাগছে এখন। হঠাৎই ওর মনে হয় ও মাইরার সাথে মিশে আছে। যেটা একদমই লজ্জাকর। তাহসান আস্তে আস্তে মাইরাকে ছেড়ে দেয়। মাইরাও তাহসানকে ছেড়ে দেয়। এখন দুজন লজ্জা পাচ্ছে। মাইরা লজ্জায় অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে আছে। তাহসান মাইরার দিকে একবার তাকিয়ে চোখগুলো মুছে বলে,
– ধন্যবাদ তোমাকে। আর সরিও। আমি জানি আমাকে নিয়ে তোমার অনেক স্বপ্ন আর ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আমি তা কিছুই পূরণ করতে পারিনি। কিংবা হয়তো পারবোও না। ক্ষমা করে দিও প্লিজ।
~ বন্ধুর মাঝে নো সরি নো থ্যাংকস। আমি আপনার অনেক ছোট। তাও একটা কথা বলছি, অতীতকে ধরে রাখলে বর্তমান সুন্দর হয় না৷ আর বর্তমান সুন্দর না হলে ভবিষ্যতটাও সুন্দর হয় না।
বলেই মাইরা উঠে দাঁড়ায়। ওকে ফ্রেশ হতে হবে৷ তবে ও যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে যায়। তাহসানকে এভাবে রেখে ওর কেন জানি যেতে ইচ্ছা করছে না। মাইরা আবার তাহসানের কাছে আসে। এসে ওর একটা হাত বাড়িয়ে দেয়৷ তাহসান অবাক হয়ে মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা অসম্ভব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলে,
~ এভাবে বসে থাকলে শরীর খারাপ হবে৷ আপনি হয়তো অনেক ক্লান্ত। উঠুন ঘুমাবেন৷
তাহসান মাইরার দিকে তাকিয়ে কেমন জানি লজ্জা পায়৷ মাইরার চোখেমুখে আলাদা একটা মায়া আছে। তাহসান মাইরাকে নিরাশ করে না। তবে ওর হাত ধরে না উঠে নিজেই উঠে দাঁড়ায়। বেডের দিকে যাওয়ার সময় মাইরাকে বলে,
– ফ্রেশ হয়ে আসো।
~ জি।
তাহসান বেডে গিয়ে বসে পড়ে। মাইরা আয়নার সামনে বসে ওর গহনা গুলো একে একে সব খুলে ফেলে৷ তারপর স্যুটকেসটা খুলে পরনের জন্য একটা নরমাল ড্রেস বের করে নিয়ে নেয়৷ তাহসান আড়চোখে মাইরাকে দেখছিলো। মেয়েটাকে পিচ্চি পিচ্চি লাগলেও সে অনেক বুদ্ধিমতী। ঠিকই তাহসানকে সামলে ফেলেছে। তবে তাহসানের খারাপ লাগছে মাইরাকে এরকম একটা অবস্থায় ফেলে। তবে ও অপারগ। তমাকে ভুলা এত সহজ না ওর পক্ষে। তাহসান তমাকে নিয়েই ভাবছিলো। হঠাৎই মাইরা ওর কাছে এসে বলে,
~ এটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে। রাতে ঘুমটাও ভালো হবে৷
তাহসান তাকিয়ে দেখে মাইরার হাতে একগ্লাস দুধ। তাহসান মাইরার দিকে তাকিয়ে দেখে মাইরা লজ্জা পাচ্ছে। তাহসানও লজ্জা পায়। তবে মাইরা এতকিছুর পরও ওকে নিয়ে ভাবছে। এটা ওর ভালো লাগছে। তাই আর কিছু না বলে মাইরার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা তাহসান নিয়ে নেয়৷ মাইরা সাথে সাথেই লজ্জায় ফ্রেশ হতে চলে যায়। মাইরা গেলে তাহসান দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওয়াশরুমের দিকে একবার তাকিয়ে আধা গ্লাস খেয়ে বাকিটা রেখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। কান্না করায় বেচারার মাথাটা ভার হয়ে আছে। তাই বেডের ডান পাশে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। মাইরা ১০/১৫ মিনিট পর বের হয়ে দেখে তাহসান ঘুমিয়ে পড়েছে। ও একটা হাসি দিয়ে বেডের পাশে তাকিয়ে দেখে দুধের গ্লাসে অর্ধেকটা দুধ রাখা। মাইরা বেশ অবাক হয়। ও মুখ মুছতে মুছতে ভাবছে, তাহসান কি ইচ্ছা করে এটা ওর জন্য রাখলো? সে চাইলে তো পুরোটাই খেতে পারতো। তাহলে রেখে দিলো কেন? মাইরার মনে হয় তাহসান ইচ্ছা করেই ওর জন্য রেখেছে। মাইরা মুখ মুছে দুধের গ্লাসটা নিয়ে বাকিটুকু খেয়ে ফেলে। তারপর ও খেয়াল করে তাহসানের গায়ে কোন কাঁথা নেই। মাইরা পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে তাহসানের গা ঢেকে দেয়৷ গা ঢেকে দিয়ে ও অজান্তেই তাহসানের মুখের কাছে বসে। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে তাহসানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ওকে এখন দেখলে কে বলবে যে এই মানুষটার মধ্যে এত কষ্ট লুকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে হারিয়ে গিয়েছে। মাইরা ইচ্ছা করে কিংবা অনিচ্ছায়ই তাহসানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
~ আপনার জীবনের হাসি আর আনন্দের কারণ হতে চাই। জানি আপনি আমাকে তা বানাবেন না। তবে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো। কারণ আপনি আমার স্বামী। আমার একমাত্র স্বামী। আজ থেকে আমার ভালো থাকা আর খারাপ থাকা সব আপনাকে ঘিরেই।
এরপর মাইরা রুমের সব লাইট অফ করে দিয়ে তাহসানের অন্যপাশে শুয়ে পড়ে। মাইরা শোয়া মাত্রই তাহসান চোখ মেলে তাকায়। ওর মনের মধ্যে এখন অনেক কিছুই ঘুরছে। তাহসান বুঝতে পারছে না কি করবে। মাইরা যে নিসন্দেহে একটা ভালো মেয়ে তা আর বুঝতে বাকি নেই তাহসানের। কিন্তু এত সহজে তমাকে ভুলা সম্ভব না ওর পক্ষে। তমার প্রতিটি বিষাক্ত স্মৃতি তাহসানকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। তবে এখন ও আর একা না। একজন ওর আশেপাশে আছে৷ সে আর কেউ নয়, মাইরা। তাহসান কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।
৬.
পরদিন সকালের মিষ্টি রোদ এসে তাহসানের চোখের উপর পড়ে। ঘুমটা আস্তে আস্তে ভাঙলে অপরিচিত একটা সুবাস ওর নাকে এসে লাগছে। আজ অবধি এই সুবাসটা ও কখনো পায় নি। নেশা লাগিয়ে দিচ্ছে এই মিষ্টি সুবাসটা। তাহসানের মনে হয় ও সেই সুবাসটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সুবাসের মাঝে ও ডুবে আছে। তাহসান ওর হাতটা একটু নড়াচড়া করতেই মনে হয় তুলার মতো নরম কোন কিছুকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ও ভয়ে ভয়ে আস্তে করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ও মাইরাকে জড়িয়ে ধরে আছে নিজের সাথে। মাইরার কাছ থেকেই এই অপরিচিত নেশা লাগানো সুবাসটা আসছে। তাহসান মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এটা ও কি করলো! মাইরাকে কোলবালিশ ভেবে জড়িয়ে ধরে আছে ও৷ মাইরার যদি এখন ঘুম ভাঙে তাহলে তাহসানের মাথা কাটা যাবে লজ্জায়। যেভাবে হোক মাইরা ঘুম ভাঙার আগে বেড ছাড়তে হবে৷ সেই ভেবে তাহসান আস্তে করে মাইরাকে ছাড়তে নিলে হঠাৎই,
চলবে..?
সবার ভালো সাড়া চাই। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। সাথে থাকবেন সবসময়।
আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া হবে৷