মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ১০| ভালোবাসার গল্প

0
3716

মিথ্যে অভিনয় পর্বঃ ১০
লেখকঃ আবির খান

তাহসান কোন কথা না বলে সোজা মাইরার রুমে চলে যায়। মাইরা কিছু বুঝতে পারে না। ও তাহসানের পিছু পিছু যায়। মাইরা রুমে ঢুকে দেখে তাহসান মাথায় হাত দিয়ে বেডে বসে আছে৷ মাইরা মুহূর্তেই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ও অস্থির হয়ে তাহসানের কাছে এসে বলে,

~ একি! কি হয়েছে আপনার? এভাবে বসে পড়লেন যে? শরীর খারাপ লাগছে?

তাহসান মাথা তুলে মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা দেখে তাহসানের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু ও কাঁদছে না। তাহসান মাইরার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,

– মাইরা শেষমেশ তুমিও আমার সাথে মিথ্যে অভিনয় করলে? কিভাবে পারলে তুমি? আমাকে ভালো করে দিয়ে তুমি নিজের ভিতর এসব লুকিয়ে রেখেছিলে! এরচেয়ে আমাকে কেউ মেরে ফেলতো তাও ভালো ছিল। কিন্তু দুই দুইবার ধোকা! আর পারছি না।

মাইরা কিছুই বুঝতে পারছে না৷ তাহসান কেন এমন করছে। ও আবার বলে,

~ প্লিজ বলুন না কি হয়েছে আপনার? বাইরে যাওয়ার সময় তো ভালোই ছিলেন এখন কেন এমন করছেন?
– বাইরে গিয়ে যে তোমার এই মিথ্যে অভিনয় এর সত্যটা জেনেছি। (মনে মনে)
~ প্লিজ কিছু বলুন আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।
– শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। চলো বাসায় যাবো। আর কাউকে কিছু বলো না। চিন্তা করবে নাহলে।
~ কি বলেন! শরীর খারাপ হলো কিভাবে?
– জানি না। তাড়াতাড়ি বাসায় চলো। আমার রেস্ট প্রয়োজন।
~ ঠিক আছে। তাহলে আমি রেডি হচ্ছি।
– হুম।
~ আমি সবাইকে বলে আসি।

তাহসান বেডে শুয়ে পড়ে চোখের উপর হাত দিয়ে। ওর প্রচন্ড খারাপ লাগছে। মাইরা আর ছেলেটার ছবিগুলো এখনো ওর চোখের সামনে ভাসছে। তাহসানের বুক ফেটে যাচ্ছে। তার উপর ওরা নাকি অনেক ক্লোজ ছিল। তাহসান আর ভাবতে পারছে না। হাত-পা কেমন লেগে আসছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ও যে এখন কি করবে তাও বুঝতে পারছে না৷ মাইরার উপর খুব রাগ হচ্ছে ওর। কারণ তমা যে কাজটা ওর সাথে করেছে, মাইরাও ঠিক একই কাজ করেছে রাতুলের সাথে৷ এরজন্য তাহসানের খারাপ আরো বেশী লাগছে।

১৬.
মাইরার পরিবারকে বিদায় দিয়ে তাহসান মাইরাকে নিয়ে চলে আসে। গাড়িতে পুরো রাস্তা জুড়ে তাহসানের মুখ গম্ভীর ছিল। একটা কথাও বলে নি ও মাইরার সাথে। মাইরা তাহসানের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বাসায় এসে তাহসান হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলে নিজের রুমে চলে যায়৷ মাইরাও পিছু পিছু চলে আসে৷ তাহসান রুমে এসে কোন রকম ফ্রেশ হয়ে বেডে শুয়ে পড়ে। মাইরার সাথে একটাও কথা বলে না। মাইরা বুঝতেই পারছে না তাহসান কেন এমন করছে। ও নিচে ভাবীর কাছে চলে যায়।

সাথী দুপুরের জন্য রান্না করছিল। মাইরা পিছন থেকে এসে বলল,

~ ভাবী আমি হেল্প করি?

সাথী চুলার আঁচটা কমিয়ে দিয়ে মাইরার হাত দুটো ধরে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

~ রান্না পরে। আগে বলো কেমন কাটলো তোমার আব্বু আম্মুর কাছে বেড়িয়ে?
~ জি অনেক ভালোই।
~ তাহসানের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছো?
~ অতটা না। কিন্তু তিনি আমাকে বলেছেন, আজ থেকে আমিই তার সব৷ তমার কথা আর ভাববেন না।
~ যাক। শেষমেশ তাহ…

সাথী খেয়াল করে মাইরার মনটা খারাপ। কেমন উদাসীন লাগছে। ও মাইরাকে ডাক দিয়ে বলে,

~ এই মাইরা তোমার মন খারাপ কেন? কি হয়েছে? বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছো তাই?
~ না না ভাবী ঠিক আছি। সমস্যা নেই।

সাথী মাইরাকে জড়িয়ে ধরে হাসি দিয়ে বলে,

~ আমার আদরের বোনটা মন খারাপ করে না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে৷
~ জি।
~ আসো এবার দুই বউ মিলে তাড়াতাড়ি রান্না করে ফেলি। জানো রান্না হলো পুরুষের আরেকটা দুর্বলতা। স্ত্রীর রান্না যত মজাদার হয় স্বামী তত খুশী হয়।
~ তাই? তাহলে আমিও অনেক মজা করে রান্না করে ওনাকে খুশী করবো।
~ হাহা। আচ্ছা করো।
~ থ্যাঙ্কিউ ভাবী।

এরপর মাইরা তাহসানকে খুশী করার জন্য অনেক মজা করে রান্না করে। তাহসান ওর রুমে চুপচাপ শুয়ে আছে। ও কোন ভাবেই মানতে পারছে না। মাইরাকে অনেকটা আপন করে ফেলেছিল ও। হয়তো ভালবেসেও ফেলেছিল। কিন্তু মুহূর্তেই যেন সব শেষ হয়ে গেল। তাহসান মনে মনে বলছে,

– কেন সবাই আমার সাথে মিথ্যা অভিনয় করে? কেন? নাহ! মাইরাকে এর জবাব দিতেই হবে।

দুপুরে খাবার টেবিলে রাহুল আর ওদের বাবা বাদে বাকি সবাই বসে আছে। তাহসানকে মাইরা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ওর মুখটা কেমন জানি হয়ে আছে। সাথী পাশ থেকে তাহসানকে বলল,

~ মাইরা তোমার জন্য স্পেশালি রান্না করেছে। খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে।
~ বউমা তাহলে স্বামী ভক্ত হয়েছে। ভালো ভালো খুশী হলাম।

সবাই হেসে দেয় তাহসানের মায়ের কথা শুনে। তাহসানও একটা হাসি দিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করে। বাকিরাও খেতে থাকে। মাইরা আড় চোখে তাকিয়ে থাকে তাহসানের দিকে। কখন ও বলবে, রান্নাটা অনেক মজা হয়েছে। কিন্তু তাহসান দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওর রুমে চলে যায়। মাইরা পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। তাহসান ওর দিকে একবারও তাকায় নি। যে তাহসান কাল রাতেও ওর জন্য পাগল ছিল আজ তার কি হলো! ভাবীও অবাক হয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরা একটা হাসি দিয়ে কষ্টটা ঢাকার চেষ্টা করে৷ ও দ্রুত খাওয়া শেষ করে তাহসানের কাছে যায়। মাইরা রুমে এসে দেখে তাহসান সোফায় শুয়ে আছে। মাইরা তাহসানের কাছে এসে অবাক হয়ে বলে,

~ একি আপনি তো অসুস্থ, এখানে শুয়ে আছেন কেন?

তাহসান চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়েই আছে৷ কোন উত্তর দেয় নি। মাইরা আবার অসহায় ভাবে বলে,

~ আপনি এমন করছেন কেন? কি হয়েছে আপনার? প্লিজ বলেন আমাকে।
– আর মিথ্যা অভিনয় করো না মাইরা। আর না।
~ কি! আমি কি মিথ্যা অভিনয় করেছি?
– মনে করে দেখো অবশ্যই মনে আসবে৷
~ দোহাই লাগে আমাকে খুলে বলেন সব? কি বলছেন আপনি?

তাহসান হাত সরিয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে দেখে ও কাঁদছে। তাহসান একলাফে উঠে আগে রুমের দরজাটা লাগায়। মাইরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ও দাঁড়িয়ে ছিল। তাহসান দরজা লাগিয়ে আস্তে করে মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা দেখে তাহসানের পুরো মুখ সেই বাসর রাতের মতো গম্ভীর। ও খুব ভয় পাচ্ছে। মাইরা আস্তে করে ভীতু গলায় বলল,

~ আপনি দরজা কেন লাগালেন?

তাহসান আস্তে আস্তে হেঁটে মাইরার কাছে আসতে আসতে বলছে,

– যাতে তোমার সত্যগুলো বাইরের কেউ না জানতে পারে।
~ এসব কি বলছেন আপনি? আমি কিছুই বুঝ…

মাইরা কথা শেষ করার আগেই তাহসান ওকে খপ করে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে। মাইরা ভয়ে কান্না করে দেয়। তাহসান মাইরার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলে,

– রাতুল কে?

মাইরার চোখগুলো সাথে সাথে বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ও প্রচন্ড ভাবে অবাক হয়েছে। ও যেন কল্পনাও করে নি তাহসান রাতুলের কথা জানবে৷ মাইরা মাথা নিচু করে বলে,

~ জানি না আমি।
– তুমি জানো মাইরা। তুমি সব জানো। তাড়াতাড়ি বলে ফেলো রাতুল তোমার কি হয়? নাহলে খুব খারাপ হবে..

মাইরা চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়িয়ে বলে,

~ আমি জানি না জানি না জানি না…

তাহসানের রাগটা বেড়ে যায়। ও একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে মাইরার ঠোঁট জোড়া কামড়ে ধরে। মাইরা অবাক হয়ে যায়। ও ব্যথায় কুকড়ে উঠে৷ তাহসান ছেড়ে দিয়ে বলে,

– এবার আস্তে দিয়েছি পরেরবার আরো জোরে দিবো। বলো রাতুল কে?

মাইরা নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর গোলাপি ঠোঁটজোড়া লাল হয়ে গিয়েছে। মাইরা ভয় পেয়ে যায় অনেক। ও কাঁদতে কাঁদতে বলে,

~ রাতুল খুব খারাপ একটা ছেলে। ও সবসময় আমার পিছনে পিছনে ঘুরতো। আমাকে নাকি ভালবাসে। আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি কখনো। কারণ ও একটা সাইকো, বখাটে ছেলে। পাগল আর উম্মাদ ও। আমার জীবনটাকে খারাপ করে দিয়েছিল। আমি চাইনি আপনি কখনো এগুলা জানেন৷ তাই বলিনি। প্রতি মেয়ের জীবনেই এরকম অনেক ঘটনা আছে যা সে কাউকে বলতে পারে না ভয়ে। (খুব কান্না করে কথাগুলো বলে মাইরা)

তাহসান মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাইরা তাহসানের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। তাহসান মাইরার চোখগুলো মুছে দিয়ে বলে,

– এগুলো দেখো তো কি।

তাহসান ওর ফোনটা বের করে রাতুল আর মাইরার ছবিগুলো বের করে মাইরাকে দেয়। মাইরা ছবি গুলো দেখে চরম ভাবে আশ্চর্য হয়ে যায়। ওর হাত থরথর করে কাঁপছে। ও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাইরার কান্নার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়৷ ও প্রতিটি ছবি দেখে পাগলের মতো হয়ে বলে,

~ বিশ্বাস করুন এগুলো সব মিথ্যা। আমি কখনো ওর এক ফিট কাছেও যাই নি। আর ছবিতে আমি ওর সাথে মিশে আছি! অসম্ভব। আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ আপনি যার কাছে আমি গিয়েছি। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি কখনো ওর কাছে যাই নি। এগুলো ফেইক ছবি। আল্লাহ আমি আপনাকে কিভাবে বিশ্বাস করাবো। ছবিগুলো কত রিয়েল মনে হচ্ছে। আপনি তো আমাকে বিশ্বাসই করবেন না। আমি এখন কি করবো? প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করুন৷ এগুলো আসল ছবি না। (মাইরা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যায়)

তাহসান এখনো মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখটা কেমন শক্ত হয়ে আছে। মাইরা খুব কান্না করছে। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎই তাহসান মাইরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ওর ঠোঁট জোড়াকে আবার আঁকড়ে ধরে। এবার অনেকক্ষণ ধরে রাখে। যতক্ষণ মাইরা কান্না না থামায়। মাইরা আস্তে আস্তে কান্না থামালে তাহসান ওকে ছেড়ে দেয়। মাইয়া তাহসানের দিকে কান্নাসিক্ত হয়ে অবাক পানে তাকিয়ে আছে। তাহসানও মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহসান আস্তে আস্তে মাইরাকে ছেড়ে দিয়ে কোন কথা না বলে চুপচাপ রেডি হয়ে কোথায় যেন চলে যায়। মাইরা অনেকবার প্রশ্ন করে। তাহসান কিছু বলে না। ও সম্পূর্ণ রেডি হয়ে রুম থেকে বের হওয়ার আগে মাইরার দিকে একবার তাকিয়ে ওর চোখটা আবার মুছে দিয়ে বলে,

– বাসার কেউ যেন কিছু না জানে।

বলেই ও দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে বাসার বাইরে চলে যায়। মাইরা কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এসব? ওর খুব কান্না পাচ্ছে। তাহসান কি করবে এখন? ওর খুব ভয় করছে। ছবিগুলো খুব অরিজিনাল মনে হচ্ছিলো। মাইরার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো যে ছবিগুলো সত্যি। তাহলে তো তাহসান কখনোই ওকে বিশ্বাস করবে না। মাইরা বিছানায় পড়ে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ কেমন করে সব উল্টো পালটা হয়ে গেল।

১৭.
রাত ১১.৪৫ মিনিট। তাহসান এখনো বাসায় আসে নি। মাইয়া মেইন গেইটের পাশে বসে আছে তাহসানের অপেক্ষায়। অনেক বার কল দিয়েছে তাহসানকে কিন্তু রিসিভ করেনি। মাইরা তাহসানের পরিবারকে বলেছে, তাহসান জরুরি কাজে কোথায় যেন গিয়েছে। ফিরতে দেরী হবে৷ তাই সবাই সেটাই বিশ্বাস করেছে। কিন্তু মাইরা তো সত্যটা জানে। তাহসান কোথায় ও জানে না। খুব চিন্তা আর ভয় করছে। কম হলেও ২০০ বার কল দিয়েছে তাহসানকে। কিন্তু ও রিসিভ করেনি। মাইরার কেমন জানি লাগছে। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ও তাহসানকে হারাবে৷ তাহসান ওকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিবে৷ কিন্তু এসবের চেয়েও এখন বড়ো চিন্তা হলো তাহসান বাসায় আসছে না কেন? অপেক্ষা করতে করতে মাইরার অস্থিরতা সীমা পার করেছে। কিন্তু তাহসানের কোন খবর নাই। ঘড়িতে এখন রাত ১২.২২ মিনিট। মাইরার ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙে যাচ্ছে৷ ও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না৷ হঠাৎই বেল বেজে ওঠে। মাইরা এক সেকেন্ড সময় না লাগিয়ে দরজা খুলে দেখে….

চলবে…?

সবার ভালো সাড়া চাই। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। সাথে থাকবেন সবসময়।

আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া হবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here