#মিসেস_চৌধুরী
#Part_07,08
#Writer_NOVA
07
যথা সময়ে মিটিংয়ের জন্য সবাই হাজির হলো।ফিহা অনিয়াকে ঘুম পারিয়ে মিটিং রুমে চলে এলো।আপতত এখন অনিয়া টেবলেটের তত্ত্বাবধায়নে থাকবে।আকশি ও আদিয়াত ছারা আরো অনেক ক্লায়েন্ট এসেছে।ফিহা রুমে ঢুকতেই সবাই যার যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওকে সম্মান জানালো।যাতে ফিহা বেশ অবাক হলো।এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবদুল সাহেবের দিকে তাকালো।আবদুল সাহেব ফিহার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো।
আবদুলঃ অবাক হওয়ার কিছু নেই ছোট বউমা।এখানে যারা যারা এসেছে সবাই আমাদের কোম্পানির অধীনে আছে।তোমার একটা সিগনেচার ছারা তাদের এক পয়সার পণ্যও বিক্রি হবে না।তুমি যদি বিল পাস না করো তাহলো কোন কোম্পানি তার পণ্য বাজারে ছারতে পারবে না।আমদানি, রপ্তানি, পুনঃরপ্তানি তো অনেক দূরেই থাক।
ফিহা ব্যাবসায় বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করেছে।তাই এসব সে ভালো করেই বুঝে।যাতে করে আবদুল সাহেবের কথার মধ্যে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছে। মুখে একটা গম্ভীরতা নিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলো ফিহা।পুরো রুমটা আবছা নীল আলোতে ঘেরা।নীল আলোটা অবশ্য মাল্টিমিডিয়ার।বিশাল বড় রাউন্ড টেবিল।২০-২৫ জন ক্লায়েন্ট হবে।সবার মাঝে নিজেকে কেমন জানি লাগছে ফিহার।ভেতরে ভেতরে বেশ ভয় পাচ্ছে। তবে মুখে একটা পাঁজি পাঁজি ভাব রেখে দিয়েছে।ওদের কোম্পানিটা আমদানি,রপ্তানি ও পুনঃরপ্তানি নিয়ে কাজ করে।
আবদুলঃ আসালামু আলাইকুম। আপনারা সবাই নিশ্চয়ই ভালো আছেন।ভালো থাকারি কথা।আজকে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আপনাদের সাথে মিটিং রেখেছি।তবে প্রথমে আমি আমাদের কোম্পানির নিউ ওনারের সাথে পরিচয় করে দিতে চাই। যদিও এর আগে আপনারা তাকে দেখেন নি।
আবদুল সাহেবের কথা শুনে আকশির গলা শুকিয়ে আসছে।কারণ এখন আবারো ওর নাম নিবে।আর মেয়েটাকে ইঙ্গিত দিয়ে বলবে ঐটা ওর বউ।বেশ কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে হাতের সামনে থাকা পানির বোতল খুলে মুখে দিলো।
আবদুলঃ আপনারা নিশ্চয়ই জানেন আমাদের কোম্পানির সাবেক ওনার আনিস চৌধুরী এখন অসুস্থ। তার বড় ছেলে ও বউ কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু বরণ করেছে।ছোট ছেলেও তিনমাস ধরে নিখোঁজ। তাই আনিস চৌধুরী বাধ্য হয়ে তার ছোট ছেলের বউকে এই কোম্পানির ওনার করেছে।সকল বিষয়ের দায়িত্ব ছোট বউমার হাতে তুলে দিয়েছে।এখন থেকে আমাদের পুরো কোম্পানি চালাবে আমাদের ছোট সাহেব আকশি চৌধুরীর বউ।আপনারা উনাকে মিসেস আকশি চৌধুরীও বলতে পারেন।
ব্যাস এই ভয় আকশি পাচ্ছিলো।পানি মুখে দেওয়ার আগেই বিষম খেলো।কাশতে কাশতে অবস্থা নাজেহাল। পানি মুখে দিয়ে ঘটালো আরেক বিপত্তি।
এবারো সে সেম কাজটা করলো।মুখের পানি আর গিলতে পারলো না।পিচকিরির মতো করে ছিটিয়ে আদিয়াতের পুরো শরীর ভিজিয়ে দিলো।ভাগ্যিস আদিয়াতের ওপর পরছে।অন্য কেউ হলে ওর খবর নিয়ে ফেলতো।আদিয়াত ওর দিকে খাইয়া ফালামু লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে।
ফিহাঃ এনিথিং রং মি.পাটোয়ারী?
আদিয়াতঃ নো ম্যাম।ইট’স ওকে।
আকশিঃ দোস্ত সরি রে।আসলে বার বার আমার নামটা এমনভাবে নিচ্ছে যে আমি নিজেই কনফিউশানে পরে যাচ্ছি। আমার আসলে কথাটা হজম হচ্ছে না।বিয়ে না করেই বউ হয়ে গেছে আমার।
কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কথাটা বলেও পার পেলো না আকশি।আদিয়াত চোখ পাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
আদিয়াতঃ শালা,তোর খবর আছে। আরেকবার এমন করেছিস কিছু বলেনি।কিন্তু এবার ছারবো না।শুধু মিটিংটা শেষ হতে দে। তারপর দেখ কি করি?
আদিয়াতের কথার বিনিময়ে আকশি শুধু মুচকি হাসলো। কারণ সে ভালো করেই জানে আদিয়াত কিছুই বলবে না।আদিয়াত তো ওর সাথে এক মিনিটের জন্যও রাগ করে থাকতে পারে না।ফিসফিস করে দুজন চারিদিকে তাকাতেই দেখলো সবাই ওদের দুজনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
আকশিঃ সরি এভরিওয়ান।যাস্ট মিসটেক।
আবদুলঃ আর ইউ ওকে মি.সুমন?
আকশিঃ ইয়াহ আই এম।
আদিয়াতঃ আপনারা প্লিজ মিটিং শুরু করুন।
আবদুলঃ আমি এখন আমাদের নতুন ওনারকে বলবো আমাদের উদ্দেশ্য কিছু বলতে।
ফিহাঃ চাচা,আমায় কেন ফাঁসিয়ে দিলেন।আমি কি বলবো?আমি তো কিছুই জানি না।কীভাবে শুরু করবো তাও বুঝতে পারছি না।ভীষণ ভয় করছে।মনে হচ্ছে কেউ বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা করছে।
কানের কাছে গিয়ে আস্তে করে কথাটা বললো ফিহা।আবদুল সাহেব ওকে আশ্বাস দিয়ে বললো।
আবদুলঃ তুমি চিন্তা করো না বউমা।আমিতো আছিই।এখন তোমাকে সবার উদ্দেশ্য কিছু কথা বলতে হবে।নয়তো তাদের মনঃক্ষুন্ন হয়ে যাবে।তুমি ভয় পেয়ো না।সাহস করে বলে দেও।
ফিহাঃ কি বলবো?
আবদুলঃ তোমার মনে যা চায় তাই বলো।
ফিহাঃ আমার ভীষণ ভয় করছে?।
আবদুলঃ ধূর বোকা মেয়ে। তোমার আবদুল চাচা থাকতে তোমার কোন ভয় আছে।
ফিহা ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালো। হৃৎপিন্ডটা ধুকপুক করছে।এত জোরে চলছে যে মনে হচ্ছে বের হয়ে যাবে।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কানে থাকা ব্লুটুথ ওন করলো।এখন ফিহা কিভাবে বক্তব্য শুরু করবে তাও খুঁজে পাচ্ছে না।
ফিহাঃ আল্লাহ কোন মসিবতে ফেললে আমায়?আমার ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে। একে তো বিয়ে না হয়ে কোন আকশি না ফাকশি তার বউ হিসেবে পরিচয় দিতে হয়েছে। তার মধ্যে এক বাচ্চার মা হয়ে গেছি।এবার এই ব্যাঙের অফিস সামলাতে হবে।সে না হয় মেনে নিলাম।কিন্তু এখন মিটিং কিভাবে সামলাবো?ধূর ব্যাঙ?।আর ভালো লাগে না।কবে যে ব্যাটা বজ্জাত, হাতির নাতি,চামচিকার বয়ফ্রেন্ড,শয়তানের দুলাভাই আকশি ফিরবে। ঐ আকশি ফিরলে তার হাতে সব তুলে দিয়ে আমি ছুটি নিবো। এসব বাবা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।
মনে মনে কথাগুলো বলে ইনসেট ফেস করে সবার দিকে তাকালো।ফিহার মুখের রিয়েকশন দেখে আকশি ফিক করে হেসে উঠলো।তবে শব্দ না হওয়ায় কেউ ওর দিকে তাকালো না। আকশি আর ফিহা দুজনেই এখন ফাটা বাঁশের চিপায় আছে।বিয়ে না করেও বউ।ব্যাপারটা মনে হতে আরেকবার মিটমিট করে হাসলো আকশি।আকশির চোখ ফিহার দিকে পরতেই দেখলো ফিহা ওর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে।আকশি মাথা নিচু করে ফেললো।ফিহার দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে নিজের চোখ সারানো দায় হয়ে যেতো।কোন ঘোরে চলে যেত সে।কারণ আকশি ফিহাকে যত দেখে তত মুগ্ধ হয়ে যায়।আকশিকে হাসতে দেখে ফিহা মনে মনে বেশ রাগলো।
ফিহাঃ দাঁড়াও ব্যাটা।আমাকে দেখে হাসি আসছে।আমিও তোমার হাসি বের করছি।কি ভেবেছো মশাই?আমি কিছু বলতে পারবো না।হু হু আমিও দেখিয়ে দিবো ফিহা কি চিজ?আমাকে কি তোমার জোকার লাগে?এবার তোমার ভূল আমি ভেঙে দিচ্ছি মহাশয়।নয়তো আমার নামও ফিহা নয়।(মনে মনে)
ফিহা চোখ বন্ধ করে একটা বড় করে নিঃশ্বাস ছারলো।নিজেকে মনে মনে শক্ত করছে।একজন ক্লায়েন্ট বলে উঠলো
—প্লিজ মিসেস আকশি চৌধুরী আপনি কিছু বলুন।
ফিহাঃ আসালামু আলাইকুম। আমার পরিচয় তো আমাদের কোম্পানির ম্যানেজার সাহেব বলেই দিয়েছেন।তাই নতুন করে আমি কিছু বলতে চাইনা।
আদিয়াতঃ দয়া করে ম্যাম, আপনার নামটা যদি বলতেন?
ফিহাঃ আমি মিসেস চৌধুরী। আপাতত আমার এখন কোন নাম নেই। আমি এই নামেই সবার কাছে পরিচিত হতে চাই। আপনারা আমাকে মিসেস চৌধুরী বললেই আমি খুশী হবো।এবার ফেরা যাক আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়।আমি প্রথমে আমাদের প্রযেক্টের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছি।
ক্লায়েন্টদের মধ্যে থেকে একজন বললো
—ম্যাম আমাদের চট্টগ্রামের প্রযেক্টের ব্যাপারে কিছু বললে ভালো হতো।কারণ সেখানেই আমদানি রপ্তানি করতে হলে অনেক বিপত্তিতে পড়তে হয়।
ফিহাঃ ওকে মিস্টার। আমরা তাহলে সে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি।আমি প্রথমে আমাদের কোম্পানির মেইন টপিক মানে আমদানি, রপ্তানি ও পুনঃরপ্তানি কি সেটাই বলি।যদিও আপনারা সবাই সেটা জানেন।আমরা বিদেশ থেকে যে পণ্যটা কিনি সেটা হলো আমদানি।আর বিদেশিদের কাছে যে পণ্যটা বিক্রি করি সেটা রপ্তানি। মেইনলি যেটা বুঝতে আমাদের সমস্যা হয় সেটা হলো পুনঃরপ্তানি।এটা হলো আমরা বিদেশ থেকে কোন পণ্য আমদানি করে আমাদের দেশে এনে সেটাকে প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করাকে পুনঃরপ্তানি বলে।
মধ্যে বয়স্ক এক ক্লায়েন্ট বললো
—ম্যাডাম আমাদের কোম্পানিগুলো যথেষ্ট পরিশ্রম করেও লোকসানের মুখে কেন পরে সেটা যদি বলতেন?
ফিহাঃবিদেশ থেকে একটা পণ্য আমদানি করতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের সেই পণ্যটা কিনতে হয়।তারপর যে ভেজাল সেটা হলো জাহাজে পণ্য আনায়ন।আমাদের কে পণ্যটা আনতে হলে অবশ্যই জাহাজের সাহায্য নিতে হবে।কিন্তু বিপর্যিত পরিবেশে পণ্য আনায়নটা অনেক টাফ হয়ে যায়।যে কোন সময় ঝড়ের মুখে পরার সম্ভাবনা আছে।তবে যদি সেটা হয় বাংলা মাসের বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্যমাসের সময়।তাছাড়া বিভিন্ন ঝুঁকি, সমস্যা তো আছেই। কোন রকম সাগর পারি দিলে দেশে আসার পর বিভিন্ন খরচ।ডকচার্জ,কুলিভাড়া,গুদামভাড়া,পরিবহণ খরচ ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক খরচ পরে যায়।তারপর বিভিন্ন শুল্ক তো আছেই। অবশেষে যখন আমরা পণ্যটা আমাদের হাতে পাই। যদি এর মাঝে একটু দেরী হয়ে যায় তাহলে আমরা যথা সময়ের পণ্য তথা সময়ে বাজারে ছারতে পারি না।কারণ পণ্য হাতে পাওয়ার পর আরো বেশ কয়েক ধাপে মোড়কিকরণ,সিল লাগানো ইত্যাদি পেরিয়ে ভোক্তাদের জন্য উপযুক্ত করে বাজারে ছারতে হয়। আমরা যদি যথাসময়ে আমাদের পণ্য বাজারে ছারতে না পারি তাহলে বেশ বড়সড় একটা লোকসান গুনতে হয় আমাদের। এম আই রাইট??
সবাইঃ ইয়েস ম্যাম।
ফিহাঃ আমাদের আমাদানির পুরো ক্ষেত্রে বেশ নজরদারি করেও আমরা লোকসানে পরি।যার কারণ বিপ্রতিকূল পরিবেশ।শুধুমাত্র পণ্যটা পৌঁছাতে কিছু দিন দেরী হওয়ার কারণে আমরা কোটি কোটি টাকার লোকসানে পরে যাই।সেটা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। নিশ্চয়ই উত্তর পেয়ে গেছেন আপনারা।
মেয়ে ক্লায়েন্টঃ ম্যাম এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি?
ফিহাঃ গুড কোশ্চেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো আমদানি করার আগে সঠিক পণ্য যাচাই করে, বাজর চাহিদা বিবেচনা করে, পণ্যটির সিজন শুরু হওয়ার কিছু দিন আগে সকল পদক্ষেপ নিয়ে আমদানি করা।তাছারা বিকল্প হিসেবে ইনসুরেন্সে তো আছেই। তারপরও সঠিক পদক্ষেপে আমরা আমাদের কোম্পানিকে কোটি কোটি টাকার লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে পারি।
একজন যুবক বয়সের ক্লায়েন্ট বললো
—ম্যাম আমরা কি রপ্তানির ক্ষেত্রেও সেম পদক্ষেপ গ্রহণ করবো??
ফিহাঃ মোটেও না।আমদানি ও রপ্তানি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও দুটো কথার ভিন্ন অর্থ,ভিন্ন পদক্ষেপ।রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের পণ্যকে আকর্ষণীয়,টেকসই,সবদিক থেকে বেটার হতে হবে।নয়তো বিদেশিরা আমাদের পণ্য কিনতে আগ্রহী হবে না।কিন্তু পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা ঠিক দুটো পদক্ষেপের দিকে খেয়াল রাখবো। তাহলে আমাদের কাজগুলো সঠিক হবে।এবং বিদেশিরা আমাদের পণ্য কিনতে আগ্রহী ও উৎসাহী হবে।সেজন্য সবার প্রথমে আমাদের পণ্যের মান ভালো হতে হবে।পণ্যের মানের ওপর ডিপেন্ড করে কোম্পানির লাভের মুখ দেখবে নাকি লোকসানের মুখ। আমি আশা করি আপনাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছি।
সবাই একসাথে হাতে তালি দিয়ে উঠলো।ফিহা নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায় সম্পর্কে এত কথা সে কি করে বললো?তারপর একে একে সবাই যার যার প্রোজেক্ট বুঝিয়ে দিতে লাগলো।কিন্তু আদিয়াত ও আকশি অবাক হয়ে ফিহার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো সুন্দর করে গুছিয়ে ফিহা কথা বলতে পারবে সেটা ওরা দুজনের কেউ ভাবতে পারে নি।আকশি তো কখন থেকে দুই হাতের ওপর নিজের গাল রেখে এক ধ্যানে ফিহার দিকেই তাকিয়ে আছে।
#চলবে
#মিসেস_চৌধুরী
#Part_08
#Writer_NOVA
রাতে একসাথে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে ফিহা ও আনিস চৌধুরী।দুপুরের মিটিংয়ের কথা আবদুল সাহেবের কাছ থেকে শুনেছেন তিনি।ফিহা যে প্রথম বার দূর্দান্ত বক্তব্য রেখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, সেটা শুনে আনিস চৌধুরী বেশ খুশি।
নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটেছে তার।তিনি সবদিক থেকে পারফেক্ট একটা মেয়ে চুজ করেছেন।অনিয়া একটা মেয়ে সার্ভেন্টে কোলে নিয়ে ঘুরছে।টেবলেট অনিয়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
আনিসঃ আজকের মিটিং কেমন হলো বউমা?
ফিহাঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা।আমি ভাবতেই পারিনি এতো কথা বলতে পারবো।পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া এতো কথা কি করে বললাম তাতে আমি নিজেই কনফিউশানে পরে গিয়েছিলাম।প্রথম প্রথম তো অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আবদুল চাচা ভয় ভেঙে দিলো।উনি যদি আজকের মিটিংয়ে না থাকতো তাহলে আমি ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে ঐখানেই চিৎপটাং হয়ে মরে পরে থাকতাম।
আনিসঃ ভয়ের কিছু নেই বউমা।আমি জানি তুমি পারবে।তাই তো তোমাকে আমি চয়েজ করেছি।তোমার চোখে আমি জেতার অদম্য শক্তি দেখেছি।যা আর কোন মেয়ের চোখে দেখতে পাইনি।তোমাকে যে শক্ত হাতে সবকিছুতে সামলে নিতে হবে।
ফিহাঃ বাবা আপনি চিন্তা করবেন না।আপনি শুধু রেস্ট নিন।আপনার ধারণা আমি একদিন অবশ্যই সত্যি করবো।
আনিসঃ মা রে আমায় মাফ করে দিও।নিজের স্বার্থের জন্য তোমাকে কতগুলো দায়িত্বে বেঁধে রেখেছি।আফিস,সংসার,মেয়ে আরো কতকিছু তোমায় সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করো বউমা আমি যে নিরুপায়।আমার হাতে এছাড়া আর কোন পথ ছিলো না।আমি এই বয়সে কখনো এতকিছু সামলাতে পারতাম না।টেনশনে টেনশনে শেষ হয়ে যেতাম।তখন আমার দিদিভাই টার কি হতো?সেটা ভেবেই তোমাকে নিয়ে এসেছি।আমি যে তোমার মাঝে মাতৃত্ব দেখেছি।
ওর মা হওয়ার আগ্রহ, যোগ্যতা দেখেছি।ওর জন্য তোমার মনে মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ খুঁজে পেয়েছি।তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে আমাদের সাথে জরিয়ে ফেলেছি।
ফিহাঃ আমি কিছু মনে করি নি বাবা।বরং অনেক খুশি হয়েছি।কারণ আমি নিজের বাবা ও মেয়ে পেয়েছি। পেয়েছি সুন্দর একটা ছোট পরিবার।এখন আমিও সবার কাছে মাথা উঁচু করে বলতে পারবো আমারও একটা পরিবার আছে।আমারও মাথার ওপরে বাবা নামক ছায়া আছে।আমি এতিম নই।না,আমি এখন সত্যিই এতিম নই। আমার একটা পরিচয় আছে। আনিস চৌধুরীর মেয়ে আমি।আমি এখন মিসেস চৌধুরী। আপনি আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচার তাগিদ দিয়েছেন।সবার কাছে পরিচয় করে দিয়েছেন আমি অনিয়ার মা। এটাই তো আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া বাবা।
আনিসঃ বউমা তুমি দেখো, একদিন তুমি অনেক বড় হবে।আমি দোয়া করে দিলাম তোমাকে।তবে বউমা কখনও অন্য পাঁচজন মেয়ের মতো আমাকে ও আমার নাতনিকে দূরে ঠেলে দিয়ো না।তাহলে যে সে দিনই হবে আমার শেষ দিন।
ফিহাঃ ছি:ছি:বাবা এসব কি বলেন?এখন যা আছে সবই আপনাদের।আমি তো শুধু আপনাদের আমানতদার।আপনাদেরকে এবং অফিস দেখে রাখার দায়িত্ব আমার।এগুলো আগে আপনাদের ছিলো, সারাজীবন আপনাদেরি থাকবে।আমার এগুলো চাই না।আপনি ও আমার মেয়ে আমার পাশে থাকলেই চলবে।আর কিছু লাগবে না আমার।আপনি মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না,তাই না বাবা।আমি সঠিক বলেছি তো??
আনিসঃ না বউমা সেটা নয়।আমি শুধু তোমার কাছে অনুরোধ করছি।আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি।কারণ আমি তোমাকে টাকার কথা বলে আনতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তুমি তা প্রত্যাখান করো।যখনি অনির কথা বললাম তখন তুমি রাজী হলে।অনিয়াকে লালন-পালনেও তুমি কোন টাকা নিতে রাজী হলে না।
এমনকি আমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলে তুমি কখনও মাতৃত্ব টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে না। ঠিক তখনি বুঝে গেছি তুমি কি রকম মেয়ে। তরপরও ভয় হয় বউমা।কখন মানুষের মন পাল্টে যায়।সেটাতো বলা যায় না।জানো বউমা,মানুষের মনকে আকাশের রংয়ের সাথে তুলনা করা হয়।কারণ দুটোই খনে খনে রং বদলায়।
ফিহাঃ আপনি আমাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকুন বাবা।আমি আপনাকে বাবা বলে ডেকেছি। কোন মেয়ে কি তার বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে?কেউ যদি করেও থাকে,আমি কখনও আমার বাবার সাথে বৈঈমানী করবো না।নিজের সর্বস্ব দিয়ে আপনাদের সাহায্য করবো।এখন যে সবকিছু আমার।যেমন আপনি,অনিয়া।আপনি তো আমাকে অধিকার দিয়েই দিয়েছেন।তাই তো আমি বলতে পারি আমার বাবা,আমার মেয়ে।এর থেকে বেশি আমার মতো এতিম মেয়ের আর কি লাগে বলুন তো?
আনিসঃ একদম কথায় কথায় এতিম বলবে না।আমি ও অনি কি মারা গেছি।যেদিন আমরা থাকবো না সেদিন বলবে তুমি এতিম।আমরা বেঁচে থাকতে কখনও নয়।তুমি আমার মেয়ে আর অনি তোমার মেয়ে।কথাটা মনে রেখো বউমা।
আনিস চৌধুরীর কথা শুনে চোখ খুশিতে দুটো চকচক করে উঠলো ফিহার।একটা এতিম মেয়ের এর কাছে এটা যে কতবড় খুশির সংবাদ সেটা শুধু মাত্র সেই জানে।আনিস চৌধুরীর চোখের আড়ালে ফিহা নিজের চোখের পানি মুছে নিলে।গাল বেয়ে দুই ফোঁটা পানি খুশির কারণে পরে গিয়েছিল। কিন্তু সে তো সাফান ছারা নিজের চোখের পানি আর কাউকে দেখায় না।তাই জলদী করে মুছে নিয়েছে।
খাবার শেষ করে ফিহা অনিয়াকে নিয়ে রুমে চলে গেল। কিছু সময় অনিয়াকে ঘুম পারানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো।কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টা আর সফল হলো না।অনিয়া ওর মায়ের সাথে দুষ্টুমী করতে লাগলো।
ফিহাঃ কি হচ্ছে এগুলো মাম্মাম?তুমি ইদানীং ভীষণ ফাজিল হয়ে যাচ্ছো।মাম্মিকে জ্বালানোর ধান্দায় থাকো।খাবার খেতে গেলে আর ঘুমাতে গেলে তোমার দুষ্টুমী শুরু হয়ে যায়।এটা তো ঠিক কথা নয়।এরকম তো পঁচা মেয়েরা করে।তুমি কি পঁচা মেয়ে বলো?মোটেও না।তুমি তো আমার ভালো মেয়ে। আমার লক্ষ্মীসোনা,জাদুর কণা।তুমি যদি মাম্মিকে এভাবে জ্বালাতন করো তাহলে মাম্মি তো বিরক্ত হয়ে তোমাকে বকা দিবো।তখন কি তোমার ভালো লাগবে বলো। একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরো মানিক।তুমি জেগে থাকলে তো আমি ঘুমাতে পারবো না।সারাক্ষণ তোমার টেনশন হবে।আর কিছু সময় পর পর জেগে উঠবো।জলদী করে ঘুমিয়ে পরো।সকালে উঠে আমাদের আবার অফিসে যেতে হবে।সেটা কি তুমি ভুলে গেছো মাম্মাম??
খাটের কোণা থেকে টেবলেট উঠে এসে ফিহার পায়ের কাছে চুপটি করে বসে রইলো।একটু আগে তারও রাতের ডিনার হয়েছে। সারাদিন অনিয়াকে সময় দেয় বলে টেবলেট মহাশয়ের চোখেও রাতে ঘুম ভির করে।চাইলে অন্য কুকুরের মতো টেবলেটও সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতে পারে।কিন্তু সেটা সে করে না।অনিয়া জেগে থাকুক বা ঘুমিয়ে সবসময় ওর দোলনার পাশে কিংবা ওর সাথে থাকবে।মনে হয় না সারাদিনে এক মিনিটের জন্যও চোখ দুটো লাগায় টেবলেট।
ফিহাঃ জানিস টেবলেট যতদিন যাচ্ছে ততই তোর,অনির আর বাবার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি।জানি না এই মায়া কাটিয়ে উঠতে পারবো কি না।রাতে ঘুমের ঘোরে, সকাল ভোরে অনির মুখটা না দেখলে মনটা ছটফট করে।তোকে সকালের ব্রেকফাস্টে খুঁজে না পেলে মনে হয় কি যেনো একটা নেই নেই। বাবার সাথে রাতের খাবার না খেলে মনে হয় সারাদিন কিছু একটা বাকি পরে গেছে। যখন তোর মালিক আকশি আসবে তখন তো তার হাতে সব তুলে দিয়ে আমি চলে যাবো।কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তখন ভালো থাকবো না রে।আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসবে।সেসব কথা ভাবলেই এখনি আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে।
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনিয়াকে কোলে তুলে নিলো ফিহা।অনির মুখটা কি মায়াবী! এই মুখের হাসির জন্য সে শত কষ্ট করতেও রাজী আছে।কারণ সে যে এখন অনিয়ার মা।হোক সে জন্ম দেয়নি কিন্তু দায়িত্ব তো ওালন করছে।তাতেই ফিহা দাবী করতে পারে এটা ওর মেয়ে।টেবলেটও বেশ কয়েকবার কুই কুই করে শব্দ করে ফিহার সাথে ঘেঁষে বসলো।
ফিহাঃ মায়া জিনিসটা বড় অদ্ভুত। যার ওপর পরে যায় হাজার চেষ্টা করেও তার থেকে উঠানো যায় না।তোদের সবার ওপর আমার এই কয়েকদিনে এতো মায়া হয়ে গেছে যে আমার মনে হয় তুই, অনিয়া,বাবা সবাই আমার আপনজন।সবকিছু আমার, আমার মনে হয়।কোথা থেকে যেনো অধিকাটা পেয়ে যাই।আল্লাহ বাচ্চাদের জন্মের সাথে সাথে চেহারায় অনেক মায়া দিয়ে দেয়।যাতে করে মা-সহ সবাই বাচ্চার মায়ায় পরে যায়। তাহলে আমি কেন অনির মায়ায় পরবো না বলতো।যেখানে ও নিজেই জানছে আমি ওর মা।আমিতো দিনকে দিন শুধু ওর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি।আমি এটাও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি যে অনি আমার নিজের মেয়ে। আমার মনে হয় ও আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। এখন ওকে আলাদা করে বাঁচা বোধ হয় আমার সম্ভব নয় রে টেবলেট। আমি যে অনিকে সত্যি নিজের মেয়ে ধরে নিয়েছি।ও বোধ হয় আমাকে নিজের মা মনে করে।তাহলে আমি ওকে ছেড়ে কি করে যাই বলতো।
ফিহা হঠাৎ থেমে গেল।আজ সব কিছু টেবলেটের সাথে শেয়ার করলো সে।নিজের মনটা অনেক হালকা মনে হচ্ছে। টেবলেটও বুঝতে পেরে চুপটি করে ওর দিকে তাকিয়ে ওর মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে।ফিহা সেটা বুঝে টেবলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
তারপর জোর খাটিয়ে কড়া গলায় বললো।
ফিহাঃ কোথাও যাবো না আমি তোদের ছেড়ে। বাকি জীবনটা আমি তোদের সাথেই কাটাতে চাই।এখন যে তোরাই আমার সব।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে অনিয়াকে শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ফিহা।মনে হচ্ছে ফিহা ছেরে দিলেই কেউ অনিয়াকে ওর কাছে থেকে নিয়ে যাবে বহুদূরে। অনিয়াও মায়ের উষ্ণ পরশ পেয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।
#চলবে