মিসেস_চৌধুরী #Part_18,19

0
1779

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_18,19
#Writer_NOVA
18

কেটে গেছে বেশ কিছু ঘন্টা। সাফান অনিকে নিয়ে ব্যস্ত।টেবলেট আকশির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।আনিস চৌধুরীকে জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে আকশি।সাথে টেবলেটকেও।আনিস চৌধূরীকে দেখে রাখার জন্য টপবলেটকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।আদিয়াত ফরেনসিক ল্যাবে গিয়েছে ফলাফল জানতে।আবদুল সাহবেও অফিসের পানে ছুটেছেন। আজও পুরো অফিস তাকে সামলাতে হবে।মানুষটা বড্ড সহজ সরল।মনের মধ্যে কোন প্যাঁচ নেই। আকশিদের কোম্পানির জন্য নিজের জানটা দিতেও প্রস্তুত আছে।আকশি কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে তার প্রেয়সীকে দেখছে।মুখটা হাজারো বিষন্নতায় ঘেরা।ফিহাকে চেকআপ করে একজন মহিলা ডাক্তার কেবিন থেকে বের হতেই আকশির মুখোমুখি হলো।

আকশিঃ ডক্টর, পেশেন্টের অবস্থা কিরকম?
ডক্টরঃ দেখুন মি.চৌধুরী উনি এখন ভীষণ দূর্বল।তার এখন ফুলদমে রেস্টের প্রয়োজন। আপনার ওয়াইফ মিসেস চৌধুরী নিজের একটুও খেয়াল রাখে না।সারাক্ষণ টেনশন করে কোন ব্যাপার নিয়ে।
খাওয়া -দাওয়া নিশ্চয়ই ঠিকমত করে না।পুষ্টিকর খাবারের ধারের কাছেও মনে হয় যায় না।যার কারণে উনি এরকম দূর্বল হয়ে গেছে। খাবারের দিকটা কড়া নজর রাখবেন।উনি যাতে স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খায়।
আকশিঃ ধন্যবাদ ডক্টর।
ডক্টরঃ ওয়েলকাম মি.চৌধুরী। নিজের ওয়াইফের খেয়াল রেখেন।আমি আসছি।

ডক্টর চলে যেতেই আকশি বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছারলো। ফিহার জন্য ভীষণ মন খারাপ করছে।মেয়েটা নিজের খেয়াল না রেখে ওদের পরিবারের জন্য নিজের ক্ষতি করলো।তারপরেও অনির চিন্তা ওর কাছে সবার আগে।

আকশিঃ পৃথিবীর সব মা মনে হয় এমনি হয়।সাফানের থেকে জানলাম, ফিহা স্লিপ কেটে পরে যাওয়ার পরেও শক্ত করে অনিকে ধরে রেখেছিলো।যাতে ওর কিছু না হয়।আমার মা থাকলে বোধ হয় আজকে আমারও এই ক্ষতি গুলো মেনে নিতে পারতো না।অনেক কষ্ট পেতো বড় ভাইয়ার জন্য। সেই ছোট্ট বেলায় তোমায় দেখেছিলাম মা।চেহারাটা আবছা আবছা মনে আছে। ছবিতে দেখলেও মনে তোমার ছবি আঁকা আছে। তোমাকে কি ভোলা যায়?তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো।আল্লাহ যেনো তোমাকে বেহেশতে নসিব করে। তুমি ছোট থাকতে আমাদের জন্য কত দোয়া করেছো?সেই দোয়া আল্লাহ নিশ্চয়ই কবুল করছে।কারণ তোমার দোয়া না থাকলে আজ আমি বেঁচে ফিরতে পারতাম না।আল্লাহর রহমতও আমার সাথে আছে।তোমায় ছারা পৃথিবীটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।এখন তোমার মতো আমাকে কেউ আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দেয় না।আমি অসুস্থ হলে কেউ মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয় না।দুধ খাওয়ার জন্য কেউ পেছন পেছন ছুটে না।তোমার মতো কেউ আমাকে ভালবাসতে পারবে না মা।কেউ না,কেউ পারবে না।
(কাঁদতে কাঁদতে)

“মা” মাত্র একটা অক্ষরের একটা শব্দ। এই শব্দটার তুলনা অন্য কিছুতে হয় না।পৃথিবীতে যদি আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারে সে হলো আমাদের মা।যে নিস্বার্থে সন্তানের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে পারে। সন্তানের দুঃখ, কষ্টে যার চোখ পানি সবার আগে আসে সে হলো মা।মায়ের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।সন্তান হাজার ভূল করলেও তাকে ক্ষমা করে বুকে টেনে নেয়।পৃথিবীর সকল মানুষ আমাদের গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেও মা তার সন্তানকে কখনও ফেলে দিতে পারে না।বুকের মাঝে আগলে রাখে।

শত ঝড় -ঝাপটা মোকাবেলা করে তিনি আমাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়।কিন্তু আমরা সেই মা-কেই বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসার সময় একটুও কষ্ট পাই না।যখন তাকে হারিয়ে ফেলি তখন বুঝি মায়ের গুরুত্ব। একটা প্রবাদ আছে না দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না।ঠিক তমনি মা শেষ বয়সে এসে আমাদের থেকে অবহেলা,অনাদর পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে নিশ্বেষ হয়ে যায়।একবারও চিন্তা করি না জীবনের প্রথম বয়সে যদি আমাদের মা আমাদেরকে এতটা আদর,যত্ন দিয়ে বুকে আগলে না রাখতো তাহলে আজ আমরা ধরনীর বুকে পা ফেলে চলতে পারতাম না।তাই এখনও সময় আছে মা থাকতে মায়ের মর্মটা বুঝুন।সমুদ্রের পানি দিয়েও যদি আমরা মায়ের গুণগান লিখা শুরু করি তাহলে সমুদ্রের পানি শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু মায়ের গুণগান, আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, স্নেহ, আদর,যত্ন কখনও শেষ হবে না।

মায়ের কথা মনে হতেই হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পরেছে আকশি।টাকা,পয়াসা,মান,দৌলত থাকা সত্ত্বেও আজ তার বুকটা শূন্য হয়ে আছে।যার অভাবটা মা ছারা কেউ পূরণ করতে পারবে না।মাথায় কারো আলতো পরশ পেয়ে চোখ মুছে তার দিকে তাকালো আকশি।সাফান চিন্তিতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অনিয়া, সাফানের কোলে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অনেক কষ্টে অনিকে ঘুম পারিয়েছে সাফান।

সাফানঃ কি হয়েছে আকশি?তুমি কাঁদছো কেন?
আকশিঃ কই কিছু হয়নি তো।আমি ঠিক আছি।(কৃত্রিম হাসি দিয়ে)
সাফানঃ আমিও একটা ছেলে আকশি।তাই তোমার যে কিছু হয়নি এই কথা আমি বিশ্বাস করছি না।তুমি অনেক সময় ধরে কাঁদছিলে।কি হয়েছে বল আমায়?ছেলেরা তো সামান্য কারণে কাঁদে না।যখন সে নিজের সাথে যুদ্ধ করে হেরে যায় তখন কাঁদে। আমায় বলতে পারো।হয়তো তোমার মনের বোঝাটা হালকা হবে।
আকশিঃ ব্যাস এমনি কিছু হয়নি।হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে হয়ে গেল।অনেক মিস করছি তাকে।
সাফানঃ এর জন্য মন খারাপ করেছো তুমি। আমি ভাবলাম কি না কি হলো?তোমার তো তাও ভালো।তুমি জানো তোমার বাবা-মা কে? তাদের পরিচয়ে বড় হয়েছে। আর আমি ও ফিহা।আমরাতো আজ পর্যন্ত এটাও জানলাম না আমাদের বাবা-মা বেঁচে আছে না মরে গেছে। তাদের নাম কি?কি আমাদের বংশ পরিচয়। কারা জানি এতিমখানায় দয়া করে ফেলে রেখে গিয়ে ছিলো।সেই সুবাদে এখনো বেঁচে আছি।নয়তো কবে শিয়াল,কুকুরের খাদ্য হয়ে যেতাম।বেঁচে আছি, ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। এর থেকে বেশি আর কি হতে পারে বলো।

আকশি অবাক চোখে সাফানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের মা নেই বলে সে দুঃখ পাচ্ছিলো।তার কাছে মনে হয়েছিলো সেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অসহায়।কিন্তু তার থেকে অনেক মানুষ আছে যাদের কেউ নেই। এটা ভেবে আকশির সব মন খারাপ উধাও হয়ে গেল।আকশির বাবা আছে,টাকা আছে, নিজস্ব বাড়ি,গাড়ি, বিজনেস আছে।কিন্তু অনেক মানুষের তো তাও নেই। তাহলে সে নিজেকে কেন অসহায় ভাবে।সাফানের কিছু নেই তারপরেও সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে।কিন্তু তার কেন এতো আক্ষেপ?হ্যাঁ,তার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ব্যাক্তি মা নেই। কিন্তু তার বাবা,ভাই তো তার সাথে ছিলো।কিন্তু সাফানের তো তাও নেই। সেজন্য গুরুজনেরা বলতো নিজের থেকে নিচুস্তরের লোকদেরকে দেখো।তাহলে তোমার মনে হবে তুমি সত্যি সুখী। উপরের স্তরের মানুষকে দেখলে আফসোস ছারা আর কিছু পাবে না।

???

দুপুরে একসাথে খাবার খেয়ে নিলো সাফান ও আকশি।দুজনের মধ্যে কয়েক ঘন্টায় ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।সাফানের থেকে ফিহার ব্যাপারে বেশ ইনফরমেশন জোগাড় করে ফেলেছে সে।সাফানকে আকশি বারবার চলে যেতে বললেও সাফান মানা করে দিয়েছে। ওর একটাই কথা ফিহা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সে এখানেই থাকবে।আকশিও আর জোর করলো না।দুজন একসাথে কেবিনের বাইরে থাকা চেয়ারে বসে গল্প করছে। হঠাৎ অনি ঘুম থেকে জেগে গেল।সাফান অনিকে নিয়ে আসতে গেল।অনিকে ফিহার পাশেই রেখে এসেছিলো।সাফান যাওয়ার পর ধীর পায়ে আদিয়াত এসে আকশির পাশের সিটে বসলো।

আকশিঃ কি রিপোর্ট দিলো?ফিডারে থাকা দুধে কি কিছু মিশানো ছিলো।

আদিয়াত হাতে থাকা রিপোর্টের ফাইলটা আকশির দিকে বাড়িয়ে দিলো।আকশি রিপোর্ট পরে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো।

আকশিঃ ওর এতবড় সাহস?আমার মেয়ের ফিডারে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছে।এর শাস্তি ওকে অবশ্যই পেতে হবে।আমি তোকে ছারবো না রিয়ানা।
(রেগে দাঁতে দাঁত চেপে)

আদিয়াতঃ আমারও ঠিক তোর মতোই রাগ উঠেছিলো।আমি যদি এই মুহূর্তে রিয়ানাকে সামনে পেতাম তাহলে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।একটা ছোট বাচ্চার সাথে কেউ এরকম করতে পারে।ছিঃ কতটা নিচ মন মানসিকতা।

আকশিঃ আমার ওকে নিজের হাতে খুন করতে ইচ্ছে করছে। কতটা খারাপ হলে কেউ এমনটা করতে পারে।এই মেয়েটাকে আমার আগের থেকেই পছন্দ নয়।নিজের স্বার্থের জন্য ও যা খুশি তাই করতে পারে।
আদিয়াতঃ হাইপার হোস না।এখন তো আমাদের হাতে প্রমাণ আছে।আমরা নিশ্চয়ই ওকে এর যথাযথ শাস্তি দিবো।কিন্তু এখন ফিহার দিকে তোর নজর দিতে হবে।
আকশিঃ ঠিক বলেছিস।

সাফান অনিয়াকে নিয়ে চলে এলো।সাফানের কোল থেকে অনিকে নিজের কোলে নিলো আকশি।

আকশিঃ কেমন আছো মা-মণি?তুমি এখন মাম্মিকে পেয়ে আমাকে ভূলে গেছো। অবশ্য ভূলবেই তো আমাকে তো তুমি এর আগে কখনও দেখো নি।তুমি তো গুড গার্ল।তাহলে এখন ফিডারে থাকা সব দুধটুকু খেয়ে নেও দেখি।

অনি ফিডারের চুষনি মুখে দিয়ে বসে আছে। এক চুমুকও গিলে নি।বেশ কিছু সময় ব্যয় করেও আকশি অনিকে একফোঁটা দুধ খাওয়াতে পারলো না।আকশি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। আকশির মুখের কন্ডিশন দেখে আদিয়াত ও সাফান দুজন একসাথে হেসে উঠলো।

আকশিঃ বেশি করে হাসো।দিন তো তোমাদেরি।আমি চিন্তা করছি ফিহা অনিকে সামলায় কি করে?বাপ রে এখনি যা দুষ্টু হয়ে গেছে। আর তো দিন পরেই গেছে।

আদিয়াতঃ শুধু শুধু তো আর ফিহা অনির মা হয় নি।মা হতে হলে অনেক দায়িত্ব লাগে।সেই দায়িত্ব গুলো পালন করে বলেই ফিহা অনির কাছে তার নিজের মা হয়ে উঠেছে। অনি এখন ফিহাকে ছারা কিছু বুঝে না।

আকশিঃ তা তো দেখতেই পাচ্ছি।আমি যে এই মা আর মেয়েকে কি করে পটাবো তার টেনশনে মরে যাচ্ছি।

চোখ দুটো ভার হয়ে আছে ফিহার।পিটপিট করে চোখ খুলে চারপাশ দেখতে লাগলো।মাথাটা অনেকটা হালকা লাগছে।চারিদিকে তাকিয়ে ফিহা বুঝতে পারলো ও এখন হসপিটালে।সকালের কথা মনে হতেই ধপ করে উঠে বসতে চাইলে কোমড়ে ব্যাথা অনুভব করলো।অনি কোথায়?সকালে তো ওকে কিছু খাওয়ানো হয়নি।ধীরে ধীরে সকালের ঘটনা মনে পরে গেল।শক্তি জোগাড় করে উঠতে নিলে নার্স এসে বাঁধা দিলো।

নার্সঃ আরে ম্যাম আপনি করছেন কি?আপনি অসুস্থ। এভাবে উঠতে পারবেন না।আপনি রেস্ট নিন।শরীর ভীষণ দূর্বল।যেকোনো সময় পরে যেতে পারেন।
ফিহাঃ আমার বাচ্চা কোথায় নার্স?সারা সকালে ও মুখে কিছু দেয় নি।আমার মেয়ে আমাকে ছারা কারো হাতে খায় না।
নার্সঃ আপনার মেয়ে আপনার স্বামীর কাছে আছে।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।প্লিজ ম্যাম আপনি হাইপার হবেন না।
ফিহাঃ আমার স্বামী। (অবাক হয়ে)
নার্সঃ হুম আপনার স্বামী। আমি কি তাকে ডেকে দিবো।আপনার মেয়ে কি নিশ্চয়ই আপনার দেখতে ইচ্ছে করছে।
ফিহাঃ হ্যাঁ,খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি আমাকে একটু ধরে বসিয়ে দিবেন।
নার্সঃ নিশ্চয়ই।

ফিহাকে ধরে নার্স বসিয়ে দিয়ে আকশির কাছে চলে
গেলো।ফিহা এবার নিজের দিকে তাকালো। শরীরে হসপিটালের আকাশি কালার পোশাক, হাতে স্যালাইন লাগানো।আকশির সামনে এসে নার্স বললো।

নার্সঃ এখানে পেশেন্টের স্বামী কে?
আকশিঃ জ্বি আমি।
সাফানঃ ??
আদিয়াতঃ ??
আকশিঃ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা আমার দিকে?আমি কি ভুল কিছু বলেছি।
সাফান, আদিয়াতঃ একদম না।(একসাথে)
আকশিঃ কিছু বলবেন? (নার্সকে উদ্দেশ্য করে)
নার্সঃ পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।আর বাচ্চাকে দেখতে চাইছে।আপনি বাচ্চাকে নিয়ে ভেতরে চলে যান।

আকশি ভীরু পায়ে গুটিগুটি পা ফেলে ফিহার সামনে যেতে লাগলো।ভেতরে ভেতরে অনেক আনইজি ফিল করছে।ফট করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।দরজা খোলার শব্দে ফিহা সেদিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল।ওর সামনে অনিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকশি চৌধুরী। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।ধীর গতিতে আকশি ফিহার সামনে এলো।আকশির থেকে ফিহা অনিকে কোলে তুলে নিলো।কিন্তু হা করে আকশির দিকেই তাকিয়ে আছে ফিহা।আকশি এক হাতে ফিহাকে জরিয়ে নিয়ে ফিহার দিকে তাকালো।ফিহা এতটাই অবাক হয়েছে যে নিজের বাহু থেকে আকশির হাত সরাতেও ভুলে গেছে।দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।কোলে ছোট বাচ্চা।মনে হচ্ছে সদ্য মা-বাবা হওয়া দম্পতি।

আদিয়াত এবারও ঠিক সময়ে একটা ফটো তুলে নিলো।আকশির পেছন পেছন এসেছিলো।ওদের দুজনকে এভাবে দেখে ছবি তোলার লোভটা সামলাতে পারে নি।পকেট থেকে মোবাইল বের করে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললো।

#চলবে

#মিসেস_চৌধুরী
#Part_19
#Writer_NOVA

৭ দিন পর…….

ফিহা এখন অনেকটা সুস্থ। অবশ্য তা সম্ভব হয়েছে আকশির জন্য। এই সাতটা দিন আকশি ফিহার সাথে আঠার মতো লেগে ছিলো।ফিহার কোনটা প্রয়োজন,কি খাবে,ঠিকমতো ঔষধ খেয়েছে কি না?কোথায় যাবে,কি করবো ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকিছুর খেয়াল রেখেছে আকশি।১ম ১ম ফিহা বিরক্ত হলেও এখন হয় না।বরং আকশির কেয়ারিং গুলোর মাঝে ভালো লাগা খুজে পায়।একটা কেয়ারিং ছেলে সব মেয়েদের পছন্দ। অতিরিক্ত কেয়ার যদিও বা একসময় বিরক্তর কারণ হয়।তবুও মেয়েরা মন-প্রাণ দিয়ে ঠিকি যত্নশীল ছেলে চায়।ফিহাও তার ব্যাতিক্রম ছিলো না।কিন্তু অনির চিন্তা মাথায় আসার পর বিয়ের চিন্তাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলো।এখন আকশিকে দেখে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে।এক কথায় বলতে গেলে ৭ দিনে আকশির প্রতি ফিহা অনেকটা দূর্বল হয়ে গেছে।

ল্যাগেজে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে ফিহা।আজ সে চৌধুরী বাড়ি থেকে চলে যাবে।কল করে সাফানকে চলে আসতে বলেছে।ফিহার বর্তমানে ধারণা আকশি যেহেতু ফিরে এসেছে এখন এই বাড়িতে ওর থাকার কোন মানে হয় না। “এই বাড়ি থেকে চলে যাবে”কথাটা ভেবে গতকাল রাত থেকে কান্না করে মুখ, চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। অনিয়া,আনিস চৌধুরী ও টেবলেটকে আর দেখতে পারবে না মনে করে আরেকদফা কান্না করে নিলো।সাফান চলে এসেছে। সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে ফিহার কান্ড কারখানা দেখে মিটমিট করে হাসছে।

ফিহাঃ হাসছিস কেন?
সাফানঃ তুই যখন এদের ছেড়ে যেতেই পারবি না তাহলে ল্যাগেজ গুছচ্ছিস কেন?
ফিহাঃ কে বলেছে আমি যেতে পারবো না।এতদিন চৌধুরী বাড়ি সামলানোর কেউ ছিলো না। তাই আমি ছিলাম।এখন এই বাড়ির ছোট ছেলে এসে পরেছে। আমার কাজ শেষ। অফিস, সংসার,বাচ্চা সব তিনি সামলাবেন।আমাকে তো কোন প্রয়োজন নেই। তাই আমি চলে যাচ্ছি। আমি কারো ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।

সাফানঃ কান্না করছিস কেন?

ফিহাঃ অনিকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।অনেক মিস করবো ওকে।তারপরেও চলে যেতে হবে।

সাফানঃ তুই তো মিসেস চৌধুরী। কথাটা ভূলে গেছিস। তোর সংসার,মেয়ে, শ্বশুর ছেরে চলে যাবি।

ফিহাঃ আমি তো সারাজীবন এই পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তা আর হলো কোথায়?আমরা তো অনেক কিছুই চাই। কিন্তু সব কি পূরণ হয়?

সাফানঃ তুই কি পাগল হলি ফিহু?তুই চলে গেলে অনির কি হবে ভেবে দেখেছিস।ঐ ছোট্ট দুধের বাচ্চাটা তোকে ছাড়া কিছু বুঝে না।তুই চলে গেলে ও মারা যাবে তোর শোকে।

ফিহাঃ একদম উল্টো পাল্টা কথা বলবি না।আমি চলে গেলে সবাই ভালো থাকবে।আকশি চৌধুরী কোন ভালো মেয়েকে বিয়ে করে নিবে। তাহলেই তো অনি ভালো একটা মেয়ে পেয়ে যাবে।

সাফানঃ তোর মাথার কয়টা স্ক্রু ঢিলে হয়েছে আমাকে বলবি কি?তোর মতো যে অনিকে অন্য কেউ ভালবাসবে তার গ্যারান্টি কি?এমন হতে পারে তার অবহেলায়,অনাদারে,অযত্নে আমাদের মতো করে বড় হবে অনি।তুই কি এটা মেনে নিবি?বাচ্চাটার সাথে তুই এমনটা করিস না।ওর কি দোষ বল?

ফিহাঃ যদি আকশি চৌধুরী না আসতো তাহলে আমি পুরো পরিস্থিতি সামলে নিতাম।কিন্তু এখন তো উল্টো হয়ে গেছে। আমি এই বাড়িতে কোন পরিচয়ে থাকবো বল তো।আমি কারো বোঝা হতে চাইছি না।সুতরাং আমি চলে যাবো।কেউ আমাকে কিছু বলেনি।সবার থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু আমার মতো মেয়ের কপালে যে এসব নেই রে।আমি কারো দয়া নিয়ে বাঁচতে চাই না।

সাফানঃ এখানে দয়ার কি হলো?তুই এতোদিন যেভাবে ছিলি সেভাবেই থাকবি।

ফিহাঃ না, সেটা তো হয় না।আকশি চৌধুরী বেঁচে না থাকলে আমি মিথ্যা সম্পর্কে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে পারতাম।কিন্তু সে বেঁচে থাকা অবস্থা তার বাড়িতে মিথ্যে পরিচয়ে কি করে থাকি বল?আমি আজ চলে যাচ্ছি এটাই আমার শেষ কথা।তুই যদি আমাকে তোর সাথে নিতে চাস তো চুপচাপ নিয়ে চল।যদি নিতে না চাস তাহলে সাফ সাফ বলে দে।আমার ব্যবস্থা আমি করে নিবো।

সাফানঃ আমি সেটা বলিনি যেটা তুই বুঝেছিস।আমি অনিয়ার দিকে তাকিয়ে তোকে এখানে থাকতে বলেছি।তুই আকশি কে বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যা।ছেলেটা ভীষণ ভালো। ওকে বিয়ে করলে এসব কিছু তোকে ছারতে হবে না।তুই মিসেস চৌধুরী পরিচয়ে বাঁচতে পারবি।

ফিহাঃ আমি এতদিন তাদের সবকিছু দেখে রেখেছি। সেই কারণে তার ঋণ চুকাতে আমাকে বিয়ে করতে চাইছে।এছাড়া আর কিছু নয়।

সাফানঃ তোর ধারণা মিথ্যে।

ফিহাঃ আমি এসব ব্যাপারে আর কথা বলতে চাইছি না।তুই বাইরে অপেক্ষা কর আমি আসছি।

সাফানঃ আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর।তুই —-

ফিহাঃ প্লিজ সাফান,প্লিজ। আমি তোর কাছে হাত জোর করছি।তুই এসব কথা আর বলিস না।আমার অনির জন্য অনেক কষ্ট হয়।

???

কথাগুলো বলে ফিহা বেডে বসে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পরে।সাফান ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। দরজার পাশে অনিকে কোলে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আকশি।ভেতরের সব কথাই সে শুনতে পেরেছে।মনের আকাশে একরাশ বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।ফিহাকে নিয়ে সংসার করার যে সুপ্ত বাসনাটুকু জেগে উঠেছিল,তা এখন উড়ু উড়ু করে পালাতে চাইছে।সাফানকে আকশি পাঠিয়ে ছিলো ফিহাকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু কাজ হলো না।

সাফানঃ আই এম স্যরি ব্রাদার। আমার কথা মানলো না।ওর ধারণা তুমি ওর ওপর দয়া করেছো।তুমি ওকে বলে দেও না কেন?তুমি যে ফিহুকে ভালোবাসো।

আকশিঃ মেয়েরা নাকি কেউ ভালোবাসলে আগে থাকতে বুঝতে পারে। তাহলে ও কেন বুঝে না।এই কয়েকদিনে আমার সবটুকু দিয়ে আমি বুঝানোর চেষ্টা করেছি।কিন্তু ও বুঝতে চায়নি।সব কথা কি মুখে বলে দিতে হবে?আমার অপরাধ হয়ে গেছে। কাল রাতে যদি ডাইনিং টেবিলে বাবার সামনে ওকে বিয়ের কথা না বলতাম,তাহলে হয়তো ও আমাদের ছেড়ে যেতে চাইতো না।অন্তত পক্ষে আর কিছুটা দিন তো আমার চোখের সামনে থাকতো।বাবা বুঝালো,আমি বুঝালাম,অনির দোহাই দিলাম। তারপরেও কাজ হলো না।ওর আত্মসম্মান এতো বেশি। তাহলে চলে যাক ও। আমি মানা করবো না।আমি কখনও বলবোও না যে আমি ওকে ভালবাসি।ওর যদি আমাদের প্রতি কোন ভালোবাসা না থাকে তাহলে আমার ভালোবাসা তো পুরোই ফিঁকে।কি দরকার মিথ্যে সম্পর্কে বেঁধে রাখার?আমি ওর ওপর কোন দয়া করছি না।আমি ভালোবেসে ওকে বিয়ে করতে চাইছি।সারাজীবন নিজের কাছে রাখতে চাইছি।আমার কথা বাদ দিলাম।কিন্তু অনিয়া, অনি কি দোষ করছে?অনিকে এতবড় শাস্তি কেন দিতে চাইছে ফিহা?ও জানে না ওকে ছারা অনি বাঁচবে না।এখন ওর মায়ের দায়িত্ব কোথায় গেলো?কোন মা কি তার সন্তানকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে পারে।তুমিই বলো সাফান।

সাফানঃ ফিহু মনে করছে তুমি ওর প্রতি দয়া করছো।এতদিন তোমাদের সবকিছু দেখে রেখেছে সেজন্য তুমি ওকে বিয়ে করতে চাইছো।কিন্তু ওর ধারণাটা সম্পূর্ণ ভূল।তুমি ওর ভূল ধারণাটা দূর করে দেও।ফিহা,ছোট বেলা থেকে কারো কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকতে চাইতো না।ওর কথা মেয়ে হয়েছে বলে কি মাথা নিচু করে থাকবো নাকি।ছেলেদের সাথে সমান তালে মাথা উঁচু করে বাঁচবো। নিজের আত্মসম্মানে আঘাত জীবনেও মেনে নেয়নি।

আকশিঃ কিন্তু এখানে তো ওর আত্মসম্মানের কোন কথাই উঠছে না।ওর দিকে যাতে ভবিষ্যৎ কেউ চোখ তুলে তাকাতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম।আজ ও বাড়ি থেকে চলে গেলে দুদিন আগে হোক বা পরে সবাই তো জেনে যাবে ফিহা আমার বউ ছিলো না।তখন ওর দিকে সবাই আঙুল তুলবে।কেউ জেনো আঙুল তুলতে না পারে সেজন্য আমি ওকে বিয়ে করতে চাইছি। ওর চরিত্রে কেউ যাতে দাগ লাগাতে না পারে।কিন্তু ফিহা তো আমাকে ভুল বুঝছে।সবচেয়ে বড় কথা আমি ওকে ভালোবাসি।ওকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে আমি ভাবতে পারছি না।

সাফানঃ আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পারেছি আকশি।কিন্তু পাগলীটা কেন বুঝতে চাইছে না সেটা আমি বুঝছি না।

আকশি চোখের পানি মুছতে মুছতে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।সাফান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। আনিস চৌধুরীর মন খারাপ করে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। টেবলেট ও তার পায়ের কাছে মুখ গুঁজে বসে আছে।চোখে পানি চিকচিক করছে।

(আপনাদের সবার হয়তো ফিহার ওপর রাগ উঠতে পারে।কারণ ফিহা একটু বেশি বুঝছে।কিন্তু ফিহা যেহেতু সিউর জানে না আকশি ওকে ভালোবাসে। এমনটা করাই স্বাভাবিক। আর ফিহার মনে ভূল ধারণা জেগেছে যে ফিহাকে আকশি দয়া করছে।তাই ফিহা এ বাড়িতে থাকতে চাইছে না।কিন্তু অনির দিকটা না দেখায় ওর ওপর রাগ করাটাই শ্রেয়।তবে ফিহার পরিস্থিতি নিজেকে দাঁড় করালে আপনার কাছেও নিজের আত্মসম্মানটাই আগে এসে হানা দিবে।পুরোটা পর্ব শেষ করে, একটু ভেবে দেখবেন।এর আগে ফিহার ওপর রাগ করেন না।)

???

ফিহা ল্যাগেজ টানতে টানতে নিচে নেমে এলো।সোফার দিকে তাকাতেই সবাইকে দেখতে পেলো।ফিহাকে দেখেই অনি তার ছোট হাত দুটো ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো।যা দেখে ফিহার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ঝড় শুরু হয়ে গেল।বুক ফেটে চিৎকার আসছে।আনিস চৌধুরীও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছেন।আদিয়াত কিছু সময় আগে এসেছে। দুই হাত ভাজ করে মুখটা গোমড়া করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। যত কিছু হোক ও তো আকশির বন্ধু। আকশির মনের অবস্থা ওর থেকে ভালো আর কে বুঝতে পারবে।ফিহাকে দেখে টেবলেট খুশি মনে ওর দিকে ছুটে এলো।ফিহা ল্যাগেজ রেখে হাঁটু মুড়ে টেবলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

ফিহাঃ একদম দুষ্টুমী করবি না।সবার খেয়াল রাখবি।সবসময় তাদের পাশে থাকবি।তুই থাকতে অনির যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে তোকে আমি ছারবো না।অনেক রাগ,অভিমান,গাল মন্দ করেছি তোকে।প্লিজ মাফ করে দিস।পারলে আমায় ভুলে যাস।বাবার খেয়াল রাখবি।কখনও তাদের নজরের বাহিরে যাস না।ভালো থাকিস।

ফিহার গলায় কান্না জরিয়ে আসছে।টেবলেটের কাছ থেকে উঠে যেতে নিলে ফিহার হাতটা ধরে বসলো টেবলেট। করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো ফিহার দিকে।টেবলেটের চোখ দুটো জেনো বলছে,কোথাও যেয়ো না আমাদের ছেড়ে। ফিহা অন্য দিকে তাকিয়ে হাতটা ছারিয়ে নিলো।ভীরু পায়ে আনিস চৌধুরীর সামনে এসে বসলো।আনিস চৌধুরী ফিহাকে দেখে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন।

ফিহাঃ আমাকে ভূল বুঝবেন না বাবা।আমি কখনও আপনাদের খারাপ চাইনি আর চাইবো না।আজ ১ম আপনার কথায় অবাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। মাফ করে দিয়েন আমাকে।আমি কারো মনে কষ্ট দিতে চাইনি।(চোখ মুছে) ঔষধগুলো ঠিকমতো খাবেন।কোন কাজ করবেন না।যথাসাধ্য রেস্ট নিবেন।অবসর সময়ে অনির সাথে সময় ব্যয় করবেন।শরীরের যত্ন নিবেন।আমি নেই বলে অনিয়ম শুরু করে দিয়েন না।আমি প্রতিদিন ফোন করে আপনার খোঁজ নিবো।আপনার ছোট ছেলের জন্য একটা মিষ্টি চেয়ে বউ এবং অনির জন্য একটা পারফেক্ট মা খুঁজে নিয়েন।

আনিসঃ আমাদের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।আমরা তোমার কেউ হই নাকি যে আমাদের চিন্তা করবে।সবার কথা যদি সত্যি তুমি ভাবতে তাহলে আমাদের এভাবে একা ফেলে কখনও চলে যেতে পারতে না।অনিকে নিজের সন্তান মনে করলে আজ ফেলে রেখে চলে যেতে পারতে না।আমরা বাঁচি বা মরি তাতে তোমার কি?তুমি এখন আসতে পারো।

আনিস চৌধুরী রেগে কঠিন গলায় ফিহাকে কথাগুলো শুনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল।ফিহা এক দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। চোখ দিয়ে অনরবত পানি ঝরছে।আঁচল দিয়ে চোখ মুছে আকশির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনি ফিহাকে দেখে ভীষণ কান্না করছে।হাত বাড়িয়ে অনিকে নিতে গেলে আকশি দু পা পিছিয়ে গেল।

ফিহাঃ একটি বার আমার কোলে দেন না অনিকে।এক মিনিটের জন্য দেন।আমি তো আর কোলে নিবো না।প্লিজ একটি বার দিন।(কাঁদতে কাঁদতে)

আকশিঃ মিছে মায়ায় জড়িয়ে কি লাভ ফিহা?তুমি তো চলেই যাবে।তাহলে অনির প্রতি দরদ না দেখালেই ভালো হয়।তুমি আমাকে ভুল বুঝলে।একবার আমাদের কথা চিন্তা করলে না।তোমাকে ছাড়া দুধের বাচ্চাটা কি করে থাকবে সেটাও ভাবলে না।আমি তোমাকে বিয়ে করে এই বাড়ির বউ হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে চেয়েছিলাম।অনির মা হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু সে সুযোগটা তুমি দিলে না।
এখন অনিকে নিয়ে কি করবে তুমি?বাবার কথাও শুনলে না।তুমি চলে যাও।আর সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আটকে রাখবো না তোমাকে।
ফিহাঃ সাফান চল।(কঠিন গলায়)

???

ল্যাগেজ হাতে নিয়ে সাফানের সাথে সদর দরজা পেরিয়ে বের হয়ে গেলো ফিহা।মাঝ রাস্তা পর্যন্ত এসে পেছনে তাকালো।নীরব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আকশি ও আদিয়াত।টেবলেট ছুটে ফিহার পিছু আসতে চেয়েছিলো।কিন্তু আকশি আটকে রেখেছে।অনি প্রচুর কান্না করছে।দোতালার দিকে তাকাতে দেখতে পেলো আনিস চৌধুরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। চশমার ফাঁক দিয়ে চোখের পানি মুছছে।
গেইট পার হওয়ার আগে ফিহা শুনতে পেলো অনির কান্নার বেগ বেরেই চলেছে।ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

সাফানঃ আরেকবার ভেবে দেখ ফিহু।তুই ভুল করছিস।এখনো সময় আছে ফিরে যা।এটা তোর নিজের সংসার।আকশি তোকে অনেক ভালবাসে।কোন দয়া দেখাচ্ছে না।
ফিহাঃ আকশি আমায় ভালোবাসে!!(অবাক হয়ে)
সাফানঃ সবকিছু আগে আগে বুঝে যাস আর এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝলি না।পেছনে তাকিয়ে দেখ ও তোর জন্য কান্না করছে।

ফিহা পেছনে তাকিয়ে দেখলো আকশি শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছছে।অবাক চোখে ফিহা সাফানের দিকে তাকালো।
সাফানঃ তুই না অনির মা।কোন মা কি তার মেয়ে কে এভাবে ফেলে রেখে যায়।তুই চলে গেলে ওর কি হবে তুই ভেবে দেখ।অনি ও তো তাহলে আমাদের মতো বেড়ে উঠবে।তুই কি সেটা চাস বল?তুই কি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছিস না।অনি তোর মেয়ে। সবার কথা বাদ দিয়ে ওর জন্য থেকে যা।মেনে নে পরিস্থিতিটাকে। আকশির সাথে বিয়ে হলে তুই অনেক সুখী হবি।

সাফান কথা শেষ করে পাশে তাকাতেই দেখলো ফিহা নেই। কারণ ফিহা দৌড়ে অনির কাছে যাচ্ছে। আকশি চোখের পানি মুছে উল্টো দিকে ঘুরেছে রুমে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনি কেউ ছোঁ মেরে ওর থেকে অনিকে কেড়ে নিলো।অনি তার কোলে গিয়ে শান্ত হয়ে গেল।সামনে তাকাতেই আকশি দেখতে পেলো ফিহা অনিকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে সারা মুখে চুমু খাচ্ছে।

ফিহাঃ কি হয়েছে আমার মাম্মামের?একদম কান্না করবে না।আমি যে তোমার মায়ায় সত্যি বাঁধা পরে গেছি।আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।কখনও যাবো না।আমি বাকি জীবন তোমাদের সাথেই কাটাবো।প্লিজ তুমি কান্না করো না।তুমি কান্না করলে আমার একটুও ভালো লাগে না।

টেবলেট সামনে এসে দাঁড়ালো। করুণ চোখে ফিহার দিকে তাকিয়ে পুরে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে।আকশি অভিমান করে নিজের রুমে চলে গেল।ফিহা মুচকি হেসে অনিকে বললো।

ফিহাঃ তোমার বাবার আমার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছে। এবার তোমার দাদুভাই ও বাবার রাগ ভাঙাতে আমার দফা রফা হয়ে যাবে।টেবলেট, তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?তোদের ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি।
আদিয়াতঃ মায়ার বাঁধন ছেড়ে যেতে যখন পারবে না তাহলে এতো কিছু করার কি দরকার ছিলো। এবার আঙ্কেল ও আকশির রাগ ভাঙাতে তোমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে।তখন বুঝবে কত ধানে, কত চাল।

ফিহা প্রতি উত্তরে কিছু বললো না।শুধু মুচকি হেসে আদিয়াতের কথা হজম করে নিলো।সাফানকে উদ্দেশ্য করে বললো।

ফিহাঃ সাফান আমার ল্যাগেজটা নিয়ে ভেতরে চলে আয়।আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।শ্বশুর বাড়িতে বাচ্চা ফেলে চলে গেলে সবাই আমাকেই বাজে মেয়ে বলবে।
সাফানঃ আমি আসছি।যাক বাবা,শেষ পর্যন্ত তোর সুমতি খুললো।

না,এই বাচ্চাটাকে ছেড়ে ফিহা কিছুতেই থাকতে পারবে না।আজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।মায়া নামক বস্তুটা থেকে এত তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়া মোটেও সম্ভব নয়।মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছে ফিহা।বাকি দুই মি.চৌধুরীর রাগ কি করে ভাঙাবে এখন তার জন্য।
অনি নিজের ছোট হাত দিয়ে চোখ ডলছে।পাশে টেবলেট অনির শাড়ির আঁচল ধরে বসে আছে।ফিহা খুশি মনে অনিকে জরিয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকালো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here