মুখোশের অন্তরালে,অন্তিম পর্ব

0
1452

#মুখোশের অন্তরালে,অন্তিম পর্ব
#কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য
#সম্প্রীতি রায়

হাতড়ে হাতড়ে চশমাটাকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করে ওঠে রিক্ত, চ্যাটচ্যাটে নোনতা তরলে হাতটা পিছলে যাচ্ছে ক্রমাগত,
ক্লোরোফর্মের প্রভাব তখনও পুরোপুরি কাটেনি,
দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে ,মনের অদম্য ইচ্ছে অবশ শরীরটার কাছে জিতে যায়,বসে পড়ে মেঝেতে
ঝাপসা চোখে নিজের হাত পা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সে, কম্পিত হাতটা বুলোতে থাকে পেটে পিঠে,
নাহ্, ছ’ফুট দীর্ঘদেহী শরীরটার কোথাও তো বিন্দুমাত্র আঁচড়ের দাগ নেই, ব্যথা-বেদনা তো দূর!
তবে এই রক্তস্রোতের উৎস কোথায়..
সর্বশক্তি দিয়ে এবার দুই পায়ে উঠে দাঁড়ায় রিক্ত, অ্যানাস্থেশিয়ার প্রভাব তখনও কাটেনি, ঝিমধরা ভাবটার সাথে গা’টাও গুলোচ্ছে ভীষণ,
টলতে টলতে পিচ্ছিল মেঝেটার উপর সাবধানে পা ফেলে এগোতে থাকলো রিক্ত, একবার আছাড় খেলে আর রক্ষে নেই,

আচমকাই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো ওর,
আলমারির পিছনে থেকে কার রক্তমাখা হাত বেরিয়ে আছে!
একপা দু’পা করে এগিয়ে উঁকি দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো রিক্ত,”রামু!”
ধারালো ফলকাটার ছুরিটা আমূল বসানো ওর বাম বুকে,
আধখোলা মুখটা থেকে বেরিয়ে এসেছে রক্তের সরু ধারা,নিষ্প্রাণ ঠান্ডা শরীরটায় কোনো সাড় নেই,
~”রামু,”কান্নার দলাটা ওর বাকশক্তিকে আটকে দেয় মাঝপথেই, কাঠ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে সজোরে ধাক্কিয়ে জাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ওঠে ও,
নাহ্,শরীরটা শক্ত হয়ে গিয়েছে, প্রাণের স্পন্দনের কোনও চিহ্ন নেই,
চোখের জল টাকে রক্তমাখা হাতের চেটো দিয়ে মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিক্ত, রামশরণের খুনের দায়ভারও তার ওপরেই চাপবে তা বলাই বাহুল্য,
হঠাৎ মুঠোফোনের কর্কশ শব্দে সম্বিত ফিরে পেলো রিক্ত, ঝাপসা চোখে ডিজিটাল অক্ষরে চোখ বুলিয়ে সর্বাঙ্গ ঝটকা দিয়ে ওঠে ওর..

~”বলুন অফিসার,” কম্পিত স্বরে বলে ওঠে রিক্ত..

~”আপনাকে কাল একবার থানায় আসতে হবে,অরিন্দম আর আগরওয়ালের খুন related
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য,”চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠেন অফিসার,
~”আপনি আমায় সন্দেহ করছেন অফিসার!” উত্তেজনাটা আর চেপে রাখতে পারল না রিক্ত,

~”গলা নিচে!একজন কর্তব্যরত অফিসারের সাথে এরকম দুর্ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ..” গর্জে উঠলেন তিনি,”দুজন ভিকটিমই আগের দিন আপনার পেন্টহাউস গিয়েছিল কোনো এক অজ্ঞাত কারণে!আপনাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখি কীকরে..
তদন্তে সহযোগিতা না করলে স্টেপ নিতে বাধ্য হব..মাইন্ড ইট,”বলে রিক্তকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলটা ডিসকানেক্ট করে দেন তিনি..
মুঠোফোনটা মেঝেতে রেখে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রামশরনের বডিটার দিকে,
কি দিনকাল এসে পড়লো,ফিল্ম প্রডিউসার রিক্ত বাসুকে দু’পয়সার এক অফিসার রীতিমত থ্রেট দিয়ে গেলো!আজ অরিন্দম বেঁচে থাকলে এভাবে হেনস্থা হতে হতো না ওকে,
~”এর শোধ আমি নিয়েই ছাড়বো!”চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল রিক্তর..
কাঁপা হাতে মুঠোফোনটা আনলক করে কন্টাক্ট লিস্ট হাতড়াতে শুরু করল রিক্ত, রুলিং পার্টির কাউকে ফোন করব কি! কিন্তু হাওয়া তো উল্টোদিকে বইছে,নিজেরাই গদি উল্টে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে আছে,এই ক্রিটিকাল সময়ে প্রধান suspected রিক্ত বাসুকে সাপোর্ট করলে বিরোধীপক্ষ ছেড়ে কথা বলবে না!
দুর্জয়কে বলা যাক! যেমন ভাবা তেমন কাজ..

THE NUMBER YOU ARE CALLING IS CURRENTLY UNTEACHABLE..

ওপ্রান্তের যান্ত্রিক মহিলা কন্ঠস্বর এবার ওর ধৈর্যচ্যুতি ঘটালো,”শালা দরকারের সময় কাউকে পাওয়া যাবেনা!” বলে চ্যাটবক্স এ ঢুকে দ্রুতহাতে টাইপ করতে শুরু করলো রিক্ত,
হঠাৎ চোখটা আটকে গেল দুর্জয়কে পাঠানো আগের বার্তাটার দিকে,গোটা গোটা হরফে জ্বলজ্বল করছে লেখাটা

COME ASAP,I AM IN DANGER, DON’T CALL ME BACK
– RIKTA,8PM

দমবন্ধ করে মেসেজটার দিকে চেয়ে রইল রিক্ত,
ডবল ব্লু টিক দেখাচ্ছে,তারমানে দুর্জয় নিশ্চয়ই পড়েছে মেসেজটা,
~”কিন্তু টেক্সট’টা তো আমি পাঠাইনি, জ্ঞান ফিরলো একটু আগেই, সেন্সলেস অবস্থায় টেক্সট পাঠানো তো অসম্ভব!”শরীরটা যেন কেঁপে উঠল ওর,”তবে কি দিয়া আমার সেন্সলেস’নেসের সুযোগ নিয়ে দুর্জয়কে ডেকে পাঠিয়েছিলো!
আবার কল করল রিক্ত,
আনরিচেবল বলছে ফের,
মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো রিক্ত,এ যে দিয়াই করেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই, এখন দুর্জয়ের যদি কিছু হয়ে যায় তার দায়ভারও রিক্তর উপরেই চাপবে!
~”কী কুক্ষণে মেয়েটাকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি,”মুখটা ঝুলে গেলো ওর,
দিয়াকে যে সত্যিই ট্রাস্ট করতে শুরু করেছিলো রিক্ত, তা বলাই বাহুল্য! তাই শারীরিক সম্পর্কে এগোনোর চাপ দিয়ার তরফ থেকে এলেও বাঁধা দেয়নি সে,ইনফ্যাক্ট প্রটেকশন ছাড়াই মিলিত হয়েছিল..
নিজের অজান্তেই চোখটা জ্বালা করে উঠল ওর, আজীবন অন্যের নিঃশর্ত বিশ্বাস নির্ভরতা সযত্নে গুড়িয়ে দেওয়ার শাস্তি বোধহয় এটাই,
এইচআইভি পজিটিভ হয় মৃত্যু অপেক্ষা করা..
Karma is a bitch!

মুঠোফোনটা ওখানেই রেখে টলতে টলতে পা বাড়ালো রিক্ত স্নানঘরের দিকে,রক্তের নোনা গন্ধটা তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ওপর চেপে বসেছে প্রায়, ঘেন্নায়
রি রি করছে গোটা শরীরটা…
শাওয়ারের অঝোর ধারায় শরীরটা সঁপে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে রক্তস্নাত জায়গাগুলো রগড়াতে শুরু করলো রিক্ত,তরল রক্তের নোনতা বোঝা যে এতটা ভারী তা রিক্তর অজানাই ছিল,

~”তোর শেষ দেখে ছাড়বো শালী!” বিড়বিড়িয়ে উঠল রিক্ত,দুর্ভাগ্যের নাগপাশে বন্দী থেকেও প্রতিহিংসার আগল পেরোতে পারলোনা সে,অবিশ্রান্ত জলের ধারা শরীরের ক্লেদ ধুয়ে মুছে দিতে সক্ষম হলেও মনের মালিন্যের অবসান ঘটাতে পারলো কই !
বেলজিয়াম কাচের ভাঙ্গা আয়নায় চোখ পড়তেই ছ্যাঁত করে উঠলো স্নানরত প্রৌঢ়ের বুকটা, ছ’ফুট দীর্ঘদেহী পেশীবহুল শরীরটা শিরদাঁড়া সমেত বেঁকেচুরে গিয়েছে আভিজাত্যের মুকুরে,
এ যেন তার কুৎসিত অন্তরাত্মার নিখুঁত প্রতিবিম্ব..

শাওয়ারটা বন্ধ করে ভেজা উলঙ্গ শরীরে বেরিয়ে আসে স্নানঘরের বাইরে,ঠান্ডা নির্মল জলের ছোঁয়ায় ঘোরটা কেটে গেছে অনেকটাই,
মাথাটা হঠাৎই কেমন অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল ওর, ইমোশন এথিক্সের আলগা বুনোট ছিড়ে ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে,”কুল ডাউন রিক্ত,কুল ডাউন, সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি এখনো,”নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে উঠলো..
আগে রামশরনের বডিটার ব্যবস্থা করতে হবে,মেঝেটাও পরিষ্কার করতে হবে..
যেমন ভাবা তেমন কাজ
ঝটপট গায়ে জামাটা চাপিয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে লেগে পড়ে রিক্ত, বডিটা ডিপার্টমেন্টের হাতে গেলে পুলিশ তাকেই জেলে পুরবে সেই ব্যাপারে আর সন্দেহ নেই, রিফ্লেক্সের বশে weapon মেটেরিয়ালটাও ধরে ফেলেছে খালি হাতে , হিজিবিজি চিন্তায় মাথাটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে,
~”এইসময় দুর্জয় থাকলে কাজে দিত!”বিড়বিড়িয়ে উঠল রিক্ত,কিন্তু মেসেজটা সীন করার পরও দুর্জয় আসছে না কেন! এতক্ষণে তো চলে আসার কথা ওর, নাকী ওর কোন বিপদ হলো! ছটফটিয়ে উঠলো ও,
“কিন্তু দিয়া ওকে মেসেজটা পাঠালো কেন!”
জবজবে হয়ে যাওয়া কাপড়টা নিংড়াতে নিংড়াতে বলে উঠলো রিক্ত,”উফফ, এতো রক্ত থাকে একটা মানুষের শরীরে!”
কিন্তু রামশরণকে যে কেন খুন করল তা স্পষ্ট নয় ওর কাছে,
যাই হোক খুনী যে এতটা ঠান্ডা মস্তিষ্কের তা বুঝতে পারেনি সে, সব খুনের দায়ভার এখন ওর আর দুর্জয়ের উপরই চাপতে বসেছে,
হঠাৎই হাসি পেয়ে গেল ওর, কি নিদারুণ কর্মফল!
এইডসের মতো মারণ রোগে আক্রান্ত ফিল্ম প্রডিউসার রিক্ত বাসু! সাথে একের পর এক খুনের অন্যতম প্রধান সাসপেক্ট!
এযে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ!
অরিন্দম বেঁচে থাকলে আর মাথাব্যথা থাকতোনা ওর, তবুও আশা ছাড়লোনা রিক্ত,
দেশের বাড়ির জমি সম্পত্তি বেচে দিলে উকিল খরচাটা উঠে যাবে আরামসে,
ইমেজের দফারফা হলেও জেলের ঘানি অন্তত টানতে হবে না!তাকে এখন শুধু মাকে রাজি করানোর অপেক্ষা,

ব্ল্যাকলিস্ট কলামটা খুলে মার নামটা মুছে দিল সে, কলটা কানেক্ট করে শক্ত করে মুঠোফোনটা চেপে রইল কানে,
একি সুইচ অফ বলছে যে!
অন্য নাম্বারে কল লাগালো সে,
এটাও সুইচ অফ বলছে,
মা তো কখনো সুইচ অফ রাখেনা..স্বভাবদোষে নিমেষেই অধৈর্য হয়ে উঠলো সে,

~”আজই যাব হলদিবাড়ি!” বলে সময়টা দেখে নিল রিক্ত, সাড়ে নটা বেজেছে সবে,rash ড্রাইভিং করলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে সে,

ব্লু মেটালিক অডিটা হাইওয়ের বুকচিরে ছুটছে দ্রুত গতিতে, স্পিডোমিটারে প্রায় একশ ছুই ছুই,
~”কিন্তু দিয়াকে চিনতে পারলাম না কেন” ছেলেবেলায় অভাবের তাড়নায় ওকে মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার পর আর সেভাবে আর দেখা হয়নি,তাই হয়ত ছোট্ট দীপান্বিতার অবয়ব হারিয়ে গেছিল ওর স্মৃতির মুকুর থেকে..
সেদিন অরিন্দমের কথামত একবার হলেও মেয়েটাকে চোখের দেখা উচিত ছিলো ওর, বিবেকের চক্রব্যূহে না জড়ালে হয়ত আজ ওর এই পরিণতি হত না,কিন্তু সেই নরককুণ্ড থেকে দিয়াকে মুক্ত করল কে!

হলদিবাড়ি গ্রামের একমাত্র ত্রিতল বাড়িটার সামনে সজোরে ব্রেক কষলো রিক্ত, ব্লু মেটালিক অডিটা পার্ক করে দিল সামনের বিস্তৃত উঠোনে,
প্রাণভরে চারিদিকটা দেখে নিল রিক্ত, বিয়ের পরপর অহনাকে নিয়ে কাজের সুবিধার্থে এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় পাকাপাকি গেড়ে বসেছিল ও,তারপর আর এবাড়ি আসার প্রয়োজন বোধ করেনি,সেও প্রায় চার বছর আগেকার কথা…

~”মা ও মা! চেনা ডাক কর্ণগোচর হতেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে অনুসূয়া দেবীর হৃদয়ের তার,
কিন্তু সহজাত দৃঢ়তার খোলসে আবৃত করে নেন মাতৃত্বের কোমল সত্তাকে,

~”হঠাৎ এই অসময়ে!” নিস্পৃহ গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠেন অনুসূয়া দেবী,”সুদীর্ঘ চার বছর পর বছর পর মাকে দেখার জন্য মনটা আনচান করে উঠল তবে!”ব্যাঙ্গের হাসি হেসে উঠলেন তিনি,”বল কি দরকার”..

অনুসূয়া দেবীর নিষ্প্রাণ কেজো গলাতে গড়ে ওঠা আত্মবিশ্বাসটা নিমেষেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল রিক্তর,কোথা দিয়ে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারেনা..

~”কি হল, বলো কি প্রয়োজন!” তাড়া দিয়ে ওঠেন অনুসূয়া দেবী,

~”এই বাড়িটা বেচতে চাই মা,আমাদের পিছনে পুলিশ বিশ্রীভাবে পড়ে গেছে, কাঠগড়ায় উঠতে আর দেরি নেই.. একজন ভালো lawyar কে এফোর্ড না করলেই নয়,কয়েদির তকমা বসে যাবে মুহূর্তের মধ্যে,”একনিঃশ্বাসে বলে ফেলে রিক্ত..

~”তোমার প্রোডাকশন হাউজ বেচে দাও!আমার অহনার সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি কেন, তোমার ভাগের যা সম্পত্তি আছে সব তুমি বেচে দিতে পারো,”কাঠিন্য বিন্দুমাত্র কমেনি অনুসূয়া দেবীর কণ্ঠস্বরে,”আজীবন নিজের স্বার্থ দেখা ছেলেকে বিনাস্বার্থে সাহায্য করা কি উচিত!”

~”তাহলে তো আমাকে পথে বসতে হবে মা!” আর্তনাদ করে ওঠে রিক্ত,”অরিন্দম আর বেঁচে নেই যে ওর কাছে টাকা ধার চাইতে পারবো..”

~”ধার! অরিন্দম তোমায় ধার দিত নাকি, যতদূর আমি জানি ওটা তো কমিশন ছিল, তাই না? তোমার কাজের মজুরি!” কেটে কেটে বলে উঠলেন অনুসূয়া দেবী

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল রিক্ত।
“কমিশন!কাজের মজুরি এসব কি বলছে মা,”আপন মনেই বলে উঠলো সে,
ওর কপালের আঁকি-বুকি রেখাগুলো পড়তে বিশেষ অসুবিধা হলো না অনুসূয়া দেবীর,হাজার হোক নিজের পেটের সন্তান..
“বসো!”অঙ্গুলিহেলনে চেয়ারটার দিকে নির্দেশ ছুড়ে দিলেন তিনি,

বাধ্য ছেলের মতো রিক্ত বসে পরলো ধপ করে,মাথাটা আবার আজগুবি ভাবনার জালে ফেঁসে যাচ্ছে..”মা কি তাহলে সবই জানে” আপন মনে বলে উঠল সে,

“সবই জানি আমি”মায়ের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল রিক্ত,মহিলা কি থট রিডার নাকি!
হালকা গলা খাকারি দিয়ে উঠলেন অনুসূয়া দেবী,”হারাধন তোমার বাপদাদার আমল থেকে আমাদের একনিষ্ঠ সহকারি ছিল, বিশ্বস্ততার বাঁধন এতটাই মজবুত ছিল যে ভৃত্য বলতে বাধে আমার,
তোমার মনে পড়ে সেবার তোমার বাবার রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল,সেই দুর্বল রোগা শরীর থেকে জীবনরস দান করতে দুবার ভাবেনি লোকটা,
ABনেগেটিভ যে খুবই রেয়ার,”
দু মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন অনুসূয়া দেবী,দৃষ্টি বাইরের পূর্ণচন্দ্রের দিকে স্থির,”কতবার হারাধনের স্ত্রীয়ের বানানো নাড়ু চুরি করে খেতে ,একদিনের জন্য হলেও বিরক্ত হননি তিনি,সন্তান স্নেহে আগলে রাখতো তোমাকে,সেই মায়ের মেয়েকেই সিংহের গুহায় ঠেলে দিলে তুমি! পয়সার এত লোভ তোমার! ভুলেই গেলে বাচ্চা মেয়েটা তোমায় রাখি পড়াতো.. ছি!”
ঘৃণায় মুখ কুঁচকে গেল অনুসূয়া দেবীর তোমার বন্ধুর কুকীর্তি ধামাচাপা দিতে গিয়ে সরল লোকটাকেও ফাঁসিয়ে দিলে কমিশনের লোভে, শেষমেষ মিথ্যা অপবাদে অভিযুক্ত হয়ে জেলে আত্মহত্যাই করে বসলো, বাঁচাতে পারলাম না তাকে,
হ্যাঁ পরিবারটা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর
তোমার অজান্তেই হারাধনের সাথে জেলে দেখা করতে যেতাম আমি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল খুব,
যে কিনা স্ত্রীবিয়োগের পর আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি ,সে নিজের মেয়ের বান্ধবীকে ধর্ষণ করে খুন করেছে,!
তোমার কুকীর্তির আভাস পাই তখনই, আইনের পথে লড়তে চেয়েও বিশেষ সুরাহা হয়নি, টাকা পয়সা ঢেলে এমনভাবে কেসটা সাজিয়ে ছিলে,যাতে হারাধনের মানসিক বিকৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে.. তারপর..”

~”মা!” আর নিজেকে সামলাতে পারেনা রিক্ত,অনুসূয়াদেবীর কথার মাঝেই বলে ওঠে সে।

~”একদম চুপ!”গর্জে উঠলেন অনুসূয়া দেবী,”প্রোডাকশন হাউজ চালানোর যখন এতটাই দরকার ছিল তখন সৎ পথে উপার্জন করতে পারতে,মেরুদন্ডের সাথে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারতে,মা-মরা মেয়েটার বিশ্বাসের প্রতারণা করলে! নিজের ক্ষমতা-স্বাধীনতার এভাবে অপব্যবহার করলে, এত নিচে কবে নেমে গেলে তুমি,”

~”কিন্তু মা দিয়া,”কথাটা শেষ করে উঠতে পারেনা রিক্ত,
দিয়া মালবিকা বেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই ওদের দেখে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালো রিক্ত,শিরদাঁড়া বেয়ে নামা শীতল স্রোত টের পেলো ভালোমতো..
ইস!কেন যে সেদিন অরিন্দমের কথামতো হারাধনের মেয়েটাকে দেখলোনা আফসোসটা আবারো চাগাড় দিয়ে উঠল ওর,

রিক্তর পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন অনুসূয়া দেবী,”দিয়াকে সেই নরককুণ্ড থেকে বের করে এনে তোমার কাছে পাঠানোর পরিকল্পনাও আমারই ছিল,তোমার পেন্টহাউস ডেকোরেশন এর ফাঁকে আমি ক্যামেরা বসাতে নির্দেশ দিয়েছিলাম আমিই!
এদিকে আয় রাজেশ”বলে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলেন তিনি

ঘরে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স,নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না রিক্ত!
এটা কি শুনলো সে!
তার জন্মদাত্রী মা’ই সব চক্রান্তের মূলে!

ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে যেতে বুক চিরে আসা প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে তার,”কিন্তু কেন!আমি যে তোমার নিজের ছেলে!”

“কুসন্তান যদিও বা কুমাতা কদাপি নয়!”তোমার পাপের যোগ্য শাস্তি এটাই, হারাধনের মতো আরো অনেক বাবার অপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে দিলাম আমি,”দু মুহূর্ত থেমে আবারও বলে উঠলেন”কিছু কিছু সম্পর্ক রক্তের চেয়েও গাঢ় হয় রিক্ত!” চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন অনুসূয়া দেবী.. “না জানি আরো কত পরিবারের সর্বনাশ করেছ তুমি”
“তাছাড়া জেলের চৌহদ্দি তোমাদের জন্য যথেষ্ঠ নয়,তাই কলঙ্কহীন মুখোশ খুলে বিষাক্ত মুখ জনসমক্ষে দেখানোর এই পরিকল্পনা, মালবিকা ডাক্তার হওয়ার সুবাদে প্রয়োজনীয় anesthesia,poisonগুলো পেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি,

হাউ হাউ করে দুইহাতে মুখ কেদে উঠলো রিক্ত,পাপের ঘড়া ভরার শাস্তি যে এতটা নির্মম তার জানার বাইরেই ছিল,নরক বোধহয় এটাকেই বলে..”কিন্তু দুর্জয় কোথায়?আমার ফোন থেকে ওকে text কেন করেছিলে রামশরণ কেইবা মারলে কেন করলে তোমরা!”

~”আমাদের আক্রমণ করেছিল রামশরণ তাই বাধ্য হয়ে ওকে সরাতেই হলো, যদিওবা রামশরণও সমান দোষে দোষী ,তোমার অনৈতিক কার্যকলাপের বিশ্বস্ত সহকারি ছিল,”এতক্ষণ বাদে কথা ফুটল দিয়ার মুখে..

~”আর দুর্জয়?”

“সেন্সলেস হয়ে যাবার পর তোমার নম্বর ব্যবহার করে তোমার পেন্টহাউসে ডেকে আনা হয়, তারপর বডিটা তোমার বেডরুমে খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখা হয়,”দু’মুহূর্ত থেমে বলে উঠল দিয়া,”পুলিশ তোমার খোঁজে চিরুনিতল্লাশি চালাচ্ছে,”অসংখ্য নারী পাচার,তিন বন্ধু সহ রামশরণ কে নির্মমভাবে হত্যা করার অপরাধে শীঘ্রই আদালতে তোলা হবে তোমাকে, তোমার রচিত ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের জালে তুমি নিজেই বন্দি…..”

~”আমি তোদের তিনজনকেই জেলের ঘানি টানাবো”হিসহিসিয়ে উঠলো রিক্ত,

~”সব এভিডেন্স তোমার এগেনস্টে রিক্ত, গেট আউট ফ্রম মাই হাউস!”

দমদেওয়া পুতুলের মত সিঁড়ির বেয়ে নামতে থাকে রিক্ত, অডিটা পড়ে থাকে সেখানেই,
নগ্ন নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে উদীয়মান সূর্যের দিকে..

ভোরের বিন্দু বিন্দু আলোয় সিক্ত অসমবয়সী তিন নারী একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তার পথচলার দিকে..

সমাপ্ত

সিজন 2 আসবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here