মুগ্ধময়ী
জান্নাতুল নাঈমা
“আমি আমার স্বামী’কে ডিভোর্স দিতে চাই।”
আকস্মাৎ রিতিভার মুখে এমন কথা শুনে ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল মুসকান৷ তারপর শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“ডিভোর্সের কারন কি?”
“আমার স্বামী আমার থেকে সতেরো বছরের বড়ো। বিয়ের সময় পরিবার, আত্মীয় স্বজনদের পরামর্শে বিয়ে করেছি। তখন বুঝিনি এই বিয়ের জন্য আমাকে সমাজের লোকের কাছে হাসির পাত্রী হতে হবে। তাদের সমালোচনার মূল বিষয় এখন আমি। রাস্তা ঘাটে বের হলেই সকলে আমাকে দেখে কানাঘুষা শুরু করে। বান্ধবী’রা প্রথম দেখায় আমার স্বামীকে আংকেল বলে ডেকেছিলো। লজ্জায় মরতে মন চাচ্ছিলো তখন। ”
ভ্রুদ্বয় কুঁচকে মুসকান বলল,
“তুমি কি অবৈধ সম্পর্কে রয়েছো? বৈধ সম্পর্কে লজ্জা কিসের? আজকাল তো অবৈধ সম্পর্ক’কে মানুষ জনসম্মুখে প্রকাশ করতেও লজ্জাবোধ করে না। ”
“প্রশ্নটা বৈধ অবৈধের নয় প্রশ্নটা আমার পুরো লাইফের। জীবনটা আমার দিনকে দিন বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে। অসহনীয় তিক্ততায় ডুবে মরছি। আর পারছিনা এসব সহ্য করতে আর না পারছি স্বামী নামক পুরুষ’টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে। ”
“শুরু থেকেই এমন অনুভূতি কাজ করছে তোমার। ”
“না মুসকান শুরু থেকে নয়। আমাদের সম্পর্কের সূচনা টা বেশ ছিলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারলাম আমার বাবা মা আমার জীবনটা ঠিক কীভাবে নষ্ট করে দিয়েছে। ”
“কীভাবে নষ্ট করে দিয়েছে? ”
“এই যে আমার চেয়ে অত্যাধিক বেশি বয়সী পুরুষের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। যেখানেই যাই সেখানেই সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে বলে,’আল্লাহ তোর জামাই এতো বয়স্ক! ‘ ”
“তুমি তাদের কথা এতটা গুরুত্ব দিচ্ছো কেন? ”
“গুরুত্ব নয় বরং ওরা আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, রিতিভা তুই এর থেকেও অনেক ব্যাটার কিছু ডিজার্ভ করিস। ”
কিঞ্চিৎ হাসলো মুসকান। সে হাসিটায় মিশে ছিল স্বল্প পরিমাণ তাচ্ছিল্যতা। সেটুকু বজায় রেখেই বলল,
“তাই… খুব ব্যাটার কিছু ডিজার্ভ করো বুঝি? ভাইয়া আই মিন তোমার হাজব্যান্ড কি করে যেন? ”
” বাংলা লেকচারার। ”
“আর তুমি? ”
এ পর্যায় কিঞ্চিৎ ইতস্তত বোধ করল রিতিভা। বলল,
“সেটা তো জানোই। ”
“নিজের মুখে আরেকবার বল শুনি। ”
“অনার্স তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। ”
“মানে হচ্ছে তোমার হাজব্যান্ড স্টাবলিশড আর তুমি জাস্ট স্টুডেন্ট। তাহলে বিষয় টা আমি সহজ এবং জটিল দু’ভাবে খতিয়ে দেখলেও ফলাফল এটাই যে সে তোমার থেকে ব্যাটার কিছু ডিজার্ভ করে। সে চাইলেই পারতো একজন স্টাবলিশড মেয়ে’কে বিয়ে করতে। তা না করে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অল্প বয়সী মেয়ে’কে কেন বিয়ে করল এটাই বুঝতে পারছি না। শুনেছি বেশ ধনাঢ্য পরিবারে তোমার বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে তাদের কোন চাহিদা ছিল না বরং তোমাকে নিজ দায়িত্বে সাজিয়ে গুছিয়ে ঘরে তুলেছে। আজকালকার যুগে এমন মানুষ ক’টা পাওয়া যায়? যাদের ধন, সম্পদ রয়েছে তারা আরো চাই চাই করে। নিউজ পেপারে সেদিনও দেখলাম, বেশ সম্পদশালী এক পরিবারের বউ’কে শাশুড়ি আর স্বামী মিলে হত্যা করেছে শুধুমাত্র যৌতুক হিসেবে দাবি করা গাড়ি,আর ফার্ণিচার না দেওয়াতে। তোমার কি ভাগ্য তাই না এসবের কিছুই হয়নি। পড়াশোনা করছো,সারাদিন স্বামী’কে ছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াও। বিলিভ মি. এখন আমারো মনে হচ্ছে ভাইয়া তোমার থেকে ব্যাটার কাউকে ডিজার্ভ করে। ভালো পরিবারের একটি ঘরোয়া মেয়ে’কে। যে তার স্বামী, সংসারের টেক কেয়ার করবে। সারাদিনের ক্লান্তির পর বাড়ি ফিরে বউ’য়ের হাসি খুশি মুখটা দেখতে পারবে। ”
মুসকানের কথাগুলো শুনে রিতিভার মুখটা ছোটো হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কয়েকবার ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। মুসকান এগিয়ে এসে রিতিভার একটি হাত নিজের দু’হাতে মুঠো বন্দি করে নিয়ে বলল,
“বৈধ সম্পর্কে বিন্দু মাত্র লজ্জা রাখা অনুচিত রিতিভা আপু। যেখানে মানুষ অবৈধ সম্পর্কে যুক্ত থেকে লোক সম্মুখে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করে, সেখানে তুমি নিজের বৈধ সম্পর্ক নিয়ে লজ্জিত হচ্ছো! পবিত্র একটি সম্পর্ক’কে এভাবে হেয় করছো? তোমাদের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটালে যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালাকে অসন্তুষ্ট করা হবে৷ সৃষ্টিকর্তার আরশ কাঁপিয়ে সমাজের লোক, বন্ধু-বান্ধব’কে সন্তুষ্ট করবে তুমি? ”
বক্ষঃস্থল মৃদু কেঁপে ওঠল রিতিভার৷ দু’চোখে স্পষ্ট হলো অনুতপ্ততা। চোয়াল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়েও পড়ল৷ মুসকান নিজ হাতে সে অশ্রু কণা মুছে দিয়ে বলল,
“আমি তোমার থেকে অনেক ছোটো আপু। দুনিয়া সম্পর্কে আমার তেমন জ্ঞান নেই৷ ভালোবাসা, সম্পর্ক এগুলো সম্পর্কেও নেই। তবুও আমি মনে, প্রাণে বিশ্বাস করি ভালোবাসা, সম্পর্ক এসবের চেয়ে বড়ো, মূল্যবান আর কিছু হতে পারে না।”
রিতিভা মুসকানের মায়াবী দৃষ্টিজোড়ায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল৷ বক্ষঃস্থলে কেমন শান্ত, শীতল অনুভূতির ছোঁয়া লাগল তার৷ মুসকান তার ভার্সিটির জুনিয়র স্টুডেন্ট। মেয়েটা হোস্টেলে থাকে৷ বান্ধবী’র রুমমেট। বান্ধবী’র সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সুবাদেই গত পাঁচ মাস আগে পরিচয় ঘটে মেয়েটার সাথে। শান্তশিষ্ট, মায়াবী চেহেরার বাচ্চা একটি মেয়ে৷ তেমন ঘনিষ্ঠতা না হলেও বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছে। আজ সে এসেছিল বান্ধবী রিনার কাছে। এসেই জানতে পারল সে ঘন্টা দুয়েক আগে সাতদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছে৷ প্রচণ্ড অসহায় লাগতে শুরু করল তার৷ মনের কথা সবাই’কে বলা যায় না। এ মুহূর্তে রিনা’কে ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার জন্য। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে রিনার বেডে ধপ করে বসে পড়ে সে৷ তখন এগিয়ে আসে মুসকান৷ রিতিভা এক গ্লাস পানি চায়৷ মুসকান দ্রুততার সঙ্গে পানি দেয়৷ তৃষ্ণা মিটিয়ে অসহায় চোখে মুসকানের দিকে তাকাতেই মুসকান বলে,
” কী হয়েছে আপু? তোমাকে খুব আপসেট লাগছে।”
এটুকু বলতেই রিতিভার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ বুকের ভিতর জমানো কষ্ট, জমানো কথাগুলো উগ্রে বেরিয়ে আসে। তখনও রিতিভা বুঝতে পারেনি বাচ্চা মেয়েটার কাছেই তার সমস্ত ক্লান্তির সমাপ্তি ঘটবে৷ লম্বা একটি শ্বাস ত্যাগ করল রিতিভা। বলল,
“তোমার চোখ দু’টো ভীষণ সুন্দর মুসকান, ভীষণ মায়াবী। তোমার কথাগুলোও খুব সুন্দর। ”
লাজুকতা মিশ্রিত একটুখানি হাসলো মুসকান। চোখজোড়া রুদ্ধ করে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত ভণিতায় তাকিয়ে বলল,
“আমি একজন’কে খুব ভালোবাসি আপু।”
রিতিভা মলিন হেসে বলল,
” তাই কে সে? ”
” এ পৃথিবী’তে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন একজন পুরুষ। কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসি বলতে পারি না। সেই সৌভাগ্য সৃষ্টিকর্তা এখনো দেননি আমাকে। ”
উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল রিতিভা। তার মাঝে বিমর্ষ বোধটুকু অনেকটাই কেটে গেছে। বুঝতে পারল মুসকান। মুচকি হেসে বলল,
” ইন্টারেস্টিং কথা কি জানো? ঐ মানুষ’টা আমার চেয়ে চৌদ্দ বছরের সিনিয়র। কিন্তু বিশ্বাস করো সে যদি আমার সতেরো বা বিশ বছরের সিনিয়রও হতো তবুও তার প্রতি ভালোবাসা একটুও কমতো না।”
রিতিভা বলল,
” তুমি তাকে বিয়ে করলে ঠিক আমার মতোই অবস্থা হবে তোমার। ”
” আই ডোন্ট কেয়ার আপু। অলরেডি বাড়ি থেকে আমাকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। আমার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তার সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ রাখার উপায় রাখেনি। তবুও আমি তাকে ভালোবাসি৷ আমার সমস্ত’টা জুড়েই সে আছে। তার বয়স নিয়ে সবার বিরাট সমস্যা। অথচ আমার একটুও সমস্যা হচ্ছে না। জীবন আমার, ভালোবাসি আমি, ঐ মানুষ’টাও আমার। বিয়ে করব আমি তার সংসার করব আমি। তার বাচ্চা,কাচ্চার মা’ও হবো আমি। অথচ সমস্যা আমার পরিবার, আত্মীয়, স্বজন বন্ধু-বান্ধব সব্বার অদ্ভুত! ”
এক সমুদ্র ভালোবাসা লালন করা চোখ দু’টো তে তাকিয়ে রিতিভারও বলতে ইচ্ছে করল,
” জীবন আমার, সংসার আমার, স্বামীও আমার তাহলে লোকের এত সমস্যা কেন? ”
মুসকান বলল,
“আপু শুনছো? ”
রিতিভা চমকে ওঠল বলল,
” নাম কী গো তার? ”
মুসকান আবারও লজ্জা পেল। কিঞ্চিৎ মাথা নুইয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” ব্যারিস্টার ইমন চৌধুরী। ”
রিতিভা নাম’টি শুনেছে রিনার কাছে। কার্ডও আছে তার কাছে৷ ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলার জন্যই ইমন চৌধুরীর খোঁজ করছিল সে। তাই বিস্মিত হয়ে বলল,
“ইমন চৌধুরী! ”
মুসকান একটু মন খারাপ করল। বলল,
“তুমিও চেনো? ইশ যাকেই নাম বলি সেই চেনে। ”
মৃদু হেসে রিতিভা বলল,
“একই শহরে থাকি এ শহরেরই তরুণ আইনজীবী সে। না চিনলে হবে? ”
মুসকান আলতো হেসে বলল,
” বয়সের ব্যবধানের জন্য সহজে তাকে পাচ্ছি না। আর তুমি পেয়েও হারানোর চিন্তা করছো? দু বছর বছর সংসার করেও। ”
” তোমরা তো দু’জন দু’জন’কে বিয়ের আগেই ভালোবেসেছো আমাদের তো সেসব কিছু ছিল না। ”
” দু’বছরে তোমাদের মধ্যে কি কোন অনুভূতিই তৈরি হয়নি? ”
রিতিভা চুপ করে রইল। মুসকান বলল,
” ছোটো মুখে একটি প্রশ্ন করব আপু? ”
রিতিভা হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিল। মুসকান বলল,
” দু’টো বছর একজন পুরুষের সঙ্গে কাটিয়েছো৷ ইন্টিমেট হয়েছো অথচ ফিলিংস হয়নি। এটাতো বিশ্বাস করতে পারছি না। ”
রিতিভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” সারাদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর না৷ আর একবারো ঐ মানুষ’টা’কে ছুঁতে দেব না আমায়। কিন্তু রাত হলে মানুষ’টা যখন কাছে আসে, ভালোবেসে যত্ন নিয়ে স্পর্শ করে তখন আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি না। গতরাতে যখন দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে আমার কাছে একটা বাচ্চার জন্য আবদার করল আমিও সম্মতি দিয়ে দিলাম৷ অথচ সকাল হতেই সব অনুভূতি ফিকে হয়ে গেল। ভার্সিটিতে আসার পর যখন ক্লাসমেট লিজা কৌতুক করে বলল, “অমন বয়স্ক জামাইয়ের নিচে শুইতে গা ঘিন ঘিন করে না? ” বিশ্বাস করো গা গুলিয়ে বমি পেয়ে গেল আমার। ”
অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে মুসকান বলল,
” আপু তুমি কেন উচিৎ জবাব দিলে না? ”
” কি বলতাম আমি? ”
অসহায় চোখে কঠিন ভাবে তাকিয়ে মুসকান বলল,
” বলে দিতে তোদের মতো বিয়ের আগেই বয়ফ্রেন্ডের ভোগের স্বীকার হইনি। তোরা যদি পর পুরুষের নিচে শুয়ে সতীত্ব বিলাতে পারিস। আমার নিজের স্বামীর নিচে শুইতে গা ঘিন ঘিন করবে কেন? ”
অনেকটা সময় নিরবতায় কাটলো। রিতিভার অস্থির লাগছে খুব৷ নিজের বিবেকের কাছে বড্ড অপরাধী লাগছে৷ সম্মুখের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” তুমি যদি পারো আমি কেন পারব না। সে তো আমার স্বামী। ”
রিতিভার ভাবনার মাঝেই দরজায় কড়া নাড়ল, পূজা। মুসকানের বেস্ট ফ্রেন্ড পূজা৷ এসেই খবর দিল গেটের বাইরে ইমন অপেক্ষা করছে তার জন্য৷ সঙ্গে সঙ্গে ওঠে দাঁড়ালো মুসকান। রিতিভা’কে বলল,
” আপু আমাকে যেতে হবে। ”
রিতিভা বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল। মুসকান হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে দরজার অবধি এগিয়ে গেল৷ কোনদিকে আর হুঁশ নেই তার। রিতিভা’কে রেখেই বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো সে। পেছন থেকে রিতিভা ডাকল,
“মুসকান। ”
থেমে গেল মুসকান৷ পেছন ঘুরে তাকাতেই রিতিভার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠল। সশব্দে বলল,
” জীবন আমার, সংসার আমার, স্বামীও আমার লোকের এত সমস্যা কেন? ”
” সমস্যা নয় দ্যাট মিন’স চুলকানি। এরপর যার যার এমন চুলকানি দেখবে তাকে অ্যাডিগান সাজেস্ট করবে কেমন? আসি। ”
হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল মুসকান। রিতিভা চোখের জল মুছে ফোন করল, তার স্বামী’কে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল,
” হ্যাঁ রিতি বলো। ”
” আপনার একটু সময় হবে প্রফেসর সাহেব। ”
” কী হয়েছে রিতি! তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? ”
” আপনার সঙ্গে একাকী কিছু সময় কাটানো যাবে? জনমানবহীন স্থানে, খোলা আকাশের নিচে বসে কিছু সময় গল্প করবেন আমার সঙ্গে? ”
দীর্ঘদিন ধরে যেটুকুর জন্য হাঁসফাঁস করতো সারিম। আজ অপ্রত্যাশিত ভাবে সেটুকু পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। ক্ষীণ স্বরে শুধু জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কোথায় আছো? ”
রিতিভা উত্তর দিতেই কল কেটে দিল সারিম। সে আসছে এক্ষুনি আসছে…।
_______________________
গোধূলিলগ্নে লেকের পাড়ে রোজই কপোত-কপোতী’দের দেখা মেলে। তবে আজকের লগ্ন’টা একটু অন্যরকমই বটে। কারণ আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে ইমন চৌধুরী। অভিভাবক হিসেবে ইমনের নাম থাকায় খুব সহজেই দেখা করতে পেরেছে তারা। মা, বড়ো ভাই আর ইমন তিনজনের নামই অভিভাবক লিস্টে রয়েছে। পারিবারিক সম্পর্কের বেশ অবনতি ঘটলেও অভিভাবক লিস্ট থেকে নাম সরানো হয়নি। মুসকানের বাড়ি’টা শহর থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। আর সে পড়াশোনা করছে শহরে। যে শহরে তার প্রিয়জন রয়েছে সে শহরে পরিবার ছেড়ে থাকতে তার খুব বেশি কষ্ট হয় না। যেহেতু ইমনের বাড়ি শহরের মধ্যেই, সে জবও করে এ শহরেই সেহেতু অভিভাবক হিসেবে তার নাম দিয়ে এত মাস বেশ নিশ্চিন্তই ছিল মুসকানের পরিবার। তবে সে নিশ্চিন্ত মনে এখন ভাঁটা পড়েছে। পাশাপাশি হাঁটছে ইমন, মুসকান৷ হঠাৎ গম্ভীর একটি স্বর শুনল মুসকান। হাঁটা পা দু’টো সহসা থেমে গেল। পাশ ফিরে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। ইমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় বলল,
“মাস্ক খোল।”
আশপাশে চেয়ে মুসকান দেখল মানুষ, জন কমতে শুরু করেছে। সূর্যটাও অস্তমান। নিশ্চিন্ত হয়ে মাস্ক খুলে হ্যান্ডব্যাগে রাখল সে। ইমন আবার চলতে শুরু করল। একটি বসার জায়গায় গিয়ে বসেও পড়ল। মুসকানও তাকে অনুসরণ করে বসার স্থানে গিয়ে বসল। দু’জন মুখোমুখি হয়েই বসেছে। ইমন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। মুসকান নড়েচড়ে বসল৷ ইমন নির্নিমেষ তাকিয়েই প্রশ্ন করল,
“পড়াশোনা কেমন চলছে? ”
“ভালো। ”
“দুপুরে খাবারের মেনুতে কী ছিল? ”
” মুরগির মাংস আর ডাল ভাত।”
“পুরো’টা খেয়েছো? ”
এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মুসকান বলল,
“মাস্ক খুলছো না কেন? ”
ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি’তে তাকিয়ে মাস্ক খুলে বলল,
“প্রশ্নের উত্তর’টা। ”
” তুমি জানো। ”
শব্দ করে একটি নিঃশ্বাস ফেলল ইমন। তবুও দৃষ্টির নড়চড় হলো না। মুসকান অসহায় কন্ঠে বলল,
” আর হবে না। ”
ইমন এ বিষয়ে আর কথা বাড়াল না। সে খুব ভালো করে জানে এই মেয়ে সোজা হবে না। যতদিন না নিজের কাছে নিয়ে আসবে ততদিন এ সমস্যার কোন সমাধান হবে না। মুসকান তাকাল ইমনের দৃঢ় দৃষ্টির পানে। কোমল কন্ঠে শুধাল,
” অনেক তো দেখলে এবার তুমি ঐ পানকৌরি পাখির দিকে তাকাও। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে আর এ সুযোগে আমি তোমায় দেখে নিই। ”
গম্ভীর মুখটা সহসা স্বাভাবিক হয়ে গেল। তবুও দৃষ্টির নড়চড় হলো না। তার বলিষ্ঠ হাতটি বাড়িয়ে মুসকানের ছোট্ট কোমল হাতটি টেনে আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিল। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের উল্টো পিঠে একটি গাঢ় চুম্বন করল। চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে ঠায় বসে রইল মুসকান। ইমন মৃদু হেসে বলল,
” ইউ আর সো এট্রাকটিভ। ইউ আর মাই মুগ্ধময়ী। এই মুগ্ধতা ত্যাগ করা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। পানকৌরির দিকে না হয় অন্যদিন তাকাব। তুমি না হয় অন্যদিন দেখো আমায়। ”
চারিদিকে মাগরিবের আজান ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল। ইমনের হাত থেকে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নিল মুসকান। বলল,
” যেতে হবে আমায়। ”
বক্ষঃস্থলে ধক করে ওঠল ইমনের৷ মেজাজ তপ্ত হয়ে ওঠল খুব। চোয়াল শক্ত করে বলল,
” এভাবে হাত ছাড়ানোর অপরাধে কী শাস্তি হতে পারে জানো? ”
মুখটা শুঁকিয়ে গেল মুসকানের। ইমনের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো করেই জানে সে। তাই ভয়কাতুরে কন্ঠে বলল,
” কী…”
সহসা দাঁড়িয়ে মুসকানের কানের কাছে ওষ্ঠাধর ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বলল,
” আজই বউ করে ঘরে তুলব। কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। না তুমি, না তোমার পরিবার গট ইট।”
আকাশ, মাটি কাঁপিয়ে বাতাস শুরু হলো। সে বাতাসে উলট পালট হতে লাগল মুসকানের উড়না, চুল সহ হৃৎপিণ্ড। সে কাঁপাকাঁপি দেখে বাঁকা হেসে ইমন বলল,
” সে সরি, আর কখনো এভাবে হাত ছাড়াবে না। ”
মুসকান মাথা নিচু করে বলল,
“সরি। ”
ইমন মৃদু হেসে ওর গাল টিপে আদর করল। চোখে’তে চোখ করে মুগ্ধতায় ডুবে গিয়ে বলল,
” ভয় দেখিয়ে নয় স্বস্তি দিয়েই বউ করব তোমায় মুগ্ধময়ী। ”
(সমাপ্ত)