মৃগতৃষ্ণা #সূচনা পর্ব

0
2100

#মৃগতৃষ্ণা
#সূচনা পর্ব
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

পঙ্খির স্বামী আজ দ্বিতীয় বার করে মারা গেল। তাও আবার একই স্বামী। ব্যাপার টা হাস্যকর শোনালেও এমনই কিছু অনাসৃষ্টি ঘটনা ঘটেছে ওর সাথে। প্রথমে মারা যায় যেদিন পঙ্খি বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল লোকটার সাথে। বিয়ের রাতেই এক এক্সিডেন্টে তার গাড়ি নদীতে ডুবে যায়। অনেক খুঁজে লা,শটাও পাওয়া যায় নি সেদিন। সবাই তাকে মৃ,তই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ মাস পর গত দুই দিন পূর্বেই হঠাৎই কোথাথেকে যেন আচমকা প্রকট হয় সে। আর আজ সকালেই বাড়ির বাগানে তার মৃ,তদেহ পাওয়া যায়। গত রাতে কেউ তাকে রহস্যজনক নৃশংস ভাবে হ,ত্যা করে রেখে গেছে।

চেয়ারম্যান সামছুল মজুমদারের বাড়িতে মানুষের যেন ঢল নেমেছে। আপন গ্রাম ছাড়িয়ে আশেপাশের অন্যান্য গ্রাম থেকেও উৎসুক জনতার বৃহত্তর ভীড় জমেছে এই ঘটনার চক্ষুসাক্ষী হেতু। বিশাল উঠোনের মধ্যভাগে লাশ রাখা আছে।তপ্ত রোদের প্রখরতাকে তাচ্ছিল্য করে মানুষ উপচে পড়ছে সামছুল মজুমদারের ছোট পুত্র নাঈম মজুমদারের মৃ,ত লাশ দেখার আগ্রহে।চেয়ারম্যান সাহেব অনেক সম্মানীয় একজন ব্যাক্তিত্ব। অত্র এলাকায় তার একটা প্রতাপ আর দাপট আছে।মানুষ একনামে তাকে মানে গোনে।তাই তিনি চেয়েও এই লোকজনকে কিছু বলতে পারছেনা। এতে তার ব্যাক্তিত্বের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে।লেখিকা-মেহরুৃা নূর। পঙ্খির শাশুড়ী ছেলের শিঁওরে বসে মাটিতে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করে যাচ্ছে। তার সঙ্গ দিচ্ছে পঙ্খির দাদী শাশুড়ী। এতদিন পর ছেলেকে ফিরে পেয়েও আবার হারালেন তিনি। তার ক্ষতটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা কারোর মাঝে নেই।

বাতাবরণ তমসাচ্ছন বিষাদভারাতুর ভারী হয়ে আছে। সবার চোখে এক অব্যক্ত অভিশঙ্কা আর সন্দেহের অস্পষ্ট ছায়া। বেশির ভাগ সন্দিহান দৃষ্টির লক্ষ্য আপাতত পঙ্খি। সাথে অন্য আরেক মানবের ওপরও এই অদৃশ্য সন্দেহের তীক্ষ্ণ তীরের বান চলছে। যে বর্তমানে উঠোনের এককোনায় চেয়ারে বিরাজমান আছে।

বারান্দার এক কোনে মাটিতে খুটির সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে পঙ্খি। অনুভূতি গুলো আপাতত এলোমেলো তার। সামনে মৃত অবস্থায় পরে থাকা স্বামী নামক ব্যাক্তিটার জন্য তার যে খুব একটা শোক হচ্ছে তেমন কিছুই না। কারণ এই লোকটার প্রতি তার কোন অনুভূতিই নেই। যদিও এর যথাযথ কারণও আছে। তবে যতযাই হোক। কোন ব্যাক্তির এভাবে মৃত্যু কখনোই কেউ কামনা করে না। পঙ্খিও তার ব্যাতিক্রম না। কোন মায়ের সন্তান এভাবে মারা গেলে কতটা খারাপ লাগে সেটা একটু হলেও বুঝতে পারছে পঙ্খি। শাশুড়ী জাহানারা কে এভাবে আহাজারি করতে দেখে তার খুব খারাপ লাগছে। সে যতোই জাহানারার কাছে পঙ্খি চক্ষুশূল হোক না কেন। পঙ্খির মনে তার জন্য কোন ক্ষোভ নেই। ছেলে হারা মায়ের কাছে এসব কিছুই না। যদিও আজ পূর্বের ন্যায় তেমন পঙ্খিকে কোন দোষারোপ করছেন না তিনি। তবে পঙ্খির দাদাী শাশুড়ী খোদেজা দমে নেই। আহাজারির নামে সে শুধুমাত্র পঙ্খিকেই দোষারোপ করে যাচ্ছে। অপয়া,মুখপুড়ি, কাল নাগিনীসহ অনুরূপ যত কটুকাটব্য আছে তার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। তারমতে পঙ্খির মতো অপয়া মেয়েকে বউ করে আনায় তার নাতীর এই অকাল মৃত্যু হয়েছে। তার সাথে সায় দিচ্ছে আশেপাশের সব জ্ঞানী গুনীজনরা।

পঙ্খি বরাবরের মতোই নির্বিকার হয়ে বসে রইলো। যেন তার মাঝে ভালো খারাপ লাগার কোন উৎসই নেই। মাঝে মধ্যে তার চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করে। কেন? কেন বিনা কারণে প্রতিবার দোষের আঙুল ওর ওপরই উঠে? সেকি বলেছিল তাকে এবাড়ির বউ করে আনতে? বরং সেতো বিয়েই করতে চেয়েছিল না। তাহলে তাকে কেন দোষারোপ করা হয়? কেউ কি ইচ্ছে করে বিধবা হতে চায়? তাহলে কেন ওকেই বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়? মন চাইলেও সে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না। শুধু নীরব পাথর হয়ে বসে থাকে সে।সবসময় সে এমন ছিলনা। সে ছিল প্রকৃতির অনুরূপ নিসর্গশোভা। ১৭ বসন্ত পার করা এই জীবনে নিজের অস্তিত্ব খুঁজছে পঙ্খি। জীবন অংক মেলাতে ব্যার্থ হচ্ছে বারংবার। চোখের সামনে ভাসছে তার অতিবাহিত জীবনীগ্রন্থের পৃষ্ঠাসমূহ। এইটুকু জীবনকালে কতকিছুই না ঘটলো ওর সাথে। লেখিকা-মেহরুমা নূর।
__

“”” লোকে বলে মানুষের জীবন কাহিনি তার জন্ম থেকেই আরম্ভ হয়। পঙ্খির জীবন শুরু হয় সিরাজগঞ্জ জেলার, উল্লাপাড়া থানার ফুলপুর গ্রামে। ২০০৪ সনের ফাল্গুন মাসের কোন এক রাতে পৃথিবীর আলো দেখে পঙ্খি। জন্মের সাথে যেন ভাগ্যরেখায় হারানোর বরদান নিয়ে আসে পঙ্খি। চার ভাইয়ের পর পঙ্খির জন্ম হয়। তবে একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন তেমন কোন বিশেষ আদর আহ্লাদ বা তেমন কিছুই সে পায়নি। বরং গরীবের সংসারে আরেকটা বাড়তি খাওয়ার মুখ ছাড়া আর কিছুই না। তারওপর আবার মেয়ে। আর মেয়ে হওয়া মানেই যেন মা বাবার জন্য বিশাল বড়ো একটা বোঝা। তবুও সবকিছু ঠিক ঠাকই চলছিল দিনক্ষণ। কিন্তু সেই ঠিক থাকাটাও বেশিদিন গড়ায় না। পঙ্খির তিন বছর বয়সের সময় ওর মা কোন এক অজ্ঞাত অসুখে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর আলো ত্যাগ করেন। ছোট্ট পঙ্খি মাতৃহীন হয়ে যায়। শান্তনা স্বরূপ তখন দাদাী এগিয়ে আসেন। পঙ্খি বড়ো হতে থাকে দাদাীর কাছে। তবে এবার দাদীকেও হারানোর পালা আসে। দশ বছরে পদার্পণ করতেই পঙ্খির দাদী পরলোক গমন করে। পঙ্খির একমাত্র আদরের সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়।লেখিকা-মেহরুমা নূর। এরপর আর কি। পঙ্খি কোনরকমে আদর আহ্লাদের ছাউনি ছাড়াই বড়ো হতে থাকে। বড়ো ভাইয়েরা যার যার মতো বিয়ে করে আলাদা আলাদা সংসার গড়ে নেয়। অসুস্থ বাবা আর পঙ্খি এদের কাছে শুধুই বোঝা। আর ওদের লালনপালনের বিনিময়ে পঙ্খিকে গাধার মতো ভাই ভাবির সংসারে খাটতে হয়। এতো খাটাখাটুনি করে ভাইদের মন যুগিয়ে পঙ্খি ওর পড়াশোনা টা চালিয়ে যায়। দাখিল মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করে একটি সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে কোনরকমে পড়াশোনা করতে থাকে সে।

গ্রামের বাড়ি মেয়ে ষোল পেরুলেই যেন সবার চোখে পড়ে যায়। মনে হয় বিয়ে না হলে বুঝি আর গতি হবে না। তবে পঙ্খির এইদিক থেকে একটা সুবিধা আছে। পঙ্খির বিয়ে নিয়ে তার ভাই ভাবিদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ একেতো ওকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ ফ্রী ফ্রী করাচ্ছে। আর তারচেয়ে বড়ো কথা বিয়ে দিতে হলে টাকার দরকার হয়। আজকাল লাখ লাখ টাকার যৌতুক ছাড়া কোন বিয়ে হয়না। সে যতই মেয়ে সুন্দর বা সুশীল হোক। টাকা ছাড়া বিয়ে নেই। যে যত টাকা দিতে পারবে তার মেয়ের তত ভালো বিয়ে হবে। বাংলাদেশে এই যৌতুকের কুপ্রথা একটা মহামারী ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আর উত্তর অঞ্চলে এটার প্রথা সবচেয়ে বেশি। এই কুপ্রথা কারণেই এখন মানুষ মেয়ে হওয়া দেখে ভয় করে। গরীব ব্যাক্তি ভিটা মাটি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। এই অভিশাপের কারণেই মেয়েরা আজ বোঝা। আর পঙ্খির ভাইদের ওর জন্য এতো টাকা খরচ করার কোন ইচ্ছে নেই। তাইতো তারা এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না। এতে করে পঙ্খির অবশ্য সুবিধাই হয়। সে এখুনি বিয়ে করতে চায়না। পড়ালেখা করে বড়ো কিছু হওয়ার আশা তার।

পঙ্খি কি জানতো বাকি সবকিছুর মতোই তার এই আশাও বিলীন হতে চলেছে। এক দুপুরে কলেজ থেকে ফিরতেই সে জানতে পারে ভাইয়েরা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। চেয়ারম্যান সামছুল মজুমদারের ছেলে নাইম মজুমদারের সাথে। পঙ্খির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে অনেক কান্নাকাটি করে ভাই আর বাবার কাছে আকুতি মিনতি করে বিয়ে না দেয়ার জন্য। কিন্তু ভাইয়েরা মানে না। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। আর অসুস্থ বাবাও কিছু বলে না। এখন যে তাকে ছেলেদের ওপরই ভরসা করতে হয়। অতঃপর পঙ্খি আবারও হেরে যায়। তবে একটা কথা সে ভেবে পায়না। চেয়ারম্যান এর মতো এতো উচ্চ পরিবার তাদের মতো গরীব পরিবারে কেন আত্মীয়তা করতে চায়? আর তার ছেলেই বা কবে দেখলো পঙ্খিকে? পঙ্খি যে গ্রামের সেরা সুন্দরী এমন কিছুও না। বাকি সব সাধারণ মেয়েদের মতোই একজন সে। তাহলে কি এমন দেখলো তারা? আর ওর ভাইয়ারাই বা হঠাৎ এমন বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলো কেন? এতো এতো প্রশ্নের কোন জবাবই পায়না পঙ্খি।তবে এসবের মাঝে যে কোন না কোন অজানা ব্যাপার আছে সেটার আভাস কিছুটা হলেও পাচ্ছে পঙ্খি। অতঃপর হার মেনে তাকে বিয়ের পিড়ীতে বসতে হয়।

এটুকু কি কম ছিল? পঙ্খির ভাগ্যে আরও দূর্দশা নেমে আসে বিয়ের দিনই। বিয়ের সব কার্যক্রম শেষে যখন বাপের বাড়ি ছেড়ে বিদায় নিয়ে আসে তখন গাড়িতে তার স্বামী নাঈম মজুমদার পাশেই বসেছিল।পঙ্খি তখনও তার মুখদর্শন করেনি। কালা না ধলা কিছুই জানে না। কিন্তু মাঝরাস্তা আসতেই হঠাৎ তার স্বামী নাইম মজুমদার গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে। পঙ্খি তখন কি বলবে বুঝতে না পেরে পূর্বের ন্যায় ঘোমটার আড়ালে চুপচাপ বসে রয়। নাইম গাড়ির ড্রাইভারকে বাড়ি চলে যেতে বলে। ড্রাইভারও তার কথামতো একা পঙ্খিকে নিয়েই বাড়ি পৌঁছায়। শশুর বাড়ি পৌঁছে সব রিতীমালা শেষে পঙ্খিকে বাসর ঘরে আনা হয়।সবার কথামতো পঙ্খি ফুলের বাসরে বসে রয় তার স্বামীর অপেক্ষায়। তবে সে আসে না। আসে তার মৃত্যুর খবর। শোনা যায় তার গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট করে নদীতে ডুবে গেছে। পঙ্খির ঠিক ওইমুহূর্তে কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা সে নিজেও জানে না। যে লোকটাকে এপর্যন্ত দেখলই না। তার জন্য যে খুব একটা শোক হয়েছে তেমন না।কারণ তার প্রতি কোন অনুভূতি জন্মই নেইনি। তবে ওর জীবনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য থমকে গিয়েছিল সে।

পঙ্খির জীবন সেদিন থেকে বদলে যায়।লেখিকা-মেহরুমা নূর। সে এই বাড়িতে নাঈম মজুমদারের বিধবা হয়ে দিনযাপন করতে থাকে। সামছুল মজুমদারের কাছে বংশের মান মর্যাদা হলো সর্বোপরি। পঙ্খি এখন তার বাড়ির বউ। এবাবড়ির সম্মান। তাই সম্মান রক্ষার্থে পঙ্খিকে সে ছেলের বিধবা হিসেবে এবাড়িতেই রেখে দেয়। পঙ্খিও এই নিয়ে কোন প্রকার মতভেদ করে না। কারণ তার যাওয়ার যে আর কোন জাইগা নেই। ওর ভাইয়েদের কাছে বোঝা হয়ে ফিরে যাওয়ার চেয়ে এইখানে পড়ে থাকাই শ্রেয় মনে করে। যদিও এখানেও যে শান্তিতে থাকে তা নয়। শাশুড়ী জাহানারা আর দাদী শাশুড়ী খোদেজার কাছে দিনরাত কটুবাক্য শুনতে হয় তাকে। তাদের অনুযায়ী পঙ্খির অশুভ কদমের কারণেই তাদের ছেলের মৃত্যু হয়েছে।এসব ছাড়াও এবাড়িতে আরও অনেক কিছু আছে।তবপ পঙ্খি এসবকিছু প্রশমিত করে যায়। তার যে আর কোন উপায় নেই। সামছুল মজুমদারের কাছে অনেক অনুরোধ করে পড়ালেখা টা কোনরকমে বহাল রাখে সে। তবে শুধু পরিক্ষার সময়ই কলেজে যাওয়ার অনুমতি আছে। পড়ালেখা সব বাড়িতে থেকেই করতে হবে। দরকার হলে গৃহশিক্ষক রেখে দিবে। এটাই সামছুল মজুমদারের শর্ত। কারণ যুবতী বিধবা নারীকে বাড়ির বাইরে থাকার রিস্ক নিতে চাইনা তিনি। তারমতে এতে বংশের মান যেতে পারে। তথাপি পঙ্খি তাতেও রাজি।সে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে এইবা কম কিসে।সে সব শর্তই মেনে নেয়। সেদিন থেকে এই মজুমদার বাড়ির বিশাল আঙ্গিনাই হয়ে যায় পঙ্খির সীমিত দুনিয়া। ব্যাস এভাবেই চলতে থাকে তার বেরঙ জীবন।

পরন্তু পঙ্খি জানতোও না তার জীবনে আবারও নতুন মোড় আসতে চলেছে। যা ওর থমকে থাকা জীবন টাকে তীব্র পবনে এলোমেলো করে দিবে। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here