#মৃগতৃষ্ণা-১০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বিকাল হতেই আকাশের মন ভার। শ্বেত রঙের মেঘগুলো অভিমানে কালো আঁধার হয়ে আছে।কিসের এতো অভিমান তাদের কে জানে? বর্ষাকালে বুঝি তাদের একটু বেশিই মন ভার হয়। অভিমানে ভার হয়ে হয়তো এখুনি কেঁদে কেটে ধরণী ভিজিয়ে দিবে। এমনই ধারণা পঙ্খির। আকাশের এমন অবস্থা দেখে ওদের নৌকা ভ্রমণের সময়কালও কমে আসে। ঘন্টা খানিক অতিক্রম হতেই ইন্ধন আবার ফিরে আসার তাড়া দেয়। বৃষ্টি নামবে এই বলে। এবং হয়ও তাই। কোনমতে বাড়িতে পাড়া দিতেই বড়ো বড়ো ফোঁটার পানির বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। মুহূর্তেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টিরা সারি বেঁধে ধরায় নামে। পঙ্খির সর্বপ্রথম মনে আসে ছাঁদে মেলে দেওয়া কাপড় চোপড়ের কথা। সে পড়িমরি করে দৌড়ায় ছাঁদের দিকে। আসতে আসতেই প্রায় আধো ভেজা হয়ে গেছে কাপড় চোপড়। দ্রুত হাতে সব জড়িয়ে তোলে পঙ্খি।
কাপড় চোপড় নিয়ে ফিরতে নিলেও বাঁধা পায় সে। তার সম্মুখে বাঁধা হয়ে আসে লুবনা, শাপলা আর ছায়া। তারা অতি উৎসাহের সহিত বলে,
–ভাবি চলোনা আজ আমরা একটু বৃষ্টিতে ভিজি। অনেক মজা হবে।
পঙ্খির হৃদয়ও ওদের এই আকুল আবেদনে হৃষ্টচিত্তে সাড়া দিতে চায়।বৃষ্টিতে ভেজা তারও যে অতি মনোরঞ্জিত একটি শখ। তবে সচেতন মস্তিষ্ক তাকে বাঁধা প্রয়োগ করে। এখন যে সে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে পারে না। তাই মলিন হাসির রেখা টেনে বলে,
–না না আমার এসব ভালো লাগে না। তোমরা যাও।
তবে ওরাও ছাড়ার পাত্রী না। পঙ্খিকে সাথে নিয়ে আজ ভিজবে এব্যাপারে ওরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ছায়া পঙ্খির হাত থেকে কাপড় চোপড় গুলো কেঁড়ে নিয়ে ছাঁদের ছোট ঘরটাতে রেখে এলো। তারপর সবাই মিলে পঙ্খির হাত ধরে নিয়ে গেল বৃষ্টির মাঝে। এতক্ষণে বর্ষণ তার চুড়ান্ত রুপ ধারণ করেছে। ছাঁদে পানির ফোঁটারা একাধারে টপাস টপাস শব্দ তুলে বেজে উঠছে।লেখিকা-মেহরুমা নূর। এতক্ষণ বাঁধনের বেড়াজালে নিজেকে বন্দী রাখলেও বৃষ্টির সংস্পর্শে আসতেই ভেতরের অবাধ্য মন নেচে উঠলো পঙ্খির। সব ভুলে দুই হাত ছড়িয়ে নিজেকে মেলে ধরলো বৃষ্টির মাঝে। মুখটা একটু উঁচু করে নেত্রপল্লব নিমীলিত করে নিলো। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝাঁক বেঁধে সন্তর্পণে ভিজিয়ে দিলো পঙ্খির সর্বাঙ্গ। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল তার। আজ কতদিন পর সে বৃষ্টির সাথে খেলছে। পুলকিত হয়ে উঠলো মনটা। মনের আনন্দে ভিজতে লাগলো সে। ভিজে তার খোঁপা খুলে লম্বা দিঘল চুলগুলো পিঠময় লেপ্টে পড়লো।
পঙ্খির সাথে বাকিরাও মহা আনন্দে বৃষ্টিবিলাস করছে। পানির মাঝে নাচছে আর গান গাইছে। ছায়া পঙ্খির হাত ধরে ওকেও নাচের মাঝে সামিল করে নিলো। পঙ্খিও আজ বাঁধন হারা পাখির ন্যায় ওদের সঙ্গ দিচ্ছে। গান গাইতে গাইতে সবাই একসাথে নাচতে লাগলো।
♬ আজ ঝোড়ো ঝোড়ো মুখর বাদল দিনে
♬ জানি নে,জানি নে,কেন যে কিছুতে মনও লাগে না
♬ আজ ঝোড়ো মুখর বাদল দিনে
গান গাইছে আর সারিবদ্ধ হয়ে নাচছে সবাই। আজ অনেক দিন পর নিজেকে একটু হলেও জীবন্ত মনে হচ্ছে পঙ্খির। মনের আনন্দে বৃষ্টি বিলাসে মেতে থাকা পঙ্খি জানলও না তার দাবদাহে কারোর অন্তর্দেশ পুড়ে খার খার হয়ে যাচ্ছে।সেই মানবের রক্তচক্ষু যুগলে অতিব মর্মপীড়া প্রতীয়মান হচ্ছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের রগগুলো ফুলে ফেটে যাবে বোধহয় তার। অন্তরালে চলছে তার তীব্র সংঘর্ষ।
বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা পঙ্খির হঠাৎই নজর গেল ছাঁদের দরজার দিকে। মনে এলো এইমাত্র কোন ছায়া যেন ওখান থেকে সরে গেল। ঘাবড়ে গেল পঙ্খি। তবে কি কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল? কে হতে পারে? সেদিনের সেই লোকটা নাতো? এই ভাবনা মনে হানা দিতেই জড়োসড়ো হয়ে গেল পঙ্খি। গায়ের কাপড় ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে এলো সে। তবে নিচে এসে কাউকেই পেলনা সে। সংকুচিত মনে নিজের কক্ষে চলে গেল।
__
রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসেছে সবাই। পঙ্খি যথারীতি খাবার সার্ভ করছে।বাকি সবার মতো ইন্ধনের প্লেটেও খাবার বেড়ে দিতে গেলেই, ইন্ধন মাথা নিচের দিকে রেখেই হাত উঠিয়ে বললো।
–লাগবেনা, আমি নিজেই নিয়ে নিতে পারবো।
পঙ্খিও কিছু না বলে খাবারের বোলটা ইন্ধনের সামনে রেখে দিলো। তবে ইন্ধনের হঠাৎ এই আচরণ গুলো একটু হলেও পঙ্খিকে ভাবাচ্ছে। আর ইন্ধন যে ওর দিকে একবারের জন্যেও তাকাচ্ছে না এই বিষয় টাও ওর নজর এড়ায়নি।যদিও পঙ্খি ইন্ধনের ব্যাপারে আর কিছু ভাবতে চায়না। লোকটার প্রতি তার মনে ধীরে ধীরে কেমন বিতৃষ্ণা জমে যাচ্ছে।
খাওয়ার মাঝেই সামছুল মজুমদার ইন্ধনের উদ্দেশ্যে বলো উঠলো।
–ইন্ধন,শুনলাম তুমি নাকি আজ বাজারে মারপিট করেছ? সত্যিই নাকি? হয়েছিল কি?
–তেমন কিছুনা চাচা, ওটা এমনই। বদমাইশ ছেলেটার মুখ একটু বেশিই চলে। তাই লিমিট লাগিয়ে দিয়েছি।
–কিন্তু এতে করে লোকের কাছে তোমার ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে। তোমার সাবধানে চলা উচিত। এসব বিরোধী দলের চাল হতে পারে। ভুলে যেওনা তোমার সাথে মজুমদার বংশের নামও জড়িয়ে আছে। তাই যেকোনো কাজ করার আগে ভেবে চিন্তে করবে।
জহির মজুমদার তার ভাইয়ের সাথে সায় দিয়ে বললো।
–হ্যাঁ ইন্ধন ভাই ঠিকই বলেছেন। এতো মাথা গরম করলে চলবে না। তুমি তো প্রায় ছেলেটাকে মেরেই ফেলোছিলে। এইজন্যই আমি তোমাকে শহরে গিয়ে থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমার কথা শুনলেই না।
ইন্ধন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
–আপনার খালি সুযোগের দরকার। কিভাবে আমাকে তাড়াতে পারেন। তবে দুঃখিত আপনার এই মনকামনা পূরণ করতে অক্ষম আমি।
অবস্থা বেগতিক দেখে রাবেয়া তার স্বামীর উদ্দেশ্যে অনুরোধের সুরে বললেন।
–থাক না, খাওয়ার সময় এসব কথা বাদ দেন না। ছেলেটারে একটু খেতে দেন।
জুবায়েদ শুধু মনে মনে সয়তানি হাসলো। তাঁর প্ল্যান যে সফল হয়েছে সেই খুশিতে। ইন্ধনের রাগই ওকে ডুবাবে।
খেতে খেতেই বেখেয়ালিতে ইন্ধনের হাত লেগে তরকারির বোল টা টেবিল থেকে কাত হয়ে নিচে পড়ে যায়।পঙ্খি টেবিলের পাশেই দাঁড়িয়ে খাবার সার্ভ করছিল। যার কারণে তরকারির ঝোল সব ওর জামার ওপর ঢেলে পড়ে। তরকারি দিয়ে জামা মাখামাখি হয়ে যায়। পঙ্খি মনে মনে চরম রাগ হলেও কিছু বলে না সে। জামা ঝেড়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায় চেঞ্জ করতে। একটু পরেই হঠাৎ পঙ্খির রুম চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। পঙ্খির চিৎকার শুনে সবাই হড়বড়িয়ে উঠলো। ঘাবড়ে গিয়ে সবাই খাবার রেখেই পঙ্খির রুমের দিকে দৌড়ালো। শুধু ইন্ধন বাদে। সে পূর্বের ন্যায় ভাবলেশহীন ভাবে খেয়ে যাচ্ছে। যেন এখানে কিছু হয়ইনি। বাকিরা পঙ্খির রুমে এসে দেখলো পঙ্খির আলমারিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পঙ্খি মুখে হাত চেপে আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাবেয়া দ্রুত গিয়ে পঙ্খিকে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসলো। ভয়ে কাঁপছে বেচারি। জহির মজুমদার বাথরুম থেকে দ্রুত পানির বালতি ভরে এনে আগুন নেভাতে লাগলো। সামছুল মজুমদার বলে উঠলেন।
–এসব হলো কি করে? আগুন লাগলো কিভাবে?
পঙ্খি আতঙ্কিত কন্ঠে বললো।
–জানি না বাবা। ঘরে এসেই দেখি আলমারিতে আগুন জ্বলছে।
–কিন্তু সবজায়গা বাদ শুধু আলমারিতেই কেন আগুন লাগলো?
এতক্ষণে আগুন নিভিয়ে ফেলেছে সবাই মিলে। পঙ্খি এগিয়ে গিয়ে দেখলো কতটা পুড়েছে। অবাক করা বিষয় হলো আলমারিতে শুধু পঙ্খির কাপড় গুলোই পুড়েছে। বাকি জিনিসপত্র ঠিক ঠাকই আছে। কিন্তু আগুন লাগলো কিভাবে সেটাই বুঝতে পারছে না ও।এভাবে একা একাই কিভাবে আগুন লেগে যেতে পারে? নাকি কেউ ইচ্ছে করে আগুন লাগিয়েছে? কিন্তু কে করবে এই কাজ? সবকিছু খুবই অদ্ভুত লাগছে পঙ্খির। এখন ও পড়বে কি? সব কাপড় চোপড়ইতো পুড়ে গেছে। আর এই ময়লা পোশাকে কিভাবে থাকবে ও?
বাকিরাও দেখলো পঙ্খির সব কাপড়চোপড় পুড়ে গেছে। ছায়া বলে উঠলো।
–ভাবি তোমার সব কাপড়চোপড় তো পুড়ে গেছে, এখন কি পড়বে তুমি?
পঙ্খির কাছে জবাব নেই। রাবেয়া তখন বলে উঠলো।
–পঙ্খি মা তুমি এক কাজ করো। আপাতত ছায়ার একটা জামা নিয়ে পড়ে নাও। কতক্ষণ আর এভাবে থাকবে? পড়ে নাহয় নতুন জামা কাপড় কিনে আনলে সেগুলো পড়ো।
খোদেজা বেগম খলবল করে উঠে বললো।
–এই সব কি কইতাছ বৌমা? বিধবা ছেড়ি ছায়ার রঙিন কাপড় কেমনে পড়বো?
–কিন্তু আম্মা আপাতত ওর কিছু পড়তে তো হবে। ওর কাছে তো আর কাপড় চোপড় নেই।
সামছুল মজুমদার বলে উঠলেন।
–মা রাবেয়া ঠিকই বলছে। আপাতত মেয়েটার কিছু পড়তে তো হবে। কাল নাহয় কাপড় চোপড় নিয়ে আসলে সেগুলো পড়বে। এখন এতরাতে কোন বাজার খোলা নেই। তাই ছায়ার কাপড় চোপড়ই পড়ুক আপাতত।
সামছুল মজুমদারের কথার পর খোদেজা আর কিছু বললোনা। সবাই চলে গেল রুম থেকে। ছায়া দৌড়ে গিয়ে ওর জামা এনে দিলো পঙ্খিকে। একটু পরে পঙ্খি পোশাক পাল্টে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেকে আজ অন্যরকম লাগছে। রঙিন পোশাকে নিজেকে যেন অনেক দিন পর জীবন্ত সতেজ মনে হচ্ছে। যদিও এর স্থায়ীকাল হয়তো খুবই ক্ষীণ। নতুন পোশাক আসলেই ওকে আবরারও সেই বেরঙ কাপড়ে মুড়তে হবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পঙ্খি বারান্দায় গেল ভেজা কাপড় চোপড় নেড়ে দিতে। কাপড় নেড়ে ফিরতে নিলেই হঠাৎ ওর নজর গেল নিচের বাগানের দিকে।জোছনার আলোয় ভালো করে খেয়াল করে দেখলো কনিকা আবারও সেদিনের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে সেই লোকটির সাথে দেখা করতে গেছে। লোকটা কনিকার হাতে কিছু একটা দিয়ে কি যেন বললো। কনিকা বোধহয় কাঁদছে। লোকটা কনিকাকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পঙ্খি বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। কনিকার জন্য চিন্তা হচ্ছে ওর। ওর মনে হচ্ছে কনিকা ভুল পথে চলে গেছে। এতে করে ওর বিবাহিত জীবন সংকটে পড়তে পারে। কিন্তু ও কি করবে এখন? কারোর ব্যাক্তিগত জীবনে কিছু বলাটাও তো ঠিক না। আবার এভাবে চুপচাপ বসে থেকে সবটা দেখাও তো ঠিক না। কিছুতো করতেই হবে। কনিকা ভাবির সাথে কথা বলতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে জুবায়ের ভাইকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে সে ঠিক করছে না।
___
সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে পঙ্খি। আজ ওর ফুপু শাশুড়ীরা সবাই চলে যাবে। একে একে খাবার টেবিলের দিকে আসলো সবাই। সামছুল মজুমদার বাইরের থেকে ফিরলেন মাত্র। মুখমন্ডল তার কেমন থমথমে হয়ে আছে। সে আসতেই খোদেজা বলে উঠলেন।
–ক্যারে গ্যাদা খালি হাতে আছু ক্যা? তুই ন্যা ওই বিধবা ছেড়ির কাপড় চোপড় নিব্যার গেছুলু? তে কো কাপড় চোপড়?
সামছুল মজুমদার চেয়ার টেনে বসে একটু হাফ ছেড়ে বললেন।
–আর বইলোনা মা। হঠাৎ করে বাজার থেকে সব সাদা পোশাক রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে।কারও দোকানে সাদা রঙের জামা কাপড় নেই। এমনকি সাদা গজের কাপড়ও নেই। হঠাৎ কি হলো আল্লাই জানে। কোথাও খুঁজে পেলাম না।
–কি কস গ্যাদা? সব সাদা কাপড় আবার কেডো নিয়া গেল? তালি এই ছেড়ি এহন কি ফিন্দিবো?
–কি জানি মা বুঝতে পারছি না। আপাতত ছায়ার পোশাকই পড়ুক। আর কি করার? তারপর নাহয় অন্য শহরে গিয়া দেখমু। শরীরটা বেশি ভালো লাগছে না। শরীর ভালো হলে যাবো।
কাজ কাজ করতে পঙ্খি সবই শুনতে পেল। তার রঙিন পোশাকের সময়কাল বাড়ার কথা শুনে ওর একটু ভালোই লাগছে। আরও কিছুদিন তাহলে ও এভাবে থাকতে পারবে। লুবনা আর শাপলা পঙ্খিকে দেখে বললো।
–বাহ্ ভাবি তোমাকে রঙিন পোশাকে অনেক ভালো লাগছে। এখন থেকে এসবই পড়ো। এমনিতেও এখনকার যুগে আর কেউ বিধবা হলে এসব সাদা পোশাক পড়ে থাকে না।
পঙ্খি কিছু বললো না। শুধু জোরপূর্বক মুচকি হাসলো । সবাই চলে এলো খাবার খেতে। ইন্ধনও আসলো ওখানে। পঙ্খি হাতের ট্রে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো ইন্ধন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। পঙ্খি হালকা আচম্বিত হলো। ইন্ধন তো এইকয়দিন ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েও দেখেনি। আর আজ হঠাৎ তাকিয়ে আছে। তাও আবার কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে। লোকটার চাল চলণ কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না পঙ্খির। অতঃপর সে এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে মন দিলো।
জুবায়েদ মজুমদারের কুদৃষ্টি আজ সরছেই না পঙ্খির ওপর থেকে। মেয়েটাকে রঙিন কাপড়ে আরও আকর্ষণীয় লাগছে ওর কাছে। এই পাখিটাকে নিজের একান্ত করে পাওয়ার কামনা ওর বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
কাজ কাম সেড়ে যথাসময়ে তৈরি হয়ে পঙ্খি পরিক্ষার জন্য বের হলো। আজই শেষ পরিক্ষা। এরপর আর হয়তো বাইরে বের হওয়া হবে না ওর। বাড়ির বাইরে রাস্তায় এসে দেখলো সিএনজি এখনো এসে পৌঁছাইনি। দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করতে লাগলো। সামনে একটু দূরে তাকাতেই দেখতে পেল একজন বয়স্ক মহিলা রাস্তার পাশে গাছের নিচে বসে আছে। আর চেয়ারম্যান বাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। এই মহিলাকে আগেও কয়দিন এখানে দেখেছে পঙ্খি। ভেবেছিল হয়তো ভিখারি হবে। কিন্তু তার কাছে তো সাহায্য চাওয়ার কোন ব্যাগ বা পাত্র দেখিনা।আর উনাকে কখনো ভিক্ষা করতেও দেখা যাইনি। তাহলে কে এই মহিলা? আর এখানে কেন এভাবে বসে থাকে? মহিলার সাথে কথা বলতে পঙ্খি তার দিকে এগিয়ে গেল। তবে ওকে যেতে দেখেই মহিলাটি কেমন তাড়াহুড়ো করে উঠে চলে যেতে লাগলো। পঙ্খি পেছন থেকে অনেক বার ডাকলেও সে থামলোনা। মহিলাটির এহেন কাজে পঙ্খির কেমন খটকা লাগলো। মহিলাটি এভাবে চলে গেল কেন? কে উনি? ভাবনার মাঝেই সিএনজি চলে এলো। পঙ্খি সিএনজিতে উঠে রওয়ানা হলো।
__
হাতে একটা খাম নিয়ে বসে আছে কনিকা। চোখ ভিজে আছে তার। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়ংকর এক চিন্তা আহত করে দিচ্ছে ওকে। কি হবে এবার কে জানে? সব ঠিক থাকবে? নাকি সেই ভয়ংকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার? আবারও সেটা হলে কি বেঁচে থাকতে পারবে ও?লেখিকা-মেহরুমা নূর। হঠাৎ দরজায় নক পড়ার শব্দে তড়িঘড়ি করে
খামটা লুকিয়ে ফেললো কনিকা। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে দরজা খুললো সে। দরজার বাইরে পঙ্খিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো।
— পঙ্খি? কিছু বলবে?
–হ্যাঁ ভাবি কিছু কথা ছিলো। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
–হ্যাঁ হ্যাঁ আসোনা।
পঙ্খি ভেতরে এসে বসলো। কনিকাও ওর পাশে এসে বসে বললো।
–বলো কি বলবে?
পঙ্খি কনিকার হাত ধরে নরম সুরে বললো।
–ভাবি আপনার জীবনে কি কোন সমস্যা চলছে যা আপনি কাউকে বলতে পারছেন না?
পঙ্খির কথায় কনিকা একটু থতমত খেয়ে গেল। সে অপ্রস্তুত ভাবে বললো।
–কি বলছ তুমি এসব? আমার আবার কি সমস্যা থাকবে?
–ভাবি দেখুন আমি জানি না আপনি আমাকে কি চোখে দেখেন। তবে আমি প্রথম থেকেই আপনাকে বড়ো বোনের মতোই দেখি। আমার কোন বোন নেই। এবাড়িতে এসে আপনাকে আমার বড়ো বোন হিসেবেই মেনেছি। তাই ছোট বোন হিসেবে বলছি। আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারেন। আপনি যদি মুশকিলে পড়ে থাকেন তাহলে আমাকে বলতে পারেন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করার।
পঙ্খির কথায় কনিকার চোখ ছলছল করে উঠলো। মন চাইলো তার সব মনের লুকায়িত কথাগুলো খুলে বলতে। তবে মস্তিষ্ক তাকে সাবধান করে দিলো এটা করার অধিকার নেই তার। এতে করে ওর সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। তাই জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
–তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ।আমার কোন সমস্যাি নেই। আমি একদম ঠিক আছি তুমি চিন্তা করোনা।
পঙ্খি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে বুঝতে পারলো কনিকা ওকে কিছু বলবেনা। তবুও সে নিজের মতো করে বললো।
–ঠিক আছে ভাবি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন। ক্ষনিকের জন্য অনেক সময় আমরা ভুল পথে চলে যাই। আমরা ভাবি এটাই বোধহয় সঠিক রাস্তা। তবে আসলে সেটা ছিলো শুধুই ভুল সিদ্ধান্ত। যারজন্য পরবর্তীতে শুধু পস্তানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন। আর যদি কখনো মন চাশ আমাকে কিছু বলার তবে নিরদ্বিধায় বলবেন। আপনার ছোট বোন আপনার পাশে থাকবে।
কথাগুলো বলে চলে গেল পঙ্খি। কনিকা শুধু বসে বসে পঙ্খির কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করলো।
চলবে….